বড়মামার সাইকেল
বড়মামা সাইকেলের বল বেয়ারিং-এ তেল দিচ্ছিলেন। মেজোমামা রকে জলচৌকির উপর আয়না রেখে ছোট মতো একটা কাঁচি দিয়ে গোঁফ ছাঁটছিলেন। আমি একটা বেতের মোড়ায় বসে বড়মামার সবচেয়ে বড় খরগোশটার অপকর্ম দেখছিলাম। সেটা একটা জুতো পরিষ্কার করার বুরুশ কুড় কুড় করে খাচ্ছিল! ভেবেছিলাম সরিয়ে নেব। তারপর মন হল কাজটা ঠিক হবে না। এ বাড়ির পশুদের স্বাধীনতায় বাধা দেবার মতো ডিকটেটার যখন কেউ নেই, আমি তো একটা নেহাৎ থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার।
তেল দেওয়া শেষ। বড়মামা চাকা দুটোকে বাঁই বাঁই করে বারকতক ঘুরিয়ে সাইকেলটাকে দেওয়ালে ঠেসিয়ে রাখলেন। তেল দেবার কেলে ডিবাটাকে পাঁচিলের ফোকরে রাখতে রাখতে বললেন,—’সাইকেল চাপবে সব ব্যাটা, তেল দিয়ে মরলে সুধাংশু ব্যাটা। কেন? কেন শুনি!’ বুঝলাম কথাটা বলা হচ্ছে মেজোমামাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। মেজোমামার হাতের কাঁচির কুটকুট শব্দ থেমে গেছে। কান দুটো খাড়া খাড়া। কাঁচিটা চৌকির উপর রেখে বললেন—’তেল ছাড়াই সাইকেল চলে। তেল দেওয়া যাদের অভ্যাস তারা কিছু না পেলে সাত সকালে সাইকেলের তেল দেবে। মানুষের নেচার। নেচার তো আর পালটানো যাবে না।’
কিছুদূরে কলতলায় বড়মামা হাতে সাবান ঘষতে ঘষতে শুনলেন। শুনে সাবান দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন—’গোঁফ ছাঁটছিস ছাঁট। সুধাংশু মুকুজ্জের চরকায় তেল দিতে আসিসনি। সুধাংশু মুকুজ্জে কবে কাকে তেল দিয়েছে রে! আই অ্যাম এ সেলফমেড ম্যান।’
মেজোমামা কাঁচিটা হাতে তুলে নিলেন। ফুঁ দিয়ে কুঁচো ওড়াতে ওড়াতে বললেন—’মিথ্যে বল না। এইমাত্র সাইকেলে তেল দিচ্ছিলে। বরং বলতে পার আমি একটা লোক যে কাউকে তেল দেয় না, এমন কি সাইকেলেও নয়।’
মেজোমামার কথার কেরামতির সামনে বড়মামা প্রায়ই একটু অপ্রতিভ মতো হয়ে পড়েন। ঠিক পেরে ওঠেন না। আজও তাই হল। সত্যই তো তেল দিচ্ছিলেন সাইকেলে। এই মাত্র, একটু আগে। নিজেই মেজোকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন—তেলের ব্যাপারটা তাঁরই। বড়মামা কলের তলায় হাত পেতে চারদিকে ছেলেমানুষের মতো খানিক জল ছিটোলেন তারপর তারে ঝোলানো তোয়ালের এক কোণে হাত মুছতে মুছতে দেরিতে হলেও জবাবটা যেন খুঁজে পেলেন—’তুইও একটি জায়গায় তেল দিস এবং ভালো করেই দিস।’
মেজোমামার হাতের কাঁচি আবার থেমে গেল। অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—’আমি! আই নেভার টাচ অয়েল।’
—’হ্যাঁ, তুমি। ‘বড়মামা গলাটা একটু বিকৃত করে বললেন—’তুমি রোজ সকালে চানের আগে তোমার নাইকুণ্ডুলে আধবাটি তেল ঢাল। সকলে জানে। জিগ্যেস করে দেখ তুমি সকলকে!’
—’সে তো নিজের শরীরে, স্বাস্থ্য রক্ষার্থে। এ তেল কি সে তেল নাকি। অয়েলিং মাই ওন মেশিন।’ —’ওই হল রে। নিজেকে নিজে যারা তেল দেয় তারা ভয়ঙ্কর লোক। ভয়াল, ভয়ঙ্কর অজগর সর্প’ বড়মামা মুখটাকে হাঁ মতো করে হাত-পা নেড়ে মেজোমামার ভয়ঙ্কর চরিত্রটা বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
এইবার বড়মামার নজর পড়ল আমার দিকে। মোড়ার উপর পা গুটিয়ে বসে বসে মজা দেখছিলুম। খরগোশটা জুতো-ঝাড়া বুরুশটাকে টানতে টানতে প্রায় পায়ের কাছে এনে তিনের চার অংশই মেরে দিয়েছে। গোঁফের সঙ্গে বুরুশের চুল জড়িয়ে আছে।
—’তুই এখানে বসে বসে চোরের মতো কি করছিস? তোকে আমি সেই সকাল থেকে গরু খোঁজা খুঁজছি।’
—’আমি তো সারা সকাল এখানেই বসে আছি। দেখতে পান নি।’
—’দেখার কি উপায় আছে। অতবড় একটা পর্বতের আড়ালে বসে আছিস। তিন ঘণ্টা ধরে শুধু গোঁফই ছেঁটে যাচ্ছে। গোঁফের জন্যে জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল।’
মেজোমামা হাঁটু খুলে মেঝে থেকে উঠতে উঠতে একটু টাল খেয়ে পড়ে যাবার মতো হলেন। অনেকক্ষণ পা মুড়ে বসে থাকার জন্যেই বোধহয়। সেই টাল খাওয়া অবস্থাতেই মেজোমামা বললেন,—’তুমি গোঁফের মর্ম কি বুঝবে বল? তোমার তো সব চাঁছা ছোলা—প্লেন। পুরুষের মতো পুরুষ যারা তাদের সব ইয়া ইয়া গোঁফ। গোবর, গামা, বড়ে গোলাম আলি, আখতার সিং, অবতার সিং, স্বর্ণ সিং। তুমি সুধাংশু মুখুজ্জে, তোমার না আছে গোঁফ, না আছে দাড়ি।’ মেজোমামা বেকায়দা অবস্থা থেকে কথা বলতে বলতে সটান উঠে দাঁড়ালেন, এক হাতে আয়না অন্য হাতে কাঁচি। এতক্ষণ আমার উপর নজর পড়েনি, এইবার পড়ল।
—’তুইও আমার মতো গোঁফ রাখবি! গোঁফ না রাখলে পুরুষ মানুষকে মেনি বেড়ালের মতো দেখায়।’
বড়মামা জুতো পরছিলেন। এক পায়ে জুতো, অন্য পা রকের কোণায় ঘষে ঘষে ধুলো ঝাড়ছিলেন। মেজোমামার মন্তব্যে উত্তর না দিয়ে পারলেন না,—’ডাক্তারদের তোর মতো গুঁপো হলে চলে না বুজেছিস। আমার মুখ দেখে রোগীদের আদ্দেক অসুখ সেরে যায়। আমার মুখখানা দেখেছিস! অনেকটা যিশুর মতো। এ মুখ দেখলে মানুষ ভরসা পায়, তোর মুখ দেখলে ভিমরি যায়।’
মেজোমামা একটা প্রাণখোলা হাসি হাসলেন, তারপর একখানা সংস্কৃত ছাড়লেন—’অমৃতং বাল ভাষিতং।’ দুম দুম করে এগিয়ে গেলেন কলের দিকে, যাবার সময় একহাত দিয়ে তার থেকে তোয়ালেটা টেনে নিলেন। গোটা কয়েক হ্যাঙার ঝুলছিল। পাকা আমের মতো টপাটপ পড়ে গেল। বড়মামার কুকুর লাকি এক পাশে মৌজ করে শুয়েছিল। একটা পড়ল তার ঘাড়ে। সে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। খরগোশটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে পালাল।
জুতো পরা শেষ। বড়মামা বললেন—’চল। তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে নিলুম।’ —’কোথায় যাবেন?’
—’চল চল। কলে যাবো। সাইকেলের কেরিয়ারে বসতে পারবি তো?’
—’কেন পারব না?’
মেজোমামা মুখে জল থাবড়াতে থাবড়াতে বললেন,—’কেন ছেলেটাকে খানায় ফেলবে। তোমার তো ব্যালেনস নেই। বেশ বসে আছে চুপচাপ। কেন সুখে থাকতে ভূতে কিলোবে।’
বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললেন—’যাবি না তুই?’
মহা বিপদে পড়লাম। কার কথা শুনি। আমি কিছু বলার আগেই মেজোমামা বললেন,—’না না, তোমার সঙ্গে ও কোথায় যাবে? ওর জীবনের দাম আছে।’
বড়মামা গম্ভীর গলায় বললেন—’উত্তরটা আমি ওর কাছ থেকেই শুনতে চাই। নট ফ্রম এনি থার্ড পার্সন। ‘বড়মামা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,—’আশু ময়রার বাড়িতে কল আছে। এই বড় বড় সন্দেশ খাওয়াবে। একাল আর কত খাবো। তুই তবু কাছে থাকলে খাওয়ার ব্যাপারে একটু হেলপ করতে পারবি। চল, উঠে পড়। রোদ চড়ে যাচ্ছে।’
মোল্লারচকে আশু ময়রার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান। লোভ সামলানো মুশকিল। উঠে পড়তে হল। মেজোমামা বললেন,—’ডাক্তার আমি অনেক দেখছি, তবে এমন পেটুক ডাক্তার বড় একটা দেখা যায় না। সেদিক থেকে তুমি অবশ্যই দর্শনীয় বস্তু। ডাক্তার না হয়ে বামুন হওয়াই উচিত ছিল।’
‘ডিসপেপসিয়ায় সারা জীবন ভুগলে সুস্থ মানুষকে পেটুক বলেই মনে হবে। তোর দোষ নেই রে, তোর ভাগ্যের দোষ। সারা জীবন ঘুমিয়েই কাটালি। একটু ব্যায়াম করলি না। বদ হজমে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। আর পাগলে? পাগলে কিনা বলে। বাকিটা তুই বল?’ বড়মামা আমার ডান কানটা মুচড়ে দিলেন।
‘ছাগলে কিনা খায়—’বলে পাদ-পুরাণের সাহস হল না। মেজোমামাকে ছাগল বলাটা খুব গর্হিত কাজ এই বুদ্ধিটা অন্তত আমার আছে। বড়মামা ইতিমধ্যে সাইকেলটাকে হাঁটাতে হাঁটাতে বাড়ির বাইরে বাগান গিয়ে পড়েছেন। সামনের রডে ক্ল্যাম্প দিয়ে আটকানো কালো রঙের ডাক্তারি ব্যাগ। গলার দু’পাশে বুকের উপর ঝুলছে বুক-দেখা যন্ত্র। লম্বা চওড়া ফরসা চেহারা। মুখে সব সময় একটা হাসি লেগেই আছে।
বড়মামা পকেট থেকে কাগজে মোড়া দুটো পিপারমিন্ট লজেন্স বের করলেন। একটা আমাকে দিলেন। মোড়ক খুলে অন্যটা নিজের মুখে ফেলে দিলেন,—’বুঝলি, সব সময় নিজেকে কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত রাখবি। একদম আইডল থাকবি না। যখন কোনও কাজ নেই তখন লজেন্স খাবি। নে উঠে বস। দু’পাশে পা ঝুলিয়ে দে আর কেরিয়ারের সামনের সিটের পিছনের এই প্যাঁচানো লোহার গোলটা শক্ত করে ধরে ব্যালেনস রেখে বস। ছটফট করবি না। বারে বারে ঘাড় ঘোরাবি না।’
বড়মামার সাইকেল চলল কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে। ঝাঁকুনিতে হ্যান্ডেলের বেলটা টিন টিন শব্দ করছে। মাঝে মাঝে সাইকেলটা লগবগ করে উঠছে। বড়মামা বলছেন,—’ভয় পাবি না একদম।’ দূরে রাস্তা জুড়ে একটা গরুর গাড়ি আসছে। দু’পাশে বিশাল নর্দমা। আমি একটু মিনমিন গলায় বললুম,—’বড়মামা নর্দমা।’ বড়মামা বললেন,—’স্টেডি থাক, দেখ-না নর্দমার পাশ দিয়ে কায়দা করে সুট করে বেরিয়ে যাবো। তুই বরং চোখ বুজে থাক।’
চোখ বুজতেই মেজোমামার কথা মনে পড়ে গেল—’কেন ছেলেটাকে মারবে।’ বড়মামা বললেন,—’পা দুটোকে ছড়াসনি, গরুর গাড়ির চাকায় ঘষে যাবে, ক্লোজ করে রাখ।’ পাশ দিয়ে হওয়ার মতো কি একটা বেরিয়ে এল। চোখ বুজলাম। গরুর গাড়ি পেরিয়ে এসেছি। সামনে ফাঁকা রাস্তা সটান বেরিয়ে গেছে। বড়মামা সাইকেলে স্পিড দিলেন। বললেন,—’দেখলি তো, একে বলে সাইকেল চালানো। আমিও চোখ বুজে ছিলুম। ভয় পেলেই চোখ বুজিয়ে ফেলবি। আমার ঠাকুমা শিখিয়ে গিয়েছিলেন।’
—’আপনি চোখ বুজিয়ে দিলেন?’
—’হ্যাঁ রে। তা না হলে তো খানায় পড়ে যেতুম। ঠাকুরমার শিক্ষা আজো ভুলিনি।’
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে সাইকেলের পিছনে বসে রইলুম। ঠাকুমা কি মারাত্মক শিক্ষা বড়মামাকে দিয়েছিল! বড়মামা এখন গুন গুন করে গান গাইছেন,—’কি রে ঘুমোলি নাকি?’
—’সাইকেলে বসে কেউ ঘুমোয় নাকি?’
বড়মামা হাসলেন—’আমি তখন তোর মতো ছোট। বাবার সাইকেলের পেছনে বসে তুই যেমন চলেছিস আমিও চলেছি বাবার সঙ্গে কলে। সময়টা কেবল তফাৎ। সকাল নয় রাত্রি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হাত আলগা হয়ে ধপাস! ওদিকে বাবাও চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। টের পাননি আমি পড়ে গেছি। বাবার আবার ভীষণ ভুলো মন। রুগির বাড়ি গিয়ে খেয়ালই হয়নি যে আমি সঙ্গে ছিলুম। রুগিটুগি দেখে ঘুর পথে বাবা বাড়ি চলে এসেছেন। মা জিগ্যেস করলেন—ন্যাড়াকে কোথায় রেখে এলে? বাবা তখন খেতে বসতে যাচ্ছেন। লাফিয়ে উঠলেন—তাই তো?’
ঝগড়া করতে করতে দুটো কুকুর সাইকেলের সামনে চলে এসেছে। বড়মামা কায়দা করে কাটাতে গেলেন। ভীত কুকুরটা পালাল। মোটা কেলে কুকুরটা সামনের চাকায় এসে পড়ল। তারপর কি হ’ল বোঝা গেল না, কুকুরটার একটা পা জড়িয়ে গেল স্পোকের সঙ্গে। বড়মামা, আমি এবং কুকুর তিনজনেই ডিগবাজী খেয়ে রাস্তার ধারের ঘাসের উপর পড়ে গেলুম। সাইকেলটা ঘাড়ের উপর শুয়ে পড়ল।
শুয়ে শুয়েই বড়মামা বললেন—’আমার দোষ নেই। দেখলি তো কেলে ব্যাটা চাকায় জড়িয়ে গেছে। তুই বলতে পারবি না যে আমি ফেলে দিয়েছি।’ বড়মামা প্রথমে উঠলেন ধুলোটুলো ঝেড়ে। আমাকে হাত ধরে টেনে তুললেন। সাইকেলের চাকায় পা জড়ানো অবস্থায় কুকুরটা তখন মর্মান্তিক আর্তনাদ করে চলেছে।
রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে বড়মামা কুকুরটার অবস্থা ভালো করে দেখলেন। আমি বড়মামার চেয়ে আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলুম, ডান পা’টা চাকার স্পোকে পাকিয়ে গেছে,—’বড়মামা?’
—’বল?’
‘দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ তো ছাড়ানো যাবে না। ছাড়াতে গেলেই কামড়ে দেবে।’
—’হুঁ, বলেছিস ঠিক। এ রকম ঘটনা আগে কখনো দেখেছিস?’
—’না বড়মামা। এ জিনিস দেখা যায় না। পা’টা বোধ হয় অ্যামপুট করতে হবে।’
বড়মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন,—’কি যে বলিস? ডাক্তার হয়েছি কি করতে? দেখছিস কুকুরটার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে?’
—’তুমি ওর চিৎকারটা বন্ধ করতে পার?’
বড়মামা উঠে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে আবার দুটো লজেন্স বেরোলো। একটা আমার। একটা বড়মামার। লজেন্সটা চুষতে চুষতে বড়মামা বললেন—’আমার কেরামতিটা একবার দেখ।’
—’হাত দেবেন নাকি?’
—’দেবো, তবে একটু পরে।’
সাইকেল থেকে ডাক্তারি ব্যাগটা খুলে নিলেন। ব্যাগ থেকে বেরোলো ইঞ্জেকসানের সিরিঞ্জ, ওষুধের অ্যামপুল। শুনেছি, কুকুরে কামড়ালে পেটে ইঞ্জেকসান নিতে হয়। ভাবলুম, বড়মামা বোধহয় আগেই নিজের পেটে ছুঁচ ঢুকিয়ে তারপর কুকুরটাকে ধরবেন। কারণ ধরা মাত্রই কুকুর কামড়ে ছিঁড়ে দেবে।
না। বড়মামা করলেন কি, কুকুরটার পাছায় পুট করে ছুঁচটা ঢুকিয়ে দিলেন।
—’কি লাগালুম বল তো? মরফিয়া, কুকুরটা ঘুমিয়ে পড়বে দেখবি।’ কিছুক্ষণের মধ্যে কুকুরটা লটকে পড়ল। বড়মামা আস্তে আস্তে পা-টা বের করে আনলেন। শোচনীয় অবস্থা। পা-টা পেঁচিয়ে গেছে।
—’একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে আনতে পারিস?’
দূরে একটা বেড়ার ধারে জিওল গাছ হয়েছিল। একটা ডাল তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে নিয়ে এলুম। বড়মামার ব্যাগ থেকে চওড়া ব্যাঞ্জেজ বেরোলো। ডাল দিয়ে টাইট করে কুকুরটার পা ব্যাণ্ডেজ করা হল।
—’নে, ধর।’
চ্যাংদোলা করে এটা ঝোপের ধারে কুকুরটাকে শুইয়ে দেওয়া হল। কখন জ্ঞান হবে কে জানে। বড়মামা বললেন,—’চড়া ডোজ দিয়েছি। বিকেলের আগে জ্ঞান হবে বলে মনে হয় না।’
সাইকেলের হ্যান্ডেলটা বেঁকে গিয়েছিল। সামনের চাকার উপর ঘোড়ার মতো বসে দু’হাত দিয়ে বড়মামা হ্যান্ডেলটা ঠিকঠাক করলেন। সাদা প্যান্টে খাবলা খাবলা ধুলো। বড়মামাকে তখন ডাক্তার নয়, মিস্ত্রীর মতো দেখাচ্ছিল।
—’বিকেলে আবার কুকুরটাকে দেখে যেতে হবে। জায়গাটা মনে রাখিস। কালভার্টের ধারে ভাঁট ফুলের ঝোপ।’
সাইকেলে উঠতে উঠতে বড়মামা বললেন,—’ইস, ভীষণ দেরি হয়ে গেল রে, আমার রুগী বোধহয় একক্ষণ টেঁসে গেল।’
বড়মামার সাইকেল এবড়োখেবড়ো রাস্তার উপর দিয়ে হুড়মুড় করে চলল। আমি ভয়ে সিঁটকে বসে রইলুম। একবার আছাড় খেয়েছি, আর একবার খেতে কতক্ষণ! হাঁটুর কাছটা ছড়ে গেছে, বেশ জ্বালা করছে। ঘাড়টা মটকে গিয়ে ভীষণ ব্যথা করছে।
—’তোর কোথাও লেগেছে নাকি রে।’
হাসি হাসি গলা করে বললুম—’না বড়মামা। খুব একটা লাগেনি।’
—’লাগবে কি করে বল, আমরা তো আস্তে আস্তে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লুম, তাই না? মেজোকে কিন্তু একটা কথাও বলবি না। বললে হইহই করে বাড়ি মাথায় করবে।
একটা লাল রকওলা বড় বাড়ির সামনে বড়মামা সাইকেল থেকে নামলেন। মার্বেল পাথরের ফলকে লেখা, ‘পঞ্জী লজ’। রকের পাশে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা ছেলে আমের আঁটি চুষছিল। বড়মামাকে দেখে, ‘ডেক্তার এসেছে, ডেক্তার এসেছে’—বলে বাড়ির ভেতর দৌড়ল। বড়মামা সাইকেলটা ঢোকাচ্ছেন, বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন, মিশকালো বিশাল মোটা এক ভদ্রলোক। বেঁটে, মাথার চুল কাঁচাপাকা, পালোয়ানের মতো ছাঁট। পাকা পুরুষ্ট দু’জোড়া গোঁফ ঠোঁটের উপর কাঠবিড়ালীর ল্যাজের মতো বসে আছে। পরনে লাল গামছা, গায়ে একটা হলদেটে রঙের টাইট ফতুয়া। ভুঁড়িটা ঠেলে উঁচু হয়ে আছে। খালি পা।
—’এস এস, ডাক্তার এস,’ গরিলার থাবার মতো দুটো হাত তুলে বড়মামাকে সাইকেল সুদ্ধ জড়িয়ে ধরেন আর কি! বড়মামা কোনও রকমে রক্ষে পেলেও আমি পেলুম না।
—’খোকাটি কে?’ যেই বড়মামা বললেন,—’ভাগ্নে,’ ভদ্রলোক আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জমি থেকে ফুটখানেক উপরে তুলে দুম করে ছেড়ে দিলেন। —’কোনও ওজন নেই ডাক্তারবাবু। এক্কেবারে দুবলা। খায়-টায় না নাকি।’
সাইকেলটা উঠোনোর কোণে দাঁড় করাতে করাতে বড়মামা বললেন,—’আর বলবেন না, আমাদের বংশের কলঙ্ক। খাচ্ছে দাচ্ছে, কোথায় যে সব যাচ্ছে। গায়ে কিছুই লাগছে না। ব্যাটার পেটে বোধহয় কৃমির বংশ আছে। দাঁড়ান না, আমার পাল্লায় পড়ছে, কৃমির বংশ ধ্বংস করে দিচ্ছি।’
‘—কৃমি!’ আশুবাবু শব্দটাকে এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যেন তাঁর পায়ের কাছেই গোটা কতক ঘুরে বেড়াচ্ছে—’রোজ সকালে এক গেলাস করে নিমপাতার রস খাওয়ান না। আমার ছোট নাতিটার হয়েছিল। সারাদিন খাই খাই করত, এখন রোজ দশটার বেশি সন্দেশ খায় না।’
আশুবাবুর সারা গায়ে একটা টকটক ছানার জলের গন্ধ। ছানার জিনিস সুস্বাদু, কিন্তু গন্ধটা সহ্য করা শক্ত।
—’কার অসুখ, আশুবাবু!’ এবার ডাক্তারের মতো গম্ভীর গলা বড়মামার!
আশুবাবু হাত কচলে অপরাধীর মতো গলায় বললেন,—’আমার অসুখ।’
চলমান পাহাড়ের মতো আশুবাবুর গামছা আর ফতুয়া পরা শরীরের দিকে বড়মামা অবিশ্বাসীর চোখে তাকিয়ে রইলেন। আশুবাবু বড়মামার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝলেন, ডাক্তারবাবু বিশ্বাস করছেন না।
উঠোনের চারদিকে চওড়া লাল রক, চকচকে তেলা। একদিকে গোটাকতক দামী পুরু সোফা। আশুবাবু বড়মামা আর আমাকে নিয়ে সেইদিকে এগিয়ে গেলেন। বসতে বসতে বড়মামা জিগ্যেস করলেন,—’কি, হয়েছে কি?’
—’মেয়েরা বলছে, ভূতে ধরেছে, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে অন্য রকম। ওরা সব রোজাও এনেছিল। ওই ব্যাটা দক্ষিণ পাড়ার পরশুরাম। অনেক টাকার ধার খেয়ে রেখেছে আমার দোকান থেকে। সেই ঝালটাই আমার উপর রোজা সেজে ঝাড়ল। কি ঝ্যাঁটাটাই যে পিটেছে আমার পিঠে, এই দেখো ডাক্তার।’ আশুবাবু ছলছলে চেখে পিঠ খুলে বড়মামাকে দেখালেন। কালো কুচকুচে চওড়া পিঠে দাগড়া দাগড়া ঝ্যাঁটার দাগ।
—’ঝ্যাঁটাটা নতুন ছিল, না পুরনো?’ বড়মামার অন্য ধরনের প্রশ্ন।
—’পুরনো ঝ্যাঁটা ডাক্তার। এক্কেবারে মুড়ো খ্যাংরা। আমার নিজের পরিবার উঠোনের কোণ থেকে নিজে হাতে করে সেই শয়তানটার হাতে তুলে দিলে। এও এক প্রতিশোধ।’
পিছনের দরজার পাশে চুড়ির শব্দ হল প্রথমে, তারপর শোনা গেল একখানা গলার মতো গলা। মনে হয়, আট রকমের বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে আট রকমের সুরে বাজছে,—’বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে। প্রতিশোধের কি হয়েছে। আত্মায় ভর করল, ভালোর জন্যে রোজা ধরে আনলুম। কথা দেখ! বলে যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর।’
—’শোনো ডাক্তার, তুমিই এর বিচার কর।’
আশুবাবু চোখের জল মুছে তেড়ে মেড়ে উঠলেন,—’তুমি তিত্থি করতে যাবার জন্যে টাকা চেয়েছিলে—হ্যাঁ কি না।’ সওয়ারজবাব শুরু হয়ে গেল।
বড়মামা বিচারকের আসনে।
উত্তর এল দরজার পাশ থেকে—’হ্যাঁ।’
—’আমি কি বলেছিলুম?’
—’হাতে টেকা নেই, তিত্থি এখন মাথায় থাক। গঙ্গার ধারে শিবের মন্দিরে জল ঢাল। তারপর গুন গুন গ্যান গেয়েছিলে—গয়া গঙ্গা পেভাসাদি ক্যাশী ক্যাঞ্চি কেবা চায়।’
—’তুমি কি বলেছিলে?’
—’কিপটে বুড়ো, মলে ট্যাকা কি সঙ্গে যাবে?’
—’আর কি বলেছিলে?’
—’আর কিছু বলিনি।’
—’বল নি? মিথ্যেবাদী! এই নারায়ণের মাথায় হাত রেখে বল তো, আর কিছু বলিনি।’ আশুবাবু সোফা থেকে আমাকে খামচে তুলে ধরে দরজার দিকে ঠেলে দিলেন। অন্য সময় হলে রেগে যেতুম, যেহেতু নারায়ণ বলেছেন তাই…।
দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভদ্রমহিলা বললেন—’আর বলেছিলুম চোরের ধর বাটপাড়ে খায়!’
—’আমি চোর’! —আশুবাবু সপ্তমে চিৎকার করে উঠলেন। বড়মামা চোখ বুজিয়ে ছিলেন। আচমকা চিৎকারে চমকে উঠলেন। হাত থেকে বুকে-দেখা যন্ত্র ছিটকে পড়ল। বড়মামা উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে বললেন, ‘বাস বাস, নো মোর।’
বিচারকের গলায় ইংরেজী শুনে আশুবাবু শান্ত হলেন। আমি দরজার কাছে ভোঁদার মতো দাঁড়িয়ে ছিলুম। বড়মামা ডাকলেন,—’চলে আয়।’ বড়মামা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডাক্তারী ব্যাগ খুললেন। বেরোলো অ্যালুমিনিয়ামের চকচকে একটা কৌটো। আশুবাবু আড়চোখে তাকিয়ে বললেন,—’পান নাকি ডাক্তার, জর্দা দেওয়া?’
বড়মামা খুব রেগে আছেন মনে হল, কোনও উত্তর নেই।
কোটো হাতে আবার সোফার উপর চেপে বসলেন। পান খাবার লোভে আশুবাবুর চোখ চকচক করছে।
—’একটা দেবে নাকি ডাক্তার?’
কৌটো খুলতে খুলতে বড়মামা বললেন,—’দেবার জন্যেই তো এসেছি।’
কৌটো থেকে পান বেরোলো না, বেরোলো ইঞ্জেকসানের সিরিঞ্জ। আশুবাবু তো এত ভালো দৌড়তে পারেন জানা ছিল না। নিমেষে একটা কালো তাল উঠোনের ওমাথায় বাথরুমের দিকে গড়িয়ে গেল। দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল। বড়মামা সিরিঞ্জের পেছনে ধীরে ধীরে পিস্টনটা পরালেন। মুখে একটা লম্বা ছুঁট ফিট করে উঠে দাঁড়ালেন। বড়মামার চোখ দেখে মনে হল যেন বাঘ শিকারে যাচ্ছেন। দরজার দিকে মুখ করে বেশ ভারী গলায় আশুবাবুর পরিবারের উদ্দেশ্যে বললেন,—’কথাটা শোনা আছে নিশ্চয়—পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য। ইঞ্জেকসানটা তাহলে আপনাকেই নিতে হচ্ছে। কত্তা তো ভয়ে বাথরুমে পালালেন।’ বড়মামার কথা শেষ হবার আগেই দুটো মোটা হাত দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে বিদ্যুতের গতিতে ছিটকিনি খুলে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন—’নাউ হোয়াট টু ডু? সহজে ছাড়ছি না। ডাক্তার ডেকে ইয়ার্কি! এক ইঞ্জেকসানে ভূত ছাড়িয়ে দোব।’ বড়মামা বন্ধ বাথরুমের দরজার কাছে সিরিঞ্জ হাতে এগিয়ে গেলেন। আশুবাবু বাথরুমে বন্ধ। দরজায় একটা টোকা মেরে বড়মামা বললেন,—’কতক্ষণ বসে থাকবেন? আমিও রইলুম বাইরে দাঁড়িয়ে, ইঞ্জেকসান আনাকে নিতেই হবে।’
—’আমার কিছু হয়নি ডাক্তার। মিছিমিছি বলেছিলুম।’
—’কি বলেছিলেন শুনি?’
—’ওই পরিবারকে জব্দ করার জন্যে। একমাস কথা বন্ধ করে দিয়েছিল কেন? তাই তো বলেছিলুম।’
—’কি এমন বলেছিলেন যে রোজা ডাকতে হল ভূত ছাড়াবার জন্যে?’
—’বলেছিলুম, রোজ রাতে ঘর অন্ধকার করে শুলেই কে যেন কানের কাছে বলছে, আশু, আর কেন, তোর দিন তো শেষ হয়ে এল রে! আর বলেছিলুম, কানের কাছে অষ্টপ্রহর কে যেন কাঁসর ঘণ্টা বাজাচ্ছে। সব মিছে কথা ডাক্তার। ভয় দেখাবার জন্যে বলেছিলুম।’
—’সব বুজেছি, এখন দয়া করে বেরিয়ে আসুন, পিঠের যা অবস্থা, পাঁচলাখ পেনিসিলিন ঠুকে না দিলে বিষিয়ে মারা যাবেন!’
—’ইঞ্জেকসান আমি নেবো না ডাক্তার, তোমার পায়ে পড়ি। ইঞ্জেকসানে আমার ভীষণ ভয়। আমার বাবা ওইতেই মারা গিয়েছিলেন।’
—’তা বললে তো চলবে না। দেখেছি যখন আমার ডাক্তারের কর্তব্য করতেই হবে।’
—’তোমাকে আমি ডবল ফী দোবো ডাক্তার। একমাস বিন পয়সায় বড় বড় সন্দেশ খাওয়াবো, যত পার।’
—’ঘুষ আমি খাই না আশুদা।’
আশুবাবু ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন,—’দয়া কর ডাক্তার। তোমার আমার কি? তুমি আছ ফাঁকা হাওয়ায়, আমি এদিকে গরমে, গন্ধে মারা যেতে বসেছি।’
—’সেই জন্যেই তো দাঁড়িয়ে আছি। বেরোনো মাত্রই ফ্যাঁস।’
আশুবাবুর আর সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। বড়মামা আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন। বাথরুমের ভেতর ভারী কিছু এটা পড়ে যাবার শব্দ হল।
—’কি হল বল তো!’
—’বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।’
—’হার্ট ফেল করেনি তো!’
—’দেখতে তো পাচ্ছি না বড়মামা, তবে ভয়ে অনেকে হার্টফেল করে।’
—’সে কি রে? পুলিশ কেস হয়ে যাবে যে! চল পালাই।’ বড়মামা ছুটে সাইকেলের কাছে গেলেন। আমিই ছুটলুম পেছন পেছনে।
বড়মামার সাইকেল ছুটেছে হাওয়ার বেগে। ঝড় ঝড় ঝড় ঝড় শব্দ করছে। ইটে পড়ে মাঝে মাঝে বেমক্কা লাফিয়ে উঠছে। কোনও রকমে কেরিয়ারে ঝুলে আছি।’
কিছু দূরে গিয়ে বললেন,—’কোথায় যাই বল তো! চল পালাই। একটু পরেই তো পুলিশ আসবে। তারপর অ্যারেস্ট। ওরে বাবারে!’ বাবারে বলা মাত্রই বড়মামা টাল সামলাতে না পেরে সাইকেল সুদ্ধ উলটে পড়ে গেলেন! আমিও কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লুম।
ধুলোর উপর শুয়ে শুয়েই বড়মামা বললেন,—’চল থানায় গিয়ে সারেন্ডার করি। তুই আমার সাক্ষী। উলটোপালটা কিছু বলবি না।’
ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। মনে হল, গলা ছেড়ে মেজোমামা-আ বলে চিৎকার করি।
থানা অফিসার টেবিলে মোটা রুল-কাঠ ঠুকতে ঠুকতে বড়মামার বক্তব্য শুনলেন। কিছু বুঝলেন বলে মনে হল না। ব্যাপারটাকে বোঝার জন্যে আগাগোড়া নিজেই একবার বলে গেলেন—’আশু ময়রা বাথরুমে ঢুকেছে। বেশ, ঢুকলো, ছুটে গিয়ে দরজা বন করল। ছুটে গেল কেন? ও বুজেছি। ভীষণ বেগ এসেছিল। আসতেই পারে, আমারও আসে, সকলেরই আসে। ভারী কিছু পড়ে যাবার শব্দ শুনলেন? ভারী, ভারী।’ ভারীর জায়গাটায় এসে অফিসার খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাঁর চিন্তা দেখে আমরাও কাঠ হয়ে বসে রইলুম।
হঠাৎ অফিসার চিৎকার করে উঠলেন,—’বুঝেছি। বেগ যখন প্রবল তখন শব্দও তো ভারী হবে। দুই আর দুয়ে চার। সেই শব্দ শুনে ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে আপনি দৌড়ে চলে এলেন থানায়। কেন এলেন?’
বড়মামা বললেন,—’আমার মনের হচ্ছে, আশুবাবু ইজ ডেড।’
‘ডেড!’ অফিসার হো হো করে হেসে উঠলেন,—’বাথরুমে আশু ডেড। বেশ ডেড। ধরে নিলুম ডেড। এতে আসুর অপরাধটা কোথায়? অ্যারেস্ট করার মতো অপরাধটা সে কি করেছে? আমি তো মশাই কিছুই বুজছি না। এতে পুলিশ আসে কোথা থেকে?’
বড়মামা বোকা বোকা মুখে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ কোনও তরফেই কোনও কথা নেই। শেষে অফিসার হাসি হাসি মুখে বললেন,—’পাবেন না, কিচ্ছু খুঁজে পাবেন না। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের কোথাও লেখা নেই—বাথরুমে ছুটে যাওয়া অপরাধ, কিংবা, শব্দ করে মল ত্যাগ করা অপরাধ। ইনডিসেন্ট বলতে পারেন? তাই বা বলি কি করে নেচারস কল।’ অফিসার উঠতে যাচ্ছিলেন, বড়মামা বললেন, ‘আর একটু। আর একটা কথা।’ অফিসার বসে পড়লেন,—’বলুন। তবে যা-ই বলুন, যে ভাবেই বলুন, কোর্টে প্রমাণ করতে পারবেন না। আশুকে জব্দ করতে চান, অন্যভাবে করুন, বাথরুম থেকে কায়দা করে বের করে এনে রাস্তায় করান, পাঁচ আইনে ফেলে দোবো।’
বড়মামা বললেন,—’সে কথা নয়। ধরুন, কেউ এসে বলল, আশুবাবুকে আমি মেরে ফেলেছি। তা হলে?’
অফিসার রুল নাড়া বন্ধ করলেন—’সে তো মশাই সাঙ্ঘাতিক কথা! না, দাঁড়ান, হঠাৎ লোকে এমন কথা বলবে কেন? আর বললেই বা আমি বিশ্বাস করব কেন? আমরা কি কান-পাতলা লোক?’
—’না, ধরুন যদি বলে?’
—’বললেই হল! আচ্ছা বেশ বলল। তখন আমরা ইনভেসটিগেশানে যাব। দেখবো কি ভাবে মার্ডার করেছেন। পোস্ট-মর্টেমে পাঠাবো। ফরেনসিক রিপোর্ট আসবে। ফিঙ্গার প্রিন্ট নেবো। সেই প্রিন্টের সঙ্গে আপনার হাতের প্রিন্ট মেলাবো। মার্ডারের জায়গায় দেখবো খুনী কিছু ফেলে গেছে কিনাই! মার্ডার কি মশাই ছেলে খেলা নাকি! অনেক জল ঘোলা করে তবে খুন হয়। অত সোজা নয় মশাই। ও সব আপনার কম্ম নয়। ভুলে যান ওসব।’ কথা শেষ করে অফিসার একটা হাঁক ছাড়লেন,—’রাম খেলোয়ান!’ দূর থেকে উত্তর এল,—’যাই হুজুর।’
—’টিফিন কেরিয়ার লে আও, আমি ফ্র্যাঙ্কলি বলছি মশাই, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, খেতে বসব, আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।’
বড়মামা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন—’একটা কথা।’
—’একটা একটা করে অনেক কথা সেই থেকে বলে গেলেন, আর একটাও কথা নয়।’
—’না না, কথা নয়। একটা পারমিশান। আমরা এই থানার কাছে ঘুরে বেড়াতে পারি?’
—’হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘুরুন না, যত খুশি ঘুরুন। কত চোর ছ্যাঁচোড় ঘুরছে, আপনারা তো সৎ নাগরিক।’
আমরা দু’জনে রাস্তায় এসে দাঁড়ালুম। —কিছু দূরেই একটা বটতলা। বটতলায় এসে আমরা পাশাপাশি বসলুম। পাশে সাইকেলটাকে দাঁড় করানো রইল। বড়মামা আমার কানে কানে বললেন,—’কোনও আশা নেই রে। নির্ঘাৎ প্রমাণ হয়ে যাবে। আমার ব্যাগটা আশুর বাড়িতে ফেলে এসেছি।’ আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলুম, আমারও চটি দু’পাটি ফেলে এসেছি।
—’বড়মামা, এখানে বসে থেকে কি হবে?’
—’তুই বুঝছিস না। যে কোনও মুহূর্তে আশুর বাড়ির লোক থানায় এসে যেতে পারে। এলেই আমি অফিসারের কাছে আত্মসমর্পণ করবো। এতে সাজা অনেক কমে যাবে।’ বটতলায় বসে বসে দেখছি লোকজন আসছে যাচ্ছে। গাড়ি বেরোচ্ছে ঢুকছে। সারাদিন খাওয়া নেই দাওয়া নেই। খিদেতে পেট চুঁই চুঁই করছে। বড়মামার পকেটে লজেন্স আর নেই। সূর্য ক্রমশ পশ্চিমে ঢলে পড়ল। বটের ডালে ডালে পাখিদের কিচির-মিচিরও থেমে গেল।
—’বড়মামা, আর কতক্ষণ?’
—’আর একটু দেখি রে! বলা যায় না। প্রথমে দরজা ভেঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তারপর ওই পিঠে ঝ্যাঁটার দাগ! দেখবি আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দেবে। সাংঘাতিক জাঁহাবাজ মেয়েছেলে। একটা দিন একটু কষ্ট কর না আমার জন্যে। আমি ওই গারদে ঢুকলেই তুই চলে যাবি। তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে সাক্ষীর কাঠগড়ার কোর্টে।’
থানার পেটা ঘড়িতে দশটা বাজল। আমি বোধহয় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। বড়মামা বোধহয় ঢুলতে ঢুলতে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। পেটা ঘড়ির কানফাটানো শব্দ আর মেজোমামার ডাক ও ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসলুম। প্রথম ঘুম-চোখে বুঝতেই পারছিলুম না কোথায় আছি। বড়মামা ভেবেছেন ভোর হয়েছে, শুয়ে শুয়েই চোখ না খুলে বললেন—’রেখে যা।’
—’কি রেখে যাবো?’
—’তুই চা নিয়ে এলি কেন? কষ্ট করে তোকে আবার কে আনতে বললে?’
—’চা নয়, চা নয়, উঠে বোসো।’ মেজোমামা ধাক্কা মারলেন।
বড়মামা ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন,—’সারেন্ডার।’ মেজোমামার কাছে সারেন্ডার করায় মেজোমামা খুব খুশি হলেন। আমি তো জানি ব্যাপারটা কি?
মেজোমামা বললেন,—’সারেণ্ডার করে ভালোই করলে; কিন্তু তোমার আক্কেলটা কি? বটতলায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ, এদিকে আমরা ভেবে মরি। আশু ময়রা সেই দুপুরবেলাই লোক দিয়ে তোমার ব্যাগ, ফী’র টাকা, এক চ্যাঙারি ইয়া বড় বড় সন্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। লোকটি বললে, ডাক্তারবাবুর বড় বাইরে পেয়েছে বলে তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। তোর চটি দু’পাটিও দিয়ে গেছে। কি হয়েছিল তোমাদের? থানায় ডায়েরি করতে এসেছিলুম, অফিসার বললেন, খুঁজে নিন কাছাকাছি আছেন, বড়টির মাথাটা গেছে, ছোটটাকে বোবা বলেই মনে হল।’
বড়মামা লাফিয়ে উঠে বললেন,—’আশু বেঁচে আছে?’
‘বেঁচে আছে মানে? বহাল তবিয়তে আছে। আসার সময় দেখে এলুম গরম গরম রসগোল্লা ছাঁকচে। বেশি না, গোটা আষ্টেক খেলাম। বেশি মিষ্টি খাওয়া ভালো নয়। সকালে ওই সন্দেশ থেকে গোটা আষ্টেক খেয়ে ফেলেছি খাবো-না খাবো-না করে।’
বড়মামা করুণ চোখে তাকালেন। —’বড্ড খিদে পেয়েছে রে মেজো।’
—’চল, বাড়ি চল, কিছু জোটে কিনা দেখি।’
বড়মামা জুতো খুলে রেখেছিলেন। দাঁড়াবার আগে পা গলায়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠলেন,—’আমার জুতো।’ ঝুঁকে পড়ে আমরা সবাই দেখলুম, জুতো নেই, মিসিং। এর পরের লাফটা আরও বড়,—’আমার সাইকেল!’ বটতলাটা গোল হয়ে প্রদক্ষিণ করা হল, সাইকেলও নেই।
—’বুঝেছি!’ বড়মামা বললেন, আমরা না বুঝে হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। মেজোমামা বললেন,—’কি বুঝলে?’ উত্তর পাওয়া গেল না, বড়মামা হনহন করে থানায় গিয়ে ঢুকলেন। আমরা পেছনে পেছনে। অফিসার চেয়ারে একটা পা তুলে ভীষণ চিৎকার করে ফোনে কথা বলছিলেন—’দুটোর মাথা ঠুকে দে। পেটে গোটাকতক রুলের গোত্তা মার।’ কথা আর শেষ হতেই চায় না। ফোন নামাতেই বড়মামা বললেন,—’আমার জুতো আর সাইকেলটা দিন স্যার, এইবার বাড়ি যাই।’
অফিসারের মুখের নীচের চোয়ালটা ঝুলে পড়ল। জীবনে আমি কাউকে এমন অবাক হতে দেখিনি। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন তারপর বড়মামার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বললেন,—’আমি কালই ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি। দয়া করে আমায় মুক্তি দিন। সকালে ছিল খুন, এখন জুতো আর সাইকেল। আমাদের সারাদিন বড্ড খাটতে হয়, সব সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না।’
বড়মামা অফিসারের বিনয়ে একটু ঘাবড়ে গেলেন,—’না, ঠিক ইয়ার্কি নয়, সাইকেল আর জুতোটা পাচ্ছি না। ঘুমোচ্ছিলুম তো, তাই ভাবলুম যদি তুলে রেখে থাকেন।’
—’আমাদের কি দায় পড়েছে মশাই ধরে ধরে লোকের জিনিস তুলে রাখবো? কাল সকালে এসে খুঁজে নেবেন। আজ অন্ধকার তো।’
বড়মামা বললেন,—’তাই হবে।’
থানার বাইরে এসে বড়মামা বললেন,—’জুতোটা না হয় বুঝলাম ছোট জিনিস। কুকুরও নিতে পারে। কিন্তু সাইকেল একটা বড় জিনিস। সেটা কেন খুঁজে পাচ্ছি না? কাল ভোরে এসে দেখতে হবে।’ উত্তরে মেজোমামা খুক খুক করে একটু কাশলেন।
বড়মামা খুব নিরীহের মতো প্রশ্ন করলেন,—’কি রে, ঠান্ডা লেগেছে নাকি? কতদিন তোকে বারণ করেছি পুকুরে স্নান করিসনি। বড়দের কথা শুনবি না তো।’
মেজোমামা বললেন—’ঠান্ডা নয়। গলাটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। অনেক মিষ্টি খেলাম তো সারাদিনে।’
ছ’ফুট লম্বা বড়মামা আগে চলেছেন খালি পায়ে। আমরা পেছনে। মেজোমামা বললেন,—’নেবে নাকি আমার এক পাটি জুতো? তোমার ডান পায়ে কড়া, আমার বাঁ পায়ে। ভালোই হয়েছে। ভাগাভাগি করে নেবো।’
—’থাক, খুব হয়েছে। একবার তো দেখেছ, এখন ক্ষান্তি দাও। সে বেচারা দোকান বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। যাই বল, আশু হল জাত শিল্পী। যেমন রসগোল্লার হাত, তেমনি সন্দেশে। আমাদের পেনেটি গ্রামের গর্ব। হাত দুটো সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া উচিত।’
—’রাখ রাখ।’ বড়মামা অন্ধকার থেকে উত্তর দিলেন।
—’সুধাংশু মুকুজ্জের নাম ক’টা লোক মনে রাখবে? আমাদের আশু ময়রা অমর।’
মনে হল, বড় মামার চলার গতি বেড়ে গেল। এক পায়ে জুতো, এক পা খালি। হাঁটাটা তাই অদ্ভুত দেখাচ্ছে।