বধূমাতা
সংস্কৃত ‘বধূমাতা’ থেকে বাংলায় বউমা। ‘বউমা’ এই সমাসবদ্ধ ক্ষুদ্র শব্দটি খুবই সুন্দর ও মধুর।
কন্যাসমা পুত্রবধূর সম্বোধনটি মধুর হওয়াই স্বাভাবিক। তেমনিই মাতৃতুল্যা শ্বশুর ঠাকুরানি হলেন মা, আজকাল অবশ্য ‘শাশুড়ি-মা’ সম্বোধনও শোনা যাচ্ছে। নবযুগের বধূমাতারা স্বামীর মাকে মা বলতে সংকোচ বা অসুবিধা বোধ করেন।
এই সূত্রে বাংলা শাশুড়ি শব্দটিও কিন্তু লক্ষণীয়। শ্বশুরের লিঙ্গান্তর, প্রশ্নপত্রের ভাষায় লিঙ্গ-পরিবর্তন হল শাশুড়ি। আদিতে একটা ব ফলা সমেত শ্বশুর শব্দটি বেশ ছিমছাম। কিন্তু যেমন ময়ূর-ময়ূরী, তেমন শ্বশুর-শ্বশুরি নয় কেন? শাশুড়িতে ব ফলা কোথায় গেল, র কী করে ড় হল, আবার কোথা থেকে এল।
শাশুড়ি বউমার এই দুঃখজনক আলোচনার ব্যঞ্জনগত এই প্রশ্নগুলো নিয়ে সময় ও স্থান নষ্ট করার সুযোগ নেই।
সুতরাং গল্পে যাচ্ছি, এবং ওই যা বললাম, দুঃখজনক গল্প।
বউ যদি বলেন, দুঃখজনক কেন তা হলে গল্পগুলো অনুধাবন করুন।
সারাদিন অফিসে বিস্তর খাটাখাটি করে সন্ধ্যাবেলায় বিশ্রামের জন্য ঘরে ফিরে তরুণ গৃহকর্তাটি দেখলেন সর্বনাশ! বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। শাশুড়ি বউয়ের ঝগড়া।
প্রশ্ন উঠবে, এ আর নতুন কী? এ তো চিরাচরিত ঘটনা। এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে।
টুকটাক, খুটখাট, চিৎকার-চেঁচামেচি আর তার থেকে ব্যাপারটা অনেক বেশিদূর গড়িয়েছে।
গৃহকর্তা ঘরে ফিরে দেখলেন যে তাঁর জননী বাইরের ঘরে সোফায় বসে বসে কাঁদছেন। ওপাশে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘর, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে সেখানে স্ত্রী রয়েছেন দরজা বন্ধ করে।
মা পায়ের কাছে একটা পুরনো সুটকেশ নিয়ে বসে রয়েছেন। ছেলেকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন, ‘তুই আমাকে একটা বৃদ্ধাবাসে রেখে আয়, আমি আর তোর বাসায় থাকব না।’
বৃদ্ধাবাসে জায়গা পাওয়া যায় না। আগে থেকে দরখাস্ত করতে হয়। ছেলে মাকে জানাল।
মা বললেন, ‘তা হলে আমাকে যে কোনও জায়গায়, যে কোনও রাস্তার মোড়ে ছেড়ে আয়, আমি ফুটপাথে থাকব। ভিক্ষে করে খাব। তবু তোর বাড়িতে আর একদণ্ড থাকব না।’
কিন্তু আজ ব্যাপার গুরুতর। অনেক চেষ্টার পর মায়ের কাছ থেকে তরুণটি জানতে পারল, বউ মায়ের কাচের ফুলদানি ভেঙে দিয়েছে। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তিরিশ বছরের পুরনো বিলিতি ফুলদানি, আমার বিয়েতে রাঙামামা উপহার দিয়েছিলেন।’
কিন্তু ফুলদানি ভাঙল কী করে? অনেক চেষ্টা করে যুবকটি বুঝতে পারলেন বউয়ের খুব একটা দোষ নেই। শাশুড়ি ঠাকরুন উত্তেজনার মাথায় বউমাকে ফুলদানিটা ছুড়ে মেরেছিলেন। তরুণী নববধূ মোক্ষম মুহূর্তে লাফ দিয়ে সরে যাওয়ায় ফুলদানিটা তার গায়ে না লেগে দেওয়ালে লেগে ভেঙে যায়।
এ গল্পের শেষ নেই। বলা বাহুল্য, শাশুড়ি ঠাকরুনের এখনও বৃদ্ধাবাসে যাওয়া হয়নি। হয়তো কোনও দিনই হবে না। চিরদিন এ ভাবেই চলবে।
তবে শোনা যায়, ফুলদানি ভাঙার ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই শাশুড়ি ঠাকুরানির মনোবাসনা পূর্ণ হতে চলেছিল।
একদিন দুপুরবেলা, তখন ছেলে অফিসে, কোথাকার এক বৃদ্ধাবাস থেকে উদ্যোক্তারা পাড়ার মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরছিল আশ্রমের জন্যে জিনিসপত্র, রসদ ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য।
বাসায় কড়া নাড়তে দরজা খুলে সংগ্রাহকদের কথা শোনার পর ভিতরের ঘরে গিয়ে বউমা ঘুমন্ত শাশুড়িকে টেনে নিয়ে আসেন বৃদ্ধাবাসে দান করবেন বলে। সেদিন নাকি বহু কষ্টে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন শাশুড়ি ঠাকরুন।
অবশ্য অতঃপর আর বৃদ্ধাবাসের জন্যে কোনওদিন আবদার করেননি তিনি। তবুও ঝগড়া, গোলমাল থামেনি। অবশেষে স্ত্রী এবং মায়ের নৈমিত্তিক ঝগড়ায় অতিষ্ঠ ছেলে একদিন তার বউকে বলেছিল, ‘আচ্ছা তুমি আর মা মিলেমিশে থাকতে পার না?’
বউ বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে তারপর সোজা বলেছিল, ‘না। পারি না।’
অনুনয়ের কণ্ঠে স্বামী বেচারা বলে, ‘দ্যাখো, আমাদের বাড়ির ওই কুকুর বেড়াল, ভুলো আর হুলো ওরা দু’জন দু’ জগতের জানোয়ার হয়েও কেমন মিলেমিশে সহাবস্থান করছে, তুমি আর মা দু’জনে কি সে ভাবে থাকতে পার না?’
বউ বলল, ‘তুমি বেড়ালের লেজটা কুকুরের লেজের সঙ্গে গিঁট দিয়ে বেঁধে দাও, তারপর দ্যাখো ভুলো আর হুলো কেমন সহাবস্থান করে?’