বড়ি ও শ্বশুরমশাই

বড়ি ও শ্বশুরমশাই

‘এই শীতকাল, এমন মিঠে রোদ, একটু বড়িটড়ি তো দিতে পার।’ ডাল দিয়ে ভাত চটকাতে চটকাতে অসীম ব্যাজার ব্যাজার মুখে কথা কটা স্ত্রীকে মিহি করে বলল। হুকুম-টুকুম নয়। একটা সামান্য অভিলাষ। এইটুকু বলে থেমে থাকলে ক্ষতি ছিল না। সে আর একটু এগিয়েই বিপদ ডেকে আনল। ‘মাও গেছেন খাবার বারোটাও বেজে গেছে।’

মনোরমা মাথা নীচু করে সরষের তেল দিয়ে আলুভাতে মাখছিল। মুখ না তুলেই বলল, ‘রাখো রাখো, মা যে তোমাকে রোজ পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে খাওয়াতেন তা আমার দেখা আছে। মরা মানুষটাকে নিয়ে আর টানাটানি কোরো না।’

‘হ্যাঁ, মায়ের কথা বললেই তো তোমার গায়ে জ্বালা ধরবে। সেই লাস্ট নাইনটিন সেভেনটি সেভেনে একবার নারকোল, ছোলাটোলা দিয়ে মোচা হয়েছিল, সেভেনটি ফাইভে হয়েছিল থোড়। তারপর থেকে লাগাতার চলছে, ভাত, ডাল, আলুভাতে, মাছের ঝোল; মাছের ঝাল, আলুভাতে, ভাত, ডাল। জীবনে ঘেন্না ধরে গেল।’

‘আমরাও।’

‘হ্যাঁ আমার যা হবে, সঙ্গেসঙ্গে তোমারও তাই হবে। শুধু হবে না, ডবল ডোজে হবে। বেশ কৌশল শিখেছ। তোমার ঘেন্না ধরার কারণটা কি?’

‘কেঁচো খুঁড়তে যেও না সাপ বেরোবে। খাচ্ছ খেয়ে যাও। মোচা, নারকোল, থোড় না দিয়ে এলে আমি কি জন্ম দেবো?’ ধপাস করে আলুভাতের একটা টেনিস বল পাতে ফেলে দিয়ে মনোরমা উঠে গেল। রান্নাঘরে গনগনে উনুনে মাছ ভাজা হচ্ছে। সাঁড়াশি দিয়ে কড়াটা উনুন থেকে উপড়ে নিয়ে এল। গরম তেলে মাছ বিজবিজ করছে মনোরমার মেজাজের মতো। একবার যদি সাঁড়াশির ঠোঁট আলগা হয়ে কড়া দুম করে মেঝেতে পড়ে, মনোরমার ঠোঁট ফসকে বেরোনো বাক্যের চেয়েও অসীম আহত হবে। বড়ো ভয় পায় এই মুহূর্তকে। মনোরমা থালার সামনে উবু হয়ে বসে ভীত অসীমের পাতে একটি চারাপোনা ফেলে দিল। ন্যাজের দিকটা নুনের ওপর গিয়ে পড়ল। ভয় কেটে গেছে। এতক্ষণ আগের কথার যে উত্তরটা মনে মনে মকশ করছিল তা বলা যেতে পারে।

‘গর্ভে মোচা ধারণ করতে গেলে কলা গাছের বীজ চাই, সে কথা আমি জানি; কিন্তু ওই তিন বস্তু বাজারের ঝোলা থেকে বেরোলে তোমার মুখ তো তেলো হাঁড়ির মতো হবে। এ তো আর তোমার ড্রেসিং নয়। ঘাড়ে পাউডার, ভুরুতে পেনসিল, কপালে কুমকুম। মোচা ড্রেস করার একটা আলাদা আর্ট আছে। সে আমার মা জানতেন।’

কড়াটা মাটিতে নামিয়ে রেখে মনোরমা বললে, ‘হ্যাঁ তোমার মা সব জানতেন। কবিরাজের মেয়ে ছিলেন তো। শেকড়-বাকড়, পাতা-মাতা, কচু-ঘেঁচু।’

‘আর তুমি হলে অ্যালোপ্যাথের মেয়ে মাছ, মাংস, লিভার পিলে।’

‘আমি কার মেয়ে সে তো ভালো করেই জান। অত ঠেসে দিয়ে কথা বলার কী আছে? ডাক্তারের মেয়ে হলে তোমার মতো মোচা-খেকোর গলায় কী আর মালা দিতুম। টাকার জোরে ব্যারিস্টার জুটত।’

অসীম হেসে ফেলল। দু-জনের ঝগড়া এইভাবেই শুরু হয়ে হাসিতে শেষ হয়। মনোরমা বড়ো ভালো মেয়ে। একা সংসারটাকে মাথায় করে রেখেছে। সহজ সরল মেয়ে। বেশি খাটাতে চায় না বলে অসীম সাবেক কালের খাবার ফ্যাচাং বাড়িতে ঢোকাতে চায় না আবার সুযোগ পেলে বলতেও ছাড়ে না।

অসীম অফিসে চলে গেল। মনোরমা কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে ঠিক করে ফেলল, যা থাকে বরাতে আজ সে সারাদুপুরে বসে বসে বড়ি দেবে। কী এমন হাতি-ঘোড়া ব্যাপার! ডাল বেটে, নুন দিয়ে ফেটিয়ে একটা সাদা কাপড়ের ওপর টুকুস টুকুস করে পেড়ে যাওয়া। সমস্যা নাক নিয়ে। নাক উঁচু উঁচু না হলে বড়ি দেখে নাক-উঁচু মানুষের মন ভরে না। থ্যাবড়া নাকী মেয়ে যেমন বিয়ের বাজারে অচল, চ্যাপ্টা নাক বড়িও তেমনি সমঝদারের সমালোচনার বস্তু।

শঙ্করীর মা বাড়িতে কাজ করে। সেই হল মনোরমার উপদেষ্টা। উপদেষ্টা বললে, ‘আজ তো হবে না মা। ও রাতের বেলা ডাল ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে বাটতে হবে। তুমি আজ ভিজিয়ে রেখো, কাল সকালে আমি বেটে দোব।’ কাল মানে রবিবার। সেই ভালো। রবিবার ছুটির দিন। অসীমের সাহায্যও পাওয়া যাবে।

রবিবার বেলা একটা নাগাদ ডালবাটা রেডি হয়ে গেল। কালো জিরে ভাজছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ। এইবার শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ডুরে শাড়ি পরে মনোরমা ছাদে বসে বড়ি দেবে।

‘তোমার এই ধুতিটা নিচ্ছি।’

অসীম লাফিয়ে উঠল, ‘কেন? আমার ওই সাধের নতুন ধুতিটা তোমার কোন কম্মে লাগবে?’

‘বড়ি দোব।’

‘বড়ি দেবে আমার ধুতিতে? মামার বাড়ি! নিজের শাড়িতে দাও।’

‘আটপৌরে নতুন শাড়ি নেই। তোলা শাড়ি একটা দেড়শো-দুশো টাকা দাম। সোনার বড়ি হলে দেওয়া যেত। ডালের বড়ি কি ফুল ভয়েলে দেওয়া যায়?’

‘তাহলে বিছানার চাদরে।’

‘চাদরে? অপবিত্র জিনিস। তোমার কোনও ভয় নেই। বড়ি খুলে নিয়ে কেচে দোব, ইস্তিরি করে নিলেই যেমন নতুন তেমনি নতুন। ধুতিটা তো পড়েই থাকে। তুমি তো প্যান্ট আর পাজামা পরেই সারাজীবন কাটালে।’

রাজি না হয়ে উপায় কী। বড়ির হুজুক সেই তুলেছিল।

বেলা তিনটে নাগাদ সার সার বড়ি অসীমের কাঁচি ধুতির ওপর থেবড়ে থেবড়ে বসে গেল। তেমন টিকোলো নাক সবকটার হল না। শঙ্করীর মা জ্ঞান দিলে, ‘ভগবানের সৃষ্টিতেই মা কত খুঁত। মানুষের হাতে সব কী সমান হয়। পাড়া বড়ির নাক ধরে আর টানাটানি করুনি; জন্মের পর মানুষেরই আর কিছু করা যায় না। এতো ডালের বড়ি।’

বড়ির পুংলিঙ্গ বড়া। কিছু বড়া হল, কিছু বড়ি। যা হয়েছে বেশ হয়েছে। মনোরমা এসে অসীমকে বললে, ‘এই যে মশাই। তোমার কাগজপত্র নিয়ে ছাতে উঠে যাও। ইজিচেয়ার পেতে বসে বসে পড় আর বড়ি পাহারা দাও।’

‘যথা আজ্ঞা।’ ইজিচেয়ারে শরীর ছড়িয়ে অসীম কাগজ পড়ছে। কিছু দূরেই কাপড়ে সত্যাগ্রহীর মতো বসে আছে সার সার বড়ি। মিঠে রোদ, মিষ্টি হাওয়া, পাখির ডাক। কেমন যেন ঘুম এসে যাচ্ছে। চোখ জুড়ে আসছে। দু-একটা কাক মাঝে মাঝে পাশে হেঁটে হেঁটে খড়খড় করে বড়ি ঠোকরাতে আসছে।

অসীম হুস করলেই উড়ে পালাচ্ছে। এ এক ভালো জ্বালা যা হোক। একেই কি বলে, যমে মানুষে টানাটানি। কতক্ষণ আর জেগে থাকা যায়। অসীমের চোখ বুজতে বুজতে বুজেই গেল।

মনোরমার চিৎকারে অসীমের ঘুম ভেঙে গেল। ‘এ কী? আমার বড়ি কোথায়?’ মনোরমার হাতে বিকেলের চা। অসীম চোখ মেলে দেখলে, ফাঁকা ছাদ। কোথাও বড়ির নামগন্ধ নেই।

‘তুমি তুলে নিয়ে গেছ।’

‘তুলে নিয়ে যাব কী! ভালো করে শুকনোই হল না।’

‘ভৌতিক ব্যাপার তো? আচ্ছা রসিকতা! আর কেউ এসেছিল?’

‘কে আবার আসবে? তোমাকে পাহারায় রেখে গেলুম তাহলে কী জন্যে?’

‘কাকের তো এত ক্ষমতা হবে না? দশহাত ধুতি ঠোঁটে করে নিয়ে পালাবে।’

‘পারে, ওরা সব পারে। এক সঙ্গে একশোটা কাক ঠোঁটে করে নিয়ে উড়তে…।’ মনোরমার কথা বন্ধ হয়ে গেল।

‘ওই দেখো? আমগাছের ডালে ওটা কী ঝুলছে।’

অসীম আমগাছের মগডালের দিকে তাকাল, সাদা একটা কাপড় ঝুলছে।

‘হ্যাঁ, ওই তো তোমার সেই বড়ি। ওই তো আমার সেই নতুন কাপড়। ওখানে গেল কী করে?’ হঠাৎ রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল। পাতার আড়ালে তিনি বসেছিলেন ন্যাজ ঝুলিয়ে। কাপড়-সমেত এ ডাল থেকে ও ডালে লাফ মারলেন, হুপ করে।

‘আরে এ তো সেই বীর হনুমানটা।’

‘আমার কাপড়! সর্বনাশ হয়ে গেল মনোরমা। টেনে টেনে ফর্দাফাঁই করে দিলে।’

‘আমার বড়ি? আমার এতক্ষণের পরিশ্রম। মুখপোড়া হনুমানে খেয়ে নিলে! কার জন্যে বড়ি দিলুম আর কার ভোগে গেল!’

‘একছড়া কলা আনো, কলা। কাপড়টা অন্তত উদ্ধার করি।’

‘কলা কোথায় পাব?’

‘তাহলে?’ তাহলে, দু-জনে ছাদে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সাধ্যসাধনা করলে। ‘হে বাবা রামের বাহন! হে পবনসুত। হে বাবা গান্ধীজির চেলা। হে ভগবান হনুমান।’ হনুমানের কোনো সুমতি দেখা গেল না। অসীম রেগে বলল, ‘ঠিক আমার শ্বশুরমশাইয়ের মতো একগুঁয়ে।’

‘অ্যাঁ, কী বললে?’

‘তখন তোমাকে কী বলেছিলুম? কাপড়ে দিও না। কাপড়ে দিও না। শুনলে?’

‘কে বড়ি বড়ি করে লাফিয়েছিল?’

‘ওই যে আমার শ্বশুরমশাই কাঁচি ধুতি পরে খাচ্ছেন।’

আবার ভীষণ ঝটাপটি হয়ে গেল দু-জনে। আর সেই ছেঁড়া ছেঁড়া ধুতিটা আমগাছের ডালে ঝুলে রইল একটা সিজন ধর্মঠাকুরের নিশান হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *