1 of 2

বদনবাবুর বাড়ি – সরোজকুমার রায়চৌধুরী

বদনবাবুর বাড়ি – সরোজকুমার রায়চৌধুরী

মদনপুরের বদনবাবু নিজের শক্তিতে তিসির ব্যবসা করে লক্ষাধিক টাকা রোজগার করেন। কুঁড়ে নঘরে ছেঁড়া কাঁথায় তিনি জন্মেছিলেন। সেই লোক কী করে অত বড় বাড়ি, অত বিষয় সম্পত্তি করেছিলেন সে এক আশ্চর্যের ব্যাপার। বিশেষ করে তাঁর তিসির গোলাবাড়ি দেখলে তাক লেগে যায়। একটা প্রকাণ্ড বড় খামারে সার সার প্রকাও প্রকাণ্ড গোলা। এক-একটা গোলায় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার তিসি। এমন গোলা পঞ্চাশটা।

ছেলেবেলায় বদনবাবু লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। কোন রকমে ভাঙা ভাঙা মোটা মোটা অক্ষরে হিসেবের খাতা লিখতে পারতেন। তাও বড় একটা লিখতে হত না। এজন্যে একজন মুহুরি ছিল। বদনবাবু লোহার সিন্দুকের পাশে একটা ফরাশের উপরে বসে খবরদারি করতেন। এককালে নিজে মাথায় করে তিসি বয়ে এনেছেন। এখন আর তা করতে হয় না। খালি একটা বেনিয়ান গায়ে দিয়ে আর একখানা মোটা ক্যাঁটকেঁটে আট হাত ধুতি পরে সব দেখাশুনো করেন। তাঁর একমাত্র ছেলে মহেন্দ্র বড় হয়েছে। সে-ই সব করে।

কিন্তু মহেন্দ্রের উপর বদনবাবুর মনে মনে আস্থা নেই। তার চোখে সোনার চশমা! মাথায় টেরি। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি। হাতে সোনার রিস্টওয়াচ। পরনে সদ্য-বোয়া দেশী ধুতি। গায়ে কোথায় তিসির ধুলো লাগবে এই ভয়েই সর্বদা সশঙ্কিত। আগে যেখানে দোকানে পনের জন লোক খাটত, সেখানে সে আরও দশজন বাড়িয়েছে। কাজেই শুধু বসে বসে হুকুম করলেই তার কাজ শেষ হয়। বদনবাবু ছেলের এই বাবুগিরি মনে মনে অপছন্দ করেন। কিন্তু পুত্রস্নেহে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। কেবল এতদিনের এত কষ্টের গড়া ব্যবসা দু-দিনে নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে যতদিন পারেন প্রত্যহ একবার ঠুক-ঠুক করে আড়তে গিয়ে বসেন।

কিন্তু তাও বেশি দিন পারলেন না। একদিনের ওলাওঠা জ্বরে বদনবাবুর স্ত্রী মারা গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বদনবাবু কেমন যেন হয়ে গেলেন। কান্নাকাটি করলেন না, হৈ হৈ করলেন না, কেবল কথা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলেন। তার পরে শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে গেলে হাজার খানেক টাকা নিয়ে চলে গেলেন কাশী। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালেন কিছুকাল। তারপর আবার কাশীতে বসলেন। সেখানে একটা বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বাস করতে লাগলেন। দেশে ফিরলেন প্রায় পাঁচ বৎসর পরে।

তখন আর সে বদনবাবু নন।

মাথায় বড় বড় চুল। সাদা সাদা দাড়ি নাভি পর্যন্ত ঝুলছে, পরনে রক্তাম্বর, কপালে ত্রিপুন্ড্রক। মুখে সর্বদা কালী কালী শব্দ। বৈষ্ণব বদনবাবু শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছেন। সেই বিনীত, শান্ত প্রকৃতি আর নেই, কারণ-বারি পানে চোখ সর্বদা রক্তবর্ণ। কণ্ঠস্বরে একটা ভীষণ এসেছে। এখন লোকে তাঁর কাছে যেতেই ভয় করে। বদনবাবু তেতলার ঘরে নিরিবিলি থাকেন, আর ধ্যানধারণা করেন। পুত্র-বধূ নাতি-নাতনী কারও সঙ্গে বড়-একটা কথা বলেন না।

এমনি করে দিন পনের কাটানোর পর একদিন মহেন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন। এ কদিন তার সঙ্গে একটা কথাও হয়নি। মহেন্দ্রও বাবার রক্তচক্ষু আর রুক্ষ মেজাজ দেখে কাছে আসতে সাহস করেনি। ভয়ে ভয়ে এসে প্রণাম করে মেঝেতে এক পাশে চুপ করে বসল। একটা বাঘের চামড়ার উপর আসন করে বদনবাবু বসে ছিলেন। মহেন্দ্রকে দেখে একটু নড়ে বসতেই রুদ্রাক্ষের মালা খট-খট শব্দ করে উঠল।

একটুক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে পুত্রের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বদনবাবু বললেন, ‘পরশু গুরুদেব আসবেন।’

মহেন্দ্র ভয়ে-ভয়ে শুধু বললে, ‘ও।’

‘পাশের ঘরে তাঁর বাবার ব্যবস্থা করে দাও।’

‘যে আজ্ঞে।’

‘আর পরশু সন্ধেয় দশ হাজার টাকা চাই।’

‘বেশ!’

‘পূজোর দালান কি মেরামত করতে হবে?’

এবারে মহেন্দ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবার দিকে চাইলে। অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ‘না।’

‘মালাকারকে বলে দাও আগামী অমাবস্যায় ছিন্নমস্তার পুজো হবে। প্রতিমা গড়ে দিতে হবে।’

শুনে মহেন্দ্র মুখ হাঁ করে চেয়ে রইল। ছিন্নমস্তার পুজো! সে ভীষণ, তান্ত্রিক পুজো, গৃহস্থ কখনও সে পুজো করতে সাহস করে না, তাতে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়।

মহেন্দ্র অস্পষ্ট স্বরে শুধু একবার বললে, ‘ছিন্নমস্তার!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ ছিন্নমস্তার। তুমি এখন যাও; ভয় নেই, গুরুদেব নিজে আসবেন। পুজোও তিনি করবেন।’

বলে, বোধ হয় সাধনার জন্যে চোখ বন্ধ করলেন।

মহেন্দ্র আর কিছু বলতে সাহস না করে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল।

গুরুদেব নিজে অবশ্য এসেছিলেন। পুজোও তিনিই করেছিলেন। অমাবস্যার অন্ধকার নিশুতি রাত্রে সে এক ভীষণ ব্যাপার। কিন্তু ‘ভয় নেই’ এ ভরসা বেশিদিন রইল না। গুরুদেব আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন, পুজো নির্বিঘ্নে সমাধা হয়েছে। মা হাসিমুখে পুজো গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি বিদায় নেবার দিন-পনের পরে মহেন্দ্রর বড় ছেলেটি বসন্তে আক্রান্ত হল এবং তিনদিন অশেষ কষ্টভোগের পর মারা গেল। তারপরে একসঙ্গে তার স্ত্রী আর মেজ ছেলে পড়ল। বহু চেষ্টা করেও তাদের বাঁচানো গেল না। তারপর মহেন্দ্র নিজে আর তার শেষ সন্তান কোলের মেয়েটি ওই একই রোগে মারা গেল।

বদনবাবু নিঃশব্দে ধীরভাব তাঁর বংশের শেষ প্রদীপটিও নিবে যেতে দেখলেন। নিজে সকলের পিছ-পিছু শ্মশানে গেলেন, শ্মশান থেকে ফিরে এলেন। লোকে তাঁর মুখ দেখে ভাবলে, মানুষ এমন পাথরও হয়!

বাড়ির চাকর বাকর সব ইতিপূর্বেই বেগতিক দেখে পালিয়েছিল। কেবল একটি বুড়ো চাকর তখনও পর্যন্ত মমতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, সে-ই ছিল। বদনবাবু বাড়িতে আলো জ্বালতে দিলেন না। চাকরটাকে তাঁর ঘরে ডাকলেন। অন্ধকারে তার হাতে কি কতকগুলো কাগজ দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে যা দিলাম, তাতে দু-পুরুষ বসে খেতে পারবে, এবারে তোমার ছুটি।’

বুড়ো চাকর হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। কিন্তু বদনবাবু গম্ভীর কণ্ঠে তাকে এমন ধমক দিলেন যে সে পালাতে পথ পেল না। যাবার সময়ে সে বদনবাবুর লোহার সিন্দুক বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেল।

সে ভাবল, বাবুর মন খারাপ। হয়তো আবার কাশী কিংবা অন্য কোন তীর্থে চলে যাবেন। তাই তাকে বিদায় দিলেন। হয়তো সেই রাত্রেই যাবেন, কিংবা পরের দিন সকালে।

এই ভেবে পরের দিন সকালে বড়বাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে গেল। গিয়ে দেখে সদর দরজা বাইরে যেমন করে ভেজিয়ে রেখে এসেছিল তেমনি আছে। কেবল বোধহয় ঝড়ে আর-একটু ফাঁক হয়ে গেছে। তার ভরসা হল বদনবাবু এখনও তাহলে যাননি। পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দেখে অন্দরের দরজাও ভেজানো। বুড়ো সটান তেতলার ঘরে গিয়ে উঠল। আস্তে করে দরজায় একটু ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে যেয়ে তার বুকের স্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম।

বদনবাবু কড়িকাঠে ঝুলছেন!

তাঁর চোখ কপালে উঠেছে, জিভ বেরিয়ে এসেছে। তিনি রাত্রেই আত্মহত্যা করেছেন।

বুড়োর চিৎকারে পাড়ার লোক জড়ো হল। পাশেই থানা, পুলিশও এল। তারা লাশ নামিয়ে নিয়ে থানায় চলে গেল। এবং বাড়ির মালিক কে, স্থির না হওয়ায় বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর এবং আড়ত তালাবন্ধ করে সীলমোহর করে গেল। পাড়ার লোকে বলাবলি করতে লাগল, ‘এ ছিন্নমস্তার পুজোর ফল। মায়ের পুজোয় নিশ্চয়ই কোন বিঘ্ন ঘটেছে। বাবাঃ, ছিন্নমস্তার পুজো চারটিখানি কথা নয়! একটুখানি ক্রটি ঘটেছে কি বংশলোপ! আমরা তখনই বলেছিলাম!’

বাড়ি ওইরকমই রইল। বদনবাবুর উত্তরাধিকারীত্ব নিয়ে লম্বা মামলা বেধে গেল। সে মামলা একবার নিচের কোর্ট থেকে জজ কোর্ট, সেখান থেকে হাইকোর্টে যায়, আবার সেখান থেকে নিচের কোর্টে ফিরে আসে। তাঁতের মাকুর মত এমনিধারা সে ঘোরাঘুরি করতে লাগল।

ইত্যবসরে একটা কাণ্ড হল।

বাড়িটার উপর পাড়ার গুটিকয়েক বিখ্যাত চোরের চোখ পড়ল। বদনবাবুর ধনশালীতা কারও অবিদিত নেই। তাঁর টাকার প্রত্যেকটি পয়সা লোহার সিন্দুকে থাকত। মফস্বলে ব্যাঙ্কে টাকা রাখার প্রধা নেই। তারই থেকে হাজার-দুয়েক টাকা বুড়ো চাকরটা পেয়ে গেছে। বাকিটা ওরা পেলে আর ভবিষ্যতের ভাবনা কয়েক পুরুষের মধ্যেও ভাবতে হবে না।

এই না ভেবে একদিন রাত্রে ছ-জন চোর বদনবাবুর বাড়ি হানা দিলে। দু-জন রইল বাইরে ঘাঁটি আগলে, আর চারজন পাঁচিল টপকে ভিতরে গেল। ভয় তো কিছুই নেই। ভিতরে জনমানবের চিহ্ন নেই। যে ঘরে লোহার সিন্দুক সে ঘর চোরদের বিশেষ জানা। কিন্তু সে ঘরে ঢোকা যায় কী করে? পুলিশ এসে সব ঘর তালা-বন্ধ করে সীলমোহর করে দিয়ে গেছে। কী উপায় করা যায় এই ভেবে একজন অন্ধকারে দরজায় হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ কী আশ্চর্য, দরজা গেল খুলে। ঢোক, ঢোক, দুজন তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। আর দুজন ছুটল পাশের ঘরে। যে ঘরে মহেন্দ্র থাকত। সেই ঘরে আছে মহেন্দ্রের স্ত্রীর রাশি-রাশি গহনা। সে ঘরেও ঠিক তাই হল। হাত দেওয়া-মাত্র দ্বার খুলে গেল। দুজন ঢুকল তার মধ্যে। ঘরের মধ্যে ঢুকে ওরা মোমবাতি জ্বালল, পাছে কেউ দেখতে পায় বলে এতক্ষণে আলো জ্বালতে সাহস হল। বন্ধ ঘরে কোন ভয়ই নেই।

লোহার সিন্দুকে হাত দিতে সিন্দুক খুলে গেল। ও ঘরেও তাই। এ ঘরে লোহার সিন্দুকে টাকা, আধুলি, সিকি, দুয়ানি, আনি, পয়সা, আধলা থরে থরে সাজানো। একদিকে থাকে-থাকে নোট। ও ঘরে রাশি-রাশি সোনার আর জড়োয়ার গহনা যেন অনেকদিন পরে বাতির আলো দেখে হেসে উঠল। চোরেদের সে দৃশ্য দেখে আর চোখের পলক পড়ে না। তারা দু-হাতে যা ওঠে তোলে, আর আঁচল বোঝাই করে। ভারে আঁচল ছিঁড়ে পড়ে আর কি! অনেকক্ষণ পরে তারা কাজ সেরে যখন বার হতে যাবে, দেখে দরজা বন্ধ।

দরজা বন্ধ! আশ্চর্য!

ওরা এদিকে টানে, ওদিকে টানে, প্রাণপণে টানে, কিছুতেই কিছু না। দরজা কিছুতেই খোলে না।

এদিকে বাইরে যারা ঘাঁটি আগলে আছে তারা অপেক্ষা করছে তো করছেই। সঙ্গীরা আর কিছুতেই ফেরে না। একটা বাজে, দুটো বাজে, তিনটে বাজে…পাখিরা এক আধটা ঘুম ভেঙে হঠাৎ ডেকে ওঠে…শেয়াল শেষ প্রহরের ডাক ডেকে গেল…কিন্তু সঙ্গীরা আর ফেরে না। অথচ ধীরে ধীরে পুবদিকে আলো জাগছে, আর অপেক্ষা করাও চলে না। ওদের কেমন ভয় হল, সঙ্গীর মমতার চেয়ে প্রাণের মমতা বেশি। ওরা আরও একটু অপেক্ষা করে অবশেষে চুপিচুপি সরে পড়ল। ওদের বরাতে যা হবার তাই হোক।

কিন্তু সঙ্গীরা আর ফিরলই না।

চোরের পরিজনের ফুক্‌রে কাঁদার শক্তি নেই। দিনকয়েক তারা চেপে রইল। বোজ ভাবে আজ ফিরবে, আজ ফিরবে। অবশেষে ব্যাপারটা আর বেশিদিন গোপন রইল না। পাঁচ কান হতে হতে পুলিশের কানে পৌঁছল। পুলিশ এসে পাঁচিল টপ্‌কে বাড়ির ভিতর গিয়ে দেখে যেমন তালা, সীলমোহর তেমনি আছে। বাইরের চোর ঘরে ঢুকবে কী করে! তারা বিশ্বাসই করল না। তবে, পুলিশ সাহেবকে এই গুজবের কথাটা জানাল।

পুলিশ সাহেব দিনকয়েক পরে চাবি নিয়ে সদলবলে এসে উপস্থিত হলেন। বিশ্বাস তাঁরও হল না। তবু তালা খুলে দেখেন, ঠিক, এ-ঘরে দুটো, ও-ঘরে দুটো কঙ্কাল পড়ে রয়েছে বটে। তিনি তো অবাক! কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়! ব্যাপারটা হয়তো ভৌতিক।

ভৌতিক ব্যাপারে পুলিশ সাহেবের আগ্রহ অপরিসীম। তিনি স্থির করলেন, কয়েকটা রাত্রি এখানে কাটিয়ে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে হচ্ছে। সন্ধের পরে বাড়ির বাইরে, ভিতরে, প্রত্যেক গলিতে গলিতে সশস্ত্র পাহারা রাখলেন। আর নিজে দুটো গুলি-ভরা রিভলভার নিয়ে বসে রইলেন—লোহার সিন্দুকের ঘরে। সঙ্গে রইল বাঘা-বাঘা দুটো বিলিতি কুকুর।

বারোটা বাজল।

কোথাও জনমানবের সাড়া শব্দ নেই। বাইরে ফুটফুট করছে চাঁদের আলো। গাছের নিচে ঝোপে অন্ধকার জমে জমে আছে। কোথাও পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে যেন মাটিতে আলপনা কাটছে। হাওয়ায় পাতা নড়ছে শিরশির করে। চাঁদনি রাত্রি, তবু বাইরেটা থমথম করছে। ভিতরে একটা দেওয়ালগিরি জ্বলছে।

সাড়ে বারোটা…একটা…

হঠাৎ হু-হু একটি দমকা হাওয়া এসে দপ করে দেওয়ালগিরি নিবিয়ে দিলে। সে তো হাওয়া নয়, কে যেন হা-হা করে সেই আধো-অন্ধকারে হেসে উঠল।

সাহেব দুটো রিভলভার দু-হাতে ধরে সতর্ক হয়ে বসে রইলেন।

আলো জ্বালার প্রয়োজন হল না। খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘর আলো করে দিলে। তখনও মৃদু মৃদু বাতাস বইছে, যেন বাইরে কার কাপড়ের খসখসানি, আর কিছু নয়। আরও আধ ঘণ্টা এমনি কাটল।

হঠাৎ ঘরের যে প্রান্তে সাহেব রিভলভার নিয়ে বসে ছিলেন, তার অপর প্রান্তে বারান্দার দিকের জানলাটা খরখর করে নড়ে উঠল। দুটো কুকুরই ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে একটি শুভ্রবসনাবৃত মূর্তি ওই জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে। সাহেব গুলি ছুঁড়লেন, কুকুর দুটো তেড়ে গেল। মূর্তি অন্য জানলার ফাঁক দিয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে গেল, একটা কুকুরও সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু পিছু জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। অথচ গরাদের ফাঁক তিন আঙুলের বেশি নয়। তার মধ্যে অত বড় একটা কুকুর যে কী করে অনায়াসে গলে যেতে পারে তা মানুষের কল্পনার অতীত।

সাহেবের কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। কণ্ঠ শুষ্ক। সাহেব বোতল থেকে মদ ঢেলে এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে সবটা খেয়ে ফেললেন। আর তাঁর সঙ্গের কুকুরটির আর্তনাদে ঘর যেন ফেটে যাবার উপক্রম। অথচ আশ্চর্য এই যে, এত কাণ্ডেও বাইরের সশস্ত্র সিপাইদের কেউ এসে জুটল না। তাদের যেন এ শব্দ কানে পৌঁছয়নি।

সাহেব এবার স্থির হয়ে বসলেন। এবার যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়। দেওয়ালগিরিটাও জ্বাললেন। সিপাইদের কাকেও ইচ্ছা করেই ডাকলেন না। পাছে তারা ভাবে সাহেব ভয় পেয়েছেন।

কিন্তু আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আধঘণ্টার উপর কেটে গেল। শিকারী যেমন শিকারের জন্য ছটফট করে, সাহেবও তেমনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। অবশেষে হতাশ হয়ে রিভলভার নামিয়ে বোতল বের করে আর একটু মদ ঢেলে খেতে যাবেন, এমন সময়ে জানলাটা আবার খরখর করে উঠল।

সাহেব তাড়াতাড়ি বোতল নামিয়ে রিভলবার তুলে নিলেন। কে যেন হুড়মুড় করে আলোর উপর পড়ে আলো নিবিয়ে দিলে। কুকুরটা চিৎকার করে যেন কাকে ধরতে জানলার দিকে ছুটে গেল। সাহেব উপরি-উপরি গুলি ছুঁড়লেন। ফল কী যে হল কিছু বোঝা গেল না। কেবল দূর থেকে যেন সাহেবের প্রিয় কুকুরটির ক্ষীণ আর্তনাদ কানে ভেসে এল।

ধোঁয়ার অন্ধকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। জানলার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো ঘরের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল। সাহেব বিস্ফারিত নেত্রে দেখলেন, ঘরে জনপ্রাণী নেই, মূর্তি না, কুকুর না, কেউ না। শুধু ঘরের দেয়ালগুলো থর থর করে কাঁপছে।

তারপর মেঝের উপরকার চাঁদের আলো ক্ষীণতর হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে…কি যেন একখানা কালো যবনিকা চাঁদকে দিলে ঢেকে…চরাচর ব্যাপ্ত করে একটা জমাট অন্ধকার সাহেবের চারিদিকে ঢেউয়ের মত দুলতে দুলতে ফিরে এল…

তারপর আর কিছু মনে নেই…

পরদিন সকালে সিপাইরা এসে দেখল, সাহেব মেঝের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর দুই পাশে দুটো রিভলভার পড়ে রয়েছে। কুকুর দুটোও নেই। আর দেওয়ালের এখানে ওখানে গুলির দাগ। অথচ আশ্চর্য এই যে, ওরা বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ কিংবা অন্য কোন শব্দ শুনতে পায়নি। কিন্তু গুলি যে ছোড়া হয়েছে সে বিষয়েও কোন ভুল নেই। দেওয়ালে গুলির চিহ্ন আছে, রিভলভারেও গুলি কম। আর কুকুর দুটোই বা গেল কোথায়?

বহু কষ্টে তারা সাহেবের চৈতন্য সম্পাদন করলে। সমস্ত বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জনপ্রাণীর চিহ্ন মিলল না। কেবল জানলার নিচে যে বাগান, সেই বাগানে কুকুর দুটো মরে পড়ে আছে। মানুষ যেমন করে গামছা নিংড়োয়, তেমনি করে তাদের যেন কে নিংড়ে দিয়েছে। তাতে আর রক্ত বলতে কিছু নেই।

এই কাণ্ড ঘটেছিল আজ থেকে অনেক কাল আগে। এ কাণ্ডের কর্তা কে, কী করেই বা ঘটল, তার অর্থ আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোকে ভৌতিক বলে এক কথায় এর মীমাংসা করে দিয়েছে। কিন্তু যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, তারা কী করে এ সমস্যার সমাধান করবে জানি না।

বদনবাবুর বাড়ি আজ শ্রীহীন, ভগ্নদশা। তার দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। কড়িকাঠ খসে ঝুলছে। স্থানে স্থানে ইটের স্তূপ হয়েছে। মাঝে মাঝে আগাছার জঙ্গল। যারা এই বাড়ির উত্তরাধিকারীত্ব নিয়ে মামলা করছিল, সাহেবের কাণ্ডের পর তারা আর কেউ এ সম্পত্তির মালিক হতে রাজী হয়নি। এ বাড়ি এখন বেওয়ারিস অবস্থায় পড়ে। সন্ধের পর আর কেউ বাড়ির ধার দিয়ে যায় না। বাড়ির একখানা ইট কেউ ছোঁয় না। এখন অবশ্য আর কিছু দেখা যায় না বটে কিন্তু কেউ কেউ বলেন, অমাবস্যার নিশুতি রাত্রে বাড়ির চারিদিকে কে কেঁদে কেঁদে বেড়ায়। কে কাঁদে কেউ জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *