বদ্যিনাথের বড়ি

বদ্যিনাথের বড়ি

কোন সকালে কলু কদ্দিন দেখেছে রাস্তার মধ্যিখানে লোহার গোল ঢাকনি খুলে খ্যাংরাকাঠির মতন গোঁফওয়ালা লোক, ছোটো বালতি-হাতে দড়িবাঁধা কালো ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওত পেতে বসে থাকে। লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কাদার ছিটে- অমুদা যখন দাড়ি কামাত না তখন তাকে যেমন দেখাত সেইরকম দেখায়। ছোটো ছেলেটা হয়তো ওর ভাইপো হবেও-বা। ওর নাম হয়তো ছক্কু, ওর গায়ে মোটে কাপড় নেই, কিন্তু কানে সোনালি রঙের মাকড়ি, গলায় মাদুলি বাঁধা। বুবু বলে নাকি সত্যি সোনার নয়; ওরা গরিব কিনা, খেতেই পায় না, ও পেতলের হবে। কলু আর বুবু ছাড়া ওদের কেউ দেখেই না। সামনে দিয়ে দেবরঞ্জন মামা, অমুদা, ননিগোপালরা সবাই চলে যায়, তাড়াতাড়ি কোথায় কোন বন্ধুর বাড়ি ওদের চোখেই পড়ে না। কিন্তু কলু দেখেছে লোকটা মাঝে মাঝে বালতি টেনেটুনে উপরে তোলে, সেটা থাকে কাদায় ভরা; সেই নোংরা কাদা রাস্তার পরিষ্কার ডাস্টবিনে ঢেলে আবার বালতি নামিয়ে দেয়। কাদা ছাড়া কখনো কিচ্ছু ওঠে না। কত কী তো হারিয়ে যায়, কিন্তু ওর ভিতর থেকে কিছু কক্ষনো বেরোয় না। দাদা বলেছিল বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে ওর সোজাসুজি যোগ আছে, ওর ভিতর কুঁদো কুমির ছেলেপুলে নিয়ে হুমো দিয়ে থাকে, কই বালতিতে তার ডিমটিম তো কক্ষনো পাওয়া যায় না!

দাদার ফাউন্টেন পেন হারিয়ে গেল; চিনুদার কবিতার খাতা হারিয়ে গেল; বদ্যিনাথের নতুন চটি হারিয়ে গেল গোরামামার বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে; সেইদিনই আবার পাল সাহেবের ছাতাও কোথায় হারিয়ে গেল; ছোড়দির চুড়ি ড্রেনের ভিতর তলিয়ে গেল; এতসব গেল কোথায়? তার কিছু মোটে কোথাও পাওয়াই গেল না। অথচ সেই লোক দুটো কত কাদা ওঠাল!

রাত্রে মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন, বুবু পড়ে না, কলু পড়ে। রোজ রাত্রে, রবিবার ছাড়া। কলু কত সময়ে সেই দু-জনের কথা ভাবে, সন্ধি-সমাস গোল হয়ে যায়, মাস্টারমশাই রেগে কাই! বলেন, ওরে আহাম্মুক! আমার ছেলে বিধুশেখর তোর অর্ধেক বয়েসে তোর তিন গুণ পড়া শিখত!

ছেলে বটে ওই বিধুশেখর! তার কথা শুনে শুনে কলু তো হেদিয়ে গেল। সে কক্ষনো হাই তুলত না, কক্ষনো চেয়ারে মচমচ শব্দ করত না, কক্ষনো চটি নাচাত না। প্রথম প্রথম ভাবত, তা হলে সে বোধ হয় এতদিনে নিশ্চয় মরে গিয়েছে। কিন্তু মাস্টারমশাই বলেছেন সে নাকি বিয়ে করে কোথায় পোস্টমাস্টারি করে।

একদিন বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনেছিল। বলেছিল ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি, কোন কবিরাজের কাছ থেকে এনেছে। নাকি অনেকদিন আগে মানুষদের পূর্বপুরুষরা বাঁদর ছিল, সেই বাঁদুরে রক্ত মানুষের গায়ে আছেই আছে, ওই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে–ওই একরকম ধাত কিনা! কলু তার দুটো বড়ি চেয়ে রাখল, কাজে লাগতে পারে।

মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বহুদূরে, উনি তবু রোজ ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হতেন। কী শখ বাবা পড়াবার! মাঝে মাঝে দাদারা এসে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ত, কলুকে শব্দরূপ মুখস্থ করতে হত। কলুর চোখ বুজে আসত, মাথা ঝিমঝিম করত, আর দাদারা শুধু কথাই বলত। কলু দড়িবাঁধা ছেলেটার কথা ভাবত, আর শুনতে পেত পাশের বাড়ির ছোটো ছেলেরা খেতে বসে হল্লা করছে। আর ভাবত, এমন অবস্থায় পড়লে মাস্টারমশাইয়ের ছেলে সেই বিধুশেখর কী করত!

এক-এক দিন যেই পড়া শেষ হয়ে আসত, বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামত। মাস্টারমশাই হয়তো বাড়িতে ছাতা ফেলে আসতেন, আটকা পড়তেন।

কলু ব্যস্তভাবে বলত, ছাতা এনে দিই, ভালো ছাতা?

মাস্টারমশাই বলতেন, না না, থাক, থাক। একটু বসে যাই।

কলু আবার সেই মচমচে চেয়ারটাতে বসত।

মাস্টারমশাই তাঁর ছোটোবেলাকার অনেক গল্প বলতেন। তখন বাবাও নাকি ছোটো ছিলেন, একসঙ্গে ইস্কুলে পড়তেন, পুজোর সময় কাঁদের বাড়ি যাত্রাগান হত, পালিয়ে গিয়ে শুনতেন। কলুর চোখ জড়িয়ে আসত, হাই তুলতে সাহস হত না; ভাবত এতক্ষণে সেই দড়িবাঁধাটা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। হাইগুলো মাথায় গিয়ে জমাট বাঁধত, চম্‌কে জেগে যেত, শুনত মাস্টারমশাই বলছেন, দে বাবা, ছাতাই দে। এ আর আজ থামবে না।

কলু ছুটে ছাতা এনে দিত, মাস্টারমশাই চলে যেতেন আর কলুর ঘুমও ছুটে যেত।

এমনি করে দিন যায়। একদিন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, মাস্টারমশাই বিধুশেখরের কথা বলছেন। সে শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে কক্ষনো বায়োস্কোপ দেখেনি, থিয়েটারে যায়নি, বিড়ি টানেনি, গল্পের বই খোলেনি। বলতে বলতে মাস্টারমশাই বললেন, ওরে, চুপিচুপি দুটো পান সেজে নিয়ে আয় তো দেখি।

কলু দৌড়ে গেল, পান দিল, চুন দিল, দুটো করে এলাচদানা দিল, বড়ো বড়ো সুপুরির কুচি দিল, আর সবশেষে কী মনে করে বদ্যিনাথের সেই আশ্চর্য বড়িও একটা করে গুঁজে দিল।

মাস্টারমশাই একটা পান তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন, একটা বইয়ের মতন দেখতে টিনের কৌটোতে ভরলেন। কলু তাক করে রইল। প্রথমটা কিছু মনে হল না– তারপর ভালো করে দেখল, মনে হল মাস্টারমশাইয়ের কপালের দিকটা কীরকম যেন লম্বাটে দেখাচ্ছে, থুতনিটা যেন। ঢুকে পড়েছে, চোখ দুটোও কীরকম পিটপিট করতে লাগল।

কলুর বুকের ভিতর কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। মাস্টারমশাই বাড়ি যান-না কেন? যদি হঠাৎ ল্যাজ দুলিয়ে হুপ করেন? এমন সময়ে বৃষ্টি থেমে গেল, মাস্টারমশাই ধুতির খুঁটটা কাদা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে গেলেন। কলু ভাবতে লাগল, ক-দিন আর ধুতির খুঁট? অন্য পানটা বিধুশেখর। বোধ হয় আজ রাত্রে চেয়ে নেবে, তারপর সেই-বা ধুতি নিয়ে করবে কী!

.

পরদিন বিকেলে বই নিয়ে কলু অনেকক্ষণ বসে রইল, কিন্তু মাস্টারমশাই এলেন না। সন্ধ্যাবেলা বাবা বললেন, ওরে তোর মাস্টারমশাই যে হেডমাস্টার হয়ে বিষ্টুপুর চলে গেলেন।

কলু ভাবল, বিষ্টুপুর কেন, কিষ্কিন্ধে হলেও বুঝতাম! তারপর বহুদিন চলে গেছে। কলুর নতুন মাস্টার এসেছেন, তার ছেলের নাম বিধুশেখর নয়, তার ছেলেই নেই। তিনি কলুকে রোজ ফুটবলের, ক্রিকেটের গল্প বলেন কিন্তু কলুর থেকে থেকে মনে হয়, অন্ধকারে ওবাড়ির পাঁচিলে দুটো কি ল্যাজঝোলা বসে আছে! একটার মুখ কেমন চেনা চেনা, অন্যটা বোধ হয় বিধুশেখর!

2 Comments
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *