বড় সাধ ছিল
কার না ইচ্ছা করে বেশ একটু খেলিয়ে, কালোয়াতি করে বাঁচতে! যেমন নিজের ছোট হলেও, ছিমছিম মাথা গোঁজার মতো একটা আস্তানা। না হয় কাঁচাই হল। বাবুই পাখির মতো চড়াইদের বলব—কাঁচা হোক, তবু ভাই নিজেরই বাসা। চারপাশে আর তিন ঘর ভাড়াটের মধ্যে স্যান্ডউইচ মেরে থাকতে হয় না। রোজ প্রত:কালে কমন বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে লেবার পেনের রমণীর মতো ডেলিভারি প্রায় হয়ে গেল বলে ছটফট করতে হয় না। নিজের মালিকানার বাথরুম। সাহস করে যা তা খাওয়া যায়, যখন খুশি ঢোকা যায়। পেঁয়াজি খেতে পারি, কাঁঠাল খেতে পারি, ছোলার ডাল, লুচি। সব সময় দরজা জানালার পরদা ঝোলাতে হয় না বেআব্রু হওয়ার ভয়ে। মাঝরাতে পাশের ঘরে বিড়ি ফোঁকা করে কেউ দমকা কাশি কাশবে না। বউ পেটানোর নাকি কান্না শুনতে হবে না। শাশুড়ি বউয়ের চুলোচুলির নীরব সাক্ষী হতে হবে না। নিজের বাড়ি, লাল মেঝে। দক্ষিণ খোলা শোয়ার ঘর। একটা ইংলিশ স্টাইলের খাট। টানটান বিছানা। কমলা রঙের পরদা। জানালার কাছে টেবিল। একটা মনোরম বসার ঘর। এক চিলতে কার্পেট। কাচ লাগানো সেন্টার টেবিল। হালকা ধরনের গোটা তিনেক সোফা। একটা বুককেস। মনের মতো শ’দুয়েক বই। ছোট একটা শোকেসে কিছু পুতুল। গোটা-দুই কফি মাগ। একটার গায়ে লেখা, মর্নিং কিস। আর একটার গায়ে লেট নাইট অ্যাফেয়ার। সবই অপ্রয়োজনীয় শোভা।
পাহারাদারের মতো খাড়া একটা টেবিল ল্যাম্প, মাথায় তার তুর্কি টুপি।
ছোট কিন্তু আধুনিক একটা রান্নাঘর। খোপে খোপে সুন্দর করে সাজানো এক মাপের সব কৌটো। কৌটোর গায়ে লেবেল মারা। চা, চিনি, সুজি, পোস্ত, আটা, ময়দা, নুন। একটা ‘অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস’ গ্যাসবার্নার। মহাদেবের মতো সাদা অকুণ্ঠ গ্যাস সিলিন্ডার। ছাই-ছাই রঙের মৃদু গীতগায়ী সদাশীতল সুগৃহিণীর মতো একটা রেফ্রিজারেটর। অভ্যন্তর ভাগে যাবতীয় সুখাদ্য। দরজাটি খোলামাত্রই হিমালয়। তপস্বীর মতো একপাত্র রসগোল্লা, জমাট সমাধিমগ্ন দধি, ব্রহ্মলীন এক ডজন কুক্কুটি আন্ডা। স্নেহশীতল একখণ্ড মাখন। জ্যেষ্ঠ চিত্রকরের আঁকা আপেলের মতো একদল কাশ্মীরি তরুণী আপেল। ত্বক-যৌবনা মুসুম্বি গুটিকয়। সুখ ও সমৃদ্ধির শিশিরমণ্ডিত একটি ছবি।
কোথাও একটি মূল্যাবান ক্যাসেট রেকর্ডার ও প্লেয়ার আত্মগোপন করে থাকবে, সুমধুর যার কণ্ঠস্বর। উচ্চকিত কর্কশ নির্ঘোষে যা শ্রোতাকে পালাই পালাই ডাক ছাড়ায় না। সেই যন্ত্রে কখনও ধ্বনিত হবে সুমধুর জলতরঙ্গ, চপলচরণ সেতার, স্বর্গীয় কণ্ঠসঙ্গীত। ভজনানন্দে মাতোয়ারা হবে পরিবার-পরিজন।
সুতৃপ্ত মার্জার যেমন মিউমিউ করে না, ঘোঁড় ঘোঁড় শব্দ করে, সেইরকম অতিতৃপ্ত সুপুষ্ট স্ত্রী, মৃদুভাষী। আপন মনে থাকলে যার কণ্ঠে মধুমাতাল ভ্রমরের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত গুঞ্জরিত হয়। ঘর থেকে ঘরে যে ঘুরে বেড়ায় নর্তকীর ছন্দে। যার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় দেখছি ফোটা কুসুম। যার ললাটের বৃত্তাকার টিপে ভোরের সূর্যোদয়। যার সুমিষ্ট হ্যাঁগো, শুনছ, ডাকে রসমালাইয়ের আস্বাদন।
আউন্সে মাপা সন্তান-সন্ততি। পরিমিত মদ্যপানের মতো। একটি পেগ, বড়জোর দুটি। তিনটি কদাচিত নয়। একটি ছেলে একটি মেয়ে। তারা মাধ্যমিকে সাতটা লেটার পাবে। উচ্চমাধ্যমিকেও অনুরূপ রেকর্ড অম্লান থাকবে। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে সব ক’টায় চান্স পাবে, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং। হাটে, ঘাটে, মাঠে, বাজারে ট্রামে, বাসে, ট্রেনে জনেজনে সেই অসীম সাফল্যের কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ব। লোকে আমায় হিংসে করবে। ফিসফিস করে বলবে, লোকটা একটা ভাগ্য করে এসেছিল বটে। ট্রামে, বাসে লোকে আমাকে সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দেবে। আরে, বসুন বসুন। মহিলা হলে বলত, আপনি মা, রত্নাগর্ভা। আমি পুরুষ, আমাকে বলবে, পিতা স্বর্গ। স্বর্গীয় পিতা আপনি। আপনার কি দাঁড়ানো উচিত? অফিসে আমার বস আমাকে সমীহ করতে শুরু করবেন। আর গরু ছাগলের মতো ব্যবহার করবেন না। ঘরে ঢুকলে টেবিলের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাড়া করে রাখবেন না। ঢোকা মাত্রই বলবেন, আরে, আসুন, বসুন। ভালো আছেন তো! মিসেস ভালো আছেন। ছেলেকে কোথায় দিলেন? আই আই টি! শিবপুর! মেডিকেল কলেজ! ছেলেকে কি আপনি নিজে পড়াতেন! আই সি! তাই বলুন! নিজে না দেখলে ওইরকম ব্রিলিয়েন্ট রেজাল্ট হয়! চাকরিই আমাদের কাল। কেরিয়ায় কেরিয়ার করে, ছেলেমেয়ের লাইফটাই নষ্ট হল। মেয়েকে কোথায় দিলেন! প্রেসিডেন্সি! তা তো হবেই। অত লেটার পেলে প্রেসিডেন্সি ছাড়া যাবে কোথায়! আমার মেয়েটা আর পনেরোটা নম্বর বেশি পেলে একটা ভালো কলেজে চেষ্টা করা যেত। এ যা হল কোনও কলেজে অ্যাডমিশান পাবে না। আর কী হবে! সর্বক্ষণ টিভির সামনে বসে থাকলে পরীক্ষায় গোল্লাই পেতে হয়। আর এক সর্বনাশের আমদানি হয়েছে। স্টার টিভি, কেবল টিভি। বস ইকোয়াল স্ট্যাটাস না হলে চা অফার করে না। আমাকে চা খাওয়াবেন। দু-চারটে সংসারের কথা বলবেন। বলবেন, আপনার একটা প্রাোমেশনের কথা ভাবছি। একই পোস্টে অনেক দিন পড়ে আছেন। এটা ঠিক নয়। স্ট্যাগনেশান মিন্স ফ্রাসট্রেশান। আমাদের ডিভিশানাল অফিসে আপনাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছি।
এক ছেলে আর এক মেয়েই আমার ভাগ্যের দরজা খুলে দেবে। ছেলে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে; কিন্তু ড্রাগঅ্যাডিক্ট হবে না। মেয়ে প্রেম করবে এমন একটা ছেলের সঙ্গে যার ব্রাইট ফিউচার। ভীষণ উদার, বিনাপণে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজে আমার আপত্তি নেই। আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডে হাত পড়বে না। জামাই আমেরিকায় বসবাস করবে। শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের খরচে সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাবে। বছরে একবার দেশে আসবে। আমার জন্য ব্লেড আনবে। আফটার সেভ লোশান আনবে। সাবান, সেন্ট আনবে। ইলেক্টনিক গুডস আনবে। স্যুটপিস আনবে। চকোলেট, লজেন্স আনবে। আমি গন্ধগোকুল হয়ে ঘুরে বেড়াব।
আমার ছেলে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়ে বেরিয়ে আসবে। বেরোনো মাত্রই একটা ভীষণ ভালো চাকরি তাকে বোয়াল মাছের মতো গপ করে গিলে ফেলবে। বিরাট অঙ্কের মাইনে। অতবড় একটা চাকরি পেয়েও আমার ছেলের মাথা ঘুরে যাবে না। সে আমার নেওটাই থাকবে। আমার পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজই করবে না। স্কুলে পড়ার সময় সে যেরকম ছিল তখনও সে সেইরকমই থাকবে। আমরাই ভালো সম্বন্ধ করে তার বিয়ে দেব। সুন্দরী, শিক্ষিতা, গৃহকর্মে সুনিপুণা। কিন্তু অহঙ্কারী নয়। উদ্ধত, মুখরা নয়। শ্বশুর-শাশুড়িকে শৃগাল জ্ঞান করে না। বাবা, বলে কাঁধের পাশে এসে শীতল ছায়ার মতো দাঁড়াবে। শিশুর মতো সরল, কিন্তু সাংঘাতিক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। আমার ছেলে তার রোজগারের সমস্ত টাকা আমার হাতে দিয়ে বলবে, এই নাও। সংসারটাকে তুমি কন্ট্রোল করো। তুমি যেভাবে চালাবে সেইভাবেই আমরা চলব। তুমি হলে আমাদের কাণ্ডারী, আমাদের ভাণ্ডারী। হেড অফ দি ফ্যামিলি।
এইভাবে আমার বয়েস বেড়ে যাবে। বৃদ্ধ কিন্তু স্থবির নই। অনেক বছর চাকরি করেছি। সংসার বলবে, এইবার তুমি আরাম করো। দোতলার দক্ষিণ খোলা সবচেয়ে ভালো ঘরটা আমার। ঝকঝকে খাট, ধবধবে বিছানা। সকালে ব্রেকফাস্ট, সুগন্ধী চা, পরিমিত ভ্রমণ, সবক’টা খবরের কাগজ পাঠ। বারোটার মধ্যে সুষম আহার। সামান্য দিবানিদ্রা। বৈকালিক আড্ডা। সন্ধ্যায় টিভি দর্শন। পরিবার পরিজনের সঙ্গে রসালাপ। অন্তে নীল মশারিতে শয়ন।
জানি এসব কিছুই হবে না। অন্তে চিতায় শয়ন।