বনসীমান্ত
০১.
গ্রামের কাছাকাছি এসে বাদল টের পেল সে আর ছুটতে পারছে না।
পা দুটো ভেঙে আসছে বাদলের, বুকটা হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে আর মাথাটা যেন চরকির মতো ঘুরছে।
তবু নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল সে। প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু গ্রামে ঢোকার মুখে যে মাঠ সেই মাঠের ধারে এসে লুটিয়ে পড়ল সে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
মাঠের ওপারে গ্রামের মসজিদ।
ফজরের নামাজ শেষ করে মাত্র বেরিয়েছেন মির্জা সাহেব। তাঁর সঙ্গে জলিল মোতালেব সোনামিয়া ও তালেব। ছুটতে ছুটিতে মাঠপারে এসে যে একজন মানুষ লুটিয়ে পড়ল এই দৃশ্যটা প্রথমে দেখলেন মির্জা সাহেব। অবাক হয়ে সঙ্গের লোকদের দিকে তাকালেন তিনি। ব্যাপারটা
কী? কে ওইভাবে পড়ে গেল?
ততোক্ষণে অন্যদের চোখেও পড়েছে দৃশ্যটা।
তালেব বলল, চলেন তো দেখি।
চারজন মানুষ পা চালিয়ে বাদলের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বাদলকে দেখে দিশেহারা হয়ে গেল।
মির্জা সাহেব বললেন, আরে এ তো বাদল! আমার ছেলে?
তারপর দুহাতে বাদলকে প্রায় কোলে টেনে নিলেন তিনি। বাদল, বাবা, বাবা, তুই কোত্থেকে এলি? কী হয়েছে?
ততোক্ষণে মাঠপারে ম্যালা লোকজন। মির্জা বাড়ির পুরনো গোমস্তা নবু, দশ বারো বছরের কাজের ছেলে বিলু।
বাদালের মুখের দিকে তাকিয়ে নবু বলল, ভাইয়ে ফিট হইয়া গেছে। একদম ফিট হইয়া গেছে।
মির্জা সাহেব অস্থির গলায় বললেন, কিন্তু বাদল তো ছিল ঢাকায়। সূর্যসেন হলে থাকে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সে এভাবে কোত্থেকে এল?
সোনামিয়া বলল, এইসব কথা পরে বলেন। আগে জলধর ডাক্তাররে খবর দেন।
মির্জা সাহেব বিলুর দিকে তাকালেন। বিলু, তুই যা। তাড়াতাড়ি গিয়া জলধররে নিয়া আয়।
সঙ্গে সঙ্গে জলধর ডাক্তারের বাড়ির দিকে ছুটল বিলু।
জলধরকে নিয়ে বিলু যখন ফিরল বাদলকে ততোক্ষণে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। বড়ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে সে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তার চারপাশে প্রচুর লোকজন। মির্জা সাহেব, তাঁর স্ত্রী বকুল এবং তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়ে খুকি। খুকি এবং বকুল দুজনেই কাঁদছে। বকুল বিলাপের সুরে বলছেন, হায় হায় কী হল আমার ছেলের! বাদল, বাদল!
জলধর ডাক্তার আস্তেধীরে পানির ছিটা দিচ্ছিলেন বাদলের মুখে।
এক সময় চোখ খুলল বাদল। চোখ দুটো টকটকে লাল, এবং সেই চোখে আতংকিত দৃষ্টি। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে সে বলল, আমি কোথায়? এ্যা, কোথায় আমি? কোথায়?
ছেলের মুখের ওপর ঝুঁকে বকুল বললেন, বাড়িতে বাবা। তুমি এখন বাড়িতে।
বাড়িতে এসে পড়েছি?
মির্জা সাহেব বললেন, হ্যাঁ বাবা। বাড়িতে এসে পড়েছ।
এবার মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল বাদল। বাবা, বাবা…
কথা শেষ না করে মায়ের দিকে তাকাল। মা মা, সব শেষ হয়ে গেছে মা। সব শেষ হয়ে গেছে। হলের একটি ছেলেও বেঁচে নেই। যাকে যাকে পেয়েছে সবাইকে গুলি করে মেরেছে। সবাইকে।
বলিস কী?
হ্যাঁ মা। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় লাশ। শুধু লাশ, শুধু লাশ। রাত দুপুরে লাশের ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে সদরঘাট পর্যন্ত এসেছি। তারপর নদী পার হয়ে….।
বাদলের কথা শুনে আতঙ্কিত গলায় জলধর বললেন, সর্বনাশ! ঢাকায় আর্মি নেমে গেছে? কিলিং শুরু হয়ে গেছে?
বাদল বলল, ডাক্তার কাকা, ডাক্তার কাকা, হলের মেয়েদেরকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। রাজারবাগে পুলিশদের সঙ্গে ওদের যুদ্ধ হয়েছে। মানুষ মেরে শেষ করে ফেলেছে ওরা। আমি কোনও রকমে বেঁচে এসেছি।
জলধর চিন্তিত গলায় বললেন, বঙ্গবন্ধুর কথা মতো এখন তাহলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।
.
০২.
বনসীমান্ত গ্রামের স্কুল মাঠ আজ লোকে লোকারণ্য।
মাঠের মাঝখানে লম্বা একখানা বাঁশ পোতা। কিছুদিন আগেও এই বাঁশের মাথায় উঠে যেত পাকিস্তানি পতাকা। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা সার ধরে দাঁড়িয়ে গাইতো ‘পাক ছার জমিন’।
সেই বাঁশের মাথায় বাদল আজ তুলছে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা। এই দৃশ্য দেখতে বনসীমান্তের লোকজন তো বটেই, চারপাশের গ্রামের লোকজনরাও এসে জুটেছে।
বাদলের অদূরে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে পনের বিশজন যুবক। তাদের সঙ্গে কয়েকজন মধ্যবয়সীও আছে। প্রত্যেকের হাতে বাঁশের লাঠি। দূরে ভিড় করে আছে মানুষজন। নবু এবং বিলুও আছে।
পতাকা তোলা শেষ করে পতাকার উদ্দেশে স্যালুট করল বাদল। তার দেখাদেখি সার ধরে দাঁড়ানো যুবকরাও করল।
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো বিলুর খুব ভাল লাগল ব্যাপারটা। সেও বাদলের মতো করে স্যালুট করল পতাকাকে।
.
০৩.
খালেকের চায়ের দোকানে আজকাল ভিড়টা যেন একটু বেশি হয়।
বাজারের তিনটি চায়ের দোকানের মধ্যে তার দোকানে ভিড় বেশি হওয়ার কারণ খালেকের দোকানে একটা ট্রানজিস্টার আছে। মারফি কোম্পানীর লাল রংয়ের ট্রানজিস্টার। যতক্ষণ দোকান খোলা ততোক্ষণ ট্রানজিস্টারটা সে বাজায়। ওই শুনতে গাহাকরা ভিড় করে।
আজ বিকেলে দোকানে বসে ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে খালেক। দোকানে গাহাক আছে ভালই। কিন্তু কে কে আছে না আছে সেদিকে যেন খেয়াল নেই খালেকের।
খালেকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই কি না কে জানে, তালেব বলল, খালেক, তুমি কি আকাশবাণী কলিকাতা ধরতাছ?
খালেক কথা বলল না।
জলিল বলল, রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ধর মিয়া।
এবার জলিলের দিকে তাকাল খালেক। ক্যান?
ঢাকার খবর হইল আসল খবর।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল মোতালেব। কে কইছে তোমারে?
আমি জানি।
তুমি জানো কচু। ঢাকার খবর আসল খবর না। আসল খবর হইল আকাশবাণীর।
তালেব বলল, বিবিসি, ভয়েজ অব আমরিকা, এইসব জাগার খবরও ঠিক।
মোতালেব বলল, হ। রেডিও পাকিস্তানের খবর ঠিক না।
একথার সঙ্গে সঙ্গে মোতালেবকে সাপোর্ট করল সোনামিয়া। হ মাস্টারের কথা ঠিক। মেলেটারিরা যে মানুষ মাইরা সাফা কইরা ফালাইতাছে এই খবর রেডিও পাকিস্তান থিকা কয় না।
খালেক বলল, রেডিও পাকিস্তান থিকা খালি কার্ফুর খবর কয়।
জলিল বলল, ধর না! কার্ফুর খবরই হুনি।
মনে হয় অধিবেশন শেষ হইয়া গেছে।
ট্রানজিস্টার বন্ধ করে দিল খালেক।
তখনই লাঠি ভর দেয়া ভিক্ষুক জমির এসে দোকানের সামনে দাঁড়াল। আল্লার ওয়াস্তে খয়রাত দেন বাবারা।
তালেব খেকুড়ে গলায় বলল, মেলিটারিরা দেশ শেষ কইরা ফালাইতাছে আর তুই চাস খয়রাত? যা ভাগ।
.
০৪.
এই বটগাছটা কতকালের পুরনো কে জানে!
জন্মের পর থেকে বাদল তো এরকম দেখছেই, বাদলের বাবা মির্জা সাহেবও নাকি তাঁর জন্মের পর থেকেও এরকমই দেখছেন। বাদল তার দাদীর মুখে শুনেছিল তার দাদাও নাকি জন্মের পর থেকে এমনই দেখছে গাছটা।
তার মানে কত বছর বয়স হবে এই গাছের?
একশো সোয়াশো বছর!
তবে গাছটি আছে বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, অনেকখানি জায়গা নিয়ে। অনেকখানি জায়গা ছায়াময় করে রেখেছে সে।
আজ দুপুরবেলা এই বটতলায় এসে বসেছে বাদলরা চারজন। বাদল আলমগির সুজন আর মন্টু।
বাদল বলল, একজন অভিজ্ঞ লোক দরকার।
আলমগির বলল, কী ব্যাপারে?
আমাদের ট্রেনিংয়ের জন্য।
সুজন বলল, অর্থাৎ আমাদেরকে ট্রেনিং দেয়াতে পারবে?
হ্যাঁ। আমরা তো আসলে কিছুই জানি না।
ঠিকই বলেছিস। এভাবে কাজ হবে না।
আলমগির বলল, কীভাবে কাজ হবে বাদলের তা জানার কথা।
মন্টু বলল, হ্যাঁ বাদল শিক্ষিত ছেলে।
বাদল বলল, আমি শুনেছি দেশের সব জায়গায় ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। কলকাতা আগরতলা মেলাঘর চলে যাচ্ছে আমাদের বয়সী ছেলেরা। ওসব জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চলছে।
আলমগির বলল, চল তাহলে আমরাও চলে যাই।
আর কয়েকটা দিন দেখি।
সুজন বলল, তাহলে চল এনামুল ভাইকে গিয়ে ধরি। তিনি ইপিআরে ছিলেন। এইসব ট্রেনিং কেমন করে দেয়াতে হয়, জানেন।
শুনে লাফিয়ে উঠল বাদল। ঠিক বলেছিস। চল।
.
০৫.
ক্রাচে ভর দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল এনামুল।
ছফিটের কাছাকাছি লম্বা, দশাসই চেহারা তার। মুখে হাসি বলতে নেই। খুবই গম্ভীর ধরনের মুখ।
বাদলের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার?
উদ্দেশ্যটা বলল বাদল।
শুনে এনামুল বলল, পাটা এমন ভাঙা ভাঙল, চাকরি আর করতে পারলাম না।
কিন্তু জানেন তো সবই।
হ্যাঁ তা জানি।
ট্রেনিং দেওয়াতে পারবেন না?
অবশ্যই পারব।
একথা শুনে চারজনের মুখেই হাসি ফুটল।
আলমগির বলল, খুব খুশি হলাম এনামুল ভাই।
সুজন গভীর উৎসাহের গলায় বলল, তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন।
এনামুল বলল, কিন্তু বাঁশের লাঠিতে তো ট্রেনিং হবে না।
মন্টু হতাশ গলায় বলল, তাহলে?
বন্দুক, রাইফেল এসব জোগাড় কর।
আলমগির বলল, এসব আমরা কোত্থেকে জোগাড় করব?
বাদল বলল, আমি জানি কোত্থেকে জোগাড় করতে হবে।
মন্টু বলল, কোত্থেকে?
দেশের বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র জোগাড় করছে আমাদের বয়সী ছেলেরা।
এনামুল বলল, এছাড়াও একটা পথ আছে।
কী?
নিজ নিজ এলাকার যেসব বাড়িতে বন্দুক আছে সেসব বন্দুক জোগাড় করা।
জ্বী। ঠিকই বলেছেন।
পুলিশ ইপিআরের জোয়ানরা যার যার অস্ত্র কাঁধে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেইসব অস্ত্র দিয়েও ট্রেনিং হচ্ছে।
বাদল দৃঢ় গলায় বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের এলাকার সব বন্দুক আমরা নিয়ে নেব।
আলমগির বলল, দরকার হলে থানা লুট করব আমরা।
এনামুল উফুল্ল গলায় বললেন, সাবাস!
.
০৬.
নিজের বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন জলধর ডাক্তার।
পরনে ধুতি আর হাতাঅলা কোড়াগেঞ্জি। গলার পৈতে একপাশে ঝুলছে। পৈতের সঙ্গে প্রায় ঝুলে পড়েছে তার ভুড়ি।
জলধর ডাক্তারের শরীর বেশ মোটা। অত্যন্ত আমুদে ধরনের লোক তিনি। মুখখানা সব সময়ই হাসি হাসি, উজ্জ্বল। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই উজ্জ্বল মুখ কেমন ম্লান, চিন্তিত। হ্যারিকেনের আলোয় খুবই বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। বুকের কাছে তাঁর ছোট্ট একখানা ট্রানজিস্টার। নীচু ভলিউমে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র শুনছিলেন তিনি। এই মাত্র খবর শেষ হলো। সঙ্গে সঙ্গে ট্রানজিস্টার অফ করলেন তিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
অদূরে জলধরের মুখোমুখি তাঁর বিধবা মেয়ে মাধবির বিছানা। হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসে আছে মাধবি। বাবাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে তাঁর দিকে তাকাল।
জলধর বললেন, না অবস্থা ভাল না।
তা বুঝতে পারছি। ঢাকার খবর কিছু বলল?
ঢাকা শান্ত। তাই নাকি?
হ্যাঁ। ওরা পলিসিটা ধরেছে অন্যরকম। ঢাকায় এখন আর তেমন কিছু করছে না। আর্মি ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। গ্রামে গঞ্জে মফস্বলে।
গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ মারছে।
মাধবি দুঃখি গলায় বলল, মিলিটারিরাও তো মানুষ! মানুষ হয়ে মানুষ এভাবে মারে কী করে?
জলধর বিছানায় উঠে বসলেন। ওরা মানুষ না। মানুষের মতো দেখতে এক প্রকারের জন্তু। বুড়িগঙ্গার ওপারে, কেরানীগঞ্জ, সুভাই, জিঞ্জিরা এসব এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা আক্রান্ত দেখে ভেবেছে নদীর ওপারে নিরাপদ থাকা যাবে। এপ্রিলের দুই। তারিখে, ভোররাতে হঠাৎ জন্তুগুলো সেখানে আক্রমণ চালায়। তিন চারহাজার লোক মেরে ফেলে এক সকালে। মাঠঘাট আর বাড়ির উঠোনে শুধু লাশ, শুধু লাশ।
শুনে বুকটা তোলপাড় করে উঠল মাধবির। সে খুবই নরম মনের মেয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভগবান নিশ্চয় এর বিচার করবে।
ঠিক তখুনি দুম দুম করে শব্দ হলো দরজায়। বাপ মেয়ে দুজনেই চমকাল।
জলধর বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, কে?
বাইরে থেকে শব্দ এলো। আমি। আমি ডাক্তার কাকা?
তুমি কে?
আমি বাদল। দরজা খোলেন।
গলাটা খুবই চেনা চেনা। তবু দরজা খুললেন না জলধর। বললেন, কোন বাদল?
মির্জা সাহেবের ছেলে।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হলেন জলধর। মোটা শরীর নিয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। হাসিমুখে বললেন, তোর গলা আমি চিনতে পারিনি বাবা। কার শরীর খারাপ হলো?
বাদলের হাতে একটা টর্চ। সঙ্গে গ্রামের আরও তিন যুবক। আলমগির সুজন এবং মন্টু। দরজা খোলার পর ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না সবার মুখ।
জলধরের কথা শুনে বাদল হাসিমুখে বলল, কারও শরীর খারাপ হয়নি কাকা।
তাহলে?
অন্য একটা কাজে এসেছি।
আয় ঘরে এসে বস।
না কাকা।
কেন? বসে বল।
তারপর মাথা নীচু করল বাদল। আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি কাকা, আপনি তো জানেনই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। আমরাও আমাদের গ্রামে, স্কুলের মাঠে ট্রেনিং শুরু করেছি।
তা আমি জানি।
এ ব্যাপারে আমাদেরকে একটু সাহায্য করতে হবে যে!
কী সাহায্য বল?
গ্রামে যার যার বন্দুক আছে ….।
বাদলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জলধর বললেন, বন্দুক লাগবে?
জ্বী কাকা?
আমারটা নিয়ে যা। গুলিও আছে অনেক। সেগুলোও নিয়ে যা। তোদের মতো যুবকরাই এখন আমাদের ভরসা। যেমন করে পারিস দেশটাকে বাঁচা।
তারপর মাধবির দিকে তাকালেন জলধর ডাক্তার। মাগো, বন্দুকটা ওদেরকে দিয়ে দে।
বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলল মাধবি।
.
০৭.
সকালবেলা মির্জা সাহেবের কাছারি ঘরে আজকাল বেশ একটা আড্ডা হয়।
আজও হচ্ছে।
গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক এসে বসেছে। এই মাত্র ভেতর বাড়ি থেকে চায়ের ট্রে হাতে নবু এল কাছারি ঘরে। ট্রেতে অনেকগুলো চায়ের কাপ।
চায়ে চুমুক দিয়ে তালেব বলল, মির্জা সাহেব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন না?
মির্জা সাহেব তালেবের দিকে তাকালেন। আমি শুনি সবই।
জলিল বলল, কিন্তু এইসব কইরা কিছু হইব না।
মোতালেব বলল, হবে না কেন?
সোনামিয়া হাসল। আপনে জানেন না মাস্টার সাব? জলিল তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় না।
তালেব বলল, হ। জলিল হইতাছে পকিস্তানের পক্ষের লোক।
মির্জা সাহেব বললেন, যার যে পক্ষ ইচ্ছা সেই পক্ষে থাকবে।
মোতালেব বলল, তবে দুদিন আগে আর পরে, দেশ স্বাধীন হবেই।
সোনামিয়া বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। এই জাতিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
কথাটা শুনে জলিল একেবারে তেড়ে উঠল। আরে রাখেন মিয়া। দাবায়া রাখা যাইব না! পাকিস্তান আর্মি হইতাছে দুনিয়ার সেরা আর্মি। তাগ লগে যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করব এসব দুধের পোলাপান? পাগল হইছেন আপনে?
মোতালেব কথা বলবার আগেই মির্জা সাহেব বললেন, কী যে হবে কিছুই বলা যায় না। কুষ্টিয়ার ওদিকে মুজিবনগর হয়েছে। অস্থায়ী
বাংলাদেশ সরকার গঠন হয়েছে। ওপারে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে ছেলেরা।
জলিল বলল, ওইপারে ক্যান, এই পারেও তো ট্রেনিং নিতাছে। আপনের ছেলে বাদল স্কুলের মাঠে বাংলাদেশের নিশান লাগাইছে। ইপিআরের এনামুল, আরে ওই যে লেংড়া এনামুল, সে পোলাপানগ ট্রেনিং দেওয়াইতাছে।
তালেব বলল, আপনের বন্দুকটা দিয়া দিছেননি মির্জা সাব?
না, ওরা এখনও আমারটা চায়নি।
জলিল বলল, চাইলেও দিবেন না।
মোতালেব বলল, কেন?
চোখ পাকিয়ে মোতালেবের দিকে তাকাল জলিল। সেইটা আপনেরে কমু না। যারে কওনের তারেই কইতাছি। তার লগে আপনেও শোনেন।
তারপর মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল জলিল। বাদলরে আপনে মানা করেন। এইসব ঠিক হইতাছে না। থানায় থানায় মেলিটারি আসতাছে। যদি তারা খবর পায় বনসীমান্ত গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং হইতাছে তাইলে কিন্তু যখন তখন আইসা গ্রাম জ্বালাইয়া দিব। যারে পাইব তারেই গুলি কইরা মারব।
মির্জা সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, কথা ঠিক।
তালেব বলল, আপনে তাইলে …….।
তালেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলে তাকে থামাল জলিল। তুই রাখ, আমি কই। মির্জা সাহেব বনসীমান্ত বাঁচাইতে চাইলে বাদলরে আপনে ফিরান।
জলিলের কথা শুনে মির্জা সাহেব চিন্তিত হয়ে গেলেন।
.
০৮.
স্কুল মাঠে পত পত করে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
তার তলায় ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে আছে এনামুল। অদূরে সবুজ ঘাসের ওপর বন্দুক হাতে ক্রলিং করছে বাদল আলমগির মন্টু সুজন। চারজনের পরনেই প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। গরমে ঘামে শরীর ভিজে জবজব করছে। তবু মুখে কঠিন কঠোর প্রত্যয় যেন প্রত্যেকের।
ঘণ্টাখানেক পর ট্রেনিং শেষ করে এনামুলের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।
এনামুল বলল, তোমরা পারবে।
বাদল বলল, পারতে আমাদেরকে হবেই।
কিন্তু তোমাকে আমার অন্য একটা কথা বলার আছে।
বলুন।
গ্রামে যে এখনও একটা বন্দুক রয়ে গেছে সেটা জোগাড় করনি কেন?
বাদল মাথা নীচু করল। বাবার বন্দুকটার কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
এখনও বাবারটা আমি চাইনি।
কেন?
তেমন কোনও কারণ নেই।
কিন্তু প্রথমেই তো তারটা নেয়া উচিত ছিল।
আলমগির বলল, আসলে বাদল ওর বাবাকে খুব ভয় পায়।
সুজন বলল, বাবার সঙ্গে সরাসরি সেভাবে কথাই বলে না বাদল।
মন্টু বলল, আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি বাদলের যা কিছু দরকার তা ও ওর মাকেই বলে।
এনামুল বলল, বন্দুকটার কথাও তাহলে মাকেই বল।
বাদল আগের মতোই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আলমগির বাদলের দিকে তাকাল। হ্যাঁ মাকেই বল বাদল।
সুজন বলল, এনামুল ভাইর সঙ্গে আমিও একমত। উচিত ছিল। তোদের বাড়ির বন্দুকটাই আগে জোগাড় করা।
এনামুল বলল, এ কদিন আমি তোমাকে ইচ্ছে করেই বলিনি বাদল।
এবার মুখ তুলল বাদল। কেন?
দেখতে চেয়েছি তুমি কী কর।
বাদল লাজুক গলায় বলল, আপনার কথা আমি বুঝেছি।
এনামুল গম্ভীর গলায় বলল, বুঝে থাকলে আর কিছু বলার নেই। আশা করি বন্দুকটা তুমি আজই নিয়ে নেবে।
কিন্তু বাদলের কথা শুনে বকুল গম্ভীর হয়ে গেলেন। তোর বাবাকে এসব কথা আমি বলতে পারব না।
বাদল বলল, কেন?
রাগি মানুষ। আমার ওপর রেগে যাবেন।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা এবং ভাইয়ের কথা শুনছে খুকি। বকুল এবং বাদল কেউ তা খেয়াল করল না।
বাদল বলল, কিন্তু আমি কোনও অন্যায় আবদার করছি না মা।
তা আমি জানি।
গ্রামে যার যার বন্দুক আছে তাদের প্রত্যেকেরটাই আমরা নিয়ে নিয়েছি। এই তো সেদিন ডাক্তার কাকারটা নিয়ে এলাম। চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলেন।
বুঝলাম। তুই তাহলে একটা কাজ কর, নিজে গিয়ে তোর বাবাকে বল।
বাদল বেশ বিরক্ত হলো। ঠিক আছে, আমিই বলব।
খুকির পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাদল।
খুকির মুখটা তখন কী রকম চিন্তিত দেখাচ্ছে। বাদলকে গিয়ে কাছারি ঘরে ঢুকতে দেখল সে। তারপর নিজেও কাছারি ঘরের দিকে পা বাড়াল।
কিন্তু খুকি পৌঁছার আগেই কথাটা মির্জা সাহেবকে বলে ফেলেছে বাদল। খুকি এসে দরজার সামনে দাঁড়াতেই শুনতে পেল মির্জা সাহেব থমথমে গলায় বলছেন, না বন্দুক আমি দেব না।
বাদল বলল, কেন?
পুরো কথাটা শোন। বন্দুক তো আমি দেবই না, তোকে ওসব ট্রেনিং ফ্রেনিংও আর করতে দেব না। এসব তোকে ছাড়তে হবে।
বাদল আবার বলল, কেন?
রাগি চোখে ছেলের দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। কেন মানে? এসব করে কী হবে? এভাবে একটা দেশ স্বাধীন করা যায়?
জীবনে এই প্রথম বাবার মুখের ওপর দৃঢ় গলায় কথা বলল বাদল। এভাবেই দেশ স্বাধীন করা যায়। যখন দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা চায় তখন তাদের স্বাধীনতা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।
দেশের সবাই স্বাধীনতা চায় না।
কে বলেছে আপনাকে।
আমি জানি। পাকিস্তানিদের পক্ষেও কিছু লোক আছে।
তা থাকলেও কিছু যায় আসে না।
মির্জা সাহেব খরচোখে বাদলের দিকে তাকালেন। তোর কথাবার্তা শুনে খুবই অবাক হচ্ছি আমি।
কী রকম?
এই প্রথম দেখছি তুই আমার সঙ্গে তর্ক করছিস।
এটা তর্ক না। সত্য কথা।
থাম। কোন ফাঁকে এরকম বেয়াদব হয়ে উঠেছিস তুই?
আমি কোনও বেয়াদবি করিনি।
অবশ্যই করেছিস। ভালভাবে চাইলে বন্দুকটা তোকে আমি দিয়ে দিতাম।
আমি ভাল ভাবেই চেয়েছি।
তা তুই চাসনি। তুই আমার সঙ্গে তর্ক করেছিস।
বাদল কথা বলল না।
মির্জা সাহেব আগের মতোই রুক্ষ গলায় বললেন, এই যে আমার সঙ্গে তর্কটা করলি, বন্দুকটা এজন্য তোকে আমি দেব না। যা, তুই যা। আমার সামনে থেকে।
বাদল খুবই মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল।
ভাইয়ের জন্য খুকির তখন মনটা কেমন করছে।
.
০৯.
সন্ধেবেলা এনামুলের বাড়ির উঠোনে এসেছে বাদলরা কয়েকজন।
এনামুল বলল, প্রাথমিক ট্রেনিংটা তোমাদের অনেকেরই হয়ে গেছে। এখন অন্যকাজ।
বাদল বলল, কী কাজ?
তিন চারজনের একেকটা করে দল করতে হবে। দু একদিন পর পরই ওরকম একটি দুটি করে দল আগরতলায় পাঠিয়ে দেব। আসল ট্রেনিংটা হবে সেখানে। ফিরে এসেই যুদ্ধ।
প্রথম দলে আমি যেতে চাই।
না।
বাদল চমকাল। কেন?
তোমাদের নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে।
বাদল আলমগির সুজন মন্টু এই চারজন একসঙ্গে তাকাল এনামুলের দিকে।
এনামুল বলল, তোমরা চারজন যাবে একে একে।
আলমগির বলল, কেন?
হাত তুলে তাকে থামাল এনামুল। এত প্রশ্ন করো না। আমার কথা শোন। প্রথমে যাবে মন্টু। তার সঙ্গে আরও তিনটি ছেলে। কারণ কাল থেকে চার পাঁচটা গ্রুপ করে ট্রেনিং দেয়া হবে। আমি তো আছিই। আরেক দলে থাকবে বাদল, আরেক দলে আলমগির, আরেক দলে সুজন। এভাবে ট্রেনিং চলবে।
এনামুলের কথার পর কেউ আর কোনও কথা বলল না।
.
১০.
খুকির মুখে সবই শুনেছেন বকুল।
তখন থেকেই তাঁর মুখটা গম্ভীর।
রাতেরবেলা স্ত্রীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে মির্জা সাহেব বললেন, মুখটা হাড়ির মতো করে রেখেছ কেন?
বকুল গম্ভীর গলায় বললেন, আমার মুখ হাড়ির মতোই।
না আমি জানি কেন এমন করে আছ।
জানোই যখন তাহলে আর কথা বলছ কেন?
তারপর একটু থেমে বলল, ছেলের সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার করা তোমার ঠিক হয়নি।
একথায় মির্জা সাহেবও গম্ভীর হলেন। তোমার ছেলেরও ঠিক হয়নি আমার সঙ্গে তর্ক করা।
কী তর্ক করেছে?
তুমি নিশ্চয় তা শুনেছ।
বকুল কথা বলল না।
মির্জা সাহেব গজগজে গলায় বললেন, লেখাপড়া শিখে বেয়াদব হয়ে গেছে।
আজকালকার ছেলেরা এরকমই।
বলেই চিন্তিত হলেন বকুল। তুমি বাদলের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলে, আমি কিন্তু অন্যরকম একটা ভয় পাচ্ছি।
কিসের ভয়?
বাদল যদি পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়? সেখানে গিয়ে যদি ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করতে আসে? যদি ছেলেটাকে আমরা আর কোনওদিন ফিরে না পাই?
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বকুল।
স্ত্রীর কান্না দেখে মির্জা সাহেব কেমন দমে গেলেন। চিন্তিত গলায় বললেন, এসব আমিও ভেবেছি। ওর বয়েসি ছেলেরা কেউ ঘরে থাকছে না।
তারপরই স্ত্রীর কাঁধে হাত দিলেন মির্জা সাহেব। শোন, বাদলের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। সে তোমার কথা শোনে। তাকে তুমি বোঝাও। সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে বল। দেশ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাদের কোনও লাভ নেই। ছেলে গেলে কিন্তু ছেলে পাবে না।
বকুল কথা বললেন না।
পরদিন সকালবেলা বাদলের ঘরে এসে ঢুকলেন বকুল।
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বেরুচ্ছিল বাদল। মাকে দেখে থামল।
বকুল বললেন, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
পরে বলো। আমি এখন বেরুচ্ছি।
বাদলের হাত ধরলেন বকুল। না, এখুনি বলব।
কী এমন কথা যে এখুনি বলতে হবে?
খুবই জরুরী কথা।
ছেলেকে টেনে এনে বসালেন বকুল। আমার কথা শুনে তারপর বাইরে যাবি।
আচ্ছা বল।
তোকে সব ছেড়ে দিতে হবে।
কথাটা বুঝতে পারল না বাদল। বলল, কী ছেড়ে দিতে হবে?
দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং, সবকিছু।
মায়ের কথা শুনে বাদল একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। আমার মা হয়ে এমন কথা তুমি বলছ?
কেন খারাপ কী বলেছি?
তোমার মতো কত মায়ের সন্তান দেশ বাঁচাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর আমাকে তুমি ঘরে আটকে রাখতে চাও?
বকুল আবদেরে গলায় বললেন, আমি কিছু বুঝি না, কিছু শুনতে চাই না। তুই কোথাও যেতে পারবি না। যদি পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাস তাহলে আমি গলায় দাড়ি দেব।
বাদল আঁতকে উঠল। মা!
বকুল কঠিন গলায় বললেন, যদি দেখতে চাস আমি গলায় দড়ি দিয়েছি,তাহলে যেখানে ইচ্ছে চলে যা। আমার কিছু বলার নেই।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বকুল। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
বাদল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
.
১১.
সকালবেলা বাবা গিয়ে বসেছেন কাছারি ঘরে আর মা ভাইজানের ঘরে। এই সুযোগে মা বাবার ঘরে এসে ঢুকেছে খুকি। আলমারির চাবিটা কোথায় থাকে জানা আছে ওর।
চাবিটা খুকি বের করল।
তারপর সাবধানী চোখে চারদিক তাকিয়ে আলমারি খুলল।
এই আলমারিতেই থাকে বাবার বন্দুক, গুলির ব্যাগ। অতি সাবধানে দুটো জিনিসই বের করল খুকি। তারপর আলমারি তালাবন্ধ করে, চাবি জায়গা মতো রেখে বন্দুক আর গুলির ব্যাগ নিয়ে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরুল।
জিনিস দুটো বয়ে আনতে একটু কষ্ট হলো তার। তবুও ঘুর পথে তাদের বাড়ি থেকে বেরুবার পথের ধারে, বাঁশঝাড় তলায় এসে দাঁড়িয়ে রইল সে।
কিছুক্ষণ পরই এই পথ দিয়ে আনমনা ভঙ্গিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাদল।
খুকি তাকে ডাকল। ভাইজান, দাঁড়াও।
বাদল দাঁড়াল। তুই এখানে কী করছিস।
তারপর বন্দুক দেখে অবাক হলো। এ কী? বন্দুক? বন্দুক কোথায় পেলি?
গুলিও আছে। নাও।
বলে বন্দুক আর গুলির ব্যাগ বাদলের হাতে দিল।
বাদল তখনও অবাক। বাবার বন্দুক, গুলি এসব তুই কীভাবে জোগাড় করলি?
খুকি হাসিমুখে বলল, যেমন করেই হোক করেছি। তুমি নাও।
কিন্তু বাবা জানতে পারলে?
কী করবে? মারবে আমাকে? মারুক।
সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য এক আনন্দে মন ভরে গেল বাদলের। খুকির মাথায় হাত দিল সে। তোর মতো বোন যে দেশে আছে সেই দেশের স্বাধীনতা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
ভাইয়ের কথায় উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরে গেল বোনের।
বন্দুক আর গুলির ব্যাগ হাতে বাদল সোজা চলে এল বটতলায়। এখানে আলমগিররা সবাই আছে।
বন্দুকটা আলমগিরের হাতে দিল বাদল।
আলমগির মুগ্ধ গলায় বলল, শেষ পর্যন্ত তাহলে আনলি?
বাদল লাজুক গলায় বলল, হ্যাঁ।
সুজন বলল, বেশ খানদানি বন্দুক।
বাদল বলল, রাখ এসব। মন্টুরা কখন রওনা দিল তাই বল।
ভোররাতে।
কুমিল্লার ওদিক দিয়েই তো বর্ডার পার হবে, নাকি?
হ্যাঁ।
সুজন বলল, আমার খুব ফূর্তি লাগছে।
কারণ?
কারণ পরের ব্যাচে যাব আমি।
.
১২.
শিরিন বললেন, আর চিন্তা নেই মা। এসে পড়েছি।
মুমূর্ষ ভঙ্গিতে শুয়েছিল যমুনা। একে জ্বর তার ওপর নৌকোর দুলুনি, মাথাটা বন বন করে ঘুরছে তার। তবু নৌকোর ভেতর থেকে বাইরের দিকে তাকাল।
নৌকো ততোক্ষণে খালপারের ঘাট ছুঁয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে মাঝিকে তাড়া দিল যমুনার ছোটমামা বরকত। ব্যাগ সুটকেস তাড়াতাড়ি নামাও।
খালপারে লগি পুতে নৌকো বাঁধল মাঝি। তারপর ব্যাগ সুটকেস নামাতে লাগল।
অকারণেই ঘুরতে ঘুরতে খালপারে এসেছিল বিলু। হঠাৎ ছইঅলা নৌকো এবং অচেনা মানুষজন দেখে নৌকোর কাছে এল সে।
যমুনাকে জড়িয়ে ধরে ততোক্ষণে নৌকো থেকে নেমেছেন শিরিন। বিলু এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। আপনেরা ঢাকা থেকে আসলেন?
শিরিন বলল, হ্যাঁ।
ঢাকার খবর কী?
শিরিনের পেছন থেকে বরকত তাকে একটা ধমক দিল। চুপ কর।
বিলু তার ডাগর চোখ দুটো তুলে বরকতের দিকে তাকাল। ক্যান? কোনও অন্যায় কথা বলছি?
মাঝির ভাড়া দিতে দিতে বরকত বলল, অন্যায় নয় তো কী! এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া, তুই খবরের কী বুঝিস?
জ্বরের ঘোরেও বিলুকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল যমুনা। শ্যামল বরণ মিষ্টি ছেলেটি। মুখখানি কী মায়াবি! চোখ দুটো কী সুন্দর! কথা বলার সময় কী সুন্দর করে হাসে!
শিরিনের দিকে তাকিয়ে বরকত বলল, যমুনার জ্বর কেমন, আপা?
শিরিন বললেন, এখন তেমন জ্বর নেই।
যমুনা মুমূর্ষ গলায় বলল, তবে আবার আসবে।
তা বুঝতে পারছি।
ডাক্তার না দেখালে হবে না।
হ্যাঁ, আজই ডাক্তার দেখাব। এখন তো আর কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ওইটুকু হেঁটে যেতে পারবি মা?
পারব।
বিলু হাসিমুখে যমুনার দিকে তাকাল। কোন বাড়িতে যাবেন আপনারা?
যমুনা কথা বলবার আগেই বরকত বলল, মির্জাবাড়ি।
তারপর দুকাঁধে দুটো ব্যাগ আর হাতে বিশাল সুটকেসটা নিল বরকত। আপা, তুমি যমুনাকে ধরে হাট।
যমুনা বলল, না ধরতে হবে না।
শিরিন মেয়েকে ধরলেন। অবশ্যই ধরতে হবে নয়তো যখন তখন পড়ে যাবি।
কিন্তু মামা অতগুলো লাগেজ একা কীভাবে নেবে?
আমাকে নিয়ে তুই ভাবিস না। আমি পারব?
এই লোকটিকে তেমন পছন্দ হয়নি বিলুর, তবু সে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আপনে একা এতগুলি পারবেন না। আমারে একটা দেন।
বরকত বলল, তুই কি মির্জাবাড়ি চিনিস?
খুব ভাল চিনি। এই গ্রামের সব বাড়িই আমি চিনি। যখন যেই বাড়িতে ইচ্ছা থাকি।
এখন থাকিস কোথায়?
মির্জাবাড়িতেই।
তাহলে তো ভালই। সেই বাড়ি পর্যন্ত এই সুটকেসটা নিতে কত নিবি?
কিছুই নেব না।
যমুনা বলল, কেন?
আমি কুলি না। পয়সার জন্য কাজ করি না। এমনিতেই গ্রামের সবার কাজ করে দিই।
বরকত খুব খুশি হলো। তাহলে তো আরও ভাল।
যমুনা বলল, কিন্তু এতবড় সুটকেস ও পারবে?
বিলু বলল, পারব। তবে মাথায় তুলে দিতে হবে।
তা আমি দিচ্ছি।
বলেই সুটকেসটা বিলুর মাথায় তুলে দিল বরকত।
দৃশ্যটা যমুনার ভাল লাগল না।
.
১৩.
দুপুরবেলাই মির্জা সাহেব টের পেয়ে গেলেন তাঁর বন্দুকটা নেই।
কী কারণে আলমারি খুলেছিলেন, বন্দুক এবং গুলির ব্যাগ না দেখে। সেই কারণটা ভুলে গেলেন। বকুলকে ডেকে বললেন ঘটনাটা।
বকুল ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মির্জা সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে খাটে বসলেন। শেষ পর্যন্ত তোমার ছেলে আমার বন্দুকটা চুরি করল! ছি ছি ছি! ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলে এমন হয়! বাপের বন্দুক চুরি করেছে ছেলে, একথা কাউকে বলা যাবে!
এই ঘরের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল খুকি। বাবার কথা সে শুনতে পেল। পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বাবা, বন্দুকটা ভাইজান চুরি করেনি।
মির্জা সাহেব এবং বকুল দুজনেই খুকির দিকে তাকালেন
মির্জা সাহেব বললেন, তাহলে কে করেছে?
আমি।
কী?
মির্জা সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক গলায় খুকি বলল, হ্যাঁ বাবা, আমি করেছি।
বকুল বললেন, কিন্তু তুই বন্দুক দিয়ে কী করবি?
ভাইজানকে দিয়ে দিয়েছি।
তখুনি বিশাল একখানা সুটকেস মাথায় নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল বিলু। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ও খুকি, খুকি, তোমগ বাড়িতে মেহমান আসছে।
সব ভুলে উঠোনের দিকে তাকাল খুকি।
বিলুর পিছু পিছু তখন তিনজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। তাদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠল খুকি। মা, যমুনা আপা এসেছে। শিরিন ফুফু, বরকত চাচা সবাই এসে পড়েছে।
দৌড়ে উঠোনে চলে এল খুকি।
ঘরের ভেতর বকুল তখন মির্জা সাহেবকে বলছেন, বন্দুক টলুক নিয়ে এখন আর কোনও কথা বল না। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
.
১৪.
যমুনাদেরকে থাকতে দেয়া হয়েছে পুবের ঘরে।
বিকেলবেলা সেই ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে যমুনা। তার মুখে থার্মোমিটার, গায়ে লেপ। অদূরে হাতলঅলা চেয়ারে বসে আছেন জলধর ডাক্তার। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই বাড়ির সবাই। মির্জা সাহেব বকুল বাদল খুকি শিরিন বরকত নবু বিলু।
শিরিন বললেন, জ্বরটা এসেছে ভয়ে। সারাক্ষণ ভয়ে উৎকণ্ঠায় মেয়েটা আমার জড়সড় হয়ে থাকত।
মির্জা সাহেব বললেন, এই বয়সি মেয়ে নিয়ে ঢাকায় এতদিন তুই থাকলি কেন?
বকুল বললেন, তোমার নিজেরও তো কাঁচা বয়েস।
বরকত বলল, আমাদের মোহাম্মদপুর এলাকায় কোনও ঝামেলা নেই।
জলধর বললেন, মানে?
বিহারি এলাকা তো! মিলিটারিদের সঙ্গে বিহারিদের খুব খাতির।
ভাইকে একটা ধমক দিলেন শিরিন। চুপ কর। বিহারিগুলো আরও খচ্চর। ওদের কারণেই বাড়ি থেকে বেরুতে পারিনি। পিস কমিটি, রাজাকার বাহিনী, বদর বাহিনী, কত বাহিনী হয়েছে। একটি বাঙালিকেও ওরা বাঁচিয়ে রাখবে না।
যমুনার মুখ থেকে থার্মোমিটার টেনে নিয়ে, জ্বর দেখতে দেখতে জলধর বললেন, ওই এলাকা থেকে আপনারা তাহলে বেরুলেন কী করে?
মির্জা সাহেব বললেন, ডাক্তার, ওকে তুমি করে বল। আমার ফুফাতো বোন। অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছে।
বিধবা শব্দটা শুনেই মুখখানি মায়াবি হয়ে গেল জলধরের। আমার মাধবির মতো। তবে ভগবানের দয়ায় মাধবির কোনও সন্তানাদি নেই।
শিরিন বললেন, জ্বর কত ডাক্তার বাবু?
এমন কিছু না। একশো এক। অষুদ দিয়ে যাচ্ছি, খাবে। আর একটা দুটোদিন রেস্ট নেবে, তিনদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
ব্যাগ খুলে প্রেসক্রিপসান প্যাড বের করলেন জলধর ডাক্তার। পকেট থেকে খয়েরি রংয়ের মোটা প্রেসিডেন্ট কলম বের করলেন। তারপর খসখস করে কী কী সব লিখলেন। লিখে শিরিনের হাতে দিলেন। এটা ধর। ট্যাবলেট দিচ্ছি।
ব্যাগ থেকে দুপাতা ট্যাবলেট বের করলেন। একটা করে তিনবেলা খাবে। খাওয়ার পর।
কদিন?
পাঁচদিন। ভগবানের দয়ায় পাঁচদিনেই দেখবে একদম ঠিক।
ব্যাগ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন জলধর। আজ আর বসতে পারছি না।
বকুল বলল, কেন দাদা?
সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।
মির্জা সাহেব বললেন, চা খাবে না?
না। আজ খাব না। মেয়েটা একা বাড়িতে।
তারপর শিরিনের দিকে তাকালেন জলধর। কাল এক সময় এসে তোমার যমুনাকে একবার দেখে যাব। কীভাবে ঢাকা থেকে বেরুলে সেই ঘটনাও শুনে যাব।
বিলু এগিয়ে এসে জলধর ডাক্তারের ব্যাগটা ধরল। ব্যাগটা আমার হাতে দেন। আমি দিয়াসি।
বিলুকে দেখে কেমন যেন খুশি হলেন জলধর। কী রে বিলু, তুই এখন থাকিস কোথায়?
বিলু লাজুক গলায় বলল, এই বাড়িতেই।
মির্জা সাহেব বললেন, ওর যখন যে বাড়িতে ভাল লাগে, থাকে। এখন আমার বাড়িতে আছে দুদিন পর দেখবে তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
তাহলে তো ভালই হয়। মেয়েটা একা থাকে। বিলু থাকলে তার একটা সঙ্গী হয়। আগে মেয়েটা একা বাড়িতে থাকত, ভয় পেতাম না, আজকাল ভয় লাগে।
বকুল বললেন, লাগবার কথাই।
মির্জা সাহেব বললেন, বিলু তাহলে আজ থেকে তোমার বাড়িতেই থাক।
তারপর বিলুর দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। কী বলিস বিলু?
বিলু মাথা নীচু করে বলল, ঠিক আছে।
.
১৫.
মুখে কোনো একখানা হাসি দিয়ে জলিল বলল, একখানা প্রস্তাব নিয়া আসছি মির্জা সাহেব।
মির্জা সাহেবও হাসলেন। বিবাহের প্রস্তাব?
আরে না।
তালেব বলল, এই বয়েসে আপনে আবার বিবাহ করবেন নাকি?
মির্জা সাহেব বললেন, তোমাকে এতকাল ছাগল হিসাবে জানতাম, ছাগল থেকে রামছাগল হয়েছ কবে?
তালেব একেবারে নিভে গেল।
মির্জা সাহেব বললেন, নিজের কথা বলছি না। বিবাহের উপযুক্ত ছেলে আছে আমার।
জলিল বলল, বাদ দেন ওইসব কথা। বিবাহের ব্যাপার না।
তবে?
ব্যাপার হইতাছে পূর্ব পাকিস্তান।
বুঝলাম।
পূর্ব পাকিস্তানটারে আমরা বাঁচাইতে চাই।
তোমরা মানে?
জলিল তালেবের দিকে তাকাল। তালেব তুই ক।
তালেব ছোট্ট করে গলা খাকারি দিল। আমরা, মানে মেলেটারি সাহেবরা, সাহেবগ লগে পূর্ব পাকিস্তানের যিনারা আছেন তিনারা….।
তালেবকে থামাল জলিল। এইবার তুই থাম। আমি কই।
মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল জলিল। থানায় থানায়, ইউনিয়নে ইউনিয়নে পিস কমিটি হইতাছে, রাজাকার বাহিনী হইতাছে। আমাগ ইউনিয়নের চেরম্যান সাবের কাছে প্রস্তাব আসছে…..।
জলিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মির্জা সাহেব বললেন, এসবের মধ্যে আমি নেই।
তালেব বলল, আগে কথাটা শোনেন। চেরম্যান সাব আমগ ইউনিয়নের পিস কমিটিরও চেরম্যান হইছে।
জলিল বলল, আর আমি আর তালেব ভর্তি হইতাছি রাজাকারে। রাজাকারের কমান্ডার হমু। তালেব, ক।
তালেব বলল, চেরম্যান সাবে চায়, আপনে তার লগে থাকেন। সে চেরম্যান আপনে মেম্বর।
জলিল বলল, আর বিদ্যান পোলাডারে সামলান। তারে বলেন টেরনিং বন্দুক জয়বাংলা এইসব য্যান ছাইড়া দেয়। নাইলে…..।
চোখ তুলে জলিলের দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। নইলে?
অসুবিধা আছে আর কী?
মির্জা সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।
তালেব এবং জলিল উঠে দাঁড়াল।
জলিল বলল, আর একখান কথা।
কী?
কোনও মোসলমানরে মেলেটারি সাবরা আর মারব না। বাইছা বাইছা খালি হিন্দুগুলিরে মারব।
জলিলরা বেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ চুপচাপ কাছারি ঘরে বসে রইলেন মির্জা সাহেব।
.
১৬.
রুগি দেইখা ফিরলেন ডাক্তার বাবু?
জলধর ডাক্তারের হাতে ডাক্তারি ব্যাগ, গলায় স্টেথিসকোপ। পরনে ধুতির ওপর ঝুল পকেটঅলা শার্ট। ধুতি এবং শার্ট দুটোই সাদা। পায়ে কালো পামসু আছে। চৌধুরী বাড়ির লাগোয়া পায়ে চলা পথে কিছুটা উদাস ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন তিনি। তালেবকে খেয়াল করেননি। তার কথায় থতমত খেয়ে থামলেন। হ্যাঁ।
তারপর তালেবের সঙ্গে জলিলকেও দেখতে পেলেন। হাসিমুখে বললেন, তোমরা কোত্থেকে?
তালেব কথা বলবার আগেই জলিল বলল, তুই থাম। আমি কই।
তালেব এবং জলিল দুজনকেই আজ অন্যরকম লাগছে। কী রকম মাতাব্বর ভাব দুজনের মাতাব্বর চেহারায় কাউকে তোয়াক্কা না করার ভঙ্গি। অথচ এই দুজন গ্রামের অতি নিম্নস্তরের মানুষ। আজকাল তেমন কিছু করে না। বাজারের চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় আর এর ওর
পয়সায় চা খায়। গ্রামের মানুষের কাছে ছ্যাচড়া হিসেবে পরিচিত।
সেই ছ্যাচড়া দুটো কোন ফাঁকে এমন বদলে গেছে!
জলধর যখন এসব ভাবছেন তখন জলিল বলল, এখন আমরা বড় বড় কাজে ঘুইরা বেড়াইতাছি, বোঝলেন ডাক্তার সাব?
জলধর হাসলেন, কী রকম বড় কাজ?
দ্যাশের কাজ আর কি। পাকিস্তানের কাজ। পূর্ব পাকিস্তানটারে বাচাইতে হইব।
জলধর একটু থতমত খেলেন। এই ধরনের কথা গ্রামের কারও মুখে কখনও শোনেন নি তিনি। অবাক গলায় বললেন, আচ্ছা।
সঙ্গে সঙ্গে কেমন খেঁকিয়ে উঠল জলিল। আইচ্ছা আইচ্ছা কইরেন না। আপনে অনেক বিপদ।
বিপদ কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে চমকালেন জলধর। বললেন, কী রকম বিপদ?
মেলেটারি সাবেরা একটা হিন্দুও এই দেশে রাখব না।
কী করবে?
এই কথাটার জবাব দিল তালেব। কী আর করব? মাইরা ফালাইব।
বল কী?
হ।
তুমি খবর পেয়েছ?
জলিল বলল, হ পাইছি। আমরা খবর না নিয়া কথা বলি না।
তারপর তালেবের দিকে তাকাল সে। তালেব তুই ক।
তালেব বলল, কী কমু?
ও তুই তো আবার জান না। ঠিক আছে আমিই কই। শোনেন ডাক্তার দাদা, পূর্ব পাকিস্তানে থাকলে বাঁচতে আপনেরা আর পারবেন না।
জলধর অসহায় গলায় বললেন, তাহলে কী করব?
চইলা যান। বাঁচতে চাইলে চইলা যান।
কোথায়?
আর কোথায়? কইলকাত্তা। বেবাক হিন্দুরা যেখানে যায়।
জলধর আর কথা বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।
জলধর চলে যাওয়ার পর তালেবের দিকে তাকাল জলিল। ক তো। ডাক্তাররে চইলা যাইতে কইলাম কেন?
তালেব বলল, জানি না।
সে চইলা গেলেই বাড়িটা আমি দখল করুম। আমার বহুতদিনের শখ আমি একটা হিন্দুবাড়ি দখল করি। এইবার চান্সটা পাইছি।
.
১৭.
‘জয় বাংলা, বাংলার
জয়
হবে হবে হবে
হবে নিশ্চয়’
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এই গান হচ্ছে। নিজের হাতলঅলা চেয়ারে বসে গান শুনছেন জলধর ডাক্তার। বাবার বিছানা গুছাচ্ছিল মাধবি। হ্যারিকেনের আলোয় মুখটা কেমন অসহায় দেখাচ্ছে তাঁর।
হঠাৎ জলধর বললেন, বাংলার জয় একদিন হবেই কিন্তু আমরা মনে হয় বাঁচব না।
মাধবি চমকাল। কেন বাবা?
বললে তুই খুব ভয় পাবি মা।
তবু বল। না বললে আমি অস্বস্তিতে থাকব।
জলধর হতাশ গলায় বললেন, দেশের একজন হিন্দুকেও বাঁচিয়ে রাখবে না ওরা।
শুনে আঁতকে উঠল মাধবি। মানে?
যেখানে যত হিন্দু আছে বেছে বেছে মেরে ফেলবে। প্রত্যেক থানায়, প্রত্যেক গ্রামে হিন্দু খুঁজতে শুরু করেছে।
তাহলে?
কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ জলিল এবং তালেব এইসব কথাই বলল।
হাতের কাজ শেষ না করেই জলধরের পাশে এসে দাঁড়াল মাধবি। বাবার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে বাবা।
ভয়ের কথাই।
চল আমরা তাহলে কলকাতা চলে যাই।
চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জলধর। এতদিনকার বসতবাড়ি, গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, আমার বাঁধারোগি সব ছেড়ে চলে যেতে বলিস?
এছাড়া কী করব, বলো? বাঁচতে তো হবে। তবে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। স্বাধীন হলে আবার ফিরে আসব।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব। তালেব এবং জলিলের কথায় আমি অবশ্য তেমন কিছু ভাবিনি। ওরা বদলোক। আমি ভালই চিনি ওদেরকে। কোন মতলবে কথাটা ওরা বলেছে তাও বুঝেছি। তবে মিলিটারিরা যে হিন্দু পেলেই মারছে এটা সত্য।
কিন্তু একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে।
কী সিদ্ধান্ত নেব বুঝে উঠতে পারছি না।
হঠাৎ করেই যেন কিছু একটা মনে পড়ল মাধবির। উৎফুল্ল গলায় বলল, তুমি একটা কাজ কর বাবা, মির্জা কাকার সঙ্গে কথা বলে দেখ। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তিনি যা বলবেন তাই করব আমরা। তিনি সাহস দিলে থাকব, না হয় চলে যাব।
পরদিন সকালবেলাই মির্জা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন জলধর। সব শুনে চিন্তিত গলায় মির্জা সাহেব বললেন, ভরসা আমি তোমাকে দিতে পারছি না ডাক্তার। দেশের অবস্থা তুমি আমি সবাই জানি। এই অবস্থায় কে কাকে ভরসা দেবে বল?
জলধর প্রচণ্ড হতাশ হলেন। তার মানে তুমিও চলে যাওয়ার কথাই বলছ?
ভেবে দেখ?
জলধর ফাঁকা শূন্য গলায় বললেন, মা হারা মেয়েটাকে নিয়ে ছিলাম। মেয়েটাকে একা বাড়িতে রেখে রোগি দেখতে যেতাম। মনে হতো চারপাশের সবাই আপন। সবাই মেয়েটাকে আমার দেখে রাখবে। দেখে রেখেছেও। কোনও অনিষ্ট আমার মেয়ের হয়নি।
মির্জা সাহেব বললেন, এখন সেই ভয়ও আছে। চেয়ারম্যান সাহেব পিস কমিটি করেছেন, জলিল তালেবরা হচ্ছে রাজাকার। মিলিটারিদের সঙ্গে ডাইরেক্ট যোগাযোগ। ঘরের ইঁদুরে যদি বাঁধ কাটে তখন আর কিছু করার থাকে না।
জলধরের কাঁধে হাত দিলেন মির্জা সাহেব। জলধর, তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধু। তুমি কোনও রিসক নিও না। মেয়ে নিয়ে চলেই যাও।
যাবই বা কেমন করে? পথেও তো কত বিপদ!
তবুও যাও। মালপত্র তেমন কিছু নেবে না। দুজনে সামান্য দুটো ব্যাগ নিয়ে রওনা দেবে। আমি শুনেছি কুষ্টিয়ার ওদিক দিয়ে বর্ডার পার হচ্ছে হাজার হাজার লোক।
মির্জা সাহেবের মুখের দিকে তাকালেন জলধর ডাক্তার। তুমি যখন বলছ, ওই পথেই যাব।
তারপর মির্জা সাহেবের একটা হাত জড়িয়ে ধরলেন জলধর ডাক্তার। গভীর আবেগে বললেন, এই জীবনে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কী না জানি না। তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। মনে হয় না কখনও কোনও দুঃখ তোমাকে আমি দিয়েছি। তবু নিজের অজান্তে যদি কখনও দিয়ে থাকি, বন্ধু, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
সঙ্গে সঙ্গে জলধরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মির্জা সাহেব। দুই ধর্মের দুজন বয়স্ক মানুষ তারপর শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
.
১৮.
জ্বর ছেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু দুর্বলতা কাটেনি যমুনার।
ঘর থেকে একেবারেই বেরয় না সে। সারাক্ষণই শুয়ে থাকে। ছোট্ট শিশুকে যেভাবে ধরে ধরে খাওয়ান মা ঠিক সেইভাবে তাকে খাইয়ে দেন শিরিন।
আজ সকালেও যমুনাকে সেভাবে খাইয়ে দিচ্ছিলেন শিরিন।
শিরিনের হাতে এক পেয়ালা দুধ আর দুখানা চালের রুটি। একটা রুটির অর্ধেকটা আর সামান্য দুধ খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল যমুনা। আর খাব না মা।
শিরিন অবাক হলেন। কেন?
ভাল লাগছে না।
জ্বর থেকে ওঠার পর খেতে কারই ভাল লাগে না। তবুও খেতে হয়। জোর করে খেতে হয়।
কিন্তু আমি পারছি না। মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে।
জ্বরের পর মুখ এমন হয়।
আবার শরীরও কেমন গুলাচ্ছে।
বমি বমি লাগছে?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আর একটু খেলেই বমি করে ফেলব।
হাতের খাবার সরিয়ে নিলেন শিরিন। তাহলে আর খাওয়ার দরকার নেই।
এসময় এই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল বাদল।
প্রথমে যমুনার দিকে তাকাল সে। তারপর তাকাল শিরিনের দিকে। জ্বর এখন কেমন?
শিরিন বললেন, জ্বর নেই, তবে শরীর খুব দুর্বল।
জ্বর হলে শরীর দুর্বল হবেই। দু চারদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর যমুনার দিকে তাকাল বাদল। হাসিমুখে বলল, জোর করে ওঠার চেষ্টা কর। হাঁটাচলার চেষ্টা কর। দেখবে তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে গেছ।
যমুনা তখন কী রকম অবাক চোখে বাদলের দিকে তাকিয়ে আছে।
সেদিন বিকেলেই যমুনার সঙ্গে আবার দেখা হলো বাদলের।
মাঠের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছে যমুনা, বাদল এসে তার সামনে দাঁড়াল। তুমি তাহলে আমার কথা শোন!
বাদলের মুখের দিকে তাকাল যমুনা। আপনি কী বলেছেন যে আমি শুনেছি?
সকালবেলা বললাম উঠে হাঁটাচলা কর আর বিকেলবেলাই হাঁটাচলা করছ!
সেটা আপনার কথায়ই যে করছি তা আপনি বুঝলেন কী করে?
আমার মনে হলো।
অনেক ভুল কিছুও মানুষের মনে হয়।
তা হয়।
আচ্ছা আপনি কি সকালবেলা আমাকে খেয়াল করে দেখেছেন?
অবশ্যই।
আপনার দিকে যে আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তা কি আপনি দেখেছেন?
দেখেছি।
কেন তাকিয়ে ছিলাম বলুন তো?
জানি না।
দেশের এই অবস্থায় ইউনিভার্সিটি পড়া কোনও ছেলে যে বাড়ি বসে থাকে, এই ভেবে।
বাদল একটু থতমত খেল। তারপর হাসল। বসে থাকিনি তো!
তাহলে কী করছেন?
দেশের কাজ করছি।
কী কাজ?
আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ অর্গানাইজ করছি। প্রাথমিক ট্রেনিংটা নিয়েছি। একেকটা গ্রুপ করে ইন্ডিয়া পাঠাচ্ছি।
একথা শুনে যমুনার জ্বরক্লান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সত্যি?
দেশ নিয়ে কি আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলব!
না তা নয়।
তবে তোমাকে আমার খুব ভাল লাগল।
যমুনা একটু চমকাল। মানে?
মানে দেশ নিয়ে তোমার ফিলিংসটা জেনে ভাল লাগল।
যমুনা হাসল। তাই বলুন।
চল কোথাও বসি।
চলুন।
মাঠের ধারে অনেকগুলো খড়ের গাদা। বিকেলে রোদ খড়ের গাদার মাথার ওপর উঠে গেছে। তলার দিকটায় ছায়া। এখানটায় এসে বসল ওরা দুজন।
এই দৃশ্যটা দেখে ফেললেন মির্জা সাহেব।
আছড়ের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন তিনি, খড়ের গাদার ছায়ায় বাদল এবং যমুনাকে দেখতে পেলেন। দেখে চোখে মুখে সামান্য একটা চিন্তা খেলে গেল তার।
তবে বাদল কিংবা যমুনা কেউ মির্জা সাহেবকে দেখতে পেল না।
যমুনা বলল, আপনি এভাবে কাজে করছেন, জেনে ভাল লাগল।
বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, কাল সকালেই আমাদের আর একটা ব্যাচ চলে যাবে।
আপনি যাবেন কবে?
বাদল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার বোধহয় যাওয়া হবে না।
কেন?
মায়ের জন্য।
তিনি কী করেছেন?
মায়ের কথাগুলো যমুনাকে বলল বাদল।
শুনে যমুনা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। এটা কোনও কথা হলো?
তবুও শেষ চেষ্টা আমি করব।
কীভাবে?
মাকে বোঝাব, তুমি যেমন আমার মা, দেশও তোমার মতো আরেক মা আমার। এক মায়ের কারণে আরেক মাকে আমি রক্ষা করব না!
বাদলের কথা শুনে কী যে ভাল লাগল যমুনার! একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। অপলক চোখে বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
বাদল বলল, কী হলো?
না কিছু না।
তারপর যমুনা বলল, আপনার কথা শুনে নিজের জন্য আমার খুব দুঃখ হচ্ছে।
কেন?
ছেলে হলে, মানে মেয়ে না হয়ে যদি ছেলে হতাম, ঘরে আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারত না। দেশের জন্য দরকার হলে জীবন দিয়ে দিতাম আমি।
বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, তোমার এই ফিলিংসটাই যথেষ্ট। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ সবাইকে করতে হয় না। তোমার মতো দেশাত্মবোধ যাদের আছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা।
তারপর একটু থেমে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?
আবার আগের মতো অপলক চোখে বাদলের দিকে তাকাল যমুনা। যে কোনও কথাই আপনি আমাকে বলতে পারেন।
তোমার নামটা আমার খুব ভাল লাগে। নদীর নামে নাম।
হ্যাঁ। শুধু নদী নয়, বাংলার বিখ্যাত নদী। আমার একটা প্রিয় শ্লোগান হচ্ছে,
‘তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা’
যমুনা তখনও আগের মতোই চোখ করে তাকিয়ে আছে বাদলের দিকে। .
.
১৯.
কথাটা শুনে বকুল একেবারে আঁতকে উঠলেন। বল কী?
মির্জা সাহেব তার স্বভাব সুলভ গম্ভীর গলায় বললেন, আঁতকে উঠবার কিছু নেই। সত্য কথাই বলছি।
তাতো বুঝেছিই। তুমি কি আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলবে?
মির্জা সাহেব হাসলেন। তবে ব্যাপারটা আমার অপছন্দ হয়নি।
কী?
মির্জা সাহেব মাথা নাড়লেন।
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
না বোঝার কিছু নেই। যমুনা সুন্দরী মেয়ে। ওদের বংশও ভাল। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। সবচে বড় কথা, বাদলের সঙ্গে ওকে খুব মানায়।
তার মানে তুমি কি ওদের বিয়ের কথা ভাবছ?
তবে কী?
দেশের এই অবস্থায় ছেলের বিয়ে?
এই অবস্থা বলেই তো বিয়ের কথা ভাবছি।
এবার বকুল কী রকম বিরক্ত হলেন। তুমি বড় প্যাচিয়ে কথা বল, কিছুই বুঝতে পারি না।
মির্জা সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন। শোন, তুমি যদি সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দাও তবুও তোমার ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যাবে।
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। এতদিন চলেও যেত।
তাহলে যায়নি কেন?
কেন যায়নি, আমি জেনে গেছি।
বল তো আমাকে।
ওর সঙ্গে যারা ছিল, সুজন মন্টু ওদেরকে গ্রামে দেখ?
না।
কেন দেখ না বল তো?
জানি না।
ওরা চলে গেছে।
মুক্তিবাহিনীতে চলে গেছে? ইন্ডিয়াতে?
হ্যাঁ। আর মাত্র কয়েকদিন, তোমার ছেলেও যাবে।
এজন্য বিয়ে করিয়ে দিতে চাও?
কারেক্ট।
বকুল হাসল। বুদ্ধিটা খারাপ না।
মির্জা সাহেব বললেন, বিয়ে দিয়ে যমুনাকে বলব, বাদলকে ধরে রাখ।
আমি যদি না পারি, যমুনা কি পরবে?
পারবে।
কী করে বুঝলে?
পুরুষমানুষরা এরকমই। মার কথা ফেললেও বউর কথা ফেলে না।
তুমি তাহলে শিরিনের সঙ্গে কথা বল।
দুচার দিনের মধ্যেই বলব।
.
২০.
বনসীমান্ত গ্রামের খালপারে আজ ভোরবেলা একখানা ছইঅলা নৌকো বাঁধা।
নৌকোয় মাঝারি সাইজের দুখানা হাত কিংবা কাঁধব্যাগ। কিছুক্ষণ আগে জলধর ডাক্তারের বাড়ি থেকে ব্যাগ দুটো বয়ে এনে নৌকোয় তুলেছে বিলু। তুলে আর ফিরে যায়নি। খালপারেই দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পরই জলধর ডাক্তার এবং মাধবি এলো খালপারে।
জলধরের পরনে আজ ধুতি নেই। পাজামা এবং পাঞ্জাবী পরেছেন। তিনি। মাধবির পরনে সাদাশাড়ি। তবে পাড় নেই শাড়ির।
খালপারে এসেই মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগল মাধবি।
ততোক্ষণে বাদল এবং আলমগিরও এসেছে খালপারে।
মাধবিকে কাঁদতে দেখে বাদল তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁদছ কেন দিদি?
কথাটা সে বলল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ দুটোও ছলছল করতে লাগল। গলা বুজে এল উদগত কান্নায়।
তবু মাধবিকে সে সান্ত্বনা দিতে লাগল। দিদি, দিদি এভাবে কেঁদ না। কেঁদ না। দেশ নিশ্চয় স্বাধীন হয়ে যাবে। নিশ্চয় তোমরা আবার ফিরে আসবে।
আলমগির বলল, স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমানের কোনও ব্যবধান থাকবে না।
জলধরও তখন দুহাতে চোখ মুছছেন।
মাধবিকে রেখে বাদল গিয়ে দাঁড়াল জলধর ডাক্তারের সামনে। আপনিও ছেলেমানুষি করছেন ডাক্তার কাকা?
জলধর নিজেকে সামলালেন। বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন। তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই বাদল।
জ্বী বলেন কাকা।
ভগবানের দয়ায় কখনও যদি ফিরে আসি তো এলাম, যদি না আসি, আমার বড়িটা তুই বিলুকে দিয়ে দিস বাবা।
আচ্ছা কাকা।
বিলুটা অনাথ ছেলে, ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার বাড়িতে জীবনভর যেন ও থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা তুই করে দিস বাবা।
জলধরের কথা শুনে বিলু তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
জলধর ডাক্তার বিলুর মাথায় হাত বুলালেন। কাঁদিস না বিলু, কাঁদিস না।
এই অবস্থায় জলধরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল বিলু।
তারপর গেল মাধবিকে সালাম করতে। পাগলের মতো দুহাত বিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরল মাধবি। দুজন মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে গেল খালপারের বাতাস।
.
২১.
মির্জা সাহেবের কথা শুনে শিরিন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। কী বলছেন ভাইজান?
মির্জা সাহেব বললেন, ঠিকই বলছি।
এই অবস্থায় বিয়ে?
অবস্থার কথা ভেবে লাভ নেই। আমার ছেলেকে তোর পছন্দ কিনা তাই বল।
শিরিন আনমনা গলায় বললেন, বাদলের মতো ছেলেকে কে অপছন্দ করবে?
শিরিনের কথা শুনে মির্জা সাহেব খুব খুশি। তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। দশদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে।
কিন্তু দেশের এই অবস্থা! বিয়ের খরচাপাতি?
কোনও খরচাপাতি নেই।
জ্বী?
ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে বোনের মেয়ের বিয়ে! এই ধরনের বিয়েতে আবার খরচা কিসের?
মুহূর্তে এই খবর ছড়িয়ে গেল পুরো বাড়িতে।
বাদলের কানে খবরটা গেল বরকতের মাধ্যমে।
শুনে বাদল একেবারে হতভম্ব। কী বলছ চাচা?
বরকত হে হে করে একটু হাসল। জেনে শুনেই বলছি। যমুনার সঙ্গে তোমার বিবাহ। দশ বারোদিনের মধ্যে। কথা ফাইনাল।
এসব শুনে বরকতের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল বাদল তারপর মা বাবার ঘরে এসে ঢুকল।
মির্জা সাহেব ঘরে নেই। বকুল আছেন।
মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রাগে একেবারে ফেটে পড়ল বাদল। এই অবস্থায় তোমরা এসব ভাবলে কী করে?
বকুল পরিষ্কার গলায় বললেন, আমি ভাবনি।
তাহলে?
তোর বাবা ভেবেছেন।
বাবাকে তুমি বোঝালে না কেন?
তিনি কি কারও কথা শোনার লোক? নিজে যা ভাল বোঝেন তাই করেন।
একটু থামলেন বকুল। তবে যমুনাকে আমারও পছন্দ। লেখাপড়া জানা লক্ষ্মীমেয়ে।
বাদল আগের মতোই রাগি গলায় বলল, তার মানে তোমারও মত আছে?
তোর মত নেই? যমুনাকে তোর পছন্দ না?
একথা শুনে বাদল একটু দমল। পছন্দ অপছন্দের কথা আমি বলিনি মা।
তাহলে?
আমি বলছি সময়ের কথা। যেখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চলছে সেখানে আমার মতো ছেলে বিয়ে করতে পারে না।
একটু থামল বাদল। আমি অবশ্য বুঝেছি বাবা কেন এই পলিসিটা করেছেন। আজ তোমাকে আমি স্পস্ট বলছি মা, তোমাদের কোনও পলিসিই কাজে লাগবে না।
বাদল রাগি ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল।
.
২২.
কথাটা যমুনা শুনল খুকির কাছ থেকে।
বিকেলবেলা খুকির মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে যমুনা, খুকি বলল, তোমার জন্য একটা খবর আছে যমুনা আপা।
কী খবর?
তোমার বিয়ে।
যাহ।
সত্যি?
কোথায়?
এই বাড়িতে।
মানে?
মানে ভাইজানের সঙ্গে তোমার বিয়ে।
কী?
হ্যাঁ।
তোকে কে বলল?
বাড়ির সবাই জানে। তোমার যদি বিশ্বাস না হয়, তুমি গিয়ে ফুফুকে জিজ্ঞেস কর।
খুকির মাথা আঁচড়ানো শেষ না করেই পুবের ঘরে এল যমুনা।
শিরিন ঘরেই ছিলেন। সরাসরি তাঁকে কথাটা জিজ্ঞেস করল যমুনা।
শিরিন বললেন, যা শুনেছিস তা ঠিক।
মানে?
মানে বাদলের সঙ্গে তোর বিয়ে।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? কেন?
দেশের এই অবস্থায় কোনও পাগল ছাড়া কেউ নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে পারে না।
চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন শিরিন। এসব ব্যাপারে তুই যে আমার সঙ্গে কখনও কথা বলবি, এ আমি ও ভাবিনি।
নিজের ভালমন্দের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আমার আছে।
তা আছে। প্রত্যেক মানুষেরই থাকে।
যমুনা গম্ভীর হল। কী বলতে চাচ্ছ তুমি?
শিরিন থমথমে গলায় বললেন, তোকে সাত বছরের রেখে তোর বাবা মারা গেলেন। যে বয়সে আমি বিধবা হলাম সেই বয়েসে অনেক মেয়ের বিয়েই হয় না। আমারও অধিকার ছিল তোর কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবা। কই আমি তো তা ভাবিনি।
দুটো ব্যাপার কিন্তু একরকম নয় মা।
তাহলে কী রকম?
আমি কিন্তু তোমার কথার অবাধ্য হচ্ছি না। তোমাদের সিদ্ধান্তেও আমার আপত্তি নেই।
তাহলে সমস্যাটা কী?
সমস্যা হচ্ছে দেশ। একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে যেখানে সেখানে একটি মেয়ের বিয়ে হয় কী করে?
পরিস্থিতিটা মনে না রাখলেই হয়।
যমুনার দিকে আর তাকালেন না শিরিন। নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যমুনার তখন কী যে অসহায় লাগছে! চোখ ফেটে যেতে চাইছে গভীর কান্নায়।
.
২৩.
জলধর ডাক্তার মাধবিকে নিয়ে যে ঘরটায় থাকতেন সেই ঘরের দরজায় এখন বেশ বড় একটা তালা ঝুলছে। নির্জন বাড়িটিকে যেন আরও নির্জন করে তুলেছে ওই তালাটা।
বাড়ি ঢুকে এই তালাটাই প্রথমে চোখে পড়ল জলিলের।
জলিলের সঙ্গে আছে তার সারাক্ষণের সঙ্গী তালেব। আর জনা চারেক কামলা মজুর ধরনের লোক।
রাজাকার হওয়ার পর জলিলের চেহারায় চেকনাই অনেক বেড়ে গেছে। গলার সুর গেছে বদলে। এখন আর কোনও ব্যাপারে কাউকে অনুরোধ করে না জলিল। আদেশ করে।
এখনও করল। তালেব, তালাটা ভাঙ।
তালেব বলল, তারপর?
তালা ভাইঙ্গা ঘর থিকা ডাক্তারের চেয়ারটা বাইর কর।
করে?
আমারে দে। আমি ঐ চেয়ার নিয়া উঠানে বসব।
তারপর?
তারপর আর কিছু না। আইজ থিকা এই বাড়িটা আমার। আগে এই বাড়িরে লোকে বলত জলধর ডাক্তারের বাড়ি, আইজ থিকা বলব জলিল রাজাকারের বাড়ি।
সঙ্গে সঙ্গে শরীরের তাক যেন বেড়ে গেল তালেবের। একজন মজুরের হাত থেকে সাবল নিয়ে জলধর ডাক্তারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে।
ঠিক তখুনি এই বাড়ির দিকে আসছিল বিলু।
গাছপালার আড়াল থেকে দেখতে পেল উঠোনে জলিলরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, আর জলধর ডাক্তারের ঘরের তালা ভাঙছে তালেব।
বিলু আর দেরি করল না। স্কুল মাঠের দিকে দৌড় দিল।
স্কুল মাঠের পতাকাতলে দাঁড়িয়ে ছিল বাদল এনামুল আর আলমগির। বাদলের হাতে মির্জা সাহেবের বন্দুক।
এনামুলকে বাদল বলল, আমি আর দেরি করতে চাই না এনামুল ভাই।
এনামুল বলল, কেন?
অসুবিধা আছে।
কী অসুবিধা?
পারিবারিক। আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। আমাকে আর আলমগিরকে আপনি একসঙ্গে পাঠিয়ে দিন।
এনামুল চিন্তিত গলায় বলল, আমাকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
আলমগির বলল, কেন? গ্রামে আর থাকা যাবে না।
তখুনি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এল বিলু। আপনেরা তাড়াতাড়ি আসেন। ডাক্তারকাকার বাড়ি দখল করতাছে জলিল মিয়ারা।
শুনে বাদল একটা লাফ দিল। কী?
তারপর বন্দুক হাতে জলধর ডাক্তারের বাড়ির দিকে ছুটল। তার সঙ্গে সঙ্গে ছুটল আলমগির আর বিলু।
কিন্তু এনামুল তেমন জোরে ছুটতে পারছিল না। ক্রাচে ভর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ছুটছিল সে।
ওরা যখন জলধর ডাক্তারের বাড়ি এল, ততোক্ষণে ঘরের তালা ভাঙা হয়ে গেছে। জলধরের হাতাঅলা চেয়ারটা বাইরে, উঠোনে এনে রাখা হয়েছে। সেই চেয়ারে বেশ একখানা ভাব ধরে বসেছে জলিল। একজন কামলা তাকে তালপাখায় বাতাস করছে।
জলিল তাকে বলল, জোরে বাতাস কর। আরও জোরে। আইজ কাইল আমার একটু বেশি গরম লাগে।
বাদল গম্ভীর গলায় বলল, কী করছেন এখানে?
বাদলকে বন্দুক হাতে দেখে আর তার জলদ গম্ভীর গলা শুনে ভয় পেয়ে গেল জলিল। তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল সে। কিছু করি না, কিছু করি না।
ঘরের তালা ভেঙেছে কে?
আমি না, আমি না। তালেব।
ভয়ে তালেবেরও ততোক্ষণে মুখ শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলে সে বলল, আমার দোষ নাই। জলিল আমারে ভাঙতে কইছে।
যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। আমার উচিত আপনাদের দুজনকেই গুলি করা। এটা আপনাদের প্রথম অন্যায় বলে গুলিটা আমি করব না। বেরোন, বেরোন বাড়ি থেকে।
জলিল বলল, হ হ যাইতাছি গা।
তারপর তালেবের দিকে তাকাল। তালেব, ল।
লও।
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর এনামুল বলল, জলিলের এই যাওয়া কিন্তু শেষ যাওয়া নয় বাদল।
তাহলে?
জলিল হচ্ছে গোখরো সাপ। গোখরো সাপ ব্যথা পেয়ে পালিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু আড়াল থেকে শত্রুকে ফলো করে। সুযোগ পেলেই ছোবলটা দেয়।
আলমগির বলল, তার মানে জলিলও ছোবল দেবে?
অবশ্যই।
ঠিক এই কথাটাই জলধর ডাক্তারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল জলিল। ছোবল না, আমি দিমু কামড়। কামড় দিয়া খাইয়া ফালামু।
তালেব বলল, তোমার কথা বুঝলাম না।
রাজাকারে নাম লেখাইছি। কাইলই থানায় গিয়া মেলেটারি সাহেবগ জানামু আমগ বনসীমান্ত গ্রামে মুক্তিবাহিনীর টেরনিং হইতাছে। কমান্ডার হইল বাদল। দেখবি আর কিছু লাগব না। ডাক্তারের বাড়ি তো আমি দখল করুমই, মির্জা বাড়িও করুম।
জলিলের কথা শুনে খুবই আমোদ পেল তালেব। খি খি করে হাসতে লাগল সে।
.
২৪.
বিকেলবেলা মাঠের দিক থেকে হেঁটে আসছে বাদল।
বাড়ি ঢুকবে। নাড়ার পালাগুলোর ওদিক থেকে বেরিয়ে এল যমুনা।
যমুনাকে দেখে থমকে দাঁড়াল বাদল। তুমি এখানে?
যমুনা সরল গলায় বলল, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
কেন?
আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
বাদল মাথা নীচু করল। আমি জানি তুমি কী বলবে।
যমুনা বলল, না আপনি জানেন না।
বাদল একটু চমকাল। যমুনার দিকে তাকাল। মানে?
বাদলের চোখের দিকে তাকিয়ে যমুনা বলল, আমি চাই বিয়েটা হোক।
কী?
হ্যাঁ।
কী বলছ তুমি?
আমি আমার মনের কথা বলছি। তবে তারপরও কথা আছে।
সে কথা আর বাকি রাখছ কেন? বলে ফেল।
যমুনা মিষ্টি করে হাসল। কথা না শুনেই রেগে যাওয়া ঠিক না।
আমি রেগে যাইনি।
তাহলে?
অবাক হয়েছি।
অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ …….।
কারণ?
বিয়েটা হবে স্বাধীনতার পর।
সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভার নেমে গেল বাদলের। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। সত্যি?
যমুনা মিষ্টি করে হাসল। সত্যি। যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।
বাদল মুগ্ধ চোখে যমুনার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
২৫.
মির্জা সাহেব আজ ফিরলেন রাত করে।
বকুল একটু উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ব্যস্ত হলেন। চেয়ারম্যান সাহেব খবর পাঠিয়েছিলেন কেন?
মির্জা সাহেবের মুখটা থমথম করছে।
বাইরে থেকে এসেই সাধারণত গায়ের পাঞ্জাবিটা খোলেন তিনি। এখন খুললেন না। গম্ভীর মুখে পালঙ্কে বসলেন।
বকুল বললেন, কী হলো? কথা বলছ না কেন?
কী বলব?
কী বললেন চেয়ারম্যান সাহেব?
মির্জা সাহেব কথা বললেন না।
স্বামীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন না বকুল। তার পাশে বসলেন। কী হয়েছে?
কিছু না।
কিছু না হলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
এবার রাগে ফেটে পড়লেন মির্জা সাহেব। বদমাসটাকে চেয়ারম্যান বানিয়ে ছিলাম আমি। আমি না বললে গ্রামের লোকে ওকে ভোট দিত না। সেই ব্যাটা আজ আমাকে শাসায়?
শাসায় মানে? কী বলেছে?
আমাকে বলে ওদের সঙ্গে দালালের খাতায় নাম লেখাতে।
মানে?
মানে পিস কমিটির মেম্বার হতে বলে আমাকে। কী মনে করেছে ও আমাকে? ছেলেকে মুক্তিবাহিনীতে যেতে দিইনি বলে আমি কি দেশের স্বাধীনতা চাই না? আমি কি ওদের মতো পাকিস্তানি কুকুর?
উঠোন দিয়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল বাদল।
মির্জা সাহেবের গলা শুনে নিজের ঘরে না গিয়ে মা বাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
বাদলকে খেয়াল করলেন না মির্জা সাহেব, স্ত্রীকে বললেন, বাদলের মা, তোমার ছেলেকে বলে দাও, বিয়েসাদি বাদ। সে যা চায় তাই করুক। মুক্তিবাহিনীতে চলে যাক।
বাবার মুখে একথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না বাদল। ঘরে ঢুকে গেল। বাবা।
বাদলকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন মির্জা সাহেব। আদেশের গলায় বললেন, কাল সকালেই চলে যাবি। দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।
বাদল দৃঢ় গলায় বলল, অবশ্যই।
তবে ফিরে এসে একটি দালালকেও ছাড়বি না। দেশের জন্য দরকার হলে শহীদ হয়ে যাবি।
বাবার কথায় এতটাই আপুত হল বাদল, বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
.
২৬.
বাদল ভেবেছিল চলে যাওয়ার সময় যমুনার সঙ্গে তার দেখা হবে না। কারণ এত সকালে তার ওঠার কথা না।
কিন্তু সকাল সকাল রওনা না দিয়ে বাদলের উপায়ও নেই।
মা বাবা ও খুকির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাঠের দিকটায় এসেছে বাদল, খড়ের গাদার ওদিকটায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছে যমুনা। ঘুম ভাঙা মুখখানি তার আনন্দে তখন ফেটে পড়ছে।
বাদলকে দেখেই এগিয়ে এল সে।
বাদল বলল, তুমি কখন এখানে এলে?
আপনি যখন মামা মামীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন তখনই।
ভাল করেছ। তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে।
আমারও খুব ভাল লাগছে। আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধে যাচ্ছেন আর আমি আপনাকে বিদায় জানাচ্ছি, এটা সত্যি অসম্ভব আনন্দের।
শুনে বাদল খুবই আপুত হল। তোমাকে একটা কথা বলব?
হ্যাঁ।
যাওয়ার আগে তুমি যদি আমাকে একবার তুমি করে বলতে, আমার খুব ভাল লাগত।
বাদলের কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল যমুনা, তারপর দুহাতে বাদলের একটা হাত জড়িয়ে ধরল। এই যে তোমার হাত ধরলাম, জীবনে এই হাত কখনও ছাড়ব না।
বাদলও ধরল যমুনার হাত। সত্যি?
এরচে’ বড়সত্য আর কিছু নেই আমার জীবনে। যেখানেই থাক তুমি, জানবে, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার হাত ধরে আছি।
আবেগে গলা বুজে এল বাদলের। সে আর কোনও কথা বলতে পারল না।
.
২৭.
খানিকটা বেলা হওয়ার পর মাঠপারের দিকে গিয়েছিল মির্জা বাড়ির গোমস্তা নবু, গিয়ে দেখে দূরের রাস্তা দিয়ে সারধরে মিলিটারি আসছে বনসীমান্তের দিকে। তাদের সঙ্গে একজন চেনা লোককে দেখতে পেল নবু। জলিল রাজাকার। সে আছে তাদের আগে আগে। যেন পথ দেখিয়ে আনছে মিলিটারিদেরকে।
মুহূর্তখানেক দৃশ্যটা দেখল নবু, তারপর চিৎকার করতে করতে মির্জা বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। মেলেটারি আসতাছে, মেলেটারি আসতাছে।
মুহূর্তে পুরো বনসীমান্ত জেনে গেল কী ঘটতে যাচ্ছে। যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল ছুটতে শুরু করল।
মির্জা বাড়িতেও হুলস্থুল পড়ল।
ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যমুনা বলল, কী? মিলিটারি আসছে?
শিরিন বললেন, সর্বনাশ! এখন কী হবে?
বরকত বলল, যে ভয়ে ঢাকা থেকে পালালাম সেই ভয় তো এখানেও!
বকুল বললেন, বাড়ির লোকজন নিয়ে এখন কোথায় যাব আমরা?
মাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে লাগল খুকি। আমার ভয় করছে। মা।
মির্জা সাহেব ছিলেন কাছারি ঘরে, হৈ চৈ শুনে ছুটে বেরুলেন। কী হয়েছে এ্যাঁ, কী হয়েছে?
নবু হাপাতে হাপাতে বলল, মেলেটারি আসতাছে। আমি নিজ চোখে দেখছি। লগে জলিল রাজাকার।
তার মানে জলিল মিলিটারিদের জানিয়েছে বনসীমান্তে জয় বাংলার ট্রেনিং হচ্ছে। এজন্য মিলিটারিরা এখন গ্রাম জ্বালাতে আসছে। যাকে পাবে তাকেই এখন গুলি করে মারবে।
নবু বলল, তাই তো মনে হইতাছে।
সর্বনাশ! তাহলে এক্ষুনি সবাইকে নিয়ে পালাতে হবে। নবু, তুই একটা কাজ কর, গোয়ালের গরুগুলো সব ছেড়ে দে। যেদিকে ইচ্ছে চলে যাক।
নবু গোয়ালের দিকে ছুট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম গুলির শব্দটা হলো।
.
২৮.
বিলু ঘুমিয়ে ছিল জলধর ডাক্তারের ঘরে।
গুলির শব্দে তার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সে। ছুটে ঘর থেকে বেরুল।
পুরো বনসীমান্ত জুড়ে তখন মানুষের পায়ের শব্দ। ছুটোছুটি, ভয় চিৎকার আতঙ্ক। গুলির শব্দ হচ্ছে অবিরাম। গাছের পাখিরা সব আকাশে উড়াল দিয়েছে। কাকগুলো সব কা কা করছে।
মুহূর্তকাল কী ভাবল বিলু তারপর স্কুলমাঠের দিকে দৌড় দিল। অন্য কিছুই আর তার মনে নেই, শুধু মনে আছে স্কুলমাঠের লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার কথা। যেমন করেই হোক পতাকাটা তাকে রক্ষা করতে হবে।
ছুটতে ছুটতে স্কুলের মাঠে এল বিলু।
এই দিকটা একেবারেই ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। দূরে গুলির শব্দ হচ্ছেই। মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বিলু এসে পতাকার খুঁটিটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল।
কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই বিলুর চারপাশ থেকে অজস্র বুট পরা পা এগিয়ে আসতে লাগল এই মাঠের দিকে।
বিলু মনে মনে বলল, যত মেলেটারিই আসুক, জীবন থাকতে আমার কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা কেউ ছিনাইয়া নিতে পারব না।