২
গদাধর চা এনে দিল, সঙ্গে পাঁপড় ভাজা। ঠিক সেই সময় ছোট- বালির গভীর থেকে রিয়্যাল রয়েল বেঙ্গল টাইগার ডেকে উঠল হা-হুম্ করে। সুন্দরবনে নদী-নালা-ভরা বর্ষণসিক্ত গা-ছম্ছম্ জঙ্গলের মধ্যে যে বাঘের ডাক শোনেনি, জীবনে একটা পরম অভিজ্ঞতা থেকে তাকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিল্পীরা বলেন, নাভি থেকে যে স্বর ওঠে তা হল নাদ। ব্যাঘ্র-নিনাদ যে কী পরম শরীর-মন ভরে দেওয়া আনন্দ, ভয় ও বিস্ময়ে পরিপ্লুত করা শব্দ, তা লিখে বলার নয়।
বাইরে সন্ধে হয়ে আসছিল। বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ারও বিরাম নেই। আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। বাঘের ডাক আমাদের উদাস, বিষণ্ণ এবং আমাদের চারপাশের পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন করে দিয়েছিল।
গদাধর এসে একটা লণ্ঠন দিয়ে গেল।
ঋজুদা বলল, এখানে না। চোখে লাগে। সামনের ডেকে রাখ।
গদাধর বলল, বাবু, মামা যে বড় ডাকাডাকি করে। আজ একটু রাতে নাম্লি হত না? মামাকি যদি পাওয়া যায়?
ঋজুদা বলল, দুর্যোগ না কমলে নামা ঠিক হবে না গদাধর এইরকম আবহাওয়ায় মাংসাশী জানোয়ারদের খুব সুবিধে। অন্য জানোয়ারদের সজাগ কান এই হাওয়া আর বৃষ্টির শব্দে কাজে লাগে না—আর এই-ই সুবিধে হিংস্র জানোয়ারের। জঙ্গলে তো আর খালি চোখ দিয়ে কোনো কাজ হয় না—কান সেখানে মস্ত বড় জিনিস। কানে কিছু শুনতে না পেলে রাতের অন্ধকারে এই আবহাওয়ায় জঙ্গলে নেমে খামোখা বাঘের মুখের খাবার হয়ে লাভ নেই।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বাঘের সঙ্গে মোলাকাত, হবে, ভয় নেই তোর গদাধর। তোর বাবার খুনের বদলা নেব। আমি এখানে থিচুড়ি খেয়ে মজা করতে আসিনি।
গদাধর মুখ নিচু করে বলল, সেই কথাই বাবু।
আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছই তার পরদিন সকালে খালপারে নীলমণি একটা ঝাটি দেখিয়েছিল।
ঝাটি মানে, গাছের ডালের মাথায় একফালি ন্যাকড়া বেঁধে কাদাতে পুঁতে দেওয়া থাকে। সুন্দরবনের গভীরে প্রতি বছর এমন অনেক ঝাটি দেখা যায়। যেখানে বাঘে মানুষ নেয়, সেখানে ঝাটি পুঁতে বাউলে মউলে জেলেরা সাবধান করে দেয় অন্যদের। নিষেধ করে সেখানে নোঙর করতে।
কিন্তু যে যেখানেই নোঙর ফেলুক, সুন্দরবনে এসে বাঘের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলা মুশকিল। তবুও পোঁতে ওরা। সংস্কার; অভ্যেস।
গত বছর চৈত্র মাসে গদাধরের বাবা যখন মিঠে-পানি নেওয়ার জন্যে এই ছোটবালিতে নেমেছিল আরও চার-পাঁচজনের সঙ্গে, বাঘ তখন তাকে তুলে নেয়। মধু-পাড়া মউলেদের দলে ছিল গদাধরের বাবা।
গদাধর ঋজুদার কলকাতার খাস অনুচর। সুন্দরবনের গোসাবারও অনেক ভিতরে এক গ্রামে ওর বাড়ি। ঋজুদা বছরে ন’ মাস প্রায় জঙ্গলে-জঙ্গলেই কাটায়—সারা বছর কলকাতায় ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাট আগলায় গদাধর। বড় বিশ্বাসী আর ভাল লোক।
এবারে ঋজুদার সুন্দরবনে আসার উদ্দেশ্যই ছিল গদাধরের বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া। এখানে আসার আগে ঋজুদা আমাকে বলেছিল, বাঘ মারিনি বহু বছর। ইচ্ছে করে না অমন সুন্দর পুরুষালী জানোয়ারকে মারতে। কিন্তু গদাধরের ইচ্ছে। এটা একটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ব্যাপার।
সারা বছর জঙ্গলেই থাকি! আজকে বহু বছর হয়ে গেল। আর আমারই যে আশ্রিত তার বাবাকে বাঘে নেবে এটা সহ্য করা ঠিক নয়। গদাধরের কাছে ছোট হয়ে যাব ঐ বাঘটা মারতে না পারলে। মারতেই হবে। যে করেই হোক
চা পাপড়-ভাজা খেতে খেতে আমি বললাম, বলো, তোমার গল্প থামালে কেন?
ঋজুদা বলল, পাঁপড় ভাজা মুখে নিয়ে কেউ গল্প বলতে পারে? দাড়া একটু।
হঠাৎ ঋজুদা বলল, এখান থেকে ফিরে গিয়ে কাজিরাঙ্গায় যাব একবার।
কেন? আমি সোৎসাহে জিগ্যেস করলাম।
ওখানে একটা গণ্ডার মেরেছে চোরা-শিকারীরা। চোরা- শিকারীরা আর্মড। বিরাট ডাকাতের দলের মতো অর্গানাইজেশন ওদের! অন্যান্য জানোয়ারও পোচিং করে। পুলিসের ডিটেকটিভরা জঙ্গলের এই সশস্ত্র শিকারীদের বাগে আনতে পারছে না। চোরা- শিকারী ধরা অন্য শিকারীর পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ। ওখানকার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট একবার যেতে বলেছেন। অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেণ্ট। খুব অ্যাডভেঞ্চারাস্, কী বল? ডেঞ্জারাও বটে! কারণ ওরা এর আগেও ফরেস্ট গার্ডদের মেরেছে—তাই আমাকে মারা তো খুবই সোজা। খুব থ্রিলিং হবে ব্যাপারটা। তাই-ই যাব ভাবছি।
আমিও যাব, বলে আমি নেচে উঠলাম।
ঋজুদা বলল, পাগলামি করিস না। এ শিকারে যাওয়া নয়, শিকারী ধরতে যাওয়া। তুই কেন এর মধ্যে যাবি?
আমি বললাম, যদি আমাকে না নিয়ে যাও, তাহলে আমি কী করব দেখো।
ঋজুদা বলল, তুইও কি শেষে আমার মতো অশিক্ষিত হয়ে থাকবি? জংলি হয়ে যাবি? তোর মা-বাবা কী বলবে আমাকে?
আমি বললাম, তুমি অশিক্ষিত?
তাশিক্ষিত নই? এম-এ বি-এ পাশ করাকে শিক্ষা বলে? আসল শিক্ষা তো শুরু হয় বি-এ এম-এ পাশের পর। শুনিনি সেই কথা? একজনকে জিগ্যেস করা হয়েছিল যে, ইউনিভার্সিটির পারপাস কি?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, টু ব্রিং দ্য হর্স নিয়ার দ্য ওয়াটার অ্যাও টু মেক ইট থার্টি।
মানে বি-এ এম-এ পাশের পরই আসল জ্ঞানের শুরু। ইউনিভার্সিটি শুধু ছেলেমেয়েদের মনে জানার ইচ্ছেটুকুই জাগিয়ে দেয়। তার বেশি কিছু নয়। যদি কেউ মনে করে যে, ডিগ্রী পেলেই শিক্ষা শেষ হল তবে তার ডিগ্রী পাওয়াটাই বৃথা। যে যাই-ই পড়ুক, শেখার কি শেষ আছে? মৃত্যুর দিন অবধি মানুষকে শিখতে হয়। সব মানুষকেই। যে যে-ভাবে শেখে। কেউ বই পড়ে, কেউ অন্যভাবে।
তারপরই বলল, তুই নিশ্চয়ই বোরড হয়ে যাচ্ছিস। ভাবছিস, এই সুন্দরবনে এসেও ঋজুদা জ্ঞান দিচ্ছে।
আমি বললাম, না। মোটেই না। আসলে কী জানো? আমার এই বন-জঙ্গল পশু-পাখি, এই খোলা আকাশের জীবন, তোমার সঙ্গে ঘোরা—এই সব ভাল লাগে বড়। তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আমি বন-জঙ্গলকে যে কী ভালবেসে ফেলেছি, তা কী বলব। আমার ইচ্ছে আছে আমি একোলজি নিয়ে পড়ব।
ঋজুদা বলল, খুব ভাল কথা। অনেক কিছু করার আছে ঐ বিষয়ে। তুই বন-জঙ্গল ভালবাসিস, একথা বুঝতে পারি বলেই অনেক বিপদের মধ্যেও তোকে আনি। অনেক ঝুঁকি নিয়ে।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বিপদের মধ্যে যে আনন্দ খুজে না পায়, কী শহরে কী জঙ্গলে; যার জীবনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, প্রতিবন্ধকতা নেই, প্রবলেম নেই, তার ধার বেশিদিন থাকে না। সে ভোতা হয়ে যায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই সব বুঝতেই তো জীবনের অর্ধেক চলে গেল আমার। তোরা তাড়াতাড়ি শুরু কর। জীবনে যে যত ছোটবেলায় ঠিক করে—কী সে করতে চায় জীবনে, তার জীবনের গন্তব্য কী—সে তত বড় হয়। এই পৃথিবীতে সময়ের চেয়ে দামী আর কিছুই নেই।
একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, এখন ভাবি। জীবনট! সত্যিই একটা ম্যাটার অফ প্রায়োরিটিজ। কোটা আগে, কোন্টা পরে, কোন্ জিনিসটার কত দাম ভোর কাছে, এইটে ঠিক করে নিয়ে মন-প্রাণ দিয়ে সেই জিনিসটার জন্যে লেগে পড়—নিশ্চয়ই তা পাবি। তোরা কত ছোট। কত কী করার আছে তোদের জীবনে। তোরা জীবনে মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠ—শুধু শরীরে মানুষ নয়— সত্যিকারের মানুষ। এইটে দেখে গেলেই তো বড়দের আনন্দ।
এই অবধি বলেই, আবার ঋজুদা বলল, দেখলি তো তোকে আবার কেমন জ্ঞান দিলাম। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আসলে। মানুষ যত বুড়ো হয় তত বেশি জ্ঞান দেওয়ার টেনডেন্সি হয়, জানিস্।
আমি বললাম, মোটেই তুমি বুড়ো নও। আর আমার এসব কথা শুনতে খুব ভাল লাগে। আমি আমার বন্ধুদেরও বলব। তোমার মতো সকলের যদি একটা করে দাদা থাকত।
ঋজুদা হাসল। বলল, তাহলে দেশসুদ্ধ ছেলে তোর মতো বকে যেত; জংলি হয়ে যেত।
আমি বললাম, অনেকক্ষণ অন্য সীরিয়াস কথা হয়েছে। এবার আবার গল্প বলো।
ঋজুদা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শালটাকে জড়িয়ে নিল গায়ে ভাল করে। হু-হু করে ভেজা-হাওয়া বইছে। সুন্দরবনে এমনিতে শীতকালে বেশি শীত মোটেই থাকে না, কিন্তু এই ঝড়বৃষ্টির জন্যে দারুণ ঠাণ্ডা পড়েছে।
ঋজুদা বলল, জেঠুমণি তখন খুব ভাল শিকারী। প্রথম শিকার- জীবনের গল্প সব নিজেই হাসতে-হাসতে বলেন সকলকে। এটা যে জেঠুমণির কত বড় গুণ ছিল, কী বলব। ক’টা লোক নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে পারে? নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে হৃদয়ের উদারতা লাগে।
যাই-ই হোক, জেঠুমণি তো শেষ বয়সে প্র্যাকটিস প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। অনেক ব্যবসার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন ধীরে-ধীরে। চা-বাগান নিয়েছিলেন একটা ডুয়ার্সে। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের বাংলোটা দারুণ ছিল। একবার শীতে গিয়েছিলাম ক’দিন। জেঠুমণির কাছে থেকে আসতে। সেবারই এই ঘটনাটা ঘটে।
একদিন জেঠুমণি আমাকে বললেন, শুয়োর মেরে তাড়াতাড়ি ফিরিস ঋজু—একজন নতুন বাঙালি প্ল্যান্টার এসেছেন এখানে। তিনি খেতে আসবেন।
আসলে ঐ বাগানটা বহুবার হাত-বদল হল। এখন যিনি কিনেছেন তাঁর সঙ্গে আলাপ নেই আমার। ছোট্ট বাগান তার বুড়ো ম্যানেজারের সঙ্গে বহুদিনের জানাশোনা। তিনি ফোন করে অনেকদিন হল বলছেন যে, আমার নতুন মালিককে নিয়ে আপনার কাছে আসব—উনি আলাপ করতে ব্যগ্র। তাই আজকে খেতে বলেছি তাঁকে। ভদ্রলোক কলকাতার লোক। বোধহয় বাগান সম্বন্ধে জানতে-টানতে আসছেন। তোর কথাও বলেছি তাঁকে। তাড়াতাড়ি ফিরিস।
সেদিন বাংলোয় ফিরেই দেখি একটি রোলস রয়েস্ গাড়ি দাঁড়িয়ে। উর্দিপরা ড্রাইভার ও পেয়াদা গাড়িতে বসে আছে শীতের মধ্যে। আমি তাদের নামিয়ে এনে জেঠুমণির লোকদের চা-টা খাওয়াতে বললাম। দরোয়ানরা বাইরে আগুন করেছিল। ওদের বললাম ওখানে বসে গল্প-টল্প করতে, গাড়িতে ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছিল বেচারারা না হলে।
বিরাট ড্রইং-রুম জেঠুমণির। ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট। দেওয়ালে ও চারপাশে মাউন্ট করা বাঘ, ভাল্লুক, বাইসনের সব ট্রফি। তার মধ্যেই কোচানো ধুতি, দশহাজারি শাল এবং হাতে রুপো-বাঁধানো লাঠি নিয়ে এক ডিপেপ্টিক ভদ্রলোক বসে আছেন দেখলাম।
উনি যে বিরাট বড়লোক তা ওঁর সাজপোশাকে, কথায়-বার্তায় ফুটে বেরোচ্ছে। তাঁর সামনে জেঠুমণি একটা লুঙ্গি পরে তার উপর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে একটা আধ-ছেঁড়া শেয়াল-রঙা আলোয়ান গায়ে দিয়ে বসে আছেন।
পোশাক-আশাক সম্বন্ধে জেঠুমণির চিরদিনই একটা প্রচণ্ড নিস্পৃহতা ছিল। বলতেন, পুরুষ মানুষের পরিচয় তার গুণে—পোশাক দিয়ে কী হবে?
সাজানো-গোছানো ড্রইং-রুম, এসবই তাঁর বাগানের আগের মালিকের। শুধু ট্রফিগুলোই তাঁর। উনি বাংলোটা ফাঁকা পেলে বোধহয় তক্তপোশ, তাকিয়া, গড়গড়া, জর্দা আর পান দিয়ে ভরে রাখতেন।
আমি ঘরে ঢুকতেই আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের আলাপ করিয়ে দিয়ে জেঠুমণি বললেন, এই যে রে, ঋজু, ইনিই মিস্টার ব্যানাজি —কুকুর-খাওয়া বাগানের মালিক।
তারপরই বললেন, বুঝলি ঋজু, মিস্টার ব্যানার্জি খুব ধরেছেন যে, ওঁকে একটা বাঘ মারিয়ে দিতেই হবে। তুই যখন আছিস্, তুই-ই একটু চেষ্টা করে দে। আমি তো আজকাল বেরোইই না বিশেষ।
আমি বললাম, নো প্রবলেম্। কত মাকাল ফলে ডুয়ার্সের বাঘ মেরে গেল; আপনি তো মারবেনই।
মিস্টার ব্যানার্জির সোনা-বাঁধানো-দাঁত ঝক্মক্ করে উঠল। রুপো-বাঁধানো-লাঠি নেড়ে বললেন, কবে? কখন?
আমি হেসে ফেললাম। বললাম, বাঘ তো বাঁধা নেই। আমি থাকতে-থাকতে সুযোগ-সুবিধা হলেই হয়ে যাবে।
না, না। সুযোগ সুবিধা কী বলছেন—এ ভার আপনাকে নিতেই হবে মিস্টার বোস।
আমি বললাম, জেঠুমণি যখন আমাকে বলছেন, আপনার আর কিছু বলার দরকার নেই।
তা হলেও, তা হলেও; কালই আমি আমার রোলস্-রয়েস্ পাঠাব—আপনি আমার বাগানে একবার পায়ের ধুলো দিন।
আমার রাগ হল। আমি বললাম, আমি জীপ নিয়ে চলে যাব। আপনার গাড়ি পাঠাবার দরকার নেই কোনো।
তাহলে আমার ওখানেই খাওয়া-দাওয়া।
আমি বললাম, ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাব—আপনার ওখানে চা খাব এক কাপ। খাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হবেন না।
তারপরই ভদ্রলোক বললেন, আপনি কী করেন?
আমি বললাম, ভ্যাগাবই বলতে পারেন। কিছুই করি না। একটু লেখালিখি করি।
ওঃ বুঝেছি। ভদ্রলোক বললেন।
জেঠুমণি বুঝলেন, আমি চটেছি।
তাড়াতাড়ি বললেন, শুয়োর পেলি? তোর সঙ্গে সিলভারস্টোন গেছিল, না একাই গেলি?
বললাম, সিলভারস্টোন গেছিল, চাওলাও গেছিল, বাগরাকোটের ডনাল্ড ম্যাকেঞ্জিও এসেছিল। সবসুদ্ধ ছ’টা শুয়োর পেয়েছি জেঠুমণি। সবই ডনাল্ডকে দিয়ে দিয়েছি—কাল ওর বাড়িতে বার-বী-কিউ হবে। তোমাকে যেতে বলেছে বিশেষ করে। ফোনও করবে কাল তোমাকে।
জেঠুমণি বললেন, যাব নিশ্চয়ই। তবে তোর জেঠিমাকে শুয়োর- ফুয়োরের কথা বলিস্ না। পুজো-আর্চা করে। আমি তো ব্যাধ—- ও বেচারির মনে দুঃখু দিয়ে লাভ কী?
আমি উঠে এলাম চান করতে, মিস্টার ব্যানার্জিকে বলে; বললাম, খাওয়ার সময় দেখা হবে।
বলেই, ঋজুদা অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে গেল। আমি বললাম, আবার কোন রাজ্যে চলে গেলে তুমি? বলো। থামলে কেন?
ঋজুদা বলল, সরী!
পরদিন সকালে গেলাম জীপ নিয়ে জেঠুমণির বাগানের একজনকে সঙ্গে করে। কুকুর-খাওয়া বাগানের পথ জানা ছিল না।
বাগানটা ছোট্ট, ছিমছাম। একারেজ বেশি না হলেও ভাল করে দেখাশুনা করলে ভালই চলার কথা। চায়ের কোয়ালিটি নাকি খুব ভাল।
মিস্টার ব্যানার্জি খুব যত্নআত্তি করলেন। দেখলাম, তাঁর বাংলোর বারান্দায় ইংল্যাণ্ডের রাজা-রানীর সব ছবি। তাঁর বাবা- ঠাকুর্দারা রায়বাহাদুর রায়সাহেব। তাঁদের দেওয়া ভোজের আসরে বাংলার সাহেব লাট সস্ত্রীক। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরও এমন মনোবৃত্তি অবাক করল আমাকে। এই সব দেখে, এখনও এখানে যে গুটিকতক অশিক্ষিত ও আধা-অশিক্ষিত সাহেব ম্যানেজার- ট্যানেজার আছে তারা মিস্টার ব্যানার্জিকে কী ভাবেন তা মনে করে লজ্জা হল।
যাই হোক্, আমি বললাম, চায়ের বাগানের মধ্যেই দু তিনটি জায়গায় কুকুর এবং ঘোড়া বেঁধে রাখতে। চিতাবাঘ তো জানিসই, পোষা কুকুর খেতে খুব ভালবাসে। আর বড়-বাঘের তন্দুরি চিকেন হচ্ছে ঘোড়া।
বলে এলাম যে, রোজই বিকেল চারটেতে ওগুলো বেঁধে দিতে— সকালে খুলে নিতে। যদি কোথাও কিল্ হয়, তাহলে আমাকে কোনে জানাতে।
মিস্টার ব্যানার্জি আমি আসার সময় আমার হাতে একটা খাম দিলেন। বললেন, এতে পাঁচশো টাকা আছে। আপনি কেন আমার জন্যে মিছিমিছি সময় নষ্ট করে আমাকে বাঘ মারাবেন?
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কী বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি খুব বড়লোক হতে পারেন, কিন্তু ভদ্র- লোকদের সঙ্গে মেলামেশা বোধহয় বিশেষ করেননি। আপনি আমার জেঠুমণির পড়শি বলে আর কিছু বলছি না আপনাকে। এটা রাখুন।
বলেই চলে এলাম।
কথাটা জেঠুমণিকে বলিনি। বললে, তুলকালাম কাণ্ড হত। কারণ জেঠুমণির বয়স হয়েছে। এই নির্জন জায়গায় প্রতিবেশী একে অন্যের উপকারে আসে অনেক।
তার পরের দিন ফোন এল সকালে যে, চিতাবাঘে কুকুর মেরেছে। গেলাম তক্ষুনি। কুকুরটার পেছন থেকে একটু খেয়েছে এবং তুলে নিয়ে গিয়ে একটা নালার মধ্যে রেখেছে। নালার কাছে বড় গাছ ছিল না মাচা বাঁধার মতো। তবে একটা কেসিয়া গাছ ছিল—তিন মানুষ সমান উঁচু হবে। তাতেই মাচা বাঁধলাম। দু’জন লোক বসতে পারে এরকম মাচা।
বাঘের পায়ের দাগ দেখে বুঝলাম, চিতাই। তাছাড়া বড় বাঘ সচরাচর কুকুর নেয় না। তবে জমিটা শক্ত থাকায় ও চায়ে ঢাকা থাকায় পায়ের দাগ ঠিকমতো দেখা গেল না।
যাই-ই হোক, আমি বললাম যে, বিকেল চারটের মধ্যে আমি আসব। উনি যেন তৈরি হয়ে থাকেন।
তারপর বললাম, আপনি আগে কি কখনও শিকার করেছেন?
ভদ্রলোক আমাকে শিকারের অ্যালবাম দেখালেন। হৈ হৈ ব্যাপার। সাহেব, মেমসাহেব, বেয়ারা, বাবুর্চি। গান্-র্যাকে সারি- সারি বন্দুক রাইফেল, যাকে বলে রাজা-রাজড়ার ব্যাপার।
আমি অ্যালবাম দেখতে-দেখতে আবার বললাম, আপনি কী কী শিকার করেছেন?
মিস্টার ব্যানার্জি ভুরু বেঁকিয়ে আমাকে উল্টে বললেন, এসব দেখার পরেও প্রশ্ন আছে আপনার?
আমি বললাম, তবে আমার সাহায্যের প্রয়োজন কী?
উনি বললেন, বাঘ ছাড়া সবই মেরেছি। তাই রিস্ক নিতে চাই না। তাছাড়া এ অঞ্চলে কখনও শিকার করিনি। এখানকার বাঘেদের চরিত্র বা ব্যবহার সম্বন্ধে কিছুই জানি না।
আমি বললাম, বাঘেরা তো মানুষের মতো ডুন-স্কুল কি আজমীর কি গোয়ালিয়রের পাবলিক স্কুলে অথবা কালীধন বা তীর্থ- পতি ইন্স্টিট্যুশানে পড়তে যায় না। তাদের চরিত্র এবং ব্যবহারের তারতম্য বিশেষ হয় না। যাই-ই হোক, তৈরি থাকবেন। আমি আসব।
বিকেলে গিয়ে দেখি এলাহি ব্যাপার। দু’জন গান-বেয়ারার দাঁড়িয়ে উদি পরে। একজনের হাতে পয়েন্ট থ্রি সেভেনটি ফাইভ হল্যাণ্ড অ্যাণ্ড হল্যাণ্ডের ডাবল-ব্যারেল রাইফেল। আর একজনের হাতে চার্চিল ডাবল ব্যারেল শটগান—টুয়েলভ, বোর। দুটোই কাস্টম-বীল্ট।
আমি শুধোলাম, কাস্টম-বীল্ট মানে?
ঋজুদা বলল, কাস্টম-বীল্ট মানে হচ্ছে হাতের কনুইয়ের মাপ, হাতের দৈর্ঘ্যের মাপ, আঙুলের মাপ সব নিয়ে কারো জন্যে বিশেষ করে যে-রাইফেল বা বন্দুক তৈরি হয়। আগেকার দিনে রাজা মহারাজারা কেউই স্ট্যাণ্ডার্ড ওয়েপন ব্যবহার করতেন না। সবই কাস্টম-বীল্ট।
ব্যানার্জি সাহেবই বা রাজা মহারাজাদের চেয়ে কম কিসে?
আমি বললাম, বলো, তারপর।
ঋজুদা আবার শুরু করল। আরেকজন বেয়ারার জিম্মায় একটা বেতের বাস্কেট, তার মধ্যে নানারকম খাবার-দাবার, জলের এবং অন্যান্য জিনিসের বোতল। অন্য একজন বেয়ারা দাঁড়িয়ে আছে একটা শাটিনের ওয়াড়-পরানো লেপ নিয়ে।
আমি তো দেখে থ! বললাম, এ কী ব্যাপার?
কেন? সঙ্গে যাবে। বরাবর শিকারে সঙ্গে যায়।
আমি বললাম, মাচাতে তো আমার আর আপনার দুজনের বসার জায়গাই হবে না। এত কিছু?
উনি বললেন, সারা রাত থাকতে হতে পারে তো?
আমি বললাম, তা হতে পারে, যদি বাঘকে ঘায়েল করেন। অত কাছ থেকে গুলি করলে বাঘের ঐখানেই পড়ে থাকার কথা দুটো ওয়েপনের দরকার নেই। তারপর বললাম, এর মধ্যে কোনটা আপনার হাতের? মানে কোনটাতে আপনি ভাল মারেন?
উনি বললেন, হার্বিভোরাস্, মানে তৃণভোজী জানোয়ার মারি শটগ্রামে, আর কার্নিভোরাস্, অর্থাৎ মাংসভোজী মারি রাইফেলে।
অনেক শিকারী দেখেছি জীবনে, এমন শুনিনি কখনও বুঝলি রুদ্র!
আবারও বললাম, আপনার গুলি কোন্টাতে বেশি লাগে— মানে মিস্ কম হয়?
উনি বললেন, জীবনে মিস্ হয়নি। মিস্ হবে কেন?
আমি হতাশ হলাম।
নিজের বা জেঠুমণির কোনো বন্দুক রাইফেল সঙ্গে আনলে ভাল করতাম। ব্যাপারটা যে এমন দাঁড়াবে ভাবিনি। ভেবেছিলাম, মাচায় বসে টর্চ দেখাব ঠিক করে, চিতা আসবে, ব্যানার্জী সাহেব গুলি করবেন। খেলা শেষ।
যাই-ই হোক, এখন যা হবার তা হয়ে গেছে। এ লোকের হাতে দুটি অস্ত্র দেওয়া আরো সাংঘাতিক। আমাকেই না মেরে বসেন।
তাই বললাম, একটা ওয়েপন নিন, আর বেয়ার নেসেসিটিজ, যা।
ঠিক আছে।
বলে, মাচায় ওঠার আগে উনি শটগানটাকে নিলেন। আর জলের বোতল।
আমি টর্চ নিলাম পাঁচ ব্যাটারির। আগে উনি উঠলেন মাচায়। তারপর আমি। লেপ-টেপ ফেরত পাঠালাম।
ওঁর লোকদের বললাম যে, গুলির শব্দ শুনেই যেন কাছে না আসে। যদি পর পর তিনটে গুলির শব্দ হয়, তাহলে হ্যাজাক নিয়ে, জীপ নিয়ে লোকজন নিয়ে যেন আসে। পায়ে হেঁটে কেউই আসবে না।
তখনও দিনের আলো দিব্যি ছিল। আদিগন্ত সবুজ ছোপ-ছোপ চায়ের ঝোপ। মাঝে-মাঝে হাত-ছড়ানো সুন্দর সব শেড-টী। চায়ের গালিচা গড়িয়ে গড়িয়ে মিশেছে দূরের নগাধিরাজ হিমালয়ের পায়ে। মাঝে তিস্তা তার শীতের গৈরিক পোশাকে টান-টান।
বড় ভাল লাগে এই তিস্তাকে আমার। ব্রহ্মপুত্র আর তিস্তার মতো সুন্দর ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভদ্রলোক খুব কমই দেখেছি। জানিস ত! এরা দুজনেই পুরুষ। এরা নদ, নদী নয়।
পশ্চিমের আকাশে সন্ধ্যাতারার নরম সবুজ চোখ জ্বলে উঠল জঙ্গলে, আলো-পড়া শম্বরের চোখের মতো। অন্ধকার হয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে শীতও এসে দু কাঁধ আর ঘাড়ের পেছনে তার দু’হাত জড়াবে। জার্কিনের কলারটা তুলে দিলাম। বুক পকেটে পাইপটা উল্টো করে রেখেছি। এখন আর পাইপ খাওয়ার উপায় নেই।
হঠাৎ প্ল্যান্টার ব্যানার্জি তাঁর চামড়ার বোতাম লাগানো মোহায়েরের কোটের পকেট থেকে কী একটা বড়ি বের করে ওয়াটার বল থেকে জল ঢেলে খেয়ে ফেললেন।
খেয়েই আমার দিকে চেয়ে বললেন, আরেকটা খাই?
আমি অবাক হয়ে শুধোলাম, কী?
কোরামিন। সীরিয়াস গলায় বললেন ব্যানার্জি সাহেব।
আমি কাঁদব, না হাসব, ভেবে পেলাম না।
কিছু বলার আগেই উনি বললেন, আমার নার্ভ যথেষ্ট স্ট্রং নয়। কঠিন কঠিন অ্যাডভেঞ্চারাস্ কাজ করার আগে আমি কোরামিন খাই। বিয়ে করতে যাবার দিনও একটা খেয়েছিলাম।
আমি চুপ করেই থাকলাম। বললাম, কথা বলবেন না। মাচায় বসে কথা বলা একেবারেই বারণ।
তখন তিনি সোনার সিগারেট কেস বের করে রনসনের গ্যাস লাইটার থেকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতেই আমি বললাম, একদম না।
ভদ্রলোক আমার হৃদয়হীনতায় ব্যথিত হলেন।
ওঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে আমি বললাম, দেখছেন না আমিও পাইপ খাচ্ছি না।
উনি বললেন, অ।
তারপরেই বললেন, বাঘের কোন্ জায়গায় গুলি করব?
বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, এসব আগে জিগ্যেস করেননি কেন? তারপর বললাম, মুখোমুখি গুলি করলে বুকে অথবা দু’ চোখের মাঝ-বরাবর করবেন। তবে মুখোমুখি গুলি না করারই চেষ্টা করবেন। বাঘ মাথা নিচু করে থাকলে ঘাড়ে গুলি করতে পারেন। সবচেয়ে ভাল সাইডওয়াইজ, বাঘের পা যেখানে বুকের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে অ্যাংগুলার শট নেওয়া। মাচা থেকে মারলে শট অ্যাংগুলারই হবে। সমান লেভেলে থাকলে বুকে মারতে পারেন। কিন্তু পেটে বা বুকের পিছনে কোনো জায়গায় একদমই নয়।
কেন নয়? ব্যানার্জি সাহেব আবার প্রশ্ন করলেন।
আমি বললাম, পরে বলব। এখন একেবারে কথা বলবেন না। নড়াচড়া করবেন না। একদম চুপচাপ থাকুন।
অনেকক্ষণ সময় গেল। সন্ধেও হয়ে গেল। দূরের কুলি লাইন থেকে সাঁওতালদের মাদলের আওয়াজ আর গানের সুর ভেসে আসতে লাগল। আলো থাকতে চিতা এলে ভাল হত। কিন্তু সে- ব্যাটা তো তার নিজের ইচ্ছামতোই আসবে। আমাদের ইচ্ছেতে তো আর আসবে না।
হঠাৎ ব্যানার্জি সাহেব বললেন, সিটিং পজিশানটা চেঞ্জ করে পদ্মাসনে বসব?
কী আর বলব!
বললাম, পদ্মাসনে বসে বাঘকে গুলি করতে অসুবিধে হবে। আই সী।
বললেন উনি।
আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন। আমি আমার নিজের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে ইশারা করলাম কথা না বলতে।
অন্ধকার হয়ে গেছে, কিন্তু শুক্লপক্ষ বলে চাঁদও উঠে গেছে। চারপাশ আস্তে আস্তে নরম দুধূলি আলোয় ভরে উঠছে। হঠাৎ দূরের কুলি-বস্তি থেকে কুকুরগুলো সব একসঙ্গে ভুক্ ভুক্ করে ডেকে উঠল।
ব্যানার্জি সাহেব, আমাকে আপত্তি জানানোর সুযোগ না দিয়েই, কোটের আরেক পকেট থেকে বিলিতি ওডিকোলন বের করে নিজের গায়ে ঢাললেন, এবং অর্ধভুক্ত কুকুটার গায়ে উপর থেকে ঝাঁকি মেরে ছুঁড়ে দিলেন। প্রথমে ওডিকোলন, পরে শিশিটাই।
বললেন, বড় বিচ্ছিরি গন্ধ।
আমি এবার রেগে গেলাম। বললাম, চলুন নেমে যাই। ওডিকোলনের গন্ধেই তো বাঘ আসবে না। বুঝতে পারবে না সে? বাঘ মারতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়।
ব্যানার্জি সাহেব তাতে বললেন, সরি, সরি! আর করব না। বাঘটা মারিয়ে দিন আমাকে প্লীজ।
তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ।
হঠাৎ আমার মনে হল দূরে বাঁদিকে চায়ের ঝোগের মাঝে- মাঝে সাদা-মতো কী একটা জানোয়ার আসছে। চায়ের ঝোপ দুলে উঠছে। মৃদু খসখস্ শব্দ হচ্ছে তার গায়ের সঙ্গে চায়ের ঝোপের ঘষা লাগায়।
আমি উৎকর্ণ ও উদ্গ্রীব হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি জানোয়ারটা কাঁ। চিতা নিশ্চয়ই নয়। তবে কি হায়েনা? বেশ উঁচু জানোয়ার।
এমন সময় ব্যানার্জি সাহেব হঠাৎ আমাকে বললেন, একস- কিউজ মী। মে আই টক্ ইন ইংলিশ?
ওঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই প্রায় লটর পটর করতে-করতে এক বিরাট রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার চায়ের ঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে সোজা কুকুরটার কাছে এল এবং কুকুরটাকে খেতে শুরু করল নালায় নেমে।
এমনটি সচরাচর হতে দেখিনি। লেপার্ডের কিলে বড় বাঘ এমনভাবে এসে খায় না।
কিন্তু জঙ্গলে-জঙ্গলে ছোটবেলা থেকে ঘুরে এইটেই শুধু শিখে- ছিলাম যে, জঙ্গলে অসম্ভাব্য বলে কোনো কিছু নেই। যাঁরা জানোয়ারদের বিষয়ে সব কিছু জেনে ফেলেছেন, আমি সেই বোদ্ধাদের দলে পড়ি না। বারবারই দেখেছি, যেটাকে নিয়ম বলে মনে-মনে মেনে নিতে আরম্ভ করেছি, পরক্ষণেই তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এইজন্যেই বড় শিকারীরা চিরদিন বলে এসেছেন, বী অলওয়েজ প্রিপেয়ার্ড ফর দ্য আনএকপেকটেড।
বাঘটা থাবা গেড়ে বসে কুকুরটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। অভুক্ত ছিল বোধহয়। এত মনোযোগ দিয়ে সে খাচ্ছিল যে, আমাদের উপস্থিতি, ওডিকোলনের গন্ধ কিছুই গ্রাহ্য করল না।
আমি বাঁ হাত দিয়ে ব্যানার্জি সাহেবকে আকর্ষণ করে ইশারায় বললাম যে, এবার মারতে হবে।
উনি বন্দুকটা তুললেন, কিন্তু তুলতে যেন বড্ড বেশি সময় নিলেন বলে মনে হল। বন্দুকের নলটা বাঘের দিকে হতেই আমি টর্চ ফেললাম বাঘের গায়ে, বন্দুকের ব্যারেলের উপর দিয়ে; যাতে নিশানা নিতে অসুবিধা না হয়।
বাঘটা বসা অবস্থাতেই মুখ তুলে আলোর দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ করল না। ডুয়ার্সের বাঘগুলোও বোধহয় স্কটিশ প্ল্যান্টারদের মতো গোঁয়ার-গোবিন্দ হয়। এরকম আশা করিনি।
ব্যানার্জি সাহেব বন্দুক ধরেই রইলেন, গুলি আর করেন না। টিকটিক্ করে সেকেণ্ডের পর সেকেণ্ড কেটে যাচ্ছে।
আমি ওঁর পেছনে আলতো করে বাঁ হাত দিয়ে চিমটি কাটলাম। চিমটি কাটার সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের নলটা সজোরে উপরে-নীচে আন্দোলিত হতে লাগল এবং নল দিয়ে গুলি না বেরিয়ে ব্যানার্জি সাহেবের মুখ দিয়ে কথা বেরোল : ন্যাজে যদি নেগে যায়?
কী বলছেন বুঝতে না পেরে উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করতেই ব্যানার্জি সাহেব দম-দেওয়া পুতুলের মতো ক্রমান্বয়ে বলতে লাগলেন, যদি ন্যাজে নেগে যায়…যদি ন্যাজে নেগে যায়…যদি ন্যাজে…?
বলতে বলতেই আমার আতঙ্কিত চোখের সামনে ধ্বপ্ করে বন্দুকটা নীচে পড়ে গেল ওঁর হাত থেকে। আর সঙ্গে-সঙ্গে উনিও গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে আমার কোলে।
আমি তখন বাঘকে দেখি, না ওঁকে দেখি? উনি অজ্ঞান অবস্থায় কী যেন বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না।
বন্দুক পড়ে যাওয়ায় বাঘটা সরে গেছিল একলাফে। কিন্তু অবস্থা বুঝে গিয়েই ফিরে এসে কুকুরটাকে মুখে করে চায়ের ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি বললাম, তারপর কী হল?
ঋজুদা বলল, শোন্ না।
কিন্তু কিছু না বলে কান-খাড়া করে কী যেন শুনল ঋজুদা বাইরে। তারপরেই সারেঙকে ডেকে বলল, আবহাওয়াটা যেন ভাল ঠেকছে না নীলমণি।
নীলমণি সারেঙ বলল, সেই কথাই বলব বলব ভাবছিলাম বাবু। মহা দুর্যোগ আসছে। এমন হলে বোট এখানে রাখা ঠিক হবে না!