১
সুন্দরবনের ছোট বালির পাশে মোটর-বোটটা নোঙর করা আছে।
সোঁদরবনের মানুষখেকো বাঘের জন্যেই এবার আসা।
মায়ের প্রচুর আপত্তি ছিল আমাকে আসতে দিতে, কিন্তু বাবার পারমিশানে মায়ের অনিচ্ছা ওভার রুলড হয়ে গেছিল। অবশ্য ঋজুদার সঙ্গে না এলে বাবাও সুন্দরবনে আসতে দিতেন কিনা সন্দেহ।
ক্যানিং থেকে রাতে বোটে রওনা হওয়া হয়েছিল। সারারাত বোট চালিয়ে পরদিন দুপুরে চামটার কাছে এসে নোঙর করেছি আমরা। সারেঙ ও মাল্লাদের বিশ্রাম ও আমাদের সকলের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে। তারপর বিকেল-বিকেল বোট ছেড়ে গভীর রাতে ছোট বালিতে এসে পৌঁছেছিলাম।
বাউলে, মউলে ও জেলেদের নৌকাগুলো মাঝে মাঝে গহীন দুপুরে এসে লাগে এই ছোট বালিতে। তারপর মুখে উলু দেওয়ার মতো অদ্ভুত আওয়াজ করে জলের কলসি নিয়ে মিষ্টি জলের কুণ্ড থেকে জল তুলে নিয়ে যায় ওরা বড় ভয়ে ভয়ে। বাঘ যে কোথায় কখন এসে হাজির হবে, তা কেউই জানে না। বনবিবির পুজো দেয় ওরা, বাবা দক্ষিণরায়ের। পায়রা কি পাঁঠা বলি দেয় ঠাকুরের নামে। কোঁচড় ভরে আছাড়ি পটকা নিয়ে ডাঙায় নামে।
কিন্তু সুন্দরবনের বাঘের কাছে এ-সবই আকর্ষণ। বাঘকে দূরে না পাঠিয়ে মানুষের গলার স্বর, আছাড়ি পটকার শব্দ সারও কাছে টানে। মৃত্যুর কাছে।
বৃষ্টি, কী বৃষ্টি। ঋজুদাই বলছিল, সুন্দরবনে তো এই নিয়ে বহুবার এলাম গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে, কিন্তু শীতকালে এমন বৃষ্টি কখনও দেখিনি।
বোট থেকে নেমে যাবোই বা কোথায়? বোটের খোলা ডেকেও বসা যায় না। হয় সারেঙের বসার জায়গার পিছনে যে জায়গাটুকু আছে সেখানে বসে আড্ডা মারি আমরা, নয়তো খোলের মধ্যে। অবশ্য এ বোটটা ভাল। ছোট্ট। দুটো কেবিন আছে, সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম। যদিও সুন্দরবন অন্য জঙ্গল নয় যে, ইচ্ছেমতো ঘুরে-ফিরে বেড়াব পায়ে হেঁটে, তবুও কার আর ভাল লাগে টিপটিপে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ায় বোটের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে?
খিচুড়ি খাওয়ার এমন পরিবেশ বোধহয় আর হয় না। খিচুড়ি খাও আর কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম লাগাও।
বোট খুলে নিয়ে এই দুর্যোগে হেড়োভাঙা কি গোসাবা কি মাতলা নদীতে গিয়ে পড়ার বিপদও অনেক। ট্রানজিস্টরে বলেছে যে, তিনদিন অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া চলবে। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। আর আমরাও চলে এসে রয়েছি একেবারে বঙ্গোপসাগরের মুখেই।
ঋজুদা বোটটাকে একটা স্মৃতিখালের মধ্যে দিনের বেলা ঢুকিয়ে রাখতে বলেছিল। রাত হলে আবহাওয়া বুঝে অন্য জায়গায় নতুন নোঙর করা যাবে। রাতের বেলা স্মৃতিখালে নোঙর করে থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক এই মানুষখেকো বাঘে-ভরা সুন্দরবনে অবশ্য রাতের বেলা আমরা ম্যাগাজিনে গুলি পুরে চেম্বার ফাঁকা রেখে রাইফেলকে প্রায় কোলবালিশ করেই শুয়ে থাকি। ঋজুদা হাসতে হাসতে একরাতে বলছিল, রাইফেল-কোলে ঘুমন্ত অবস্থায় বাঘের পেটে গেলে সে বড়ই বেইজ্জতি হবে।
একই জায়গায় প্রথম দিন প্রথম রাত এইভাবে কাটার পর আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ঋজুদাকে বললাম, ঋজুদা, সঙ্গে আমি টেপ রেকর্ডার এনেছি, বাঘের ডাক, হরিণের ডাক টেপ করার জন্যে। যা দুর্যোগ! বাইরে তো বেরোতেই পারছি না, তার চেয়ে তুমি গল্প-বলো, আমি টেপ করি।
ঋজুদা সবটাতেই ইয়ার্কি মারে। বলল, আর হনুমানের ডাক টেপ করবি না?
আমি বললাম, না।
ঋজুদা বলল, গভীর জঙ্গলে হনুমানের ডাক যারা শোনেনি, তারা ঐ ডাক শুনেই বাঘ বলে ভাববে। তুই সেফলি হনুমানের ডাক টেপ করে নিয়ে যা। যা ঠাণ্ডা আর বৃষ্টি, বাঘেদের গলা ভাল না-থাকারই কথা। যদি না ডাকে, আর ডাকলেও, তাদের পারমিশান না নিয়ে টেপ করলে আপত্তি করতে পারেই; তার চেয়ে যা বললাম, তাই-ই কর।
তারপরই বলল, একবার উত্তরবঙ্গের বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলের গভীরে এক গ্রামে গরু ডাকছিল, সেই ডাক টেপ করেছিলাম। আমার কলকাতার দাদার এক ব্যারিস্টার বন্ধু নাকি খুব শিকার – টিকারে যেতেন আর আলো-জ্বলা ড্রইংরুমে বসে দাদা-বৌদির কাছে হাত নেড়ে, কান নেড়ে দুর্ধর্ষ সব শিকারের গল্প করতেন।
একদিন তিনি যখন এসেছেন, দাদা-বৌদির কাছে, আমি টেপটা বাজালাম।
জাদরেল গরু তার বাজখাই গলায় ডাকছিল হাম্বা—আ—আ। গভীর জঙ্গলের মধ্যে বৃষ্টিভেজা গাছপালার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে সে ডাক গগম্ করে উঠছিল।
দাদার ব্যারিস্টার বন্ধু মনোযোগ দিয়ে ডাকটা শুনলেন বারকয়েক, তারপরই বৌদির দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বললেন, বুঝলে?
কী বুঝলে ম্যাডাম?
বৌদি চোখ বড় বড় করে বললেন, কী? কোন্ জানোয়ার? কুমির?
ব্যারিস্টার-দাদা বললেন, ধুৎ, কুমিরের ডাক আক্যানি। এটা বাঘিনীর ডাক। সঙ্গীকে ডাকছে।
আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম।
ঋজুদা বলল, হেসো না। জঙ্গলের ভিতরের গ্রামের গরুর হঠাৎ- ডাক ফেলনা নয়।
আমি বললাম, ঋজুদা, এই করে কিছুই হচ্ছে না। সময় চলে যাচ্ছে। আমি কিন্তু টেপ করছি, তুমি গল্প বলো; তোমার নানান জায়গায় শিকারের গল্প।
ঋজুদা পাইপটা থেকে ছাই ঝেড়ে বলল, বলিস কী? আমি কি জিম করবেট? বেশি গ্যাস্ দিস না আমাকে। তোকে তো এমনিতেই সব জায়গায় নিয়ে আসি। তবে আর কেন? আমার আবার গল্প, তাও আবার টেপ, করবি। আর লোক পেলি না?
আমি বললাম, তুমি কথা ঘোরাচ্ছ। যতদিন…মানে এই দুদিন তো দুর্যোগে বোটের মধ্যেই আটকা…বলোই না বাবা। প্লীজ, তুমি বলো। তোমারও পুরনো কথা সব মনে পড়ে যাবে—আর আমারও শোনা হবে গল্প।
তারপরই কী মনে হওয়ায় আমি বললাম, তাহলে, তোমার জেঠুমণির গল্প বলো। দারুণ লেগেছিল সেই কানা-বাঘের গল্পটা। তোমার আর তোমার জেঠুমণির যা-যা মজার মজার গল্প আছে, সব বলো, প্লীজ।
ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে, আমাকে বলল, গদাধরকে বল তো চায়ের জল চড়াবে। আর হ্যাঁ, সঙ্গে পাঁপড় ভাজতে বল। তারপর বলল, আজ রাতে ভুনি-খিচুড়ি পেলে কেমন হয় বল তো? বাদাম কড়াই- শুঁটি ছাড়িয়ে, মুগের ডালের খিচুড়ি, একটু ঘন করে, সঙ্গে ডিমের বড়া, পেঁয়াজি আর শুকনো-লঙ্কা ভাজা করবে!
আমি বলে উঠলাম, আঃ। আর বোলো না, আর বোলো না, গন্ধ পাচ্ছি।
ঋজুদা বলল, পাচ্ছিস গন্ধ! তাহলে বলেই আয় গদাধরকে। শুকনো-কড়াইশুঁটি কি আছে আমাদের সঙ্গে?
আমি বললাম, সব আছে। নেই কী! তুমি তো জেঠুমণিরই ভাইপো। তুমিই বা কম কী?
ঋজুদা বলল, ফার্স্ট ক্লাস। গদাধরকে চায়ের কথাটাও বলে দিয়ে চলে আয় দেখি। এক চামচ চিনি, দুধ কম; মনে আছে তো?
আমি বললাম, শুধু আমার কেন, আমার বন্ধুদেরও মুখস্থ হয়ে গেছে যারা তোমার বই পড়েছে। তুমি বেশ খাদ্যরসিক আছ বাবা। আমার এক বন্ধুর মা বলেছেন।
ঋজুদা বলল, যাঃ ভাগ। বলেছেন তো বলেছেন। তা বলে ভাল-ভাল জিনিস খাব না?
রাতের খাওয়ার অর্ডার আর চায়ের কথা বলে আমি ফিরে এসে আসন করে বসলাম সারেঙের ঘরে পাতা গদিতে একটা বালিশ কোলে নিয়ে।
ঋজুদা দূরে তাকিয়ে ছিল। জলের উপর দিয়ে এক ঝাঁক কালু উড়ে যাচ্ছিল দ্রুত ডানায়। খালের ওপার থেকে হরিণগুলো ডাকছিল টাউ-টাউ করে।
ঋজুদার চোখে তাকিয়ে আমার সমস্ত মনটাও যেন প্রশান্ত হয়ে এল। এই সুন্দরবনের নির্জন, ভিজে, ভয়-ভয়; অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন ঋজুদার চোখে ক্যামেরার লেন্সের মতো ছায়া ফেলেছে। বড় ভালবাসে প্রকৃতিকে মানুষটা! ভাবলেও ভাল লাগে। আমি যদি ‘কমপিটিটিভ, পরীক্ষায় বসি বড় হয়ে, তাহলে ফরেস্ট সার্ভিসে যাব। যে একবার জঙ্গলের আর প্রকৃতির কাছে থেকেছে, সে কি জঙ্গল ছেড়ে থাকতে পারে?
ঋজুদা যখন চোখ ফেরাল বাইরে থেকে, আমি বললাম, বলো ঋজুদা।
ঋজুদা যেন অনেক দূরে চলে গেছিল। এই বৃষ্টি-ভেজা নদী, জঙ্গল, দূরে ঝাপসা দিগন্তের বঙ্গোপসাগরের দিকে চেয়ে ঋজুদা যেন অন্য কারো কথা ভাবছিল। অথবা প্রকৃতির মধ্যেই বোধহয় ঋজুদা কাউকে দেখতে পায়, বুঝতে পারি না। কাছাকাছি থেকেও ঋজুদাকে মাঝে- মাঝে একেবারেই বুঝতে পারি না। কিছুক্ষণের জন্যে দূরে—বড়ই দূরে চলে যায়। তখন চোখের দিকে তাকালে মনে হয় কী যেন গভীর দুঃখ কাজল হয়ে তার চোখে চোখে লেগেছে।
আমি বললাম, শুরু করো।
ঋজুদা আমার কাছে ফিরে এল। আবার সেই হাসিখুশি, রসিক মানুষটা।
বলল, শোন্ তাহলে, শুরু করি। তারপর বলল, তুই একটা দামি কথা বলেছিস : গল্প বলতে-বলতে আমারও অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাবে। ছেলেবেলায় ফিরে যাব। এটা কম কথা নয়।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার নিজের গল্প নাই-ই বা শুনলি; ইচ্ছে আছে, পরে কখনও ডায়রির মতো করে লিখব। তার চেয়ে জেঠুমণির গল্পই শোন।
ঋজুদা গল্প বলতে শুরু করল…
জেঠুমণি কলকাতার নামজাদা ব্যারিস্টার। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় তাঁর সব বড় বড় মক্কেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একবার যাব বললেই হল। খাতির-যত্ন, আদর-আত্তির অভাব নেই। তবে বিগ-গেম্ শুটিং-এর শখ জেঠুমণির মাঝ-বয়সে হয়। তার আগে ফেদার-শুটিং করতেন। মানে পাখ-পাখালি আর কী!
জেঠুমণির হাত ছিল দারুণ। বন্দুকে ফ্লাইং মারতেন পটাপট্। পাখি উড়েছে কি মরেছে। রাইফেলেও ভাল নিশানা ছিল জেঠুমণির। পয়েন্ট টু টু ওপেন রাইফেল দিয়ে, ম্যাচ রাইফেল নয়; পঁচাত্তর গজ দূরে আমি জেঠুমণিকে দেখেছি গ্যাদাফুলের পাপড়ি ছিঁড়তে এক-এক করে।
সবচেয়ে বড় কথা ছিল এমন রসিক দিল-খোলা ও উদার লোক আমি কমই দেখেছি। মানুষজন ভালবাসতেন ভীষণ। যখনই শিকারে যেতেন, সঙ্গে যেত মস্ত দল। অনেকেই তাঁর শিকার-পার্টিকে তাই যাত্রা-পার্টি বলত। কিন্তু জেঠুমণি দমবার লোক ছিলেন না। সকলকে নিয়ে যা আনন্দ, তাতেই তিনি মজা পেতেন।
আমাকে জেঠুমণি খুব ভালবাসতেন ছোটবেলা থেকে। জেঠুমণির বড় ছেলে, মানে আমাদের বড়দা একটু কবি-কবি গোছের লোক ছিলেন। জেঠুমণি তাঁর নাম দিয়েছিলেন হোঁদল-কুত কুত্। বড়দাদা শিকারে গিয়ে কবিতার খাতা নিয়ে বসতেন কি ছবি আঁকতেন। জেঠুমণি ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেন না, কিন্তু বড়দাদার কবিত্বের কারণে আমিই জেঠুমণির অনেক কাছের ছিলাম। বড়দাদা শিকার-টিকারে বড় একটা যেতেও চাইতেন না, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্কুল কামাই হবে বলে।
জেঠুমণির এক বড় মক্কেল, বিশ্ববিখ্যাত মাইকা কোম্পানি, কোডারমার, জেঠুমণিকে নেমন্তন্ন করল শিকারে যেতে। ঝুম্রি- তিলাইয়ার উল্টোদিকে কোডারমা শহর। কোডারমা স্টেশন থেকে বেশ কিছু দূরে শিবসাগর। পুরোটাই ক্রিশ্চিয়ান মাইকা কোম্পানির এলাকা। তখন তাদের যে গেস্ট হাউস ছিল, তার নাম ছিল পাঁচ- নম্বর বাংলো। তখন সবে সাহেবরা কোম্পানি বিক্রি করে দিয়েছে এখনকার মালিকদের কাছে। বিরাট শালবন ছিল বাংলোর কম্পাউণ্ডে। বেয়ারা, বাবুর্চি, স্টুয়ার্ড, সহিস, ঘোড়া, গাড়ি, জীপ, ওয়েপন-কেরীয়ার—কিছুরই অভাব ছিল না।
যথারীতি জেঠুমণি তাঁর বহু চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে একদিন সকালে তো কোডারমা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন। সঙ্গে দাশকাকু, অহীনকাকু, বক্সীকাকু, সমীরকাকু, গবুকাকু। আর আমি তো আছিই।
তখন শিকারও ছিল সে-সব জায়গায়। বিখ্যাত বিখ্যাত সব জঙ্গল। ঢোঁড়াখোলা, শিঙ্গার, ইটখোরি-পিতিজ, রাজৌলির ঘাট, আরও কত কী জঙ্গল। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া, হৈ হৈ। বিকেলে হান্টলি-পামার বিস্কিট দিয়ে চা খাওয়া হত। আহা! সেই বিস্কিটের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। গত বছর লণ্ডনে গিয়ে খেয়েছিলাম বহুদিন পর বুঝলি!
যাই-ই হোক, অহীনকাকু অন্য দলের লীডার হলেন। অহীন- কাকুর চেহারাটা ছোট-খাটো, কিন্তু অমন বিদ্বান, বুদ্ধিমান, রসিক ও সাহসী মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তিনি বললেন, দাদা, আমি গবুদের নিয়ে রাজৌলির ঘাটে যাচ্ছি। আপনি দাশ সাহেবকে নিয়ে যান।
দলের মধ্যে দাশকাকুই সবচেয়ে সাহেব। যেমন সাহেবের মতো দেখতে, মুখে পাইপ, তেমনি আস্তে-আস্তে চোস্ত, ইংরিজি- মেশানো বাংলা বলেন। ইন ফ্যাক্ট, পাইপ খাওয়ার বাসনাটা আমার দাশ-সাহেবকে দেখেই হয় ছোট বেলায়—যদিও ভগবান চেহারাটা দাশ-সাহেবের মতো দেননি।
সবে বিয়ে করেছেন দাশকাকু। একটি ছেলে, এক বছর বয়স।
আসল ব্যাপার, দাশকাকু কট্টর সাহেব বলে অহীনকাকুরা তাঁকে জেঠুমণির জিম্মায় দিয়ে বিকেল-বিকেল বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ওয়েপন-ক্যারীয়ার দেখে মনে হল শিকার তো নয়, যুদ্ধযাত্রায় চলেছেন তাঁরা।
জেঠুমণির স্ট্যান্ডিং অর্ডার—জানোয়ার চেহারা দেখিয়ে যেন কোনোক্রমেই পালিয়ে না যেতে পারে। একসঙ্গে ফায়ারিং স্কোয়াডের মতো গুলি করে তাকে ধরাশায়ী করা চাইই চাই!
আমি, জেঠুমণি আর দাশকাকুর সঙ্গে জীপে বেরোলাম। অন্য দিকে। জেঠুমণি সামনে বসেছেন জীপের। ড্রাইভার মাহমুদ হুসেন। পিছনে আমি এবং দাশকাকু
দাশকাকুর হাতে দোনলা শটগান। আমার হাতে পয়েন্ট টু-টু রাইফেল। জেঠুমণির হাতে পয়েন্ট ফোর-নট-ফাইভ সিংগল ব্যারেল রাইফেল। আণ্ডার লিভার। প্রত্যেকবার গুলি করে ঘ্যাটা-টং আওয়াজ করে নীচের লিভার টানাটানি করে রি-লোড করতে হয় রাইফেলকে।
জীপের পকেটে গোটা চল্লিশ মঘাই পান, আর খুশবুভরা জর্দা। শিকার যাত্রার আগে কোডারমা শহরে গাড়ি ছুটিয়ে গিয়ে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে যুগল এই পান নিয়ে এসেছে। যুগলই আমাদের গাইড, স্পটার; সব। তার চেহারাটা দারুণ। লম্বা চওড়া। গোঁফ আছে ইয়া বড়। শীত গ্রীষ্ম সব সময় তার পোশাক হল একটা গামবুট, তার উপরে একটা ওয়াটার-প্রুফ। শীতে অবশ্য ওয়াটার প্রুফের নীচে গরম পুলওভারও থাকত। মাথায় কোনো সাহেবের দিয়ে যাওয়া একটা নীল রঙা ফেল্ট-হ্যাট।
জীপ ছাড়ল সন্ধের মুখে-মুখে। দেখতে দেখতে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম আমরা। শীতকাল।
জেঠুমণির ওজন দেড় কুইন্টাল—গায়ে মোটা কালো ওভারকোট —মাথায় বাঁদুরে টুপি। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই জেঠুমণি ঘাড় ঘুরিয়ে কষ্ট করে দাশকাকুর সঙ্গে কথা বলছেন, কথা বলার সময় তাঁর মুখ দিয়ে রাশান সামোভারের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলি বেরোচ্ছে ঠাণ্ডায়। তার সঙ্গে দাশকাকুর থী-নান টোব্যাকো-ঠাসা পাইপের স্টীম- বয়লারের মতো নিরন্তর ধোয়া। আরও ছিল যুগলের ঘন-ঘন দু হাতে খৈনি মেরে খাওয়া।
আমার তো প্রাণ যায় যায়।
এমন সময় হঠাৎ ধূলিধূসর ঢোঁড়াখোলার পথে একটি নির্বোধ, প্রাণভয়হীন শশকের আবির্ভাব হল।
আমি বললাম, এই ঋজুদা, সংস্কৃত বোলো না, প্লীজ। আমি সংস্কৃতে পনেরো পেয়েছিলাম।
লজ্জার কথা। ঋজুদা বলল, শশক মানে খরগোশ, র্যাবিট, হেয়ার। বুঝলি তো?
আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।
ঋজুদা বলল, খরগোশ জীবনে হাজার হাজার দেখেছি, শয়ে শয়ে মেরেছি, কিন্তু ঐ খরগোশের কথা জীবনে ভুলব না। খরগোশটা বোধহয় খরগোশদের স্পোর্টসে থ্রি-লেগেড রেসে ফার্স্ট হয়েছিল। এমন অদ্ভুতভাবে একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে তিন পা তুলে তুলে লাফাতে লাফাতে জীপের সামনে সামনে দৌড়চ্ছিল যে কী বলব!
খরগোশ দেখেই যুগল বিরক্তির সঙ্গে বলল, মানহুস্।
মানহুস্ আবার কী ঋজুদা? আমি শুধোলাম।
আহা, মানহুস মানে জানিস না?
অধৈর্য গলায় ঋজুদা বলল।
মানহুস্ মানে অপয়া। শিকারে বেরিয়ে প্রথমে কী জানোয়ার পড়ে না পড়ে তার উপর নির্ভর করে সেদিনকার শিকারের ভাগ্য। জায়গা বিশেষে এই পয়া-অপয়া বদলে যায়। কোথাও শেয়াল মানহুস্, কোথাও খরগোশ, কোথাও বনবেড়াল; এইরকম আর কী।
আমি বললাম, বলো, তারপর বলো।
খরগোশ দেখে জেঠুমণি জীপের পকেট খুলে আরো চারটে পান মুখে দিলেন। তারপর রুপোর তৈরি মনোগ্রাম করা জর্দার কৌটোটা হাতখানেক উঁচু করে উপর থেকে যেই মুখে জর্দা ফেলছেন টিপ, করে, অমনি মাহমুদ হোসেন কী অনিবার্য কারণে ব্রেক কষল জীপের। ফলে, কাশীর জর্দা জেঠুমণির মুখে না পড়ে সটান আমারই উত্তেজিত হাঁ-করা মুখে! বোঝ একবার। স্পেশ্যাল বেনারসী জর্দা— বেনারস থেকে জেঠুমণির মক্কেল পাঠায় যত্ন করে।
কী হল বোঝার আগেই তো গিলে ফেললাম। তারপরই খেল শুরু। জীপ চলতে দেখি পথের উপরে একটা নয়, শত শত শশক। সামনে সামনে লাফাতে লাফাতে চলেছে।
জেঠুমণি অর্ডার দিলেন প্রধান অতিথিকে, মার্ দাশ।
দাশকাকু পাইপটা মুখে কামড়ে ধরেই চলমান জীপ থেকে লম্ফমান খরগোশের উদ্দেশে আই-সি-আই কোম্পানির তৈরি একটি চার নম্বরের ছররা দেগে দিলেন।
নৈবেদ্য যথাস্থানে পৌঁছল না। খরগোশটা বোধহয় বলল, খেলব না কিন্তু।
বলেই, জোরে একটা লাফ দিয়ে উঠেই আবার এক্কা-দোক্কা খেলার মতো জীপের সামনে লাফাতে লাফাতে চলল। পথ ছেড়ে যে প্রাণ বাঁচাতে এদিকে কি ওদিকে জঙ্গলে ঢুকে যাবে তা নয়।
ছাড়িস না। আবার মার।
জেঠুমণির অর্ডার হল।
আবার গুলি হল। এবার বোধহয়, ভাল হচ্ছে না কিন্তু, বলে খরগোশটা একটা বড় লাফ দিয়ে উঠে যেমন চলছিল তেমনই লাফাতে-লাফাতে একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে চলতে লাগল।
জেঠুমণি আবার বললেন, বেইজ্জত। পরক্ষণেই বললেন, মার, দাশ, ছাড়িস না।
দমাদ্দম গুলি হতে লাগল। দাশকাকু বন্দুক রিলোড করেন আর মারেন। খরগোশ লাফায় আর লাফায়, আর জীপের সামনে সামনে চলে।
জেঠুমণি নেহাত দাশকাকুর বেলাতেই এবং খরগোশের মতো ছোট জানোয়ার বলেই এমন একক শিকারের সম্মানের অধিকার দিয়েছিলেন। অন্য দল হলে এবং অন্য দিন হলে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে পড়ে খরগোশ ততক্ষণে কাবার হয়ে যেত।
এবার জেঠুমণি তাঁর সাধের ভাইপোকে বললেন, তুইও মার্, ঋজু।
কিন্তু আমি তখন কি আর ঋজু আছি? জর্দা খেয়ে বন্ করে মাথা ঘুরছে। পথময় খরগোশ। ডানদিকে, বাঁদিকে; উপরে নীচে। বেনারসী জর্দাটা বড় কড়া ছিল।
কিন্তু জেঠুমণির অর্ডার। আমিও কর্তব্য করে যেতে লাগলাম, পটাং পটাং করে। ম্যাগাজিনের দশটা গুলি, দশটাই শেষ।
দাশকাকু গোটা দশেক গুলি করে দেখি ডান হাতের বাইসেপসের গোড়ায় বাঁ হাত দিয়ে মালিশ করছেন। দড়কচ্চা মেরে গেছে হাত।
এদিকে জেঠুমণির যা রাইফেল, তা বাঘ কি শম্বর কি ভাল্লুক মারার। ঐ রাইফেল দিয়ে খরগোশ মারলে প্রথমত খরগোশকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, দ্বিতীয়ত রাইফেলের অসম্মান করা হবে। কিন্তু খরগোশটারও ধৃষ্টতার সীমা থাকা উচিত।
পিছনে বসে আমি এবং দাশকাকু সবিস্ময়ে এবং সভয়ে দেখলাম যে, জেঠুমণি রাইফেল কাঁধে ওঠালেন।
মাহমুদ হোসেন মৃদু আপত্তি করতে গেল। বলল, ছোড়িয়ে হুজৌর। ইসকা আজ মওত নেহি হ্যায়।
অর্থাৎ ছেড়ে দিন হুজুর, এর আজকে মৃত্যু নেই।
পিছন থেকে জেঠুমণির অনুগত অনুচর যুগল বলল, আজ ইসকো খতম্ করেগা।
জেঠুমণি বললেন, মওত্, নেই? ফওত্ করেগা?
এমন সময় হতভাগা গুলিখোর খরগোশটা নির্বুদ্ধিতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে হঠাৎ রাস্তার ডানদিকে চলে গিয়ে একেবারে জীপের সামনেই একটা শাল গাছের গুড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়তে গেল।
ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে তারপর বলল, খরগোশরা এরকম করেই লুকোয়। তুই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিস, জঙ্গলে, বিশেষ করে রাতে, ওদের গায়ে আলো পড়লে ওরা এইভাবে গা-ঢাকা দিতে চায়।
মুখটা গাছের আড়ালে লুকিয়েই ও ভাবল বুঝি খুব লুকিয়েছে। সমস্ত শরীরটা যে বাইরে আছে, সে-হুঁশ নেই। হুঁশ থাকলে মরতে যাবে কেন?
জেঠুমণি সেরিমনিয়ালি রাইফেলের ব্যারেলটা একেবারে খরগোশের গায়েই প্রায় ঠেকিয়ে গদ্দাম্ করে দেগে দিলেন।
আমার মনে হল প্রলয়কাল সমুপস্থিত। ধুলোর মেঘে ধরণী অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকার হবার ঠিক আগে দেখলাম, খরগোশটা লাফিয়ে উঠেই চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল। তখনও জর্দার নেশা ছিল আমার। কী দেখতে কি দেখলাম জানি না।
এতক্ষণে দাশকাকু কথা বললেন।
বললেন, আরে, এ তো একেবারে ছেড়ে-ভেড়ে গেছে, এ নিয়ে গিয়ে কী করবে? কাবাব পর্যন্ত হবে না।
জেঠুমনি বিজয়োল্লাসে আরো চারটে পান খেয়ে বললেন, আজকের পয়লা শিকার। একে তো স্টাফ্ করে রাখব আমার স্টাডিতে। যে কাণ্ড এ করল, যতগুলি গুলি খরচ করাল; তাতে তো এই খরগোশ লেজেণ্ডারি হয়ে গেছে।
যুগল বলল, এ মাহমুদ ভাইয়া, জল্দি উঠা লে উসকো— সামনেমে টাইগারকা চান্স হ্যায়।
দাশকাকু বেশ শান্তমনে খরগোশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, টাইগার? মানে বাঘ?
যুগল বলল, জী হুজৌর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার
দাশকাকু জেঠুমণিকে সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, গাড়ি ঘুরাও।
জেঠুমণি বললেন, ছাড়, তো ওদের কথা। বাঘ বললেই বাঘ? অত সহজে বাঘ দেখা গেলে তো হতই।
দাশ কাকু বললেন, সহজে না হোক, কঠিনেও দরকার নেই। চারদিক খোলা, হুড-নামানো, উইণ্ড-স্ক্রীন-নামানো জীপে বসে এ কী ছেলেখেলা?
জেঠুমনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আরে দাঁড়া, উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? খরগোশটাকে তুলে নিক।
মাহমুদ হোসেন জীপটাকে স্টার্টে রেখেই জীপের বাঁদিকের স্টীয়ারিং ছেড়ে নেমে জীপের সামনেটা ঘুরে গিয়ে খরগোশটাকে তুলবে বলে যেই তার পায়ে হাত দিল, অমনি খরগোশটা ওর হাতে আঁচড়ে দিয়ে তড়াক করে এক লাফে জঙ্গলে উধাও।
জেঠুমণির মুখের পান আর গলায় নামল না।
যুগল মিটিমিটি হাসতে লাগল, জেঠুমণির উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে। তারপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় মাহমুদ হোসেনও হেসে উঠল। তারপর আমি, শেষে দাশকাকু এবং জেঠুমণিও।
কতক্ষণ পরে আমাদের হাসি থামল তা আজ আর মনে নেই।
খরগোশটার গায়ে গুলি লাগেনি। কিন্তু অত কাছে অত হেভি রাইফেলের গুলি পড়ায় সে ভয়ে আর আওয়াজে অজ্ঞান হয়ে গেছিল।
মাহমুদ হোসেন স্বীয়ারিংয়ে ফিরে এসে আবার অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, একটু যেতে না-যেতেই যুগলের স্পটলাইটের আলোয় ডানদিকে জঙ্গলের ফাঁকে-ফাঁকে শ’খানেক গজ দূরে খাড়া পাহাড়ের গায়ে কিসের যেন নীলচে-লাল দুটো চোখ জ্বলে উঠল।
যুগল কী জানোয়ার তা নিরীক্ষণ করে বলবার আগেই জেঠুমণি গুলি চালিয়ে দিলেন। চোখটা জ্বলতেই লাগল। আবার গুলি চলল। আণ্ডার লিভারের ঘ্যাটা-ঘং আওয়াজ হচ্ছিল প্রত্যেকবার রিলোডিং-এর সময়।
দাশকাকু বললেন, ওরে, বাঘ যে ঘাড়ে চলে আসবে, স্টপ ইট্, স্টপ দিস চাইল্ডিশ ফায়ারওয়ার্ক। বাড়ি চল, প্লীজ বাড়ি চল।
জেঠুমণির ম্যাগাজিন যখন শেষ হয়ে গেল তখন গুলি আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।
যুগল হতবাক হয়ে দাড়িয়ে ছিল।
রণক্ষেত্র শান্ত হলে অবাক গলায় সে জেঠুমনিকে শুধোলো, কওন্ চি থা সাহাব?
জেঠুমণি চটে উঠে বললেন, ম্যায় কা জানতা? তুম বাত্তি ফেকা থা। ম্যায় উসি লিয়ে গোলি চালায়া।
যুগল বলল, ও তো মাইকা। অভ্র। চারদিকে অভ্রখনি। এখানে সব নানারকম পাথরের ভাঁজে ভাঁজে মাইকা থাকে। মাইকা জ্বলে ওঠে, আলো পড়লেই।
জেঠুমণি বললেন, ই-শ-শ, এতগুলো গুলি!
দাশকাকু বললেন, তাই-ই ভাবছিলাম। বাঘ হলে কি আর অ্যাটাক করত না এতক্ষণে?
মাহমুদ বলল, এক এক গোলিকা কিম্মৎ কিনা সাহাব? জেঠুমণি বললেন, দশ টাকা।
তাড়াতাড়ি হিসাব কষে মাহমুদ হোসেন বলল, ইয়া আল্লা, কিতনা আচ্ছা খাসি মিল যাতা থা একঠো, ইতনা রূপেয়াসে।
মাহমুদ হোসেন জীপ এগোতেই দাশকাকু বললেন, কি রে? আরও যাবি নাকি? শিকার তো হলই। আর কেন?
জেঠুমণি বললেন, সবে তো সন্ধে। এর মধ্যে ফিরে গিয়ে কী করবি বাংলোতে?
মিনিট পনেরো জীপ চলল, মাঝে মাঝে নাইট-জার পাখিগুলো লাল লাল গোল চোখ আর বাদামী-ছাই শরীর নিয়ে একেবারে জীপের বনেট ফুঁড়ে ফুঁড়ে উড়ছিল!
ঋজুদা গল্প থামিয়ে আমাকে বলল, পাখিগুলো তুই তো দেখেইছিস নিশ্চয়ই। জঙ্গলের পথের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে —জীপটা যখন প্রায় তাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে ওমনি হঠাৎ সোজা মাটি থেকে ফর ফর করে উড়ে ওঠে।
দাশকাকু বললেন, এ কী অলক্ষুণে পাখি রে বাবা।
অলক্ষুণে কেন? জেঠুমণি বাঁদুরে টুপি পরা মাথা ঘুরিয়ে দাশ- কাকুকে শুধোলেন।
ঠিক এমন সময়—হিস্-স্-স্-স্ করে যুগলের শিস্ শোনা গেল। আমরা সকলে একসঙ্গে আলোর দিকে তাকালাম। এইখানে রাস্তাটার দু পাশে উঁচু পাথুরে জমি প্রায় দু-মানুষ সমান। বাঁ দিকে সেই জমির ঠিক উপরে একজোড়া লাল চোখ জ্বলছে। দুটি চোখের মধ্যের দূরত্ব সামান্যই। কিন্তু লাল।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, রিয়্যাল বাধ
আর যায় কোথায়?
জেঠুমণি রাইফেল তুলেছিলেন, দাশকাকু নিজের বন্দুকটা আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে অতর্কিতে পেছনের সীট থেকে জেঠুমণির উপর বডি-থো মারলেন এবং বডি-থো মেরেই দুহাতে রাইফেল-সমেত জেঠুমণিকে জাপটে ধরলেন। একে মোটা-সোটা জেঠুমণি মোটা ওভারকোট ও বাঁদুরে টুপিতে এমনিই আড়ষ্ট হয়ে ছিলেন, তার উপর এমন চোরা আক্রমণ।
যুগল নিবিষ্ট মনে ঐ চোখের দিকে চেয়ে ছিল। ড্রাইভারও। তারা দুজনেই জীপের মধ্যের ঐ হঠাৎ অনির্ধারিত আলোড়নে কোনো জানোয়ার পেছন থেকে উঠে পড়ল ভেবে চমকে উঠল।
জেঠুমণি কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে নিশ্ছিদ্র আবৃত শরীরের উপরে দাশকাকুর শরীর, মুখ ভর্তি পান জরদা—কী বললেন শোনা গেল না—শুধু একটা ওঁ ওঁ ওঁ আওয়াজ শোনা গেল।
দাশকাকু ক্রমান্বয়ে বলে চলেছিলেন, সবে বিয়ে করেছি, এক বছরের ছেলে, বৌকে আমার বিধবা করিস না, ওরে—রিয়্যাল বাঘ! রিয়্যাল বাঘ!
জেঠুমণি রিয়্যাল বাঘকে গুলি করবেন না এমন ভরসা যখন ওঁ আঁ ইত্যাদি সাংকেতিক প্রক্রিয়ায় দাশকাকু পেলেন ওঁর কাছ থেকে, তখন উনি জেঠুমণিকে ছেড়ে দিলেন।
জেঠুমণি ছাড়া পেয়ে, পানের ঢোক গিলে যুগলকে শুধোলেন, কওন চি? যুগল!
যুগল নৈর্ব্যক্তিক অথচ বিদ্রূপাত্মক গলায় বলল, আঁখ খোল কর্ দেখিয়ে না। আভভিতক্ তো খাড়াই হ্যায়।
দাশকাকু চোখ বন্ধ করে বললেন, গাড়ি ঘুমাও ড্রাইভার।
এমন সময় সেই রিয়্যাল বাঘ উপর থেকে আমাদের উপরেই প্রায় জাম্প মারল।
দাশকাকু দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।
বন-বিড়ালটা ধুলো আর পাথরে ভরা অসমান রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার এই ভীরু-ভরা জীপগাড়ির দিকে তাকিয়েই দৌড়ে ডানদিকের জঙ্গলে চলে গেল।
দাশ কাকু ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়ে, কী বলবেন ভেবে না পেয়ে বললেন, ওয়েল, ইট কুড় এ্যাজ ওয়েল বী আ রিয়্যাল টাইগার ইট কুড় ইজিলি বী!