বটুকদাদার গল্প
বটুকদাদা সম্পর্কে আমার ঠাকুরদা হতেন, তিনি ছিলেন আমার নিজের ঠাকুরদার আপন পিসতুতো ভাই। তবু কেন জানি না, আমরা বাড়িসুদ্ধু ছোটোরা সবাই তাঁকে বটুকদাদা বলেই ডাকতাম। তাঁর সঙ্গে আমাদের খুব ভাব ছিল।
বটুকদাদার নিজের বাড়ি কোথায় ছিল তা আমরা জানি না, তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। থেকে যেতেন কয়েকদিন। বেশ মজার মানুষ ছিলেন তিনি, বাড়িতে ঢুকতেন গান গাইতে গাইতে। একটা গান আমার এখনও মনে আছে: রয়েছে দুয়ার খোলা, এসেছে পাগলা ভোলা, আজ কোনো কাজ হবে না, হবে শুধু নাচনা গানা…।
সেই গান গাইতে গাইতে তিনি উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে ভিখিরির মতন হাত জোড় করে বলতেন, ‘ওগো দাদা-দিদি, মাসি-পিসিরা, পাগলা ভোলা এসেছে, হাঁড়িতে চাল বেশি নিও, আমি কিন্তু পেটভরে খাব, অনেকদিন কিছু খাইনি গো!’
প্রত্যেকবার এই কথা শুনে আমার ঠাকুরদা রাগ করতেন। তিনি বলতেন, ‘ছি বটুক, কী পাগলামি করিস! ছোটো ছেলে-মেয়েরা কী ভাববে? তুই কি ভিখিরি নাকি? এবাড়িতে এসে তুই থাকবি, খাবি, সেটা আবার এমন কথা কী!’
ঠাকুমা ও কাকিমা-জেঠিমারা খুব হাসতেন বটুকদাদাকে দেখে। আমরাও বটুকদাদাকে দেখে খুব মজা পেতাম। বটুকদাদা এলেই পড়াশুনো ফেলে ছুটে যেতাম, তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসতাম। প্রত্যেকবার এসেই তিনি বলতেন, ‘উঃ, রাস্তায় কী বিপদ, খুব জোর প্রাণে বেঁচে এসেছি। এবারে কী হয়েছিল জানিস?’
বটুকদাদা বাইরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরলেও, বাড়িতে এসেই সেসব ছেড়ে একখানা পায়জামার ওপর রঙিন আলখাল্লা চাপাতেন। সেটাতে লাল-নীল-হলুদ অনেক রকম রং। তাঁকে দেখাত বহুরূপীর মতন। একবার সেই আলখাল্লাটা পরলে তিনি আর কিছুতেই খুলতেন না। এমনকী, খুব গরমের সময় ছেলেরা সবাই খালি গায়ে থাকে, সেই সময়ও বটুকদাদার গায়ে আলখাল্লা, সেটা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেলেও খোলার নাম নেই। বটুকদাদাকে খালি গায়ে কেউ দেখেনি।
তাঁকে দেখাত বহুরূপীর মতন…
বটুকদাদার কাঁধে থাকত একটা ঝোলা। সেই ঝোলায় ভরতি অনেক খুচরো পয়সা। বেশিরভাগই সিকি আর আধুলি, তাঁর হাঁটার সময় ঝনঝন শব্দ হত। বটুকদাদা দুষ্টুমি করে বলতেন, ‘ওই-সব খুচরো পয়সা তিনি ভিক্ষে করে পেয়েছেন।’ পরে জেনেছি, আসলে তা মোটেই নয়। বটুকদাদাদের খেয়া-নৌকোর ব্যাবসা ছিল। অনেক জায়গায় নদীর ঘাটে তাঁদের খেয়ার নৌকো চলত, বটুকদাদা ঘুরে ঘুরে সেই সব খেয়াঘাট থেকে টাকা আদায় করে আনতেন। কোথাও খেয়ার মাঝির অসুখ-টসুখ হলে তিনি নিজেই নৌকো চালাতেন। খেয়া পার হবার সময় লোকে তো খুচরো পয়সাই দেয়, তাই তাঁর ঝুলিতে অত খুচরো।
তিনি আমাদের নানারকম ধাঁধা জিজ্ঞেস করতেন, উত্তর দিতে পারলেই তিনি দিতেন একটা সিকি। বাবা-মায়েরা ছোটো ছেলে-মেয়েদের হাতে পয়সা দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানাতেন খুব, কিন্তু বটুকদাদা শুনতেন না। আমরা অবশ্য সেই পয়সা পেয়ে দারুণ খুশি হতাম। আমার সেজদা ‘ধাঁধার বই’ নামে হাট থেকে একখানা বই কিনে এনে লুকিয়ে একা-একা সব ধাঁধার উত্তর মুখস্থ করত বেশি পয়সা পাবার জন্য। কিন্তু বটুকদাদার ধাঁধা কোনো বইতে পাওয়া যাবে না। তাঁর ধাঁধাগুলো আসলে খুব সহজ, কিন্তু চট করে উত্তরটা মনে আসে না। যেমন একটা ধাঁধা ছিল এইরকম: ‘গোরুতে ঘাস খায়, আর গোরুর গলার দড়িটা কী খায়?’
আমাদের মধ্যে ছোড়দির বুদ্ধিই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমরা কেউ উত্তর দিতে পারিনি, ছোড়দি টপ করে বলে দিয়েছিল, ‘দড়ি পাক খায়!’
বটুকদাদার আর একটা খেলা ছিল, বাংলা-বাংলা খেলা। সারাদিন যদি কেউ বটুকদাদার সামনে একটাও ইংরেজি কথা না-বলে থাকতে পারে, তাহলে সে চারখানা সিকি পাবে। এ-খেলাটা ছিল খুবই শক্ত। টেবিল, চেয়ার, শার্ট, প্যান্ট এসবও বলা চলবে না। অনেক কথার তো আমরা বাংলা জানিই না। বটুকদাদা অনেক কথার বাংলা জানতেন। যেমন বুকশেলফ-এর বাংলা বইদানি; যাতে ফুল রাখে সেটা যদি ফুলদানি হতে পারে তবে বই রাখার জায়গা বইদানি হবে না কেন? আর প্যান্টের বাংলা দু-চোঙা। চেয়ারের বাংলা কেদারা আর টেবিলের বাংলা মেঝ।
আমার ছোড়দি মুন্নি ছাড়া অবশ্য আর কেউই বাংলা-বাংলা খেলায় জিততে পারত না। ছোড়দির কথাবার্তাগুলো ছিল চটাং চটাং ধরনের। ছোড়দি আবার খেতে খুব ভালোবাসত। পাকা তেঁতুলে নুন মাখিয়ে ছোড়দি নিজেই আচার বানিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখত, সেই আচার সে অন্য কাউকে দিতে চাইত না। এমনকী, বটুকদাদাকেও দিত না। বটুকদাদা চাইলে বলত, ‘ছি, বুড়োমানুষদের আচার খেতে নেই, দাঁত টকে যায়!’
বটুকদাদা দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, ‘মুন্নি, তুই আমাকে বুড়ো বললি? আর তো কেউ বলে না। এখনও তো আমার মাথায় টাক পড়েনি!’
ছোড়দি বলেছিল, ‘ওমা, বুড়োমানুষকে বুড়ো বলেছি, তাতে দোষের কী হয়েছে? টাক না-পড়ুক, দাড়ি তো পেকেছে!’
বটুকদাদার ঝোলার মধ্যে বাঁশিও থাকত একটা। সন্ধ্যে বেলা তিনি বাঁশি বাজিয়ে শোনাতেন। কিন্তু ছোড়দি এসে সামনে বসলেই বটুকদাদার বাঁশি বাজানো থেমে যেত। ছোড়দির হাতে তেঁতুলের আচার, জিভ দিয়ে চাটে একটু একটু করে, তাই দেখলেই বটুকদাদার জিভে জল এসে যায়। আর জিভে জল এসে গেলে কী বাঁশি বাজানো যায়?
বটুকদাদা বললেন, ‘ওলে, মুল্লি, তুই একটু পেছন দিকে গিয়ে বোস না!’
ছোড়দি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
বটুকদাদা আমাদের গুরুজন হলেও তাঁর সঙ্গে আমরা সবাই সমানে হাসিঠাট্টা করতে পারতাম। বটুকদাদা এলে আমরা কয়েকটা দিন পড়াশুনোর পাঠ চুকিয়ে দিয়ে হইহই করে কাটাতাম।
একদিন ছোটোকাকা বলল, ‘তোরা কেউ বটুকদাদাকে কোনোদিন খালি গায়ে দেখেছিস?’
আমরা সবাই মাথা নাড়লুম। সত্যিই তো বটুকদাদাকে তো কক্ষনো খালি গায়ে দেখা যায়নি!
ছোটোকাকা বললেন, ‘যা:, তাহলে তো তোরা কেউ বটুকদাদার আসল গল্পই শুনিসনি! ওঃ, সে যা গল্প, শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়!’
আমরা বটুকদাদার কাছ থেকে অনেক গল্পই শুনেছি। এর মধ্যে কোনটা যে আসল গল্প আর কোনটা যে নকল গল্প, তা আমরা বুঝিনি। সবই ভালো লেগেছে। তবু আমরা ছুটে গিয়ে বটুকদাদাকে ঘিরে ধরলুম।
বটুকদাদা তখন একটা পেয়ারাগাছের ডাল কেটে আমার ছোটো ভাইয়ের জন্য গুলতি বানিয়ে দিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে, কী হয়েছে, তোরা এত চ্যাঁচামেচি করছিস কেন?’
আমরা বললুম, ‘বটুকদাদা, তুমি এতদিন আমাদের আসল গল্পটা বলনি কেন? তোমার খালি গায়ের গল্প!’
বটুকদাদা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘সে গল্প তোদের এখন শোনার দরকার নেই। বড়ো হলে শুনবি!’
কিন্তু আমাদের ধারণা আমরা তখনই বড়ো হয়ে গেছি, আমরা ওই কথা মানব কেন? ছোড়দি বলল, ‘দাঁড়া না, আমি ব্যবস্থা করছি!’
বটুকদাদা দিনের বেলা চান করতেন না। তাঁকে যে ঘরটায় থাকতে দেওয়া হত, সেটা পুকুরের ধারে। রাত্তির বেলা আটটা-ন-টার সময় উনি আলখাল্লাটা খুলে রেখে অন্ধকারের মধ্যে পুকুরে কয়েকটা ডুব দিয়ে আসতেন।
সেই রাত্তিরে ছোড়দি বটুকদাদার ঘর থেকে তাঁর জামাকাপড়ের পুঁটুলি সরিয়ে ফেলল। বটুকদাদা পুকুরে নামবার পর লুকিয়ে ফেলল আলখাল্লাটাও।
জল থেকে উঠে এসে বটুকদাদা বললেন, ‘আরে, আমার জামাটা কোথায় গেল? কে নিল রে অ্যাঁ!’
একটু দূর থেকে হেসে উঠল ছোড়দি।
বটুকদাদা কোমরে গামছা জড়িয়ে ছুটে গেলেন নিজের ঘরে। সেখানেও জামাকাপড় না-পেয়ে অসহায়ভাবে বললেন, ‘আরে, সবই নিয়ে নিয়েছে। বিচ্ছু ছেলে-মেয়েদের কান্ড। ওরে ও মুন্নি, শিগগির দে, আমার শীত করছে!’
তখন আমরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লুম ঘরের মধ্যে। তারপরই চমকে গেলুম!
ইলেকট্রিকের আলো তো ছিল না, একটা লণ্ঠন জ্বলছিল সেই ঘরে। তাতে দেখা গেল, বটুকদাদার বুক-পিঠে অসংখ্য খোবলানো-খোবলানো দাগ। মশলা-বাটা শিল কিংবা খেজুরগাছ যেমন অক্ষত হয় না, বটুকদাদার গায়েও সেইরকম অনেক পুরোনো ক্ষত। বটুকদাদা সবসময় গায়ে জামা দিয়ে এই ক্ষতগুলো লুকিয়ে রাখেন।
আমাদের অবাক দৃষ্টি দেখে বটুকদাদা বললেন, ‘আগে মাথা মুছে জামাকাপড় পরে নিই, তোরা ঠাণ্ডা হয়ে বোস, তারপর গল্প বলছি! মুন্নি, আমার জন্য একটু চা করে নিয়ে আসতে পারবি?’
খানিকবাদে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বটুকদাদা বললেন, ‘আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন ভালো ফুটবল খেলতে পারতাম, বুঝলি! পড়াশুনোর চেয়ে খেলাধুলোর দিকেই বেশি মন ছিল। আমি যে-বছর ফার্স্ট ক্লাসে পড়ি, ফার্স্ট ক্লাস কাকে বলে জানিস তো, আমাদের আমলে ক্লাস টেনকে বলা হত ফার্স্ট ক্লাস, সেই সময়ে আমার এত নাম হয়েছিল যে, বিভিন্ন গ্রামের ফুটবল টিম আমাকে ভাড়া করে নিয়ে যেত! আমি খেলতাম সেন্টার ফরোয়ার্ডে। এক-একখানা গোল দিতে পারলে দু-টাকা করে পেতাম। কোনো কোনো খেলায় দশখানা পর্যন্ত গোল দিয়েছি বুঝলি?’
ছোড়দি বলল, ‘নিশ্চয়ই পচা-পচা টিমের সঙ্গে খেলতে?’
বটুকদাদা বললেন, ‘‘গ্রামের টিম আর কত ভালো হবে। খেলোয়াড়রাও সেইরকম। কিন্তু আমার মতন এত বেশি গোল দিতে আর কেউ পারত না। একবার এক ডজন গোল দিয়ে রেকর্ড করার ইচ্ছে ছিল, তা আর হল না অবশ্য।’
আমি ভাবলুম, ফুটবল খেলতে গেলে মাথা ফাটতে পারে কিংবা পা ভাঙতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে বটুকদাদার গায়ের ওই সারস খোবলানোর কী সম্পর্ক?
বটুকদাদা বললেন, ‘তখন তো আমাদের নিজেদের গ্রামে ইস্কুল ছিল না। তাই অন্য একটা গ্রামের স্কুলে পড়তাম, থাকতাম সেখানকারই বোর্ডিং-এ। এখন যাকে হস্টেল বলে, তখন তাকেই বলত বোর্ডিং। এই বোর্ডিং-এ আর একটা ছেলে থাকত, তার নাম প্রাণগোপাল, ডাকনাম ভুতো। সেই ভুতোও ভালো ফুটবল খেলত, সে ছিল গোলকিপার। ভুতো আমার চেয়ে বয়েসে কয়েক বছর বড়ো ছিল, গায়ের রং টকটকে ফরসা, সুন্দর চেহারা। অনেক সময় আমরা একই টিমে ভাড়া খাটতে যেতাম। আমি সেন্টার ফরোয়ার্ড, ভুতো গোলকিপার। আমাদের টিমই বেশিরভাগ খেলায় জিতে যেত! একবার গোবিন্দপুরে একটা খেলায় জিতে আমি আর ভুতো একহাঁড়ি রসগোল্লা খেয়েছিলাম!’
ছোড়দি বলল, ‘আমরা খেলার গল্প শুনতে চাই না!’
চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বটুকদাদা বললেন, ‘এটা খেলারই গল্প-রে, অন্য গল্প নয়। একবার হল কী জানিস, আমি আর ভুতো দুটো আলাদা টিমে খেলতে গেলুম। ওই গোবিন্দপুরেই খেলা হবে, কিন্তু ভুতো খেলবে ঘোড়াডাঙার টিমে। ওই টিমের ক্যাপটেন ওর মামাতো ভাই, ওকে ওখানে খেলতেই হবে, এদিকে আমি গোবিন্দপুরের টিমকে কথা দিয়ে ফেলেছি! উপায় নেই। দু-জনে দু-টিমের হয়ে খেলতে গেলুম। মাঠে নেমে ভুতো আমার কানে কানে বলল, ‘বটুক, তুই বেশি গোল দিস না। খেলাটা ড্র করার চেষ্টা করিস।’ শুনেই রাগে আমার গা জ্বলে গেল। ওই সব গট-আপ খেলায় আমি বিশ্বাস করি না। যার যতটা সাধ্য খেলবে, তারপর হার-জিত তো আছেই। হাফ-টাইমের মধ্যেই আমরা অনেকটা এগিয়ে গেলুম। ঘোড়াডাঙা গোল দিয়েছে মোট পাঁচটা, আর আমাদের টিমের পক্ষ থেকে আমি একাই আটখানা গোল দিয়েছি। ইচ্ছে আছে আরও অন্তত চারখানা দেবার। ভুতো আবার আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে বলল, ‘বটুক, তুই এবার চেপে খেল, খেলাটা ড্র করাতেই হবে। তুই আর গোল দিলে আমার মামাতো ভাই বলেছে তোর ঠ্যাং ভেঙে দেবে!’
‘আবার খেলা শুরু হবার একটু পরেই আমি একটা বল পেয়ে ছুটে গেলুম অন্য সাইডের গোলের দিকে, আমার পা থেকে বল ছাড়াবার সাধ্য কারো ছিল না। গোলপোস্টের একেবারে কাছে পৌঁছে গেছি, এমন সময় কারা যেন চেঁচিয়ে উঠল অফ সাইড, অফ সাইড! কিন্তু সে চিৎকারে আমি কান দিলুম না। রেফারির বাঁশি আমার কানে আসেনি, আমি মারলুম প্রাণপণে শট! ভুতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা ধরতে গেল, কিন্তু পারল না, বলটা ঢুকে গেল গোলের মধ্যে। ভুতো কিন্তু মাটিতেই পড়ে রইল, আর উঠল না!’
আমি বললুম, ‘মরে গেল?’
সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজন আমার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, ‘ধ্যাত বোকা! ফুটবল লাগলে কেউ মরে নাকি? নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল!’
বটুকদাদা বললেন, ‘অজ্ঞানও হয়নি, ভুতোর পেটে খুব লেগেছিল, সে আর খেলতে পারল না। তাকে নিয়ে যাওয়া হল মাঠের বাইরে। সেই খেলা আর শেষই হল না। দর্শকরা হইহই করে নেমে পড়ল মাঠের মধ্যে, আমরা সব দৌড়ে পালালুম। খেলা ভণ্ডুল!’
‘বোর্ডিংয়ে কোনোক্রমে ফিরে আমি ভুতোর খবর নিতে গেলুম, কিন্তু ভুতো আমার সঙ্গে কথা বলল না। তার অভিমান হয়েছে। সে ভেবেছে, আমি ইচ্ছে করে তার পেটে বল মেরেছি। আমি কতভাবে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, সে কিছুতেই বুঝবে না। ক-দিন ভুতো জ্বরে ভুগল। তারপর একটু সুস্থ হতে-না-হতেই তার গায়ে স্মল পক্স বেরোলো। স্মল পক্স!
‘তখনকার দিনে স্মল পক্স-এর নামে মানুষ ভয়ে কাঁপত। বোর্ডিংয়ে বা হস্টেলে একজন ছাত্রের স্মল পক্স হলেই অন্য ছাত্ররা পালাত বাড়িতে। এবারেও তাই হল, অন্য ছাত্ররা পালিয়ে গেল, আমরা দু-তিনজন রয়ে গেলুম ভুতোর সেবা করার জন্য।
‘পাঁচ দিন বাদে ভুতো মারা গেল। গ্রামে তো ডাক্তার ছিলেন না, ছিলেন এক কবিরাজ, তিনি অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু বাঁচানো গেল না কিছুতেই। শহর থেকে বড়ো কবিরাজ কিংবা অন্য ডাক্তার ডাকারও উপায় ছিল না, কয়েকদিন ধরে একটানা বৃষ্টিতে পথঘাট সব ডুবে গিয়েছিল।
‘ভুতোর বাবা-মা থাকতেন বিহারে, তাই খবর দেওয়া হল ঘোড়াডাঙায় তার মামার বাড়িতে। ভুতোর মামা খুব বুড়ো, তিনি আসতে পারলেন না। এল শুধু তার মামাতো দু-ভাই। তাদের মধ্যে একজনের আবার জ্বর, সে স্মল পক্সের মড়া ছুঁতে চায় না। বোর্ডিংয়ে তখন আমরা মাত্র তিনজন ছাত্র, তাদের মধ্যেও একজনের গায়ে দু-চারটে স্মল পক্সের গুটি বেরিয়েছে। সেও যেতে পারবে না। ওরকম ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আর কোনো লোকও জোগাড় করা যাবে না। আমরা তিনজনে মিলেই ভুতোকে নিয়ে চললুম শ্মশানের দিকে।’
হঠাৎ থেমে গিয়ে বটুকদাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর শুনবি?’
আমরা সবাই বললুম, ‘হ্যাঁ, শুনব। শুনব।’
আমার জ্যাঠতুতো দাদা নিমাই বসেছিল দরজার ধারে, সে সরে এসে বসল ভেতরে। ছোড়দির আচার খাওয়া থেমে গেছে!
বটুকদাদা বললেন, ‘স্মল পক্সের মড়া চব্বিশ ঘণ্টার বেশি ফেলে রাখতে নেই। আমাদের বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ঝড়বৃষ্টি চলছে অবিরাম। সেই দুর্যোগের মধ্যে কুকুর-বিড়ালও বেরোয় না, আমাদের তো যেতেই হবে। আমাদের বোর্ডিং থেকে শ্মশান প্রায় তিন মাইল দূরে, নদীর ধারে। জল-কাদার মধ্যে আমরা হাঁটছি খুব আস্তে আস্তে। বিদ্যুৎচমকে আর বাজের গর্জনে চমকে চমকে উঠছি। যাই হোক, অতিকষ্টে তো শ্মশানে পৌঁছোলুম, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি খাঁ-খাঁ। জনমনুষ্য নেই। মড়ার খাট নামিয়ে আমরা হাঁকাহাঁকি করতে লাগলুম, তবু ডোমের কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না। তখন কী উপায়?’
বটুকদাদা তাকালেন আমাদের দিকে। ভুরু নাচিয়ে আবার বললেন, ‘কী উপায়? কিন্তু আমরা কী কেউ মড়া পোড়াবার বিষয় কিছু জানি যে উত্তর দেব?’
ছোড়দি বলল, ‘একজন কেউ ডোমকে খুঁজে আনলেই পারতে!’
বটুকদাদা বললেন, ‘সেটাই তো হচ্ছে কথা। কে যাবে? নিয়ম হচ্ছে এই যে, মড়া কখনো একলা ফেলে যেতে নেই। একজনকে ছুঁয়ে থাকতে হয়। আমাদের সঙ্গে আর একজন যে গিয়েছিল, তার নাম বিষ্টু, আর ভুতোর মামাতো ভাইয়ের নামটা আমি ভুলে গেছি। সেই জায়গাটা বিষ্টুর চেনা। আমি বিষ্টুকে বললুম, ‘তুই যা।’ বিষ্টু সেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে কয়েক পা গিয়ে বলল, ‘এই শ্মশানের মধ্যে আমি একলা যেতে পারব না, আমার ভয় করছে!’
‘তখন আমি ভুতোর মামাতো ভাইকে বললুম, ‘তাহলে তুমি এখানে থাকো, আমি বিষ্টুর সঙ্গে যাই? সে বলল, ‘ওরে বাবা, আমি একা মড়ার পাশে বসে থাকব? সে পারব না!’ ভেবে দেখ তোরা, ওর নিজের মাসতুতো ভাই, তাকে সে ভয় পাচ্ছে! শেষপর্যন্ত বিষ্টু আর সে গেল ডোমকে ডাকতে, আমি একা বসে রইলুম ভুতোকে ছুঁয়ে।
‘ওদের পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই ভুতো উঠে বসল!’
ছোড়দি সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠল, ‘ভুতো মরেনি, ভুতো মরেনি, আমি আগে বুঝেছিলুম। ও মটকা মেরে পড়েছিল।’
বটুকদাদা ছোড়দির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘ভুতো উঠে বসল, সেই অন্ধকারেও তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল, সে অদ্ভুত ভাঙা গলায় বলল, ‘‘বটুক, এইবার তোকে পেয়েছি। তুই আমার পেটে বল মেরেছিস, তুই ইচ্ছে করে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি!’’ ’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললুম, ‘ভুতো, তোকে মারার কথা আমি একবারও চিন্তা করিনি। খেলতে নামলে আমার গোল দেওয়ার কথা ছাড়া আর অন্য কিছু মনে থাকে না।’
‘ভুতো হাত বাড়িয়ে আমার বুকটা খিমচে ধরে একটা টান মারতেই আমার জামাটা ছিঁড়ে গেল। ভুতো মুখটা আরও কাছে এনে আমার বুকটা কামড়ে ধরতে গেল। তখন আমি দু-হাতে ভুতোর গলা চেপে ধরলুম। কিন্তু ভুতোর গায়ে তখন অসুরের মতন জোর। সে তার দু-হাতের আঙুলের নখ দিয়ে আমার বুক পিঠ থেকে মাংস খুবলে খুবলে তুলতে লাগল।’
নিমাইদা বলল, ‘ভুতো ভূত হয়ে গেছে!’
বটুকদাদা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ভূত নয়, নর-দানব। আমি তার গলা টিপে ধরেছি, তবু সে আমার গা থেকে মাংস তুলে তুলে দিতে লাগল মুখে। গলা টিপে ধরলে কেউ কথা বলতে পারি? কিন্তু ভুতো সেই অবস্থাতেও হিহি হিহি করে হেসে উঠে বলল, ‘‘তুই আমার সঙ্গে পারবি না, বটুক, আজ তোকে আমি শেষ করে দেব! আমি চলে যাব, আর তুই মনের আনন্দে ফুটবল খেলে যাবি ভেবেছিস? আজই তোর শেষ দিন!’’ ’
নিমাইদা বলল, ‘দরজা বন্ধ করে দে! দরজাটা বন্ধ করে দে!’
বটুকদাদা বললেন, ‘সেই অবস্থায় আমি ভুতোর সঙ্গে লড়াই করে গেছি। তার গলাটা ছেড়ে দিলে সে আমাকে কামড়েই খেয়ে নিত। আমি কিছুতেই ছাড়িনি। এক এক সময় মনে হচ্ছিল, আর পারব না, আমার সব শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে! যন্ত্রণার চোটে আমি চিৎকার করছিলুম, ‘‘ওরে বাবা রে, মা রে! বিষ্টু কোথায় গেলি? কে কোথায় আছ…’’ ’
‘এক সময় দূর থেকে বিষ্টুর গলা শোনা গেল, ‘‘বটুক, আমরা এসে গেছি! কী হয়েছে?’’ ’
‘ওদের গলা শোনা যাওয়া মাত্র ভুতো আমাকে ছেড়ে দিয়ে এলিয়ে গেল। আমি তার গলা থেকে হাত সরাতেই সে ধপাস করে পড়ে গেল। আবার আগের মতন।’
‘বিষ্টুরা এসে পড়ার পর যাতে আমার অবস্থা দেখতে না-পায় তাই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লুম নদীতে!’
একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বটুকদাদা বললেন, ‘তারপর থেকে আমি ফুটবল খেলা একেবারে ছেড়ে দিয়েছি!’
সেদিন রাত্তিরে আমাদের কী ভয়! খাওয়ার পর আমরা কেউ আর বাথরুমে যেতেও সাহস পাই না। জানলায় একটু বাতাসের শব্দ শুনলেই চমকে চমকে উঠি।
ছোটোকাকা বললেন, ‘তোরা বটুকদাদার ওই গাঁজাখুরি গল্প শুনে ভয় পেয়েছিস বুঝি? ওই গল্প আমাদের কাছে আগে কতবার বলেছে। বটুকদাদার গায়ে ওই যে দাগগুলো, ওগুলো আসলে স্মল পক্সের দাগ। ছোটোবেলায় ওর একবার খুব সাংঘাতিক স্মল পক্স হয়েছিল, প্রায় মরতে বসেছিলেন, সেই দাগ রয়ে গেছে সারাগায়ে।’
আমি অবিশ্বাসের সুরে বললুম, ‘তাহলে মুখে দাগ নেই কেন? স্মল পক্স হলে মুখে দাগ থাকবে না?’
ছোটোকাকা বললেন, ‘মুখেও দাগ আছে। সেই দাগ ঢাকার জন্যই তো অত বড়ো দাড়ি রেখেছে!’
ছোড়দি বলল, ‘ঠিক, ঠিক। বটুকদাদার নাকের পাশেও দুটো-তিনটে দাগ আছে। এখন মনে পড়ছে!’
এই কথা বলে ছোড়দি বিছানা ছেড়ে উঠে গেল আচার খাবার জন্য।