বড়দার বেড়াল
আমার বড়মামার দুটো বেড়াল। একটার নাম চাঁদিয়াল, আর একটার নাম ঘোড়েল। চাঁদিয়াল নামটা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত। কারো কোনও প্রতিবাদ ছিল না। সাদা ধবধবে বেড়াল, একপাশে পেটের কাছে গোলমতো কালো একটা ছাপ, যেন কম্পাস ফেলে আঁকা। বেড়ালের আকাশে কালো চাঁদ। বেড়ালটার স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো। সর্বক্ষণ একপাশে চোখ বুজিয়ে বসে থাকে, যেন ধ্যানমগ্ন। মাসিমা যখন খেতে দেয় তখন খায়। তারপর সামনের ডানথাবায় মুখটুখ মুছে আবার ধ্যানে বসে পড়ে। কোনও দিন ইচ্ছেটিচ্ছে হলে গা হাত পা একটু চাটাচাটি করে। নয় তো ওই সব ঝামেলার মধ্যে একেবারেই যেতে চায় না। বড়মামার থিওরি হল, বেড়ালের লোমে এমন একাট কেমিকেল আছে যাতে অটো ক্লিনিং হয়ে যায়, টেপরেকর্ডারের অটো স্টপের মতো, রেফ্রিজারেটারের অটো ডি-ফ্রস্টিং-এর মতো।
মাসিমা শুনে বলেছিলেন, ‘রাখো তো! বেড়ালের মতো অলস প্রাণী আর দুটি নেই। লেজি ক্যাট।’
বড়মামা বেড়াল গবেষণায় আরও কিছুটা এগিয়েছেন। তাঁর ধারণা, চাঁদিয়াল হল ছদ্মবেশী সাধক। রূপ গোপন করে আছে। সারাদিন ধ্যানমগ্ন। এক কড়া দুধ খোলা পড়ে আছে। একটু চোখে দেখার সামান্যতম ইচ্ছে নেই। মাছ পড়ে আছে, মানুষের তো একদিনও চুরি করার ইচ্ছে হয়! চাঁদিয়াল নির্বিকার। কার্নিসে বসে স্পেশ্যাল কোনও ধ্যান করছে নিরালম্ব সাধন প্রণালী অনুসারে। দুটো পরশ্রীকাতর ছোটলোক শ্রেণীর কাক এসে প্রলম্বিত লেজে প্যাঁক প্যাঁক ঠোকর মারছে। চাঁদিয়ালের কী সহিষ্ণুতা। ভুরু কুঁচকে মাঝে মাঝে ক্যাঁক শব্দ ছাড়া আর কিছুই করছে না। মাঝে মধ্যে চড়াই পাখি এসে মাথা চুলকে দিয়ে যায়।
এ বেড়াল বেড়াল নয়, লুক্কায়িত সাধক। হিংসা, লোভ, ক্রোধ সব জয় করেছে। এ বেড়াল ইঁদুরের চৌকিদার হতে পারে। এ বেড়ালকে ভাঁড়ারের চার্জে বিশ্বাস করে বসানো যায়। আস্থাভাজন বেড়াল।
মেজোমামা এই সব শুনতে শুনতে একদিন বললেন, ‘আমার একটা ছোট্ট প্রতিবাদ আছে ভারতীয় সাধক সমাজের তরফ থেকে। তাঁরা বৃন্দাবনে বৃক্ষ হয়ে থাকতে পারেন, তাঁরা কোন দুঃখে বড়দার বেড়াল হতে যাবেন! আই রেজিস্টার মাই আম্বল প্রোটেস্ট ইন দিস রিগার্ড।’ মেজোমামা আজকাল পাইপ ধরেছেন। সায়েবি চালচলন। টিভিতে টেনিস খেলা দেখেন। শোনা যাচ্ছে গলফ খেলবেন। খেতে বসে এক চুমুকে এক বাটি ডাল সাবাড়। ওইটাই হল স্যুপ।
মেজোমামা পাইপ পরিষ্কারে মন দিলেন। মাসিমা বসে আছে। বড়মামা বহুক্ষণ ধরে একটা ওষুধের শিশির ছিপি খোলার চেষ্টায় জেরবার। যা হয়, প্যাঁচ ঘুরে গেছে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কেবলই বলছেন, ‘ধ্যাত তেরিকা। ধ্যাত তেরিকা।’
মাসিমা বললেন, ‘মেজদার কথাটা শুনলে?’
—শুনেছি।
—কিছু বলার আছে!
—জাস্ট উলটে দিলুম। সাধক বেড়াল হয়েছে বললে আপত্তি, বেশ, তাহলে বলি, বেড়াল সাধক হয়েছে। এতে তো আপত্তি নেই!
মেজোমামা বললেন, ‘অর্থাৎ, বেড়াল তপস্বী।’
বড়ামা উঠে চলে গেলেন। বাইরে থেকে আমাকে হেঁকে বললেন, ‘ছুরি, কাঁচি, দা, কাটারি, যা পাশ নিয়ে যায়। শিশির ছিপি খুলব, তবে জলস্পর্শ করব।’
মেজোমামা যোগ করলেন, ‘চিতোর রাণার পণ। ফ্রি স্যাম্পলের ওই দশাই হয়। ওষুধ খেতে হলে আমাদের মতো পয়সা খরচ করে খেতে হয়। এ যেন মানুষ মারা হচ্ছে। ওরে, আগে একটা এ.টি.এস. দিয়ে দে। রক্তারক্তি তো হবেই।’
বড়মামার যাবতীয় কেরামতিকে আমরা সকলেই ভয় পাই। একবার পাখার ব্লেড পরিষ্কার করার জন্যে ঘড়াঞ্চিতে উঠেছিলেন। সবসুদ্ধ হুড়মুড় করে পড়ে তিনমাস পায়ে প্লাস্টার। ছবি টাঙাবেন, দেয়ালে পেরেক মারছেন। সেখানেও অধৈর্য, ধ্যাততেরিকা। বুড়ো আঙুলের মাথা হাতুড়ির এক ঘায়ে থেঁতো। এতখানি ব্যাণ্ডেজ। আঙুল ফুলে কলাগাছ।
মাসিমা শিশিটা বড়মামার হাত থেকে কেড়ে নিয়েই লাফিয়ে উঠলেন, ‘এ কী! এ তো তরল আলতা! আলতার শিশি নিয়ে তুমি এতক্ষণ ধরে কী করছ!’
বড়মামা ঘাবড়ে গেছেন। ‘আলতা! আমি তো ভেবেছি কাফ মিকশ্চার।’
—এটা তোমার কাফ মিকশ্চার? একবার পড়ে দেখবে তো! খুলে গেলে কী করতে?’
—দু চামচ পরিমাণ গালে ঢেলে দিতুম।
মেজোমামার ঠোঁটে পাইপ। উঠে এসেছেন বারান্দায়। বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘একটা জিনিস। মুকুজ্যে ফ্যামিলিতে এই এক পিসই পাবি। আলতা খেয়ে সতী সাবিত্রী হওয়ার ইচ্ছে। তোর মনে আছে কুসি, সোদপুরের মেলা থেকে একবার একটা এঁড়ে বাছুর কিনে এনেছিল। রোজ খাঁটি দুধ খাবে!’
বড়মামা দমে না গিয়ে বললেন, ‘তুই আর কথা বলিসনি। একবার লেবেল না পড়ে টিংচার আইডিন খেয়েছিলিস। মনে আছে কুসি? আর হাতিবাগান থেকে কিনে এনেছিল অ্যালসেশিয়ানের বাচ্চা। হঠাৎ একদিন শেষ প্রহরে ডাক ছাড়ল, হুক্কা, হুয়া, কেয়া হুয়া। তাড়া তাড়া, ব্যাটা শেয়ালের পো।’
মাসিমা রায় দিলেন, ‘এক পিস মুকুজ্যে নয়, দু পিস। দুটি ভারতরত্ন। এ বলে, আমায় দেখ, ও বলে, আমায় দেখ।’
বড়মামা এ গাল হেসে বললেন, ‘আমরা ওই রকমই, কী বল মেজো? ভোলে ভালে।’ মেজোমামা বললেন, ‘আমি অনেকটা চেঞ্জ করে গেছি। সম্প্রতি সিডনি থেকে ঘুরে আসার পর একেবারে পাককা সায়েব। তুমি এখনো যে গেঁইয়া, সেই গেঁইয়াই। মানুষ আর হতে পারলে কই। আঙুল চেটে চেটে ভাত খাও, চেয়ারে ঠ্যাং তুলে বসার অভ্যাস, ঢ্যাড়স করে ঢেঁকুর তোলো। গামছা দিয়ে গা মোছো। লজ্জা, লজ্জা, শেম, শেম।’ বড়মামা ফুঃ করে একটা আওয়াজ করলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সায়েব! বলিস নি, বলিস নি, লোকে হাসবে। সায়েব একমাত্র ইংল্যান্ডেই পাওয়া যায়। সাদা, সাদা। তাদের কথা তুই একবর্ণও বুঝতে পারবি না। সাধারণ একটা ইংরিজি যেমন ধর ওয়াটার, কি ভাবে উচ্চারণ করবে জানিস, ওটাররর। ওরা দি বলে না, বলে দ্যা। সায়েব অত শস্তা নয়। থ্রি পিস স্যুট পরে। গলায় টাই। গিঁট দেবার কায়দা জানিস, টানলেই ফস। তুইও তো পরিস, কাঁচি দিয়ে কেটে খুলতে হয়। সায়েব হয়ে জন্মাতে হয়, জন্মে সায়েব হওয়া যায় না।’
কাজিয়া আরও এগতো। বড়মামার কমপাউন্ডার হুড়তে পুড়তে এসে হাজির। বৃদ্ধ হাঁপাচ্ছেন আর হায় হায় করছেন, ‘সর্বনাশ হয়ে গেল, নৃশংস হত্যাকাণ্ড।’
শুদ্ধ বাংলা শুনে সুদ্ধ বাংলায় বড় মামার প্রশ্ন, ‘কোথায় সংঘটিত হল?’
—আপনার চেম্বারে।
—চেম্বারে! সে কী! আপনি অ্যালাউ করলেন কেন?
—হ্যাট হ্যাট করতে করতেই ওষুধের বড় আলমারিটার তলায় চলে গেল।
—কে গেল, খুনী?
—আপনাদের ধুমসো বেড়ালটা। এই এত বড় একটা পায়রা ধরেছে। ধড়ফড়, ধড়ফড় করছে। গোলাপি রঙের জ্বলজ্যান্ত, টাটকা একটা পায়রা।
বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘এ ওই ঘোড়েলটার কাজ। মেজোর আদরে একটা বাঁদর তৈরি হয়েছে। এত খাচ্ছে, ব্রেক ফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার, তবু জীব হিংসা। চলুন, চলুন, কোনওরকমে বাঁচান যায় কি না দেখি। আপনি স্যালাইন রেডি করুন। ইললিটারেট ক্যাট। ওটাকে আজই বিদায় করব। বস্তায় ভরে সোজা ব্যারাকপুরে। জানোয়ার।’
দলবল বড়মামার চেম্বারে। মেজোমামাও আছেন। বড়মামার পেয়ারের সাগরেদ মনিদার হাতে একটা লাঠি। মাসিমার মুখে চেহারা করুণতম। রোজ সকালে পায়রাদের দানা খাওয়ান। চারপাশে ফট ফট করে ওড়াওড়ি করে। কাঁধে এসে বসে।
কম্পাউণ্ডারবাবু বলছেন, ‘ফেরোসাস বেড়াল মশাই। আমি তাড়া দিতেই গোঁ গোঁ করছিল। পারলে পায়রা ছেড়ে আমাকেই ধরে।’
তাড়া খেয়ে আলমারির তলা থেকে বেড়ালটা পায়রামুখে বেরিয়ে এল।
মেজোমামার চিৎকার, মুখ থেকে পাইপ পড়ে গেল, ‘লুক হিয়ার, এ আমার ঘোড়েল নয়, আমাদের ওয়ান পিস বড়দার সাধক বেড়াল চাঁদিয়াল। আজ তার ধ্যান ভেঙেছে, আজ তার পতন হয়েছে।’
ধর, ধর, মহা ছুটোছুটি। তাড়া খেয়ে চাঁদিয়াল পায়রা ফেলে সোজা মিটার ঘরের ছাদে। ক্ষিপ্ত বড়মামা মনিদাকে বলছেন, ‘আজ ব্যাটাকে কিমা কর। আমার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছে।’ মেজোমামা বললেন, ‘প্রেস্টিজ পাংচার করেনি বড়দা, তোমার বেড়ালটা এতদিনে বেড়াল হল। ছিল একটা ভ্যাবা গঙ্গারাম। ভেবে দেখো বাঘ যদি মানুষ না খেয়ে ছাগলের মতো বটপাতা খায় তাকে কেউ টাইগার বলবে? বেড়াল যদি ফলাহারী হয় তাকে তুমি বেড়াল বলবে। বেড়ালের যা করা উচিত এতদিনে তাই করে জাতে উঠল। ব্র্যাভো চাঁদিয়াল ব্র্যাভো!’
মাসিমা পায়রাটাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। চাঁদিয়াল গলায় একটা দাঁত বসিয়েছে। রক্ত বেরোচ্ছে। এতটুকু একটা নরম বুক ধড়ফড় করছে। চোখ দুটো আধ বোজা। বড়মামা ছোটাছুটি করছেন। একবার বলছেন, স্যালাইন চালাবেন। একবার বলছেন ব্লাড দেবেন।
মেজোমামা বললেন, ‘ব্লাড যে দেবে, ওর ব্লাড গ্রুপ জান?’
বড়মামা বললেন, ‘পায়রা গ্রুপ।’
—তাহলে আর একটা পায়রা ধরে এনে রক্তদান নয় রক্তপাত করো।
কিছুই করতে হল না, পায়রাটা আস্তে আস্তে মাসিমার কোলে নেতিয়ে পড়ল। বাড়িতে শোকের ছায়া। গোটা কতক পায়রার পালক বাতাসে উড়ছে।
বড়মামা বললেন, ‘সঙ্গ দোষ।’
মেজোমামা বললেন ‘তার অর্থ?’
—চাঁদিয়াল ঘোড়েলের সঙ্গে মিশে স্বভাব হারিয়েছে। মাস্তান হয়ে গেছে। ওর কালো হাত আমি ভেঙে দেব, গুঁড়িয়ে দেব।
ব্যাপারটা আর বেশি দূর গড়াল না। বড়মামার রুগিরা সব এসে গেছেন, চেম্বার ভর্তি।
দুপুরে আমরা সবাই খেতে বসেছি। বেড়ালের মেমারি খুব কম। বড়মামার সামনে চাঁদিয়াল রোজ যেমন এসে বসে, সেইরকম বসেছে, চোখ বুজিয়ে থুপ্পি মেরে।
বড়মামা বললেন, ‘মনি এটাকে সামনে থেকে হাঁটা, এটার আমি মুখদর্শন করতে চাই না।’
আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালটা পিছন ফিরে বসল।
মেজোমামা বললেন, ‘কি সেনস দেখেছ! মানুষের মতো।’
মাসিমা ঘোষণা করলেন, ‘আজ সব নিরামিষ, ঘোড়েল মাছ খেয়ে হাওয়া হয়েছে। আমরা যখন পায়রা নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় সাবাড় করেছে।’
বড়মামা মেজোমামাকে বললেন, ‘শুনলি, শুনলি, যত চোর ছ্যাঁচড় নিয়ে কারবার।’
—বেড়াল মাছ খাবেই, এটা তাদের ধর্ম। সুযোগ পেলেই খাবে।
বড়মামা হঠাৎ যেন একটা ক্লু পেলেন, ডিটেকটিভরা যেমন পায়, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, চাঁদিয়াল কেন পায়রা ধরেছে।’
—কেন ধরেছে!
—যাতে তোর বেড়াল মাছ চুরি করতে পারে। কায়দা করে আমাদের সব ব্যস্ত করে রাখলে, রান্নাঘর আরক্ষিত, তখন তোর নিকৃষ্ট বেড়ালটা সব সাবড়ে দিলে।
মেজোমামা বললেন, ‘বড়দা, একেই বলে ফ্রেন্ডশিপ। বেড়ালে বেড়ালে সহমর্মিতা, যেটা মানুষের মধ্যে নেই। বুঝলে ভায়া!’
মাসিমার পরবর্তী ঘোষণা, ‘দুধও সাবাড়, বিকেলে র চা।’