বড়বাজারের দেওয়ান কাশীনাথের পরিবারবর্গ
কাশীনাথের পিতামহ ঘাসীরাম ছিলেন সম্রাট শাহ্ জাহানের শাসনকালের শেষ দিকে তাঁর অন্যতম দেওয়ান; বাদশাহী দরবারে তাঁর যথেষ্ট প্রতিষ্ঠাও ছিল। জাতিতে ক্ষেত্রীটুনন ঘাসীরাম লাহোরে বাস করতেন, সেখানেই তিনি প্রবীণ বয়সে পরলোকগমন করেন । তাঁর বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন তাঁর একমাত্র পুত্র মুলুকচাঁদ । তাঁর বহু বিস্তৃত ব্যবসায় বাণিজ্য চালাবার জন্য মুকুলচাঁদ প্রথমে মুর্শিদাবাদে এবং পরে কলকাতায় বসবাস করতে থাকেন ।
মুলুকচাঁদ (বিভিন্ন কারণে) মুর্শিদাবাদ ছেড়ে কলকাতায় বাস করতে আসেন; গোঁড়া হিন্দু মুলুকচাঁদ গঙ্গার সান্নিধ্য পাবার নিশ্চয়তায় কলকাতাকে পছন্দ করেন। ব্যবসায়ী হলেও মুলুকচাঁদ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত অনুরাগী ছিলেন । তিনিও পরিণত বয়সেই পরলোকগমন করেন । মৃত্যুকালে তাঁর একমাত্র পুত্র দেওয়ান কাশীনাথ (সাধারণ্যে কাশীনাথ বাবু নামে সমধিক পরিচিত) বর্তমান ছিলেন ।
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগে কাশীনাথ কিছুকাল কর্নেল ক্লাইভের দেওয়ান রূপে কাজ করেন । এই সঙ্গে তিনি উত্তর পশ্চিম প্রদেশের এবং ভারতের অন্যান্য অংশের বহু রাজা ও ধনী ব্যক্তির কলকাতাস্থ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতে থাকেন ।
১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশীজুড়ার (কাশীজোড়) রাজার বিরুদ্ধে একটি মামলা রুজু করেন । এই মামলায় ওয়ারেন হেস্টিংস রাজার পক্ষ অবলম্বন করেন । রাজাকে কোর্টের অধিকার স্বীকার করতে নিষেধ করেন, এবং সামরিক ব্যক্তিদের শেরিফের কর্মচারীবর্গকে বাধা দেবার নির্দেশ দেন। গভর্নর জেনারেল হিসাবে তিনি একটি ঘোষণা জারি করে ‘সকল জমিদার, তালুকদার এবং চৌধুরীদের আদেশ দেন যে, তাঁরা ব্রিটিশের প্রজা না হলে বা কোন চুক্তিদ্বারা আবদ্ধ না থাকলে, সুপ্রীম কোর্টের রায় যেন না মানেন; প্রাদেশিক শাসকদের নির্দেশ কার্যকর করার জন্য তাঁরা যেন সামরিক সহায়তা না দেন ।’ উত্যক্ত হয়ে কোর্ট শেষ পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন যে, কাশীনাথের মামলায় তাঁর কোর্টের অফিসারদের আটক করেছেন, এই অভিযোগ এনে আদালতে হাজির হবার জন্য তাঁদের ওপর সমন জারি করলেন । হেস্টিংস অবিলম্বে জানিয়ে দিলেন যে, পদাধিকার বলে তাঁরা (মিনি ও কাউন্সিলের সভ্যগণ) যে কাজ করছেন, তার জন্য কোর্টের আদেশ মানবেন না । ইতিমধ্যে গভর্নর জেনারেল এবং কলকাতাবাসী বহু ইংরেজ কোর্টের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে আবেদন জানালেন । এই সকল ঘটনা ঘটে ১৭৮০-এর মার্চ মাসে। বিষয়টি (পার্লামেন্টে) বিশদরূপে আলোচিত হবার পর একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে সারা দেশের উপর বিচার ক্ষমতা প্রয়োগ করা থেকে কোর্টকে বিরত করা হয়– অধিকার লাভের জন্য কোর্ট অবশ্য বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন । এই মামলায় দেওয়ান কাশীনাথ প্রভূত আর্থিক ক্ষতি স্বীকারে বাধ্য হন, কিন্তু তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন কাশীনাথ অবশ্য শীঘ্রই এই ক্ষতি পুষিয়ে নেন ।
দেওয়ান কাশীনাথ সংস্কৃত, ফার্সী এবং অন্যান্য কয়েকটি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন; কাজ চালাবার মতো ইংরেজি ভাষাও তিনি জানতেন । ধর্মপ্রাণ হিন্দু ছিলেন বলে তিনি বড়বাজারে একটি বিরাট মন্দির নির্মাণ করে শ্যামলজীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, এবং মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য ‘নূতন চক’ দান করেন। লঙ্গরনাথের মন্দির ও মূর্তিও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন । সুন্দরবন থেকে জুম্মা শাহ্ পীর কলকাতা এলে, তাঁর নিবাসের জন্য কাশীনাথ একটি পাকা বাড়ি দান করেন । বাড়িটি আজও (১৮৮১) বড়বাজারে বর্তমান । পূণ্যার্থে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এই বাড়িতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান । ধার্মিক ও পুণ্যবান বলে এই পীরের তখনকার দিনে বিশেষ খ্যাতি ছিল ।
খুব বৃদ্ধ বয়সে দেওয়ান কাশীনাথের মৃত্যু হয় । মৃত্যুকালে তাঁর দুই পুত্ৰ শ্যামল দাস ও শ্যামাচরণ বর্তমান ছিলেন । শ্যামল দাসের পৌত্র দামোদর দাস এখন এই প্রাচীন সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারের কর্তা ।
বাবু দামোদর দাস সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা ভালই জানেন । রাজাবাবু নামেই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ । তিনি ধর্মপ্রাণ ও চরিত্রবান । ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের তিনি সভ্য । ইংল্যান্ডের রাণীর ভারতসম্রাজ্ঞী পদবী ধারণ উপলক্ষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত দরবারে দামোদরবাবুকে সাম্মানিক প্রশংসাপত্র দেওয়া হয় । কলকাতার নূতন চক কাশীবাবুর বাজার প্রভৃতি সম্পত্তি ছাড়াও মেদিনীপুর ও ২৪ পরগণায় তাঁর জমিদারী আছে । জানা যায় যে, রাজাকাটরা, কাশীপুর প্রভৃতি কাশীনাথবাবুরই সম্পত্তি ছিল; কলকাতার বিখ্যাত শিখ, কোটিপতি হুজুরীমলের বিস্তৃত মূল্যবান সম্পত্তি কাশীনাথবাবুই কিনে নিয়েছিলেন । কালীঘাটের প্রাচীন ও প্রখ্যাত মন্দিরটি এই হুজরীমলই নিৰ্মাণ করিয়ে দেন ।