উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

বড়মামার মিনেজারি

বড়মামার মিনেজারি

হাড়ের নস্যির ডিবে। আগে কখনো দেখিনি। পুরী থেকে স্পেশাল আমদানি। বড়মামার এক রোগী পুরী থেকে এনে প্রেজেণ্ট করেছে, পুরস্কার। ভদ্রলোক একদিন বেদম হাসছিলেন। চোয়াল আটকে হাঁ হয়ে গেল। কোনও ডাক্তারেই কিছু করতে পারে না। শেষ বড়মামা। বড়মামা সেই সময় বাড়িতে সিল্কের লুঙ্গি পরে পেয়ারের কুকুর লাকিকে ওঠবোস করাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক হাঁ করে রিকসা থেকে নেমে এলেন। ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে বড়মামাও হাঁ। ভদ্রলোকের বাড়িতে সেদিন মাংসের ঝোল হয়েছিল। চোয়াল আটকে গেলে খাওয়া যায় নাকি? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। ঝোল জুড়িয়ে জল। এখন শেষ ভরসা বড়মামা।

লাকিও ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে হাঁ। আশেপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও হাঁ। বড়মামা মিনিট খানেক কী ভাবলেন! তারপর ঠেসে এক চড় ভদ্রলোকের গালে। খুট করে একটা শব্দ হল। ভদ্রলোকের চোয়াল নিমেষে খুলে গেল। এক মুখ হাসি। বড়মামাকে জড়িয়ে ধরে সে কি আদর! বড়মামা যত বলেন, ‘ছাড়ুন ছাড়ুন, কাতুকুতু লাগছে,’ আদর যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে! শেষে লাকি যখন রেগে গর গর করে উঠল ভদ্রলোক তাঁর উচ্ছ্বাস সংযত করলেন।

—মশাই, পাঁচকড়ি বসে বসে তারিয়ে তারিয়ে আমার মাংস আমারই চোখের সামনে খেয়ে যাবে, বলুন সহ্য করা যায়! পাঁচকড়ি ভদ্রলোকের বেকার ভাই। বড়মামা বললেন,—আজকের দিনটা লিকুইড খেলেই ভালো হয়। —লিকুইড তো, মাংসের ঝোলটাই তো বেশি, পাঁচশো মাংস আর ক’টা টুকরো বলুন। ঝোলের সঙ্গেই গিলে নেব। কড়কড়ে আটটা টাকা হাতে গুঁজে দিয়েই পাঁচকড়ির দাদা সাতকড়ি রিক্সায় উঠলেন। চড় মামার ফি। সেই সাতকড়িবাবুই নস্যির ডিবেটা দিয়েছেন।

নস্যির ডিবেটা সিল্কের লুঙ্গি দিয়ে পালিশ করতে করতে বড়মামা বললেন,—তুই আমার কাছে শুবি। ফাসক্লাস তিন তলার ঘর। বড় বড় জানালা। ফুর ফুর করে হাওয়া খেলে যাচ্ছে। দুজনে মজা করে পাশাপাশি শোব। গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ব। বড়মামা এক টিপ নস্যি নিলেন সশব্দে। মেজোমামা জানালার কাচ পালিশ করছিলেন। মেজোমামার হল পরিষ্কার বাতিক। সব সময় কাঁধে ঝাড়ন নিয়ে ঘুরছেন। আসা-যাওয়ার পথে এটা ওটা সেটা ঝাড়ছেন। সিঁড়ির হাতল, খাটের মাথা, টেবিল, ফুলদানি। তখন পড়েছিলেন জানালার কাচ নিয়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শোবে শোও, তবে অপঘাতে মরলে আমাদের দোষ দিও না।’ আমি অবাক হয়ে বড়মামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। বড়মামা ইশারায় নিজের মাথার উপর একটা আঙুল বার কতক গোল করে ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিলেন মেজোর মাথার গণ্ডগোল আছে। জানালার কাচে বড়মামার হাত ঘোরানো মেজোমামা দেখতে পেয়েছিলেন, ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন,—’হ্যাঁ, আমার মাথার গোলমাল তো হবেই, তোমার মাথাটা খুব ঠিক আছে, তাই তো। বাড়িটা তো একটা চিড়িয়াখানা বানিয়েছ! ছটা গরু, কোনওটার দুধ নেই। খাচ্ছে দাচ্ছে, নাদা নাদা হাগছে। মশার চোটে বাড়িতে টেঁকা যাচ্ছে না। চার চারটে কুকুর, ঠাকুর ঘরে চুরি হয়ে গেল! দুটো কাকাতুয়া সারাদিন চেল্লাচ্ছে। কার্নিসে একঝাঁক পায়রা অনবরত মাথায় পায়খানা করছে।’ বড়মামা খুব রেগে গেলেন,—’তাতে তোর কি, তোর কি অসুবিধে হয়েছে?’ মেজোমামার কাচ পরিষ্কার বন্ধ হয়ে গেল,—’আমার কি? আমার কি তাই না? তোমার লাকি সকাল বেলা কার্পেট ভিজিয়েছে। তোমার গরু লক্ষ্মী, সকালে আমার বাগানে ঢুকে সব গাছ মুড়িয়ে খেয়েছে। তোমার কাকাতুয়া সকালে ডানার ঝাপটা মেরে আমার চোখের চশমা ফেলে কাচ ফাটিয়ে দিয়েছে।’

বড়মামা আবার এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন,—’লাকি, লাকির পেচ্ছাপ গোলাপ জল, জানিস ও রোজ ডগসোপ মেখে চান করে। তুই তো সাত জন্মেও চান করিস না।’ মেজোমামা কিছুক্ষণ বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলেন তারপর বিস্ফোরণ—’ওঃ, গোলাপ জল, তাই না! এবার থেকে বিয়ে বাড়িতে ওটাকে নিয়ে যেও, কাজে লাগবে। ভাড়া খাটাতে পার তো, গোলাপ জল ছিটিয়ে আসবে। কার্পেট তুমি পরিষ্কার করবে, আমি পারব না।’

—’আমার সময় কোথায়, জানিস আমার গর্জমান প্র্যাকটিস।’ বড়মামা রোরিং-এর বাঙলা করলেন গর্জমান। প্রতিজ্ঞা করেছেন, যখন বাংলা বলবেন ‘পিওর বাংলা’ যখন ইংরেজি তখন ‘খাঁটি ইংলিশ।’

—’তোমার প্র্যাকটিস আমার জানা আছে, যত চড়-চাপড় মেরে বুদ্ধু লোকের কাছ থেকে টাকা বাগাও।’ মেজোমামা সেই সাতকড়ির চোয়াল আটকে যাবার কেসটা বললেন।

—’তুই ডাক্তারির কি বুঝবি। এ কি তোর ফিলজফি!’ বড়মামা মেজোমামার দর্শন নিয়ে এম.এ. পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন।

—’তোমার গরু যদি কাল আমার বাগানে ঢোকে, আমি খোঁয়ারে দিয়ে আসব।’ মেজোমামা এইবার গরু দিয়ে বড়মামাকে কাবু করার চেষ্টা করলেন।

—’ঠিক আছে, খাঁটি ক্ষীরের মতো দুধ হলে তোকে দেখিয়ে খাব।’ বড়মামা লোভ দেখালেন।

—’দুধ!’ মেজোমামা একখানা নাটকীয় হাসি ছাড়লেন। —’কার দুধ? লক্ষ্মীর দুধ! ওর পেটে দুধ ভরে বাঁটের কাছে একটা কল ফিট করে দিলে তবে যদি দুধ পড়ে, বুঝেছো? ছ’বছরেও যে দুধ দিলে না, তার দুধ তুমিই খেও। ডুমুরের ফুল দেখেছ, সাপের পা দেখেছ, সোনার পাথর বাটি দেখেছ, কুমিরের চোখে জল দেখেছ!’ মেজোমামা মনে হয় উপমার বন্যা বইয়ে দিতেন যদি না সেই সময় ঘরে ছোটোমাসি ঢুকতেন!

ছোটোমাসির হাতে একটা শাড়ি। মেজাজ একেবারে সপ্তমে। —’বড়দা এটা কি হয়েছে?’ শাড়িটার একটা দিক টুকরো টুকরো। মনে হয় কেউ চিবিয়েছে। বড়মামা নস্যির ডিবেটা নাচাতে নাচাতে বললেন,—’ছিঁড়ে ফেলেছিস?’

বারুদে যেন আগুন লাগলো,—’আমি ছিঁড়েচি! তোমার খরগোশের কীর্তি।’

—’যাঃ, খরগোশে তোর শাড়ি চিবোতে যাবে কেন?’ বড়মামার অবিশ্বাস।

—’যাবে কেন? তোমার খরগোশ কোনও কিছু আস্ত রেখেছে। স্টেনলেস স্টিলের বাসনগুলোও চেষ্টা করেছিল, পারে নি।’ মেজোমামা মনে হল বেশ খুশি। মেজোমামা বললেন,—’খরগোশের পেটে সব কিছু যাবার আগে রোস্ট করে ওগুলোকে পেটে পুরে দে।’ বড়মামা যেন শিউরে উঠলেন। —’কাপড় তুই যেখানে সেখানে ফেলে রাখিস কেন, কেয়ারলেসের মতো?’ —’যেখানে সেখানে!’ মাসিমা তেড়ে এলেন, —’বাসকেটে রেখেছিলুম ছাড়া কাপড়ের সঙ্গে, সেখানে গিয়ে ঢুকেছে শয়তানগুলো।’ —’বাসকেটে কেউ কাপড় রাখে?’ —বড়মামা দোষটা মাসিমার ঘাড়ে চাপাতে চাইলেন। —’ছাড়া কাপড় বাসকেটেই রাখে বড়দা, চিরকাল তাই রাখা হয়।’ বড়মামা হাল্কা চালে বললেন,—’আর রাখিস নি। ছাড়া কাপড় একটু উঁচুতে রাখিস।’ —’কড়িকাঠে ঝুলিয়ে রাখব, কিংবা মাথায় করে নিয়ে ঘুরবো এবার থেকে।’ মাসিমা রেগে বেরিয়ে গেলেন।

মেজোমামার আবার আক্রমণ,—’তোমার খরগোশ সেদিন আমার চটি জুতো খেয়েছে। বলো, চটি এবার থেকে মেঝেতে খুলে না রেখে মাথায় করে ঘুরে বেড়াস?’ বড়মামা ফাইন্যালি এক টিন নস্যি নিয়ে বললেন,—’দেখ মেজো, আমার বাবার বাড়িতে আমি যা খুশি তাই করতে পারি, তোদের পছন্দ না হয় আমার কিছু করার নেই। গরু আমার থাকবে, কুকুর থাকবে, কুকুর আমার বিশ্বস্ত বন্ধু, বেটার দ্যান মেন, পাখি আমার দাঁড়ে ঝুলবে, খরগোশ আমার নেচে নেচে ঘুরবে। পৃথিবীর পশু জাতি আমার বন্ধু, আমার ফ্রেন্ড।’ মেজোমামা কি বলবেন একটু যেন ভেবে নিলেন, তারপর ছাড়লেন তাঁর উত্তর—’বাড়িটা তোমার একলার নয়, বুঝেছ। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে একটু মিলে মিশে থাকতে হয়। এরপর তুমি একটা কেঁদো বাঘ আমদানী করবে, তারপর একটা বিটকেল ভাল্লুক। একদিন বাড়ি ফিরে দেখলে আমরা সব ক’টা চলে গেছি পেটে, হাড় ক’খানা পড়ে আছে। তোমার বাঘ বসে বসে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। তখন কি হবে! বলো কি হবে!’

‘ঘোড়ার ডিম হবে’, বড়মামার নির্বিকার উত্তর। —’ভাল্লুক কেউ পোষে না, কথার কথা বললেই হল, না! আসলে তোরা ভীষণ মিন মাইন্ডে, আত্মসুখী, তোদের কোনও ক্যারেকটার নেই!’

—’কী বললে? আমরা চরিত্রহীন! তোমার ভারি চরিত্র আছে, না? জোচ্চোর ডাক্তার। তুমি আর কথা বোলো না। রামকৃষ্ণ কী বলে গেছেন জানো, ডাক্তার আর উকিলরা কখনো সিদ্ধিলাভ করতে পারে না।’ মেজোমামা এক নিঃশ্বাসে কথা ক’টা বলে গেলেন। বলে যেন বেশ তৃপ্তি পেলেন।

বড়মামা এক টিপ নস্যি বেশ সশব্দে নাকে গুঁজে বললেন, ‘পশু-পক্ষী নিয়েই আমি থাকব। তোরা হলি বিষাক্ত সাপ।’ তারপর আমাকে বললেন,—’তুই আমার একমাত্র ভাগ্নে। তুই এইসব নোংরা আদমিদের সঙ্গে একদম থাকবি না, আমার তিন তলার ঘরে আরামে ফুরফুরে হাওয়ায় আমার পাশে ঘুমোবি, সকালে আমার সঙ্গে বেড়াবি। বিকেলে লাকির সঙ্গে খেলবি।’ মেজোমামা কান খাড়া করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ,—’ভাগ্নে তোমার একলার নয়, আমাদের সকলের, আমরা সকলেই তার ভাগ পাব। তুমি বেচারাকে তিনতলার ঘরে পুরে সারারাত ফুটবল খেলবে, তা হবে না, আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আই প্রোটেস্ট।’

—’তোর প্রোটেস্ট?’ বড়মামা হাসলেন— ‘তোর মতো অমানুষের হাতে একে আমি ছেড়ে দিতে পারি না।’

অমানুষ বলায় মেজোমামা ফিউরিয়াস। —’অমানুষ কাকে বলে জানো? পশুদের কাছাকাছি যারা থাকে তারাই অমানুষ। পশুদের নিয়ে এ বাড়িতে কে থাকে? তুমি থাকো। সুতরাং অমানুষ তুমি, আর তাই ছেলেটা তোমার হেফাজতে যাতে চলে না যায়, আমাদের দেখতে হবে!’

এইবার বড়মামার হাসবার পালা,—’তুই দেখবি! তোকে কে দেখে তার ঠিক নেই, তুই দেখবি! তুই সারা বাড়ির ধুলো আর নোংরা ছাড়া তো কিছুই দেখতে পাস না, আগের জন্মে বোধহয় ধাঙড় ছিলিস।’ মেজোমামাও ছাড়বার পাত্র নন,—’তোমার মতো অপদার্থরা বাড়িতে থাকলে আমাদের মতো পদার্থওয়ালাদের তো খাটতেই হবে। তোমার পাখি, তোমার পেয়ারের কুকুর, তোমার শুকনো গরু, তোমার বোকা রুগীর দল চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িটাকে ডাস্টবিন বানিয়ে যাচ্ছে। আমি আছি বলে বাস করতে পারছ, চলে গেলে বঝবে ঠ্যালা। Cleanliness is next to godliness, বুঝেছো। আমি হলুম সেই God!’

বড়মামার বিস্ময়। —’তুই হলি গিয়ে God আর আমরা হলুম Demon’, বড়মামার সে কি প্রাণখোলা হাসি। —’গায়ত্রী জপ করতে জানিস? গলায় তোর পৈতে আছে? সেটাকে তো বহুকাল ধোপার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিস।’ বড়মামার কথা শেষ হবার আগেই মাসির তাড়া খেয়ে সবচেয়ে বড় খরগোশটা, যেটাকে আমরা পালের গোদা বলি, সেটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরে এসে ঢুকল। মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে ফেদার ডাস্টার তুলে সেটাকে পেটাতে যাচ্ছিলেন। বড়মামা খরগোশটাকে তুলে নিয়ে বললেন,—’এই যে God, জীবে দয়া করার কথাটা বুঝি তোর শাস্ত্রে লেখা নেই! শুধু জিভে দয়াটাই বুঝেছিস, না?’

বড়মামা এক বগলে খরগোশ অন্য বগলে আমাকে নিয়ে বাগানে চলে এলেন। বড়মামা জুট মিলের ডাক্তার। মিলের দুটো জোয়ান ছেলে বড়মামার চাকর কাম এডি-কং কাম কনফিডেনসিয়াল এডভাইসার। একজনের নাম রতন আর একজনের নাম প্রফুল্ল। রতনের মুখের ডানদিকে একটা গভীর কাটা দাগ লম্বা হয়ে ভুরুর কাছ থেকে দাড়ি অবধি নেমে এসেছে। মিল এলাকায় কে যেন ছোরা মেরেছিল বছর কয়েক আগে। বড়মামা খুব জোর চোখটা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রতনের ভগবান বড়মামা। প্রফুল্লর একবার কার্ডিং মেশিনে হাত ঢুকে প্রায় ছিংড়ে গিয়ে কনুইয়ের কাছ থেকে ঝুলে গিয়েছিল। বড়মামা খুব কায়দা করে জোড়াতালি মেরে হাতটা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

মেজোমামার সখ ফুলবাগান। বড়মামার ফল বাগান। রতন আর প্রফুল্ল তার মালি। শ’খানেক নারকেল গাছ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। কেরালার গাছ। মাথায় বেশি বড় হয় না। ছোট ঝাঁকড়া গাছ। কাঁদি কাঁদি ডাব নেমে এসেছে। রতন তারই একটায় উঠে, পাতার আড়ালে ঢুকে ছিল, পা দুটো খালি দেখা যাচ্ছিল। প্রফুল্ল ছিল বাগানে। কোদাল পেড়ে মাটি কোপাচ্ছিল। বড়মামা বাগানে আসা মানে তিনটে কুকুরও পেছনে পেছনে এসেছে। এর মধ্যে লাকি সবার আগে, কারণ সে হল পেয়ারের কুকুর। তার সাতখুন মাপ।

বড়মামা বললেন,—’ওই দ্যাখ, রতন তোর জন্যে ডাব পাড়ছে। এক একটা ডাবের কতটা ফল জানিস, ফুল দু’গেলাস, আর ইয়া পুরু নারকেল। তোর মেজোমামার ক্ষমতায় কুলোবে, পারবে তোকে কেরালার ডাব খাওয়াতে? এই তো বাগানের ছিরি, ক’টা দোপাটি, কলা ফুলের ঝাড়! প্রফুল্ল’—বড়মামা হাঁক ছাড়লেন। প্রফুল্ল কোদাল ফেলে, মিলিটারি কায়দায় এগিয়ে এল,—’শোন, শিগগির মোল্লার হাটে যা, দু’কেজি ফাসক্লাস মাংস নিয়ে আয়, আর আনবি দই। জানিস কে এসেছে, হামারা ভাগনে।’ প্রফুল্ল দৌড়োল হুকুম তালিম করতে। বড়মামা এক মুখ হাসি,—’এখান থেকে যখন ফিরে যাবি, তোর ওজন চার কেজি বাড়িয়ে তবে ছাড়ব। তোকে মাল্টি ভিটামিন খাওয়াব, ফেরাডল খাওয়াব, বোতলে ভরা নেবুর রস খাওয়াবো, দুধটা এবার খাওয়াতে পারব না, গরুগুলো খুব শয়তানি করছে।’ তারপর ফিস ফিস করে বললেন,—’মেজোটার নজর লেগে দুধ শুকিয়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, তার বদলে তোকে মোল্লারচকের দই খাওয়াব।’

রতনের দাঁতে ছুরি কোমরে দড়ি বাঁধা, হনুমানের লেজের মতো ঝুলে এসেছে। কাঁদি কাঁদি সবুজ ডাব দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে দিচ্ছিল।

মেজোমামার যে কেন ঠিক এই সময় বাগানে আসার দরকার পড়ে গেল কে জানে। মেজোমামার আবার সব ব্যাপারে নাক গলানো চাই। বিশেষত বড়মামার ব্যাপারে। দোপাটি গাছের চারায় বাঁশের কঞ্চির গোঁজ দিতে দিতে কাকে উদ্দেশ্য করে বললেন বোঝা গেল না,—’এরা সব দেশের শত্রু, কচি কচি ডাব পেড়ে নষ্ট করছে। কেরালার কচি ডাব পেড়ে নষ্ট করছে। কেরালায় কচি ডাব পাড়া সরকার আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। ঝুনো হলে নারকেল হয়, ছোবড়া হয়। দেশের কাজে লাগে। তা না, বাবুরা ডাবের জল খাবেন। ডাবের জলে কি আছে! ঘোড়ার ডিম আছে!’

বড়মামা বেশ বড় করে এক টিপ নস্যি নিয়ে বলেন,—’বুনো ফুলগাছ করেছিস, তাই নিয়ে থাক। ডাব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। আমার ডাব আমি বুঝব।’

—’তোমার ডাব মানে? গাছ আমাদের সকলের। জানো, তুমি কি অনিষ্ট করছ? দেশের কত বড় ক্ষতি করছ? নারকেল শুকিয়ে ‘ফোপরা’ হয়, সেই ‘ফোপরা’ থেকে নারকেল তেল হয়। নারকেল তেলের কিলো জানো?’

—’যা যা, তোর ফোপরা আর তেলের নিকুচি করেছে। ডাবের জল খেয়ে পেট ঠান্ডা হয়।’ বড়মামা একটা কাঁদির গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন। মেজোমামা বললেন,—’মাথা জোড়া যার টাক সে আর তেলের কী মর্ম বুঝবে! ছোবড়া থেকে কতরকম শিল্প হয় জানো? বিদেশে রপ্তানি করে কত টাকা রোজগার করা যায় জানো?’

—’আমার জেনে দরকার নেই। আমাতে আর আমার ভাগ্নেতে মিলে গেলাস গেলাস জল খাব, দুরমো নারকেল খাব ফুলো ফুলো মুড়ি দিয়ে।’

মেজোমামা আগাছা পরিষ্কার করতে করতে বললেন,—’তাই নাকি? বার করছি তোমাদের ডাব খাওয়া, আমি কোর্ট থেকে ইনজাংসান দেওয়াব।’

—’ইংজাংসান!’ বড়মামা হইহই করে হেসে উঠলেন, —’পাগলের পাগলামী বাড়িতে চলে বুঝেছিস, কোর্টে চলে না। ঘাস ওপড়াচ্ছিস ওপড়া, অন্যের চরকায় তেল দিতে আসিস নি।’

রতনের উপর হুকুম হল,—’যা, সমস্ত ডাব তেতলায় আমার ঘরে খাটের তলায় নারকেল পাতা বিছিয়ে সাজিয়ে রেখে আয়। আর এখন থেকে বলে রাখছি তোর মেজোবাবু যদি কোনো দিন বলে রতন পেট-গরম হয়েছে রে, একটা ডাব কাট তো। সোজা বলে দিবি, বাজারে গিয়ে খেয়ে আসুন। গাছের ডাব একটাও দিবি না। আমাকে আইন দেখাতে এসেছে, কোর্ট দেখাতে এসেছে।’

ব্যাপারটা কতদূর গড়াত কে জানে, হঠাৎ বড়মামার এক রোগী এসে গেল। একটা বাচ্চা ছেলে নাকে ন্যাপথালিনের বল ঢুকিয়ে ফেলেছে। বড়মামা প্রথমে পাত্তা দিতে চান নি। —’ন্যাপথালিন, আরে ভালোই তো, আস্তে আস্তে উড়ে যাবে, ভয়ের কী আছে।’ ছেলের মা নাছোড়বান্দা,—’উড়ে যেতে যেতে ছেলের এদিকে প্রাণ যায়, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। —’হাতের কাছে ওসব রাখো কেন?’ বড়মামার ধমক। —’উপায় কি না রেখে। আমাদের যে ন্যাপথালিনের কারবার! সারা বাড়িতেই ছড়ানো।’ বড়মামা বললেন,—’তাহলে বাড়িতে তো সব সময় একজন ডাক্তার রাখা উচিত, সেই বের করে দিয়ে আসবে, পেছনে ফিরতে না ফিরতেই তো আবার ঢোকাবে।’ ছেলের মা করুণ গলায় বললেন,—’আর একবার ঢুকিয়েছিল, নাকে চিমটে ঢুকিয়ে বের করে দিয়েছিলুম, এবার আর বেরোচ্ছে না, আপনি একটু দয়া করুন, ছেলেটাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, বড় হলে তারপর আনব।’

পাড়ার কলে বড়মামা সিল্কের লুঙ্গির উপর একটা গেরুয়া পাঞ্জাবি পরেই বেরিয়ে পড়েন। রতন পাঞ্জাবি আর ডাক্তারি ব্যাগটা নামিয়ে আনল। বাড়িরই সাইকেল রিকশা রেডি ছিল। রহমতুল্লা চালায়। বড়মামা কলে বেরিয়ে গেলেন। বাগানে আমি একা। লাকিটা তখন শুঁকে শুঁকে আমাকে টেস্ট করছে, আমার স্বভাব কি রকম। শুনেছি কুকুররা নাকি শুঁকেই বলে দিতে পারে মানুষটা চোর না সাধু।

মেজোমামার আবার কুকুর দু চোক্ষের বিষ। নিজের ফুল বাগান থেকে হেঁকে বললেন,—’এদিকে আয়। একলা আসবি, ওই শয়তানটাকে আনবি না।’ কুকুর যদি সঙ্গে সঙ্গে আসে আমার কি দোষ! মেজোমামা এক দাবড়ানি দিলেন,—’তোকেও এবার কুকুরে পেয়েছে!’—’আমি কী করব? পেছনে পেছনে আসছে যে!’—’ঠিক আছে তুই ওইখান থেকেই শোন, তুই কার দলে?’

কী উত্তর দেব, বললুম,—’নিরপেক্ষ, স্বতন্ত্রও বলতে পারেন।’

—’নিরপেক্ষ তো বড়র পেছন পেছন ঘুরছিস কেন?’ একটু ভেবে বললুম। —’ঘোরাচ্ছেন তাই ঘুরছি।’ মেজোমামা বললেন,—’ঘুরবি না, চুপ করে বসে থাকবি ঘরে, তুই আমাদের কমন ভাগ্নে।’ এমন জানলে কে আসত মামার বাড়িতে! দরকার নেই বাবা, মামার বাড়ির আদরে। আমি যে এখন কোন দলে যাই! মাসির কাছে যে ভিড়ব তারও উপায় নেই। তিনি তো সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নাচ নিয়েই ব্যস্ত। আর মাঝে মাঝে সময় পেলেই খরগোশে লাথি। লাথি মারার মতো খরগোশের অভাব বড়মামা রাখেননি।

সকালের খাওয়া যেমন গুরুপাক হল, রাতের খাওয়াও কিছু কমতি হল না। দুপুরে আবার গোটা দুই ডাবের জল! সব মিলিয়ে টইটম্বুর ভরা নদীর মতো অবস্থা। রাতের খাবার পর একটা বিশাল দাঁড়ানো টেবল ল্যাম্প জ্বেলে মেজোমামা মোটা একটা দর্শনের বইয়ে ডুবে গেলেন। সংসারে তখন কে কার। দু’বার পাশে ঘুর ঘুর করলুম, মনে হল মেজোমামা যেন চেনেনই না। দিশি কাপড়ের কোঁচার খুঁট কারপেটে লুটোচ্ছে। বড়মামার সবচেয়ে বড় খরগোশটা সোফার তলায় শরীর ঢুকিয়ে কেঁচার খুঁট চিবোচ্ছে। মেজোমামাকে বললুম। গ্রাহ্যই করলেন না। শেষে বললেন, যা বললেন তার মানেও বুঝলুম না, সংসারে কিছুই চিরকাল থাকে না। শরীরটাই যখন চলে যাবে তখন তুচ্ছ কোঁচার খুঁট। আবার সকালেই চায়ের টেবিলে মেজোমামার অন্য রূপ দেখব। কাঁধে ঝাড়ন। এটা ঝাড়ছেন ওটা ঝাড়ছেন। তখন এই চিবোনো কাপড় নিয়ে বড়মামার সঙ্গে ধুম লেগে যাবে। মাসিমাকে হুকুম হবে, ‘আজই খরগোশের রোস্ট বানা।’

রাত ১১টা নাগাদ বড়মামা বললেন,—’চল এবার শোয়া যাক।’ আমি একটা শোফার উপর ঘুমিয়েই পড়েছিলুম। ধড়মড় করে উঠে বসলুম। ঘুম চোখেই সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে তিন তলায় উঠে এলুম। পিছন পিছন লাকি। বড়মামার হাতে পাঁচ সেলের একটা টর্চ। বড়মামার ঘরটা বেশ বড়ই। বিশাল একটা খাট। খাটের তলায় ডাবের গোডাউন। চারিদিকে বড় বড় জানালা। দুটো জানালা ছাদের দিকে। সারা ছাদ চাঁদের আলোয় ফুটফুট করছে। পিন পড়লে খুঁজে নেওয়া যায়।

ছাদের দিকের জানালা দুটো বন্ধ করে দিলেন।—’বন্ধ করছেন?’

—’তোর তো আবার সর্দির ধাত।’ বড়মামার উত্তরে অবাক হয়ে গেলুম, —’কে বললে আমার সর্দির ধাত।’ বড়মামা বললেন,—’আমি জানি। জানিস আমি ডাক্তার।’

—’তা জানি, কিন্তু আমার সর্দিকাশি বহু বছর হয়নি।’ আমি একটু প্রতিবাদ করে ফেললুম। বড়মামা বললেন,—’দেখি তোর নখ।’ অবাক হয়ে হাতের দশটা আঙুল টর্চের আলোর তলায় মেলে ধরলুম। —’এই দেখ’, ‘বড়মামা দেখালেন,—’দেখছিস নখের উপর সাদা ফুল। ক্যালসিয়ামের অভাব। সর্দি তোর হবেই, হতে বাধ্য। দাঁড়া, আমার গরুর দুধ হোক। দুই খাইয়ে তোর সর্দি সরিয়ে দেব।’

বিছানার উপর কেমন চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ছিল। জানালা বন্ধ করে বড়মামা চাঁদের আলো আসার পথ বন্ধ করে দিলেন। —’কেমন চাঁদের আলো আসছিল সমুদ্রের জলের মতো,’ আমি খুঁতখুঁত করে উঠলুম। —’চাঁদের আলো!’ বড়মামা চমকে উঠলেন,—’চাঁদের আলো বেশি গায়ে লাগালে চর্মরোগ হয়।’ তর্ক না করে শুয়ে পড়লুম। পাতলা মশারি নেমে এল। দুটো বালিশের মাঝখানে টর্চলাইট। লাকি চলে গেল ঘরের কোণে তার নিজের জায়গায়।

বড়মামার হাই উঠলো। —ঘুমোলি নাকি?—না।—ভূতের ভয় আছে! গা-টা একটু ছম ছম করে উঠলো। —ভয় নেই, আমি আছি, টর্চ আছে। —ভূত আছে নাকি? ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম। ‘থাকতে পারে, তাই তো ছাদের দিকের জানালা দুটো বন্ধ করে দিলুম।’ বড়মামার আর একটা হাই উঠলো। —’আজ তুই পাশে আছিস, ভূত এলে দু’জনে লড়ব। অন্যদিনে একলা থাকি তো, একটু ভয় ভয় করে। স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আজ আর খাইনি।’

বড়মামার কথায় ঘুম চমকে গেল। টর্চটা একবার হাত দিয়ে দেখে নিলুম। ভূত তাড়াবার দাওয়াই। আমার ঘুম আসার আগেই, বড়মামার নাক ডাকা শুরু হয়ে গেল। বেশ মিঠে ডাক। ফুড়ুত, ফুড়ুত, ফুড়, ফুড়, ফুড়ুত। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম নিজেই জানি না। হঠাৎ কোঁক করে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুকের উপর দুম করে একটা কি পড়ল! ভয়ে ভয়ে হাত দিলুম। বড় বড় লোম। কি এটা! ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে যাবার জোগাড়। শেষে আবিষ্কার করলুম বড়মামার হাত। হাতটাই দমাস করে বুকে পড়েছে। হাতটা আস্তে আস্তে সরিয়ে দিলুম। একবার ঘুম ভেঙে গেলে ঘুম কি আর আসতে চায়! ছাদে যেন একটা খড় খড় আওয়াজ হল। ক’টা বাজল কে জানে! চোখ চেয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ বড়মামার হাতটা উপরে উঠলো, এইবার পড়ছে, পড়ছে, উরে বাবা, আমার বুকের দিকে নেমে আসছে, তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে খাটের সীমানায় সরে গেলুম। হাতটা দুম করে পাশে পড়ল। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেলুম। এরপরই দুম করে বড়মামা একটা পা ছুঁড়লেন। নেহাৎ সীমানার বাইরে ছিলুম। তা না হলে ফুটবল হয়ে যেতুম।

আড়ষ্ট হয়ে, সেই খাটের সীমানায়, বড়মামার হাত আর পায়ের ধাক্কা থেকে নিজেকে কোনোরকমে বাঁচিয়ে আবার কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। স্বপ্ন দেখছি, আমি যেন ছোটনাগপুরের কোনও এক প্রান্তরে অজস্র টিলার উপর শুয়ে আছি। সবটাই অসমতল, ভীষণ লাগছে। মাঝে মাঝে ছুরির ফলার মতো কি যেন ঘাড়ের কাছের নরম জায়গায় খোঁচা মারছে। ঘুম ভেঙে গেল। এ কি! আমি কোথায় শুয়ে আছি। মাথা উঁচু করতে গেলুম। উঃ! মাথা ঠুকে গেল। ঘরের ছাদটা মাথার এত কাছে নেমে এল কি করে। অন্ধকারে চোখ সয়ে এলো। আমি পড়ে আছি খাটের তলায়। ডাবের গাদার উপর। নারকেল পাতার খোঁচা লাগছে ঘাড়ের কাছে। বড়মামার বিশাল একটা পা মশারি ভেদ করে খাটের পাশে ঝুলছে। মানে, বেশ মোক্ষম লাথিই আমাকে খাট থেকে ডাবের গাদায় ফেলে দিয়েছে।

খাটে ওঠার আর চেষ্টা করলুম না। বড় বিপজ্জনক জায়গা। বড়মামার দুটো হাত আর পা’র মহড়া নেবার মতো শক্তি আমার নেই। তার চেয়ে কেরালার ডাবের উপর শুয়ে থাকাই ভালো। একটু অসমতল। তা আর কী করা যাবে। ভোর হতে আর কতই বা দেরী। বেশ আরামেই ঘুমিয়ে পড়লুম আবার। মাথার উপর খাটের ছাদে বড়মামা সারা রাত অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠলেন! আমি তখন ছাদে হাওয়া খাচ্ছি।

হাতের নস্যির ডিবে থেকে এক টিপ নস্যি নিতে নিতে হাসি হাসি মুখে জিগ্যেস করলেন,—’কেমন ঘুমোলি বল, ফাসক্লাস’ লাকি বেড়ে লেজটা দু’বার নাচিয়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *