1 of 2

বড় ঘর – নেপাল মুখোপাধ্যায়

বড় ঘর – নেপাল মুখোপাধ্যায়

তারপর অনেকদিন চলে গেল। একদিন অনেক রাত্রে একজোড়া নূপুরের শব্দে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। মনে হল, বিবিঘর থেকে শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি আর থাকতে পারলাম না। আস্তে-আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর খিলটা খুলে অন্ধকার বাগানের দিকে চেয়ে রইলাম। সেই যেখানে চোরকুঠুরি আছে। যার চাতালে আমি প্রথম আপনাকে দেখি। মনে পড়েছে? আপনি আমাকে দেখে মাথাটা নিচু করে ফেললেন আর রানিমা খানিকটা ঠাট্টা করতে কসুর করলেন না। ঠিক সেই চাতালের ওপরে একটা আলো এ-পাশ থেকে ও-পাশ পায়চারি করছিল। সমস্ত শরীরটা আমার দুলে উঠল। আগ্নেয় আলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিথর অন্ধকারে দৃষ্টিটা ছুড়ে মারলাম। মুঠো-মুঠো ঘন কালো বাতাস আমার মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেল। আবছা গাছের পাতাগুলো অন্ধ-কারের চাদরে কুঁকড়ে রইল আর শিশিরের কান্না ঝরল ডালে-ডালে। কতক্ষণ আমি চেয়েছিলাম জানি না। কিন্তু পায়চারি-করা আলো হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। নূপুরের শব্দ থেমে গেল।

বিশ্বম্ভরবাবু ডাকলেন : নায়েবমশাই! নায়েবমশাই—!

—আজ্ঞে। ক্যাঁচক্যাঁচ করে বিবিঘরের দরজা খুলে গেল : আপনি তো জানেন, সেই বসন্ত-বাঈজিকে। আর এও তো জানেন, জমিদার বিশ্বম্ভরবাবু বসন্ত-বাঈজির নাচে রাতের পর রাত কত টাকাই না ঢেলেছেন। আমি জানতাম, রানিমা কেন আপনাকে অত ডেকে পাঠাতেন। বসন্ত-বাঈজির কাছে রাতের পর রাত মদ খেয়ে চলা রানিমাকে আঘাত দিয়েছিল বেশি। আর সেই ক্ষতস্থল যখন জ্বালা করে উঠত, তখন আর থাকতে পারতেন না। নায়েবমশাইয়ের হাত দিয়ে চিঠি ফেলতে পাঠাতেন। আমি জানতাম যে, চিঠি আপনাকে দিচ্ছেন। মাঝে-মাঝে মনে হত, চিঠিটা একবার খুলে দেখি। পিয়নের সামনা-সামনি কতবার গেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে যে-দুঃখ রানিমার আছে, রানিমা যা চান, সে-কথা কখনওই চিঠিতে লেখা থাকবে না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যদি কোনওদিন এর জবানবন্দি দেওয়ার দিন আসে, তবে সেদিনের আলো যেন আমাকে দেখতে না হয়। কারণ, আপনি তো জানেন, আমি আর তাদের বাড়ির শিক্ষক নই। আর আমাকে জমিদারের গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতে হয় না। আমাকে যদি জমিদার বিশ্বম্ভরবাবুর মৃত্যু সম্পর্কে সত্য কথাটা বলতে হয়, তবে লোকে আমাকে বলবে মিথ্যেবাদী। এ অপরিচিতের জুলুম। সেইজন্যে আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। আর সেইজন্যেই রানিমাকে আমার কোনও ঠিকানা জানাইনি। আজ যখন কলকাতার একটি কানাগলির বাড়িতে বসে আপনার চিঠিখানা পড়ছি, তখন সেদিনের সেই নূপুরধ্বনির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, খাসমহলের একটা ঘর থেকে ভেসে-আসা রানিমার কান্না আর নায়েবমশাইয়ের চঞ্চল পদক্ষেপ।

আপনি হয়তো শুনলে অবাক হবেন, আমি যেন কেমন বিমনা হয়ে পড়েছিলাম। বেশ মনে পড়ে, সেই অন্ধকার আমবাগানের মধ্য দিয়ে আমার লঘু পধ্বনি কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠছিল। কখন যে আমি বিবিঘরের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তা জানি না। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, জমিদার বিশ্বম্ভরবাবু মাতাল হয়েছেন। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে কী যেন বলছিলেন নায়েবমশাইকে। বসন্ত-বাঈজি—হ্যাঁ, বসন্ত-বাঈজিকে যদি আজ সামনে পাই, তা হলে আমার এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। মনের মধ্যে যে-প্রশ্নের পাহাড় জমে উঠেছে আজ, সেগুলো লাভার চাদর হয়ে মুড়ে দেবে বাঈজির দেহ। বিশ্বাস করুন, সেদিন বাঈজি মদ খায়নি—কিন্তু মাতাল হয়েছিল। মাঝে-মাঝে ঢলে পড়ছিল বিশ্বম্ভরবাবুর গায়ে। আমি জানালা দিয়ে একবার মুখ বাড়ালাম। ইচ্ছে করল, একবার রানিমার ঘরে যাই। ধীরে-ধীরে শরীরটা জ্বলে উঠল, আর আমি জানালা থেকে নেমে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালাম।

—রানিমা—রানিমা!—থরথর করে কেঁপে উঠলাম।

—রানিমা! শুনছেন, দরজাটা—।

খিল খোলার শব্দ হল। আমি ঝড়ের মতো ঢুকে পড়লাম।

যেন সাপ দেখে চমকে উঠলেন রানিমা : আপনি—আপনি হঠাৎ এত রাত্রে? কেউ যদি দেখতে পায়?

—জানি—জানি। তবু—।

গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসছে। সমস্ত শরীরটা দুলছে। পায়ের তলায় আর-একটা প্রকাণ্ড বরফের পাহাড় সমস্ত শরীরটাকে সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে। ওপরে ঝাড়লন্ঠনের আলোগুলো কী করুণ—কী মর্মান্তিক। দেওয়ালে টাঙানো বিশ্বম্ভরবাবুর ডাগর-ডাগর চোখ দুটো নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। ঝিঁঝি-ঝিল্লির একটানা শব্দ আছাড় খেয়ে পড়ছে কাচের শার্সির ওপর আর আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি সামনে।

হঠাৎ রানিমার ধমক শুনে চমকে ফিরে তাকালাম।

তিনি বলছেন : ভুলে যাবেন না, এসেছেন স্কুলে কাজ করতে। কোয়ার্টার পেয়েছেন এখান থেকে অনেক দূরে। এই মধ্যরাত্রে নিজের ঘর ছেড়ে নিশ্চয়ই ভুল করে এই অন্দরমহলে এসে পড়েননি। জেনে রাখুন বিদ্যুৎবাবু, এর জন্যে আপনাকে অনুশোচনা ভোগ করতে হবে। আপনি ধরা পড়বেন।

ধরা পড়ব! ইচ্ছে করল, রানিমার ওই সুন্দর মুখখানা অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে ফেলি। সমস্ত ঝাড়লন্ঠনগুলো ভেঙে ফেলি খানখান করে। কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। আস্তে-আস্তে বললাম, ছুরি—রানিমা, বাঈজির হাতে ছুরি।

রানিমা প্রথমটা তাকিয়ে রইলেন ফ্যালফ্যাল করে। তারপর ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলেন : বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান এখান থেকে।

আমি স্পষ্ট দেখলাম, রানিমার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। কেবল মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

বাইরেটা নিরঙ্কুশ অন্ধকার। মাথার ওপরে আকাশের অসংখ্য চোখ জ্বলছে। দশমীর একফালি চাঁদ মেঘের দোলায় ধাক্কা খেতে-খেতে থমকে দাঁড়াল খানিকটা। তারপর আবার ভাসতে লাগল একটানা। দূরে কোন এক পাকুড়গাছে কুবো পাখি শব্দ করে চলেছে। বাঁশের মাচানে মড়া শুইয়ে একদল লোক চলেছে শেওড়াফুলির গঙ্গায়। দূর থেকে তাদের হরিধ্বনির আওয়াজ ঘন বাতাসে খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘোড়ারগাড়ির একটা অস্পষ্ট স্বর এগিয়ে আসতে লাগল সামনে। আমি বুঝলাম, এবারে আমাকে তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে। যে-কোনও মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কালো রাতের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বিখ্যাত জমিদার বংশের যে-পাপ এতদিন ধূমায়িত হচ্ছিল, শত-শত দরিদ্র চাষির ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত দিয়ে তৈরি যে-টাকা এতদিন ধরে মদের পেয়ালা আর বাঈজির নৃত্য-ছন্দে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তার অবসান আজ আসন্ন। কিংবা নায়েব চারুচন্দ্র সান্যাল আজ জমিদার বিশ্বম্ভর হতে চলেছেন।

কুবো পাখিটা এখনও থেকে-থেকে ডেকে উঠছে। একটা সাদা প্যাঁচা অস্পষ্ট আলোয় পাখনা ভর করে উড়ে চলেছে। আর মিলকি বাদামতলা গ্রামের উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের জুনিয়র টিচার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে একটা অনাগত পরিবর্তন। ইচ্ছে করলে, পারতাম—পারতাম ওই কর্কশ গাড়ির আওয়াজকে মাটির ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। অথবা বসন্ত-বাঈজির হাত থেকে তীক্ষ্ন ছুরিটা কেড়ে নিতে। কিন্তু কী জানেন, নিজের ব্যক্তিত্বকে আমি কখনও নষ্ট করতে চাইনি। আর চাইনি বলেই আমি নিথর-নিস্পন্দ পাথরের মতো গাছের গায়ে গা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গাড়িটা এসে দাঁড়াল রাজফটকের সামনে। দূর থেকে যে-আলোটা চাতালের ওপর ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলাম, সেটা এখন বেরিয়ে এল বিবিঘর থেকে। দপদপ করতে-করতে একেবারে নিভে গেল। সমস্ত অঞ্চলটা যেন মৃত্যুপুরী। মৃত্যুর তুষার-শীতল গুহায় আমরা কতকগুলো বন্য পশু সেই আদিম যুগে ফিরে গেছি। আমাদের তীক্ষ্ন নখর দিয়ে পৃথিবী চিরে-চিরে দেখছি আমাদের পূর্বপুরুষের ফসল। অক্টোপাসের মতো লোমশ বীভৎসতা আমাদের পাকে-পাকে গ্রাস করে ফেলেছে। জোরে-জোরে নিশ্বাস নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পায়ের কাছে কীসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। না, অন্য কিছু নয়—মানুষ। কিন্তু কোনও মানুষ যে পড়েছিল, তা অত দেখবার সময় পাইনি। বাগানের পাঁচিল টপকে যখন রাস্তায় এসে পড়লাম, তখন রীতিমতো আমি হাঁপাচ্ছি। সমস্ত পৃথিবীটা আমার কাছ থেকে সরে গেছে। আমি একা—ভয়ানক একা। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে আমি সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে চলেছি। তারপর বেশ মনে আছে, খানিকটা ফিসফাস কথার আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছি, ঘোড়ারগাড়ি আমাকে ফেলে রেখে পালাতে পারবে না।

কিছুক্ষণ পরে কালো-কালো কতকগুলো লোক অচৈতন্য বিশ্বম্ভরবাবুকে এনে তুলল গাড়ির মধ্যে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম। কিন্তু কী জানেন, বলতে এখনও সঙ্কোচ হচ্ছে। দেখলাম, রানিমাও তাদের দলে রয়েছেন। আপনি হয়তো কথাটা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছেন। নয়তো ভাবছেন, আমি মিথ্যেবাদী। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে অনুরোধ করছি, আমরা শিক্ষকের জাত, সুতরাং মিথ্যে কথা খুব কমই বলে থাকি। রানিমাকে দলের মধ্যে দেখে আমি বিস্মিত হইনি, বরং এইটাই আশা করেছিলাম। রানিমা ধীরে-ধীরে গাড়ির মধ্যে উঠলেন। উঠল বসন্ত-বাঈজি। তারপর ধরাধরি করে বিশ্বম্ভরবাবুকে গাড়ির চালের ওপরে তুলে দেওয়া হল।

নায়েবমশাই বললেন, ফটকের ওপর ভার রইল এই সমস্ত নিয়ে যাওয়ার। গাড়িটা বাবুর বাগান পর্যন্ত খুব জোরে যাবে। তারপর মাটচিপি পড়লে বেগ কমিয়ে আনবে। সবাইকে বলে দিচ্ছি, খুব সাবধান—অন্তত ফাঁড়ির কাছ বরাবর গিয়ে যেন ভুল করে বসো না। তোমরা এগোও, আমি সাইকেলে যাচ্ছি পেছন-পেছন।

—শুনছেন?—এবারে বাঈজির গলা আমি কিন্তু ওখান থেকেই পাড়ি জমাব। আমার টাকাটা মিটিয়ে দিলে হত না!

—হবে—হবে। কাজ উদ্ধার হলে আপনি টাকা আসবে হাতে। কিচ্ছু ভাবতে হবে না।

—তাহলে একটা কথা আছে।—বাঈজি এবারে নেমে এল গাড়ি থেকে। নায়েবমশাইকে সঙ্গে নিয়ে একটু সরে গেল। ফিসফিস করে কথা বলল অনেকক্ষণ। কী কথা বলেছিল আমি শুনতে পাইনি। তবে দুটো কথা ছিটকে এসেছিল হঠাৎ।

নায়েবমশাই বলেছিলেন কী যে বলেন আপনি! তবে আসবেন মাঝে-মাঝে। দেখা যাবে’খন।

আবেগে নায়েবমশাইয়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরেছিল বাঈজি। রানিমা একটাও কথা বলেননি। কেবল একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন বাগানের দিকে। বোধহয়, আমার ঘরের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন তিনি। কী জানি কেন আজও বুঝতে পারিনি।

কিছুক্ষণ পরে সকলেই গাড়িতে উঠে পড়ল। আস্তে-আস্তে চলতে লাগল ঘোড়া।

গাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে আচ্ছন্নের মতো বেশ বসেছিলাম। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি

খেয়ে গাড়িটা থেমে গেল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, দু-পাশে অফুরন্ত মাঠ। মিঠেল বাতাসের ঝাপটা চোখ স্বপ্নাতুর করে তোলে। আমি যেন কেমন কাল্পনিক হয়ে পড়ি। কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে কিছুই আর মনে স্থান পায় না। মন মাঠ-ঘাট ছাড়িয়ে বাগানের এক কোণে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদের চাঁদোয়া। মাঝে-মাঝে দিকচক্রবাল আশ্রয় করে শালবন উঁকি মারছে। আর হয়তো একটা-একটা করে শেয়াল আর্ত চিৎকারে রাত্রির বুক বিদীর্ণ করছে। ঘোড়ারগাড়িটা থেমে পড়ল। হয়তো কোনও এক বিপদের ইশারা পেয়েছে। নয়তো মাঝপথে কোনও প্রয়োজনের তাগিদ মনে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে আমার যে ভয় করছিল, তা বলব না। বরং কেমন এক অশরীরী-আনন্দ আমার দেহে ভর করেছিল। অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পদক্ষেপ আমার বক্ষের স্পন্দনের সঙ্গে আমি যেন অনুভব করছিলাম। সামনের সিটে বসেছিল বসন্ত-বাঈজি। আবছা অন্ধকারে তাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম, দৈহিক ও মানসিক অত্যাচারের বিভিন্ন চিহ্ন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে। কথা বলতে ইচ্ছে করলেও তাই চেষ্টা করলাম না।

একটা লোক ওপর থেকে নেমে বসন্তকে বলে, মাইজি, দূর থেকে সিপাহিরা সন্দেহ করেছে।

—তাহলে উপায়?—কেঁপে উঠল বাঈজির গলা।

—সামনের ওই পোলের তলায় গাড়িটাকে ঢুকিয়ে দিলে ভালো হয় না?

—আর এখান থেকে কতদূর যেতে হবে?

—ঠিক আছে, কিচ্ছু ভাবতে হবে না।—লোকটা পিছনে তাকাল।

নায়েবমশাই সাইকেলে আসছেন। হাত নেড়ে ইশারা করে কী যেন বলছেন উনি : আরে, কী ব্যাপার? সামনে একটা লাইট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না?

—আজ্ঞে স্যার, পোলের তলায়—।

—ঝটপট করো। লাশটা নামিয়ে নাও কাঁধে করে। তারপর মাঠ ভেঙে এগিয়ে চলো। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। সামনের জঙ্গলটার মধ্যে গেলেই ওরা আর খুঁজে পাবে না।

দুটো বন্দুকের আওয়াজ হল।

ঘোড়া আর গাড়িটাকে টানতে-টানতে পোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল লোকগুলো। তারপর লাশটাকে কাঁধে করে নিয়ে ছুটে চলল সামনের জঙ্গলের দিকে। আমাকে আর বাঈজিকে সাইকেলে বসিয়ে নায়েবমশাই দুর্দান্ত বেগে সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটে চললেন।

তুমি হয়তো হাসছ। কিন্তু তখন অত ভাববার সময় ছিল না। প্রাণ বাঁচাবার সমস্যাই ছিল কঠিন।

পেছনে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলাম আমরা। নায়েবমশাই মৃদু হেসে বললেন, মরুক খানিকটা ফাঁকা আওয়াজ করে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পরে আমরা বনের মধ্যে এক পরিষ্কার জায়গায় এসে পৌঁছলাম।

নায়েবমশাই বললেন, হারি-আপ—হারি-আপ।

লোকগুলো অচৈতন্য বিশ্বম্ভরবাবুকে ধরাধরি করে একটা গভীর গর্তের মধ্যে ফেলে দিল। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখলাম। কোনও প্রতিবাদ করতে পারলাম না। বাধা দিতে পারলাম না। বরং মনের দরজা খুলে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, হাই-স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার পরম নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে। আঘাত পেয়েছে সে রানিমার কাছ থেকে। না-না, এখন আর তাচ্ছিল্য করব না তোমায়। তোমার জন্যেই যে এতসব কাণ্ড। গর্তের মধ্যে স্বামীকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমার মনে কোনও কান্নার পাহাড় লুকিয়ে নেই। গর্তের মধ্যে সবাই মাটি ফেলছে অনবরত। অথচ চোখের জল আমার বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে না। কথাটা ভাবতে হয়তো তোমার বিশ্রী লাগছে। কিন্তু কী করব, মন যখন একজনের আকর্ষণে নিয়ত ছিন্নভিন্ন হয়, টাটিয়ে ওঠে বিষফোঁড়ার মতো, তখন নিজেকে পর্যন্ত ভুলে যেতে বসি, ভাই। স্বামীকে পথের কাঁটা বলে মনে করে ফেলি। তাই বলে কি আমি চেষ্টা করিনি? অনেক করেছি। তিলে-তিলে নিষ্পেষিত করেছি আমার দেহ। কতবার আমার গলা টিপে ধরেছি। কুটনো-কোটার বঁটি তুলে ধরেছি মাথায়। রাগে কখনও মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেছি মুঠো-মুঠো করে। যখন কিছুতেই কিছু হয়নি, তখন অফুরন্ত চোখের জল ফেলতে দ্বিধাবোধ করিনি। কিন্তু—।

যখন স্কুলের ঘণ্টা পড়েছে, তখন হাতুড়ির আওয়াজ শুনতে পেয়েছি বুকে। পা ছড়িয়ে কান্নার বদলে জানালা খুলে দৃষ্টিটা ছুড়ে দিয়েছি স্কুলের খোলা চত্বরে। দেখেছি, একখানা ফরসা কাপড় পরে, দীর্ঘ ছায়া ফেলে এগিয়ে চলেছে হাই-স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা চাপা দীর্ঘ নিশ্বাস।

সেইজন্যে স্বামী তখন হয়ে গেছে আমার কাছে তুচ্ছ। সংসার হয়েছে নরকের রাজ্য। স্বামীকে গর্তের মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে। নেশায় বেহুঁশ হয়েছে বলে তার এইরকম মৃত্যু।

জীবন্ত কবর কখনও দেখেছ তুমি? আমি ভাই দেখতে পারিনি। সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল, সেই রাত্রেই অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচারকে নিয়ে পাড়ি জমাব অন্য দেশে।

প্রাণপণে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটেছিলাম আমি। কতবার যে পড়েছি, তা বিচার করিনি। আমাকে যেতে হবে। পাঁচিল টপকে বাগানে নামতে হবে। তারপর দরজায় ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে টিচারকে। কাক-পক্ষীটি টের পাবে না। টিচারকে অবাক হওয়ারও সময় দেওয়া হবে না। ভোর হওয়ার আগেই আমাদের চলে যেতে হবে অনেক দূরে।

কিন্তু ভাই, ভোর হয়েই গেল। আমাদের চলে যাওয়া হল না।

হাঁপাতে-হাঁপাতে যখন পাঁচিল টপকালাম, যখন আস্তে-আস্তে ধাক্কা দিলাম দরজায়, তখন দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু আমার মনের মানুষকে দেখতে পেলাম না। বিছানাটা খাঁ-খাঁ করছে। বুকের ভেতরটা হু-হু করে পুড়ে যাচ্ছে।

আমি কি ক্রমশ আমার স্বামীর মতো মৃত্যু-গহ্বরে নেমে যাব? নয়তো পায়ের তলায় মাটি অত দুলছে কেন? ঘরের দেওয়ালগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে কেন?

বিশ্বাস করো তুমি, আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। ধপ করে বসে পড়লাম সেখানে।

ভোর হল।

এরপর গোটা চারটে সূর্য আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। আমি খেলাম না, ঘুমোলাম না। কেবল শুনলাম, বাঈজির নূপুরের আওয়াজ আর নায়েবমশাইয়ের বিকট অট্টহাসি। ইচ্ছে করল, বিক্ষোভে ফেটে পড়ি। জোর করে প্রচার করে দিই, নায়েবমশাই যে বাইরের লোকদের বলে বেড়াচ্ছেন, বিশ্বম্ভরবাবু বিদেশে হাওয়া বদল করতে গেছেন, সে-কথা ভুল। বিশ্বম্ভরবাবুকে মেরে ফেলা হয়েছে। জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। কেঁদে-কেঁদে বলতে ইচ্ছে করল, ওগো, তোমরা চলো—দেখবে চলো সেই জায়গা। আমি জানি গো জানি, সেখানে গুচ্ছ-গুচ্ছ ঘাস জন্মেছে। আমাকে তোমরা ফাঁসি দাও—জেলে দাও—কিন্তু নায়েবমশাইকে ছেড়ো না।

কথাগুলো সমুদ্র-সফেনের মতো আছাড় খেয়ে পড়ল হৃদয়ের পটভূমিতে। আমি বুকফাটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। সকলে বলল, আমি নাকি পাগল হয়ে গিয়েছি।

সত্যিই তো, নইলে অমন করে আমি বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকব কেন? আর কেনই বা হঠাৎ নায়েবমশাইয়ের সঙ্গে বসন্ত-বাঈজির ঝগড়া শুনে পালানোর চেষ্টা করব।

ঘর যেন আমার কাছে কয়েদখানা। বাইরের খোলা আকাশ আমার কাছে মুক্তির সমুদ্র। হয় আমার মনের মানুষকে ফিরিয়ে দাও, নয়তো কবরখানা থেকে উদ্ধার করো আমার স্বামীকে। তা না হলে আমি বাঁচব কাকে নিয়ে? তুমি তো বলেছিলে নায়েবমশাই, বিশ্বম্ভরবাবুর মৃত্যুর বদলে আমায় এনে দেবে মনের মানুষকে। কই, সে-সত্য পালন করলে কই?

কোথায় যাব—কোথায় যাব আমি?

দুরন্ত ঝড়ের মতো আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালেন নায়েবমশাই : না, তোমার যাওয়া হবে না।

—মানে! কী বলতে চাও তুমি?—ধনুকের মতো বেঁকে দাঁড়ালাম আমি।

বসন্ত-বাঈজি ছুটতে-ছুটতে এল—বলল, ছেড়ে দাও—ছেড়ে দাও ওকে।

—না, ছাড়ব না।

—কী ভেবেছ তুমি? এতদিন ধরে আমাকে কথা দিয়ে—।

—ভুল—ভুল বাঈজি। আমি রানিকে ভালোবেসেছি।

—ওঃ, তাই নাকি!—ঠোঁটের কোণে বিদ্যুতের মতো বাঁকা হাসি বসন্ত-বাঈজির : তুমি বসন্ত-বাঈজিকে চেনো না, নায়েব। এই মুহূর্তে তোমাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন—।

কারও কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই। সমস্ত জঙ্গল খাঁ-খাঁ করছে। আমি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলাম সেই কাঁটা-ঝোপের মধ্যে। যখন চেতনা ফিরে এল, দেখলাম, সকাল হয়ে এসেছে। কোনওরকমে নিজেকে মুক্ত করে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি, ভাই। আজ দশদিন পরে তোমার কাছে আমার মনের মানুষের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু মন আর সাড়া দিচ্ছে না। যতবার মনে ভাবছি, এই ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই—ততবার মন আমাকে ঠেলে দিচ্ছে পেছনে। কখনও ভাবছি, আবার ফিরে যাই। কিন্তু কবর থেকে জ্বলন্ত চোখ নিয়ে আমার স্বামী আমায় পুড়িয়ে মারছে কেবলই। কী করি—কী করতে পারি আমি? আচ্ছা, বলতে পারো, কেন এমন হল?

মাসিক রহস্য পত্রিকা

এপ্রিল-মে, ১৯৫৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *