1 of 2

বনমালীর বিষয়

বনমালীর বিষয়

এইখানে বনমালী বাগান করেছে। বাগানের মাঝখানটিতে তার লাল ইটের বাড়ি। বলতে কী, যৌবনকালটা তো সুখে কাটায়নি বনমালী। বড় কষ্ট গেছে। সে সময়ে সে ঘর ছেড়ে কাপড়ের গাঁট নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিল। মহাজন ধারে কাপড় দিত, নইলে সে ব্যাবসাও শুরু করতে পারত না। ক্রমে ফিরি করতে-করতেই তার শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের কাছে দোকানটা হয়ে গেল। সারাটা জীবন সে দেখেছে, মানুষের লজ্জা ঢাকার জন্য বস্ত্রের বড় প্রয়োজন। বস্ত্র ছাড়া উপায় নেই।

বনমালী সেই মানুষের লজ্জা ঢাকার বস্ত্রের ব্যাবসায় এখন সুখে আছে। এই যে বাগান, এই যে লাল ইটের বাড়ি এ-ও হচ্ছে মানুষের বস্ত্র। এসব দিয়ে মানুষ লজ্জা ঢাকে। বনমালী তার সারাটা যৌবনকালের দীনতার লজ্জা ঢেকেছে। বাগানে হরেক ফুল, কত নার্শারি ঘুরে-ঘুরে বীজ আনে সে, কত জায়গা থেকে নিয়ে আসে গাছের চারা, লাগায়।

সামনে ফুলের বাগান, পিছনে ফলের। সামনে যেমন ফোটে গোলাপ, বেল, শেফালি, পপী, কিংবা চন্দ্রমল্লিকা, কাঠচাঁপা, তেমনি পেছন দিকে রয়েছে মর্তমান কলার ঝাড়, কেরালার নারকেল গাছ, আম, লিচু পেয়ারা, সুপুরি, কাঁঠালের গাছ। শীতকালে পালং বুনে দেয়, বাঁধা আর ফুলকপি, আলু মুলো বেগুন লঙ্কা সব গাছ লাগায়। অবসর সময়ে ছুটির দিনে সারাদিন বাগানে ঘুরে-ঘুরে গাছ দেখে সে। ভারী একটা বিস্ময় তার বুকে থমকে থাকে। এই যে গাছ হয়, ফুল ফোটে, ফল ফলে—এটাই একটা অবাক কাণ্ড। কী করে এক মাটি, এক সার থেকে এত রকমের রং আর রস তৈরি হয় তা সে বুঝেই পায় না। মাটির ভিতরে বোধহয় তাহলে সবই লুকিয়ে থাকে। এই ফুল ফোঁটা, ফল হওয়ার সব গুপ্ত রহস্য!

ফিরি করার সময়ে সে যেত কত বাড়িতে। বিচিত্র সব বাড়ি, বিচিত্র সব মানুষ থাকে তাতে। বনমালী বেরোত দুপুরের দিকে, যখন বাড়ির কর্তারা থাকেন বাইরে। গিন্নিরা ফিরিওলার কাছ থেকে জিনিস রাখে—এটা কর্তাদের পছন্দ নয় কখনও। মেয়েরা ঠকেই। দশ টাকার জিনিস কমিয়ে সাত টাকায় রাখে, তবু দেখা যায় দু-টাকা ঠকে গেছে। কর্তারা তাই ফিরিওয়ালা বাড়িতে এলে ভারী বিরক্ত হন, গিন্নিদের ধমকটমক করেন। বনমালী তাই দুপুরে বেরোত। ধার বাকিতে জিনিস দিত, ভারী মিষ্টি ছিল তার ব্যবহার। ডবলের বেশি দাম হেঁকে রাখত, যাতে কমিয়ে কমিয়েও গিন্নিরা তল না পায়। বনমালীর জিৎ হত বরাবর। এখন তার শ্যামবাজারের দোকানে ‘ফিক্সড প্রাইস’ লেখা কয়েকটা প্লাস্টিকের ছোট বোর্ড ঝোলে। এখন সে আর কষ্ট করে দর কষাকষির মুখে ফেনা ভোলা ব্যাবসাতে নেই। তা সেই ফিরিওলা বনমালী যখন বাড়ি-বাড়ি যেত তখন সে মানুষের বাড়ির ভিত দেখত, জানলা দরজা দেখত, গ্রিল দেখত, আসবাব দেখত। তার। মন বলত—যদি কোনওদিন হয়, ভগবান সুদিন দেন তো এরকম বাড়ি করব। সামনে বারান্দা থাকবে, তাতে পদ্ম আর রাজহাঁসের নকশাওলা গ্রিল, ঘরে-ঘরে বাথরুম থাকবে, ছাদে থাকবে ঠাকুরঘর…এরকম নানা কথা ভাবত, ভেবে রাখত বনমালী। ঘরে টিউবলাইট, রেডিও, রেফ্রিজারেটার, গ্রামোফোন, সবই থাকবে। আর থাকবে বউ। সুন্দরী লক্ষ্মীমন্ত।

সবই হয়েছে বনমালীর। ভগবানের ইচ্ছা। বাগান হয়েছে, হয়েছে লাল ইটের দেড়তলা ছিমছাম সুন্দর বাড়িখানা। সামনে পদ্ম আর হাঁসের নকশাওয়ালা গ্রিল। গ্রীষ্মের রাতে স্নান করে এসে যখন বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে সে তখনই বেল আর গোলাপের গন্ধ আসে, আরও নানা গন্ধ। সবচেয়ে ভালো লাগে মাটির ভিজে স্নিগ্ধ গন্ধটি। একই মাটি থেকে কোন ম্যাজিকওয়ালা যে এতরকম রং আর রস তৈরি করছে! বনমালীর বিস্ময় এখানেই শেষ হয় না। বসে-বসে সে। চারদিক দেখে। তার বিষয়-সম্পত্তির ওপর যখন আবহমান কালের চাঁদের আলো পড়ে, তখন তার মনে হয়, তার এক জীবনের দারিদ্র্যের লজ্জা কেমন সুন্দর বাগানের ফুলের গন্ধে, বাড়িটার ছিমছাম সৌন্দর্যে ঢাকা পড়ে গেছে। বিষয় হচ্ছে মানুষের আত্মার সবচেয়ে বড় বস্ত্র। কী করে এই দুলর্ভ বস্ত্রটি পেয়েছে! এইটে ভেবেই তার বিস্ময় আর শেষ হতে চায় না। সে চুপ করে বসে থাকে। মুখটি হাঁ হয়ে যায়, চোখে পলক পড়ে না। এইভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেলে তার বউ এসে ডাক দেয়—বলি ভূতে পেয়েছে না কি! ভাবছ কী হাঁ করে!

বনমালী চমকে উঠে তার বউয়ের দিকে চায়। বিস্ময় তার শেষ হয় না সত্যিই। এই যে রমণীটি—এ হচ্ছে তার সেই মহাজনের মেয়ে। খেটেখুটে বনমালী উন্নতি করল দেখে সে ভারী খুশি হয়েছিল। একদিন তাকে ডেকে বলল–দেখ বনমালী, ছেলের মতো তোমাকে দেখেছি এতদিন। দেখলাম, তুমি বাহাদুর বটে। তোমার মতো ছেলেকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে, তোমাকে বেঁধে রাখি। আমার পয়সার অভাব নেই, বড় তিনটে মেয়েকে সোনা জহরৎ আর টাকায় মুড়ে ভালো ঘর-বরে বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ভালো ঘর-বর বলতে লোকে বোঝে টাকাওলা বনেদি বংশ। বনেদি বংশে মেয়ে দিয়ে সুখ পাইনি। জামাইরা সব পৈতৃক টাকায় খায়দায় বাঁশি বাজায়, ঘুড়ি আর পায়রা নিয়ে আছে। পরিশ্রমী, লড়িয়ে মানুষ নয়। ভাবছি শেষ মেয়েটাকে আর ওসব অপদার্থের গলায় ঝোলাব না। তোমার এখন উঠতি সময়, এখনও দাঁড়াওনি। তবু তোমাকেই দেবো, যদি রাজি থাকো।

বনমালী রাজি হয়ে গেল। মেয়েটিকে সে দেখেছিল। সুন্দরীই বলা যায়। রংটা চাপার দিকে, মুখখানা গোলগাল। কিন্তু সব মিলিয়ে চটকদার। ঘন জ্ব, টানা চোখ, গালে টোল। সেই মেয়েটিই এখন তার বউ। বনমালীর এও এক বিস্ময়।

মহাজনের মেয়ে। ওর বাপের না হোক দশ-বারো লাখ টাকার কারবার। যৌবনকালে ওর বড়বাজারের দোকানের সামনের হাতায় ঠান্ডায় বসে থাকত বনমালী। সারা দিনটা কলকাতায় দৌড়ঝাঁপ। পৃথিবীটা তখন ভারী পিছল জায়গা বলে মনে হত। কোথাও দাঁড়ানো যাচ্ছে না। দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেই পা হড়কায়। প্রাণপণে তখন পৃথিবীতে লেগে থাকার চেষ্টা এক নাগাড়ে চালিয়ে যাচ্ছে বনমালী। বাপ রিফিউজি কলোনিতে দু-খানা ঘর তুলতেই মাজা ভেঙে বসে পড়েছে। তার আটটি ছেলেপুলে, বনমালী বড়। তাকে ডেকে বলেছে–রাস্তা দেখ।

তা সারাদিন রাস্তাই দেখত বনমালী। কত রাস্তা, কত অলি-গলি, কী বিচিত্র কায়দায় কলকাতা শহর কেটে-কেটে রাস্তা বানিয়েছে মানুষেরা। তখন বনমালীর বিশ্বাস ছিল, কলকাতা শহরে আগে তৈরি হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট। তারপর সেই জমাট বাড়িঘর আর দোকানপাটের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মানুষেরা শাবল গাঁইতি চালিয়ে এইসব অলিগলি তৈরি করেছে। রাস্তা ঘাটগুলো তাই এমন গোলমেলে।

সারাদিন রাস্তা দেখে-দেখে বনমালী ক্লান্ত হয়ে এ-বাড়ির রক, সে বাড়ির বারান্দায় বসত। লোকে অচেনা লোক বিশ্বাস করে না। হুড়ো দিত। বনমালী আবার উঠে রাস্তায় হাঁটত। ক্রমে সে দেখেছিল রোদ উঠল, গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে ছায়ার জায়গা হচ্ছে বড়বাজার। সেখানে কাটারার ঘিঞ্জিতে কোনওকালে দিনমণির আলো পড়েনি। দুপুরের দিকটায় তাই বনমালীর বাঁধা আস্তানা। ছিল বড়বাজার। সেখানে ব্যাপারি খদ্দেরের ভিড়ে দিব্যি গা-ঢাকা দিয়ে থাকা যেত। হুড়ো যে কেউ দিত না তা নয়। তবু বেশিরভাগ ব্যাপারিই গা করত না। তার মহাজন, হবু শ্বশুরের দোকান ঘরটার সামনে একধাপ সিঁড়িতে বসে থাকত সে। দেখত, দোকান-ঘরে টিউবলাইট জ্বলে, পাখা ঘোরে, খদ্দেরের ভিড় গায়ে-গায়ে, টাকার গাদি লেগে যায় ক্যাশবাক্সে।

মহাজন একদিন এক বড় খদ্দেরকে খাতির করতে গিয়ে বনমালীকে ডেকে বলে—যাও তো খোকা, লাটুর দোকানে তিন কাপ চা বলে এসো তো। বোলো দুখীরামবাবুর চা, তাহলে বেশি দুধ-চিনি দিয়ে দেবে।

সেই হল বনমালীর পয়লা দড়ি, যা দিয়ে নিজেকে সে পিচ্ছিল পৃথিবীর সঙ্গে আজও আটকে রেখেছে। চা বলে এল বনমালী। পরদিন সিগারেট এনে দিল। ক্রমে-ক্রমে মহাজন তাকে দিয়ে আরও ফাইফরমাস করাতে লাগল। যত করায় তত করে বনমালী টু শব্দটিও না করে, ফলের আশা না রেখে। কী করো খোকা? কোথায় থাকো? ’—এরকম দু-একটা প্রশ্নও তাকে মহাজন কখনও-কখনও করেছে।

মহাজনের দোকানে দু-একবার কাপড়ের গাঁট বাঁধল সে। দু-এক জায়গায় মাল পৌঁছে দিয়ে এল। ওইভাবেই একদিন মহাজনের মনের মধ্যে সে সেঁধিয়ে গেল। আর মনের মধ্যে একবার সেঁধোতে পারলে আর ভয় নেই। মানুষের মনই হচ্ছে মানুষের ঠিক বাসা। সে দোকানে ঢুকল বিশ টাকা মাইনের কর্মচারী হয়ে। কয়েকদিন পর মহাজনকে ঘাড় চুলকে বলল–কয়েকখানা বাছাই কাপড় ধারে দিন। মহাজন দিল। গোপনে কাপড় বেচে এল সে, টাকা শোধ করল। এইভাবে তার ব্যাবসার শুরু। ক্রমে-ক্রমে বেশি কাপড়, আরও বেশি কাপড় নিতে-নিতে সে একদিন আলাদা হয়ে ফিরিওলা হয়ে গেল। মহাজন দুখীরাম আপত্তি করেনি। কেবল চোখটা সে খোলা রেখেছিল।

সেই মহাজনকে বরাবর গৃহদেবতার পরের আসনটাই দিয়ে রেখেছিল সে। তার বাড়ির জামাইও যে হওয়া যায় এমনটা তার কখনও মনে হয়নি।

সে রাজি হয়ে গেল। মহাজন দশ হাজার টাকা নগদ দিয়ে সে এক এলাহি বিয়ে দিল তাদের। লোক খাওয়াল হাজার দুই। সেই ম্যারাপ, আলো ফুল লোকজন, উপহার সবই স্বপ্নের মতো মনে হয়। বিয়ের পরও কয়েকদিন সে তার বউয়ের অঙ্গস্পর্শ করতে ভয় পেত। কেমন যেন মনে হত—আরেব্বাস, এ তো মহাজনের মেয়ে!

বলতে কী, বনমালীর আজও তা মনে হয়।

বাগানে জ্যোৎস্না পড়লে কী ফুল ফুটল হাঁ করে দৃশ্যটা দেখে বনমালী। তা সেই মহাজনের মেয়ে যখন এসে তাড়া দেয় তখন বনমালী হঠাৎ মুখ তুলে তার বউকে ঠিক বউ বলে বিশ্বাস করতে পারে না। বিস্তর রাম-চিমটির দাগ বনমালীর শরীরে আজও আছে। স্বপ্ন দেখছে মনে করে নিজেকে জাগানোর জন্য বিস্তর চিমটি কেটেছে।

তা এখন বনমালীর মনে হয়, স্বপ্ন ব্যাপারটা ভারী গোলমেলে। গত কয়েকবছর ধরে সে একনাগাড়েই বোধহয় স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। স্বপ্নের মধ্যেই করছে বসত। সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে—যদি স্বপ্নেই রেখেছ তো শেষ দিনতক আর ঘুমটা ভাঙিও না বাবা।

বনমালী বাহারি বাগান করেছে এইখানে। নানা রঙে রঙিন বাগানের মাঝখানটিতে তার বাড়ি। কলকাতা থেকে জায়গাটা দূরে নয়। কিন্তু কলকাতার বাইরে, বালী মাকালতলা। বাঁশঝাড় আছে, পুকুর আছে, পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ আছে, রাতে শেয়াল ডাকে, জ্যোৎস্না উঠল টের পাওয়া যায়। কলকাতা আর ভালো লাগে না বনমালীর। বিয়ের পরও বছর সাত-আট তার কলকাতার নবীন পাল লেনের পুরোনো ভাড়াটে বাসায় কেটেছে। তার বউ—আসলে যে মহাজনের মেয়ে—সে-ই তাগাদা দিত। বলত ‘বাড়ি করো, বাড়ি না করলে পৃথিবীতে ঠিক শেকড় গাড়ে না মানুষ। তুমি যে বড়লোক, প্রতিষ্ঠাবান, তার প্রথম প্রমাণই হচ্ছে দিনের শেষে তুমি অন্যের বাসায় না ফিরে ফিরছ নিজের বাড়িতে। ভাড়াটে বাড়ির দেয়ালে একটা পেরেক ঠুকলেও বাড়িওয়ালা দৌড়ে আসে। এ আর ভালো লাগে না।’

চৌপর দিন ঘুরে, দালালের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে, বিস্তর দেখেশুনে মহাজনের মেয়ের পছন্দমতো বালীর মাকালতলায় জমি নিল বনমালী। গ্রামও নয় শহরও নয়। ইলেকট্রিক আছে, দোকানপাট আছে। বাড়ি থেকে টানা তার শ্যামবাজারের দোকানে পৌঁছতে বড়জোর পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ মিনিট লাগে।

তার বউ অতসীকে সে বাড়ির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে নিশ্চিন্ত হল। এখন সকালবেলা গৃহদেবতাকে ভূলুণ্ঠিত প্রণাম করে নিজের বাড়ি থেকেই বেরোয় বনমালী।

পৌনে সাতটার ট্রেন ধরে। পৌনে আটটার মধ্যে ধূপধুনো দিয়ে দোকান খুলে ফেলে। বাচ্চা একটা চাকর আছে, সে চা এনে দেয়। বাড়ি থেকে যখন বেরোয় তখন প্রায় দিনই চা খেয়ে আসা হয় না। মহাজনের মেয়ের বেলা পর্যন্ত ঘুমোনোর অভ্যাস। সকালে উঠলে সারাদিন মেজাজ ঠিক থাকে না। ঠাকুর আছে, বাচ্চা একটা কাজের মেয়েও আছে বটে, কিন্তু বনমালী কাউকে খাটায় না। এক গ্লাস ইসবগুলের ভুসি খেয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে চলে আসে। সকালের প্রথম চা-টি খায় দোকানে বসে।

দোকানখানা তার নিজের। একার। কোনও অংশীদার নেই। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের কাছে এই দোকানঘরখানা যদি বনমালী এখন ছেড়ে দেয় তবে লাখ দেড়েক সেলামি লেগে যাবে। বনমালী হাজার দশেক দিয়ে নিয়েছিল দশ বছর আগে।

ঘরখানা বড়ই, একনম্বর সেগুন দিয়ে তৈরি তার বিশাল বিশাল আলমারি, শো-কেস, কাউন্টার। কাউন্টারের গায়ে ইদানীং সানমাইকা লাগিয়ে আরও বাহার খুলেছে। দোকানটা চার ভাগে ভাগ করা। এক কাউন্টারে তাঁত ও সিল্ক, অন্যটাতে মিলের সুতি, সিল্ক, টেরিলিন, একটাতে রেডিমেড, আর সবশেষে হোসিয়ারি। শীতকালে পশমি জিনিস, শাল-মলিদা, সোয়েটার, সুটের কাপড়। লাখ টাকার মাল মজুত রয়েছে দোকানে। কাচের ওপাশে হরেক রঙের বাহার। বনমালীর জীবনে রঙের অভাব নেই। বাড়িতেও রং, দোকানেও রং।

দোকানের ঠিক মাঝখানটিতে একটি কংক্রিটের থাম। ঘরটার ভারসাম্য রাখার জন্যেই তৈরি। চৌকো থামখানা বিশ্রী দেখায়, তাই বনমালী ভালো পালিশ কাঠে থামখানা আগাপাশতলা ঢেকে চারধারে চারটে সরু, লম্বা আয়না লাগিয়েছে। থাম ঘিরে গোল একখানা কাউন্টার। থামের একপাশে পেতলের রেলিংওলা ক্যাশের খোপে বসে বনমালী, অন্য ধারটায় প্যাকিং আর ডেলিভারি।

সাতসকালে ধোঁয়া ওঠা পুরো এক গ্লাস সুগন্ধি চা সামনে রেখে বনমালী হাই তোলে। আর চারদিকে চায়, আলাদিনের গল্পের সেই দৈত্য, নাকি মহাভারতের সেই দানব ময়কার যে কীর্তি তা ঠিক বুঝতে পারে না।

লোকে বলাবলি করে, বনমালী বড় উন্নতি করেছে।

উন্নতি! তা অবশ্য বনমালী অস্বীকার করে না। উন্নতি বইকী! কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা আছে একটা। উন্নতির চেয়েও বেশি হচ্ছে একটা বিস্ময়বোধের জন্মলাভ, এ দোকান যে তারই, সে-ই যে মালিক, এর যে আর কোনও মহাজন নেই সেটা তার ঠিকমতো বিশ্বাস হতে চায় না। এ দোকান সে কি নিজে করেছে! এ কি তারই! তার বর্ণহীন জীবনে এত রঙের বাহার কবে খোলতাই হল!

কারবার দাঁড়িয়ে গেলে আপনিই চলে, তার জন্য হালদারি শিকদারির আর দরকার হয় না। একবার কারবারটা বেঁধে ফেলতে পারলেই হল। পেতলের রেলিং ঘেরা ক্যাশ কাউন্টারে বসে পাখির পালকে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে আরামে আধবোজা চোখে বনমালী দেখে, তার কারবার চলছে। চোখ পুরোপুরি বুজে থাকলেও চলবে। কাপড় মাপা হবে, কাটা হবে, প্যাকিং হবে, ক্যাশে এসে দাঁড়াবে লোকজন, বনমালী টাকা গুনে-গেঁথে তুলবে, ইনকাম ট্যাক্স, পুলিশ, কর্পোরেশন সব বন্দেবস্ত মতো চলবে। মাঝে-মাঝে দুপুরের দিকে বড়বাজারে মাল তুলতে যাবে বনমালী, কিংবা রেল-ইয়ার্ডে মাল ছাড়াতে। কিছু কষ্ট নেই সেইসব নড়াচড়ায়। টাকার ছবিতে বড় বাহার। সব সয়। বড় ছেলেটা দশে পা দিল। মেরেকেটে আঠারো হলেই কারবার বোঝাবে। ততদিন বেঁচে থাকলেই হল। বড় ছেলেটা একটু বুঝে গেলেই আর চিন্তা নেই। শুধু সেটুকুর জন্য, কয়েক বছর সময়ের জন্যে একটু দুশ্চিন্তা তার। মোটা ইন্সিওরেন্স করে রেখেছে নিজের আর বউয়ের, দোকানও ইন্সিওর করা, তবু ভয় একটু থেকেই যায় সেটাকে ইন্সিওর করা চলে না। আর আট-দশ বছর সে কি বাঁচবে না? বাঁচবে, এখনও সে পোক্ত আছে বেশ। মাত্র পঁয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ বছর, ঠিকমতো বাঁচলে আরও বহুদিন তার বাঁচার কথা।

বিকেলের দিকে সত্যচরণ আসে। গাঁটরি বওয়ার আমলে তার সঙ্গে ভাব হয়েছিল। দিনের শুরুতে ঠিক করে নিত কে কোন রাস্তায় ফিরি করবে। সেই থেকে বন্ধুত্ব। সত্যচরণ তেমন কিছু করতে পারল না। রিফিউজি কাটারায় দোকান দিয়েছে একটা। চলে না তেমন। স্টকও রাখতে পারে না। শরীরটাই সত্যচরণের জুতের নয়। রোগা-ভোগা, তার ওপর নেশা-ভাঙ, একটু মেয়েমানুষের দোষও ছিল, গায়ে পারা উঠে যাচ্ছেতাই ভুগেছিল একবার। জমানো টাকা সব তাতেই গলে গেল। শেষমেষ রিফিউজি কাটারায় দোকান ছাড়া আর উন্নতি করতে পারল না সে। ছেলেরা বড় হয়েছে, তাদের মধ্যে বড়টি দোকান দেখে, সত্যচরণ আসে বনমালীর দোকানে। দরজার কাছে টুলখানায় বসে থাকে। ছ’টা বাজলে বনমালী ক্যাশে সবচেয়ে বুড়ো আর বিশ্বাসী কর্মচারী সুধীরবাবুকে বসিয়ে বেরিয়ে আসে।

দুই বন্ধুতে তেমন কোনও কথা হয় না, বনমালী একটা সস্তার নেশা শিখেছিল। মোক। হেমদ কবিরাজের দোকানে এক সময়ে যেত বাবার জন্য স্বর্ণ-সিঁন্দুর কি চ্যবনপ্রাশ আনতে। সেই থেকে মদনানন্দ মোদকের বিজ্ঞাপনটা খুব টানত। হেমদার পর বরদা কবিরাজের আমলে সাহস করে কথাটা পেড়েছিল সে মোক একটু খেলে বোধহয় প্রফুল্ল থাকা যায়, কী বলেন বরদাবাবু?

খুব হেসেছিলেন বরদা, বললেন—লজ্জার কী? প্রফুল্ল থাকলেই হয়।

সেই থেকে সে বাঁধা খদ্দের! নেশা কে নেশা, গন্ধ বেরোয় না, মাতলামি নেই, কেবল একটা বুদ হয়ে যাওয়া আনন্দের ভাব আছে।

সেবার যখন সত্যচরণ লিভারের বারোটা বাজিয়ে ক’দিন প্রাণান্তকর ন্যাবায় ভুগে উঠল তখন তার বউ তাকে দিয়ে মা কালীর পা স্পর্শ করিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয় যে মদ খাবে না। মদ ছেড়ে ভারী মুশকিলে পড়ে গেল সে। বনমালী তখন তাকে মোদক ধরায়। বরদা কবিরাজের দোকানে এখন দৈনিক যাতায়াত, কবিরাজও বন্ধু হয়ে গেছে। পয়সার বেশ সাশ্রয়। কেবল সত্যচরণ। খুঁতখুঁত করে বলে—মাইরি বরদাবাবু, শুনেছি মৃতসঞ্জীবনীতে নাকি এইট্টি পারসেন্ট অ্যালকোহল আছে।

—আরও কম। বরদা কবিরাজ চেয়ারে কেতরে বসে হাঁটু দুটো তুলে নাড়তে নাড়তে বলে।

—তোমরা কি আর সেই অ্যালকোহল দাও নাকি! বলে সত্যচরণ হাই তোলে।

—তবে কী দিই?

–কাঁচা ধেনো। একটা বোতল দিও তো, চেখে দেখব।

বনমালী কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলে–যা নিয়ে আছ তাই নিয়ে থাকো। একটারই বশ হও।

সত্যচরণ রোগে ভুগে খেকি হয়ে গেছে, সহজেই খ্যাঁক করে ওঠে। বলে—সেইজন্যই তো তোমার টাকা ছাড়া আর কিছু হল না! তুমি ওই একটি জিনিসের বশ।

—আর কী হবে শুনি! বনমালী দাপটে বলে।

সত্যচরণ তখন কথা খুঁজে পায় না। বিড়বিড় করে।

নেশা জমে এলে বনমালী মিটিমিটি হাসে—টাকা হলে সংসারী মানুষের আর কী হওয়ার থাকে! অ্যাঁ! আমি ভেবে তো পাই না। কী বলেন বরদাবাবু?

বরদার বাপকেলে ব্যাবসা এখন ঝুল। পুরোনো আমলের ঘরভাড়া কম বলে দোকান টিকে আছে। যুদ্ধের বাজারে লাখোপতি হওয়ার জন্য বরদা বিস্তর পাথর কুচির ব্যাবসা করতে গিয়ে ঘোল খায়, নইলে এতদিনে সে দোকান তুলে দিত। এখন দোকানের কলে ইঁদুরের মতো আটকে পড়ে গিয়ে খাবি খায়। মাদকের খদ্দেররাই বাঁচিয়ে রেখেছে সালসাটালসা, সুধা কিংবা পাঁচন চলে না। বরদা কবিরাজ তাই ফলাও মোদক বানায়। খদ্দের প্রায় বাঁধা। বনমালীর কথা শুনে একটু ছটাকে হাসি হেসে বলে—তাই তো। টাকাই হচ্ছে সংসারের সুতো, যেমন ইচ্ছে মালা গাঁথা যায়।

সত্যচরণ সেটা মানতে চায় না। বলে—বনমালী, তোমার সত্য উপলব্ধিই তো হল না। এই যে পৃথিবীতে জন্মেছ, এর ক’টা জায়গা দেখলে তুমি? ক’টা মানুষের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা হল? জীবনের একশো মজা আছে তার কটা মজার স্বাদ পেয়েছ? মদ খেলে না, মেয়েমানুষের কাছে গেলে না, কাশী হরিদ্বার বৃন্দাবন কি লন্ডন নিউইয়র্ক গেলে না—ধুস ওটা কি জীবন? তুমি হচ্ছ গিয়ে সাদা দেওয়াল, ছবি ছক্কর নেই, রং নেই, দূর-দূর…সাঁঝের বেলা মোদক চেটে ভাম হয়ে বসে থাকো, এর বেশি তোমার আর কিছু হল না।

ততক্ষণে নেশা জমে আসে। চোখে লাল নীল নানারকম রং দেখে বনমালী। দেখে কলকাতার রাস্তাঘাটে কেমন সব বাহারি রং কেমন আলো, কেমন মিঠে বাতাস বইছে! এসময়ে তার মনের ওপর একরকম মাখনের প্রলেপ পড়ে যায়। কোনও কথাতেই রাগ হয় না, বরং ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। সত্যচরণের কথা শুনে তাই সে মৃদু হাসে। দুলে-দুলে হাসে। তারপর বলে বিশ্বরূপ দেখতে ত্রিভুবন ঘুরতে হয় না; আমি আমার দোকানে বসেই দেখি।

—আমার ইয়ে। বলে সত্যচরণ। তারপর মৃদু হেসে বলে—আর এক বিশ্বরূপ তোমার পরিবারের রূপে। তোমার মতো মাদি পুরুষ দেখিনি হে! অত ন্যাওটা হয়ো না বনমালী, একটু নিজের সংসারের বাইরের দুনিয়াটাকেও দ্যাখো!

বনমালী ঝিমুনোর মধ্যেই বলে–যারা বাউণ্ডুলে তাদের ঘরে জায়গা হয় না, পরিবার বের করে দেয় বাড়ি থেকে। তখন তাদের অগত্যা বিশ্বরূপ দেখতে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। সত্যচরণ, সাফল্যের মধ্যে যে বিশ্বরূপ আছে তা তোমার দেখার কপাল নেই।

তর্ক হয়, ঝগড়াঝাঁটি হয়। তারপর একটা টানা রিকশায় উঠে দুজনে ফিরে আসে। বনমালী ফিরে ক্যাশ মেলায়। সত্যচরণ হেঁটে বাড়ি ফেরে। যতটুকু বনমালীর রিকশায় আসা যায় ততটুকুই লাভ, তারপরের রাস্তাটুকু তার নিজের।

বনমালী জানে সত্যচরণ তাকে গাল পাড়তে-পাড়তে বিড়বিড় করে বকতে-বকতে বাড়ি ফেরে। তা হোক। বনমালীর রাগ হয় না। সত্যচরণের সঙ্গে তার অবস্থার তফাতটুকুই প্রমাণ করে যে বনমালীর উপলব্ধি সত্য। সত্যচরণেরটা হচ্ছে গিয়ে প্রলাপ। তার রাগ করার দরকার হয় না।

ন’টা সাতের ট্রেনটা রোজ পায় না বনমালী। তার পরের ট্রেন ন’টা পঞ্চান্নোয়। লম্বা সময়। হাওড়া স্টেশনের মুখে বারোমাস কয়েকটা ছোকরা কাটামুণ্ডুর মতো ঝুঁটি ধরে কানফুল নাকফুলের মতো ছোট ফুলকপির আঁটি বিক্রি করে। হাতে সময় থাকলে অসময়ের কপি সওদা করে বনমালি, স্টেশনের বাইরের দোকান থেকে মহাজনের মেয়ের জন্য ফল কেনে। মর্তমান কলাটা আবার মহাজনের মেয়ের বড় পছন্দ। ছেলেপুলের জন্য খেজুর কি আমসত্ব লিচু বা আম—সময়ের ফলপাকুড় কেনে। সওদা করেও সময় থাকে। তখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অন্যমনে নানা কথা ভাবে। বেশিরভাগই বাকি বকোয়া, মন্দা বাজার, সোনার দর, আয়কর, জমি ইত্যাদির কথা। কখনও-সখনও সত্যচরণের বিশ্বরূপের কথাও ভেবে ফেলে। সত্যটা পাগল। একটা জীবন। ফুস্কুড়ি করে কাটিয়ে দিল।

ট্রেনে পনেরো মিনিট বালী স্টেশন, তারপর মিনিটছয়েকের হাঁটাপথ। বাগানের ফটকে পা দিতেই অন্য জগতে চলে আসে বনমালী। ছবির মতো বাড়িখানা তার, চারদিকের ফুলবাগিচায় ডুবে আছে। নানা ঘরে নানা আলো, দরজায় পাতলা রঙিন লেস-এর পরদা ওড়ে। লাল, সবুজ, নীল, হলুদ সব টিউবলাইট জ্বলে ঘরে-ঘরে। ধূপগন্ধ পাওয়া যায়। রেডিয়োর শব্দ আসে। ভালো রান্নার গন্ধ।

বাগানের ফটক থেকেই বনমালীর দ্বন্দ্বের শুরু হয়। এই বাড়ি কি তার! এই বাগান, ওই আলো, ঘরে-ঘরে সব দামি আসবাব, এ সব কি তার! মনে কিছুতেই বিশ্বাসটা আসে না। ঘেমো শরীর, সারাদিনের পরিশ্রম, চিন্তা সব মিলিয়ে বনমালীর ভিতরটা শুকিয়ে থাকে। ভিতরে ভিতরে সে জানে পৃথিবীতে খুব সাধারণভাবে বেঁচে থাকাটাও কত কষ্টকর! কী পরিশ্রমটাই গেছে এক জীবনে! তাই বোধহয় এত আলো, মহার্ঘ জিনিসপত্র, বাগান, এসব দেখে তার ভিতরটা কেমন। চমকে ওঠে। এখানে রিফিউজি কলোনিতে তাদের পরিবার আলাদা পড়ে আছে। মা-ভাই-বোন। সম্পর্ক না থাকার মধ্যেই। বনমালী মাস-মাস এক-দু-শো ধরে দেয়, ভাইরা খেটে খায়, একটা বোনের বিয়ে বাকি। সে বাড়িতে গিয়ে পা দিলে দুর্ভাগ্যজনক অতীতটা যেন হুড়মুড় করে মাথায় ভেঙে পড়ে। সব মনে পড়ে যায়! সেই দুর্ভাগ্যের দিন তো খুব বেশি দূরে ফেলে আসেনি সে, তাই মনে পড়ে। এইসব বাড়িঘর, আলো, বাগান আবিশ্বাস্য লাগে।

মহাজনের মেয়েকে খুশি করা সহজ কথা নয়। টাকার খেলা সে মেয়ে দেখেছে বিস্তর। তাই বনমালীর অবস্থা ফিরলেও সে এখনও পুরোপুরি খুশি নয়, বাড়িঘর সে-ই সাজায়, ঘরে-ঘরে নানা রঙের আলো জ্বালে, ছেলেমেয়েদের নিত্যনতুন পোশাক পরায়, নিজেও সাজে খুব। তাকে খুশি রাখার জন্যই পরিবারের সঙ্গে আর একত্র হল না বনমালী, বাড়ির লোকেরা তার কুৎসা গায় সেইজন্যে। বলে-মেড়া, কামাখ্যার যোগিনীদের বশ-করা পুরুষমানুষ—আরও কত কী! এত করেও মহাজনের মেয়ের মন পাওয়া গেছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বাড়িতে ফিরে বরাবর তার নিজেকে অতিথি-অতিথি মনে হয়, ভয়ে-ভয়ে অস্বস্তিতে আলগা-আলগা থাকে সে। পরিষ্কার গেঞ্জি পরে, দামি লুঙ্গি, চুল আঁচড়ায়, পায়ে মোষের-নাক চটি, রোজ দাড়ি কামাতে হয়। —বিস্তর ঝামেলা। হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে, বিড়ি ফুকে, বিছানায় গড়ানোর গার্হস্থ্য আয়েস তার কপালে নেই। মহাজনের মেয়ে সব টিপটপ চায়। ছেলেমেয়েদের যে টেনেহিঁচড়ে বুকে নিয়ে হামলে আদর করে চিড়বিড়ে ভালোবাসা মেটাবে তারও উপায় নেই। ছেলেমেয়েরা মায়ের শাসনে আলগা থাকে, গায়ে-গায়ে মাখামাখি বারণ। মাঝে-মাঝে জ্যোৎস্না উঠলে, কি ফুলের গন্ধ ছুটলে, কি অকারণ পুলকে মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে, বউকে বুকে চেপে ধরে লন্ডভন্ড করে দেয়। পোশাক, গাল কামড়ে ধরে আলগা দাঁতে, ঝামরে দেয় বাঁধা চুল। কিন্তু তা করতে গিয়ে থমকে যায়। সেই পুরোনো গণ্ডগোল। বউকে বউ মনে হয় না, মনে হয়—এ তো মহাজনের মেয়ে! ভারী একটা ভয়-ভক্তির ভাব এসে পড়ে তখন।

মোদকটা অনেকক্ষণ ধরে শরীরের ভিতরে খেলা করে। রিমঝিমে একটা আনন্দের ভাব।

দেহ নিশপিশ করে। সুন্দর বাগানের ভিতর দিয়ে বারান্দা পর্যন্ত কংক্রিটে বাঁধানো চওড়া রাস্তা পার হতে-হতে সে দেখে, বারান্দায় মহাজনের মেয়ে দাঁড়িয়ে। গায়ে একটা নেট-এর ফুলহাতা ব্লাউজ, বুকে পেটে অনেকখানি খোলা জায়গা। এ ছাঁটের ব্লাউজ বনমালীর দোকানেও রাখা হয় না। মহাজনের মেয়ের পোশাক নিউমার্কেট থেকে আসে। পরনের মিহিন খদ্দরের ছাপা শাড়িটা। পর্যন্ত বনমালীর দোকানের নয়।

—বাঃ-বাঃ! বনমালী খুশি হয়ে বলে—দিব্যি কাটটা তো ব্লাউজের! স্টক করব নাকি!

—তোমার তো কেবল স্টকের চিন্তা। একটা জিনিস চোখে পড়েছে যখন, তখন তার সৌন্দর্যটা দ্যাখো, তা না স্টক।

লজ্জা পায় বনমালী। হেঁহেঁ করে হেসে বলে—চোখে লাগল বলেই তো বললাম।

বউ গম্ভীর হয়ে বলে বাড়িতে এসে যখন দোকানদারি পোশাকটা ছাড়বে, তখন দোকানদারি স্বভাবটাও ছেড়ে ফেলবে। আমার বাবা বাড়িতে মেজাজি জমিদারের মতো থাকতেন।

বনমালী যে একদিন ফিরিওলা ছিল তা বোধহয় অতসী ভুলতে পারে না। দোষ নেই। নিজের অবস্থাকে আজও তো নিজেই সঠিক বিশ্বাস করতে পারে না বনমালী!

স্বপ্ন! সবই স্বপ্ন। মার্বেল মাজা বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে ওডিকোলোন আর দামি পাউডারের গুঁড়ো গায়ে মেখে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে বনমালী। বাগানে জ্যোৎস্না পড়ে, ফুলের গন্ধ আসে। নিজের গা থেকে প্রসাধনের গন্ধ ছড়ায়। পাশেই হেলানো চেয়ারে বসে থাকা অতসীর গয়নার টুং টুংশোনা যায়। স্বপ্ন ছাড়া আর কী!

টেবিলে বসে রাতের খাবার খায় সে। মোদকের নেশার রেশটা তখনও থাকে। খাবারের স্বাদ ভারী ভালো লাগে। ছেলেমেয়েরা সব ইংরেজি স্কুলে পড়ে। অতসীর কড়া নিয়ম, বাড়িতেও ভাইবোনেরা পারতপক্ষে ইংরেজিতে কথা বলবে। খাওয়ার টেবিলের এধারে-ওধারে ছেলেমেয়েরা পরস্পরের দিকে ইংরেজি কথা ছুড়ে দেয়, লুফে নেয়, বাবার দিকে চেয়ে হাসে। বনমালী ভালো বোঝে না, কিন্তু ভারী একটা সুখ হয়। সেও হাসে। এ যেন কোনও-না-কোনও বড়লোকের সাহেবি কেতার খাওয়ার ঘরে তার মতো উটকো এক লোকের নিমন্ত্রণ, অস্বস্তিটা মোদকটাকে ধাক্কা মারে, নেশাটা ফিকে হয়ে আসে প্রায়। তবু হাসে বনমালী, সুখও হয়।

সত্যচরণ মাঝে-মাঝে দুহাতের বুড়ো আঙুল অশ্লীল ভঙ্গিতে নেড়ে তাকে দেখিয়ে বলে—এত যে করলে হে, কিছুই তোমার নয়। যখন পটল প্লাক করার সময় হবে তখন বুঝবে কী গু-খোরের কাজই করেছ একটা জীবন। নিজেকেই জানলে না বনমালী।

ফক্কড়। সত্যচরণের কথা ভাবতেই তার ওই শব্দটাই কেবল মনে আসে। রাতে ভালো ঘুম হয় বনমালীর। চারদিক নিশুত হয়ে গেলে সারা বাড়ি জুড়ে কে যেন, কারা যেন কেবলই খুটখাট শব্দ করে। উদ্বেগ। মহাজনের মেয়ে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এক খাটে ঘুমোয়। বনমালীর ঘর আলাদা, বিছানাও, তবু পাছে মহাজনের মেয়ের ঘুম ভাঙে সেই ভয়ে বনমালী বাতি জ্বালে না। টর্চ জ্বেলে-জ্বেলে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। দরজা-জানলা ঠেলে দেখে, গ্রিলের দরজার তালা নেড়ে দেখে। আবার শোয়, ঝিমুনি আসে। আবার শব্দ পেয়ে ওঠে।

জ্যোৎস্না ফুটেছে খুব। অন্ধকারে ভূতের মতো ঘর থেকে ঘরে ঘুরতে-ঘুরতে বনমালী তার বিষয়-সম্পত্তি দেখতে পায়। দেখে বাগানের জ্যোৎস্না। সুখ তাকে খামচে ধরে। সুখ তাকে যন্ত্রণা। দেয়। সত্যচরণ বলে—একটা জীবন পরের ঘরেই বাস করল বনমালী, সেটা টেরই পেল না। ফক্কড়, কে কার ঘরে বাস করে দেখে যা হারামজাদা। চিরকাল মদ-মেয়েমানুষের পিছনে উচ্ছন্নে গেলি! থু!

বেঁটে একটা ডেশান্ড কুকুর আছে অতসীর। কর্মের নয়। কেবল হাত-পা চাটে, আর পায়ে পায়ে ঘোরে। মাঝে-মাঝে ভুক-ভুক করে নরম আদুরে আওয়াজ ছাড়ে। বনমালীর সঙ্গে প্রায়। রাতেই সেটাও ইঁদুরের মতো বেঁটে-বেঁটে পায়ে তুরতুর করে ঘোরে।

ছাদের সিঁড়িঘরের দরজা দেখে পিছু ফিরতেই সে কুকুরটার লেজ মাড়িয়ে দিল। বলল—আঃ হাঃ, ব্যথা পাসনি তো! কুকুরটা আদুরে আওয়াজ ছাড়ে। গ্রিলের গেট-এ একটা শব্দ হয়। কে যেন। দরজা নাড়ে।

বনমালী টর্চ জ্বেলে নেমে আসে। কুকুরটা দৌড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে ফিরে আসে। পায়ের চারধারে ঘোরে। বনমালী গাল দেয়–ব্যাটা নিষ্কর্মা।

সদরটা খুলে বারান্দায় পা দিতেই ভীষণ চমকে যায় বনমালী। কোলকুঁজো এক মানুষ, গ্রিলের ওধারে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে।

চিলের মতো চিল্কার করে সে–কে?

ছায়াটা ফিসফিস করে বলে—দাদা, আমি গো, আমি হরিপদ।

বনমালী ভারী অবাক হয়,–হরিপদ? এত রাতে তুই কোত্থেকে?

—একবার বাড়ি চলো, মার অবস্থা খুব খারাপ।

—মা? বনমালী যেন কিছুক্ষণ বুঝতে পারে না। বাগবাজারের দোকান কি মাকালতলার বাড়ি জুড়ে তার যে জীবন তাতে মা তো নেই!

—অবস্থা কেমন বললি?

—ভালো নয়। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। রাত বোধহয় কাটবে না।

বনমালী চাবি এনে দরজা খোলে। চোরের মতো সাবধানে ঢোকে হরিপদ। এইসব বাড়িঘর দেখে তাদের অভ্যাস নেই, দাদা-বউদি নিষ্পর! বলে–কুকুর সামলাও।

–কামড়াবে না, ঘরে আয়। শব্দ সাড়া করিস না, তোর বউদির আবার পাতলা ঘুম।

অন্ধকারেই মাথা নাড়ে হরিপদ–না, না, সেসব আমরা জানি।

ঘরে এসে দুই ভাই অন্ধকারে মুখোমুখি বসে। বাতি জ্বালে না বনমালী, মহাজনের মেয়ের ঘুম বড় পাতলা।

–কী হয়েছে?

হরিপদ মাথা নীচু করে বলে—কী আর হবে। বুড়ো হয়েছে! বয়সটাই তো রোগ। যেবার বাবা ফেঁপে-ফুলে মরে গেল, সেই থেকে মা আর মা নেই। তুমি তো অতশত খবর রাখে না। মার বড় টান ছিল তোমার ওপর।

ফিসফিস করে বনমালী জিগ্যেস করে—কীরকম টান?

হরিপদ বলে—দেরি কোরো না দাদা, যদি যেতে চাও তো চলো, সাড়ে বারোটায় শেষ ট্রেন। যদি তুমি না যাও, আমাকে ফিরতেই হবে।

বনমালী তবু ওঠে না, একটু চুপ করে থেকে বলে—যাচ্ছি। টানের কথাটা কী যেন বলছিলি!

—মার খুব টান ছিল তোমার ওপর। প্রায়দিনই তালের বড়াটা, নারকোলের নাড়ুটা বানিয়ে কৌটোয় ভরে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিত তোমাকে দেওয়ার জন্য।

—তোরা কখনও দিসনি তো!

—দেব কী! বউদি রাগারাগি করবে হয়তো, আর সেসব কি এখন আর তোমরা খাও! ভালো ভালো খাবার তোমাদের। আমরা তাই সেসব নিজেরাই লুকিয়ে খেয়ে ফেলতাম। তবু মা মরে মরে তৈরি করত। কতদিন তোমাকে দেখতে চেয়েছে! গত তিন-চার মাস একটানা মা তোমাকে দেখেনি। দাদা, ওঠো। বেশি সময় নেই।

—উঠি। বলে একটা শ্বাস ছাড়ে বনমালী।

–উঃ দাদা, কী পেল্লায় বাড়িখানা বানিয়েছ, কী বাগান!

বনমালী ধমক দেয়—আস্তে। তোর বউদি উঠে পড়বে। শব্দ করিস না।

হরিপদ মিইয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে—প্রত্যয় হয় না।

—কী?

—এসব যে তোমার!

—আমারও হয় না। বলে বনমালী অন্ধকারেই কাপড় বদলাতে-বদলাতে বলে-হরিপদ–

–উঁ।

—তোর বউদি জেগে যাবে, এইটাই ভয়। নইলে—

–নইলে কী?

বনমালী আবার একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—নইলে আমি একটু কাঁদতুম। আমার বড় কাঁদতে ইচ্ছে করছে রে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *