বড় মানিক ছোট মানিক
এই গাঁয়ে দুই মানিক। একজন থাকে পুব দিকে, অন্যজন পশ্চিমে। উত্তরে মাঠ। মাঠ পেরিয়ে ঘাট। ঘাট মানে নদী। নদী পেরিয়ে আর এক গাঁ। আর দক্ষিণে জঙ্গল। সেই জঙ্গলে বাঘ আছে কেউ বলে। কেউ বলে বাঘ নয় গুলবাঘা। বাঘের মতোই বটে, তবে মানুষ দেখলে লুকোয়, হাঁস মুরগী টানে গেরস্তের ঘর থেকে। গুলবাঘা কেউ দেখেছে, কেউ দ্যাখেনি। যারা দেখেছে, বেশিরভাগই তাদের লেজ। মানে পালাচ্ছে। একজন দেখেছিল নাকি খুব ভোরবেলায়,সে গুণধর। গুণধর বলেছিল, তাকে দেখে নাকি কেঁদে ফেলেছিল গুলবাঘা। তারপরই দৌড় উলটো দিকে। যতক্ষণ দেখা গেল, সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।
শুনে এক মানিক,বড় মানকে,যে থাকে পুব দিকে,সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কাঁদছিলে ভয়ে?
আমি না সে, বোধকরি বনের ভিতরে ঢুকে তার কান্না থেমেছিল।
ছোট মানকে মানে পশ্চিমে থাকে যে মানিক সে বলেছিল, সে কি তোমার দিকে তাকিয়ে পিছন পানে ছুটেছিল?
গুণধর রেগে গিয়েছিল, কিন্তু সে কি হেরে যাবার পাত্র বলেছিল, তাইই প্রায়, একবার কিছুটা যায়, আর ঘুরে তাকায় জলভরা চোখে।
বড় মানকে তখন বলেছিল, কেন তাকায়?
হে হে করে হাসে দুই মানকে, তারপর বলে, ভয়ে ফিরে তাকায়?
হ্যাঁ তাইই তাকিয়ে দেখছিল বারে বারে, ভীতু বাঘা। গুণধর বলেছিল।
বড় মানকে বলল, না তোকে চিনে নেওয়ার জন্য ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল।
গুণধর একটু ঘাবড়ে যায়। আসলে সে নিজেই খুব ভীতু মানুষ। কিন্তু দেখায় খুব সাহসী। গুলবাঘা সে দেখেছে কি দ্যাখেনি, তা সে নিজেই জানে না। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে দেখেছে। কেমন দেখেছে না অমনি দেখেছে। লেজ নয় মুখ। কান্নাভরা চোখে সে ফিরে ফিরে দেখছিল। কিন্তু দুই মানকে,বড় মানিক আর ছোট মানিক বলছে, না সে চিনে নিয়েছে গুণধরকে। দেখে নেবে।
গুণধর আমতা আমতা গলায় জিজ্ঞেস করল, দেখে নেবে মানে?
তোকে দেখে নেবে গুলবাঘা। বলল বড় মানকে।
এ কথার মানে কী ?
সাবধানে চলিস ফিরিস, গুলবাঘা ধরবে তোকে।
গুণধর বলল, কেন আমি কী করলাম?
সে তুই জানিস।
গুণধর চুপ করে পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে তাকায়। ইস! কেন যে সে গুল দিতে গেল বাঘা নিয়ে। এখন সত্যিই তো ভয় করছে। গুলবাঘা ফিরে ফিরে তাকাবে কেন? নিশ্চয় তাকে চিনে রাখতে। চিনে রাখবে কেন? নিশ্চয় তাকে দেখে নেবে। মানে তার ঘাড়ে থাবা বসাবে অতর্কিতে। কিন্তু গুলবাঘা কি সত্যিই দেখেছে সে? নাকি গুলবাঘা তাকে দেখেছে ঘুরে ঘুরে? সে তো বানিয়ে বলেছে। বানিয়ে বলা তার অভ্যেস। ভীতু গুণধর বুঝতে পারছিল না সে বানিয়ে বলেছে না সত্যিই ঘটনাটা ঘটেছিল ভোরবেলায়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তখন আলো ফুটে গেছে। গরমে তো সাড়ে চারটেয় ফুটে যায় আলো। তাদের হাঁসের ঘরে হাঁসের ঘুম ভেঙেছে তখন। তার মনে হয়েছিল গুলবাঘা এসে থাকতে পারে। না কি সত্যিই এসেছিল বাঘের ছা। গুলবাঘা কিংবা ঝিঙেফুল বাঘ। গায়ে ফুল ফুল ছাপ। সাইজে ছোট। বাঘের বাচ্চা যেন। গুণধর আর ভোরে উঠবে না। কিন্তু তার তো ইস্কুল আছে। ক্লাস নাইন। ইস্কুলে বড় মানকে ক্লাস টেন। ছোট মানকে এইট। গুলবাঘা নিয়ে গুল মারায় ইস্কুলে রটে গেছে গুলবাঘা আসছে তাকে ধরতে। একা পেলেই ধরবে। বড় আর ছোট মানকে খুব সাহসী। রাতে শ্মশানে যেতেও তাদের ভয় নেই। বড় মানকে তো এর ভিতরেই দশটা শবদাহনে গেছে। ছোট মানকের দাদু মারা গেলে সারা রাত শ্মশানে ছিল। তার সাহসের কোনো তুলনা হয় না। গয়ে গুলবাঘা অয়ে অজগর, ভয়ে ভূত আর পয়ে পেত্নি কোনোটাতেই তার ভয় নেই। আর তার সঙ্গে আগানে বাগানে ঘুরে ঘুরে ছোটমানকেরও ভয়ডর কমে যাচ্ছে। ভয় বলতে একমাত্র চারুবাবু স্যার। অঙ্ক কষতে না পারলে, মধু মোড়া। দুই আঙুলের ভিতর পেনসিল ঢুকিয়ে আচ্ছা মোড়া। কিন্তু এতে বড় মানকের কিছু হয় না। সহ্য শক্তি খুব। ছোট আবার অঙ্ক ভালই পারে।
বোঝা গেল, কিন্তু তারপর কী হলো?
তারপর? ইস্কুল থেকে ফেরার সময় বড় মানকে বলল, এই তুই ঢিল মেরেছিলি গুলবাঘারে?
কে বলল? গুণধর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
জঙ্গলে রটে গেছে। ছোট মানকে বলল।
গুণধর জিজ্ঞেস করল, কে বলল?
কে আবার, গুলবাঘায়।
না তো। গুণধর বলে।
না বললে হবে, বনের সবাই জেনে গেছে ক্লাস নাইনের গুণধর ঢিল মেরেছে নিরীহ গুলবাঘারে, তারা শোধ নেবে, খুব সাবধান।
ছোট মানকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করে জানলে মানকেদা?
বড় মানকে বলল, বনে গিয়েছিলাম, প্রথমে বলল এক শজারু, তারপর বনবিড়াল, শেষে গুলবাঘা নিজেই।
গুণধর বলে, তুমি কী করে বুঝলে তারা কী বলছে, তারা কি কথা বলতেপারে?
গুণধরের প্রশ্ন কেমন নিরীহ মুখে সমর্থন জানায় ছোট মানকে, হ্যাঁ গো কী করে বুঝলে জন্তুর কথা, তারা কি মানুষের মতো কথা বলতে পারে?
বড় মানকে বলল,ময়না বলেছে,মানে শজারু, বনবিড়াল আর গুলবাঘার কথা ময়না টানসেশন করে বুঝিয়ে দিল, গুলবাঘার খুব লেগেছিল তাই চোখে জল এসে গিয়েছিল, চোখ মুছতে দাঁড়ায় আর পেছনে তাকায়, গুণ তুই সত্যি কথাই বলেছিলি।
গুণধর বলল, আমি তো ঢিল ছুড়িনি।
তুই খুব মিথ্যে কথা বলিস, তোর খুব বিপদ।
গুণধর বলল, আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।
তাহলে গুলবাঘা কি মিথ্যে বলেছে?
গুণধর বলল, তা আমি জানি না, কিন্তু আমি ঢিল ছুড়িনি।
কিন্তু ইস্কুলে রটে গেল গুণধর কী করেছে। ঢিল মেরে গুলবাঘার পা ভেঙে দিয়েছে। তবে সেরেও উঠছে সে। বনের ভিতরে কবরেজি গাছ আছে। গুলবাঘা সেই গাছের পাতা পায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে ডালিম গাছের নিচে। ব্যথা কমছে। উঠল বলে। উঠে বন থেকে বেরোল বলে। বেরিয়ে গুণধরকে ধরল বলে। ধরে নিয়ে যাবে বনের ভিতর। বিচার হবেই হবে। গুলবাঘা খুব শান্ত প্রাণী। সাতে পাঁচে নয়ে ছয়ে থাকে না, শুধু খিদে পেলে বাইরে এসে হাঁসটা মুরগিটা নিয়ে যায়। তাকে ঢিল মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?
এই যে বললে পা?
তুই বল না পা না মাথা? বড় মানকে বলল।
গুণধর বলল, আমি মারিনি।
মেরেছিস কি মারিসনি সে গুলবাঘাই বলবে। বড় মানকে বলল, তোর খুব বিপদ।
হুম, তারপর কী হলো?
কী আবার হবে। গুণধরের ঘুম, গেল। স্বপ্ন দেখল, গুলবাঘা ওই এল। গুলবাঘা নয় শুধু ঝিঙে ফুল বাঘাও এল বুঝি। ঝিঙে ফুল বাঘা কেন শজারু, বনবিড়াল সব সারারাত্তির তার ঘরের বাইরে এসে গরম নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল, গুণধর বেরোক, দেখে নেবে। বনের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিচার করে জেলে ভরে দেবে। পাতা আর কাঁটা দিয়ে ঘেরা জেলখানা। বেরোতে গেলেই কাঁটায় আঁটকে যাবে। ওই জেলখানা থেকে কেউ বেরোতে পারে না। ওখানে যাওয়া মানেই যাবজ্জীবন।
এসব কথা কে বলল? না সেই বড় মানকে ছোট মানকে। তারা সব খোঁজ রাখে। গুণধরের মনে হয় সব মিথ্যে। সে নিজে যেমন বানিয়ে বলে ফেঁসে গেছে, রাতের ঘুম গেছে তার, তেমনি ওরাও ওইসব বলেছে বানিয়ে, কিন্তু ফাঁসেনি। মনের আনন্দে ঘুমোচ্ছে, ঘুরছে ফিরছে। ওদের ভয়ডর নেই। গুণধরের ভয় খুব। এমনি ভয় নিয়ে চলছিল। প্রত্যেকদিন ইস্কুলে নিজের টিফিনের ভাগ দিতে হয় একদিন ছোটকে, আর একদিন বড়কে। নিজের জন্য থাকে একটুখানি হালুয়া, এক পিস রুটি আর আধখানা সন্দেশ। কোনোদিন পুরো সন্দেশটাই বড় খেয়ে নেয়, শোন ময়নাকে আমি ফিট করেছি, সে বনের খবর নিয়ে আসে, সবদিন মিটিং চলছে, ওরা সন্ধে হলেই বেরিয়ে পড়বে যে কোনোদিন, দে সন্দেশটা দে, তুই কলা খা, জঙ্গলে কলা, আতা, নোনা, শাঁকালু… এই সব খেতে হবে তোকে।
হুঁ। গুণধর বলল, কাল থেকে আর সন্দেশ আনব না, কলা পেয়ারা, শসা, পেপে…।
না না না, আমি তো ওসব পছন্দ করি না, তুই বরং সন্দেশ, মুগের নাড়ু, বালুসাই, ক্ষীরকদম নিয়ে আসিস, ফল বলতে শাঁকালু ছাড়া আর কিছু না, বাকি ফল বনে গিয়ে খাবি।
গুণধর খুব রেগে যাচ্ছিল কিন্তু তার কিছু করার নেই। সে ভীতু আর বোকা। আর বানিয়ে কথা বলে। বলতে তার ভালোও লাগে। একবার তো বলেছিল জঙ্গল থেকে একটা হাতি এসেছিল। হাতি তাকে দেখে হাঁটু গেড়ে নমস্কার করে আবার বনে ফিরে গিয়েছে জঙ্গলের ভিতর। বসিরহাটে এক সার্কাস এসেছিল,তাতে হাতিকে সে দেখেছিল অমনি নমস্কার করতে। সেইটা সে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিল। বড় মানকে সার্কাস দ্যাখেনি বসিরহাটে গিয়ে। তার তখন ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছিল।জ্বর ছাড়ে আর ধরে। ছোট যায়নি দেখতে, বড় জ্বরে বিছানায় পড়ে থাকলে সে যায় কী করে? গুণধরের গুলবাজিতে খুব রেগে গিয়েছিল দুই মানকে। কিন্তু কিছু করতে পারেনি। ম্যালেরিয়া ছিল যে। এইবার গুণধরকে বাগে পেয়েছে। ছাড়বে না। গুণধর না গুলধর। গুলবাঘা তোকে টেনে নিয়ে যাবে জঙ্গলের ভিতরে। বিচার হবে। যাবজ্জীবন হবে। শুধু মানকে ঠেকিয়ে রেখেছে ময়না পাখিকে বলে। সন্দেশ আর রসকদম আনতেই হবে।
গুণধর গোঁয়ার গোবিন্দ। সে ঢিল ছোড়েনি, গুলবাঘাও দ্যাখেনি তবু তার বিচার হবে। গুল মারার বিচার। কিন্তু গুল তো দুই মানকেও বলে। তাদের তো বিচার হয় না। টিফিনের ভাগ দিতে হয় না।
বোঝা গেল। এখন কী উপায়?
পরদিন গুণধর টিফিন বাক্স ধরে দিয়ে দিল কাঁদো কাঁদো মুখে। রাত্তিরে দুই বাঘা আর বনবিড়াল তার জানলার পাশে ফোঁস ফোঁস করছিল আর তাকে হুমকি মারছিল, আয় বেরিয়ে আয়, তোর মুণ্ডু চিবিয়ে খাব, মানকেদা বাঁচাও।
কী টিফিন এনেছিস দেখি।
গোটা বাক্স ধরে দিয়ে দিল গুণধর। আর চোখ মুছতে লাগল। সন্দেশ আর রসকদম আর শাঁকালু। বাহ বাহ। আগে ফল পরে মিষ্টি। বনে রাঙা আলুও খেতে দেবে বিচারের সময়। শাঁকালুও। বনের শাঁকালু খুব ভালো। খুব টেস!গুণধরকে চোখের জলে ভাসিয়ে শাঁকালুতে কামড় দিল দুই মানকে। এক কামড়ে অনেকটা ভিতরে নিয়ে কচর মচর, মচর কচর…ওরে বাপরে এ কী শাঁকালু? বুনো কচু কেটেকুটে শাঁকালু সাজিয়ে নিয়ে এসেছে গুণধর। আর তা খেয়ে নাচতে আরম্ভ করেছে দুই মানিক। বড় মানিক আর ছোট মানিক। গুণধর কাঁদতে কাঁদতে বলছে, বাঘারা দিয়ে গেছে তোমাদের জন্য, তাই দিয়েছি, বলের আলু।
সেই যে বুনো কচু খেয়েছে দুই মানিক। সাতদিন লাগল গাল চুলকানি বন্ধ হতে আর ফুলো কমতে। গুণধরকে দেখলে তারা মুখ ঢাকে দুই হাতে। অন্য রাস্তায় যায়।