বড়পিসিমা – সমরেশ মজুমদার

বড়পিসিমা – সমরেশ মজুমদার

আমার বড়পিসিমার সঙ্গে প্রেতাত্মাদের খুব যোগাযোগ ছিল৷

আমরা তখন থাকতাম চা-বাগানের বাড়িতে৷ ওখানে গাছগাছালি বেশি, সেসময় ইলেকট্রিকের আলোও যায়নি বাড়িতে অথবা রাস্তায়৷ সন্ধে নামলেই পৃথিবীটা ঝুপসি কালো হয়ে যেত৷ আর হ্যারিকেনের আলো ছাড়া এক পা এগোবার উপায় ছিল না৷

বাড়িটা ছিল বেশ বড়৷ শোওয়ার ঘরগুলোর পেছনে চওড়া উঠোন৷ উঠোনে একটা পেল্লাই বুড়ি কাঁঠালগাছ, লিচুগাছ আর তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকত৷ তালগাছে ফল হয়নি কোনোদিন৷ তার ওপাশে আমাদের পায়খানা৷ উল্টোদিকে রান্না এবং খাওয়ার ঘর৷ সন্ধের পর ওদিকে যেতে খুব ভয় করত৷ বড়পিসিমা স্বচ্ছন্দে হেঁটে যেতেন৷ বাড়িটার পেছনে ছিল সজনেগাছের জঙ্গল, গোয়ালঘর, তার পেছনে ছোট্ট নদী—যেটা চা-বাগানে গিয়ে হুইল ঘোরাচ্ছে৷ দিনের বেলায় যা একরকম, রাত্রে তার চেহারাই বদলে যেত৷

বড়পিসিমার বিয়ে হয়েছিল এগার বছর বয়সে৷ পাত্রের বয়স তখন আঠারো৷ তিনি নাকি খুবই সুদর্শন ছিলেন৷ বিয়ের পর মাত্র ছয়মাসের জন্যে বড়পিসিমা শ্বশুরবাড়িতে যান—চা-বাগান থেকে চাকদহে৷ ফিরে এলেন বিধবা হয়ে৷ তখন আমার বাবার বয়স মাত্র ছয়মাস এবং ঠাকুমা মারা গিয়েছেন কালাজ্বরে৷ সেই থেকে বড়পিসিমা এ বাড়িতেই৷ বাবা-জেঠাদের মানুষ করে আমাকেও সেই চেষ্টা করে গেছেন৷

বড়পিসিমার মন ভালো থাকলে ভরদুপুরে একটা গল্প শুনতাম৷ তাঁকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘তুমি তাঁদের প্রথম কবে দেখলে?’

বড়পিসিমা বলতেন, ‘তাঁদের আবার কি? তোর ঠাকুমাকে দেখলাম৷ বাবা চলে গিয়েছে অফিসে৷ তোর জেঠা স্কুলে৷ আমি তোর বাবাকে ঘুম পাড়াচ্ছি, সে কিছুতেই ঘুমাবে না৷ মায়ের দুধ না খেলে ঘুমাত না তো! বাইরে বেশ কড়া রোদ৷ হঠাৎ টিনের চালে মড়মড় করে শব্দ হল৷ ভাবলাম কোনো গাছ থেকে ডাল খসে পড়ল বোধহয়৷ তারপর সিলিং-এ শব্দ হল৷ বুঝলাম বেড়াল ঢুকেছে৷ হেই-হেই করে তাড়ালাম৷ আর তারপরেই গায়ে গরম হাওয়া লাগল৷ হাওয়া আসবে কোত্থেকে, জানলা তো বন্ধ! তখনি বোঁটকা গন্ধ নাকে ঢুকল৷

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে?’

সঙ্গে সঙ্গে মশারির চালটা নড়ে উঠল, স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ‘ওরে, ওকে ভরপেট দুধ খাওয়া!’

নাকি-নাকি-স্বর কিন্তু মায়ের গলা চিনতে ভুল হল না৷ বললাম, ‘দুধ খাইয়েছি!’’

‘তবে কাঁদে কেন?’

‘আমি কি করে বুঝব? আমার হাড় জ্বালিয়ে ছাড়ছে!’

‘আহা, তুই ফিরে এসেছিস বলে আমি নিশ্চিন্ত৷ ওকে দেখিস৷’ তারপর মা যে চলে গেল সেটা বুঝতে পারলাম গন্ধটা উধাও হয়ে গেল বলে!

বড়পিসিমার গল্প শেষ হলে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার ভয় লাগেনি?’

‘ভয় লাগবে কেন, বরং খুব রাগ হচ্ছিল৷ কোনো মা মেয়ে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে বলে নিশ্চিন্ত হয়? কি স্বার্থপর মানুষ!’

‘দাদুকে বলনি?’

‘বলেছি৷ কোনো উত্তর দেয়নি, গম্ভীর হয়ে বসেছিল৷ তারপরেই জনার্দন ঠাকুরকে ডেকে এনে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করেছিল ধুমধাম করে৷’

‘আর ঠাকুমাকে দ্যাখোনি?’

‘দেখেছি৷ বাবা তো আবার বিয়ে করেছিল৷ ছোটমা আসার পর একদিন ভোরবেলায় উঠোনে গিয়েছি—দেখলাম কাঁঠালগাছটা খুব নড়ছে৷ নিচে যেতেই শুনলাম আমার নাম ধরে মা বলছে, ‘আমি চললাম, এখন তো তোরা নতুন মা পেয়ে গেছিস৷ সতীনের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে পারব না বাপু৷ ভাইদের দেখিস৷ ব্যাস, আর দেখিনি৷’

বড়পিসিমার কথা অবিশ্বাস করার কোনো যুক্তি পাইনি৷ ওই মানুষকে কখনো মিথ্যে বলতে শুনিনি৷ কোনো কথা তাঁকে বলে কাউকে জানাতে নিষেধ করলে দেখা যেত তিনি না বলে থাকতে পারেন না৷ বড়পিসিমা খুব সরল মানুষ ছিলেন৷

আমাদের বাড়িতে যে মানুষটি কাজ করতেন তাকে আমরা কাকা বলে ডাকতাম৷ সেই কাকা একবার নালিশ করলেন, রাত্রে নদীতে বাসন মাজতে যাবেন না৷ নদীর গায়ে একটা সিমেন্টের স্লাব পাতা হয়েছে যার ওপর বসে কাকা বাসন মাজেন, কাপড় কাচেন৷ রোজ রাত্রে পাশে হ্যারিকেন নামিয়ে বাসনমাজা শুরু করলেই কেউ তাঁকে কুল ছুঁড়ে মারে৷ নদীর গায়ে কয়েকটা কুলগাছ ছিল৷ বড়পিসিমা সেই রাত্রে কাকার সঙ্গে নদীর ধারে গেলেন৷ কাকার মুখে শোনা গেল, ‘বড়দি পাশে দাঁড়িয়েছিল বলে কেউ আর কুল ছুঁড়ছিল না৷ কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়, শেষ পর্যন্ত ছুঁড়ল! সঙ্গে সঙ্গে বড়দি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে রে? কোন হতভাগা?’

প্রথমে সাড়া এল না৷ বড়দি কুলগাছের দিকে এগিয়ে গেল অন্ধকারে, ‘কে ওখানে?’

‘আমি মাখন৷’ নাকি-নাকি গলায় জবাব এল৷

‘ওখানে কি করছিস?’

‘এমনি বসে আছি৷’

‘কুল ছুঁড়ছিস কেন?’

‘মাছের কাঁটা দেখে৷ রোজ রোজ মাছ খাও তোমরা!’

‘তাতে তোর কি? আর আমি তো বিধবা, আমি মাছ খাই?’

‘তোমার কথা বলছি না৷ তবে জানো, আমাদের বাবুর মা দুপুরবেলা রান্নাঘরে লুকিয়ে মাছ খায়৷ সে-ও তো বিধবা৷ আমার মাছ খেতে খুব ভালো লাগে৷’

‘ঠিক আছে, কাল থেকে তোর জন্যে একটুকরো পাঠিয়ে দেব৷ আর কুল ছুঁড়বি না৷’

‘আচ্ছা৷ তুমি খুব ভালো৷’

পরের দিন বড়পিসিমা গেলেন পাশের কোয়ার্টার্সে৷ ওদের চাকর মাখন কুলগাছ থেকে পড়ে মরে গিয়েছিল মাসতিনেক আগে৷ বড়পিসিমার কথায় তারা সেই কুল গাছের নিচে মাখনের শ্রাদ্ধ করল৷ তাতে প্রচুর মাছ ছিল৷ তারপর থেকে কাকাকে আর কুল ছুঁড়ে মারেনি মাখন৷

আমার সেজপিসিমা আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ জন্মাবার পর মায়ের শরীর খারাপ ছিল বলে ওঁর বুকের দুধ খেয়েছি কিছুদিন৷ ওঁর মেয়ে আমারই সমবয়সী৷ চা-বাগান থেকে মাইল দুয়েক দূরে গঞ্জে ওঁদের বাড়ি৷ পিসেমশাই ব্যবসা করতেন৷ হঠাৎ খবর এল সেজপিসিমা মারা গিয়েছেন৷ বড়পিসিমার হাত ধরে আমি গেলাম সেজপিসিমাকে দেখতে৷ সেই প্রথম আমার মৃতদেহ দর্শন৷ মনে আছে, দরজার দিকে পা ফিরিয়ে শোওয়া বলে আমি প্রথমে ওঁর সিঁদুরমাখা পা-জোড়া দেখেছিলাম৷ এলোচুলে শুয়ে আছেন না ঘুমিয়ে, বোঝা যাচ্ছিল না৷ কিন্তু এখনো স্মৃতিতে ওই সিঁদুরলেপা জোড়া-পা জ্বলজ্বল করে৷

অনেক কান্নাকাটির পর যখন সবাই ওঁকে শ্মশানে নিয়ে গেল, তখন বড়পিসিমা আবার আমার হাত ধরে ফিরে আসছিলেন৷ তখন চা-বাগানে মানুষ কম৷ দুপাশে দেওদার আর শালের মতো ঝাঁকড়া গাছের নিচে নির্জন রাস্তা৷ কেঁদে কেঁদে পিসিমার মুখচোখ ফুলে গেছে৷ হঠাৎ বড়পিসিমা দাঁড়িয়ে গেলেন, ‘এ্যাই টুনি, তুই কেন সঙ্গে আসছিস? না না, এটা ভালো কথা নয়, বাচ্চা ছেলে ভয় পাবে! তোর তো এখন শ্মশানে থাকা উচিত৷ কি? না! নিজের দেহ ছাই হয়ে যাচ্ছে—তা নিজের চোখে দেখতে হয়৷ যাঃ৷’

বড়পিসিমাকে আঁকড়ে ধরেছি ততক্ষণে৷ তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না নিশ্চিন্ত হলেন৷ বাড়িতে ফেরার পর স্নান করলেন, আমাকেও করালেন৷ তারপর ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে চন্দন দিয়ে আমার কপালে মা শব্দটি লিখে বললেন, ‘আজ তোমার এক মাতৃবিয়োগ হল!’

‘মানে? আমার মা তো বেঁচে আছে?’

‘সে তোমার গর্ভধারিণী মা! টুনি তোমাকে বুকের দুধ দিয়ে বাঁচিয়েছিল, সে তোমার দ্বিতীয় মা৷ ভগবানকে বলো তিনি যেন তাকে কাছে ডেকে নেন৷’

এর অনেক বছর পরে, আমি তখন চাকরি করি, জলপাইগুড়িতে গিয়েছি৷ একদিন বড়পিসিমা বললেন, ‘তোর জ্যাঠা মারা গিয়েছে রে!’

‘মারা গিয়েছে? কবে?’

‘তা জানি না৷ কাল আমার কাছে এসেছিল৷ খুব বকলাম৷ তখন হেসে বলল, আর কি হবে বলো, শোধরাতে পারব না তো! বেঁচে থাকলে না-হয় চেষ্টা করতাম৷’

জেঠার কার্যকলাপে বিরক্ত ঠাকুর্দা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন৷ আমাদের ওপর নিষেধ ছিল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার৷ জ্ঞান হবার পর তাঁকে আমি দেখিনি৷ পরের দিন মালবাজার থেকে খবর এল জেঠা মারা গিয়েছেন সপ্তাহখানেক হল৷

ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর বড়পিসিমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁকে দেখেছেন কিনা৷ তিনি মাথা নেড়েছেন, ‘সবাই তো আর এখানে থাকে না৷ বাবা অন্য স্তরে উঠে গেছে৷’

‘আপনি নিজে যখন মারা যাবেন, তখন আমাকে দেখা দেবেন?’

‘পাগল! আজন্ম তোদের বাড়িতে বন্দী হয়ে আছি, এখান থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি!’

বড়পিসিমা এখন পর্যন্ত আমাকে দেখা দেননি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *