৭
হরিণ ডাকতে লাগল খুব জোরে জোরে ওদিক থেকে। বাঁদিক থেকে বাঁদরগুলো প্রচণ্ড চিৎকার শুরু করে দিল হুপ হুপ করে। ট্যাকটার কাছাকাছি পৌঁছে ঋজুদা ফিসফিস্ করে বলল, রুদ্র, খুব সাবধান। এবার আর আগে পিছে নয়। তুই এখানে দাড়া, আমি একটু গাছে উঠে দেখি।
তারপর নিজের মনেই বলল, তোকে আজও না আনলেই ভাল হত।
আমি রাইফেল রেডি-পজিশানে নিয়ে দাড়ালাম। ঋজুদা জুতোটা খুলে রাইফেল হাতেই তর্ তর্ করে গাছে উঠে গেল। গাছে উঠেই কী যেন দেখতে পেয়েই রাইফেল তুলল সেদিকে। তখনও হাঁফাচ্ছিল ঋজুদা। ব্যাপারটা কী বোঝার আগেই গুড়ুম করে শব্দ হল। একটা মোটা ডালে রাইফেল রেস্ট করে রেখে গুলি করল ঋজুদা।
আমি নীচে দাঁড়িয়ে সামনের ঝোপ ঝাড়ের জন্যে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিছুই। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মনে হল গাছপালা সব বাঘের গর্জনে গুঁড়িয়ে যাবে। সে যে কী গর্জন তা নিজের কানে না শুনলে বোঝা যায় না। গর্জনটা আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিকে একটু এগিয়ে এসেই থেমে গেল।
ঋজুদা আরও কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তখন আমার ঋজুদার দিকে তাকাবার অবসর ছিল না। সামনে গুলি খাওয়া বাঘ। টেন্স হয়ে সামনে চেয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমি রাইফেল রেডি রেখে।
ঋজুদা গাছ থেকে নেমে ফিফিস্ করে বিরক্তির গলায় বলল, নাঃ! ওয়ার্থলেম্। শিকার ছেড়ে দেব আমি। এমন ফিজিক্যালি আন্ফিট্ হয়ে গেছি না! গাছে উঠতেই হাঁপিয়ে গেলাম। কচ্ছপের মতো মোটা হয়ে গেছি।
আমি বললাম, গুলি কোথায় লেগেছে?
ঋজুদা রাইফেলের ব্রীচ খুলে এম্পটি কার্টিজটা ফেলে নতুন গুলি ভরছিল। সফট-নোজড়, বুলেট।
ফিসফিস করেই বলল, বাঘের পায়ের সামনে, মাটিতে পড়েছে গুলি। তারপর বলল, বাঘ এখন সাক্ষাৎ যম হয়ে রয়েছে। কালকের গুলি বুক আর পেটের মধ্যিখানে পাঁজরে লেগেছে। পেটে ভীষণ যন্ত্রণা, কিন্তু মেরুদণ্ড ও সামনের ও পিছনের পায়ের সব জোরই আছে। বেচারাকেও কষ্ট দেওয়া হল, আমাদের ঝুঁকি বাড়ল অনেক।
তারপর বলল, এইবারেই চার্জ কেন করল না বুঝলাম না।
আমি বললাম, বাঘটা গেল কোনদিকে?
তাই তো দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না। একটু এগিয়ে এসে ঘন আত্তারগ্রোথে লুকিয়ে গেল। তারপর আড়ালে আড়ালে যে কোনদিকে গেল দেখা গেল না।
একটু থেমে বলল, এবারে কিন্তু খুউব সাবধানে এগোবি।
আরও কিছু দূরে ডানদিকে গিয়ে আমরা ট্যাকের দিকে এগোতে লাগলাম। যাতে বাঘের মুখোমুখি না পড়ি। ঋজুদা চাইছিল পাশ থেকে বাঘকে পেতে, যদি ব্রড-সাইড শট্ পায় একটা।
ট্যাঁকের কাছাকাছি আসতেই মনে হল যেন শ্মশানে এসেছি। পাখি নেই, প্রজাপতি নেই, পোকামাকড়, বাঁদর, হরিণ কিছুই নেই। নিথর নিস্তব্ধতা। কেবল মোহনার কাছে দূরের চরে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার শব্দ।
একটা সুঁতিখাল নেমে এসেছে ট্যাঁক থেকে। চলে গেছে, আমরা যেখানে পরশু রাতে নোঙর করেছিলাম সেদিকে।
ঋজুদা আমাকে বলল, তুই এই বাঁ খালের পাড় ধরে এগো রুদ্র, খুব সাবধানে। আমি ট্যাকের দিকে যাচ্ছি। যদি আমাকে দেখে এই খালে নামে বাঘ, তবে তোর দিকে আসবে। দেখা মাত্রই গুলি করবি। সময় দিবি না একটুও। তাতে যদি ভাইটাল জায়গায় না লাগে নাই-ই লাগল। রিপিট করবি সঙ্গে সঙ্গে! বাঘ একটু সময় পেলেই আমাদের ভীষণ মুশকিল হয়ে যাবে।
আমি বললাম, আচ্ছা!
ঋজুদা যাওয়ার আগে আমার কাঁধে বাঁ হাত দিয়ে চাপ দিল। বলল, ওয়াচ আউট্। অ্যাণ্ড গুড লাক।
এবার আমি একা। উত্তেজনায় রাইফেলের কুঁদোয় রাখা আমার ডান হাতের তালু ঘেমে উঠেছে। এরকম সাঙ্ঘাতিক পরিবেশে এর আগে ঋজুদা কখনও আমাকে একা ছাড়েনি। আজকে ঋজুদার সঙ্গে আমার চেয়েও বেশি অভিজ্ঞ আর কেউই নেই। তাছাড়া আমার প্রচণ্ড উৎসাহও হয়তো আর একটা কারণ।
স্মৃতিখালের পাড়ে পাড়ে এক-এক পা করে আমি এগোচ্ছি। খালের মধ্যে এবং দু পাড়ে দেখতে দেখতে। এখন আর ঋজুদাকে দেখা যাচ্ছে না।
ভাঁটি দিয়েছে। ছোট ছোট রূপোলি মাছ লাফাতে লাফাতে জলের তোড়ে নেমে আসছে খাল বেয়ে।
খালের সঙ্গে সঙ্গে বাঁক নিতেই একটা অতর্কিত আওয়াজে চমকে উঠলাম। একটা বিরাট বড় মাছরাঙা—নীল আর লাল — মাছ ধরছিল খালপাড়ে বসে। হঠাৎ কেন যেন ভয় পেয়ে চিৎকার করে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে।
আমার বুকের ভেতরটা ধক্ ধক্ করে উঠল।
একটু একটু করে সাবধানে এগোচ্ছিলাম। কতক্ষণ কেটে গেছে! কে জানে? পনেরো মিনিট না আধঘণ্টা? গাছের পাতার দিকে চেয়ে দেখলাম হাওয়াটা কোন্ দিক থেকে বইছে? আমার সামনের দিক দিয়েই আসছে হাওয়াটা। মাঝে মাঝে তাই পিছনদিক ও দু পাশটা দেখে যেতে লাগলাম।
আর একটু এগোতেই হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ল। সুঁতিখালের ভাঁটি-দেওয়া জল তখন চার ইঞ্চি মতো আছে। সেই নেমে যাওয়া জলে, উপর থেকে রক্ত মিশে আসছে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাইফেলটা কাঁধে লাগিয়ে, সেফটি ক্যাচ অন করে খুব আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে এগোতে লাগলাম। এবারে জলটা আরও লাল। কিসের রক্ত ধুয়ে আসছে?
সামনেই নালাটা বাঁক নিয়েছে আর-একটা। ইঞ্চি-ইঞ্চি করে এগোতে লাগলাম এবারে। বাঁকের মুখে এসেই দেখি একটা উটের সমান বড় বাঘ জলের মধ্যে সোজা হয়ে বসে আছে।
বাঘটা ট্যাকের দিকে মুখ করে নিবিষ্টমনে চেয়ে আছে। ঋজুদাকে দেখেছে বোধহয় অথবা শুনেছে তার পায়ের শব্দ। আমার দিকে শরীরের বাঁ পাশটা। লেজটা জল ছাড়িয়ে ভাঁটি-দেওয়া খালের নরম কাদায় নোয়ানো আছে। কাদায়, জলে, রক্তে বাঘটা মাখামাখি হয়ে গেছে। চারটে পাঁচনম্বরি ফুটবলের মতো গোল মাথাটা। এত বড়। বাঘটার পেটটা ওঠানামা করছিল নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে। আমার বুকটা এত ধক্ ধক্ করতে লাগল যে, মনে হল আমি হার্ট-ফেল করব। .
তারপর চুল চুল করে রাইফেলের নলটা ঘুরিয়ে অনেক যত্নে এইম্ করলাম। আমার মন বলছিল যে, এত কাছ থেকে আমি যদি মিস্ করি, তো বাঘ আমাকে কইমাছের মতোই চিবিয়ে খাবে।
আমি বাঘের বুকের বাঁদিকে এইম্ নিলাম। তারপর যত শক্ত করে পারি রাইফেলটাকে ধরলাম। হোল্ডিং ভাল না হলে কখনও এইম্ ঠিক হয় না। কখন যে টি গারে ফার্স্ট প্রেশার অনুভব করলাম আমি নিজেও জানি না।
হঠাৎ যেন আমার অজান্তেই গুলিটা শব্দ করে বেরিয়ে গেল।
বাঘটা সোজা একটা লাফ দিয়ে উঠল; একেবারে সোজা বোধহয় হাত পনেরো কুড়ি হবে, তারপর ঝপাং করে পড়ল এসে খালের জলে, নরম কাদায়। এবার ওর মুখ আমার দিকে। বাঘটা সমস্ত শরীরটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল, লেজটা একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে ফেলতে লাগল শক্ত লাঠির মতো করে। নরম কাদায় লেজের বাড়ির শব্দ হচ্ছিল পত্ পত্ করে।
কখন যে রিলোড করেছিলাম আমার মনে নেই। বোধহয় রিফ্লেক্স অ্যাকশানে। বাঘটা লাফিয়ে ওঠার আগেই আবার গুলি করলাম। এবারে গুলিটা গিয়ে লাগল ঘাড়ে। বান্টা ঐরকম লাফাতে-যাওয়া অবস্থাতেই থরথর থরথর কাঁপতে লাগল। তারপর, জাবি না কতক্ষণ পরে—ওর মাথাটা সামনের দু পায়ের থাবার উপর এবং কাদার মধ্যে নুয়ে এল।
আমি ততক্ষণে বাঘটার দিকে চেয়ে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কিছু যে আছে—আমিও যে আছি–তাও আমার খেয়াল ছিল না তখন।
ঘোর ভাঙল, প্রথমে একটা লম্বা ছায়া দেখে। ছায়াটা পড়ল খালের মধ্যে আড়াআড়ি। তারপর ঋজুদার গলার স্বরে।
ঋজুদা খালের অন্য পাড়ে বাঘটার ঠিক মাথার উপরে দাঁড়িয়ে ছিল। রাইফেলট। কাঁধে তুলে, ব্যারেলটাকে বাঘের দিকে করে।
ঋজুদা বলল, রুদ্র, সেফটি-ক্যাচ্ অফ করে নে।
আমি সেফটি-ক্যাচ, অফ করে, টি গার থেকে আঙুল সরিয়ে ব্যারেল ধরে রাইফেলটাকে কাঁধে ফেললাম।
ঋজুদা সুতিখালে নেমে, লাফিয়ে খালটা পার হয়ে আমার দিকে দৌড়ে এগিয়ে এল। মুখময় হাসি। সে মুহূর্তে ঋজুদার মুখ দেখে মনে হল, বাঘটা আমি মারায় তার খুশির শেষ নেই। এরকম হাসি শুধু ঋজুদাই হাসতে পারে।
রাইফেলটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ঋজুদা বলল, কনগ্রাচুলেশনস্!
তারপর ঋজুদা তার শক্ত হাতের এক থাবায় আমাকে তার বুকের মধ্যে টেনে নিল।
আমি বললাম, ঋজুদা!
ঋজুদা বলল, এবার থেকে তোকে সব জায়গায় নিয়ে যাব রুদ্র, সব বিপদের মধ্যেই। তুই শিকারী হয়ে গেছিস। পুরোদস্তুর।
তারপর হঠাৎ উদাস গলায় বলল, গদাধর আর শাজাহান খুব খুশি হবে। চল আমরা বোটে ফিরি। কিছু খেয়ে, ওদের সকলকে নিয়ে বাঘটা স্কিন করার জন্যে আসা যাবে।
ফেরার সময়ও সাবধানে চারধারে চোখ রেখে হাঁটতে লাগলাম আমরা। এমন সময় ট্যাকের গভীর থেকে একটা বাঘ ক্ৰমান্বয়ে ডাকতে লাগল, খুব বিরক্তির গলায়।
ঋজুদা একবার ওদিকে তাকাল, তারপর জোরে জোরে পা চালাল।
বলল, বেচারা!
আমি বললাম, বেচারা কেন? গদাধরের বাবাকে, ওরা খেল, তুমি বলছ বেচারা?
ঋজুদা বলল, এ রাজ্যটা তো ওদেরই। পৃথিবীর সবটুকুই কি মানুষের? ওদের মনের মতো থাকার জন্যে ওদেরও একটু শান্তি, স্বাধীনতা তো চাই। আমরা এই রাক্ষুসে মানুষরা— রাইফেল হাতে মানুষ, চাষী মানুষ, জেলে মানুষ, মউলে মানুষ, বাউলে মানুষ সবাইই তো ওদের ঘরে এসে ওদের ঘর থেকে ওদের ভাড়াতে চাই। সমুদ্রে ওদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় না করা পর্যন্ত শাস্তি নেই বুঝি আমাদের।
সবটুকু পৃথিবীই যে আমরা মানুষরাই শুধু ভোগ করতে চাই একা একা, স্বার্থপরের মতো!
ওরা বেচারা নয় কি?
আমি চুপ করে রইলাম। কথা বললাম না কোনো।
দূর থেকে বোটের মাথাটা, সারেঙের কেবিনের সাদা রঙা ছাদ দেখা যাচ্ছিল। ওরা সবাই সারবন্দী হয়ে ওপরের ডেকে দাঁড়িয়েছিল।
ডেকে শাজাহান বুড়ো হাঁটু গেড়ে বসে নমাজ পড়ছিল। নরম রোদে ওর নতজানু ভঙ্গি, সাদা বুক-অবধি দাড়ি, আর বাদামি চেহারা দেখে দূর থেকে মনে হচ্ছিল, ও যেন কোনো দূরলোকের যাত্রী।
ওর জন্যে আমার বুকের মধ্যেটা হঠাৎ কেমন মুচড়ে উঠল।
অন্যরা সকলে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল সারবন্দী, চিন্তান্বিত মুখে।
বাঘটা কে মারল, কেমন করে মারা হল; এ সব নিয়ে ওদের কারোই আর কোনো উৎসাহ ছিলো না।
শুধু গদাধর বোট আর ডাঙ্গার মধ্যে লাগানো কাঠের তক্তাটা বেয়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে।
বোটের দিকে হেঁটে চললাম ঋজুদার সঙ্গে আমি।