বধূ-বরণ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

বধূ-বরণ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

নারীর সঙ্গে এমনি করিয়াই জীবনে তাহার প্রথম পরিচয়।

বাসন্তী চিঠি লিখাইতে আসে।

বলে, ‘লেখ্ প্রাণেশ্বর—’

প্রাণেশ্বরের অর্থ বুঝিবার মত বয়স তখন ননীমাধবের হইয়াছে। মুখ-কান তাহার লাল হইয়া ওঠে, সলজ্জ একটুখানি হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলে, ‘না।’

কিন্তু ‘না’ বলিলেই চলে না। বাসন্তীর শহরে স্বামী সেদিন তাহাকে গেঁয়ো ভূত বলিয়া উপহাস করিয়া গেছে। সুতরাং উহা তাহাকে লিখিতেই হইবে।

বাসন্তী তাহার হাতখানি চাপিয়া ধরিয়া বলে, ‘না ভাই, লক্ষ্মী মানিক আমার!’

তা হাত ধরিবার দোষ নাই। এই সেদিন পর্যন্ত দুজনে একসঙ্গে খেলা করিয়াছে।

দুর্ভাগ্য ননীমাধবের।

পনের বছরেই বাসন্তীকে দেখায় যেন এক মস্ত ডাগর মেয়ে; আর চোদ্দ বছরের ননীমাধব,—সেই যে-ছোটকে সেই ছোট!

উপরোধে কে নাকি টেকি গিলিয়াছিল, এ তো সামান্য কথা।

ননীমাধবকে লিখিতে হয়।

কিন্তু তাহার পর অনর্গল যে-সব কথা বাসন্তীর মুখ দিয়া বাহির হইতে থাকে, চিঠিতে তাহা লিখিবাব নয়; তবু ননীমাধব যা-হোক করিয়া লিখিয়া চলে।

বাসন্তী বলে, ‘পড় দেখি—শুনি।’

ননীমাধব উঠিয়া দাঁড়ায়। বলে, ‘পারব না।’

বাসন্তী লেখাপড়া জানে না। কিন্তু যাদুবিদ্যা জানে হয়তো। সে এক অদ্ভুত গ্রীবাভঙ্গি করিয়া আয়ত ঢলঢলে চোখ দুইটি তুলিয়া ননীমাধবের পানে ফিরিয়া চাহিতেই তাহাকে বসিতে হয়। যাহা না লিখিয়াছে তাহাও পড়িয়া শোনায়। বাসন্তী খুশি হইয়া বলে, ‘আর—দুটি কথা।’

ননীমাধব আবার বাঁকিয়া বসে।

কিন্তু এবার আর চোখের চাহনি দিয়া নয়, গ্রীবাভঙ্গি করিয়া নয়, বাসন্তী হাতে ধরিয়া টানিয়া তাহাকে কাছে বসায়, বসাইয়া কি যে করে কে জানে, ননীমাধব তৎক্ষণাৎ গলিয়া জল হইয়া গিয়া আবার লিখিতে শুরু করে।

নিচের উঠান হইতে মামীমা ডাকেন, ‘ননী!’

ভয়ে একেবারে জড়সড় হইয়া জিব কাটিয়া ননী তাহার হাতের কলম দোয়াতের ভিতর ছাড়িয়া দেয়।

বেলা তখন পড়িয়া আসিয়াছে। মাটির ঘরের দোতলায় ছোট্ট জানালাটির পাশে তাহারা বসিয়াছিল। জানালার পথে উঁকি মারিয়া বাসন্তী বলিল, ‘হয়ে গেল মাসীমা, ওকে দিয়ে একখানা চিঠি লিখিয়ে নিচ্ছিলাম মাসীমা—হয়ে গেছে।’

বলিয়াই সে ননীমাধবের মুখের পানে তাকাইয়া পিঠে হাত দিয়া বলিল, ‘দে ভাই,—দে তাড়াতাড়ি ওইটুকু শেষ করে দে।’

কিন্তু ননীমাধব তখন মামীমার ভয়ে কাঠ হইয়া গেছে। সে আর কিছুতেই কলম হাতে লইল না। বলিল, ‘কাল হবে।’

বলিয়াই সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া একরকম ছুটিয়াই নিচে চলিয়া গেল।

সুনয়না তখন গোয়ালে বাছুর বাঁধিয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। ননীমাধবকে দেখিবামাত্র দাঁত কিসমিস করিয়া উঠিলেন। —‘আ, মরণ! বাপ পাঠিয়েছেন পড়তে, পড়া না তোর পিণ্ডি হবে।’

বাসন্তী চলিয়া গেলে তিনি আবার শুরু করিলেন, ‘ওই সব ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়ে—লজ্জাও তো লাগে না মা! কেন, দিনের মাথায় ওদের তো চিঠি লিখতে পারিস পঞ্চাশ গণ্ডা, আর আমি যা বলেছি, লিখেছিস তোর বাপকে?’

ননীমাধব ঘাড় নাড়িল। বলিল, ‘কাল লিখব।’

‘এখনও কাল? বলেছি কতদিন তার ঠিক নেই। লিখিস—পাঁচ টাকায় আর চলবে না বাপু, আমি হিসেব করে দেখেছি। কাপড় এক জোড়া কিনে দিয়েছি, তার দাম যেন পাঠিয়ে দেয়। আমি দেব কোখেকে?’

এমন সময় পাড়ার একজন মেয়ে আসিয়া উঠানে দাঁড়াইল।—‘কি গো, কি হচ্ছে? ভাগনের সঙ্গে কথা হচ্ছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ মা, এস। কই, তুমিই বল দেখি চন্দর-মা, এই ছেলের দু’বেলা খাওয়া আছে, জল খাওয়া আছে, ইস্কুলের মাইনে আছে, তার ওপর ছেলে মানুষ করা বলে কথা—হেন-তেন সাত-সতের তো আছেই। তা বাপ ওর মাসে পাঁচটি করে টাকা পাঠিয়ে দিয়েই খালাস। তাই বলছিলাম—লেখ তোর বাপ-মিন্‌সেকে। মিন্‌সের অভাব তো নেই গা,—কিপ্পিন্ মিন্‌সে দিতে চায় না, বুঝলে?—বস চন্দর-মা, বস।’

বাপ-মিন্‌সে এই গ্রামেরই জামাই! চন্দর-মা তাহাকে চিনিত। বলিল, ‘শশধরের অভাব কি মা?’

বলিয়াই সে বসিল।

বলিল, ‘বুড়ো বয়সে মিন্‌সে আবার বিয়ে করতে কেন গেল গা? এমন সুন্দর ছেলে—বিয়ে দিলেই দুদিন পরে ঘর-সংসার সবই হত।’

সুন্দর ছেলে তপন সরিয়া পড়িয়াছে।

কিন্তু ননীমাধব ঘাড় নাড়িলে কি হইবে—

মেয়েরা ছাড়ে না।

চিঠি আসিলে তাহা পড়াইতেও হয়, আবার জবাব না লিখিলেও চলে না।

একা বাসন্তী ছিল, এখন আবার আরও পাঁচজন আসিয়া জুটিয়াছে।

দুলী আসে, চঞ্চলা আসে, সখী আসে, মালতী আসে।

মামীমার ভয়ে বেচারা ননীমাধব সর্বদা সশঙ্কিত হইয়া থাকে। সুনয়নার বাড়ি সুবিধা হয় না।

চঞ্চলা বলে, ‘চ ভাই, আমাদের বাড়ি চ।’

বাড়ি তাহাদের একেবারে ফাঁকা।

রান্নাঘরের দোতলাটায় বাস কেহ করে না। আধখানা জুড়িয়া শুকনো বালি বিছাইয়া সম্বৎসরের আলু রাখা হইয়াছে। বাকী আধখানা হাঁড়িতে-কলসীতে বোঝাই।

তাহারই এক পাশে কোনমতে একটুখানি জায়গা করিয়া লইয়া চঞ্চলার চিঠি লেখা চলে।

চঞ্চলার চিঠি লেখা না ছাই! চিঠি লেখাইতে সে জানে না।

ননীমাধবের কাছে গিয়া বসে। বসিয়া বলে, ‘দে না ভাই একটা জবাব লিখে। ও কি লিখেছে দেখলি তো?’

ননীমাধব বিপদে পড়ে। বলে, ‘বাঃ, আমি কি লিখব? তোর চিঠি, তুই বল, আমি লিখি।’

চঞ্চলা বলিবার চেষ্টা করে। একটুখানি সরিয়া বসিয়া চোখ বুজিয়া কিয়ৎক্ষণ ধ্যানস্থ হইয়া ভাবে, তাহার পর খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠে।

‘নাঃ, আমি পারব না বলতে।’

ননীমাধব তখন নিজেই লিখিতে শুরু করে। লেখে, ‘শ্রীচরণকমলেষু, আপনি কেমন আছেন, আমি ভাল আছি।’

লিখিয়া পড়িয়া শোনায়।

ননীও হাসে, চঞ্চলাও হাসে।

হাসিতে হাসিতে একেবারে গড়াইয়া পড়ে!

চঞ্চলা বলে, ‘বাস্! এইবার ঠিকানা লিখে ফেলে দাওগে যাও।’

এমন সময় সিঁড়ির দরজায় শব্দ হয়।

সহসা হাসি থামাইয়া চঞ্চলা বলে,‘কে!’

ননীমাধব ভয়ে জড়সড় হইয়া জিব কাটিয়া সরিয়া বসে। চুপি চুপি বলে, ‘কে ভাই, মামী নয় তো?’

‘না’ বলিয়া চঞ্চলা উঠিয়া গিয়া খিল খুলিয়া দেখে, মালতী।—‘ওমা, তুই?’

হাসিতে হাসিতে দুমদুম করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া দুজনেই উপরে উঠিয়া আসে।

মালতীরও চিঠি লিখাইবার কথা ছিল। চঞ্চলা বলে, ‘তুই ভাই আগে লেখা।’

ঠোঁট উল্টাইয়া মালতী বলে, না ভাই, আমার অত সখ নাই। তার চেয়ে আয় বরং আমরা বৌ-বৌ খেলি।’

বৌ-বৌ খেলা তাহারা ছোটবেলায় খেলিয়াছে। খেলাটা ভারি মজার খেলা।

চঞ্চলা প্রথমে রাজী হয় না। কিন্তু মালতী ছাড়িল না। বলিল, ‘না ভাই, খেলতেই হবে।’

ননীমাধব দেখিল, চিঠি লেখার চেয়ে বৌ-বৌ খেলা ঢের ভাল।

দুজন মেয়ে। একজন বৌ—একজন ননদ।

ননীমাধব হইল—বর।

কিন্তু কে ননদ আর কে বৌ, এই লইয়া বচসা বাধিল।

শেষে মালতীরই হইল জিৎ। তাহার বৌ হইবার বড় সাধ।

নিচে সিঁড়িটা হইল তাহাদের বাড়ি। আর উপরের ঘরখানা হইল কলিকাতা শহর।

কলিকাতায় ননীমাধব চাকরি করে।

হঠাৎ একদিন উপরের কলিকাতা হইতে চাকরি করিয়া হাসিমুখে ননীমাধব তাহার নিচের সিঁড়ির ঘরে আসিয়া পৌছিল।

কিন্তু আসিয়াই দেখে মহামারী কাণ্ড! ননদ-ভাজে ঝগড়া করিয়া দুইজনে দুই সিঁড়ির ধাপে গম্ভীরভাবে বসিয়া আছে। দুদিন ধরিয়া তাহাদের রান্না নাই, খাওয়া নাই,—কথা কওয়া তো একেবারেই বন্ধ হইয়াছে। বৌ কাঁদিয়া কাটিয়া ঝগড়ার বিবরণ তাহাকে যাহা জানাইল,—শুনিয়া মনে হইল বোনের দোষ, আবার বৌ-এর কাছ হইতে উঠিয়া বোনের কাছে গিয়া বসিতেই বোন যাহা বলিল, তাহাতে মনে হইল—বৌ-এর দোষ।

কি করিবে বেচারা তো তখন ভাবিয়াই অস্থির!

চুপি চুপি বৌ-এর কাছে পরামর্শ চাহিতেই অভিমান করিয়া মুখ ফিরাইয়া বৌ বলিল, ‘যাও!’

অনেক সাধ্য-সাধনা করিয়া বৌ-এর মান যখন ভাঙ্গিল, বৌ তখন ধরিয়া বসিয়াছে,—সে আর এমন মুখরা ননদের কাছে বাস করিবে না। করিতে হইলে কোন্ দিন বিষ খাইয়া মরিবে; সুতরাং তাহাকে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া হোক।

ননীমাধব বোনকে অনেক করিয়া বুঝাইতে লাগিল। মালতী চোখ টিপিতেই বুঝিতে তাহার দেরি হইল না।

ননীমাধব তৎক্ষণাৎ তাহার কোঁচড় হইতে পনেরটি আলুর টাকা গুনিয়া শুনিয়া চঞ্চলার আঁচলে ফেলিয়া দিয়া বৌকে লইয়া কলিকাতা রওনা হইল।

কলিকাতা হইতে তাহারা আর ফেরে না।

বোনের রাগ তখন পড়িয়া গেছে। ক্রমাগত চেঁচাইয়া চেঁচাইয়া চিঠি পাঠাইতে থাকে,—‘বাবা রে বাবা, টাকা ফুরিয়ে গেল, এবার আমি খাই কি!’

‘টাকা না পাঠালে এবার আমি পরের বাড়ি ভাত রাঁধব গিয়ে।’

‘আমায় এখানে একা ফেলে রেখে কেমন নিশ্চিন্তি আছে দেখ তো।’

কিন্তু অন্ধকার সিঁড়ির নিচে মশা ভনভন করিতেছিল। অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চঞ্চলা সত্যই একটুখানি চঞ্চল হইয়া উঠিল। বলিল, ‘না ভাই, এস এবার।’

দুজনেই নামিয়া আসিল।

চঞ্চলা বলিল, ‘এবার ভাই আমি বৌ হব।’

মালতী বলিল, না ভাই অনেকক্ষণ এসেছি। যাই এবার মা বকবে।’

চঞ্চলা বলিল, ‘তবে আবার কাল খেলব। তুই আসবি তো ভাই?’

ননীমাধব ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ।’

ননীমাধবের বাবার কাছ হইতে চিঠির জবাব আসিয়াছে।

শশধর লিখিয়াছেন, পাঁচ টাকার বেশি তিনি পাঠাইতে পারিবেন না।

একটি ছেলের জন্য মাসিক পাঁচ টাকাই যথেষ্ট।

চিঠির খবর ননীমাধব দিন পাঁচ-ছয় চাপিয়া রাখিয়াছিল।

মামীমা ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাঁরে, চিঠি তুই লিখেছিলি তো? না মিথ্যে কথা বলছিস?’

ননীমাধব বলে, ‘লিখেছি।’

কিন্তু চিঠির জবাব যখন কিছুতেই আসে না, তখন সুনয়না তাহাকে এবং তাহার বাবাকে উদ্দেশ করিয়া এমনসব কটু কথা বলিতে শুরু করিলেন, যাহা শুনিলে মানুষের রাগ হইবারই কথা।

ননীমাধব তখন আর সংবাদটা চাপিয়া রাখা উচিত মনে করিল না। বই-এর দপ্তর খুলিয়া তাহার একটি পাঠ্যপুস্তকের ভিতর হইতে সযত্ন-রক্ষিত তাহার পিতার চিঠিখানি আনিয়া মামীমার পায়ের কাছে ফেলিয়া দিয়া ম্লান-মুখে সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল।

সুনয়না ভাবিয়াছিলেন, ঠাকুর-জামাই-এর অগাধ সম্পত্তি, তাও আবার একটিমাত্র ছেলে, দশটি করিয়া টাকা তো সে নিশ্চয়ই পাঠাইবে, এমন কি বেশি পাঠাইতেও পারে। চিঠি এতদিন তাঁহার না লেখানোই অনুচিত হইয়াছে। বলিলেন, ‘পড় বাবা, পড়ে শোনা, আমি তো আর পড়তে জানিনে।’

ননীমাধব ধীরে ধীরে চিঠিখানি পড়িয়া শুনাইল।

সুনয়নার মুখ-চোখ তখন লাল হইয়া উঠিয়াছে। গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘হুঁ।’ বলিয়াই গুম্ হইয়া বসিয়া রহিলেন।

পরদিন হইতে ননীমাধবের আর স্বস্তি রহিল না। উঠিতে-বসিতে যখন-তখন মামীমা তাহাকে যা তা বলিতে আরম্ভ করিলেন। সব দোষ যেন তাহারই।

বেচারা চোরের মত ঘরে আসিয়া ঢোকে, আবার চোরের মত বাহির হইয়া যায়। কি যে করিবে কিছুই ভাবিয়া পায় না।

এক-একবার ভাবে তাহার বাবাকে একখানা চিঠি লিখিবে; আবার ভাবে, কাজ নাই, এমনি করিয়া যতদিন চলে চলুক। বাবাকে জীবনে সে তাহার খুব কমই দেখিয়াছে, লিখিতে ভয়ও করে, আবার লজ্জা হয়। ভাবে, এই লইয়া মালতীর সঙ্গে একবার পরামর্শ করিবে।

মামীমা তাহার চোখের সুমুখে খাবার থালা ধরিয়া দিয়া প্রত্যেকটি জিনিসের দর করিয়া করিয়া দেখাইয়া দেন যে, প্রতিদিন দু’বেলায় অন্তত পক্ষে আট আনা মূল্যের আহার্য বস্তু যে গলাধঃকরণ করিতে পারে তাহার মাসিক ব্যয় পনের টাকার পরিবর্তে তিনি যদি পাঁচ টাকা করিয়া গ্রহণ করেন, তাহা হইলে দশটি করিয়া টাকা তাঁহাকে লোকসান দিতে হয়। এবং প্রতিমাসে এতগুলি টাকা লোকসান বহন করিবার মত সামর্থ্য তাঁহার নাই।

বলেন, ‘জানি আমি। দিষ্টিকিপ্পিন্ সে মিন্‌সেকে আমি চিনি না! তার চেয়ে কাজ নেই বাপু, নিজের ছেলে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখুক, ভাল-মন্দ খাওয়াক পরাক, যা খুশি তাই করুক, তাতে আমার কি! আমি একে গরীব মানুষ, নিজেই খাব কি তার ঠিক নেই, আমি কোথায় পাব বল!

ননীমাধব একটি কথারও জবাব দেয় না।

সুনয়না বলেন, ‘পরের চিঠি লিখতে খুব বাহাদুর! চিঠি তুই কি ভাল করে লিখেছিলি? গুছিয়ে লিখতেই যে পারিসনি।’

ননীমাধব তবু চুপ করিয়া থাকে।

‘চুপ করে রইলি যে? আ মর্! তার বেলা মুখে রা নেই। পাঁচ পাঁচ দশ টাকা আমার দু’মাসের বাকী পড়ে রয়েছে এখনও। কালই চিঠি লিখে দিস—টাকা যেন আমায় লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, আর অমনি নিয়ে যায় যেন তোকে।’

ননীমাধব বলে, ‘দেব।’

সুনয়না বলেন, ‘দেব নয়—দিস।’ বলিয়া একটুখানি থামেন। থামিয়া আবার শুরু করেন, ‘দেবে এমনি করে আমার মত পঞ্চোপচার সাজিয়ে দু’বেলা? খাবি।—খাবি আর কি,—সৎমায়ের ঝাঁটা খাবি লাথি খাবি।—সৎ-মা মাগী দজ্জাল-বাটপাড়ের একশেষ। জানি আমি। শুনেছি রে—সব শুনেছি। শুনতে কিছু বাকী থাকে না।’

ননীমাধব চিঠি লিখিল, কিন্তু তাহার জবাবের অপেক্ষা আর করিতে হইল না।

বাসন্তী আজ কয়েকদিন হইতেই ননীমাধবকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। কিন্তু ননীমাধবকে খুঁজিয়া পাওয়া আজকাল নাকি দুঃসাধ্য। তাহার মামীমা অন্তত তাহাই বলেন। তবে তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইবার কারণ যাহা, তাহা সকলের কাছে বলিবার নয়। বাসন্তী এই লইয়া আর বেশি হৈ চৈ করিতে পারে না।

বৈকালে গা ধুইবার জন্য কলসী কাঁখে লইয়া দল বাঁধিয়া মেয়েরা পুকুরে যায়। অন্যদিন চঞ্চলাই বাসন্তীকে ডাকিতে আসে। সেদিন সে আসিল না দেখিয়া বাসন্তী নিজেই তাহার বাড়ির দিকে চলিতে লাগিল।

গিয়া দেখে, নিস্তব্ধ বাড়ির প্রাঙ্গণে মাত্র কয়েকটা কাক উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে,—কোথাও কাহারও সাড়াশব্দ নাই।

বাসন্তী ডাকিল, ‘চঞ্চলা!’

সুমুখে টিনের ঘরটার উপর হইতে কে যেন সাড়া দিল, ‘যাই।’

বাসন্তী একটুখানি আগাইয়া গিয়া দেখে, দরজার খিল খুলিয়া মালতী বাহির হইয়া আসিতেছে।

মালতীকে দেখিবে বাসন্তী তাহা ভাবে নাই। জিজ্ঞাসা করিল, ‘চঞ্চলা কই?’

‘আসছে।’ বলিয়া আঙ্গুল বাড়াইয়া উপরের সিঁড়ি দেখাইয়া দিল।

বলিল, ‘আসছে, চল।’

বাসন্তী কিন্তু গেল না। বলিল, ‘কেন দেরি করছিস কেন লা? সন্ধে হয়ে যাবে। ঘুমোচ্ছিস বুঝি?’

বলিতে বলিতে এক এক ধাপ করিয়া সিঁড়ি উঠিতে উঠিতে উপরে গিয়া দেখে, চঞ্চলা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। পশ্চাতে ননীমাধব।

হাসিয়া বলিল, ‘চিঠি লেখাচ্ছিলাম ভাই।’

বাসন্তী হাসিল না, একটি কথাও বলিল না, ননীমাধবের পানে একবার মাত্র তাকাইয়াই গম্ভীর ভাবে চুপ করিয়া রহিল।

বৈকালে তিন চার জনে দল বাঁধিয়া পুকুরে যাওয়া তাহাদের প্রতিদিনের অভ্যাস। হাসিতে গল্পে সময়টা তাহাদের কাটে ভাল। সেদিন বাসন্তীর মুখ দিয়া আর কথা সরে না।

বেশি কথা বলা চঞ্চলার স্বভাব নয়।

কথা বলিতেছিল মালতী।

বাসন্তীর শুনিবার ইচ্ছা নাই অথচ মালতী ক্রমাগত বলিয়া চলে।

পুকুরের কাছে গিয়া বাসন্তী বলিল, ‘আঃ, চুপ কর না ভাই, আবোল-তাবোল বকছিস কেন মিছেমিছি!’

লজ্জায় মালতী চুপ করিল।

বাসন্তী এবার চঞ্চলাদের বাড়ি গিয়া উঠানের কাছ হইতে তাহাকে চিৎকার করিয়া ডাকে না।

চোরের মত পা টিপিয়া টিপিয়া প্রায় প্রত্যহই তাহাদের বাড়ি গিয়া টিনের ঘরখানার সিঁড়ির দরজাটার পাশে চুপ করিয়া দাঁড়ায়। কোনদিন দেখে, ভিতর হইতে দরজা বন্ধ, উপরে তাহাদের চিঠি লেখা চলিতেছে। মাঝে-মাঝে দু’একটা কথা শোনা যায় মাত্র। আবার কোনদিন-বা নিরাশ হইতে হয়। দেখে, দরজা খোলা, আলুগুলা সরানো হইয়াছে, আর তাহারই পাশে মালতী, চঞ্চলা, সখী ও সুমতি—চারজনে মুখোমুখি বসিয়া কড়ি চালিয়া দশ-পঁচিশ খেলিতেছে।

দিন সাত আট পরে একদিন সে দরজা বন্ধ দেখিয়া চৌকাটের পাশে গিয়া কান পাতিয়া দাঁড়াইয়াছে, শুনিল, দরজার ওপারে সিড়ির উপর হইতে সখী বলিতেছে, ‘দেরি হচ্ছে, এবার কিন্তু ভাই চিঠি লিখব।’

ব্যাপারটা বাসন্তী ভাল বুঝিতে পারিল না। চিঠি লেখালেখির কথা শুনিয়া আন্দাজি ভাবিল, ননীমাধব সেখানে নিশ্চয়ই আছে।

‘যাচ্ছি।’—গলার আওয়াজ ননীমাধবের।

বাসন্তী তাহাই শুনিল। এবং শুনিয়া অবধি সর্বাঙ্গ তাহার রী রী করিতে লাগিল।

অন্যদিন সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে। দাঁড়াইয়া থাকিয়া থাকিয়া তাহার যখন আর সহ্য হয় না, তখন ডাকে, ‘চঞ্চলা, আয়।’

আজ কিন্তু সে-অবসর তাহার আর রহিল না, তেমনি পা টিপিয়া টিপিয়া সেখান হইতে সরিয়া পড়িল।

ধীরে ধীরে শীত পড়িতেছে। সুনয়না তাঁহার ঘরের দাওয়ায় বসিয়া কাঁথা সেলাই করিতেছিলেন। বাসন্তী বলিল, ‘কি করছ মাসী?’

‘কেন, দেখতে পাচ্ছিস না কি করছি?’ এই বলিয়া মুখ না তুলিয়াই তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘চিঠি লেখাতে আর আসিসনি যে বাসু?—আর আসবি কার কাছে মা? হতভাগা বাড়িতে কি আর থাকে কোনদিন?’

বাসন্তী বলিল, ‘কোথা থাকে তা তুমি জাননা মাসীমা?’

‘কি করে জানব বাছা, তোরাই জানিস।’

‘এস, দেখবে এস।’ বলিয়া বাসন্তী তাঁহার হাতে ধরিয়া একরকম টানিয়াই তুলিল এবং জোর করিয়া তাঁহাকে চঞ্চলাদের বাড়ি লইয়া গিয়া দরজার কাছে চুপি চুপি বলিল, ‘দাঁড়াও তুমি।’

বাসন্তী ডাকিল, ‘চঞ্চলা!’

টিনের ঘরের দোতলার মৃদু গুঞ্জন সহসা মিয়া গেল। এমন অসময়ে বাসন্তী কোনদিন ডাকে না।

‘যাই।’ বলিয়া চঞ্চলা নামিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি?’

বাসন্তী বলিল, ‘ননীমাধব আছে?’

‘হা’ ‘না’ কিছুতেই সে বলিতে পারিল না, দূরে সুনয়নাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া হতভম্ব হইয়া শুকনো মুখে শুধু একবার ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, ‘আছে।’

বাসন্তী বলিল, ‘ডাক।’

চঞ্চলা ডাকিতেই চোরের মত ধীরে ধীরে ননীমাধব আসিয়া দাঁড়াইল।

সুনয়না ইতিমধ্যে অনেকখানি আগাইয়া আসিয়াছেন। তিনি আর কোন কথাটি বলিলেন না, টপ করিয়া বা-হাত দিয়া তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া যৎপরোনাস্তি প্রহার লাগাইয়া দিলেন।

ননীমাধবের মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির হইল না, চোখ দিয়া দরদর করিয়া জল ঝরিতে লাগিল। সুনয়নার তখন রোখ চাপিয়া গেছে, কিছুতেই তিনি থামিতেছেন না দেখিয়া বাসন্তী জোর করিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া থামাইয়া দিল।

সুনয়না রাগে থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিত বলিলেন, ‘হ—ত ভাগা!’

সখী, চঞ্চলা, মালতী, বাসন্তী—সকলেই দাঁড়াইয়াছিল। ননীমাধব মুখ তুলিয়া লজ্জায় কাহারও মুখের পানে একটিবার তাকাইতে পারিল না, নীরবে মাথা হেঁট করিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে দ্রুতপদে সেখান হইতে চলিয়া গেল।

কিন্তু সেই যে চলিয়া গেল, আর সে ফিরিল না। পাঁচ-ছ’ ক্রোশ দূরের একটা গ্রামে, দেখা গেল, রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় ননীমাধব মাত্র তাহার কাপড়খানি গায়ে দিয়া চারিদিকে প্রাচীরঘেরা একখানি বাড়ির দরজায় গিয়া ডাকাডাকি করিতেছে।

অগ্রহায়ণের শেষ। সকাল-সন্ধ্যায় আজকাল রীতিমত শীত। ছেলেটা বোধ করি এতখানি পথ একরকম ছুটিয়াই আসিয়াছে, তাহা না হইলে আজ আর তাহাকে এই শীতের রাত্রে থরথর করিয়া না কাঁপিয়া এমন সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে হইত না।

অনেক ডাকাডাকির পর একটি মেয়ে আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। ছিপছিপে দোহারা গড়ন। বয়স কুড়ি কি পঁচিশ কিছুই বুঝিবার উপায় নাই। বাঁ-হাতে একটি কেরোসিনের কুপি। সেই আধ-আলো আধ-অন্ধকারে দেখা গেল, মুখখানি সুন্দর, চোখ দুটি ঢলঢলে।

আন্দাজে ঠাহর করিয়া ননীমাধব হেঁট হইয়া একটি প্রণাম করিল। পায়ে হাত দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘বাবা আছেন?’

মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কে?’

‘আমি ননীমাধব।’

‘ও!’ বলিয়া ঠোঁটের ফাঁকে একটুখানি হাসিয়া মেয়েটি তাহাকে আলো দেখাইয়া বলিল, ‘এস।’

পাকা ইটের ছোট্ট একটি একতলা বাড়ি। সুমুখে একটুখানি রক। সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া গিয়া দরজার কাছ হইতে ভিতরে একটা তক্তপোশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দিয়া মেয়েটি বলিল, ‘যাও ওইখানে। জ্বর হয়েছে তোমার বাবার!’

মিনিট পনের-কুড়ি মেয়েটিকে আর দেখা গেল না।

ঘরের এককোণে একটি লণ্ঠন জ্বলিতেছিল। তক্তপোশের উপর আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়া বোধ করি তাহার বাবা শুইয়া আছেন। ননীমাধব শিয়রের কাছে গিয়া চুপ করিয়া বসিল।

কিন্তু মেয়েটি পুনরায় ফিরিয়া আসিয়া ঘরে ঢুকিতেই দেখে, ননীমাধব তখনও তেমনি চুপটি করিয়া হেঁটমুখে বসিয়া আছে, লজ্জায় বোধ হয় বাবাকে সে তাহার ডাকিতে পারে নাই। জোরে জোরে বলিল, ‘ওগো শুনছ, দেখ—দেখ কে এসেছে।’

হঠাৎ ডাক শুনিয়া শশধরের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। কথাটা ভাল শুনিতে পান নাই। মুখের ঢাকা খুলিয়া হতভম্বের মত চোখ চাহিয়া বলিলেন, ‘কি?’

‘দেখ তাকিয়ে, কে এসেছে দেখ।’

‘কে?’ বলিয়া পাশ ফিরিয়া চাহিতেই দেখেন ননীমাধব। দেখিয়াই একটুখানি অবাক হইয়া গেলেন। বলিলেন, ‘তুই? এত রাত্রে?’

মেয়েটি জবাব দিল। —‘এসেছে হয়তো রাগ-টাগ করে। গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, কোঁচার খুটে গা ঢেকে এসেছে।’

লেপের ভিতর হইতে একখানা হাত বাহির করিয়া ছেলের হাতখানা চাপিয়া ধরিয়া বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হাঁরে?’

নীরবে শুধু একবার ঘাড় নাড়িয়া ননীমাধব বসিয়া রহিল।

তাহার পর অত্যন্ত ধীরে ধীরে কহিল, ‘আর আমি ওখানে থাকব না।’

শশধর কোন কথাই বলিলেন না, মেয়েটি সুমুখে দাঁড়াইয়াছিল, একবার শুধু তাহার মুখের পানে তাকাইয়া একটি নিশ্বাস ফেলিলেন মাত্র।

সকলেই চুপ।

মেয়েটি সেখান হইতে সরিয়া গিয়া পাশের ঘরের দরজা খুলিয়া ভিতরে ঢুকিল।

ননীমাধবের হাতখানি আর একবার চাপিয়া ধরিয়া শশধর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘পাঁচ টাকার বেশি দিতে চাইনি, তাই কিছু বলেছে ঠিক। না?’

ননীমাধব ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হাঁ।’

শশধর বলিলেন, ‘হুঁ, তা জানি। মাগী চামারের একশেষ।’

বলিয়াই ডাকিলেন, ‘মায়া!’

ঘরের ভিতর হইতে মেয়েটি সাড়া দিল, ‘কি!’

‘খাবার-টাবার কিছু…’

‘জানি গো জানি, তুমি চুপ কর।’ বলিয়া মায়া তৎক্ষণাৎ বাহিরে আসিয়া বলিল, ‘এস ননীমাধব, বাইরে জল আছে বালতিতে, হাত-পা ধোও, ধুয়ে এসে তুমি খাবে এস।’

খাইতে বসিয়া ননীমাধব দেখে, মামীমার কথা একদম ভুল। দিব্য পরিপাটি করিয়া কার্পেটের একখানি আসন পাতিয়া খাইতে দেওয়া হইয়াছে। পঞ্চোপচার না হোক্—আহার্যের পরিমাণ কম নয়, তরি-তরকারি ভাত ডাল- এমন কি,—আস্ত একটা মাছের মুড়া পর্যন্ত দেওয়া হইয়াছে।

হাসিতে হাসিতে মায়া তাহার সুমুখে আসিয়া বসিল। বসিয়া বলিল, ‘লজ্জা করিসনে ননীমাধব।’

তাহার পর কত কথা!

‘রাতের রান্না আমি সবই রেখে দিই। কাল সকালে খাই। শীতকাল। এতক্ষণ হয়তো সব ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে।’

‘তোর বাবাকে আমি কতদিন বলেছি তোকে নিয়ে আসতে। উনি বলেন, ‘থাক্, বেশ আছে।’

‘শীত করছে, না? তা তো করবেই। দাঁড়া!’ বলিয়া মায়া হাত বাড়াইয়া সুমুখে কয়েকটা টিনের তোরঙ্গের উপর হইতে গোলাপী রঙের একটি ভাঁজ করা গায়ের কাপড় টানিয়া আনিয়া ননীমাধবের গায়ের উপর বেশ করিয়া জড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘খাও এবার। সব ক’টি খেতে হবে কিন্তু।’

পথশ্রমের ক্লান্তির জন্যই বোধ করি তাহার ক্ষুধা পাইলেও ভাল করিয়া খাইতে পারিল না।

শয়নের ব্যবস্থাও চমৎকার!

ননীমাধব শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল, এতদিন কেন সে এখানে আসে নাই? মামীমার মার খাইয়া আর একবার সে এমনি চলিয়া আসিতে চাহিয়াছিল কিন্তু ওই বাসন্তীই তাহাকে আসিতে দেয় নাই। চঞ্চলা, মালতী, সখী, সুমতি—সকলের কথাই তাহার মনে পড়িল। কাল হয়তো তাহারা তাহাকে খুঁজিয়া মরিবে। খুঁজুক!

মায়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার বিছানার এক পাশে হাতের উপর মাথা রাখিয়া শুইয়া শুইয়া গল্প করিয়া গেছে। দেখিতে সে অনেকটা বাসন্তীর মতই। তাহাকে সে যে কি বলিয়া ডাকিবে তাহাও সে কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া চিন্তা করিল। নিজের মা তাহার অতি শৈশবেই মরিয়াছে। মা বলিয়া আজ পর্যন্ত কাহাকেও সে ডাকে নাই। ননীমাধবের কেমন যেন লজ্জা করিতে লাগিল।

এমনি করিয়া একথা-সেকথা ভাবিতে ভাবিতে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। সকালে চোখ মেলিয়া দেখে, মায়া আবার কখন তাহার পাশে আসিয়া শুইয়াছে।

দিনের আলোয় ননীমাধব তাহার ঘুমন্ত মুখখানি ভাল করিয়া একবার দেখিয়া লইতেছে, এমন সময় মায়ার ঘুম ভাঙ্গিল। হঠাৎ চোখাচোখি হইতেই ননীমাধবকে সে তাহার কোলের কাছে টানিয়া ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তাকিয়েছিলে যে অমন করে?’

নিতান্ত লজ্জিত হইয়া ননীমাধবও হাসিয়া মুখ নামাইল।

রাত্রে যাহাকে সে বাসন্তীর মত দেখিয়াছিল, দিনের আলোয় তাহাকে সে আর-একরকম দেখিল। সে যে এত সুন্দর, গতরাত্রির অস্পষ্ট আলোকে তাহা সে বুঝিতে পারে নাই।

মায়ার নিশ্বাসের বাতাস ননীমাধবের মাথার চুলে আসিয়া লাগিতেছিল। সে আর অমন করিয়া শুইয়া থাকিতে পারিল না, ধীরে-ধীরে চোখ দুইটি তুলিয়া বলিল, ‘উঠি।’

মায়া হাতখানি তাহার ছাড়িয়া দিয়া চোখ বুজিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘ওঠো।’

গ্রামখানিও মন্দ নয়।

দু’চার দিনের মধ্যেই ননীমাধবের সঙ্গী জুটিয়া গেল বিস্তর। সৎ-মা নাকি কাহারও ভাল হয় না, ননীমাধবেরও ধারণা ছিল তাই। কিন্তু তাহার কপাল ভাল,—আসিয়া অবধি সে-ধারণা তাহার বদলাইয়া গেছে।

বাপের অবস্থা ভাল, তাহা সে পূর্বেই শুনিয়াছিল। আসিয়া দেখে, সত্যই তাই, কোনদিক দিয়া অভাব অনটন কোনদিন তাহার নজরে পড়ে না।

বুড়া বাপ বোধ করি তাহার একটুখানি কৃপণ।

রোজ সকালে জেলে আসিয়া খিড়কির পুকুরে জাল ফেলে। রান্নাঘরের পাশে, ঘাটে যাইবার ছোট দরজাটির ফাঁকে মাথা গলাইয়া চুপি চুপি ডাকে, ‘মা-ঠাকরুণ!’

মা-ঠাক্‌রুণ বঁটি হাতে লইয়া গিয়া, মাছ ভাগ করিয়া ঘাট হইতে একেবারে কুটিয়া বাছিয়া ঘরে লইয়া আসে।

ননীমাধব সেদিন কাছেই দাঁড়াইয়াছিল, মায়া তাহার গলা জড়াইয়া কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপি চুপি বলিল, ‘যা তো ননী, কাপড়ের তলায় মাছটা লুকিয়ে একেবারে এইখানে নিয়ে আয়।’

কিন্তু অমন করিয়া চুপি চুপি বলিবার প্রয়োজন ছিল না। ননীমাধব বলিল, ‘বাবা তো বাড়িতে নেই!’

মায়া বলিল, ‘তা হোক। আসতেই বা কতক্ষণ!’

সত্যই আসিলেন

আঁচলের তলা হইতে মাছটি ননীমাধব বাহির করিতে যাইবে, এমন সময় সদর দরজার কাছে খুকখুক করিয়া কাশির শব্দে তাকাইয়া দেখে, তাহার বাবা।

‘ওটা কি রে?’

ননীমাধব না পারিল জবাব দিতে, না পারিল তাঁহার মুখের পানে তাকাইতে। সকরুণ দৃষ্টিতে একবার সে মায়ার মুখের পানে তাকাইল মাত্র।

মায়া উনানের কাছে বসিয়াছিল, তৎক্ষণাৎ সে হাসিয়া মুখ ফিরাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।—‘কেন, এত মার-মূর্তি কেন? আর কিছু নয়—একটা মাছ।’

ঘাড় নাডিয়া শশধর বলিলেন, ‘জানি। কিন্তু মাছগুলি বড় হতে দিলে না দেখছি।’

মায়া বলিল, ‘দুটো নয়, দশটা নয়,—একটা ছেলে। কতদিন পরে বাড়ি এল, তোমার পুকুর-ভৱা মাছ—কি যে বল তুমি…’

‘বলি আমার মাথা আর মুণ্ডু! ছেলে না হয় আজ দশ দিন এসেছে, মাছ ধরা চলছে সেই পুজো থেকে ইস্ত আজ পর্যন্ত, একদিনের জন্যেও তো কামাই নেই। কত আর বলব তোমাকে? বলে বলে হায়রান হয়ে গেলাম।’

বলিতে বলিতে তিনি ঘরে গিয়া ঢুকিলেন।

মাছটা নামাইয়া রাখিতে বলিয়া মায়াও তাঁহার পিছু পিছু গেল। —‘জানি আমি। সকাল থেকে রোদ্দুরে ঘুরলে মাথার কখনও ঠিক থাকে মানুষের? বস, ঠাণ্ডা হও, জল-টল খাও, তারপর যা বলতে হয় বল।’

বলিয়া গলার কাপড়টা আর-এক ফেরতা ঘুরাইয়া লইয়া হাসিয়া হাত দুইটি কপালে ঠেকাইয়া বলিল, ‘অপরাধ হয়েছে মশাই, ক্ষমা করুন!’

শশধরও না হাসিয়া থাকিতে পারিলেন না।

মায়া এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হইয়া জলখাবারের থালাটি স্বামীর সুমুখে ধরিয়া দিয়া বলিল, ‘যাই আবার উনোনে আলু চড়িয়ে এসেছি।’

রান্নাঘরে আসিয়া সে বঁটি লইয়া মাছ কুটিতে বসিল।

‘ননীর বিয়ে দেব, রাঙা টুকটুকে বৌ আসবে, তখন আর কষ্ট করে মাছ-টাছ আমায় কুটতে হবে না। কি বল ননী?’

লজ্জায় ননী তাহার মুখের পানে তাকাইতে পারিল না। সেখান হইতে উঠিয়া সে একরকম ছুটিয়াই চলিয়া যাইতেছিল।

মায়া বলিল, ‘যাস্‌নে ননী, খেয়ে যাবি।’

কথাটা বোধ করি সে শুনিতে পাইল না।

কিন্তু এত আদর এত যত্ন জীবনে সে কখনও পায় নাই।

অন্ধ হঠাৎ সূর্য দেখিয়াছে। অসত্য হইবারই কথা। ননীমাধব ‘না’ও বলিতে পারে না, ‘হাঁ’ও বলিতে পারে না।

সেদিন সকালে শশধর তাঁহার স্ত্রীকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিতেছিলেন। ননীমাধব ঠিক সেই সময়েই ঘরে ঢুকিতেছিল, হঠাৎ শুনিয়া সে দরজার আড়ালে চুপ করিয়া দাঁড়াইল। এখানে থাকিয়া ননীমাধবের পড়াশোনা কিছুই নাকি হইতেছে না।

গত কয়েকদিন হইতে শহরের একটা ইস্কুলে তাহাকে পাঠাইবার কথা হইতেছে। তাই তাহার এ আগ্রহ।

শশধর বোধ করি অনেকক্ষণ হইতেই চিৎকার করিতেছিলেন, বলিলেন, ‘আমি জানি তোমার স্বভাব। তুমি আর কথা বল না।’

কি কথা সে যে বলিয়াছে, ননীমাধব তাহা শোনে নাই। এবার কিন্তু মায়া সত্য সত্যই চুপ করিয়া রহিল।

শশধর বলিলেন, সবেতেই তোমার বাড়াবাড়ি। এ আমি আজ বলে নয়, হাজার দিন লক্ষ্য করেছি। বললে কথা শুনবে না, হেসেই উড়িয়ে দেবে—এই হচ্ছে তোমার মস্ত রোগ।’

মায়া জবাব দিল। হাসিয়া বলিল, ‘কথা আবার তোমার শুনলাম না কবে? হ্যাঁগা?—নাও জামাটা তোমার খুলে ফ্যালো দেখি, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তেল হাতে নিয়ে। আমায় বকতে পেলে আর কিছু তুমি চাও না বাপু,—হ্যাঁ। ভাল লাগে না চব্বিশ ঘণ্টা।’

শশধরও হাসিলেন। বলিলেন, ‘তোমার ভালর জন্যেই বলছি। লোকে বলবে কি! ওকে তো আর তুমি পেটে ধরোনি!’

‘তা বলুক লোকে। লোকের মুয়ে ঝ্যাটা!’ বলিয়া মায়া তাঁহাকে তেল মাখাইতে বসিল।

স্বামী বোধ করি আরাম বোধ করিতেছিলেন। তাই একটুখানি চুপ করিয়া রহিলেন। পরে আবার ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, ‘তা বাপু তুমি যা-ই বল, পুরুষমানুষ দেখলেই কেমন যেন বে-চাল হয়ে পড়। এ যেন তোমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বুঝলে?’

মায়া বলিল, ‘ছি ছি ছি ছি, এ আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব না কী কিছু বুঝতে পারি না বাপু! উলটো কথা বলছ কেন? তোমারই বরং স্বভাব হয়ে গেছে—আমায় কিছু না বলে তুমি থাকতে পার না।’

এই বলিয়া একটুখানি থামিয়া সে আবার বলিল, ‘ননী আমার পেটের ছেলের মত। ও আবার পুরুষমানুষ হল কবে থেকে? ও-কথা তুমি মুখে আনছ কেমন করে গা? লজ্জা করে না? ছি!’

স্বামী এইবার চুপ করিয়া রহিলেন। বুঝা গেল, তিনি নরম হইয়া আসিয়াছেন।

কেশবিরল মাথাটি তাহার কোলের উপর টানিয়া আনিয়া মায়া বেশ ভাল করিয়া তেল মাখাইতে শুরু করিল। বলিল, ‘শীত পড়েছে কি অমনি চান বন্ধ করেছ! এমন শীত-কাতুরে মানুষ! আজ তুমি চান কর। বুঝলে?’

‘চান?’ বলিয়া শশধর তাহার কোলের উপরেই মাথাটা একটুখানি উঁচু করিয়া মায়ার মুখের পানে তাকাইয়া হাসিলেন।

‘হাসি নয়, সত্যি বলছি। নইলে শরীর খারাপ হবে।’

কথার ধারা অন্যপথ ধরিয়াছে। তবু কেন না জানি তাহাদের কাছে যাইতে ননীমাধব লজ্জাবোধ করিতেছিল। পা টিপিয়া টিপিয়া যেমন আসিয়াছিল তেমনি আবার পলায়ন করিতে যাইবে, পশ্চাতে সহসা মায়ার ডাক শুনিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইল।

‘যাস্‌নে ননী, গরম জল ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর আমি গরম করতে পারব না কিন্তু।’

অপরাধীর মত ননী ঘরে আসিয়া ঢুকিল।

শশধরের মাথাটা সরাইয়া দিয়া তেলের বাটি হাতে লইয়া মায়া ননীমাধবের কাছে আগাইয়া আসিল। বলিল, ‘বোস!’

বলিয়া জোর করিয়া তাহাকে সেইখানেই বসাইয়া দিয়া বলিল, জামা খোল! —ওগো তুমি বাইরে রোদে গিয়ে বসো ততক্ষণ, তেলটা শুকোক্ গায়ে।’

বাহিরে রকের উপর চৌকি পাতা ছিল। শশধর ধীরে ধীরে তাঁহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে সেইখানে গিয়া বসিলেন।

এমনি করিয়া দিন চলে।

কিন্তু এমন করিয়া আর কতদিন চলিবে?

সুযোগ-সুবিধা হইলেই শশধর ননীমাধবের পড়াশোনার কথা তোলেন। পাড়ার সব দুষ্টু ছেলেদের নাম ধরিয়া ধরিয়া তাহাদের অপবাদ ঘোষণা করিতে থাকেন।—‘এদের সঙ্গে মিশলেই ছেলের মাথাটি একদম ফর্সা!’

সুতরাং যেখানে-হোক একটা বোর্ডি-স্কুলে তাহাকে না পাঠাইলেই নয়।

কিন্তু আজ পর্যন্ত কেন যে তাহা হইয়া ওঠে না কে জানে!

সঙ্গী-সাথীদের লইয়া চব্বিশ ঘন্টা ঘুরিয়া বেড়ানোর অজুহাতে শশধর তাহাকে তিরস্কার করেন।

ননীমাধব দোয়াত-কলম আর একটা খাতা লইয়া লিখিতে বসে। লিখিতে বসিয়া কি যে লিখিবে খুঁজিয়া পায় না। একখানা বইও নাই যে তাহা দেখিয়া হাতের লেখা অভ্যাস করিবে। নিজের নামটি লিখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। যে মা তাহার মরিয়া গিয়াছে তাহারই কথা মনে পড়ে। মরিলে মানুষ কোথায় যায়? লেখে,—মা, তুমি কোথায় আছ জানি না। তাহার পর আর-কিছু সে লিখিতে পারে না। এই চিঠি লিখিবার প্রসঙ্গে প্রথমেই তাহার চোখের সুমুখে মালতীর মুখখানা ভাসিয়া ওঠে, তাহার পর বাসন্তীর, তাহার পর চঞ্চলার, তাহার পর সখীর। মেয়েদের সঙ্গে জীবনে তাহার এই প্রথম পরিচয়। তাহার পরেই মায়া। মা’ও কি তাহার ঠিক এমনিই ছিল? আর বেশি-কিছু সে ভাবিতে পারে না, ভাবিবার চেষ্টাও করে না। দোয়াত, কলম, খাতা,—সবই সে সেইখানে ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া পড়ে।

গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে শ্যাম-সায়রের পাড়ে শহর হইতে কয়েকজন ‘পাশী’ আসিয়া তালপাতার কুঁড়ে বাঁধিয়াছে। খেজুর গাছ হইতে রস সংগ্রহ করিয়া তাহারা শহরে চালান্ দেয়। গ্রামের প্রায় সমস্ত খেজুর গাছেই তখন একটি করিয়া মাটির ভাঁড় টাঙ্গানো। গ্রামের দক্ষিণ দিকে বামুন-পুকুরের পাড়-চারটা একেবারে ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। এবং সেই ঝোপ-জঙ্গলের মাঝখানে একটি মাত্র খেজুর গাছ। ননীমাধব এবং ও-পাড়ার পটলা সম্প্রতি আবিষ্কার করিয়াছে যে, দুপুরবেলা বামুন-পুকুরের এই খেজুর গাছে চড়িয়া ভাঁড়টা পাড়িয়া চুরি করিয়া আবার যদি সেটা টাঙাইয়া দেওয়া হয় তো পাশীদের বাবারও সাধ্য নাই যে তাহাদের ধরিয়া ফেলে।

ননীমাধব যাইতেছিল পটলার সন্ধানে। পথের মাঝখানে দুজনের মুখোমুখি দেখা। সেও আসিতেছিল তাহারই কাছে।

শশধর প্রায়ই বলেন, ‘আর্লি টু বেড—আর্লি টু রাইজ্।’

মায়া হাসে। সে মধুর হাসি হাসিয়া বলে, ‘আমার মাথা।’

শশধরও রসিকতা করিয়া হাসিয়া বলেন, ‘পালন তো কর না কোনদিন! করলে বুঝতে।’

কথাটার মানে সেদিন তিনি তাহাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন। মায়া বলে, ‘তুমি পালন করছ তো? তাহলেই হল। স্বাস্থ্যের উন্নতি তোমার হোক, তাহলেই আমার হবে।’

সন্ধ্যা তখন সবে সাতটা কি সাড়ে সাতটার বেশি নয়। একে শীতকাল, তার উপর পাড়া-গাঁ। মনে হয় যেন বেশ রাত্রি হইয়াছে।

আগাগোড়া বালাপোষ মুড়ি দিয়া শরতের বৈঠকখানায় দাবার আড্ডা ভাঙ্গিয়া শশধর আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন। ঘরের এককোণে লাঠিগাছটি নামাইয়া রাখিয়া ডাকিলেন, ‘কই গো—!’

বেশিদূর খুঁজিতে হইল না, সামনেই দেখিলেন, ঘরের মেঝের উপর একটা সতরঞ্জ বিছাইয়া মায়া ও ননীমাধব পাশাপাশি হাঁটু গাড়িয়া সুমুখের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া একটা খাতার উপর কি যেন লেখালেখি করিতেছে।

মায়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘আমার চেয়ে ননীর বাংলা হাতের লেখা ঢের—ঢের ভাল।’

শশধর তাহার মুখের পানে একবার তাকাইলেন। তাহার পর গম্ভীরমুখে বলিলেন, ‘হুঁ।’

মায়া বলিল, ‘হবে না? তোমার লেখা কেমন! বাপকা বেটা…না সেই কি বলে না—দূর ছাই, আমার ও-সব হয় না বাপু কিছুতেই।’ বলিয়া সে এক অপরূপ লীলায়িত ভঙ্গিতে এমন হাসি হাসিতে লাগিল যে সেই হাসির গুণেই বোধ করি মুহুর্তের মধ্যে ঠিক যেন যাদুমন্ত্রের মত শশধরের অমন রুক্ষ মুখের ভাব কোনদিক দিয়া যে উড়িয়া গেল তাহাও টের পাওয়া গেল না।

কথাটা এমন কিছু হাসির কথা নয়, তবু শশধর তাহার সেই হাস্যোজ্জ্বল চমৎকার মুখখানির দিকে বিমুগ্ধদৃষ্টিতে বারকয়েক তাকাইয়া নিজেও ঈষৎ হাসিলেন।

হাসিয়া বলিলেন, ‘জানো না? বাপ্‌কা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া, কুছ্ না হোয় তো থোড়া থোড়া।’

বলিয়াই তিনি চুপ করিলেন। চোখ-মুখের ভাব দেখিয়া বুঝা গেল, সহসা তিনি অত্যন্ত উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছেন।

শশধর একবার হাঁচিলেন।

মায়া বলিল, ‘দেখ, বলেছিলাম না, ঠাণ্ডায় বেড়িয়ে না। লাগিয়েছ তোত ঠাণ্ডা! বেশ হয়েছে, নাও, শোও, পায়ে একটুখানি তেল মালিশ করে দিই।’

বিছানা পাতাই ছিল। শান্ত-শিষ্ট ছেলেটির মত শশধর তৎক্ষণাৎ শুইয়া পড়িতেছিলেন, হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, বাজল ক’টা?’

‘ও, তোমার আবার ‘আর্লি টু বেড্’ আছে যে! আচ্ছা তবে খেয়েই নাও আগে।’ বলিয়া মায়া তাঁহাকে খাওয়াইবার জন্য আসন পাতিয়া জল গড়াইতে বসিল।

‘ননীকেও দিলে না কেন?’

‘বেশ, তাহলেই হয়েছে। একটি খাবারে হাত দেবে না। বসবে আর উঠবে।’ বলিয়া সে স্বামীর সুমুখে খাবারের থালা ধরিয়া দিল।

স্বামীর আহারাদি শেষ হইলে মায়া হাসিয়া বলিল, ‘এস, তোমার ‘আর্লি টু বেড্’ করে দিই—এস।’

বলিয়া তেলের বাটি হাতে লইয়া মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতে লাগিল।

গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়া শশধর শয্যা গ্রহণ করিলেন। মায়া তাঁহার পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া একখানি পা তাহার কোলের উপরে সঙ্গে ধীরে ধীরে টানিয়া লইল।

সেবা-শুশ্রূষায় মায়ার হাত বড় চমৎকার!

স্বামীর হাত হইতে গড়গড়ার নলটা অনেকক্ষণ খসিয়া পড়িয়াছিল। তাহার পর ঘড়ঘড় করিয়া নাক ডাকিয়া উঠিতেও দেরি হইল না।

মায়া ধীরে ধীরে আর একটি প্রণাম করিল। কোল হইতে তাঁহার পা-দুইটি নামাইয়া দিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে গায়ের উপর আগাগোড়া লেপ চাপাইয়া দিয়া পা টিপিয়া উঠিয়া গিয়া বলিল, ‘নাও, খুব লেখাপড়া হয়েছে। তোল এবার তোমার এ-সব।’

ননীমাধব তাহার মুখের পানে তাকাইয়া দোয়াত-কলম তুলিয়া রাখিল।

পাশের ঘরে রোজ যেমন হয়, সেদিনও তেমনি ননীমাধবের বিছানা পাতা হইয়াছিল।

আহারাদির পর শোবার ঘরে ঢুকিয়াই ননীমাধব বলিল, ‘আমি আজ পটলাদের ঘরে শোব।’

মায়া একটুখানি বিস্মিত হইয়া গিয়া স্মিতহাস্যে তাহার মুখের উপর একাগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া কহিল, ‘কেন?’

কিন্তু এ ‘কেন’র জবাব সে দিতে পারিল না। ননীমাধব মাথা নত করিয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল।

মায়া আর তাহার জবাবেরও অপেক্ষা করিল না। বাঁহাত দিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া একরকম জোর করিয়াই বিছানার উপর শোয়াইয়া দিল এবং তাহাকে আর দ্বিতীয় কথাটি বলিবার অবসর না দিয়াই হাত বাড়াইয়া ফস্ করিয়া আলোটা নিভাইয়া দিয়া মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপি চুপি বলিল, ‘পাগল!’

শয্যাপ্রান্তে নিরতিশয় ভীত সঙ্কুচিত ননীমাধব নিসাড় নিম্পলভাবে চক্ষু মুদিত করিয়া পড়িয়া রহিল, আর তাহারই একান্ত সন্নিকটে ঘন সতেজ পুষ্পিত-যৌবনা লতার মত অনিন্দ্যসুন্দরী মায়া তাহাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবেষ্টন করিয়া তাহার দুই পরিপুষ্ট গণ্ডদেশে, কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশাবৃত ললাটে, মুদিতপক্ষ দুই চক্ষে, সুচারু দুই ওষ্ঠপুটে ক্রমাগত চুম্বন করিয়া তাহাকে একেবারে উদ্‌ভ্রান্ত বিহ্বল করিয়া দিতে লাগিল।

জানালাটা বন্ধ করা হয় নাই। মৃদু জ্যোৎস্নালোকের একটি সুদীর্ঘ রেখা বাতায়ন পথ অতিক্রম করিয়া গৃহের অপর প্রান্তে আসিয়া পড়িয়াছে। বাহিরে হিমাচ্ছন্ন জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি। নিস্তব্ধ নিযুপ্ত গ্রাম। নিদ্রিত গৃহস্বামীর নাসিকাধ্বনি ছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ পর্যন্ত শোনা যায় না।

পরদিন হইতে ননীমাধবের মাথার ভিতরটা কেমন যেন সকল সময়েই ঝিমঝিম করিতে থাকে। মুখ তুলিয়া কথা কহিতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টা বাহিরে বাহিরেই কাটায়।

কিন্তু মায়া তাহাকে অমন করিয়া কিছুতেই থাকিতে দিবে না। আদর যেন তাহার আরও শতগুণ বাড়িয়া চলে। একটুখানি ফাঁক পাইলে হাসিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। সোহাগ করিয়া মাথাটি তাহার বুকের উপর চাপিয়া ধরে। বলে:‘তোকে আমার কেন ভাল লাগে বল তো?’

ননীমাধব জবাবও দিতে পারে না, তাহার মুখের পানে তাকাইতেও পারে না।

স্নেহ-ভালবাসা জীবনে যাহারা পায় না, বেশি পাইলে তাহারা আবার তাহা সহ্যও করিতে পারে না। তাই বোধ হয় হঠাৎ একদিন দেখা গেল, কাহাকেও কিছু না বলিয়া ননীমাধব পলায়ন করিয়াছে।

কে যে এই হতভাগার জীবন লইয়া এমন খেলা খেলিল জানি না। এতদিন তাহার কোনও খবর পাওয়া যায় নাই। হঠাৎ দেখা গেল, রেলওয়ে কোম্পানীর ছোট্ট একটি ব্র্যাঞ্চ লাইনে চলন্ত একটি ট্রেনের কামরায় ননীমাধব বসিয়া আছে। চোদ্দ বছরের ননীমাধবের বয়স তখন প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। তাপস বালকের মত দেহে তাহার সে সুকুমার সৌন্দর্য আর নাই, চোখে-মুখে কেমন যেন একটা রুক্ষ ভাব, মাথায় উস্কোখুস্কো অগোছালো চুল, পরনে খাঁকি রং-এর আধা-পায়জামা, গায়ে কামিজের উপর কোট, পায়ে জুতা-মোজা দুই-ই।

এতদিন কেমন করিয়া যে তাহার জীবন কাটিয়াছে কে জানে। দেখিলে মনে হয়, ঝড়-ঝঞা অনেক তাহার মাথার উপর দিয়া পার হইয়াছে। কিন্তু সে পল্লী-কিশোরের অটুট স্বাস্থ্যের এতটুকু হানি করিতে পারে নাই।

কামরায় আরও দুজন যাত্রী—দুজনেই স্ত্রীলোক। তের-চোদ্দ বছরের একটি মেয়ে সুমুখের বেঞ্চে তাহারই দিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া আছে, পাশের বেঞ্চে, বোধ করি ওই মেয়েটারই মা—আগাগোড়া মুড়ি দিয়া সম্ভবত ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।

ব্রাঞ্চ লাইনের ট্রেন। কামরার মাথার উপরে অনুজ্জ্বল একটি গ্যাসের আলো মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছিল। তাহারই সেই স্তিমিত আলোকশিখায় দেখা গেল, ছোট সেই ঘুমন্ত মেয়েটির গলায় হার, হাতে চুড়ি, কানে দুল।

দুল দুটি বোধ করি হীরার। নইলে ওই সামান্য আলোকে অমন আগুনের মত জ্বলিবে কেন?

ননীমাধব তাহার মুখের পানে না তাকাইয়া ঘন-ঘন সেই জ্বলন্ত দুটি দুলের পানে তাকাইতেছিল।

হঠাৎ কি মনে হইল কে জানে, ননীমাধব ধীরে ধীরে বেঞ্চের এক কোণের দিকে সরিয়া গিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে হাত বাড়াইল।

হাত বাড়াইল বোধ করি খুলিয়া লইবার জন্যই। হাত তাহার এতটুকু কাঁপিল না। গত দশ-পনর বৎসর ধরিয়া এই কর্মেই সে শুধু অভ্যস্ত হইয়াছে কিনা তাই বা কে জানে!

কিন্তু আধ-আলো আধ-অন্ধকারে হয়তো ঠাহর হয় নাই, ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পাইবামাত্র মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ চাহিল। ননীমাধব তাহার হাত তখন সরাইয়া লইয়াছে।

মেয়েটি চিৎকার করিল না, মুখে একটি কথাও বলিল না, ননীমাধবের মুখের পানে একবার মাত্র তাকাইয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। তাহার পর গায়ের কাপড়টি ভাল করিয়া জড়াইয়া লইয়া আস্তে আস্তে পাশের বেঞ্চে উঠিয়া গিয়া মায়ের গায়ে হাত দিয়া ডাকিল, ‘মা!’

ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘ও তোমার মা বুঝি?’

মেয়েটি নিঃসঙ্কোচে ননীমাধবের দিকে মুখ ফিরাইয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হুঁ।’

মা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়াই চিৎকার শুরু করিলেন, ‘নাম্, নাম্, নাম্ মা গৌরী, নেবে পড় চট্ করে।—ওমা, গাড়ি যে চলছে দেখি,—ছেড়ে এল নাকি আমাদের ইস্টিশান?’

মায়ের ছট্‌ফটানি দেখিয়া গৌরী না হাসিয়া থাকিতে পারিল না। ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘না মা, তুমি উঠে বস। আমার ভয় করছে।’

‘সোনার্‌ডি আসেনি, তুই দেখেছিস তত ঠিক?’ বলিয়া মা একটুখানি আশ্বস্ত হইয়া চাপিয়া বসিলেন। ঘুমের ঘোরে ননীমাধবকে এতক্ষণ তিনি দেখিতে পান নাই, এইবার হঠাৎ তাহার দিকে নজর পড়িতেই বলিয়া উঠিলেন, ‘ওমা, এ যে একটা সায়েব-লা। আ মর, এত গাড়ি থাকতে আর জায়গা পাওনি মুখপোড়া?’

ননীমাধব হাসিয়া বলিল, ‘না, আমি সায়েব নই, আপনারা কোথায় যাবেন মা?’

মা একটুখানি অপদস্থ হইয়া পড়িলেন।—‘ওমা, তুমি আমাদেরই যে! আমরা যাব বাছা বহুৎ দূর। মুখপোড়া বললাম, কিছু মনে কোর না বাছা!’

‘না না, ছেলেকে মুখপোড়া বলেছেন, তাতে আর হয়েছে কি!’

ননীমাধব কথা শিখিয়াছে ভাল। মার প্রাণ একেবারে গলিয়া জল হইয়া গেল। আহা, দিব্যি ছেলেটি তো!

মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোথায় যাবে বাছা তুমি?’

ননীমাধব বলিল, ‘আমি যাব না মা কোথাও। এমনি ঘুরে বেড়ানোই আমার কাজ।’

মা বলিলেন, ‘আমরা বাছা কি কুক্ষণেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম,—আসবার সময় টেরেন্ ফেল হল! গিয়েছিলাম আজিম্‌গঞ্জ গঙ্গাচান্ করতে…বাড়ি থেকে গরুর গাড়ি—আসবার কথা। ও-বেলায় এসে একবার ফিরে গেছে, এবেলায় যদি না আসে তো কি যে হবে বাবা, তাই ভাবছি।’

ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘স্টেশন থেকে বাড়ি আপনাদের কতদূর মা?’

‘অনেকদূর বাছা,—দু’ ক্রোশ। আর এই অন্ধকার রাত, আর এই মেঘ করে আছে, আর যদি কখনও বাড়ি থেকে বেরোই তো এই—। গৌরী তুইও কান মল্!’ বলিয়া তিনি সত্য সত্যই কানে হাত দিলেন।

গৌরী হাসিল।

ননীমাধবও না হাসিয়া থাকিতে পারিল না।

‘হাসি নয় বাছা, বুক আমার দুরদুর করছে। এই রাত্তির কাল, সঙ্গে সোমত্ত মেয়ে, আর মেয়ের গায়ে এক-গা গয়না।’ বলিয়া মেয়ের মুখের পানে তাকাইয়া বলিলেন, ‘গয়না-টয়না খুলে ফেল বাছা, কাপড়ের একটা পুঁটলিতে না হয় বেঁধে দিই।’

গৌরী একবার মায়ের দিকে, একবার ননীমাধবের দিকে তাকাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। গা হইতে গহনা খুলিল না।

চলন্ত গাড়ির শব্দে কথা বলিবার বোধ করি সুবিধা হইতেছিল না, মা তাই ও বেঞ্চ হইতে এ-বেঞ্চে উঠিয়া আসিলেন।—‘আমার অভাব কিছু নেই বাছা, ঘর-বাড়ি, জমি-জায়গা গাই-গরু আমার যেমন আছে গাঁয়ে তেমনটি আর কারও নেই। নেই শুধু সেই কথায় বলে,—‘আছে সবই বিন্দাবনে—আঁধার সবই কেষ্ট বিনে।’

বলিয়াই তিনি চোখ বুজিয়া, ঢোঁক গিলিয়া, হাত উল্‌টাইয়া গম্ভীর ভাবে বসিয়া রহিলেন।

ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি একা এলেন কেন? সঙ্গে একটা বেটাছেলে—’

কথাটা তাহাকে তিনি শেষ করিতে দিলেন না। মাঝখানেই কথা বলিলেন। কিন্তু কণ্ঠস্বর তখন তাহার ভারী হইয়া উঠিয়াছে। বলিলেন, ‘সেই কথাই বলছি বাছা, আমার মত অভাগীর কি আর বেঁচে থাকা সাজে, না মুখ দেখাতে হয়। এই ঠিক তোমার মতন একটি, তোমার চেয়ে ডাগর একটি, আর একটি তোমার চেয়ে ছোট,—এই তিন-তিনটিকে দিয়ে এসেছি বাছা শ্মশান-ঘাটে তুলে। ছেলে তো নয়—যেন রাজপুর।’ বলিতে বলিতে ঠোঁট দুইটি তাঁহার থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। চোখ দিয়া টসটস করিয়া জল গড়াইতে লাগিল।

মিনিটখানেক পরে একটুখানি সামলাইয়া লইয়া তিনি গৌরীর দিকে আঙুল বাড়াইয়া বলিলেন, ‘এখন বাছা, ওই আমার পুঁজি।—থাক্ মা থাক্, তুই ওইখানে রসে থাক্। কোনও ভয় নেই। ছেলেটি বড় ভাল ছেলে। হ্যাঁ বাবা, তোমার নামটা কি?’

‘আমার নাম ননীমাধব।’

মা বলিলেন, ‘ননীমাধব? আমার একটির নাম ছিল সুবোধ, একটির নাম ছিল রাখাল, আর একটির নাম ছিল গোপাল।’

বলিয়া ছেলে তিনটিকে মনে পড়িতেই বোধ করি তিনি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তাহার পর বলিলেন, ‘এই যে তুমি মা মা বলে ডাক বাছা, আমার বুকের ভেতরটা কেমন হা হা করে উঠছে। মনে হচ্ছে, রাখাল আমার বেঁচে আছে। তুমি বাবা আমার ঠিক রাখালের মত দেখতে।’

দেখিতে দেখিতে গাড়ি আসিয়া সোনার্‌ডি স্টেশনে পৌঁছিল। গাড়ি থামিতে না থামিতেই মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোন্ ইস্টিশান বাবা?

ননীমাধব জানালার পথে মুখ বাড়াইল, কিন্তু স্টেশনে না আছে লোক, না আছে আলো,—অন্ধকারে ভাল করিয়া কিছু ঠিক-ঠাহর করা যায় না।

গৌরী যেদিকে বসিয়াছিল, প্ল্যাটফর্ম সেইদিকে। গৌরী বলিয়া উঠিল, ‘সোনার্‌ডি। মা তুমি নামো আগে।’

এক হাতে কাপড়ের বোঁচকা, আর এক হাতে একটা ঘটি লইয়া মা তখন উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন। বলিলেন, ‘জানিস তো ঠিক? মিন্‌সেরা দুটো আলো জ্বেলে রাখে না গা!’

গৌরী তাড়াতাড়ি করিতেছিল, ‘আমি দেখেছি মা, আলোর গায়ে লেখা রয়েছে, তুমি নামো চট্ করে।’

ননীমাধব উঠিয়া আসিয়া দরজা খুলিয়া দিয়া মার হাত হইতে ঘটি ও বোঁচকা কাড়িয়া লইয়া বলিল, ‘নাবুন ধীরে ধীরে। তুমিও নাবো গৌরী।’

মা ও গৌরীকে নামাইয়া দিয়া, ঘটি, বোঁচকা নামাইয়া, ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর-কিছু আছে আপনাদের?’

‘না বাবা, কিচ্ছু নেই। গৌরী, তোর সেই খাগড়াই গেলাসটি?’ বলিয়াই আর জবাবের অপেক্ষা না করিয়া মা বলিলেন, কিন্তু তুমি বাবা—হ্যাঁ বাবা, কতদূর যাবে বাবা ননী, তোমার মা আছে তো?’

সে-কথার কোনও জবাব না-দিয়াই ননীমাধব তাহার কাগজে-মোড়া পোঁটলাটি হাতে লইয়া গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল। সেইখানেই হেঁট হইয়া একটি প্রণাম করিয়া মায়ের পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া ননীমাধব বলিল, ‘না মা, মা আমার নেই।’

‘আ আমার কপাল! আহা বাছারে, মা নাই তোমার?’

বলা তখনও শেষ হয় নাই, এমন সময় সিটি দিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, ‘গাড়ি যে ছেড়ে দিল ননী—?’

‘তুমি ওঠো।’ কথাটা মা’র মুখের মধ্যে যেন আটকাইয়া রহিল।

নিতান্ত উদাসীনের মত ননীমাধব সেই চলন্ত ট্রেনের দিকে একবার তাকাইল মাত্র। বলিল, ‘চলুন—আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।’

আনন্দের আতিশয্যে মা’র মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না। গরুর গাড়ির কথা, অন্ধকার এতখানি পথের কথা, এতক্ষণ ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। বলিলেন, ‘তোমায় কি বলে যে আশীর্বাদ করব বাবা!’

বলিয়াই তিনি প্রাণপণে চিৎকার করিতে লাগিলেন, ‘বংশী! বংশী! আমাদের বংশী এসেছিস? রাজিবপুরের বংশী এখানে কেউ আছিস বাবা?’

অদূরে কয়েকজন গাড়োয়ান গাড়ি খুলিয়া দিয়া শুকনো খড় জ্বালাইয়া আগুন পোহাইতেছিল। তাহাদেরই কে একজন বলিয়া উঠিল, ‘উঁহু, বংশী তো নাই মা, গোপালগঞ্জের বলরাম আছে।’

গাড়ি তাঁহার আসে নাই।

ননীমাধব বিস্তর হাঁক-ডাক করিয়া গাড়ির সন্ধান করিতে লাগিল।

শেষে অনেক কষ্টে অনেক খোঁজাখুঁজির পর সংবাদ পাওয়া গেল যে, স্টেশনের একজন খালাসীর নাকি একজোড়া গাড়ি আছে, অসময়ে বেশি ভাড়া পাইলে সে নাকি ট্রেনের যাত্রীদের বাড়ি পৌঁছাইয়া দেয়।

ননীমাধবের সাহেবী পোশাক দেখিয়া স্টেশন-মাস্টার স্বয়ং সুপারিশ করিলেন। লোকটা তৎক্ষণাৎ তাহার গাড়ি জুড়িয়া আনিয়া বলিল, ‘চলুন হুজুর!’

ননীমাধবকে আশীবাদ মা’র যেন আর ফুরাইতে চায় না।

খানিকক্ষণ পরে বলিলেন, ‘তোমার ওই সায়েবের মতন ওইগুলো তুমি খোল বাছা, আমার বড় ভয় করে।’

ননীমাধব হাসিতে লাগিল।—খুলব মা খুলব। বাড়ি গিয়েই খুলে ফেলব এসব।’

তাহার পর সারা রাস্তা ধরিয়া মা তাহাকে কত কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।

সত্য-মিথ্যায় জড়াইয়া কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে সে কসুর করিল না। জায়গা-জমি বাড়ি-ঘর সবই আছে, কিন্তু মা নাই, বাবাও মরিয়াছেন, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে—আছে মাত্র এক মামীমা। মামার বিষয়-সম্পত্তি, প্রকাণ্ড জমিদারী, লাখো লাখো টাকা। মামীমা তাহাকে বিবাহ করিয়া ঘর-সংসারী হইতে বলেন, কিন্তু বিবাহ সে এখন করিতে চায় না, তাই এমন করিয়া পালাইয়া পালাইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়।

মা তাহার কথাও শুনিতেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ইহাও ভাবিতেছিলেন যে, ছেলেটিকে এত রাত্রে বাড়ি লইয়া গিয়া তিনি কি খাইতে দিবেন।

কথা শেষ হইলে গৌরীর মুখের পানে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কলা কি রাতের বেলা পাড়তে নেই মা?’

গৌরী বোধ করি অন্যমনস্ক ছিল, কথাটা সে ভাল বুঝিতে পারিল না। বলিল, ‘কি মা? কি বললে?’

‘রাত্তিরকালে গাছ থেকে কলার কাঁদি কাটলে কিছু হয় নাকি গৌরী?’

গৌরী বলিল, হ্যাঁ মা, সেই যে কুষ্টোব্যাধি না কি হয়, তুমিই তো একদিন বলেছিলে?’

‘তবে কাজ নেই মা।’ বলিয়া মা চুপ করিলেন।

মাকে সবাই গৌরীর মা বলিয়া ডাকে। আগে বোধ করি সুবোধের মা বলিত।

সবাই বলে, ‘মাগী বকে একটুখানি বেশি, নইলে অমন সাদাসিধে ভাল মানুষ সত্যি দেখা যায় না।’

আজকাল মুখে তাঁহার ননীমাধবের কথা ছাড়া আর কথাই নাই। বলেন, ‘অমন ছেলে আর দুটি হয় না। আমি আমার রাখালকে ফিরে পেয়েছি।’

বলেন, ‘আহা, মা নেই ছেলেটির। মামী বড়লোক। দুয়ারে হাতি বাঁধা।’

ননীমাধব যাই-যাই করে! মায়ের চোখে তখন জল ভরিয়া আসে। বলেন, ‘আর দুটি দিন বাছা।’

দুটি দিন দুটি দিন করিয়া ননীমাধবের আর যাওয়াই হয় না।

মাসখানেক পরে হঠাৎ শোনা গেল, ননীমাধবের সঙ্গে গৌরীর নাকি বিয়ে।

গ্রামের লোক তো অবাক!

যেমন ছেলে তেমনি মেয়ে। সবাই বলে, ‘ভগবানের দেওয়া—এমনি করেই জোটে। নইলে কোথায় তীথি করতে গিয়ে পথে দেখা!’

পাড়ার একজন হিতৈষিনী মেয়ে আসিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘ছেলেটির খোঁজ-খবর সব নিয়েছিস তো গৌরীর মা? বরের আপনজন কেউ এল না যে এখনও?’

গৌরীর মা চোখ-মুখের ইশারায় তাহাদের একটুখানি দূরে লইয়া গিয়া হাত নাড়িয়া বলেন, ‘চুপ চুপ! লুকিয়ে বিয়ে হচ্ছে মা, লুকিয়ে। জানাজানি হলে কি আর রক্ষে আছে। আমার মতন অমন সাতটা গৌরীর মা ওদের দাসীবাদীর যুগ্যি।’

সেই এক কথা—

বলেন, ‘মামীর দুয়োরে হাতি বাধা।’

অজানা ছেলেটির ঠিক-ঠিকানা না জানিয়া বিবাহ দেওয়া,—কেহ কেহ বলিতে লাগিল, ‘নিজের ছাগল কেউ যদি মাথার দিকটা না কেটে লেজের দিকে কাটে তো তোমারই বা কি, আমারইবা কি! নিজের মেয়ে,—যা-খুশি তাই করুক্ না বাপু!’

কিন্তু মুরুব্বি মাতব্বরেরা ছাড়িলেন না। তাঁহাদেরও দু’একজন গৌরীর মাকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া গিয়া প্রশ্ন করিলেন।

গৌরীর মা তাঁহাদেরও ঠিক সেই এক কথা বলিয়াই চুপ করাইয়া দিলেন।—‘আমার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকল, আর—আমি বুড়ী মাগী কিনা না জেনে-শুনেই—কি যে বল তোমরা!’

যাই হোক, কাহাকেও কিছু বলিতে হইল না।

খুব খানিকটা ধূমধামের সঙ্গে পরের তেসরা তারিখে শুভকার্য নির্বিঘ্নেই সুসম্পন্ন হইয়া গেল।

গৌরী তাহার প্রতিবেশিনী সঙ্গিনীদের সঙ্গে হাসিয়া খেলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, আর বাড়ি ঢুকিয়াই কেমন যেন লজ্জিত সঙ্কুচিত হইয়া ওঠে।

মা বলেন, ‘আ আমার কপাল! বসে বসে দু’দণ্ড কথা ক’না তোরা। দরজার ফুটো দিয়ে দেখি, দেখে হিয়ে জুড়োক্।’

গৌরী মুচকি মুচকি হাসে। হাসিয়া যেন সে লজ্জায় আরও বেশি জড়সড় হইয়া যায়।

রাত্রে সঙ্গিনীরা তাহাকে জোর করিয়া ঠেলিতে ঠেলিতে ননীমাধবের ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া আসে।

গৌরী সেই যে বিছানার এক পাশে মুড়িসুড়ি দিয়া শুইয়া পড়ে একটিবারের জন্যও আর মুখ তুলিতে পারে না।

ননীমাধব বলে, ‘কি গো লজ্জাবতী, লজ্জার যে সীমে নেই দেখছি।’

গৌরী মুখও তোলে না, কথাও বলে না।

অথচ বিবাহের পূর্বে কথা সে তাহার সঙ্গে কতবার বলিয়াছে।

ননীমাধব একবার উঠিয়া গিয়া বাহিরে দেখিয়া আসে, কেহ আড়ি পাতিয়াছে কিনা, তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া বলে, ‘না কেউ নেই।’ ডাকে, ‘গৌরী!’

লেপের তলা হইতে গৌরী সাড়া দেয়।—‘উঁ!’

‘তাই তো বলি।’ বলিয়া ননীমাধব হাসে।

গৌরী ধীরে ধীরে লেপের তলা হইতে মুখ বাহির করিয়া বলে, ‘আজ এমন মজা হল! মা বলে, তোরা দুজনে কথা ক’—আমি দেখি।’ বলিয়া ফিকফিক করিয়া হাসিতে হাসিতে আবার লেপের নিচে মুখ লুকায়।

দুষ্টুমি করিয়া ননীমাধব লেপটা তুলিয়া ধরে।

গৌরী হাসিয়া বলে, ‘বা—রে! আমার শীত করে না?’

ননীমাধব তাহার মুখের পানে একদৃষ্টে তাকাইয়া থাকে। বলে, ‘করুক। কিন্তু তোমার ও দুল-জোড়াটি খুলো না যেন। চমৎকার মানায়।’

এই দুলের প্রসঙ্গে গৌরী আর কথা বলে না, চুপ করিয়া কি যেন ভাবে।

‘চুপ করে রইলে যে?’

‘কি বলব?’

জবাবটা ননীমাধবের ভাল লাগে না। বলে, ‘তোমার কি মনে হয়? ট্রেনে সেদিন তোমার ও-দুটো আমি চুরি করতে চেয়েছিলাম?’

গৌরী এবার কথা কহিল। বলিল, ‘তা না তো কী?’

‘তোমার তাই বিশ্বাস?’

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া হুঁ-বলিয়া সরিয়া সরিয়া লেপের তলায় গিয়া ঢোকে।

কথাটা চাপা দিবার জন্য ননীমাধব অন্য কথা পাড়িতে চেষ্টা করে, কিন্তু সব তাহার বিফল হইয়া যায়। গৌরী চুপ করিয়া থাকে, ননীমাধবের আর ঘাঁটাঘাঁটি করিতে ইচ্ছা হয় না।

ইচ্ছা না হইলেও গৌরীর এই বিশ্বাসের কথাটা তাহার মনের মধ্যে কেমন যেন নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়া বসে। অনেকক্ষণ ধরিয়া ওই কথাটাই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। রাত্রে ভাল ঘুম হয় না।

এমনি করিয়া নব-পরিণীত বরবধুর প্রেমালাপের সূত্র কোথায় যেন ছিন্ন হইয়া যায়।

সেদিন রাত্রে কথাবার্তার মাঝখানে ননীমাধব হঠাৎ বলিয়া বসিল, ‘আমার কি ইচ্ছে করে জানো গৌরী, আমি কোথাও কোন দূরদেশে চলে যাই। তুমি চিঠিপত্র লিখবে, আমি তার জবাব দেব। আবার তুমি লিখবে, আবার আমি লিখব। এমনি করে আমাদের চিঠি লেখালেখি চলবে, তারপর হঠাৎ একদিন আমি এসে হাজির হব। কেমন?’

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ’।’

ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমি কাছে থাকব না, তোমার মন কেমন করবে না?’

এবারেও গৌরী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, করবে।’

বলিয়াই একটুখানি থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথায় যাবে?’

‘যাব না কোথাও। এমনি বলছিলাম। যদি যাই—’

গৌরী তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল, ‘না, তুমি যেয়ো না।’

কথাটা অন্যদিকে চলিয়া যায় দেখিয়া ননীমাধব কহিল, ‘যাচ্ছি আর কোথায়? যাব না। কিন্তু ধর, যদি যাই, তুমি তো ভাল লিখতে পড়তে জানো না, চিঠি তুমি কাকে দিয়ে লেখাবে?’

গৌরী তাহার চক্ষু স্থির করিয়া একটুখানি ভাবিয়া বলিল, ‘কেন, মিনিকে দিয়ে।’

‘মিনি কে?’

‘আ, জানে না। সেই যে তোমায় ‘কাত্তিক’ বলে’ ডাকে,— সেই যে কানে বটফল আছে, নাকে চিড়িতন।’

ননীমাধব বলিল, ‘ও। সে তো লিখতে ভাল জানে না—আমি দেখেছি।’

গৌরী সত্যই চিন্তিত হইয়া পড়িল। বলিল, ‘তবে—তবে, ওই জিতুকে দিয়ে।’

‘জিতু কে?’

মিনির ভাই গো। ওইটুকু ছেলে, থার্ড ক্লাসে পড়ে।’

‘হুঁ।’ বলিয়া ননীমাধব সহসা গম্ভীর হইয়া পড়িল।

এবং তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া গৌরীর কি যে মনে হইল কে জানে, বলিল, ‘তোমার যেয়ে কাজ নাই।’

ননীমাধব নিষেধ করে। বলে, তুমি ছেলেমানুষ নও। যেয়ো না ওদের সঙ্গে। পাড়ার মেয়েগুলো ভাল নয়।’

গৌরী ভাবে, কথাটার প্রতিবাদ করে। কিন্তু প্রতিবাদ সে করিতে পারে না। মুখ বুজিয়া চুপ করিয়া থাকে। ননীমাধব বলে, ‘চুপ করে রইলে যে?’

ঘাড় নাড়িয়া গৌরী বড় দুঃখেই জানায়, ‘বেশ, যাব না তাহলে।’

সঙ্গিনীরা দুপুরে ডাকিতে আসে। গৌরী বলে, ‘না ভাই, এইখানেই খেলা করি আয়।’

মিনি বলে, ‘কেন লা? বাড়ি ছেড়ে আর বুঝি তোর নড়তে ইচ্ছে করে না?’

গৌরী লজ্জিত হইয়া হাসিয়া বলে, ‘ধেৎ! তা কেন?’

‘তবে আর কি, চল্! বলিয়া মিনি তাহাকে একরকম জোর করিয়াই ধরিয়া লইয়া যায়।

পথ চলিতে চলিতে মিনিকে সে একটুখানি দূরে লইয়া গিয়া কাঁধে হাত দিয়া চুপি চুপি বলে, ‘ও ভাই বারণ করেছে।’

মিনি বলে, ‘ও মা গো! কেন, আমরা কি তোকে খেয়ে ফেলব নাকি?’

গৌরীও বলে, কে জানে ভাই, কি রকম যে মানুষ।’

কথাটাকে মিনি তেমন গ্রাহ্যই করে না। বলে, ‘হ্যাঁ, ও যেন দেখতে আসছে। চল্!’

ননীমাধব আবার আর-একদিন বারণ করে। —‘বললাম তবু শুনলে না তো?’

কথাটা গৌরীর মনেই ছিল না। বলিল, ‘কি?’

‘ভুলে গেছ? তা যাবে বৈকি!’

গৌরী মনে করিবার চেষ্টা করিতে থাকে। বলে, ‘ও, সেই কথা তো? আচ্ছা আর যাব না, দেখ।’

দুদিন সত্যই সে যায় না।

তিন দিনের দিন সে এক ভারি মজার ব্যাপার।

কোথা হইতে একদল বিদেশী ভ্রমণকারী আসিয়া সমস্ত গ্রামখানাকে একেবারে ছাইয়া ফেলিয়াছে। পুরুষেরা সর্বাঙ্গে ছাই মাখিয়া মাথায় জটা পরিয়া হাতে কমণ্ডলু লইয়া সাধু সাজিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়, আর রং-বেরং-এর ঘাঘ্‌রা-পরা মেয়েগুলা তাহাদের সারা দুপুরবেলাটা গ্রামখানিকে গুলজার করিয়া রাখে। কেহ-বা বুড়ো-বুড়ীদের বাতের ঔষধ দেয়, ধনেশ পাখির তেল বিক্রি করে, কেহ-বা স্বামী বশ করিবার সিঁদুর দিতে চায়, কেহ-বা শত্রু দমন করিবার মন্ত্র জানে, কেহ-বা পুত্রহীনা নারীর বন্ধ্যাত্ব ঘুচাইতে পারে, কেহ-বা বিড় বিড় করিয়া মন্ত্র পড়িয়া চোখের সুমুখে অদ্ভুত সব খেলা তামাসা দেখাইয়া বেড়ায়।

মিনি বলিল, ‘চল্ ভাই দেখে আসি।’

গৌরীর ইচ্ছা ছিল ষোল আনা, বু সে ভয়ে ভয়ে বলিল, ‘না ভাই—’

‘আ-মর্। ছুঁড়ি ভয়েই মলো।’

গৌরী কি যে বলিবে কি যে করিবে, কিছুই বুঝিতে পারিল না; মিনির মুখের পানে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া রহিল।

মিনি বলিল, ‘চল্ ভাই চল্, দেখতে তো পাবে না, জিজ্ঞেস করে তো বলবি যাইনে। বাস্, ফুরিয়ে গেল।’

পরামর্শ মন্দ নয়। গৌরী বলিল, ‘চল্ তবে।’

এ-বাড়ি সে বাড়ি ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহারা শেষে অনেক কষ্টে সুরেশীদের বাড়ি গিয়া দেখে, গোলাপী রঙের ঘাঘ্‌রা-পরা একটি মেয়ে সেখানে তাহার তল্পিতল্পা খুলিয়া ভেল্‌কি-বাজি দেখাইতে শুরু করিয়াছে।

হাতে কিছুই নাই, দেখিতে দেখিতে মন্ত্র পড়িয়া ফুঁ দিতেই টাকা বাহির হয়, টাকা হঠাৎ মার্বেলের গুলির আকার ধারণ করে, মার্বেলের গুলি অদৃশ্য হইয়া গিয়া একটা পুতুল হয়, আবার পুতুল উড়িয়া গিয়া ক্রমাগত ডিম বাহির হইতে থাকে। কোথা হইতে আসে এবং কোন্‌দিক দিয়া যে উড়িয়া যায়, কিছুই টের পাইবার উপায় নাই।

তাহার পর এমনি করিয়া একটির পর একটি কত রকমের কত অদ্ভুত খেলা দেখানো চলে।

অবাক হইয়া সকলে সেই বিদেশী মেয়েটার মুখের পানে হাঁ করিয়া তাকাইয়া থাকে। দু’একটা মেয়ে তাহার কৌশল ধরিয়া ফেলিয়া তাহাকে জব্দ করিবার চেষ্টা করে, কিন্তু না পারিয়া শেষে নিজেরাই অপদস্থ হইয়া সরিয়া দাঁড়ায়।

মিনি বলিল, ‘কেমন? আসতে চাইছিলি না যে!’

গৌরী বলিল, ‘হ্যাঁ ভাই।’

ঘুরিয়া ফিরিয়া ইহার-উহার বাড়ি গল্প করিয়া বাড়ি যখন তাহারা ফিরিল তখন প্রায় সন্ধ্যা।

রাত্রে ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘গিয়েছিলে আজ?’

কি জবাব দিবে বুঝিতে না পারিয়া সে এমনি ভাব দেখাইল, কথাটা যেন সে শুনিতেই পায় নাই। বলিল, ‘কি? কোথায়?’

গম্ভীরভাবে ননীমাধব বলিল, ‘বেড়াতে?’

অম্লান বদনে গৌরী ঘাড় নাড়িয়া বলিয়া ফেলিল, ‘না।’

ননীমাধব আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না।

ফাগুন মাসে মিনির বিয়ে।

‘হ্যাঁগা, মিনি আমার অতদিনের বন্ধু, ওর বিয়ে দেখতে যাব তো? তা যদি না যেতে দাও তাহলে ভারি অন্যায় হবে কিন্তু।’

ননীমাধব বলিল, ‘আমি কি তোমায় বেঁধে রেখেছি?’

গৌরী বলিল, ‘দেখ, তাই আমি বলছি বুঝি?’

ননীমাধব চুপ করিয়া রহিল।

গৌরী তাহার ভয়ে কিছুক্ষণ কথা বলিতে পারিল না। তাহার পর সাহস করিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘যাব তো?’

‘যেয়ো, কিন্তু বেশিক্ষণ থেকো না যেন।’

‘না, তা থাকব না।’

‘বাসর জেগো না। দূরে থেকে বর দেখবে, দেখেই চলে আসবে।’

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘বেশ।’

অনুমতি পাইয়া গৌরী বর দেখিতে গেল। কথা রহিল, মা নিজে গিয়া তাহাকে লইয়া আসিবেন।

মিনি তাহার ছেলেবেলার সঙ্গী। পাড়ার যত মেয়ে সেখানে আসিয়া জুটিয়াছে। কত আমোদ, কত আহ্লাদ! সে সব ছাড়িয়া সহজে বাড়ি ফিরিতে তাহার ইচ্ছা করিতেছিল না, অথচ মা হয়তো এখনই ডাকিতে আসিবেন। না ফিরিলেও নয়। এত আনন্দের মাঝখানেও তাহার বুকের ভিতরটা কেমন যেন খচখচ করিতে লাগিল।

মনে হইল, বিবাহ যেন তাহার না হইলেই ভাল হইত।

বর-কন্যার হাতে-হাত বাঁধিয়া দিয়া পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করিতেছেন, শুভদৃষ্টি তখনও বাকী, এমন সময়ে লণ্ঠন হাতে লইয়া তাহার মা আসিয়া উপস্থিত। তাঁহাকে দেখিবামাত্র গৌরীর বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধক্ করিয়া উঠিল।

গৌরীর মা আসিতেই বর্ষীয়সী মেয়েরা তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিল।—‘এস মা এস। তুমি না এলে ক…’

মা বলিলেন, ‘হ্যাঁ মা, আসতাম এতক্ষণ, কিন্তু জামাই রয়েছে ঘরে বাছা, না খাইয়ে শুইয়ে তো আসতে পারি না মা। কই বর দেখি!’

ছান্‌লা-তলার একটুখানি দূর হইতে লণ্ঠন তুলিয়া মা বর দেখিলেন।

‘ওমা, এ যে বেশ ছেলেটি! আহা, এ যে ঘর-আলোকরা জামাই হয়েছে বাছা। কই, মিনুর মা কই?’

বলিয়া তিনি পিছন ফিরিতেই পট্টবস্ত্ৰ-পরিহিতা মিনুর মা তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিয়া অনুচ্চকণ্ঠে কহিলেন, ‘আশীর্বাদ কর মা, আমার মিনু যেন…’

কথাটা শেষ হইল না। আনন্দে তাঁহার কণ্ঠ সহসা রুদ্ধ হইয়া গেল।

ঘরের ভিতর মিনির যত সমবয়সী বন্ধুরা তখন হল্লা করিতেছে। মা ডাকিলেন, ‘কই মা গৌরী, আয় বাছা আয়!’

কিছুক্ষণ আগে বোধ করি তাহাদের এই কথাই হইতেছিল। কে একটা মেয়ে যেন বলিয়া উঠিল, ‘মাইরি আর-কি!’

গৌরীও বলিল, ‘দাঁড়াও না মা একটুখানি। এই একটুখানি। শুভদৃষ্টিটা হয়ে যাক্।’

একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটিয়া গিয়া মিনির মাকে খবর দিয়া আসিল।

‘তাই নাকি?’—মিনির মা ওদিকের কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিলেন।—‘ওমা সে কি কথা গো! গেলেই হল কিনা!’

বলিয়া হাসিতে হাসিতে তিনি তাঁহাকে সেখান হইতে টানিয়া বাহিরে লইয়া গেলেন।

গৌরীর মাকে ভুলাইতে আর কতক্ষণ! নিতান্ত সহজ সরল ভালমানুষ। বিয়ে-বাড়ির কাজে লাগাইয়া দিবামাত্র বাড়ি ফিরিবার কথা তাঁহার আর মনেই রহিল না।

বিবাহ শেষ হইয়া গেল। বরযাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া চুকিল।

বাসরের উদ্যোগে মেয়েরা তখন মাতিয়া উঠিয়াছে। গৌরীর মনে পড়িল, বাসরে যাওয়া তাহার নিষেধ। একবার ভাবিল, মাকে লইয়া চুপি চুপি এই সময় সে সরিয়া পড়ে।

সারাদিন উপবাসের পর মিনুর মা তখন মিনুকে তাঁহার কোলে বসাইয়া আদর করিয়া নিজের হাতে খাওয়াইয়া দিতেছেন। লাল চেলি-পরা মিনুর কপালে চন্দনের ফোঁটা, হলুদরঙের সূতা-বাঁধা হাতে একটি রূপার কাজললতা।

মিনু তার মা’র কোল হইতে মুখ তুলিয়া ছোট একটা মেয়েকে কাছে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিল, গৌরীকে ডাক তো সাবু।’

আহা, গৌরীকে সে অনেকক্ষণ দেখে নাই।’

গৌরী কাছে আসিয়া বসিতেই লজ্জায় সে মায়ের কোল হইতে নামিয়া বলিল, ‘আর খাব না মা।’

বলিয়াই সে গৌরীর একখানি হাত চাপিয়া ধরিয়া জলভরা চোখে তাহার মুখের পানে একবার তাকাইল। বলিল, ‘যাসনে ভাই।’

গৌরী তখন ঝরঝর কাঁদিয়া ফেলিয়াছে।

মিনুর মা তাহাকে চুপ করাইলেন।—‘ছি মা, আনন্দের দিনে আজ কি চোখের জল…’

বলিয়া তাহাকে চুপ করাইতে গিয়া তিনিও মহা বিপদে পড়িলেন। নিজের চোখের জল গোপন করা তাঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল।

মা ও মেয়ে বাড়ি যখন ফিরিল, রাত্রি তখন অনেক হইয়াছে।

মা এবার বলিলেন, ‘যা মা তুই ওপরে যা!’

পা টিপিয়া টিপিয়া গৌরী দোতলায় গিয়া দেখে, ননীমাধবের ঘরের দরজায় ভিতর হইতে খিল বন্ধ। ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আজ আমি তোমার কাছে শুই মা?’

মা আজকাল মেয়েকে লইয়া শুইতে পান না। বলিলেন, ‘বেশ তো, দরজা বন্ধ বুঝি?’

গৌরী চুপ করিয়া রহিল।

পরদিন সকালে ননীমাধব কোনও কথাই জিজ্ঞাসা করিল না। গৌরী ভাবিল, হয়তো এ সামান্য কথা লইয়া সে আর তাহাকে বেশি কিছু বলিবে না।

সত্যই বলিল না।

রাত্রে সে মাত্র একবার জিজ্ঞাসা করিল:

‘সকালে এসেছিলে?’

ঘাড় নাড়িয়া গৌরী বলিল, ‘না, এসেছিলাম রাত্রেই। কি করব বল, কিছুতেই ছাড়ে না, তাই একটুখানি দেরি হয়ে গেল। এসে দেখি, দরজায় তোমার খিল বন্ধ। মায়ের কাছেই শুয়েছিলাম।’

কিছু না বলিয়া ননীমাধব এমনিভাবে চুপ করিয়া রহিল যে, গৌরীর মনে হইল, কথাটা সে বিশ্বাস করে নাই। বলিল, ‘মাকে না-হয় জিজ্ঞেস করে দেখো।’

ননীমাধব তথাপি নিরুত্তর।

মিনুকে তাহার শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইতে গিয়াছিল—মিনুর সেই থার্ড ক্লাসে-পড়া ভাই—জিতু।

সেদিন বৈকালে গৌরী তাহাদের রান্নাঘরের সুমুখের চালায় বসিয়া পান সাজিতেছে, এমন সময় ছুটিতে ছুটিতে জিতু আসিয়া হাজির।

গৌরী তাহাকে দেখিবামাত্র পান সাজা ফেলিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘ফিরে এলি তোরা? কেমন শ্বশুরবাড়ি রে?’

জিতু তাহার সুমুখে চাপিয়া বসিল। বসিয়া দুই হাঁটুর উপর হাত রাখিয়া দুলিয়া দুলিয়া মিনুর শ্বশুরবাড়ির গল্প আরম্ভ করিল। প্রথমেই আরম্ভ করিল, ‘দু’টো যা কুকুর আছে বাড়িতে—ফাইন্! একটা কালো আর একটা কালোয়-শাদায়।’

গৌরী কুকুরের গল্প শুনিতে চায় নাই। জিজ্ঞাসা করিল, ‘শ্বশুর-শাশুড়ী আছে কিনা তাই বল্ আগে।’

‘দাড়াও বলছি।’ বলিয়া কুকুর দুটো যে নূতন মানুষ দেখিলেই চিৎকার করে, এবং তাহাকেও যে দিনকতক অত্যন্ত বিব্রত করিয়া তুলিয়াছিল, প্রথমে সেই কথাই বলিল, পরে জামাইবাবু কেমন করিয়া তাহাদের সঙ্গে তাহার ভাব করিয়া দিলেন, অঙ্গভঙ্গি সহকারে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা করিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, শ্বশুর আছে, শাশুড়ীও আছে।’

বলিয়াই জিতু মুখ বাড়াইয়া গৌরীর কানের কাছে চুপি চুপি বলিল, ‘শাশুড়ী-মাগী ভারি বজ্জাত। এমনি উঁচু-উুঁচ দাঁত, যেমন কালো মাগী, তেমনি মোটা। দিদিকে আসতে দিচ্ছিল না কিছুতেই। তবে শ্বশুরটা ভাল।’

পানে সুপারি দিতে দিতে গৌরী জিজ্ঞাসা করিল, ‘মিনু কাঁদেনি তো সেখানে গিয়ে?’

‘বাঃ, কাঁদবে কেন?’ বলিয়া আবার সে তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গেল। বলিল, ‘জামাইবাবু যে খুব ভালবাসে।’

গৌরীর মুখখানা হঠাৎ লাল হইয়া উঠিল। হাসিয়া বলিল, ‘যা! তোকে যেন ওই কথা আমি জিজ্ঞেস করছি!’

জিতু বলিল, ‘দিদি তোকে যেতে বলেছে।’

গৌরী হেঁটমুখে পানের খিলি করিতে করিতে ভাবিতে লাগিল, যাইতে সে পারিবে কি না কে জানে।

জিতু ভাবিল, কথাটা সে বিশ্বাস করে নাই। বলিল, ‘মাইরি বলছি। যাস্ যেন।’ বলিয়াই হাত বাড়াইয়া একেবারে যতগুলা পান হাতে ওঠে একসঙ্গে ততগুলা তুলিয়া লইয়া জিতু পলায়ন করিতেছিল।

‘অতগুলো নিসনে।’ বলিয়া হাঁ হাঁ করিয়া গৌরী তাহার হাত হইতে পানগুলা কাড়িয়া লইতে গেল, কিন্তু জিতুও ছাড়িবার পাত্র নয়। দুজনে টানাটানি ছেঁড়াছেঁড়ি করিতে গিয়া কতক পান ছিঁড়িয়া পড়িল মাটিতে, একটি মাত্র খিলি আসিল গৌরীর হাতে, বাকী গোটা-দুই পান এক সঙ্গে মুখে পুরিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে জিতু ছুটিয়া পলাইল। যাইবার সময় চিৎকার করিয়া বলিয়া গেল, ‘যাস্ যেন।’

ঘাড় নাড়িয়া গৌরী বলিল, ‘যাব।’

বলিয়াই সে মুখ ফিরাইতেই উপরের জানালার পানে সহসা তাহার নজর পড়িল। দেখিল, জানালা খোলা, এবং সেই জানালার একটা কপাটের আড়ালে ননীমাধবের সন্দিগ্ধ তীক্ষ দুই চক্ষু তাহারই উপর স্থির নিবদ্ধ।

কয়েকদিন পরে শাশুড়ীকে ডাকিয়া ননীমাধব একখানি চিঠি দেখাইল। চিঠিখানি অত্যন্ত জরুরী। লিখিয়াছেন, ননীমাধবের সেই বড়লোক মামীমা।

ননীমাধব বলিল, ‘বিয়ে করেছি শুনে ভারি খুশি হয়েছেন; আবার দুঃখও করেছেন একটুখানি। লিখেছেন, বৌ নিয়ে তুই আমার এই চিঠিখানি পাবামাত্র আসিস যেন। না এলে কিন্তু ভাল হবে না।’

মাও খুব খুশি হইয়া একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, ‘যাক্! ভাবছিলাম রাগ করবেন হয়তো।—বাঁচা গেল। খুশি হয়েছেন তাহলে—কি বল বাবা, অ্যাঁ? খুশি হয়েছেন, কি বল?’

এই বলিয়া আহ্লাদে একেবারে আটখানা হইয়া চিঠিখানি মা একবার হাতে করিয়া তুলিয়া লইলেন। পড়িতে জানেন না, কি করিবেন, নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলেন, এই ক’টি কথা—তাও খামে চিঠি লিখেছেন…যেতে বলেছেন। তা বলবেন বৈকি!’

কিয়ৎক্ষণ পরে ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হবে তাহলে, কবে যাওয়া হচ্ছে আমাদের?’

মা বলিলেন, ‘দাঁড়াও বাবা, দাঁড়াও। যাবে,—দু’দিন সবুর কর। ভট্‌চাজ্‌কে দিন-টিন দেখাই।’

ননীমাধব বলিল, ‘আজই দেখাবেন যেন। মামীমাকে অনেকদিন দেখিনি, আমারও মন-কেমন করছে।’

মা বলিলেন, ‘তা তো করবেই বাছা।’

দিন পনের পরে মামীমার কাছ হইতে একখানি ‘টেলিগ্রাম’ আসিল। —‘এখনও তোমরা আসিলে না কেন?’

মা আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। দিন হির হইল, মাসের তের তারিখে।

রাত্রে ট্রেন।

একটিমাত্র মেয়ে। বিবাহের সময় মা তাঁহাকে ফাঁকি দেন নাই।

গয়না দিয়াছিলেন প্রায় তিন হাজার টাকার।

জিজ্ঞাসা করিলেন, হ্যাঁ বাবা ননীমাধব, সব গয়নাই দেব সঙ্গে? কি বল তুমি? কিন্তু বাবা, আঁধার রাত, গরুর গাড়িতে যাবে…’

ননীমাধব বলিল, ‘কিছু ভয় নেই মা।’

একটি একটি করিয়া মা তাহাকে সব গহনাই পরাইয়া দিলেন। সবচেয়ে ভাল শাড়ি পরাইলেন, সবচেয়ে ভাল জামা পরাইলেন, দামী একখানি শাল দিলেন সঙ্গে, তাহার পর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে বাক্স গুছাইয়া দিয়া সাবধানে থাকিতে বলিয়া পিঠে হাত দিয়া বলিলেন, ‘কাঁদিসনে মা, বড়জোর সাতদিন কি দশ দিনের বেশি রাখবে না, আমি বলে দিয়েছি ননীমাধবকে।’

মেয়েকে কাঁদিতে নিষেধ করিয়া মাও কাঁদিলেন। —‘একা ঘরে তোক ছেড়ে আমি কেমন করে থাকব মা?’

গরুর গাড়ি আসিয়া দরজায় দাঁড়াইল। শীতকাল। অন্ধকার রাত্রি। গ্রামে তখনও পর্যন্ত দু’একজনের খামারে ধানঝাড়াই-এর কাজ চলিতেছিল।

গাড়ির নিচে গাড়োয়ান তখন একটি লণ্ঠন বাঁধিয়া লইল। মাও কাঁদিলেন। মেয়েও কাঁদিল। মেয়ে-জামাই গাড়িতে উঠিয়া বসিলে গাড়োয়ান গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

যতক্ষণ দেখিতে পাওয়া গেল লণ্ঠন হাতে লইয়া দরজার কাছে মা দাঁড়াইয়া রহিলেন।

দু’ধারে ধানের ক্ষেত। মাঝখানে গরুর গাড়ি চলিবার পথ। চারিদিক অন্ধকার। আকাশে অগণিত নক্ষত্র। গাড়ির নিচের লণ্ঠনটির আলোকে পথের একটুখানি মাত্র দেখা যাইতেছিল। দূরে দূরে কয়েকটা অস্পষ্ট গ্রাম।

কতকগুলো শৃগাল একবার কাছাকাছি কোথায় যেন চিৎকার করিয়া উঠিতেই ননীমাধব জিজ্ঞাসা করিল, ‘হাঁরে পাঁচু, এইখানেই না সেদিন সেই কাকে যেন আগলেছিল?’

গাড়োয়ান বলিল, ‘আজ্ঞে না, এখানে নয়, জামাইবাবু, সে ওই সেই ভূতেশ্বরের মাঠে। জায়গাটা তেমন ভাল নয়। মড়ুইপুরের একটা শ্মশান আছে।’

গাড়ির মধ্যে একটু একটু করিয়া সরিয়া সরিয়া গৌরী ননীমাধবের গা ঘেঁষিয়া বসিল।

‘এই যে এই দিকে ভূতেশ্বরের মাঠ। ঠাকুর আছেন, প্রণাম কর!’ বলিয়া ননীমাধব নিজের হাত দু’টি কপালে ঠেকাইয়া গৌরীকেও একটি প্রণাম করিতে বলিল।

জিজ্ঞাসা করিল, ‘ভয় করছে তোমার?’

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া অত্যন্ত চুপি চুপি বলিল, ‘হুঁ।’

ননীমাধবও তেমনি আস্তে আস্তে কহিল, ‘গয়নাগুলো পরে আসা ভাল হয়নি। হাত-বাক্সটা কোথায়?’

‘এই যে।’ বলিয়া গৌরী তাহার পাশে হাত বাড়াইয়া বাক্সটা ননীমাধবের হাতের কাছে আগাইয়া দিল।

ননীমাধব বলিল, ‘খোল। এক একটি করে ধীরে ধীরে গয়না-টয়না সব খুলে তুমি রাখ এতে। রেখে চাবি বন্ধ কর।’

গৌরী তাহাই করিতে বসিল। এবং কিছুক্ষণ পরেই নাকের নাকছবিটি ছাড়া গয়না-গাঁটি সবই খুলিয়া ফেলিয়া বাক্সবন্দী করিয়া চাবিটি ননীমাধবের হাতে দিয়া বলিল, ‘তুমি রাখ।’

ননীমাধব বলিল, ‘চাবি থাক না তোমার কাছে।’

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া চুপি চুপি বলিল:

‘না। যদি কেড়ে নেয়?’

বলিয়া ফিক্ করিয়া একটুখানি হাসিল। অন্ধকারে সে হাসির কিছু দেখা গেল না। কিন্তু গৌরীর মাথাটা তাহার কোলের উপর ঢলিয়া পড়িতেই ননীমাধব ধীরে ধীরে তাহা কোল হইতে নামাইয়া দিয়া বলিল, ‘ঘুম পাচ্ছে তো শোও এইখানে।’

গাড়ি স্টেশনে আসিয়া পৌঁছিল। সেই স্টেশন। সেদিনও এমনি এক অন্ধকার রাত্রে তাহারা এইখানে আসিয়াই নামিয়াছিল।

লণ্ঠনের কাঁচটা কালি পড়িয়া পড়িয়া একেবারে কালো হইয়া গেছে। গৌরী কতদিনের জন্য বাপের বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়াছে কে জানে। পাঁচুর সঙ্গে কথা বলিবার আর কোনও ছুতা না পাইয়া বলিল, ‘এ আলোয় তুমি কেমন করে ফিরে যাবে পাঁচু?’

লণ্ঠনটার দিকে একবার তাকাইয়া ঈষৎ হাসিয়া পাঁচু বলিল, ‘এতেই ঠিক চলে যাব দিদি, ঘরমুখো গরু—কিছু বলতে হবে না, দেখতে না দেখতে ওরা উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলবে।’

গৌরী চুপি চুপি বলিল, মাকে বলো পাঁচু, মা যেন আমার জন্যে না ভাবে।’

কথাটা বলিতে বলিতে গৌরীর ঠোট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল। আরও কি যেন সে বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বলা হইল না।

গহনার ছোট বাক্সটি হাতে লইয়া ননীমাধব বলিল, ‘নে পাঁচু, একে-একে বড় বাক্স দুটো নাবিয়ে নিয়ে চল্ প্ল্যাটফর্মে দেখি, গাড়ি আসতে হয়তো আর বেশি দেরি নেই।’

স্টেশনটি নিতান্ত ছোট। প্ল্যাটফর্ম বলিতে কোথাও কিছু ছিল না। গাড়ি যেখানে আসিয়া দাঁড়ায়, লাইনের ধারে সেইখানের জমিটা মাত্র লাল কাঁকর বিছাইয়া সমতল করা হইয়াছে। চারিদিক অন্ধকার। স্টেশন-ঘরের সুমুখে দেওয়ালের গায়ে মাত্র কেরোসিনের একটি আলো মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছিল। বাকী আলোগুলো তখনও জ্বালানো হয় নাই।

বাংলাদেশে শীত তখন আর নাই বলিলেই হয়। চৈত্রের প্রথম। বসন্তের হাওয়া বহিতেছিল।

বাক্স দুটি নামাইয়া দিয়া প্রণাম করিয়া পাঁচু বিদায় লইল।

ননীমাধব বলিল, ‘বস তুমি ওই বাক্সের ওপর চেপে।’

কিন্তু স্বামী দাঁড়াইয়া আছে, নিজে সে বসিবে কেমন করিয়া! গৌরী ইতস্তত করিতেছিল।

ননীমাধব বলিল, ‘বস, আমি টিকিট কেটে আনি।’

দু’পা আগাইয়া গিয়াই আবার পিছন ফিরিয়া বলিল, ‘একা ভয় করবে না তো?’

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘না।’

ট্রেন আসিল আধ ঘণ্টা দেরি করিয়া। ব্র্যাঞ্চ লাইনের ট্রেন। না আছে আলো, না আছে যাত্রী। জন দুই-তিন উঠিল, জন চার-পাঁচ নামিল। একটুখানি গোলমাল হৈ-চৈ হইল। তাহার পর সিটি দিয়া ট্রেন ছাড়িয়া দিল।

দেখা গেল, ইন্টার ক্লাসের একটি কামরায় গৌরী ও ননীমাধব উঠিয়া বসিয়াছে।

ট্রেনের জানালার বাহিরে ননীমাধব ঘন ঘন তাকাইতেছিল। সুমুখের দুইটা বেঞ্চে আরও জন-কতক যাত্রী আগাগোড়া মুড়িসুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে। গৌরীর ইচ্ছা করিতেছিল, স্বামীর সঙ্গে দু’টা কথা কয়। এমনি আর-এক রাত্রে এমনি একটি ট্রেনের কামরাতেই যে তাহাদের প্রথম পরিচয়—হাসিয়া এই কথাটি তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিবার জন্য গৌরী উস্‌খুস্ করিতে লাগিল। কিন্তু সুমুখের বেঞ্চের ঘুমন্ত লোকটা তাহাদেরই দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিয়াছে বলিয়া গৌরী না পারিল কথা কহিতে, না পারিল ননীমাধবের কাছ ঘেঁষিয়া আর একটুখানি সরিয়া বসিতে। গায়ের শালখানি মুড়ি দিয়া সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

ঘন্টাখানেক পরে অনেকগুলো ছোট ছোট স্টেশন পার হইয়া আসিয়া অন্ধকার একটি ছোট স্টেশনে ট্রেন আসিয়া দাঁড়াইতেই ননীমাধব বলিল, ‘ওঠো।’

গৌরী প্রস্তুত হইয়াই ছিল, চট করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘বাক্স দুটো?’

‘তুমি নামো আগে।’ বলিয়া ননীমাধব দরজা খুলিয়া ধীরে ধীরে তাহাকে প্রথমে নামাইয়া দিল। তাহার পর বাক্স দুইটা টানিয়া দরজার কাছে আনিয়া নিজেও নামিল, বাক্সও নামাইল।

প্ল্যাটফর্মের বালাই এখানেও নাই।

বাক্স দুইটা নিজের হাতেই কতক টানিয়া, কতক তুলিয়া স্টেশন-ঘরের কাছাকাছি লইয়া গিয়া বলিল, ‘বস, আমি গাড়ি দেখি। ধর তো, এই টিকিট দুটো!’ বলিয়া গৌরীকে আবার তেমনি বাক্সর উপর বসাইয়া ননীমাধব ‘গাড়ি!’ ‘গাড়ি!’ করিয়া চিৎকার করিতে করিতে অন্ধকারে বোধ করি স্টেশনের বাহিরেই খোঁজ করিতে গেল।

ট্রেন আবার ছাড়িয়াছে।

দেখা গেল, গহনার বাক্সটি হাতে লইয়া ননীমাধব একাকী সেই চলন্ত ট্রেনের যে-কক্ষে আসিয়া উঠিয়াছে তাহাতে লোকজন কেহ নাই। মুখে তাহার কেমন যেন একটি অত্যন্ত নীরস নিষ্ঠুর নিরানন্দ হাসি।

স্বল্পালোকিত সেই নির্জন কক্ষের বাতায়ন-পথে মুখ বাড়াইয়া ননীমাধব একবার স্টেশনের দিকে তাকাইল। কেরোসিন-বাতির একটুখানি আলো গৌরীর মুখের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। বাক্সের উপর সবুজ রঙের শালখানি গায়ে দিয়া তখনও সে ঠিক তেমনিভাবে নিশ্চল পাষাণ-মূর্তির মত বসিয়া। স্বামীর আগমন প্রতীক্ষায় অন্ধকারের দিকে ব্যাকুল একাগ্র দৃষ্টি তাহার তখনও নিবদ্ধ।

এই বয়ঃসন্ধিগতা কিশোরীর—এবং শুধু এই কিশোরীর কেন, সমগ্র নারীজাতির নিষ্ঠা ও ভালবাসার উপর আস্থা তাহার অনেকদিন হইতেই নাই। আজও তাই সে তাহার দৈনন্দিন ঘটনার মতই অত্যন্ত সহজভাবে গৌরীকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়া নিশ্চিন্ত নীরবে গহনার বাক্সটি কোলের উপর চাপিয়া ধরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কিন্তু এমনি মজা, মুখখানি তাহার চোখের সুমুখ হইতে যতই ঝাপসা হইয়া আসে, ননীমাধবও জানালার বাহিরে তত বেশি করিয়া তাহার গলা বাড়াইয়া দেয়।

কিন্তু সে আর কতক্ষণ!

গাড়ির বেগ ক্রমশ দ্রুত হইতে দ্রুততর হইতে লাগিল। ননীমাধবের চোখের সুমুখ হইতে গৌরীর সেই একাগ্র উন্মুখ দুটি চক্ষু অদৃশ্য হইল, মুখখানি অদৃশ্য হইল, দেহ অদৃশ্য হইল, সবুজ রঙের শাল, শালের নিচে গৌরীর দুটি অলক্তকরঞ্জিত সুকোমল শুভ্র পা, টিনের তোরঙ্গ, কেরোসিনের আলো—দেখিতে দেখিতে পশ্চাতের অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হইয়া গেল। হু হু করিয়া বাতাস বহিতে লাগিল। দু’পাশের ঘন বন-বেষ্টিত গ্রাম, দিগন্ত-বিলীন শস্যশূন্য উন্মুক্ত প্রান্তর, শুষ্ক ধানের ক্ষেত,—সকলের উপরেই অন্ধকারের গাঢ় আস্তরণ ক্রমশ আরও গাঢ়তর হইয়া উঠিল।

গত পনের বৎসরের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতার কাহিনী যে তাহার জীবনে একেবারেই নাই তাহা নয়, তবে মানুষের জীবন লইয়া এমন খেলা কোনদিন খেলিয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইল না।

গহনার বাক্সটার উপর হাত পড়িতেই ক্ষণপূর্বে যে-মুখ তাহার বিগত জীবনের মতই পশ্চাতের অন্ধকারে মিলাইয়া গেছে, সেই গৌরীর মুখখানাই তাহার আবার মনে পড়িল। মনে পড়িতেই কেমন যেন একটা শুষ্ক অসাড়তায় মাথার ভিতরটা তাহার ঝিমঝিম করিতে লাগিল।

গাড়ি তখন খুব জোরে চলিয়াছে।

গাড়ির ঝকঝক শব্দ নির্জন কক্ষের সেই এক যাত্রীটির দুই কানের ভিতর দিয়া, বুকের উপর দিয়া, ধকধক করিয়া বাজিতে বাজিতে কোথায় যেন অতি নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করিতে শুরু করিল। কেন করিল কে জানে। এই অভাবনীয় ব্যাপারে ননীমাধবের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না। গাড়িতে উঠিবার সময় নারীজাতির উপর তাহার আবাল্যসঞ্চিত বিদ্বেষের, তাহার পুঞ্জীভূত ঘৃণার চমৎকার প্রতিশোধ লইতেছে ভাবিয়া যে-আনন্দ সে অনুভব করিয়াছিল, সহসা না জানি কেন সেই আনন্দের আবেগ কেমন যেন এক প্রাণান্তকারী নির্মম বেদনায় রূপান্তরিত হইয়া তাহার সমস্ত অন্তঃকরণটিকে মুহূর্তের মধ্যে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম করিতে লাগিল। মনে হইল, এ তাহার হৃদয়ের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া চলন্ত গাড়ির মধ্যে টলিতে টলিতে পদচারণা করিতে লাগিল। বাহিরে সূচীভেদ্য ঘন অন্ধকার-পরিবেষ্টিত বিশাল বহিঃপ্রকৃতির মাঝখানে নিঃসহায় নিরবলম্ব নিরপরাধ একটি বালিকার বেদনা-পরিম্লান দুটি সজলপক্ষ্ম চক্ষু, একটি ব্যথিত করুণ মুখচ্ছবি ব্যতীত তাহার মনশ্চক্ষুর সম্মুখে আর কোথাও কিছু অবশিষ্ট রহিল না। গহনার বাক্সটা একবার মাত্র হাতে করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা সে দূরে সরাইয়া দিল।

ট্রেনের গতি তখন আরও বাড়িয়াছে। এইবার বহুদূরে জংশন-স্টেশন। আর একবার সে জানালার বাহিরে তাকাইল। গাড়ি তখন একটি নদীর পুলের উপর দিয়া সশব্দে চলিয়াছে। পশ্চাতে—ঘন অন্ধকার নদীতীরের বায়ু-হিল্লোলিত শুভ্র কাশগুচ্ছের অস্পষ্ট শুভ্রতা, সম্মুখে—বহু দূরে একটি ডিস্‌ট্যান্ট্ সিগ্‌নালের রক্তিম আলোকও যেন সেই পরিত্যক্তা গৌরীর দুটি ব্যথিত পাণ্ডুর চোখের মত জ্বলজ্বল করিতেছে!

ননীমাধব কোন প্রকারেই সেদিক হইতে তাহার মুখ ফিরাইতে পারিল না।

কিন্তু বাসন্তীর মুখখানা এখনও তাহার মনে আছে। মায়ার কথাও বিস্মৃত হয় নাই। ও-মেয়ে সেই তাহাদেরই জাত, এই কথা ভাবিয়া সে জোর করিয়া চোখ বুজিল।

চোখ বুজিয়াও নিস্তার নাই। মুদিত চক্ষুর সম্মুখবর্তী মসীকৃষ্ণ ঘন অন্ধকারের দুর্ভেদ্য যবনিকা ভেদ করিয়া সে-আলোক যেন তাহার অন্তরের মাঝখানে প্রবেশ করিতে চায়।

এতদিন পরে সত্যই তাহার মনে হইতে লাগিল, নিখিল ব্যাপী এই বিরাট মিথ্যাচারের বাহিরে সত্য বস্তু হয়তো-বা কোথাও কিছু থাকিতেও পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *