উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

বড়মামার বেড়াল ধরা

বড়মামার বেড়াল ধরা

বড়মামা মিলের হাসপাতালের ডাক্তার। রসুল সেই হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়। বড়মামার ডান-হাত বাঁ-হাত। প্রাইভেট সেক্রেটারি। যেমন ইঞ্জেকসান দিতে পারে তেমনি ভালো কাটলেট ভাজতে পারে। ফোঁড়াও কাটে। কচাকচ মুরগিও কাটে। মিল এলাকায় মুরগির ছড়াছড়ি। বড়মামার ইদানীং আবার মুরগীতে অরুচি। হিসেব করে দেখেছেন হাজারখানেক মুরগি খেয়েছেন। এখন একটু মালপো-টালপোয় রুচি এসেছে! গোবিন্দভোগ চালের ভাত। একটু গাওয়া ঘি। আলুভাতে। ঘন দুধ। আমসত্ত্ব আচার। পায়েস। একটু বৃন্দাবন বৃন্দাবন ভাব। রসুলের মহা দুঃখ। ডাক্তারবাবু মুরগি খাবেন বলে মিল কোয়ার্টার থেকে আগে যখন তখন একটা করে ধরে এনে জবাই করত। এখন সে উপায় নেই। রসুল বলছে, ‘কেন এমন হল ডাক্তারবাবু? একটু ওষুধ-টষুধ খেয়ে দেখুন না। মুরগি না খেলে শরীর থাকবে কি করে?’

বড়মামা বললেন, ‘দূর বেটা, তুই এসবের বুঝবি কি? আমি বৈষ্ণব হয়ে গেছি, মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, রসুনের নাম আমার কাছে করবি না। পারিস তো এক টিন ভালো গাওয়া ঘি যোগাড় কর। দেখ কে দেহাতে যাচ্ছে, আমার নাম করে বলে দে।’ রসুল মনমরা হয়ে লম্বা টেবিলের কাছে গিয়ে চা বানাতে শুরু করল। ডাক্তারবাবু সারাদিনে বার পঞ্চাশ চা খান।

বড়মামা এইমাত্র একটা অ্যাক্সিটেন্ড কেস অ্যাটেন্ড করে নিজের চেম্বারে এসে বসেছেন। আজকাল মেডিকেল লিটারেচার খুব কমই পড়েন। ড্রয়ারে একটা ঢাউস ভাগবত রেখেছেন। সময় পেলেই টেবিলের তলায় পা নাচাতে নাচাতে ভাগবত পড়েন। হাসপাতালের ওয়ার্ডে যে ক’টা বেড়াল ঘোরে সবকটাই বড়মামার বন্ধু। তাদের একটার গোটা চারেক বাচ্চা হয়েছে। বেড়ালটা সব কটাকে বড়মামার চেম্বারে এনে তুলেছে! কোণের দিকে ওষুধের একটা খালি পেটি ছিল! সেটাই হয়েছে বাসা। বাচ্চা ক’টার চোখ ফুটেছে। অনবরত মিউ মিউ করে। মা’টার দেখা পাওয়াই ভার। সব সময় রান্নাঘরের সামনে ওত পেতে বসে আছে। বাচ্চা সামলাবার ভার বড়মামার! চোখ ফুটেছে। জগৎ দেখতে শিখেছে। প্যাকিং বাক্স ভালো লাগবে কেন? প্রায়ই খচখচ করে গা বেয়ে বেয়ে একটা দুটো করে মেঝেতে ডিগবাজি খেয়ে পড়ছে। সারাঘরে থইথই সাদা বেড়াল। খেলছে, ছুটছে, লাফাচ্ছে। যেন বেড়ালদের নার্সারী। বড়মামা পা নাচিয়ে নাচিয়ে ভাগবত পড়ছেন। রসুল দুধ গুলছে। বাচ্চা চারটে টেবিলের তলায় বড়মামার পায়ের কাছে গুলতানি করছে। মোটা মোটা দুটো বুড়ো আঙুলের ওপর তাদের নজর। মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠে আঙ্গুলের মাথাটা কুড়কুড় করে কামড়াচ্ছে। যেই বড়মামার সুড়সুড়ি লাগছে অমনি পাটা ঝাড়া দিয়ে বলছেন, ‘ডোন্ট ডিসটার্ব’। বেড়ালগুলো ছিটকে মিউ মিউ করে উঠছে। বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বলছেন, ‘আহা লাগল নাকি? রসুল, সব কটাকে এক চামচে করে দুধ দে।’ রসুল সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তালিম করে আবার নতুন করে দুধ গুলছে। এই রকম বার চারেক হবার পর রসুল বিরক্ত হয়ে বাচ্চা চারটেকে প্যাকিং বাক্সে ভরে ঢাকা বন্ধ করে দিল যাতে বেরিয়ে আসতে না পারে। বাচ্চাগুলো তারস্বরে মিউ মিউ করছে। বাক্সর ভেতরটা আঁচড়াচ্ছে। বড়মামা ভাগবতে মশগুল হয়ে বলছেন, ‘রসুল, দুধ দে, দুধ দে।’ রসুল চারবারের চেষ্টায় এক একবার দুধে চায়ে এক করতে পেরেছে। সে বলছে, ‘দিয়েছি তো, দিয়েছি তো।’ ‘দিয়েছিস তো চেঁচাচ্ছে কেন? আরও দে।’

—দুধে হবে না বাবু, মাকে চাইছে।

—রাসকেলটার কান ধরে নিয়ে আয়।

—কামড়ে দেবে যে।

—কামড়ায় কামড়াক। তুই একটা এ-টি-এস নিয়ে যা। আয়, দিয়ে দি।

—না কামড়াতেই এ-টি-এস!

—তুই তো বলছিস কামড়াবে! কতরকম কথা বলিস বেটা?

রসুল বড়মামার টেবিলে চায়ের কাপ ধরে দিতে দিতে বললে, ‘বেঠিক কিছু বলিনি বাবু! খেয়ে খেয়ে তার যা চেহারা হয়েছে। ইয়া তাগড়া।’

বড়মামা বোধ হয় অন্যমনস্ক ছিলেন, জিগ্যেস করলেন, ‘ঘাগরা আবার কি হবে?’

—’ঘাগড়া নয়, ঘাগরা নয়, তাগড়া।’

—’কে তাগড়া?’ বড়মামা আগের কথা ভুলে গেছেন। বড়মামার এই বড় দোষ। এমনি একটু অন্যমনস্ক, তার ওপর ভাগবতে মন!

রসুল বেশ জোরে জোরে ঘরফাটানো গলায় বললে, ‘বেড়ালটা খেয়ে খেয়ে এই ক’দিনে ইয়া তাগড়া হয়েছে!’

বড়মামা বই থেকে মুখ তুলে রসুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘চেঁচাচ্ছিস কেন রাসকেল? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন? আমি কি কালা?’

রসুল গলাটা আগের চেয়ে একটু খাটো করে বললে, ‘আপনি যে শুনছেন না।’

‘শুনছি না? সব শুনেছি। তুই জানিস না। বেশি মোটা হয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ। হার্ট উইক হয়ে যায়। দেখিসনি গুপ্তবাবুর কি হয়েছে? জেনেশুনেও যখন মোটা হচ্ছিস, হয়ে যা। আমার কি? আমার কাঁচকলা। মরবি ব্যাটা তুই।’ বড়মামা ফডাস করে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার ভাগবতের পাতায় চোখ নামালেন।

রসুল বললে, ‘খুব শুনেছেন! আমি মোটা হব কেন? আমি তো আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে। দেখুন না, আমাকে কেউ মোটা বলবে?’

বড়মামা মুখ না তুলেই হুঁ হুঁ করে একটু হেসে বললেন, ‘আজ মঙ্গলবার কারুর চেহারায় নজর দিতে নেই, তবু যখন জিগ্যেস করলি বলতেই হচ্ছে, তুই যখন চাকরিতে ঢুকলি এই রোগা লিকলিকে ছিলিস, এখন?’ বড়মামা আবার একটু হাসলেন, ‘এখন তুই রিয়েলি ফ্যাটি। ফ্যাটি রসুল। রুগীদের খাবার চুরি করে করে আর দুধ সাবড়ে সাবড়ে ইয়া কেঁদো বাঘ। তুই ভাবিস আমি কিছু দেখি না, না? ওরে আমার চোখ সবসময় খোলা। চারিদিকে আমার চোখ। মাথার পেছনেও আমার চোখ।’

রসুল বললে, ‘কি মুশকিল! হচ্ছে অন্য কথা, আপনি বলছেন আর এক কথা।’

বড়মামা বললেন, ‘কার কথা? তুই কি বলতে চাস আমি মোটা হচ্ছি! তুমি চুরি করে কিচেন থেকে খাবার সাবড়াবে আর মোটা হব আমি, তাই না রাসকেল! তোদের সব অকর্মের ভাগ আমার! ভুল ওষুধ দিবি, দায় আমার। ইন্টার মাসকুলার ইঞ্জেকসান ইন্টার ভেনাস করে দিবি, দায় আমার। আজ বলছিস, তুই চুরি করে খাবি মোটা হব আমি! মামার বাড়ি পেয়েছিস, তাই না? দিস ইজ হসপিটাল, দিস ইজ নট ইওর মামার বাড়ি।’

রসুল বললে, ‘যাঃ বাবা।’

বড়মামা রসুলের কথার উপর দিয়েই মেল ট্রেনের মতো কথা চালিয়ে দিলেন, ‘আমি মোটা হচ্ছি আমার নিজের পয়সায়। নিজের রোজগারের পয়সায় ঘি খেয়ে মোটা হচ্ছি। তাতে তোর এত চোখ টাটাচ্ছে কেন? বেরো! গেট আউট? দূর হয়ে যা রাসকেল।’

রসুল বললে, ‘ঠিক আছে আমি আবার প্রথম থেকে বলছি। একেবারে ফার্স্ট থেকে বলছি, তা না হলে আপনি সারাদিন চেঁচাতেই থাকবেন। আমি চা করছিলুম।’ বড়মামা ভাগবত থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ‘কে তোকে চা করতে বলেছিল হতভাগা? আমি জানি না ভাবো? তুমি দুধ খাবার লোভে চা করতে আস। এক টিন দুধে ক’কাপ চা হল বল রাসকেল!’

‘সে হিসেব পরে হবে সাহেব, আমি আগে ফার্স্ট থেকে বলি। প্রথমে আমি চা করছিলুম। জল ফুটছে! আমি দুধ গুলছি, এমন সময় চারটে বাচ্চা বাক্স থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সায়েবের পায়ের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছে। সায়েব মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যেই না পা ছুড়ছেন বাচ্চাগুলো মিউ মিউ করে উঠছে। সায়েব অমনি বলেছেন রসুল দুধ দে। আমি অমনি যেটুকু দুধ গুলেছিলুম দিয়ে আবার চায়ের জন্যে নতুন করে দুধ গুলতে শুরু করলুম, সায়েব আবার লাথি মারলেন, বাচ্চাগুলো আবার মিউ মিউ করে উঠল, সায়েব আবার দুধ দিতে বললেন, আমি দিলুম, আবার নতুন করে গুলতে শুরু করলুম, সায়েব আবার লাথি মারলেন বেড়াল বাচ্চা মিউ করে উঠল, সায়েব বললেন দুধ দিতে, আমি আবার দুধ দিলুম, দিয়ে নতুন করে দুধ গুলতে শুরু করলুম।’

বড়মামা একটু একটু করে মুখ তুলছিলেন এবার পুরো মুখ তুলে রসুলকে ধমকে উঠলেন, ‘তুই আমার খাটাল দেখেছিস, তাই না! তোর মামার বাড়ির দুধ। আমিও বললুম, তুইও দিয়ে দিলি! অতবার দুধ খাইয়ে বেড়ালগুলোকে মারবার তাল করে। জানিস না বেশি দুধ খেলে বাচ্চাদের ইনফ্যানটাইল লিভার হয়।’

রসুল বললে, ‘জানি বলেই তো বাচ্চাগুলোকে ধরে ধরে প্যাকিং ব্যাক্সি ঢুকিয়ে দিয়েছি। যাতে বেরোতে না পারে তার জন্যে মাথায় ঢাকনা লাগিয়ে দিয়েছি। তখন থেকেই শুরু হয়েছে মিউ মিউ। ওই যে শুনুন এখনো মিউ মিউ করছে।’

বড়মামা কান খাড়া করে শুনলেন। শুনে বললেন, ‘সত্যি তো, ভীষণ মিউ মিউ করছে। একটু দুধ দে।’

রসুল বললে, ‘না। দুধে হবে না। আগেও আপনি ঠিক এই কথাই বলেছিলেন। তখন আমি বলেছিলুম দুধে হবে না বাবু, ওদের মাকে চাই।’

বড়মামা বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। কোথায় রে রাসকেল? বেটাকে কান ধরে নিয়ে আয়!’

রসুল বললে, ‘তখনো আপনি এই কথা বললেন। আমি বললুম, সেটা খেয়ে খেয়ে অ্যায়সা তাগড়া হয়েছে কান ধরে টেনে আনতে গেলেই আঁচড়ে কামড়ে দেবে। তখন আপনি সব গুলিয়ে ফেললেন। কে মোটা, কেন মোটা, বেড়ালের মোটা থেকে আমি মোটা, আপনি মোটা তারপর আমাকে চোর বলেছেন, গেট আউট করে দিয়েছেন, সাতবার রাসকেল বলেছেন।’

বড়মামা খুব চিন্তিত হলেন। চিন্তা-টিন্তা করে রসুলকেই প্রশ্ন করলেন, ‘কেন এসব বলেছি বল তো! যে ভাগবত পড়ে, যে আজ একমাস মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ স্পর্শ করেনি, তার মুখে এসব কথা কেন? তার জানা উচিত কাউকে চুরি করতে না দেখে চোর বলা ভীষণ অপরাধ। তোকে তো আমি চুরি করতে দেখিনি। আমি শুনেছি রসুল চুরি করে। সেই শোনা কথা রাগের মাথায় তোর ওপর চালান করলুম কেন? এত রাগ তো ভালো নয়। যাকগে, যা হয়ে গেছে গেছে। কিছু মনে করিস নি বাবা। এখন কড়া করে দু’কাপ চা কর। আর বিস্কুটের টিনটা খোল। যা ঝামেলায় ফেলেছিলি, সব জট পাকিয়ে গিয়েছিল। এরচে ডাক্তারি সোজা রে!’

বড়মামা আবার ভাগবতে চলে গেলেন। রসুল চলে গেল চায়ে। এদিকে প্যাকিং বাক্সের ভেতরে দক্ষযজ্ঞ চলেছে। চারটে বাচ্চার মধ্যে দুটো হলো। সে দুটো মাঝে মাঝে কর্কশ গলায় মিয়াও, মিয়াও করে উঠছে। বাক্সর ধারগুলো খচর মচর করে আঁচড়াচ্ছে। ডালাটা খোলার জন্যে গোঁত্তা মারছে। বড়মামা আর থাকতে না পেরে রসুলকে বললেন, ‘একটা কিছু করনা রে। আর তো পারা যায় না! কানের পোকা বের করে দিলে। তুই দেখ না চুক চুক করে লোভ দেখিয়ে, দুধের লোভ দেখিয়ে মা’টাকে যদি ধরে আনতে পারিস।’

রসুল চা আনছিল। কাপটা রাখতে বললে, ‘এ মা সে মা নয় সায়েব। বরং এক কাজ করি, বাক্সটাকে বাইরে মাঠে ফেলে দিয়ে আসি দূর করে।’

বড়মামা আঁকতে উঠলেন, ‘না না না। চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে! মরে যাবে রে!’

‘কিন্তু স্যার ডাক্তারখানায় বেড়ালছানার ডাক খুব ভালো শোনায় না। এই নিয়ে কিন্তু কমপ্লেন হতে পারে।’

‘কমপ্লেন!’ বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘কে কমপ্লেন করবে রে! কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে! জানিস আমি ডক্টর-ইন-চার্জ! মানুষ রুগি হতে পারে, বেড়াল পারে না!’

‘পারে। তবে তার জন্যে তো পশু হাসপাতাল আছে স্যার। সেই কথা যদি কেউ বলে?’

‘বললে মারবো মুখে এক থাবড়া। এখানে দশ মাইলের মধ্যে পশু চিকিৎসালয় কোথা রে? তুই যখন কমপ্লেনের ভয় দেখালি বেড়াল আমার চেম্বারেই থাকবে, যদ্দিন না বড় হয় তদ্দিন থাকবে। আর তোর মতো ওয়ার্থলেসের দ্বারা চা-ই হতে পারে, বেড়াল মানুষ হতে পারে না। আমি নিজেই যাচ্ছি ওদের মায়ের খোঁজে। করপোরেশান সাঁড়াশি দিয়ে পাগলা কুকুর ধরতে পারে আর আমি ডাক্তার হয়ে একটা বেড়াল ধরতে পারব না! চ্যালেঞ্জ।’

এক চুমুকে চা শেষ করে বড়মামা উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়েই আবার বসে পড়লেন। বসে পড়ে বললেন, ‘রসুল, একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছি তাই না?’ রসুল বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তা একটু হয়েছেন বটে।’

‘কেন হলুম?’

‘ওই বেড়াল স্যার! অনবরত চেল্লাচ্ছে।’

‘না, ঠিক নয়। সামান্য বেড়াল আমাকে উত্তেজিত করছে। ভেরি ব্যাড। ভাগবতের কোনও ফল পেলুম না রে! দপ করে রেগে যাচ্ছি কথায় কথায়। রাগটা যেন আগের চেয়ে বেড়েই যাচ্ছে। এটা ঘি খেয়ে হচ্ছে বোধ হয়। ডাক্তার, কাল থেকে তোমার ঘি বন্ধ।’ বড়মামা নিজেই নিজের ঘি বন্ধ করে আবার ভাগবত নিয়ে বসলেন।

রসুল বললেন, ‘এই যে বললেন বেড়াল ধরতে যাবেন!’

‘বেড়াল ধরতে যাব মানে? ইয়ারকি পেয়েছিস! ডাক্তারের কাজ বেড়াল ধরা, রাসকেল?’

বড়মামা আবার রেগে গেলেন। রসুল বড়মামাকে হাড়ে হাড়ে চেনে।

রসুল কিন্তু ঘাবড়ে গেল না। সে বললে, ‘এমনি বেড়াল নয়। মা বেড়াল। বেড়ালের মা। বিল্লী কী মাতাজী!’ প্রায় সব ভাষাতেই রসুল বোঝাতে চাইল। ইংরেজীটাই বাকি রইল। বললেই পারত, ক্যাটস মাদার বা মাদার অপ কিটেনস।

বড়মামা বললেন, ‘দেখেছিস মাথার কি অবস্থা হয়েছে। এই বলছি, এই ভুলে যাচ্ছি! ঘি খেলে আগে মানুষের স্মৃতিশক্তি বাড়ত। এখন উলটোটা হয়, কমে যায়। ঘিয়ে ভেজাল আছে রে রসুল। লাগা আজ, লাগিয়ে দে বেশ ঝোল ঝোল।’

বড়মামার কথায় রসুলের চোখ চকচক করে উঠল। গত দু’মাস ভোরবেলা মুরগির ডাকই খালি শুনছে, একটা ঠ্যাঙও চিবোতে পারছে না। রসুল লাফিয়ে উঠল, ‘ইয়াসিন একটা দিয়েই রেখেছে স্যার। কাজে লাগাতে পারছিলুম না। প্রেশার কুকারে মরচে ধরে গেল। আমি তাহলে এখুনি শুরু করে দি? একবার মোল্লার হাটে চলে যাই। ফাইন বাসমতী নিয়ে আসি। কিলোটাক আলু। মশলাও কিছু লাগবে। এখন আরম্ভ করলে সন্ধ্যে সাতটা-আটটার মধ্যে রেডি হয়ে যাবে।’ রসুল ধড়ফড় করে পালাচ্ছিল।

বড়মামা বললেন, ‘রোককে! আগে বেড়াল তারপর অন্য কাজ।’

‘বেড়াল তো আপনি ধরবেন স্যার। সেই রকমেই তো বললেন।’

‘ভুলে গেছিস বোধহয় তুই আমার অ্যাসিসটেন্ট। আমি যা করব সব সময় তুই আমার পাশে থাকবি পাঁঠা।’

বেড়াল ধরার সরঞ্জাম অনেক। বড়মামার হাতে অফিসের ওয়েস্ট পেপার বাসকেট। রসুলের হাতে দুটো বিস্কুট, ক্লোরোফর্মের শিশি, একটা বড় ডাস্টার, একটা ইঁদুর ধরা কলে ছোট একটা নেংটি ইঁদুর। বড়মামার প্ল্যান একরকম, রসুলের প্ল্যান আর একরকম। কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। বড়মামা ঠিক করেছেন হাসপাতালের কিচেনের কাছে গিয়ে, মিনি মিনি, আয় মিনি করে চুকচুক করে বেড়ালদের গাদা থেকে আসল বেড়ালটাকে ডেকে এনে বিস্কুট খেতে দেবেন। বেড়াল যেই খেতে শুরু করবে ঝপ করে বাসকেটটা চাপা দিয়েই, ডাস্টারে খানিকটা ক্লোরোফর্ম ছড়িয়ে ওপরে চেপে ধরবেন। বেড়ালটা অজ্ঞান হয়ে যাবে তখন সেটাকে চ্যাদোলা করে এনে বাচ্চাগুলোর কাছে চিৎপটাং করে শুইয়ে দেবেন।

রসুলের প্ল্যান অন্য। রসুল ইঁদুরের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে বেড়ালটাকে ঘর পর্যন্ত টেনে আনবে। তারপর ঘরে ঢুকিয়ে ডাস্টার দিয়ে চেপে ধরে গলায় একটা দড়ি বেঁধে গ্রিলের সঙ্গে আটকে রাখবে। থাকো বেটা বন্দী হয়ে। ছেলেমেয়ে যদ্দিন না মানুষ হচ্ছে তদ্দিন তোমার মুক্তি নেই।

বড়মামা বলছে, ‘মরবি রসুল। বেড়ালের গলায় কেউ কখনো ঘণ্টা বাঁধাতে পারেনি। ঘণ্টা আর দড়িতে তফাত কতটুকু! তোর জন্যে দেখবি সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।’

দু’জন দু’রকম প্ল্যান নিয়ে রান্নাঘরের সামনে। ছ’টা বেড়াল ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছে। বড়মামা বললেন, ‘কোনটা বল তো? কোন রাসকেলটা রে?’

বেড়ালটা মাঝে মাঝেই আসে যায়! কেউই তেমন লক্ষ্য করে দেখেনি। ছ’টা বেড়ালের তিনটে সাদা। দু’টো সাদাতে কালোতে। একটা কুচকুচে কালো! কালোটা নয়। সাদা তিনটের যে কোন একটা। কিন্তু কোনটা? বড়মামা আবার রেগে গেলেন, ‘তোর মতো গাধা আর দু’টো নেই রসুল। তুই একটা বেড়াল চিনতে পারিস না, রুগি চিনিস কী করে?’

রসুল বললে, ‘মানুষের নাম আছে, কার্ড আছে। এক একটা মানুষকে এক এক রকম দেখতে। বেড়াল তো সব এক রকম। খালি যা একটু রংয়ের তফাৎ।’

বড়মামা বললেন, ‘জানিস যখন এক, তখন চিহ্ন দিয়ে রাখিসনি কেন? গায়ে অফিসের একটা শীল মেরে দিতে কি হয়েছিল? সবেতেই ফাঁকিবাজি। আমি জানি না, আমার বেড়াল ধরে দাও।’

রসুল ইঁদুর-ধরা কলটা মেঝেতে নামিয়ে একবার চুকচুক করতেই ছটা বেড়াল দৌড়ে এল। একটা ফোঁস ফোঁস করে সামনে জালটা শুঁকছে, একটা কলের ওপরে থাবা মারছে। দু’টো শিকার পাছে হাতছাড়া হয়ে যায়। সেই ভয়ে মুখোমুখি বসে ল্যাজ ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। ফ্যাঁ ফ্যাঁ গড়র গড়র গড়র। দুজনেরই পিঠ ধনুকের মতো বেঁকে উঠেছে। বড়মামা পায়ে পায়ে পেছোতে পেছোতে কোণের দিকে দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়েছেন। আর সরবার জায়গা নেই। কিছু করবারও নেই। একমাত্র রসুলকে গালাগাল দেবার জন্যে মুখটাই যা খোলা আছে। দু’টো হাতই জোড়া।

বড়মামা বললেন, ‘রাসকেল, তখনই বলেছিলুম কাঙালদের শাকের ক্ষেত দেখাসনি। একটা ইঁদুর ছ’টা বেড়াল। সামলা এবার ঠ্যালা ইডিয়েট, তোর মাথায় কবে যে ভগবান একটু বুদ্ধি দেবেন! ও, তোর তো আবার ভগবান নয়, আল্লা।’

রসুল বললে, ‘ইঁদুরটাকে ছেড়ে দিয়ে দেখি।’

‘তা দেখবে না! নেংটি ইঁদুরের দৌড় জানিস? ছাড়লেই দৌড়োবে, পেছন পেছন বেড়ালও ছুটবে। তখন ধরবি কি করে! এক বালতি জল এনে গায়ে ছিটো তাহলে যদি মারামারি থামে!’

‘জল ছিটোলে বেড়ালের ঝগড়া বেড়ে যায় বাবু। ছেলেবেলায় দেখেছি তো, তার চেয়ে ইঁদুরটাকে নিয়ে ঘরে চলে যাই তাহলে লোভে লোভে সব ক’টা চেম্বারে চলে আসবে আমাদের এরিয়ার, তখন ঠিক ম্যানেজ করা যাবে।’

‘পাগল হয়েছিস। এর মধ্যে দু’টো হুলো আছে না ইডিয়েট, বাচ্চা চারটেকে সাবাড় করে দেবে। তুই ক্লোরোফর্ম ছিটো, সবক’টা অজ্ঞান হয়ে থাক। তারপর যা-হোক একটা কিছু করা যাবে।’

রসুল আর মামা কথা কাটাকাটি করছেন, এদিকে ইঁদুরকে সাক্ষী রেখে তিন জোড়া বিড়াল ফুলছে, গোঁ গোঁ করছে, মাঝে মাঝে থাবার তুলে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে উঠছে। বড়মামার এই দুঃসময়ে রণক্ষেত্রে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে প্রবেশ করলেন হাসপাতালের সিস্টার। সাদা কাপড়, সাদা টুপি। বড়মামার খোঁজে চেম্বার থেকে এই পর্যন্ত ছুটে এসেছেন। ব্যাপার দেখে মুখের কথা মুখেই আটকে গেছে। রসুল আর বড়মামাকে দেখে মনে হচ্ছে চাঁদে যাবেন। হাতে নানা ধরনের সরঞ্জাম। বড়মামা রসুলকে বলছেন, ‘তোর তো মানুষ মারাই কাজ, সাহস করে যে কোন একটা সাদাকে চেপে ধরতে পারছিস না ব্যাটা।’ রসুল একপা এগোয়ে তো দশপা পেছোয়। ইঁদুর কলে ইঁদুরটা ভয়ে সিঁটকে একেবারে ভিতরের দিকে ঢুকে বসে আছে। ছ’টা বেড়ালের গন্ধে আর শব্দে সে ভবিষ্যৎ বুঝে ফেলেছে—রক্তাক্ত মৃত্যু। সিস্টার বলছেন, ‘ডাক্তারবাবু শিগগির চলুন, গুপ্তু সায়েবের অবস্থা আবার খারাপের দিকে। শ্বাস নিতে পারছেন না।’

বড়মামা বললেন, ‘গুপ্তু সায়েবটা কে? একে আবার কোত্থেকে আমদানী করলেন?’

‘ওই তো আমাদের ক্যাশিয়ার বাবু।’

‘তার নাম তো গুপ্ত বাবু, গুপ্তু বলছেন কেন? ইংরেজীর উচ্চারণ জানেন না বুঝি!’

‘আজ্ঞে উনি যে ডবল ও লেখেন।’

‘ডবল কেন, তার ডবল লিখলেও গুপ্ত ইজ গুপ্ত। সিঙ্গল ডিমের ওমলেটও ওমলেট, ডবল ডিমের ওমলেটও ওমলেট।’

‘গুপ্তু না বললে উনি রেগে যান। ওই তো সেদিন যখন জ্ঞান ফিরে এল কে যেন দেখতে এসে বলেছিলেন গুপ্ত সাহেব, উনি চটেমটে বললেন, অ্যাই অ্যাম গুপ্তু, নট গুপ্তওও। এত উত্তেজিত হলেন শেষে আপনি গিয়ে সেই আবার ঘুমের ইঞ্জেকসান দিলেন!’

বড়মামা দার্শনিকের মতো বললেন, ‘গুপ্ত আর গুপ্তু, মুখার্জি আর মুকার্জি, দাশ আর দশ চিতায় উঠলে সব সমান সিস্টার। কিন্তু আমি এখন যাই কি করে! দেখছেন তো আমার অবস্থা! ডু ওয়ান থিং, অক্সিজেনের নলটা ঠেসে নাকে ঢুকিয়ে দিয়ে রুম কুলারের ভল্যুমটা বাড়িয়ে দিন। অত খেলে মানুষ বাঁচে? চারদিক থেকে চর্বি এসে হার্টটাকে চেপে ধরেছে। ডাক্তার কি করবে! গবগব করে খাবার সময় গুপ্তুর খেয়াল ছিল না দিন দিন আড়ামনি কৈলাশ হচ্ছি। যেতে দিন, যো যায়েগা যাউক যো আয়েগা আউক।’

‘আজ্ঞে যায়েগা যাউক বললে, আমাদেরই বিপদ। মাইনে হবে না এ মাসে। ক্যাশিয়ার ছাড়া মাইনে দেবে কে?’ বড়মামা এতক্ষণে একটু হাসলেন, ‘পৃথিবীতে ক্যাশিয়ারের অভাব আছে সিস্টার! এক যাবে আর এক আসবে। গুপ্ত গেলে, ঘোষ, বোস, মিত্তির যে কেউ একজন আসবে।’

‘তা হলেও হাতের পাঁচ কি ছাড়া উচিত স্যার? একে তো বাঁচাবার চেষ্টা করতেই হবে।’

‘তা তো হবেই, খাবার জন্যে বাঁচাতে হবে। দেশে দুর্ভিক্ষ করার জন্যে এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। চলুন দেখি।’

যাবার সময় রসুলকে বললেন, ‘একটাকে পটকে ফেল তারপর ওই ডাস্টার দিয়ে জড়িয়ে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে চেন দিয়ে টেবিলের পায়ার সঙ্গে বেঁধে ফেল।’

সিস্টার আর বড়মামা পাশপাশি হাঁটতে-হাঁটতে চলে গেলেন। সিস্টার যেতে যেতে শুধু একবার প্রশ্ন করলেন, ‘বেড়াল কি করবেন ডাক্তারবাবু?’ বড়মামার এক উত্তরে সব কথা বন্ধ, ‘আমার শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণকে দান করা হবে।’

বড়মামা চলে যেতেই রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এল ইয়াসিন। ইয়াসিনের বাড়ি বিহারে। এই হাসপাতালে রাঁধুনিক কাজ করছে বছর দশেক। থেকে থেকে বাংলা শিখেছে! ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। গুণ্ডার সর্দারের মতো বিশাল চেহারা। ইয়া মোটা লোমঅলা হাত, গর্দান। লাল গুলি গুলি চোখ। খাকি পোশাক, কাঁধে একটা হাত-টাত-মোছা তোয়ালে। ইয়াসিন একটা বিড়ি ধরিয়ে বেড়ালের যুদ্ধ কিছুক্ষণ দেখে রসুলকে জিগ্যেস করলে, ‘ক্যা শুরু কর দিয়া। আরে মারো না ইয়ার এক লাথ।’

‘মারো না এক লাথ’ রসুল ভেঁচি কেটে বললে, ‘আর হামারা চাকরি চলা যায়গা।’

‘আই বাপ। চাকরি তুমহার যাবে কেন? বিল্লী কো তো এইসি আদমী লাথাতা। হাম ঝাড়েগা একঠো। এক লাথ সে ছেগোকো একসাথ চারদিওয়ারিকা উধার কমপাউন্ডমে ফেক দেঙ্গে। দেখেগা।’ ইয়াসিন এমন একটা ভঙ্গী করল যেন হাবিব পেনালটি কিক নিতে যাচ্ছে।

রসুল বললেন, ‘লাথ মারতা হায় মারো লেকিন ইসমে ডাগদারবাবুকা একঠো সফেদ বিল্লী হায়, উ চলা যায় তো তুমহারা কেয়া হোকা, আল্লা মালুম।’

ইয়াসিন কোমর থেকে হাত নামিয়ে বললে, ‘সাচ!’

‘সাচ’ রসুল বললে। এদিকে একটা কালো আর একটা সাদায় খুব জমেছে। সাদাটা একটা কোণ পেয়েছে। কালোটা ল্যাজ ফুলিয়ে একেবারে ধনুক। সাদাটাকে দু’একবার থাবা চালিয়েছে। কোষা কোষা লোম খসে পড়েছে। নবাবী আমলের মুরগির লড়াই দেখা পূর্বপুরুষের রক্ত ইয়াসিনের শরীরে। বেড়ালের লড়াই দেখে তার মহানন্দ। মুঠো পাকিয়ে ইয়াসিন কালোটাকে উৎসাহ দিচ্ছে, লাগা-লাগা, মার এক থাবা! বহুত আচ্ছা। কালো বেটা জিতে যাবে।

রসুল জানে, যে বেড়াল কোণ নিয়েছে তাকে হারাবার সাধ্য কারুর নেই। সে বললে, ‘কালা জিতে তো দশ রুপীয়া বেট।’

ইয়াসিন বললেন, ‘সাদা জিতে তো বিশ রুপীয়া বেট। চলো, হো যায়।’

রসুল মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, ‘হাঁ হো যায়।’

কালো দশ, সাদা কুড়ি। টাকার লড়াই হচ্ছে। একপাশে রসুল, একপাশে ইয়াসিন। মাঝে মাঝে দুজনে চিৎকার করে উঠছে, ইয়া, লাগা আওর থোড়া। আ-আ। ইয়াসিন মাঝে মাঝে গোঁফ চুমড়ে নিচ্ছে। রসুলের সাদাটা ইয়াসিনের কালোটার চোখের কাছে একটা থাবা বসিয়ে দিতেই ইয়াসিন একটু চুপসে গেল। রসুলের ধেই ধেই নাচ, ‘লাগা বাহাদুর, লাগা বাহাদুর।’ ইয়াসিন কালোটাকে বলছে, ‘মছিলিকা বেড়া দেগা, মার এক থাবা, এক বাটি দুধ দেগা, মার এক থাবা।’ রসুল বললে, ‘ইয়াসিন, এটা কিন্তু অন্যায় হচ্ছে। তোমার হাতে রান্নাঘর বলে তুমি মাছের লোভ, দুধের লোভ দেখাচ্ছ। এভাবে জেতালে টাকা পাবে না।’ রসুল এমনভাবে বল বেড়াল যেন মানুষের কথা বোঝে। কালোটা হঠাৎ তেড়ে গেল। ইয়াসিন মছলি মছলি বলে দালান ফাটানো চিৎকার করতেই, রসুল কনডেনস মিল্ক বলে তার সাদাটাকে লোভ দেখাল। রান্নাঘর থেকে এগিকে আরও অনেকে বেরিয়ে এসেছে। সকলেই রসুলের বিপক্ষে, কারণ ইয়াসিনের জেতার অঙ্ক অনেক বেশি।

কে জেতে কে হারে! সাদাটা কোণ নিয়ে এ্যায়সা বসেছে, কালোটা তেড়ে গেলেও সাদাটার ফ্যাঁস আর থাবার ভয়ে ছটাপটি লটাপটি করতে পারছে না। ঝটাপটি লটাপটি না হলে লড়াইয়ের ফয়সালাও হবে না। এইভাবে চললে সারারাত কাবার হয়ে যাবে। ইয়াসিন সেটা বুঝেছে। ইয়াসিন বলছে, ‘উসকো হুঁয়াসে নিকালো।’

‘হুঁয়াসে নিকালো?’ রসুল প্রতিবাদ করে উঠল, ‘কাহে হুঁয়াসে নিকালবে? মামার বাড়ি পা গিয়া! যে যেই পোজিসানে আছে সেই পোজিসানেই লড়বে।’

ইয়াসিন বললে, ‘ফুটবলমে পোজিসান চেঞ্জ হোতা নেই? আবি কালা আয়েগা উধার, সাদা জাগেয়া ইধার। নেহিতো দোনা চলা আয়েগা পেনালটি পোজিসানে। এ হামিদ ভাই, উসকো খোঁচাও।’!

অ্যাসিসটেন্ট হামিদ সত্যিসত্যিই সাদাটাকে খোঁচাতে গেল। রসুলের মেজাজটা এমনিই ভালো নয়। কথায় কথায় তার হাত ওঠে। রসুল ধাঁ করে হামিদের কলার চেপে ধরে বললে, ‘এক পা আগে বাড়ে তো হালত চেঞ্জ কর দেগা।’ ইয়াসিন সঙ্গে সঙ্গে রসুলের ঘাড় চেপে ধরে দুবার ঝাঁকানি দিয়ে বললে, ‘চোপরাও জমাদার।’ এদিকে সাদাটা কালোটাকে আর একটা মোক্ষম থাবা দিয়েছে। রসুল জানে, জিততে হলে এখন তাকে গায়ের জোরে জিততে হবে।

রসুল হামিদের কলার ছেড়ে দিয়ে ইয়াসিনের চিবুকের তলায় একটা ঘুষি মেরে বলল, ‘চোট্টা কাঁহাকা।’ আর বেশি কিছু বলার সে সময় পেল না। মাটি থেকে অল্প একটু উঁচু হয়ে, জমির হাত খানেক ওপর দিয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে যে কোণে সাদা আর কালো বেড়াল দুটো বাজির লড়াই লড়ছিল সেই কোণে ঘাড় মুখ গুঁজড়ে বেড়াল দুটোর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। ক্লোরোফর্ম শিশির ভাঙা গলাটা বাঁ হাতের তালুতে বিঁধে গেল। সারা দালানে ক্লোরোফর্ম উড়ছে। একপাশে ডাস্টার, অন্যপাসে গড়াচ্ছে ওয়েস্ট পেপার বাসকেট। রসুলকে আর উঠতে হল না। ইয়াসিনের ঘুষি আর ক্লোরোফর্ম যে কোনও একটাই তার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। একসঙ্গে দুটো! বেড়াল ছটারও সে একই অবস্থা। বারকতক ফোঁস ফোঁস করে সবকটাই পালাবার চেষ্টা করছিল। কেউ একপা কেউ দু’পা গিয়ে লটকে পড়েছে। ইঁদুরটা খাঁচার মুখে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার লম্বা ল্যাচটা ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

বড়মামা তখন গুপ্তু সাহেবকে নিয়ে হিমসিম। আজীবন নস্যি নিয়ে নিয়ে সাহেবের নাকের ছিদ্র দুটো কামানের নলের গর্তের মতো। বড়মামা সিস্টারকে বলছেন, ‘এ ছেঁদা ছোট না করলে অক্সিজেন ভেতরে যাবে কি করে। সবই তো লিক করে বেরিয়ে আসবে। চারদিক থেকে প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে গোল করে বুজিয়ে আনতে হবে। এ কি আমাদের কম্ম! রাজমিস্ত্রী ডাকুন।’

স্লিপ নিয়ে সিস্টার-ইন-চার্জ এলেন। এমার্জেন্সি কেস। তলার চোয়াল ঝুলে গেছে, খুলে গেছে বলেই মনে হয়। বাঁ হাতের চালু এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়। সেনসলেস। ভিকটিম নিজেই নিজেকে অ্যানেসথেসিয়া দিয়েছে। সারা গায়ে মুখে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। দাগ দেখে মনে হয় বন্য জন্তুর আক্রমণ। অ্যাটেন্ডিং ফিজিসিয়ানের রিপোর্টটাই পড়লেন। পেশেন্টের নামটা দেখেও দেখলেন না। বড়মামা বললেন, ‘চলুন দেখি। সুন্দরবন তো অনেক দূরে। বাঘে কামড়েছে বলে মনে হচ্ছে!’

সিস্টার-ইন-চার্জ বললেন,—’বুঝতে পারছি না ঠিক, তবে মুখটা ফালা ফালা করে দিয়েছে। চোয়ালটা কব্জা ভাঙা বাক্সর ডালার মতো ঝুলে পড়েছে।’

বড়মামা একটু ভেবেচিন্তে বললেন, ‘হতেও পারে। সার্কাস কিম্বা চিড়িয়াখানার বাঘ হয়তো।’ সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের অপারেশন টেবিলে রসুল মুখে ভেঙচি কেটে শুয়ে আছে। ডক্টর মিত্র ইতিমধ্যে বোতল ভাঙাটা বের করে ছোট বুরুশ দিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে কাঁচের টুকরো বের করছেন। বড়মামা রসুলের মুখটা দেখেই বললেন,—’রাসকেল, অপদার্থ, তখনই বলেছিলুম ছটা বেড়াল একটা ইঁদুর, মরবি রসুল। বেড়াল হল বাঘের মাসি। ইস চোয়ালটা পর্যন্ত খুলে নেবার চেষ্টা করেছিল। মুখে মাংসর গন্ধ পেয়েছে। সবক’টা কামড়ে ধরে টানতে শুরু করেছিল বোধহয়!’

ডক্টর মিত্র বুরুশ দিয়ে কাঁচের টুকরো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ‘মাইনের ব্রুইজগুলো বেড়ালের। চোখটা জোর বেঁচে গেছে। আসল ঘটনা ইয়াসিনের ঘুষি। দৈত্যের ঘুষি। এক ঘুষিতেই চোয়াল খুলে গেছে। ক্লোরোফর্মটা কে ঢেলেছে বুঝতে পারছি না। চব্বিশ ঘণ্টার আগে জ্ঞান হবে বলে মনে হয় না।’

ক্লোরোফর্মের রহস্য বড়মামা জানে। বেড়ালের আঁচর, তাও বুঝলেন। বুঝলেন না ইয়াসিনের ঘুষি। কুক ইয়াসিন রসুলকে ঘুষি মারবে কেন? চোরাই খাবারের ভাগ-বাঁটোয়ারা নাকি? জুনিয়ার ডক্টর মিত্রকে যে নির্দেশ দেবার দিয়ে বড়মামা কিচেনের দিকে চললেন। আহা কি দৃশ্য! চোখ জুড়িয়ে যায়। শ্রীক্ষেত্রের মতো বেড়াল ক্ষেত্র। ছ’টা তাগড়া বেড়াল ছ’দিকে ঠ্যাং ছড়িয়ে পড়ে আছে। রান্নাঘরে সকলেই আছে, ইয়াসিন আছে, বিশু আছে, গদাই আছে, একটা বড় রুই মাছ আছে, ছ’টা মুরগি আছে, এক ঝুড়ি ডিম আছে, ঘি আছে, তেল, মশলা, নুন, মাখন সব আছে। তবে কথা বলার মতো অবস্থায় কেউ নেই। ইয়াসিন সব্জী-কাটা লম্বা টেবিলে কাঁচাকলা মাথায় দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। থামের মতো একটা পা কিচেন র‍্যাকের ওপর। চায়ের একটা বড় কৌটো, দুটো জ্যামের টিন পায়ের দিকের মেঝেতে গড়াগড়ি। হামিত ওই দিকেই উপুড় হয়ে আছে। সারা মাথায় চা পাতা। এক এক ভঙ্গীতে সকলেই গভীর ঘুমে। উনুন কড়ায় একটা কিছু চাপান ছিল। কি বস্তু এখন বোঝার উপায় নেই। কড়াটা উনুনের তাতে ফেটে দু’চাকলা হয়ে দুদিকে সরে গেছে।

কাউকে ঘাঁটাবার সাহস বড়মামার হল না। সারা হাসপাতালের রুগি আর হাউস স্টাফের আজ উপবাস। সব ক’টাকে দাওয়াই দিয়ে চাঙ্গা করতে হবে। ক্লোরোফর্ম সার্জিক্যাল ওয়ার্ড থেকে রান্নাঘরে আসে কি করে, রসুলকে তার জবাবদিহি করার জন্যে ফতোয়া জারি করতে হবে। পুরো ব্যাপারটা তদন্তের জন্যে কমিটি বসাতে হবে। চেয়ারম্যান বড়মামা—ডক্টর মুখার্জি। সব কিছুর মূলে, বড়মামা—ডক্টর মুখার্জি, তার চারটি বেড়ালছানা আর ছটি বেড়াল।

চিন্তিত বড়মামা বেছে বেছে সাদা একটা বেড়াল বগলদাবা করে চেম্বারে ফিরে এলেন। একটা রবার-স্ট্যাম্প দিয়ে সারা গায়ে দেগে দিলেন। এবার আর গুলিয়ে যাবার উপায় নেই। বেড়ালটাকে মেঝেতে ফেলে মিউ মিউ বাচ্চা চারটেকে ছেড়ে দিয়ে ঘটনার নোট লিখতে বসলেন। রসুলকেও সাসপেন্ড করতে হবে, নিজেকেও সাসপেন্ড করতে হবে। বড়মামা একবারও লক্ষ্য করলেন না, মা বলে যে বেড়ালটাকে ধরে এনেছেন সেটা একটা বিশাল হুলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *