৩
ঋজুদা বাইরে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দূরের অন্ধকার সমুদ্রের দিকে কী যেন দেখল, তারপর বলল, এঞ্জিন স্টার্ট করো। চলো ভিতরে গিয়ে আরো ভাল জায়গা দেখে নোঙর করি।
তাই-ই ভাল। নীলমণি বলল। তারপর এনিম্যান নটবরকে বলল, স্টার্ট কর্।
ডিজেলের এঞ্জিন গুটু-গু-গুট করে স্টার্ট হল। নীলমণি ঘণ্টা দিল ব্যাক করার।
মোটরবোট সুন্দরবনে চালাতে খুব মজা। যে সারেঙ, সে স্বীয়ারিং ধরে বসে থাকে। কোথায় চড়া, কোথায় জল, জোয়ার-ভাঁটা, গোন- বেগোন, খাল-সু তিখাল, বাওড়, নদী সব তার মুখস্থ। কিন্তু এঞ্জিনটা থাকে নীচে। উপর থেকে সে দড়িতে বাঁধা ঘণ্টা বাজিয়ে এঞ্জিনম্যানকে সিগন্যাল দিলে এঞ্জিনম্যান সেইমতো গীয়ার চেঞ্জ করে, ব্যাক-গীয়ার দেয়; এঞ্জিন বন্ধ করে। একে অন্যকে দেখতে পর্যন্ত পায় না।
ঋজুদা আর আমি বাইরের ডেকে এসে দাঁড়ালাম। নীলমণি বোটটা একটু ব্যাক করে নিতেই বড় খালে এসে পড়ল বোটটা। বড় খালে আসতেই বুঝলাম সমুদ্রে কী বিপর্যয় চলছে। বড়-বড় ঢেউ আর উথাল-পাথাল ঝড়ের শব্দে সুন্দরবনের নদী, গাছপালা পাগলের মতো মাথা, হাত-পা ঝাঁকাঝাঁকি করছে।
নীলমণি বলল, সামাল। সামাল।
আমরা ডেকে বসে পড়লাম। বোটটা পাশ হতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। কোনোক্রমে সামলে নিয়ে গু-গু-গুট্ করে বোট চলতে লাগল। সার্চলাইটের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ইলিশমাছের আঁশের মতো চক্চক্ করে উঠছিল।
আমরা নীলমণির ঘরে চলে গেলাম আবার। বেশ খানিকটা ভিতরে গিয়ে একটা ছোট খালে ঢুকতে বলল ঋজুদা। সেই খালের দুপাশে বিরাট বিরাট কেওড়াগাছ। আর কী কী গাছ আছে, অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না। কেওড়াগাছের ডালগুলোয় শোঁ শোঁ করে হাওয়া আর্তনাদ করছিল এসে।
সুন্দরবন এমনিতেই কেমন আন্ক্যানি লাগে আমার কাছে। ঋজুদাও সে-কথা বলে। ভারতবর্ষের আর-কোনো জঙ্গলের সঙ্গে এই আশ্চর্য অরণ্যের তুলনা হয় না। সুন্দরবনের গভীরে দিনের পর দিন রাতের পর রাত যে না কাটিয়েছে, সে এ-কথার তাৎপর্য বুঝবে না।
খালটাতে ঢুকেই নীলমণি আতঙ্কিত গলায় বলল, এখানে?
ঋজুদা বলল, এখানে ঝড়ের দাপট কম হবে নীলমণি।
নীলমণি গররাজি গলায় বলল, তা হবে। কিন্তু জায়গা বড় সাংঘাতিক বাবু। .এ-তঙ্গাটে এমন সর্বনেশে খাল আর দুটি নেই।
ওর কথা শেষ হবার আগেই সার্চলাইটের আলোয় খালের দুপাশে সার-সার প্রায় দশটি ঝামটি দেখা গেল। হঠাৎ খালের মাঝখানে জ্বলন্ত কাঠকয়লার মতো মাথা-ভাসানো একটা বিরাট কুমিরের চোখ জ্বলে উঠল। পরক্ষণেই কুমিরটা মাথা ডুবিয়ে নিল।
ঋজুদা বলল, থাক ঝাটি। তোমরা কেউ বাইরে বা জালি- বোটে শুয়ো না। মোটরবোটে উঠে বাঘ কখনও নেয়নি কাউকে সুন্দরবন থেকে।
নীলমণি বলল, তা নেয়নি কিন্তু কোনোদিন নিতেও তো পারে-?
ঋজুদা বলল, এই দুর্যোগের হাত থেকে তো আগে : বাঁচতে হবে। বোটসুদ্ধ ডুবে গেলে তো কুমিরে আর হাঙরে সকলকে ছিঁড়ে খাবে। আর বাঘের জন্যে তোদের ভয় নেই। আমি আজ সারেঙের ঘরে রাইফেল নিয়ে পাহারা, দেব। তোরা সকলে নিশ্চিত্তে নীচে ঘুমো। ঠাণ্ডা আছে, তাছাড়া বৃষ্টিও হচ্ছে। সব পর্দা-টর্দা বন্ধ করে শুয়ে থাকিস। কোনো ভয় নেই। আরাম করে ঘুমো, ভাল করে খেয়ে দেয়ে।
নীলমণি অগত্যা আরও ভিতরে নিয়ে গিয়ে বোট থামাল। নটবর আর পরেশকে বলল, ভাল করে নোঙর ফেল্, রাতে না নোঙর হেঁটে যায়।
ততক্ষণে খিচুড়ি হয়ে গেছে। বেশ শীত করছে। আমরা নীচে কেবিনে নেমে গরম-গরম খেয়ে নিলাম। তারপর পয়েন্ট ফোর-ফিফটি
ফোর-হাণ্ডে ড ডাবল ব্যারেল রাইফেলটাতে গুলি ভরে ঋজুদা উপরে উঠল। আমাকে বলল, তুই নীচেই শো।
আমি বললাম, কেন? তোমার সঙ্গে যাই।
ঋজুদা বলল, দুজনে অল্প জায়গায় কষ্ট করে শুয়ে লাভ নেই। তোর বন্দুক, গুলি আর টর্চ হাতের কাছে রাখিস। পর্দা ভাল করে ফেলে নিস।
তারপর আমাকে ফিসফিস করে বলল, ওদের বললাম বলে কী, আমিও তো ঘুমোব। তবে আমার ঘুম সজাগ। বাঘ যদি বোটে ওঠার চেষ্টা করে তাহলে টের পাওয়ার কথা। তবে এ পর্যন্ত কখনও বোটে ওঠেনি আজ অবধি। দিশি নৌকো থেকে মানুষ নিয়েছে বহু। তবু মোটর বোটে যে উঠবে না এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। আরামে জমিয়ে ঘুমো। দুর্যোগ কমলে গদাধরের বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে হবে। অনেক অ্যাডভেঞ্চার তোর জন্যে বাকি আছে এখনও। এখন ঘুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
কম্বল গায়ে দিয়ে আরামে শুয়ে পড়লাম। খিচুড়িটা দারুণ রেঁধেছিল গদাধর। কিছুক্ষণের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করে ওরাও সকলে শুয়ে পড়ল। বোটের সামনে ও পিছনে দুটি লণ্ঠন ফিতে কমিয়ে রেখে দিল ওরা। ঋজুদা ওদের সকলকে বলে দিল, আমাকে না বলে কেউ যেন রাতে ডেকে আসিস না। দরকার হলে আমাকে চেঁচিয়ে ডেকে তারপর আসবি।
বাইরে শোঁ-শোঁ করে হাওয়া বইছে। এখন জোয়ার। জোয়ারে ভেসে আসা কাঠকুটো লতাপাতা কত কী জলের সঙ্গে বোটের খোলে সড়সড় করে শব্দ করে ঘষে যাচ্ছে। কেওড়া, সাদা বাণী, হেঁতাল, গরান, গোলপাতা, গেঁও আর সুদীর পাতায়-পাতায় ঝোড়ো হাওয়ার কত না দীর্ঘশ্বাস। জিন-পরীরা বুঝি এমনই দিনে খেলতে নামে বনে-বনে।
বড় বড় ডালপালা সম্বলিত কেওড়া গাছেদের নীচে-নীচে অনেক- খানি জমি ফাঁকা দেখা যায়। যে মাঠে চিতল হরিণের দল খেলে বেড়ায়। কেওড়া ফল বড় ভালবাসে ওরা। কত-কত বুড়ো হরিণ! কী তাদের শিং-এর বাহার। গায়ের রঙ পেকে সোনালি থেকে কালো হয়ে গেছে।
আজ এই দারুণ দুর্যোগের রাতে হরিণ, বাঁদর কি কোনো রাতচরা পাখিও ডাকছে না। শুধু জলের শব্দ, ঝড়ের শব্দ, সমুদ্রের শব্দ। বড়-বড় কেউটে সাপগুলো এখন কী করছে কে জানে? কুমিররাও কি আজ তাদের নদীর পারের জলের তলার গভীর গর্তে আঁট-সাঁট হয়ে শুয়ে আছে? হাঙরেরা এই দুর্যোগে কী মাছ পায়? কোনো ফিশ-ক্যাটও খাল-পাড়ে বসে মাছ ধরার চেষ্টা করছে না আজ। আজ যে বড় দুর্যোগ।
আর বড় বাঘ? মামা? বাঘ তো বেড়ালের মাসি। ওদের গায়ে জল লাগলে বাঘ বড় খুশি হয়। অন্যান্য জঙ্গলে দেখেছি, জঙ্গলে বৃষ্টির পর বাঘ এবং অন্যান্য অনেক জানোয়ার ফরেস্ট রোডে এসে বসে থাকে অথবা হেঁটে যায়। কারণ বৃষ্টি-শেষে লতাপাতা থেকে অনেকক্ষণ অবধি বড় বড় ফোঁটা টাপুর টুপুর করে পড়ে। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘের কথা আলাদা। জলই তাদের ঘরবাড়ি। নোনা জল।
রাত দিনের মধ্যে চার বার জোয়ার ভাটার খেলা চলে এখানে। ভাঁটায় গাছ-গাছালির ভাসমান এরিয়াল রুটসগুলো সব বেরিয়ে পড়ে দাঁত বের করে। ভাঁটার সময় সমস্ত জঙ্গলকে নানা-রঙা শিকড়ের-দাত-বার-করা এক ধাঁধার মতো মনে হয়। কত বিচিত্ৰ প্যাটার্ন, আঁকি-বুকি, কারুকাজ সে-সব শিকড়ের। আবার যেই জোয়ার আসে, দু-মানুষ তিন-মানুষের বেশি জল বাড়ে। তখন পুরো জঙ্গলকে মনে হয় একটা ভাসমান বোটানিকাল গার্ডেন। সবুজ লাল পাটকিলে হলুদ পাতায় আর ফুলে ফুলে নদী-খালের দু পাড় ভরে যায়। জোরে জল ঢোকে তখন স্মৃতিখালগুলোয়।
সুন্দরবনের গভীরে যে উঁচু জায়গা থাকে—তাকে বলে ট্যাক্। ট্যাক জোয়ারের সময়েও শুকনো থাকে। জোয়ারের সময় বাঘ এবং অন্যান্য জানোয়ারও ঐ ট্যাকেই থাকে জল এড়াতে। তারপরই ভাটার সময় কাদা ভেঙে ভেঙে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। ভাঁটা দিলেই সোজা গোল-গোল বিভিন্নাকৃতি শিকের মতো কেওড়া গাছের শিকড়গুলো মাথা বের করে মাঠময় উঁচিয়ে থাকে। ঐ শিকড়গুলোকে বলে শুলো। তার উপর পড়ে গেলে একেবারে শরশয্যা। কী যে ধার শুলোগুলোর মুখে, তা বলার নয়।
উভচর স্যালামাণ্ডার বুকে হেঁটে হেঁটে প্যাতপেতে গা-ঘিঘিন্ে কাদার উপর দিয়ে পতপত করে চলে। কত রকম জোঁক, পোকা, মাছি, মৌমাছি; কত রঙের। কত মাছ, ছোট বড়।
চারদিকে এই সুন্দরবনে কী আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। পাখি এখানে অন্যান্য জঙ্গল থেকে অনেক কম। কিন্তু ডাকতে ডাকতে যখন কাদাখোঁচা, কালু বা মাছরাঙা উড়ে যায় তখন একটি পাখির গলার স্বরও এই জলজ প্রকৃতিতে যে কত দূরে জলের উপরে উপরে ভেসে যায় তা কী বলব! এমন আশ্চর্য নিবিড় ভয়াবহ অতিপ্রাকৃত শাস্তি পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই আছে। আনন্দের মধ্যে, সৌন্দর্যের মধ্যে ঠাসবুনটে বোনা এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভয়ও আর কোথাও নেই।
শুয়ে-শুয়ে ভাবছিলাম, এখন ঝাটির ফালি-ন্যাকড়াগুলো ঝড়ের দাপটে পত পত করে উড়ছে। আমাদের দেশের মানুষ যে কত গরিব, বেঁচে থাকার, দু-মুঠো খেতে পাওয়ার ও একটি ধুতি-গামছার জন্যে কত লোকের যে প্রাণ যায় প্রতি বছর আজকেও এই সুন্দরবনে, তা যারা জানে; তারাই জানে। ওদের গ্রাম থেকে ওরা যখন ফাগুন-চোতে বেরোয় প্রতি বছর, তখন কারা যে ফিরবে আর কারা যে বাঘ কিংবা কুমিরের পেটে যাবে তা কেউই বলতে পারে না।
নৌকো এসে লাগে বাদা থেকে সুন্দরবনের গভীরে। ডাঙায় নেমে প্রথমে পুজো দেয় পুরুত। ওরা বলে দেয়াসি। মন্ত্রজ্ঞ। পুজো দেয় বনবিবির। বাবা দক্ষিণ রায়েরও দেয়। আরও কত দেবদেবী। দক্ষিণ বাংলার কত শত লৌকিক দেবতা।
চৈত্রের প্রথমে সুন্দরবন ফুলে-ফুলে সেজে ওঠে। শীতে এলে সে-রূপ দেখা যায় না। তখন কেওড়া, ওড়া, গেঁয়ো, গরান সব গাছই ফুলে ফলে ভরে ওঠে। ফুলপটি তলার লাল নীল হলুদ রঙা ফুল। মৌমাছির দল আর প্রজাপতির দল তখন আকণ্ঠ মধু পানে ব্যস্ত হয়ে চঞ্চল পাখনায় ঘুরে বেড়ায়।
মউলেরা কোঁচড়ে করে বন বিভাগ থেকে আছাড়ে পটকা নিয়ে ডাঙায় নামে। মন্ত্রজ্ঞ পুজো-পাঠ সেরে পায়রা বলি দিয়ে বলে, যা তোরা, ভয় নেই কোনো। গরান ফুলের থেকে মধু খেয়ে যেই মৌমাছি ওড়ে, অমনি সেই মৌমাছিকে অনুসরণ করে মউলে চলে বনে-বনে, মৌচাকে গিয়ে পৌঁছবে বলে। যে হ্যাঁতাল গেঁয়ো গোলপাতার নিশ্ছিদ্র জঙ্গলে রাইফেল হাতে ঢুকতেও ভয়ে বুক কাঁপে, সেই বনে চাক ভেঙে মধু পাড়বে বলে মউলে বনবিবির হাতে তার প্রাণ জমা দিয়ে ধুতি-লুঙ্গি কষে নিয়ে কাদা ভেঙে চলে। বাঘ কখন কোথা থেকে যে এসে পড়ে, তা বাঘই জানে। হৈ হৈ পড়ে যায়। আছাড়ে পটকা ফাটে। নিরস্ত্র অসমসাহসী মানুষগুলো দৌড়ে যায় বাঘের মুখ থেকে আত্মীয় বন্ধুকে ছাড়িয়ে আনতে।
কিন্তু বড় বাঘ যাকে একবার ধরে, সচরাচর সে বাঁচে না। শেয়ালে যেমন কই মাছের মাথা চিবিয়ে ধান খেতের আলে ফেলে দিয়ে যায়, কখনও বাঘও তেমনি করে মানুষের মাথাও চিবিয়ে বাদায় ফেলে সরে যায় বিরক্ত হয়ে। যে মারা যায়, তার শবের অংশ কখনও পায় দাহ করার জন্যে ওরা, কখনও পায় না।
ঝাটি পড়ে নদী বা খালের সেখানে। তারপর আবার নতুন উৎসাহে অন্যরা মরণ-মাছিকে ধাওয়া করে মৌচাকের দিকে চলে। যে মধু তারা পাড়ে তাদের নিজের জীবনের মূল্যে, মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীরা তার দাম দেয় সামান্যই। সেই মধু বহু হাত ঘুরে আমাদের খাওয়ার টেবিলে আসে চড়া দামে। কিন্তু সেই সোনালি মধুর পিছনে যে করুণ অশ্রুসিক্ত কাহিনী থাকে, তার খবর আমরা রাখি না।
দুপুরবেলা একচোট ঘুমিয়েছিলাম বলে ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে বাইরের উম্মত্ত প্রকৃতির প্রলয় নৃত্যের আওয়াজ শুনতে পাই। দামাল হাওয়া বোটের ত্রিপলের পর্দার কোণগুলোয় পত-পত আওয়াজ তুলে বোটের গায়ে আছাড় মারে। আমি শুয়ে শুয়ে অনেক কথা ভাবি, অন্ধকারে। কিছু শোনা, কিছু দেখা।
কতরকম যে কাঁকড়া সুন্দরবনে! কতরকম যে তাদের রঙ! বড় বড় কাঁকড়াও আছে তাদের মধ্যে। কী মিষ্টি শাঁস। পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা দিয়ে রাঁধলে মাংসের চেয়েও উপাদেয়।
ব্যাঙও হরেক রকমের। কালো ব্যাঙ, রূপো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, হলুদ-রেখা ব্যাঙ, পাতাসি ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, ব্যাঙে-ব্যাঙে সুন্দরবন ‘বাঙ্ময়’!
মাছের কথাও কী আর বলব! কাঁকলাস মাছ। ট্যাংরা, কুচো চিংড়ি, ভেটকি, খয়রা, ভাঙর, কানমাগুর। মেনি মাছগুলো ভাঁটি দিলেই কাদার উপর চিড়িং বিড়িং করে লাফায়।
ভাঁটির সময় জল কমে গেলে বাঘ খালের মধ্যে মাছ ধরে। হাতের থাবা মেরে-মেরে এক-এক ঝটকায় মাছকে শূন্যে তুলে পাড়ে ছুঁড়ে দেয়। তারপর অনেক মাছ হলে সেগুলোকে জড় করে খায়। শেষ হলে পর আবার খালে নেমে আসে।
কুচো চিংড়ি দিয়ে কেওড়া ফলের টক রাঁধে সুন্দরবনের লোকেরা। দারুণ খেতে। হেঁতালের মাথা কেটে বড়াও ভেজে খায় ওরা। খেতে বেশ। খয়রা মাছ ভাজা, ভেট্কির কাটা-চচ্চড়ি, ট্যাংরার ঝাল, বড় চিংড়ির মালাইকারি, কচ্ছপের মাংস।
মাছের বাহার বর্ষায়। রেখা, রুচো, দাঁতনে, ভাঙন, কাল- ভোমরা, পান-খাওয়া, পারশে, তপসে, কুচো চিংড়ি এবং নানানিবিমুনি মাছ।
বর্ষার সুন্দরবনের রূপও নয়ন-ভোলানো। ভয়াবহ সন্দেহ নেই, কিন্তু বর্ষার এই বনের এই রূপের সঙ্গে তুলনীয় বেশি কিছু নেই।
এখানে কত রকম যে গাছ—কেওড়া, হেঁতাল, গেঁয়ো; গরান, সুন্দরী ছাড়াও আছে পশুর, আমুড়, ধে দিল, বাইনন্। আর অপ্রধান গাছের মধ্যে আছে গোলপাতা, লোহাগড়া, ভাতকাটি, শিঙড়ে, টক-হুঁ দরি। গেঁওর লতা লাল টুকটুক সিঁদুর-রঙা হয়ে ওঠে। তখন দেখতে যে কী ভাল লাগে। টক-সুদরি বন খুব ছোট-ছোট, নিবিড়। এর মধ্যে দিয়ে বাঘ হরিণকে ধাওয়া করে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হরিণের শিং যায় এতে আটকে। তখন বাঘ তাকে ধরে খায়। কত যে পশু পাখি জীব জন্তু। একে অন্যকে মেরে খায়। আমাদের চোখে তা বিসদৃশ লাগে বটে, কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্য এমনি করেই বজায় থাকে। যিনি জীব সৃষ্টি করেন তিনিই তার খাওয়ার সংস্থানও করে দেন। মানুষ বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য নয়, কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে সুন্দরবনের প্রায় সব বাঘই মানুষখেকো। এর কারণ বলতে গেলে আলাদা প্রবন্ধ লিখতে হয়। তার জায়গা এ নয়। তাছাড়া তার যোগ্যতাও হয়তো আমার নেই। ঋজুদা লিখলেও লিখতে পারে।
খয়েরি গোলফলের কাঁদিগুলো যখন নুয়ে পড়ে জলের উপর, দেখতে ভারী ভাল লাগে তখন। খেতেও মন্দ নয়। তালশাঁসের মতো মিষ্টি। কেমন একটা বুনো-বুনো গন্ধ তাতে।
গভীর রাতে এবং দিনেও নদীর ধারে জোয়ারি পাখিরা ডাকে পুত্ৰ পুত্ৰ পুত। বাউলে মউলেরা বলে এর পিছনে প্রবাদ আছে। সেই ডাক শুনতে ভারী ভাল লাগে। এই বন এমন ভয়াবহভাবে নির্জন, নিস্তব্ধ যে, যে-কোনো শব্দকেই মধুর লাগে কানে।
একজন নাকি তার ছেলেকে নদীর খোলে ভাটার সময় শুইয়ে কী করছিল, জোয়ার এসে ছেলে ভাসিয়ে নেয়। পুত্রশোকে সে পাখি হয়ে যায়। পাখি হয়ে গিয়ে সেই থেকে সে নদীতীরে ডেকে ফেরে, ভাঁটায় রাখলাম পুত্র, জোয়ারে নিয়ে গেল পুত; পুত; পুত; পুত; পুত… এইসব ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল নীলমণির উত্তেজিত চিৎকারে।