বদন রায়ের অয়েল পেন্টিং – বিশ্বপতি চৌধুরী
ভূত বিশ্বাস করি কি না জিজ্ঞেস করছ? যদি বলি বিশ্বাস করি, তাহলে তোমরা নিশ্চয় আমাকে নেহাতই পাড়াগেঁয়ে ঠাওরাবে। কিন্তু তাই বলে তো আর জলজ্যান্ত মিছে কথাটা বলতে পারি না! বিশেষ করে এই বুড়ো বয়সে!
সুতরাং জিজ্ঞেসই যখন করলে, তখন বলেই ফেলি, ভূত আমি বিশ্বাস করি।
চিরকালই যে বিশ্বাস করতাম, তা নয়। একটা বিশেষ ঘটনার পর থেকে বিশ্বাস করি, এবং বাকি জীবনটা বিশ্বাস করেই চলতে হবে আমাকে।
এখন সেই বিশেষ ঘটনাটা কী, সেই কথাই তোমাদের বলব।
ঘটনাটা ঘটেছিল বহুকাল আগে। বহুকাল বৈকি! ত্রিশ বছর আগেকার ঘটনাকে বহুকালের ঘটনা ছাড়া আর কী বলব বল!
আমার বয়েস তখন উনিশ কি বড়জোর কুড়ি। কলেজে তখন বি.এ.পড়ি।
সেদিন সৌরীনদের বাড়িতে আমাদের মজলিস বসেছিল। কথায় কথায় ভূতের প্রসঙ্গ উঠেছিল সেদিন। সৌরীনটা ফস্ করে বলে উঠল, ‘ভূত বিশ্বাস করে যারা, আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি তাদের পাগলা গারদে পুরে রাখতুম।’
আমিও যে ভূত বিশ্বাস করতুম তা নয়। কিন্তু সৌরীনটাকে আমি কোনদিনই সহ্য করতে পারতুম না। ওর মধ্যে এমন একটা হামবড়া ভাব ছিল যেটা আমাকে ভিতরে ভিতরে কেমন যেন ধাক্কা দিত। ঠোঁটদুটোকে বেঁকিয়ে, ভুরুদুটোকে কুঁচকে এমন একটা উপর-চাল মেরে ও কথা বলত, যেটা সহ্য করা আমার পক্ষে অনেক সময় অসম্ভব হয়ে উঠত।
আমি নিজে কোনদিনই ভূত বিশ্বাস করতুম না, কিন্তু সৌরীনটাকে দাবাবার জন্যেই ফস্ করে সেদিন বলে ফেললুম, ‘আমি ভূত বিশ্বাস করি।’
সঙ্গে সঙ্গে ভবেশ, প্রবোধ, নির্মল আর গুণেনও বলে উঠল, ‘আমরাও করি।’
ওরাও ঠিক ওই একই কারণে আমার কথায় সেদিন সায় দিয়েছিল। সৌরীনটার চালিয়াতি ওরাও সব সময় বরদাস্ত করতে পারত না।
এবার চলল তুমুল তর্কযুদ্ধ। সে যুদ্ধে যুক্তি-প্রমাণ যত না ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল গলাবাজির দাপট।
সৌরীনদের বাড়ি থেকে ফিরে সেদিন ঠিক করলুম, রাস্কেলটাকে যে-করে হোক জব্দ করতে হবে। তারপর বসল পরামর্শ-সভা। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ঠিক হল, ওকে একদিন ভূত দেখাতে হবে।
কিন্তু দেখানো যায় কী করে? প্ল্যান আঁটতে বসে গেলাম সবাই মিলে।
ভবেশের মাথায় অনেক রকম দুষ্টুবুদ্ধি খেলত। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘হয়েছে!’
বললুম, ‘কী হয়েছে রে?’
চোখ দুটো বুজে ভবেশ বললে, ‘রায়েদের বরানগরের বাগানবাড়ি।’
প্রবোধ বললে, ‘তার মানে?’
চোখদুটো না খুলেই বিড়বিড় করে ভবেশ বললে, ‘ভূতনাথ।’
বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘কী মাথামুণ্ডু বকছিস তুই!’
সে তেমনিভাবেই বিড়বিড় করে বললে, ‘বদন রায়ের অয়েল-পেন্টিং।‘
সজোরে একটা ঝাঁকুনি মেরে বললুম, ‘সিদ্ধি খেয়েছিস নাকি?
এইবার চোখদুটো খুলে সোজা হয়ে বসে ভবেশ বললে, ‘ব্যস্ত হয়ো না বন্ধু, ব্যস্ত হয়ো না,—খুলে বলছি সব।’
তারপর কতকটা আপন মনেই সে বলতে লাগল, ‘রায়েদের বরানগরের বাগানে কোন রকমে সৌরীন রাস্কেলটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে! রায়েদের নন্দর সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে। বাগানটা একদিনের জন্যে চাইলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে। ওদের বাগানবাড়ির দোতলার হলঘরটার দেয়ালে নন্দর ঠাকুরদা বদন রায়ের একটা প্রকাণ্ড অয়েল-পেন্টিং ছবি আছে। ইয়া লম্বা-চওড়া পুরুষ, ইয়া পাগনো গোঁফ; ইয়া গালপাট্টা; গায়ে কালো রঙের চোগা, তার উপর কাদার সেকেলে শাল…’
তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, ‘তাতে আমাদের কী এল গেল শুনি?‘
আমার কথায় একটুও কান না দিয়ে ভবেশ পূর্ববৎ বলে যেতে লাগল: ‘আমাদের ভূতনাথের চেহারাটা এইবার একবার চোখ বুজে ভেবে নেওয়া যাক। দিব্যি লম্বা-চওড়া চেহারা। নাকের তলায় পাকানো গোঁফ নেই বটে, কিন্তু নকল গোঁফ সাজওয়ালাদের দোকান থেকে ভাড়া করে এনে যথাস্থানে দিতে কতক্ষণ? গাল দুটোতে নকল গালপাট্টাও অনায়াসে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। চোগা আর শাল নন্দর কাছ থেকে একদিনের জন্যে ধার করলেই হবে। বদন রায় যে চোগা আর শাল গায়ে ছবি আঁকিয়েছিলেন, সেই চোগা আর শাল নন্দদের বাড়িতেই আছে। সুতরাং ওর কাছ থেকে একদিনের জন্যে চাইলেই পাওয়া যাবে।’
সকলেই এবার সোৎসাহে বলে উঠলুম, ‘তারপর?’
ভবেশ এতক্ষণ কতকটা নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, এইবার আমাদের দিকে চেয়ে বললে, ‘তারপর তোরা কোন উপায়ে সৌরীনটাকে রায়দের ওই বাগানবাড়িতে নিয়ে ফেলবি। দোতলার হলঘরটায় বসবে তোদের মজলিস। বদন রায়ের অয়েল-পেন্টিংটার তারিফ করবি তোরা সকলে, যাতে করে সৌরীনের নজর পড়ে ছবিটার দিকে। ছবিটা নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ আলোচনা চালাবি তোরা, যাতে করে ছবিটার দিকে ওকে বার-বার চাইতে হয়, এবং তার ফলে ছবিটার খুঁটিনাটিগুলো ওর মনের মধ্যে বেশ করে গেঁথে যায়। ওদিকে ভূতনাথটা আগে থাকতেই বাগানবাড়ির তেতলার ছাতের চিল-কুঠুরিটায় সেজেগুজে তৈরি হয়ে থাকবে। ওখানে একটা বড় দেখে আয়না রাখা হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও নকল গোঁফ আর গালপাট্টা স্পিরিট-গাম দিয়ে বেশ করে যথাস্থানে জুড়ে দিয়ে শাল আর চোগা গায়ে দিয়ে স্বর্গীয় বদন রায় সেজে রেডি হয়ে বসে থাকবে।
‘আমরা এদিকে দোতলার হলঘরটায় হল্লা করতে থাকব। তারপর যেই একটু রাত হবে, স্বর্গীয় বদন রায়ের ভৌতিক সংস্করণটি তেতলার চিল-কুঠুরি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে হলঘরের সামনের চলনটাতে ঘটঘট করে জুতোর শব্দ করে গদাই-লস্করি চালে পায়চারি করতে থাকবে।’
‘ব্যাপার দেখবার জন্যে তোরা তখন হলঘর থেকে সৌরীনকে নিয়ে বেরিয়ে আসবি। তারপর যা হবে, তা বোধ হয়…’
তার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সকলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘থ্রি চীয়ার্স ফর ভবেশদা—হিপ্ হিপ্ হুররে!’
জয়ধ্বনির পালা শেষ হতেই প্রবোধের দিকে চেয়ে ভবেশ বললে, ‘মনে আছে, তুই কথা দিয়েছিলি, বিয়ের পর একদিন আলাদা করে আমাদের ফীস্ট দিবি! ফীস্টটা রায়দের বাগানবাড়িতে হলে কেমন হয়? খাওয়াও হবে, ভূত দেখাও হবে। অর্থাৎ আহার এবং ওষুধ দুই একসঙ্গে হবে। আহারটা হবে আমাদের, আর ওষুধটা গিলবে সৌরীন রাস্কেল!’
সকলে একসঙ্গে বলে উঠলুম, ‘চমৎকার হবে!’
এক মাস পরের ঘটনা। রায়দের বরানগরের বাগানবাড়িতে জড়ো হয়েছি সবাই। প্ৰবোধ তার বিয়ের ফীস্টটা এইখানেই দেবার ব্যবস্থা করেছে। এইখানেই আজ খাওয়া দাওয়া করে রাত কাটাব সবাই।
ভূতনাথ আগে থাকতে তেতলার চিল-কুঠুরিটায় আস্তানা গেড়েছে। সব মজুত। নকল গোঁফ, নকল গালপাট্টা, চোগা, শাল সবই জোগাড় হয়েছে। চিল-কুঠরির দেয়ালে বড় দেখে একটা আয়না ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই কোথাও। ভূতনাথের উপর আমাদের সকলের অখণ্ড বিশ্বাস। এসব কাজে তার উপর যথেষ্ট নির্ভর ব্রা যায়। শখের যাত্রার দলে নারদ মুনি থেকে শুরু করে জল্লাদ পর্যন্ত অনেক কিছুই সেজেছে হতভাগা। সুতরাং ওর মেক-আপ সম্বন্ধে আমরা সবাই নিশ্চিন্ত।
বিকেলটা বাগানে বেড়িয়ে কাটানো গেল। বেড়াবার মতই বাগান।
ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। রান্নার হাঙ্গামা করা হয়নি। কলকাতা থেকে খাবার দাবার সবই কিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চা-টা কেবল স্থানীয় একটা দোকান থেকে আনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
খাওয়া দাওয়া চুকতে রাত প্রায় নটা বেজে গেল। তারপর কিছুক্ষণ চলল গান বাজনা আর হৈ-হুল্লোড়। বাগানবাড়ির দোতলার হলঘরটায় বসেছিল আমাদের মজলিস।
রাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটায় ঢং ঢং করে এগারোটা বেজে গেল। গ্রীষ্মকাল, হলঘরের জানলাগুলো সব খোলা ছিল। বাইরে যতদূর দৃষ্টি চলে, কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কেবল বড় বড় আমগাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথা, এক-একটা যেন মূর্তিমান জমাট অন্ধকার!
হঠাৎ প্রবোধ বলে উঠল, ‘ওটা কার অয়েল-পেন্টিং বলতে পারিস কেউ?’
ভবেশ বললে, ‘এই বাগানবাড়ির বর্তমান মালিক গোকুল রায়ের জ্যাঠামশাই স্বর্গীয় বদন রায়ের ছবি ওটা।’
নির্মল বললে, ‘লোকটা কিরকম লম্বা-চওড়া ছিল দেখেছিস!’
গুণেন বললে, ‘গোঁফজোড়া তারিফ করবার মতন!’
প্রবোধ বললে, ‘মা-দুগ্গার অসুরের মতন গালপাট্টার বাহার দেখেছিস!’
আমি বললুম, ‘যাই বল ভাই, মরদের মতন চেহারা বলতে হবে!’
সৌরীন ঠোঁটটাকে বেঁকিয়ে শুধু বললে, ‘জঙলি!’
এরপর বদন রায়ের অয়েল পেন্টিংটার উপর অনেক কিছু মন্তব্য চলতে লাগল। কেউ বললে, বদন রায়ের গায়ের ওই শালটার দাম হাজার টাকার কম নয়। কেউ বললে গায়ের ওই চোগাটা সাটিনের, কেউ বললে ভেলভেটের, কেউ বললে না আমার মনে হয় বনাতের।
ভবেশ বললে, ‘ওঃ, চোখদুটো কিরকম জ্বলজ্বল করছে! চোখের চাউনি দেখলেই বোঝা যায়, লোকটা খুব বুদ্ধিমান ছিল!’
একটা অবজ্ঞার হাসি হেসে ঠোঁটটাকে আগের মতই বেঁকিয়ে সৌরীন বললে, ‘মুখ-চোখের ভাব দেখে আমার কিন্তু মনে হয় লোকটা একটা আস্ত ইডিয়ট ছিল!’
ঠিক সেই সময় গুণেন বলে উঠল: ‘বাইরের চলনে ও কিসের শব্দ?’
বাইরে তখন সত্যই একটা খট্খট্ শব্দ হচ্ছিল। ভারী জুতো পরে কেউ পায়চারি করে বেড়ালে যেরকম শব্দ হয়, ঠিক সেই রকম শব্দ। শব্দটা যেন চলে-চলে বেড়াচ্ছে।’
ভবেশ চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে?—কে ওখানে?’
কোন উত্তর নেই।
গুণেন বললে, ‘একবার বেরিয়ে দেখলেই তো সব গোল চুকে যায়!’
চাপা কষ্ঠে ভবেশ বললে, ‘কাজ নেই বেরিয়ে!’
ঠোঁটটাকে বেঁকিয়ে সৌরীন বললে, ‘যত সব মেয়েমানুষ!’
কথাটা শেষ করেই সে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল এবং এক নিমেষে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে চলনের সুইচটা টেনে দিলে। দেখতে দেখতে বাইরের চলনটা আলোকিত হয়ে উঠল।
পরক্ষণেই একটা ভারী জিনিস পড়ার আওয়াজ শোনা গেল।
সকলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম। সৌরীন তখন চলনের একধারে মেঝের উপর পড়ে গাঁ-গাঁ করছে।
ওদিকে বদন রায়ের ভৌতিক সংস্করণটি লম্বা চলনটায় তখনও গদাইলস্করি চালে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
বলিহারি মেক-আপ! অয়েল পেন্টিং-এর বদন রায় সহসা যেন শরীর ধারণ করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।—একেবারে হুবহু সেই চেহারা! ভূতনাথটার কেরামতি আছে বলতে হবে!
কিন্তু ওদিকে মন দেবার সময় নেই তখন। সৌরীনকে নিয়ে আমরা তখন রীতিমত বিব্রত হয়ে পড়েছি।
ধরাধরি করে তাকে হলঘরে এনে ফরাশের উপর শুইয়ে দেওয়া হল। মাথার উপরকার ইলেকট্রিক ফ্যানটা পুরোদমে চালিয়ে দিয়ে মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দেওয়া হতে লাগল।
বাইরের চলনে তখন পায়চারির শব্দ থেমে গেছে।
প্রায় দশ মিনিট পর সৌরীন চোখ চাইলে। বুঝলুম, এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে এসেছে।
এতটা বাড়াবাড়ি হবে ভাবতে পারি নি আমরা। সৌরীনটার অবস্থা দেখে তখন সত্যি দয়া হচ্ছিল।
ফ্যালফ্যাল করে চারিদিক পানে একবার চেয়ে সৌরীন আবার চোখ বুজলে। তারপর ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
ভবেশ বললে, ‘যাক, এতক্ষণে ফাঁড়া কাটল। আর ভয় নেই। ঘণ্টাখানেক ঘুমোলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এতক্ষণ ভূতনাথের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। সৌরীনটা একটু সুস্থ হতেই তার কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই বাহাদুরি আছে ওর!
ছুটলুম চিল-কুঠুরির দিকে ওকে কন্গ্র্যাচুলেট করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখলুম, তাতে আমার চক্ষু কপালে ঠেলে উঠল। দেখি, চিল-কুঠুরির মেঝের উপর ভূতনাথের অচৈতন্য দেহটা পড়ে রয়েছে।
ঘরের এক কোণে একটা কুঁজো ছিল। তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল নিয়ে তার মুখে-চোখে জোরে-জোরে ঝাপটা দিতে লাগলুম।
অনেকক্ষণ পর ভূতনাথ চোখ মেললে। ইতিমধ্যে নির্মল আর ভবেশও এসে পড়েছিল। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে দোতলায় নামিয়ে এনে হলঘরের পাশের একটা ছোট খালি ঘরে শুইয়ে দিলুম।
আশ্চর্য ব্যাপার! নকল গোঁফ, গালপাট্টা সবই তাজা রয়েছে। তাতে কেউ হাত দেয়নি। ব্যবহার করলে ওতে স্পিরিট গাম লেগে থাকত। শাল, চোগা প্রভৃতি একটা সুটকেসে পরিপাটিভাবে ভাঁজ করা অবস্থায় সাজানো রয়েছে। হস্তক্ষেপের কোন চিহ্ন বা লক্ষণ সেখানে নেই।
এ কী করে সম্ভব হতে পারে? একটু আগে কে তবে বদন রায় সেজে আমাদের চোখের সামনে পায়চারি করে বেড়ালো? কে সে?
বুকটা আমাদের দুর-দুর করে উঠল।
পরদিন ভূতনাথ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে তার মুখ থেকে ব্যাপারটা যা শুনেছিলুম তা এইরূপ:
রাত পৌনে এগারোটার সময় সে অথাৎ ভূতনাথ টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজের ব্যবস্থা করছিল, এমন সময় হঠাৎ আয়নায় কার ছায়া পড়ল। আয়না থেকে চোখ ফিরিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে সে যা দেখলে, তাতে তার সমস্ত শরীরের রক্তচলাচল হঠাৎ যেন বন্ধ হয়ে গেল। সে দেখলে, তার সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অয়েল পেন্টিং-এর সেই বদন রায়। সেই গোঁফ, সেই গালপাট্টা, সেই জ্বলজ্বলে বড় বড় চোখ⋯!
তারপর কী হয়েছিল সে জানে না। কেবল জ্ঞান হারাবার পূর্বমুহূর্তে সে একজোড়া ভারী জুতোর অস্পষ্ট খট্খট্ আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। আওয়াজটা তেতলার সিঁড়ি বেয়ে যেন নিচে নেমে যাচ্ছে!
এর বেশি সে আর কিছু বলতে পারে নি।