বনলতা

বনলতা

কলেজে গরমের ছুটি৷ দুপুরবেলা খেয়ে উঠে পরীক্ষার খাতার স্তূপ নিয়ে বসেছি, হঠাৎ কলিংবেলের ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ৷ উফ এখন আবার কে এল? নির্ঘাত সেলসগার্ল৷ আজকাল এই এক হয়েছে, সারাটা দুপুর উৎপাত চালায় মেয়েগুলো৷ শ্যাম্পু, সাবান, ক্রিম, বড়ি, আচার, ধূপ, ফিনাইল, ব্রা, প্যান্টি কিছু না কিছু গছানোর জন্য হানা দেয় অবিরাম৷ বাড়িটা বড়ো রাস্তায় হয়ে আরও যেন জ্বালা হয়েছে, এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল৷

আবার বেল বাজল৷ আবার৷ আমার সবিতারানি গেলেন কোথায়? না বলে পাড়া বেড়াতে বেরোলেন নাকি? না ভোঁস ভোঁস নাক ডাকাচ্ছেন?

অগত্যা উঠতেই হল৷ বিরক্ত মুখে চোখ রাখলাম দরজায় ম্যাজিক হোলে৷ ওপারে এক বয়স্কা মহিলা৷ বৃদ্ধাই বলা যায়৷ পরনে সাদা শাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ৷ দেখে ঠিক সেলসগার্ল মনে হয় না৷ ডাকাত টাকাতও না৷

খুললাম দরজা— বলুন?

হাত জোড় করে নমস্কার করলেন মহিলা৷ মুখে একটা কৃপাপ্রার্থী, কৃপাপ্রার্থী হাসি— আমি একটা চ্যারিটেবল সংস্থা থেকে আসছি৷ সামান্য কিছু সাহায্যের জন্য৷

মহিলার মুখটা যেন ভারি চেনা চেনা! কোথায় দেখেছি? কোথায় দেখেছি? বেশিক্ষণ স্মৃতি হাতড়াতে হল না৷ অস্ফুটে বলে উঠলাম— বনোদি না?

মহিলা থতমত খেয়ে গেছেন— হ্যাঁ মানে… আপনি…

—আমাকে চিনতে পারছেন না দিদি? আমি আপনার ছাত্রী৷ সর্বাণী৷ আপনি আমাদের সেন্ট মারিয়া গার্লস স্কুলে…৷ বলতে বলতে ডেকেছি— আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন৷

অপ্রস্তুত বনোদি লজ্জিত মুখে বললেন— আমি তোমাকে ঠিক…?

—আপনার কী করে মনে থাকবে? সেই কবেকার কথা৷ আমি আটষট্টির হায়ার সেকেন্ডারি৷ আপনি আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন এক বছর৷ সেই ক্লাস ফোরে৷

ঈষৎ গুটিয়ে থাকা বনোদিকে প্রায় হাত ধরে এনে বসালাম সোফায়৷ পাখা চালিয়ে দিয়েছি৷ ওঘরে পার্ট ওয়ান পাসের ইতিহাসের খাতা ডাঁই হয়ে পড়ে, সামনের রোববারের মধ্যেই জমা দিতে হবে, এখন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট মানে সমূহ বিপদ, তবু মন খুশিতে ভরে উঠল৷ ছোট্টবেলাকার স্কুলের দিদিমণিকে হঠাৎ দরজায় দেখলে কোন ছাত্রীর না ভালো লাগে৷ বিশেষ করে এই মধ্যবয়সে পৌঁছে!

বনলতা বিশ্বাস ছিলেন আমাদের প্রাইমারি সেকশনের টিচার৷ ভারি যত্ন করে ইংরেজি পড়াতেন বনোদি, বলতে গেলে ওই বিদেশি ভাষা শিক্ষার ভিত আমাদের তৈরি হয়েছিল বনোদির হাতেই৷ শুদ্ধ উচচারণ, সিলেবল ভাগ করে করে সঠিক বানান লেখা, ইংরেজি ব্যাকরণের প্রাথমিক পাঠ সুন্দরভাবে গুছিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে পারতেন বনোদি৷ প্রতি পদেই আমরা ভুল করতাম, কিন্তু বনোদিকে কখনো রাগতে দেখিনি৷ হাসিমুখে বলতেন, মন দে মন দে, ওরে মেয়ে যা বলছি মাথায় রাখ৷

বাইরে প্রখর গ্রীষ্ম৷ গনগনে তাত৷ পাখার হাওয়াও যেন গায়ে লাগছে না৷ বনোদি রুমালে ঘাড় গলা মুছছেন, হাঁপাচ্ছেনও যেন অল্প অল্প৷ চোখে এখনও বিস্ময়৷

বনোদি কী দরকারে এসেছেন প্রায় ভুলেই গেছি৷ বললাম— আপনাকে একটু সরবত করে দিই দিদি?

—না না, অযথা কষ্ট করবে কেন? বরং এক গ্লাস জল দাও৷

—কিছু কষ্ট হবে না৷ একটু ঠাণ্ডা জলে লেবু নুন চিনি দিয়ে… রোদ্দুরে এসেছেন, ভালো লাগবে৷

—দাও তবে৷ বেশি ঠাণ্ডা দিও না৷ আমার সহ্য হয় না৷

সবিতা রান্নাঘরেই শুয়ে৷ থসথসে গরমেও কেমন ঘামছে দ্যাখো৷ ঠেলে তুলতে গিয়েও তুললাম না নিজের হাতেই যত্ন করে বানিয়েছি সরবত ট্রেতে বসিয়ে এনে রাখলাম সেন্টার টেবিলে— নিন দিদি৷

গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন বনোদি, আমি দেখছি বনোদিকে৷ মুখখানা ভারি মিষ্টি ছিল বনোদির৷ সুন্দরী নয়, তবে একটা লাবণ্য ছিল চেহারায়৷ ছোটোখাট্টো রোগাসোগা গড়ন, শ্যামলা শ্যামলা রং, একমাথা কোঁকড়া চুল বনোদি কেমন যেন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াতেন৷ এখন বয়স অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে৷ রঙটা কেমন খসখসে হয়ে গেছে বনোদির, চুলও কমে গেছে অনেক৷ কপালে, গালে, গলায় চোখের নীচে বলিরেখার দাগ অতি স্পষ্ট৷ কত বয়স হল বনোদির? পঁয়ষট্টি? সত্তর?

সরবতটুকু খেয়ে বনোদি যেন বেশ আরাম পেলেন৷ গ্লাস নামিয়ে রেখে তৃপ্ত মুখে বললেন— হ্যাঁ, যা বলছিলাম৷ আমাদের একটা ছোটো হোম মতন আছে৷ দুঃস্থ মেয়েদের জন্য৷ এই ধরো, যাদের স্বামী পরিত্যাগ করেছে, যাদের কোথাও যাওয়ার নেই, সমাজ যাদের নানান কারণে নেয় না… তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো একটু ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা…

—বাহ৷ খুব ভালো৷.. কিন্তু আপনি এখনও এসব করেন? এই বয়সেও?

—অথর্ব যখন হয়ে পড়িনি, চুপচাপ বসে থাকব কেন? যতটুকু পারি করি, আমার সাধ্য মতন৷ বলেই আবার কাজের কথায় ফিরলেন বনোদি— হোমটা খুবই ছোটো, এখন আঠারোটা মেয়ে আছে৷ তাদের খরচখরচা চালানো…

—গভর্নমেন্ট থেকে গ্রান্ট পান না কিছু?

—পাওয়ার চেষ্টা করছি৷ তবে সে অনেক ঝঞ্ঝাট৷ চিঠিচাপাটি চলছে, ধরাধরিও করছি, কিন্তু…৷ নিজেরাই তাই ঘুরে ঘুরে যতটা পারি টাকাপয়সা তোলার চেষ্টা করি আর কী৷ অনেক ধরনের খরচা আছে তো৷ মেয়েগুলোর খাওয়া, পরা, নানান রকম হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে তাদের৷ তারও একটা খরচ আছে…

—এভাবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা ওঠে?

—দেয় অনেকে৷ বনোদি আলগা হাসলেন— বেশির ভাগই অবশ্য হাঁকিয়ে দেন৷ তাও পাঁচ টাকা দশ টাকা করে যা ওঠে, তাই বা কম কী!

—চলে তাতে?

—আমরা যারা চালাচ্ছি, তারাও দিই যতটা পারি৷ তা সাধ থাকলেও আমাদের ক্ষমতা কতটুকু? কত মেয়ে এসে কান্নাকাটি করে, আমরা তাদের জায়গাই দিতে পারছি না…

—যেটুকু করেন, তাই বা কে করে৷ আমি অকপট ভাবেই মুগ্ধতাটা জানালাম৷ বললাম— আমি তো ভাবতেই পারছি না এই বয়সেও আপনি এত বড়ো একটা কাজ করছেন!

—বড়ো-টড়ো কিছু নয়৷ মানুষ হয়ে জন্মেছি, যতটুকু পারি মানুষের জন্য করা…

—আপনি রিটায়ার কবে করেছেন দিদি?

—সাত বছর৷

বনোদির সঙ্গে ক্লাস ফোরের পর আমাদের আর তেমন যোগাযোগ ছিল না, উঁচু ক্লাসে পড়াতেন না বনোদি৷ হয়তো তত কোয়ালিফিকেশান ছিল না বলেই৷ অবশ্য স্কুলে থাকতে দিদিমণিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোনোদিনই আমাদের কোনো প্রশ্ন জাগেনি৷ জাগেও না৷ তেমন বিশেষ কারণ না থাকলে তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও নয়৷ হয়তো কারুর স্বামী মারা গেছেন, কিংবা কারুর নতুন বিয়ে হয়েছে… তাই নিয়ে দু-চারদিন চাপা কানাকানি হয়, ব্যাস ওইটুকুই৷ বনোদির ক্ষেত্রে সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি কখনো৷ আজ বনোদিকে দেখে কৌতূহল হচ্ছিল অল্প অল্প৷ এখন শিক্ষিকা ছাত্রীর ব্যবধানটা নেই, এখন তো জিজ্ঞেস করে ফেলাই যায়৷

—বাড়িতে আপনার কে কে আছেন দিদি?

—আমি৷ আর আমার ছেলে৷

—ছেলে কী করেন?

—ওর একটু সমস্যা আছে৷ ছোটোবেলায় বিশ্রী টাইফয়েড হয়ে মাথাটা কমজোরি হয়ে গেছে৷ লেখাপড়াও সেভাবে করতে পারেনি, কাজকর্মও গুছিয়ে করে উঠতে পারে না, ঘরেই বসে থাকে সবসময়৷

—ও৷ প্রশ্নটা করেই অস্বস্তিতে পড়ে গেছি, কথা বলতে পারছিলাম না৷ মনে মনে অনুমান করে নিলাম স্বামীও মারা গেছেন নিশ্চয়৷ অথবা অন্য কোনো দুঃখজনক ঘটনাও থাকতে পারে৷ তবে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আর প্রশ্ন করাটা শোভন নয়৷

ছেলের কথা বলতে গিয়ে পলকের মধ্যে মেঘ জমেছিল বনোদির মুখে, পলকেই মিলিয়ে গেছে৷ হেসে বললেন— তুমি তো খুব গিন্নিবান্নি হয়ে গেছ দেখছি৷ পাক্কা হাউসওয়াইফ৷

—না না, আমি হাউসওয়াইফ নই৷ চাকরি করি৷

—তাই নাকি? কোথায়?

—একটা কলেজে পড়াচ্ছি৷ ইতিহাস৷

—বাহ বাহ, খুব ভালো লাগল শুনে৷ আমার কোনো ছাত্রী পড়ানোর পেশায় আছে শুনলে আমার এত আনন্দ হয়৷… স্বামী কী করেন? তিনিও পড়ান?

—না, ও ব্যাঙ্কের অফিসার৷

—ছেলেপুলে?

—একটিই ছেলে৷ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে৷ কানপুর আই আই টিতে৷

—ছেলে তাহলে খুব ব্রাইট বলো৷

—ওই আর কী৷ নরেন্দ্রপুরে পড়ত, ওখান থেকেই পাশ করে… বাক্যটা মাঝপথেই থামিয়ে দিলাম৷ বনোদির বিফল সন্তানের তুলনায় আমার ছেলে অনেক বেশি সফল, এ সত্যটা আমায় যেন হঠাৎ অসহজ করে তুলল৷

বনোদির হাসি কিন্তু টাল খায়নি একটুও৷ দারুণ উচ্ছ´সিত গলায় বললেন— আমার ছাত্রীরা সার্থক মা হয়েছে শুনলেও আমার এত গর্ব হয়৷ ভালো থাকো তুমি, আরও সুখে থাকো৷

মৃদু হেসে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিলাম এবার৷ অন্য প্রশ্ন করছি বনোদিকে৷ স্কুলের কী খবর, অন্যান্য শিক্ষিকারা কে কেমন আছেন, অনিমাদি এখনও হেড মিস্ট্রেস আছেন কিনা…৷ বনোদি অবশ্য সব বলতে পারলেন না, স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক তো তাঁরও অনেক দিন চুকে গেছে৷ তবে বনোদির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হারানো একটা গন্ধ যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম৷

হঠাৎ এক সময়ে বনোদি বললেন— এবার তো আমায় উঠতে হবে সর্বাণী৷

ইঙ্গিতটা বুঝে বললাম— কত দেব দিদি?

—যা তোমার খুশি৷

শোওয়ার ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে ভ্যানিটিব্যাগ বার করলাম৷ কত দিই? পঞ্চাশ দেব? না একশো? একশোই দি৷

বনোদি টাকাটা পেয়ে ভীষণ খুশি৷ ঝোলাব্যাগ থেকে একটা বই বার করে রসিদ লিখে দিলেন ঝটপট৷ বললেন— এই যে তুমি দুঃখী মেয়েদের জন্য ভাবলে, এইটাই আমার সব চেয়ে বড়ো পাওয়া সর্বাণী৷

ভারি প্রসন্ন মুখে চলে গেলেন বনোদি৷

এরপর থেকে মাঝে মাঝেই আসা শুরু হল বনোদির৷

মাস খানেকের মাথায় এসে বেশ কয়েকটা পুরোনো শাড়ি জামা নিয়ে গেলেন৷ হোমের মেয়েরা পরবে৷ হপ্তা তিনেক পর ফের এলেন, এবার প্রার্থনা টাকা৷ মেয়েদের জন্য উল বোনার মেশিন কিনবেন, চাঁদা তুলে তুলে৷ আমি থাকি না বলে এখন আর দুপুরের দিকে আসেন না, হয় সন্ধেবেলা, নয় বেছে বেছে ছুটির দিন৷ পুজোর মুখে মুখে এসে আরও শ-খানেক টাকা নিয়ে গেলেন৷ পুজোর সময়ে মেয়েগুলো পুরোনো কাপড়ে ঘুরবে এ নাকি তার বুকে বাজছে! শীতের মুখে মুখে এলেন একবার৷ মেয়েদের হাতের কাজের একটা প্রদর্শনী করতে চান, কোনো ছোটো হল ভাড়া নিয়ে, সেখানেও আমার সাহায্য দরকার৷

লেবু চটকালে তেতো হয়৷ আমি ক্রমশ উত্যক্ত বোধ করছিলাম৷ ছাত্রী পরিচয় দিয়ে এ তো মহা গেরো হল৷ কলেজে পড়াই জেনে আরও যেন জোর পেয়ে গেছেন৷ ভাবছেন টাকার গাছের দর্শন মিলেছে৷ একে ঝাঁকালেই কিছু না কিছু মিলবে৷ আশ্চর্য, এ মানুষগুলো বোঝে না কোনো ব্যাপারেই বেশি বাড়াবাড়ি করতে নেই৷ উনি সমাজসেবা করে নাম কিনছেন, আমি কেন বার বার তার জন্য কিছু করে খসিয়ে যাব? মাস মাস পাঁচ দশ টাকা করে নিয়ে যাক সেও তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এ যে একেবারে ঘাড়ের ওপর উঠে পড়া৷ সময় অসময় জ্ঞানও নেই, এলে আজকাল আর উঠতেই চান না৷ নিজের মনে হোমের সমস্যার কথা বলে চলেছেন তো বলেই চলেছেন৷ বয়স হলে যা হয়, আগে কী বলেছেন তাও মনে থাকে না, একই কথা পুনরাবৃত্তি করে যান৷ দেঁতো হাসি হেসে শুনতে যে কী বিরক্তি লাগে৷

এই তো সেদিন থিয়েটার দেখতে যাব, দুম করে বনোদির আবির্ভাব৷ হোমে কোনো একটি মেয়ে নাকি আগের হপ্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তাকে নিয়ে বনোদিকে নাকি ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালে৷ অপারেশন হয়েছে মেয়েটির, রক্ত জোগাড় করতে কীভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে বনোদিকে, সেই কাহিনিও বিস্তারিতভাবে শুনতে হল মুখ বুজে৷ সবিতা চা মিষ্টি দিল৷ বনোদির খাওয়া শেষ, আমি সমানে উসখুস করছি, অশোক ইশারা করছে ঘন ঘন, কিন্তু বনোদি নট নড়নচড়ন৷ গেলেন প্রায় পৌঁনে ছ-টা বাজিয়ে৷ হুড়মুড় করে তৈরি হলাম বটে, ট্যাক্সিও নিলাম, তবু শো শুরু হওয়ার আগে কিছুতেই হলে পৌঁছতে পারলাম না৷ নাটকের মাঝখানে ঢোকা মানেই দর্শকদের টিপ্পনী গেলা৷ অশোক তো সেদিন চটে লাল৷ বলে, এত কীসের আহ্লাদিপনা? মুখের ওপর বলতে পার না আমার কাজ আছে?

সত্যি, এবার বনোদিকে সোজাসুজি কিছু বলে ফেলা দরকার৷ কাঁহাতক আর এই অত্যাচার সহ্য করা যায়৷

এ বছর শীত ভালো করে পড়লই না৷ মাঘ মাসেই ঠাণ্ডা উধাও, ফাল্গুনে তো রীতিমতো গরম৷ ভোরের দিকে তাও একটু শিরশিরে ভাব থাকে৷ কিন্তু ন-টা দশটার মধ্যেই বেজায় চড়ে যায় রোদ্দুর৷ ফাল্গুনে এমন গরম কালেভদ্রে পড়ে৷

রবিবার সকাল৷ একটু রান্নাবান্না করছিলাম৷ অশোকের দুই পুরোনো বন্ধু খাবে আজ, সস্ত্রীক৷ বড়ো বড়ো চিংড়ি এনেছে অশোক, মালাইকারি হবে৷ সঙ্গে কই মাছের গঙ্গা-যমুনা, সোনামুগের ডাল, ভেটকির ফ্রাই৷ প্রচুর হ্যাপা৷ নারকেল কোরো রে, দুধ বার করো রে, ফ্রাই গড়ো রে…

সবিতা সাহায্য করছে হাতে হাতে৷ রান্নাঘরে নিয়মিত থাকার অভ্যেসটা ছেড়ে গেছে বলে তবু যেন দিশা পাচ্ছি না৷ ভিনিগার ঠিকমত ঢাললাম তো?

তখনই কলিংবেল ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ৷

অশোক এসে বলল— যাও, হয়ে গেল৷

—কে?

—আর কে! তোমার দিদিমণি৷

এবার বনোদি বেশ কিছুদিন পরে এলেন৷ প্রায় মাস দুয়েক৷ তবু শুনেই মেজাজ তেতো হয়ে গেল৷ আবার? এই অসময়ে?

ভুরু কুঁচকে বললাম— কাটিয়ে দাও না৷ বলো আমি ভীষণ ব্যস্ত৷

—বললে কি নড়বেন? অশোক ঠোঁট ওল্টাল৷

—খাল কেটে কুমির এনেছ, নিজের কুমির নিজেই সামলাও৷

—আহা, দরকারটা কী একবার জিজ্ঞেস করে দ্যাখো না৷

—গিয়ে জেনে নাও৷ তবে দয়া করে মনে রেখ, বারোটা বাজে, প্রভাস পল্লবরা এক্ষুনি এসে পড়ল বলে৷

ন্যাপকিনে হাত মুছতে মুছতে ড্রয়িংস্পেসে এলাম৷ বেজার মুখে একটা ইলাস্টিক হাসি টেনে বললাম— কী খবর দিদি?

বনোদি খবরের কাগজখানা উল্টোচ্ছিলেন৷ মুড়ে রেখে বললেন— তুমি কেমন আছ?

—ভালো৷ ঝটপট বলে ফেললাম— রান্না করছি৷ কিছু গেস্ট আসছেন খেতে…

—ও৷ তাহলে তো এখন আসাটা উচিত ছিল না৷

মনে মনে বললাম, উচিত অনুচিতের বোধ আছে আপনার?

মুখে বললাম— না না, বলুন৷ কিছু বলবেন?

বনোদির মুখে যেন হাসি ফুটল— তোমার কাছে একটা বিশেষ প্রার্থনা নিয়ে এসেছিলাম সর্বাণী৷ তুমি কিন্তু কিছুতেই না বলতে পারবে না৷

দপ করে মাথা গরম হয়ে গেল৷ ব্যঙ্গের সুরে বলে ফেললাম— আপনি তো প্রার্থনা ছাড়া আসেন না দিদি৷

বনোদি থমকে গেলেন৷ দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন— না না, ঠিক তেমন নয়৷

অর্থাৎ টাকা-পয়সা জামা-কাপড় ছাড়াও অন্য কিছু ধসবে এবার!

অসহিষ্ণু গলায় বললাম— যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন, প্লিজ৷

এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন বনোদি৷ তারপর মৃদু স্বরে বললেন— হোমের মেয়েরা তোমায় একদিন দেখতে চায় সর্বাণী৷ ওরা তোমার কথা আমার মুখে অনেক শুনেছে তো৷… কত কী করেছ তুমি ওদের জন্যে…

তপ্ত মেজাজ হোঁচট খেয়ে গেল৷ গলা নেমে গেছে— ওমা, আমি গিয়ে কী করব?

—তেমন কিছু নয়৷ এই একটু ওদের সঙ্গে আলাপ করবে, কথা-টথা বলবে…

—তুমি তো লেখাপড়া শিখেছ, তোমার সঙ্গে কথা বললে ওরা অনুপ্রাণিত হবে৷ বলতে বলতে হাসিটা যেন একটু ম্লান হল বনোদির৷ —আমার জ্ঞান আর কতটুকু৷ তুমি উচচশিক্ষিত, আমার চেয়ে অনেক বেশি জানো৷ তোমার সঙ্গে আলাপ হলে ওরা অনেক কিছুই শিখবে৷

বনোদির চোখে চোখ রাখতে পারলাম না৷ মাথা নামিয়ে নিলাম৷

বনোদি উৎসুখ মুখে বললেন— যেতে হবে কিন্তু সর্বাণী৷ সামনের শনিবার৷ ওদিন আমাদের হোমের জন্মদিন৷ আমার খুব ইচ্ছে তুমি সেদিন… আমি এসে তোমায় নিয়ে যাব৷

এরপর কি বনোদিকে ফেরানো সম্ভব? আলগোছে বললাম— আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবেখন৷

—তাহলে আমি শনিবার আসছি৷ বিকেলবেলা তুমি তৈরি থেকো৷ চারটে নাগাদ৷

বনোদি উঠে পড়ল৷ এতক্ষণ পর বনোদিকে লক্ষ করলাম ভালো করে৷ এই কদিনেই যেন আরও একটু বুড়িয়ে গেছে বনোদি, কেমন কালসেটে মেরে গেছে মুখচোখ৷ অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? এমন মানুষকে বসতে না বলা কি অন্যায় হল?

ভদ্রতা করে বললাম— একটু চা খেয়ে যান না বনোদি৷

—না না, আজ থাক৷ তুমি আজ ব্যস্ত আছ…৷

—এমনি খবর-টবর সব ভালো তো আপনার?

—চলছে৷ দু-এক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন বনোদি৷ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললেন— ছেলেটাকে নিয়ে বড়ো ধকল গেল…

—কী হয়েছে ছেলের?

—হয়েছে নয়, হয়েছিল৷ এখন আর সে নেই৷ বনোদির গলা সহসা ধরা ধরা৷

—ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া৷ খুব চেষ্টা করেছিলাম৷ রইল না৷

আমি পলকের জন্য স্তম্ভিত৷ মুখ দিয়ে প্রশ্ন ঠিকরে আসছিল, তবু আপনি হোমের কাজে বেরিয়েছেন বনোদি! হঠাৎ টের পেলাম কোনো শব্দই বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে৷

চশমা খুলে আঁচলের খুঁটে চোখের কোণ দুটো মুছছেন বনোদি৷ ফের চশমা পরে নিয়ে মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন৷ তারপর বেরিয়ে গেলেন, মন্থর পায়ে৷

আমি নিশ্চল৷ বনোদিকে ডাকতেও পারলাম না৷ সম্বিত ফিরতে দৌড়ে ব্যালকনিতে গেছি৷ তিনতলা থেকে দেখতে পাচ্ছি নীচের রোদ্দুর ভেঙে ভেঙে চলে যাচ্ছেন বনোদি৷ ছোট্টো জীর্ণ শরীরখানাকে টেনে টেনে৷ খানিকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ ডান পায়ের চটিটা খুলে হাতে নিয়ে দেখছেন কী যেন৷ ছিঁড়ে গেছে কি? আবার গলিয়ে নিলেন পায়ে৷ ডান পা ঘষে ঘষে হাঁটছেন৷

আমার চোখ ভিজে এল৷ দেখতে দেখতে কখন যেন ঝাপসা হয়ে গেলেন বনোদি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *