বড়বাজারের মল্লিক পরিবার
এই প্রাচীন সম্মানিত সুবর্ণ-বণিক পরিবারটির জাতিগত পদবী ‘দে’, মুসলমান সরকার তাঁদের মল্লিক পদবী দান করেন।
সম্রাট আকবরের আমলে এই পরিবারের বনমালী মল্লিক হুগলী জেলার ত্রিবেণীতীরে সপ্তগ্রামে (ব্যবসায় করে) সঙ্গতিসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। নদীয়া জেলায় কাঁচড়াপাড়ায় তাঁর একটি ‘আবাদ’ ছিল, আবাদের পাশে একটি খাল কাটিয়েছিলেন। আজও এই খালটি মল্লিকের খাল নামে পরিচিত। দানশীল বনমালি নদীয়া জেলায় একটি অতিথিশালা স্থাপন করেছিলেন।
বনমালী মল্লিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারীরূপে বালক পৌত্র কৃষ্টদাস মল্লিককে রেখে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। কৃষ্ণদাসের জন্ম হয় ১৬০১-এ। কৃষ্টদাস ছিলেন বিচক্ষণ ও উৎসাহী বণিক, আবার দানশীল ও ধার্মিকও ছিলেন। হুগলী নদীর তীরে বল্লভপুরে তিনি একটি মন্দির ও ত্রিবেণীতে একটি অতিথিশালা স্থাপন করেন। তিন পুত্র রাজারাম, প্রাণবল্লভ ও কালীচরণকে রেখে তিনি ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
রাজারামের জন্ম ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি উর্দু, ফার্সী ও বাংলা ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। দুই পুত্র দর্পনারায়ণ মল্লিক ও সন্তোষ মল্লিককে রেখে রাজারাম ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। সন্তোষ মল্লিক নিঃসন্তান ছিলেন।
কৃষ্টদাসের মধ্যম পুত্র প্রাণবল্লভের জন্ম হয় ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি তাঁর একমাত্র জীবিত পুত্র সুখদেবকে রেখে মারা যান। সুখদেবের আট পুত্রের মধ্যে রাইহরি রাম মল্লিক (জন্ম ১৭০৭) ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকাস্থ রায় রায়ান অর্থাৎ এজেন্ট। তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। যাদবচন্দ্র, বিনোদচাঁদ প্রভৃতি সুখদেবের বর্তমান বংশধর।
রাজারাম মল্লিকের জ্যেষ্ঠপুত্র দর্পনারায়ণ ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মনিষ্ঠ দর্পনারায়ণ দানের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বারাণসী, হুগলী ও নদীয়া জেলায় অতিথিশালা স্থাপন করেন। তদানীন্তন মুসলিম সরকারের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য তিনি ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর খুড়তুত ভাই সুখদেবকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন। একমাত্র পুত্র নয়নচাঁদকে রেখে ১৭৪০- এ দর্পনারায়ণ মারা যান।
নয়নচাঁদ ১৭১০-এ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বারাণসী, শ্রীরামপুরের কিট মাহেশ ও অন্যান্য বহু স্থানে ধর্মশালা স্থাপন করেন। বড়বাজারে একটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করে তিনি সেটি অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দান করেন। হুগলী, নদীয়া এবং ২৪ পরগণা জেলায় তাঁর বহু জমিদারী ছিল। গৌরচরণ, নিমাইচরণ এবং রাধাচরণ এই তিন পুত্র রেখে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন। তিন ভাই মিলে বিপুল ব্যয়ে পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন। কনিষ্ঠ রাধাচরণের কোন পুত্রসন্তান ছিল না।
গৌরচরণ ও নিমাইচরণ মিলিতভাবে কাঁচড়াপাড়ায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গৌরচরণের চার পুত্র : বিশ্বম্ভর, রামলোচন, জগমোহন ও রূপলাল। জ্যেষ্ঠ বিশ্বম্ভর দানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কনিষ্ঠ রূপলাল ছিলেন সাদাসিধা মানুষ। তাঁর চার পুত্র : প্রাণকৃষ্ট, শ্রীকৃষ্ট, নবকুমার ও শ্যামাচরণ। এঁরা সকলেই জনসেবার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ‘খন্ড বৃন্দাবন’ নামে খ্যাত সপ্তদীঘি সে যুগের সকল ইউরোপীয়ের কাছে সুপরিচিত ছিল। রূপলালের বর্তমান বংশধর নন্দলাল বর্তমানে এই উদ্যানবাটির মালিক। দেশীয় সম্ভ্রান্ত সমাজ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে এখানেই মহামান্য ডিউক অব এডিনবর্গকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। উল্লেখ্য যে, মহামান্য উউক এই উদ্যান ও দীঘিসমূহ দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন।
নয়নচাঁদের মধ্যমপুত্র নিমাইচাঁদ কলকাতার বড়বাজারে ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তখন অবশ্য বড়বাজারের নাম ছিল কমল নয়নের বেড়। নিমাইচাঁদ ছিলেন বহু গুণের অধিকারী; বাংলা, ফার্সী এবং ইংরেজি ভাষা তিনি ভালই জানতেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কাছ থেকে তিনি চল্লিশ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন; নিজ চেষ্টায় এই অর্থ থেকেই তিনি বিশেষ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। পাথুরিয়াঘাটার মল্লিক পরিবারের গঙ্গাবিষ্ণু ও রামকৃষ্ণের ভগিনীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। গঙ্গাবিষ্ণু পাথুরিয়াঘাটার বীর নরসিংহের পিতামহ আর রামকৃষ্ণ ছিলেন চোরবাগানের রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের পিতামহ। নিমাইচরণ বল্লভপুরে একটি মন্দির এবং ভাই গৌরচরণের সঙ্গে মিলিতভাবে কাঁচরাপাড়ায় কৃষ্ণরায়জীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি তদানীন্তন সুপ্রীম কোর্টের নিকট পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ জমা রাখেন। তিনি বিপুল ব্যয়ে চৈতন্যমঙ্গল গান, পারায়ণ, তুলট প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন। এ উপলক্ষ্যে তিনি ব্রাহ্মণ, গোস্বামী প্রভৃতিদের সোনার হার, মুক্তার হার, রূপোর থালা দান করতেন; তাছাড়া অন্নবস্ত্র ও কিছু দানসহ কাঙালী-বিদায় তো ছিলই। শ্রীশ্রীসিংহবাহিনীর পূজার পালা পড়লে, তিনি ঋণের দায়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তিদের ঋণের টাকা পরিশোধ করে তাদের মুক্ত করতেন। এতেই তাঁর বদান্যতা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেত। তিন কোটিরও বেশি টাকা ও তালুক প্রভৃতি ভূসম্পত্তি রেখে ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ৭১ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর ছিল দুই মেয়ে ও আট ছেলে : রামগোপাল, রামরতন, রামতনু, রামকানাই, রামমোহন, হীরালাল, স্বরূপচন্দ্র এবং মতিলাল।
১. নিমাইচরণ মল্লিকের জ্যেষ্ঠপুত্র রামগোপালের জন্ম হয় ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৮২৫-এ গৃহদেবতা শ্রীশ্রীগোবিন্দজীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন অবৈতনিক মধ্যস্থ, তাঁর সিদ্ধান্তে বিবদমান দুই পক্ষই খুশি হতেন। তিনি ১৮৩০-এ মূর্তিবাগানের ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনুষ্ঠিত কর্মসভার সভাপতি হয়েছিলেন। বীরচরণা, অদ্বৈতচরণা প্রভৃতি পুত্রদের রেখে তিনি ১৮৩০-এ মারা যান।
২. নিমাইচরণা মল্লিকের মেজ ছেলে রামরতন তাঁর পুত্র পিতাম্বরের বিবাহে প্রচুর অর্থ ব্যায় করেন ৷ সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি কলকাতার কয়েকটা পথে গোলাপজল ছড়ান। ১৮১০-এ তিনি ব্রাহ্মণদের ডবল-বহরের বস্ত্র দান করেন। যাই হোক, লবণের একচেটিয়া কারবারের ফাটকার ব্যবসায়ে তাঁর বিপুল লোকমান হয়। তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৪১ সালে।
৩. নিমাইচরণ মল্লিকের তৃতীয় পুত্র রামতনু বহু সৎ কাজের জন্য তাঁর সময়ে বিখ্যাত ছিলেন। দুই পুত্র রমানাথ ও লোকনাথকে রেখে ১৮৫৩-তে তিনি মারা যান। জ্যেষ্ঠ রমানাথ মারা যান ১৮৬৫-তে। তাঁর তিন পুত্র : কালীচরণ, ভারতীচরণ এবং বিনোদবিহারী ॥ ভারতীচরণ ছিলেন ২৪ পরষণার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট। কলকাতায় মহারাণীর আরতসম্রাজ্ঞী উপাধিধারণ উপলক্ষে তাঁকে একটি সম্মানসূচক প্রশংসাপত্র দান করা হয়।
৪. নিমাইচরণা মালিকের চতুর্থ পুত্র রামকানাই আফিমের ব্যবসা করতে গিয়ে ভীষণভাবে ক্ষতিপ্রাপ্ত হন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৮২৭-এ। বর্তমানে তাঁর পৌত্রগণ গঙ্গানারারণ, নকুড়চন্দ্র, ধনঞ্জয়, শ্যামচাঁদ, নরসিংহদাস প্রভৃতি এই শাখার প্রতিনিধি। প্রপিতামহ নিমাইচরণের গচ্ছিত অর্থ থেকে গঙ্গানারায়ণবাবু পুরীতে জনসাধারণের জন্য একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. নিমাইচরণের পঞ্চম পুত্র রাধামোহন জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার ১৭৭৯-র অক্টোবরে। তিনি তাঁর পূত চরিত্র, হৃদয়বত্তা, শিক্ষা এক চিকিৎসা ও জ্যোতিষীতে পাত্রীর জ্ঞানের জন্য জনসাধারণের মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, বাংলা, বাংলা, ফার্সী ও উর্দু জানতেন– কাজ চালাবার মতো ইংরেজি জ্ঞানও তাঁর ছিল : মহাজনী কারবার করে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। তছাড়া উত্তরাধিকারসূত্রেও তিনি প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন। এই সম্পত্তি পাবার পর তিনি পিতৃপুরুষের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলি সুচাৰুৰূপে চালাবার দিকে মনোনিবেশ করেন। পরিবারের রীতি অনুযায়ী সিংহবাহিনী দেবীর পূজার পালা পড়লে মহা ধুমধানের সঙ্গে তিনি সেটি সম্পন্ন করতেন। পূজো উপলক্ষে স্থল কজ কোর্ট কর্তৃক ঋণের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের তিনি প্রতিবারই মুক্ত করতেন। ১৮৪৩-এ অষ্টাদশ পুরাণ পাঠের অনুষ্ঠান করে তিনি আরও খ্যাতি অর্জন করেন। তিন মাস ধরে এই পাঠ-উৎসব চলত, সে-সময় তিনি প্রতিদিন ব্রাহ্মণ ও গোস্বামীদের সোনা ও মুক্তার হার, রূপোর থালা, কাপড়, শাল প্রভৃতি দক্ষিণা দিতেন আর ব্রাহ্মণ সেবা ও কাঙালী ভোজন তো চলতই৷ তাঁর সময়ে গঙ্গানদীর তীরভূমির অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়, ফলে উত্তর কলকাআর গঙ্গাস্নানার্থীদের অসুবিধার অন্ত ছিল না! এই অসুবিধা দূর করতে প্রচুর অর্থব্যয় করে তিনি একটি ঘাট নির্মাণ করেন। হুগলী ব্রীজের নিকট এখনও (১৮৮১) ঘাটটি বর্তমান। নির্মিত ঘাটের জমিটি ছিল মিউনিসিপ্যালিটির সম্পত্তি, ঐ জমির বিনিময়ে ক্লাইভ স্ট্রিটে অধিকতর মূল্যবান এক খন্ড জমি তিনি মিউনিসিপ্যালিটিকে দান করেন। তাঁর এক কন্যা ও পাঁচ পুত্র : দ্বারকানাথ, তারকনাথ, প্রেষনায়, ভোলানাথ এবং হরনাথ। প্রতিটি সন্তানের বিবাহে তিনি প্রচুর অর্থব্যয় করেন। পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়; মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। সে সময় জীবিত ছিলেন তাঁর তিন পুত্র : তারকনাথ, প্রেমনাথ ও ভোলানাথ। এঁরা তিন ভাইয়ে মিলে মহা ধুমধামের সঙ্গে পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন ৷
ক. রামমোহন মল্লিকের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বারকানাথ পিতার জীবিতকালেই ১৮৫৮ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তিনি অপুত্রক ছিলেন; মৃত্যুর পূর্বে তিনি দত্তক গ্রাহণ করেন, আর দত্তকপুত্রের নাম অটলবিহারী।
খ. রামমোহনের মধ্যমপুত্র তারকনাথ পিতার মৃত্যুর দুবছর পর, ১৮৬৬-তে মারা যান; মৃত্যুকালে রেখে যান পাঁচ পুত্র : ব্ৰহ্মনাথ, যদুনাথ, বৈকুণ্ঠনাথ, বরেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথ।
গ. রামমোহনের তৃতীয় পুত্র প্রেমনাথের জন্ম হয় ১৮১৪ সালে। তিনি তাঁর ভাই ভোলানাথের সঙ্গে একত্রে পুরীতে জগন্নাথ দেবের রন্ধনশালাটি সংস্কার করে দেন; তাছাড়া, পিতৃপুরুষগণের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নতিসাধন করেন ৷ দুই ভাইয়ের মিলিতভাবে বৃন্দাবনের গোবর্ধন ধারের কাছে প্রস্তরনির্মিত ত্রিতলা একটি কুঞ্জবাসী খরিদ করেন, এই বাড়িটির পূর্বনাম ছিল গোস্বামীর হাভেলি। প্রেমনাথবাবু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু, পূজার্চনাতেই তাঁর বহু সময় ব্যয়িত হয়। আর তিন পুত্ৰ : প্ৰসাদদাস, নিত্যলাল এবং মনু্লার। প্ৰসাদ দাস বাবু আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে একটি পারিবারিক সাহিত্য ক্লাব স্থাপন করেন; তিনিই আর উৎসাহী সম্পাদক ৷ এই ক্লাবের সমগ্র ব্যয়ভার তিনিই বহন করেন৷
ঘ. রামমোহন মল্লিকের চতুর্থ পুত্র ভোলানাথের জন্ম হয় ১৮১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল আছে। অত্যন্ত সহজে তিনি বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করতে পারেন। তিনি জন সেবাপরায়ণা, দরিদ্রদের অন্নবস্ত্র দান করা তাঁর স্বভাব। তাঁর একমাত্র পুত্র বলাইচাঁদ সাদাসিধা সরল যুরক।
ঙ. রামমোহন মল্লিকের পঞ্চম পুত্র হরনাথ দুটি বুদ্ধিমান পুত্র রেখে পিতার জীবিতকালেই ১৮৪৮ সালে মারা যান। তাঁর পুত্রদের নাম তুলসীদান ও মহেশচন্দ্ৰ ৷
চ. নিমাইচরণ মল্লিকের ষষ্ঠ পুত্র হীরালালা যৌবনেই মারা যান। তিনি রেখে যান চার কন্যা : শ্রীমতী রঙ্গনমণি দাসী, জয়মণি দাসী, অপর্ণা দাসী এবং নবীন কুমারী দাসী। এঁদের মধ্যে জয়মণি দুই পুত্র রেখে মারা যান; তাঁরা হলেন হরিদাস দত্ত ও সিংহীদাস দত্ত। হরিদাস দত্ত একটি দত্তক পুত্র রেখে মারা যান।
ছ. নিমাইচরণ মল্লিকের সপ্তম পুত্র স্বরূপচন্দ্র বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। তিনি পুটি বাংলা উপন্যাস রচনা করেন। তিনি দুই পুত্র নিত্যানন্দ ও চৈতন্যচরণকে রেখে ১৮৪৮-এ মারা যান। চৈতন্যচরণের মৃত্যু হয় ১৮৭৫-এ। তাঁর একটি দত্তক পুত্র ছিল; তাঁর নাম যোগেন্দ্রনাথ মল্লিক।
জ. নিমাইচরণ মল্লিকের অষ্টম পুত্র মতিলাল বৃন্দাবনে একটি কুঞ্জবাটী নির্মাণ করেন। পুরাণ পাঠের জন্য ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণাদানে শ্রীশ্রীসিংহবাহিনীর ও তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীরাধাশ্যামজীর পূজা উপলক্ষে তিনি প্রচুর ব্যয় করতেন। দত্তক পুত্র যদুলাল মল্লিককে রেখে তিনি ১৮৪৬-এ মারা যান। মতিলালের বিধবা স্ত্রী মাহেশে একটি কুঞ্জবাটী নির্মাণ করেন; সেখানে প্রতিদিন দরিদ্র নারায়ণের সেবা করা হয়।
পিতার মৃত্যুকাল থেকে আজ পর্যন্ত বাবু যদুলাল মল্লিক কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে করে আসছেন। ১৮৭৮-এ তিনি বিপুল ব্যয়ে মায়ের তুলা ও পারায়ণ সম্পন্ন করেন। তিনি কলকাতা ও ২৪ পরগণার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভ্য। বহু জনের কাছেই তিনি শিক্ষিত, বুদ্ধিমান সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরূপে পরিচিত। ইংল্যান্ডেশ্বরীর ভারত সম্রাজ্ঞী খেতাব ধারণ উপলক্ষে ১৮৭৭-এর ১ জানুয়ারি কলকাতার অনুষ্ঠিত দরবারে তাঁকে সাম্মানিক প্রশংসা-পত্র দেওয়া হয়।
১৮৮০-র ১০ জানুয়ারী বাবু যদুলাল মল্লিক হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত তাঁর দক্ষিণেশ্বরের জমকালো উদ্যানবাটীতে বিশেষ আনন্দময় একটি মিলনোৎসবের অনুষ্ঠান করেন। স্যার রিচার্ড গার্থ, মিঃ ডব্লু এম সাউটার, মিঃ এ. ম্যাকেঞ্জী, দি অনারেবল মিঃ সি টি বাকলান্ড, দি অনারেবল মিঃ ইগলিস, দি অনারেবল মিঃ কলভিন, দি অনারেবল মিঃ ফিল্ড, মিঃ পীকক, দি অনারেবল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই, মহারাজা কমল কৃষ্ণ বাহাদুর, মহারাজা নরেন্দ্র কৃষ্ণ বাহাদুর, ডাঃ রাজেন্দ্র লাল (?) মিত্র, সি আই ই, দি অনারেবল রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর, সি আই ই এবং আরও বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানের আর একটি আনন্দদায়ক কর্মসূচি ছিল মেয়ো হাসপাতাল থেকে দক্ষিণেশ্বরের উদ্যানবাটী এবং সেখান থেকে মেয়ো হাসপাতাল পর্যন্ত স্টিমারে অতিথিবর্গের প্রমোদ-ভ্রমণ। বাবু যদুলালের ইউরোপীয় ও দেশীয় অতিথিগণকে অতি উপাদেয় ভোজ্য দ্বারা আপ্যায়িত করা হয়েছিল। এই উৎসব উপলক্ষে উদ্যানবাটীটিকে অত্যন্ত সুরুচিপুর্ণভাবে আলো, মালা, ফুলপাতা ও পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল; তার সঙ্গে ছিল নাচ, দেহ সৌষ্ঠব ও ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শন। সব মিলিয়ে অতিথিবর্গ সেদিন প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলেন।