বনসাইদের গল্প

বনসাইদের গল্প

এখন অনেক রাত। বোম্বের অভিজাত পাড়ায় রাত-দিনে বেশি তফাত না থাকলেও এখানেও রাত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এখন।

মিসেস সেন একবার লিভিং রুমে এসেছিলেন হালকা নীলরঙা নাইটি পরে। দরজা ঠিকমতো লক হল কি না, ছোটো নাইট-লাইটগুলো ছাড়া অন্য বাতি সব নেভাল কি না বেয়ারা, তাই দেখতে। সব দেখেশুনে মিসেস সেন আবার এয়ার-কণ্ডিশনড বেডরুমে ফিরে গেলেন।

আমাকে মিসেস সেন বড়োই ভালোবাসেন। ঘরে যাওয়ার আগে একবার আমার গায়ে হাত রেখেছিলেন। একে ভালোবাসা বলে কি না জানি না। তবে আজকের রাতের পার্টিতে মিসেস সেন-এর পালি হিল-এর এই ফ্ল্যাটে বোম্বের যেসব গণ্যমান্য মানুষ এসেছিলেন, তাঁরা আমাকে দেখে মিসেস সেনের আশ্চর্য প্রতিভার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেছেন। আমার কারণে তিনি সবসময়ই গর্বিত, তবে আমার সম্বন্ধে মিসেস সেন যখনই ডাহামিথ্যে কথাটা বলেছিলেন, তখন ওঁর মুখের কোথাও চামড়ার একটুখানিও কোঁচকায়নি। বড়ো বড়ো চোখের সুন্দর গভীর পাতাতেও একটু কাঁপন লাগেনি।

মানুষ মিথ্যে কথা বলতে পারে আমি জানতাম। তবে মানুষের মেয়েরা আরও বেশি বলে যে, সেকথা জানতাম না। প্রত্যেক মেয়েই বোধ হয় জন্মেই অভিনেত্রী।

আসলে মানুষদের কথা আমার তো অজানা থাকার কথা নয়। মানুষের হাতে আমার জন্ম না হলেও মানুষের হাতেই বড়ো হয়ে ওঠা। মানুষের ঘরেই আমার বন্দিত্ব।

মিস্টার সেনের পূর্বপুরুষদের দেশ ছিল পূর্ববঙ্গে। নিজে যদিও একবার দু-বার ছাড়া কখনো যাননি। তবে, আমারই মতো কিছু কিছু গাছ এবং হয়তো মানুষও থাকে, যত উঁচুতেই বাস করুক-না কেন, অথবা উঁচুতলায়; তাদের গায়ে তাদের শিকড় লেগেই থাকে, লেগে থাকে শিকড়ের মাটির গন্ধ।

মিসেস সেন অবশ্য অন্য কথা বলেন, ‘ইউ মাস্ট কাট ইয়োর রুটস রুথলেসলি। যে-যুগে মানুষ চাঁদে পা দিচ্ছে সেযুগে রুটস কথাটাই টাইমবারড হয়ে গেছে।’

হয়তো হবে। শিকড় সঙ্গে করে বয়ে বেড়ালে, ওপরে ওঠা যায় না; ওড়া যায় না; ওড়া যায় না এই নতুন পৃথিবীর আকাশে।

শিকড়ের কথাতেই মনে পড়ল আমার জন্ম হয়েছিল কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে যে হাইওয়ে গেছে তারই পাশে। কৃষ্ণনগরের কাছেই। আমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সব একই জায়গায়। গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করেই বেড়ে উঠেছিলাম আমরা! একে অন্যের গায়ের গন্ধ নিয়ে। বটের ঝুরি নামে, ফল থেকে চারা গজায়। আমিও আমার সেই অভিজাত প্রাচীন বটবংশের এক শিশুবট ছিলাম। সবুজ পাখির ঠোঁটের ঠোকরে মাটিতে পড়া লাল বটফল থেকে আমার জন্ম। কলকাতার এক শৌখিন বাঙালিবাবু আমাকে শেকড়সুদ্ধ উপড়ে নিয়ে এসে আলিপুরের আচার্যি সাহেবের মেমসাহেবকে দান করেন। তিনিই আমাকে বামন করে দেন।

তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য চিন দেশের মেয়েরা যেমন একসময় লোহার জুতো পরে পায়ের গড়ন ছোটো রাখত, তেমনি আমার বট-জাতীয় চরিত্রকে অক্ষুণ্ণ রেখেই নানারকম মানুষি বজ্জাতির সঙ্গে আমাকে মিসেস আচার্যি এবং অন্য অনেকে মিলে পরামর্শ করে বামন করে দিয়েছেন। জীবনের মতো নির্বাসন দিয়েছেন একটি চার ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি পোর্সিলিনের টবে। তবে সাধারণ টব নয় সে। বোম্বের বিখ্যাত দোকান, ‘পেডার’ থেকে কেনা। চমৎকার কারুকাজ, রঙের খেলা সে-টবে।

বামন না বানালে আমি হয়তো আজ হাত-পা ছড়িয়ে চল্লিশ বছরের দশ কাঠা জমির ওপর ঝাঁকড়া চুলের নিশান উড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম! মানুষ আমার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আমাকে বলত ‘বনস্পতি’। কত পাখি এসে বাসা বাঁধত আমার ডালে। সোহাগ খেত। নীড়ের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা সব ক্রিস্টালাইজড হয়ে সুন্দর উষ্ণ ডিম হয়ে প্রকাশিত হত। তারপর আর এক নতুন প্রজন্মের পাখি হয়ে ডিমের মধ্যে থেকে অনাগত ডিমের বাহক এবং ধারক সব পুরুষ ও মেয়ে পাখিরা কিচিরমিচির করে উড়ে যেত আমার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে। গভীর রাতে, কেউটে সাপ হানা দিয়ে পাখির বাচ্চা আর ডিম খেত এবং প্রমাণ করত যে, সমস্তরকম নিরাপত্তার মধ্যেই বিপদের বীজ নিহিত থাকেই। ডাকাতের আর মাতালের আর মৈথুনকারীর রম্যস্থান হত আমার ঘনঘোর স্নিগ্ধ ছায়া। শিবলিঙ্গ বসাত কেউ এনে আমার পায়ের কাছে। সিঁদুর লেপে তাতে জল ঢালত অনেক বোকা মেয়েরা ঘড়া ঘড়া তার মাথায়, আর চালাক বামুন পয়সা লুঠত। ভক্তির ‘ভ’ নেই মনে অথচ ঠাকুরকে নিয়ে ব্যাবসা পাতত কেমন! যেমন প্রেমের ‘প’ও না নিয়ে ঘর বেঁধেছেন মিসেস সেন।

সততা মরে গেছে। আমার উচ্চতার মতোই, সততা এ পৃথিবী থেকে উবে গেছে! অথবা আমারই মতো তাকে বামন করে রেখেছে সাবধানি, সতর্ক, নির্গুণ সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষেরা।

হঠাৎ মিসেস সেনের বেডরুমের দরজার উলটোদিকে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। মিস্টার সেন দরজা খুলে বাইরে এলেন। ভদ্রলোকের খালি গা, একটা কালো চেক- চেক লুঙ্গি পরা। উনি এয়ার-কণ্ডিশনড ঘরে থাকেন না। বসবার ঘরও এয়ার- কণ্ডিশনড, যেখানে আমি এবং আরও অনেক বামনগাছ থাকি এবং যেখানে বড়ো বড়ো মানুষ আসেন, হুইস্কি খান, বাখ বিটোভেন এবং মোতজার্ট, চাইকোভোস্কি শোনেন। আর্ট ফিলম নিয়ে দুর্বোধ্য সব আলোচনা করেন।

মিস্টার সেন মানুষটার মধ্যে দুটো মানুষ বাস করেন। বুঝতে পারি। একটা মানুষ অন্যরকম, অন্য দশজনের মতো। কিন্তু আর একটা মানুষ? তিনি এই গভীর রাতের নি:সঙ্গ, হৃদয়হীন, সঙ্গীহীন, প্রেমহীন একা ফ্ল্যাটে-থাকা মানুষটা। মিসেস সেন যখন সামনে বা বাড়িতে থাকেন না, শুধু তখনই সেই মানুষটা প্রকাশিত হন। কাফকার মেটামরফসিস-এর গ্রেগর এবং সেই পোকাটার সঙ্গে মিস্টার সেনের আর আমার; এই বামন-বটের কোথায় যেন একটা দারুণ মিল আছে।

আজ রাতেই একজন অতিথি, আমার অসংখ্য কানের একটা কান মুলে দিয়ে তাঁর জাভেরি ব্রাদার্সের হিরেমোড়া সঙ্গিনীকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘উড নট বি সারপ্রাইজড, ইউ সাম ডে আই ভেঞ্চার টু রাইট অ্যাপালিং ডায়ারি অফ দি গ্রেট, ওল্ড, পুয়োর, ডোয়াফর্ড চ্যাপ; অ্যা বনসাই ব্যানিয়ন!’

সঙ্গিনী ধন্য হয়ে বলেছিলেন, ‘‘হানি, ঠাট্টা কোরো না। আমি ভাবছি, ‘ফ্রেণ্ডস অফ দ্য ট্রিজ’- এর মতো, ‘সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু ট্রিজ’ নাম দিয়ে একটা সোসাইটি ফাউণ্ড করব। দিস ইজ অ-ফুল। দিস বনসাই বিজনেস। গাছেদের বুঝি লাগে না? বলো হানি? জানো তুমি! সেদিন একটা বই পড়ছিলাম, ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অফ প্লান্টস।’ ফ্যান্টাসটিক। ওরাও আমাদের মতো জীবন্ত, ওরাও ভালোবাসে, ভালোবাসা বোঝে মানুষদেরই মতো। ই……..।’

মিস্টার সেন ফ্রিজ খুললেন। বিরাট লিভিং রুম পেরিয়ে, অন্যপ্রান্তের ডাইনিং রুমে গিয়ে। তারপর পান্তাভাতের বাটিটা বের করে কার্পেটের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে বসলেন, বাবু হয়ে। শুকনো লংকা পোড়া আর বড়ো বড়ো আস্ত কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে চাকুম-চুকুম করে খেতে লাগলেন পান্তাভাত। যেন ছোট্ট ছেলেটি। অনাবিল, ঋজু, অকলুষিত।

কোনো কোনোদিন পাশের ফ্ল্যাটের বাংলাদেশি আয়াকে দিয়ে শুঁটকি মাছও রান্না করিয়ে রাখেন মেমসাহেব। গভীর রাতে আয়ার ছেলে লুকিয়ে এসে সে মাছ দিয়ে যায়। মিস্টার সেন পেঁয়াজ-রসুন আর ঝালে লাল সেই শুঁটকি মাছ জমিয়ে খান।

মিসেস সেন শুঁটকি মাছের গন্ধ পেলেই স্মেলিং সল্টের শিশি তলব করেন এবং ওডিকোলন স্প্রে করান ফ্ল্যাটময়। খাওয়ার সময় মিস্টার সেনের চোখে-মুখে এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে যে, তা দেখে আমার কৃষ্ণনগরের কাছের সেই পথের পাশের পুরোনো চেনা গন্ধের বনস্পতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। উড়াল চুলের কালবোশেখির মেঘ, প্রথম বর্ষার সোঁদা গন্ধ, বর্ষার ঘনঘোর, রাতভর ব্যাঙের ডাক, জোনাকির নীলচে আলোর কাচটিপ, দুগ্গা পুজোর ঢাকের আর কাঁসির বাদ্যির অনুরণন, এই সমস্ত স্মৃতি আমার পাতায় পাতায়, শিরায় শিরায়, শিরশিরানি তোলে। পাট পচানোর কটু কিন্তু দেশি গন্ধ, পাট কাচার চটাং-পটাং আওয়াজ, পুকুরের হাঁসেদের সম্মিলিত গলার প্যাঁকপ্যাঁকানি এবং গায়ের আঁশটে গন্ধ সবই ভিড় করে আসে আমার ডালে ডালে, পাতায় পাতায়; শিরায় শিরায়।

মিস্টার সেন খাওয়া শেষ করে নিজেই প্যানট্রিতে সব ধুয়ে ফেললেন। বাসন সব জায়গামতো তুলে রাখলেন। পাছে মিসেস সেন বা বাবুর্চি জানতে পান। তারপর জানলা খুলে দিলেন লিভিং রুমের।

মিস্টার সেন যখন গভীর রাতে এমন করে জানলা খোলেন, শুধু তখনই আমি এবং আমার অন্যান্য বামন সঙ্গীরা একটু হাওয়া পাই। সমুদ্রের আওয়াজ আর নোনা গন্ধ কান ও নাক ভরে দেয়। এই বাইশ-তলার মার্বেল এবং কার্পেটে মোড়া ফ্ল্যাটে বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এয়ার-কণ্ডিশনারের একইরকম ঝিরঝিরে ঠাণ্ডায় থেকে থেকে আমাদের গুঁড়ি আর ডালপালাতে বাত ধরে গেছে। সেই আড়ষ্টতা নোনা হাওয়ায় ছেড়ে যেতে থাকে। আমরা বেঁটে বেঁটে হাত তুলে মিস্টার সেনকে নি:শব্দে ধন্যবাদ জানাই।

মিসেস সেনও কখনো কখনো আমাদের রোদ খাওয়ার জন্য জানলা খুলে জানলার তাকে রাখেন। তখনও একটু মাটি দেখতে পাই। মাটিরই গাছ আমরা। এখন যে চার ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি পোর্সিলিনের টবে থাকি সে-মাটি মিসেস সেন প্লেনে উড়ে গিয়ে কলকাতার হর্টিকালচারাল সোসাইটি থেকে পলিথিনের ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলেন। মাইতিবাবু নিজে যত্ন করে সে মাটি বানিয়ে দিয়েছিলেন, সার, ক্ষার সব হিসেব করে। কিন্তু সে মাটিতে কেষ্টনগরের গন্ধ নেই। আমি আসলে আর আমি নেই। আমি বুঝতে পারি। আমার অবয়বে, আমার সুখে-দুঃখে, আমার কামনা-বাসনা-চাওয়া-পাওয়া আর শব্দে-গন্ধে একেবারেই বামন হয়ে গেছি। আমার অনেক নামডাক, অনেক মূল আমার, অনেকই গাছ এবং গাছের মালিকের ঈর্ষার কারণ আমি। কিন্তু যে গর্ভে জন্ম আমার, যে গর্ভে আমার বীজ রোপণ করার কথা ছিল, আমার হৃদয়ের সব লালিমা দিয়ে যে লাল ফল ফলাবার কথা ছিল তা সবই বিফল হল এ জন্মে। আমি একটি নন-এন্টিটি, একটি বামন, একটি জরদগব প্রাণ হয়ে গেছি। প্রশ্বাস নিচ্ছি এবং নিশ্বাস ফেলছি। আমার হাত-পা ডাল-পাতা সবই আছে, কিন্তু, শুধু প্রাণেই আমি জীবিত আছি। বেঁচে থাকা মানে যে প্রাণে বাঁচার চেয়েও অনেক বড়ো কিছু, সেকথা আজ প্রায় ভুলেই গেছি।

শুধু আমিই নই, আমার সব সঙ্গীরাই সেকথা বলে গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে। সঙ্গী বলতে একটি কনকচাঁপা গাছ, একজোড়া রঙ্গন, আর একটি বোগোনভেলিয়া।

বাইশ-তলার জানলায় বসানো অবস্থা থেকে যখন আমরা নীচে তাকাই তখন মাথা ঘুরে ওঠে আমার। তবে ওদের আরও বেশি ঘোরে। কনকচাঁপা আর আমি তাও আকাশের কথা বুঝি কিছু, কারণ আকাশের অনেকখানিই আমাদের থাকার কথা ছিল, বামন না হলে। এখন আমাদের আকাশ বলতে শুধু এই ডুপ্লে ফ্ল্যাটের হালকা খয়েরি রঙের সিলিংটুকু।

মিস্টার সেন এসে মাঝে মাঝে আমার সামনে দাঁড়ান। আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলোন। বড়ো সহানুভূতি আর করুণা থাকে সেই হাতের আঙুলে। মিসেস সেনের আঙুলে শুধুই গর্ব আর মালিকানার দুর্গন্ধ। উনি আমার গায়ে হাত দিলেই আমার পাতাগুলি লজ্জাবতীর পাতার মতোই আপনা থেকেই কুঁকড়ে যায়। মিসেস সেন পুলকিত হন। আমার যেটা ঘেন্না, সেটাই ওঁর তীব্র আনন্দ। উনি হয়তো বট গাছের ‘বনসাই’-এর মধ্যে লজ্জাবতীর লক্ষণ দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে ওঠেন, পরের ‘শো’তে অন্য একটা প্রাইজ পাওয়ার আশায়। দশ-জনকে এই অভূতপূর্ব গুণ দেখিয়ে চমকিত করার আশায়।

শুনেছি মিস্টার সেন মস্ত কাজ করেন। অনেক বছর আমেরিকাতে ছিলেন। এখন এক মালটি ন্যাশনাল কোম্পানির নাম্বার ওয়ান। এয়ার-কণ্ডিশনড সাদারঙা মার্সিডিজ, সে-গাড়িতে আমিও চড়েছি অনেক দিন, বটানিস্টের বাড়ি যেতে। সে গাড়িতে চড়েও বাইরের হাওয়া পাই না একটুও। জ্যৈষ্ঠের দুপুরের গরম কাকে বলে আমি ভুলে গেছি। ভুলে গেছি গ্রীষ্মরাতের স্নিগ্ধ হাওয়ার প্রলেপ। আমার চুলে খোলা হাওয়া আর কখনো চিরুনি বুলোবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে; এ জন্মের মতো।

মিস্টার সেন মানুষটা বড়ো একা। মনে হয়, মানুষটাকে মিসেস সেন বনসাই করে দিয়েছেন। তাঁর সমস্ত নিজস্বতা ছাঁটতে ছাঁটতে, যেমন করে আমাদের নতুন গজানো পাতা আর নতুন গজানো ডাল মিসেস সেন তাঁর রুপোর কাঁচিতে ছাঁটেন, তেমনই ছেঁটে ছেঁটে কেটে ফেলে ন্যুব্জ, বামন করে দিয়েছেন মানুষটাকে।

মানুষটার বড়ো সুখ। সকলেই বলে। অথচ এই কোনো সুখেই যেন আমারই মতো মানুষটারও প্রয়োজন ছিল না কোনোই। অশান্তি এড়াবার চেষ্টা করতে করতে; মানুষটা আজ রাতে এই বাইশ-তলার খোলা জানলার কাছে……

হঠাৎ মিস্টার সেন খোলা জানলা থেকে ফিরে এলেন। ফিরে এসে, আমাদের প্রত্যেককে এক-এক করে জানলায় এনে বসালেন। তারপর, অনেকদিন থেকে যা ভেবেছিলাম, মানে যা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলাম, তাই করে বসলেন তিনি।

আমাদের জন্যে হঠাৎ এক তীব্র আনন্দে এবং মানুষটার জন্যে দুঃখে আমার মন ককিয়ে কেঁদে উঠল।

মিস্টার সেন হঠাৎই লুঙ্গিটা খুলে ফেললেন। নাইট-লাইটের স্বল্প আলোতে উদোম মানুষটাকে হঠাৎ যেন আমার বনস্পতি প্রপিতামহর ছায়ায়, তাঁর পায়ের কাছে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকা সেই নাগা সন্ন্যাসীর মতো মনে হল। মানুষটা মনে মনে বোধ হয় সন্ন্যাসীই ছিলেন। এই অপ্রয়োজনের আড়ম্বর এবং অবিচ্ছিন্ন আরামকে মানুষটা তার বাড়তি পোশাকের মতোই হঠাৎই খুলে ফেললেন। তারপর একে একে বোগোনভেলিয়া, রঙ্গন দুটি এবং কনকচাঁপাকেও জানলা গলিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর আমাকে যত্ন করে দু-হাতে বুকে তুলে নিলেন।

আহা! কনকচাঁপা এবং রঙ্গনেরা মাটির সঙ্গে মিশে গেল! হাত-পা, চুল ছড়িয়ে ওরা যখন গভীর রাতের বোম্বের মালটি-স্টোরিড বাড়ির ইট-কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝের খোলা জায়গা দিয়ে দ্রুত নীচে পড়তে লাগল, তখন যেন নীচের মাটি দু-হাত বাড়িয়ে দিল তাদের ধরবার জন্যে। মুহূর্তের জন্যে আরব সাগরের জল উছলে উঠল ওদের এই মুক্তির আনন্দে।

‘আর্থ টু আর্থ, অ্যাশেস টু অ্যাশেস, ডাস্ট টু ডাস্ট’……

হঠাৎ মিস্টার সেন জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়ে, নিজেও জানলার তাকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ধবধবে উলঙ্গ শরীরের চুলে সামুদ্রিক হাওয়া বিলি কাটতে লাগল। তাঁর বুকের ঘন চুলের মধ্যে আমাকে তিনি আর এক বার চেপে ধরলেন। তারপর টব থেকে আমাকে এক হ্যাঁচকা টানে মুক্ত করলেন। তাঁর বুকের ঘন চুলে মাইতিবাবুর যত্ন করে সাজিয়ে দেওয়া মাটি মাখামাখি হয়ে গেল। তারপর বামন আমাকে, হতভাগ্য এক শিশুরই মতো দু-হাতে বুকে জড়িয়ে আধুনিক সভ্যতার অর্থ ও যন্ত্রদানবের অত্যাচারে অত্যাচারিত, বড়ো একা মানুষটি, লোভ, গর্ব এবং অহমিকায় স্ফীত-নাসা এই ক্লান্তিকর অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে এক লাফ দিলেন জানলা দিয়ে।

জোরে হাওয়া লাগতে লাগল গায়ে। রাতের আরব সাগর থেকে সিগাল আর টার্নরা তাদের শান্তির সাদা ডানা মেলে হঠাৎ জল ছেড়ে অন্ধকারে উড়ে এল আমাদের স্বাগত জানাতে। মুক্তির গান ঠোঁটে করে। উড়ন্ত মৃত্যুতে মিস্টার সেনের সঙ্গে মিলিত হলাম।

একজন বামন-মানুষ। আর একটি বামন গাছ!

প্রচন্ড শব্দ হল একটা। মিস্টার সেনের মাথাটা ফেটে গেল টুকরো হয়ে। নাক দিয়ে গরম রক্ত গড়িয়ে এল। এসে চ্যাটচেটে হয়ে আমার সবুজ পাতাতে মাখামাখি হয়ে গেল। আমার এতদিনের শীত মুছে দিল।

দারোয়ান, চৌকিদার, পুলিশ সব দৌড়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। মিস্টার সেন আমাকে যে সোহাগে, যে মমতায়, যে প্রেমে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন, তেমন করে মিসেস সেনকেও কোনোদিন হয়তো জড়াতে পারেননি। অথচ নিশ্চয়ই জড়াতে চেয়েছিলেন। গাছের মতো, মানুষেরও মনটাই আসল। তেমন করে মন ডাক না দিলে, মানুষের শরীরও কথা বলে না। আসলে গাছ, পাখি বা মানুষ সকলেই এক জায়গায় সমানই বরাবর। কেউই কারও চেয়ে বড়ো নয় ছোটোও নয়। বামন করা যায় গাছকে, বা মানুষকে নিশ্চয়ই। কিন্তু অগাছ বা অমানুষ করা যায় না কখনোই।

এই বনসাই গাছ—আমার সবুজ পাতার রং গাঢ় লাল হয়ে এল বনসাই মানুষটার টাটকা তাজা ভালোবাসার, মুক্তির রঙে।

ভীষণই ভালো লাগতে লাগল। কারণ কোনোদিন আবার আমি সবুজ, বিরাট গাছ হব; প্রাচীন বনস্পতি! লাল ফল আসবে আমারও ডালে ডালে। অনেক ভালোবাসার টিয়া পাখি তার সঙ্গিনীকে আদর করবে আমারই বুকের নীড়ে বসে। নাগা সন্ন্যাসী, গভীর রাতে আমার পায়ের কাছে ধুনি জ্বালিয়ে বসে চুপ করে ভাববে স্তব্ধ রাতে, সেই গন্তব্যর কথা, যেখানে চিরন্তন মানুষ চিরদিনই যেতে চেয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *