প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

বঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা প্রসঙ্গে – ড. গোপীকান্ত কোঙার

বঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা প্রসঙ্গে – ড. গোপীকান্ত কোঙার

ইতিহাস কোনো স্থানু বিষয় নয়। আবার ইতিহাসের সঠিক কোনো সংজ্ঞা দেওয়াও প্রায় অসম্ভব। অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান সময়কে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলাই হল ইতিহাস। এর মধ্যে রয়েছে ধারাবাহিকতা, প্রবাহমানতা। তাই দেশ, কাল ও মানুষের কাহিনি নিয়েই ইতিহাস, আর সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি রাজনীতি প্রভৃতির পরিবর্তনে কিছু বিষয় স্থিতিশীল হয় যা টিকে থাকলেও অনেক কিছু হারিয়ে যায়। তাই ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্য হল অতীত এবং বর্তমানের যে সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে তা খুঁজে বের করা। ইতিহাসের মধ্যেই জাতীয় জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালাভ করা সম্ভব।

সামগ্রিক অথবা জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় ইতিহাসচর্চা এবং আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার লক্ষ্য অভিন্ন হলেও এক নয়। পাশ্চাত্য দেশে ইতিহাসচর্চা প্রায় পাঁচ-শো বছর পূর্বে শুরু হলেও বৃটিশ শাসন শুরুর পরে ভারতে যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার উদ্ভব হয় তা থেকে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হন দেশের ইতিহাস লেখার জন্য। এক্ষেত্রে ইতিহাসচর্চায় প্রবৃত্ত হয়ে অনেকেই শিবাজী বা মারাঠাদের ইতিহাস, রাজাপ্রতাপাদিত্য, শোভাসিংহ, নবাব সিরাজদৌল্লা, মহারাজ নন্দকুমার, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রমুখ রাজা-জমিদার বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু ইতিহাসের অর্থ কেবলমাত্র রাজ-রাজাদের কাহিনি নয়। সামগ্রিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশ্ব ইতিহাস, মহাদেশীয় ইতিহাস অথবা কোনো রাষ্ট্রের ইতিহাস হতে পারে যাকে Macro studies হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু কোনো রাজ্য, প্রদেশ, জেলা, মহকুমা, ব্লক, অঞ্চল বা গ্রাম সম্পর্কে আলোচনা যদি হয় তাকে আধুনিক গবেষণায় Macro studies বলা হচ্ছে। এ ধরনের চর্চায় কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয় এবং এখানে জনজীবনের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব। আঞ্চলিক ইতিহাস যেমন কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে নিয়ে রচিত হয় তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোনো জনপদকে নিয়ে এমনকী একটি গ্রামকে নিয়ে ইতিহাস রচিত হতে পারে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন ‘বাঙালীর ঐতিহাসিক স্মৃতি কই? বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙালি কখনও মানুষ হইবে না।’ কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবিভক্ত বাংলায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা মোটামুটিভাবে শুরু হয়েছে বলা যায়। এমনকী তারও আগে অষ্টাদশ শতকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গারাম রাঢ় অঞ্চলে বর্গী হাঙ্গামা নিয়ে মহারাষ্ট্রপুরাণ রচনা করেন। ১৭৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে বিজয়রাম সেন বিশারদ তীর্থমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয় Memoirs of a Map of Hindusthan প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয় হেনরি ক্রে’টন-এর Ruins of Gour. শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে রামরাম বসুর রাজা প্রতাপাদিত্যচরিত এবং ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে পাদরি উইলিয়াম ওয়ার্ডের ৪ খন্ডে রচিত History Literature and Mythology of the Hindoos; ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্লস স্টুয়ার্ট-এর History of Bengal, ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডন থেকে তিন খন্ডে আঞ্চলিক বিবরণ-সহ প্রকাশিত হয় Statistical Description of Hindoosthan; ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে কালীকমল সার্বভৌম কর্তৃক রচিত গোহিরাম রাজদ্বারা বৃত্তান্ত, ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে শ্যামধন মুখোপাধ্যায় রচিত মুরশিদাবাদের ইতিহাস; ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে অম্বিকাচরণ ঘোষ রচিত বিক্রমপুরের ইতিহাস, ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে হরচন্দ্র চৌধুরি রচিত সেরপুর পরগণার ইতিহাস প্রভৃতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তা ছাড়া ঊBনবিংশ শতাব্দীতে সরকারিভাবে প্রদেশ এবং জেলার বিবরণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যেগুলি আঞ্চলিক ইতিহাসের আকরগ্রন্থ বলা যেতে পারে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয় W. W. Hunter-এর Annals of Rural Bengal, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ভোলানাথ চন্দের The Travels of a Hindoo; ছোটোনাগপুর ও উত্তরবঙ্গের আদিবাসী জনজীবনের উপাদানসমৃদ্ধ গ্রন্থ Descriptive Ethnology of Bengal ই. টি. ডাল্টন কর্তৃক ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ওই বছরেই চন্দ্রনাথ ব্যানার্জি কর্তৃক রচিত হয় An Account of Howrah—Past and Present; ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে J. Westland কর্তৃক Report on the District of Jessore এবং ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে বেভারিজ কর্তৃক District of Bakerganj; রচিত হয়; ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে হান্টারের উদ্যোগে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ২০ খন্ডে Statistical Account of Bengal; ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে জর্জ টয়নবি রচনা করেন A sketch of the Administration of the Hooghly District; ওই বছরেই উইলিয়াম কেরি রচনা করেন A Missionary Tour in the Hugli and Howrah District; ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ডব্লিউ. বি. ওল্ডহাম রচনা করেন Some Historical and Ethnical Aspect of the Burdwan District; ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় H. H. Risley রচিত The Tribes and Castes of Bengal; ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত জাল প্রতাপচাঁদ; ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে নবীনচন্দ্র ভদ্রের ভাওয়ালের ইতিহাস প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীতেও অনেকক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনে ইতিহাস, ভূগোল, নদ-নদী, বংশাবলী, শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, প্রশাসন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে ওম্যালি, মনোমোহন চক্রবর্তী, পিটারসন, গ্যারেট, ল্যামবোর্ন, ষ্ট্রং, গ্রূলিং, কুপল্যাণ্ড প্রমুখের নাম করা যেতে পারে, যাঁরা জেলার গেজেটিয়ার রচনা করে বিবরণমূলক বহু তথ্য রেখে গেছেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিতের তমোলুকের ইতিহাস, জগৎচন্দ্র ভট্টাচার্য চন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ, বিহারী চক্রবর্তীর খাটুয়ার ইতিহাস ও কুশদ্বীপ কাহিনী রচিত হয়; ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মোহিনীমোহন দাসগুপ্ত রচনা করেন শ্রীহট্টের ইতিহাস; ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কেদারনাথ মজুমদার কর্তৃক প্রকাশিত হয় ময়মনসিংহের বিবরণ এবং ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ঢাকার বিবরণ; ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রজনাথ চন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত হয় মেদনীপুর প্রদেশ নিবাসী শোলাঙ্কি বা শুল্কি জাতির আদি বৃত্তান্ত; দুর্গাচন্দ্র সান্যাল কর্তৃক ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বাংলার সামাজিক ইতিহাস ১ম খন্ড এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ২য় খন্ড; আনন্দনাথ রায় কর্তৃক ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরের ইতিহাস এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কর্তৃক বিক্রমপুরের ইতিহাস; ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কুমুদনাথ মল্লিক কর্তৃক নদীয়া কাহিনী প্রকাশিত হয়; ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আবিদ আলি খান কর্তৃক Short notes on the Ancient Monuments of Gaur and Pandua রচিত হয়; ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে E. C. Dozey কর্তৃক A Concise and Complete History of Darjeeling District প্রকাশিত হয়; ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভদ্রপুরের ইতিবৃত্ত; রাজনারায়ণ চৌধুরির মালদহ জেলার ভৌগোলিক বিবরণ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস; মহিমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক তারা (তারাপীঠের বিবরণ); উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ কর্তৃক কাছাড়ের ইতিবৃত্ত প্রভৃতি প্রকাশিত হয়; ১৯১৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক তিন খন্ডে বীরভূম বিবরণ; ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে সুরেশ্বর ব্যানার্জি কর্তৃক চট্টগ্রাম দর্পণ; ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অবনীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক উত্তরপাড়া বিবরণ; ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে চারুচন্দ্র মিত্র কর্তৃক গৌড়-পান্ডুয়া; ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে গৌরীহর মিত্র কর্তৃক বীরভূমের ইতিহাস প্রভৃতি বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এককথায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার যে ব্যাপকতা দেখা যায় স্বাধীনোত্তরকালে তা আরও বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে তরুণদেব ভট্টাচার্য যেমন ‘মেদিনীপুর’, ‘বাঁকুড়া’, ‘পুরুলিয়া’ জেলার ইতিহাস রচনা করেছেন, তেমনি সুধীর মিত্র, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হিতেশরঞ্জন সান্যাল, অমলেন্দু মিত্র, দিলীপকুমার মৈত্র, নির্মলকুমার মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সরসীকুমার সরস্বতী, দেবলা মিত্র, বিমলকুমার দত্ত, ডেভিড ম্যাককাচ্চন, চারুচন্দ্র সান্যাল, মানিকলাল সিংহ, তারাপদ সাঁতরা, প্রভাস পাল, সুধীর চক্রবর্তী প্রমুখ শতাধিক মানুষ আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার কাজে ব্রতী হয়েছেন। আবার জেলার বা মহকুমার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বর্ধমান সমগ্র, অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, বীরভূমি বীরভূম, আসানসোলের ইতিবৃত্ত, কাটোয়ার ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়ে প্রত্নচর্চায় যেমন ব্রতী হয়েছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ, ননীগোপাল মজুমদার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কুঞ্জবিহারী গোস্বামীর মতো বিশিষ্ট মানুষেরা, তেমনি আঞ্চলিকভাবে বা স্থানীয়ভাবে লোকসংস্কৃতিচর্চার মধ্যে দিয়ে সমাজ ও জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বিষয়কে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে। ইতিহাসচর্চা বর্তমানে রাজরাজড়া ও উচ্চবর্ণের মানুষের কাহিনি থেকে সরে এসে সাধারণ মানুষ এবং নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। লোকসমাজের ঐতিহ্যের আলোচনায় বর্তমানে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার পদ্ধতিরও পরিবর্তন সূচিত করেছে।

আবার সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, কাজি মিনহাজ-উদ-দীনের তবকাত-ই-নাসিরী, আবুল ফজল আলামীর আকবর নামা এবং আইন-ই-আকবরী থেকে যেমন মধ্যযুগের আঞ্চলিক ইতিহাসের বহু তথ্য মেলে, তেমনি ডি. ডি. কোশাম্বীর মত অনুসরণ করে বলা যায় ধর্মীয় ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের বহু তথ্য। তাই বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ, নারায়ণদেবের মনসামঙ্গল, বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসাবিজয়, কবিকঙ্কণ মুকুন্দর চন্ডীমঙ্গল, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল, রূপরাম চক্রবর্তী, মানিক গাঙ্গুলি, ঘনরাম চক্রবর্তী, যদুনাথ প্রমুখের ধর্মমঙ্গল, ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল, প্রাণরামের কালিকামঙ্গল, রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন কাব্য প্রভৃতি গ্রন্থগুলি সমকালীন সমাজ ও ধর্মের চিত্র তুলে ধরেছে, এখান থেকে পাওয়া সম্ভব আঞ্চলিক ইতিহাসের বহু তথ্য বা উপাদান।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস অনুশীলন পদ্ধতি পালটাচ্ছে। এক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত আচরণের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। কারণ ইতিহাস কেবলমাত্র সাহিত্যের কোনো শাখা নয়, এখানে নিশ্চিতভাবে ঐতিহাসিক অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ঐতিহ্য ও পরম্পরার যে অচ্ছেদ্য যোগাযোগ রয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবেন। সামগ্রিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রচেষ্টা বিংশ শতাব্দীতে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হলেও আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এখনও দুর্বলতা রয়েছে। কারণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব, মৌলিক তথ্য সংগ্রহ করা বা সরকারিভাবে তথ্য পাওয়ার অসুবিধা, পেশাদার ঐতিহাসিকের আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় অনীহা, অপেশাদার ঐতিহাসিকদের অনেকক্ষেত্রে নিষ্ঠা, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিদ্যাশৃঙ্খলার অভাব যেমন রয়েছে তেমনি সরকারি সুযোগের অভাব; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগের অভাব (যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতা, বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ, কল্যাণী, রবীন্দ্রভারতী, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে আংশিকভাবে, সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু এক্ষেত্রে এটি মহাবিদ্যালয় স্তরে আজও আনা হয়নি), আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা ও রচনা পদ্ধতি সম্পর্কে গ্রন্থের অভাব, আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষার সুযোগের অভাব, অনেক সময় আঞ্চলিক ইতিহাসকারের নিজস্ব অঞ্চলপ্রীতি অথবা রাজা, প্রসিদ্ধ ব্যক্তি বা জাতির ইতিহাস বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখার প্রচেষ্টা, অনেকক্ষেত্রে সংকলনমূলক বা বিবরণকেন্দ্রিক বা সাহিত্যনির্ভর গ্রন্থ রচনার প্রবণতা (যেখানে বিচারবিশ্লেষণের অভাব রয়েছে) প্রভৃতি।

কিন্তু প্রায় দু-শো বছর ধরে বাংলার সামগ্রিক ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার যে ইতিহাস তার গুরুত্বও কম নয়। সংখ্যা কম হলেও পেশাদার ঐতিহাসিকের একাংশ যেমন একাজে যুক্ত হয়েছেন, তেমনি অপেশাদার শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, বিভিন্ন চাকুরিজীবী দেশপ্রেমী বহু মানুষ নিজস্ব উদ্যোগ, অধ্যবসায় ও অর্থ ব্যয় করে আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চায় ব্রতী হয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বিষয় নির্বাচনে এবং প্রাপ্ত তথ্যের উপস্থাপনায় ও বিশ্লেষণে ঘাটতি রয়েছে, ঐতিহাসিক কালক্রম ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্বলতা আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকে দুর্বল করেছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা, অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি প্রভৃতি হয়তো অনেকক্ষেত্রে প্রকট হয়ে পড়ে।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও বলা যায় অনেকে আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাসচর্চা এবং গ্রন্থ রচনায় জীবনের ব্রত হিসাবে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন। বঙ্গদেশে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছিল অপেশাদার ঐতিহাসিকদের দিয়ে এবং আজও এক্ষেত্রে তাদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে বা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। আজও আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার বিষয়টি পরিপূর্ণতা লাভ করতে না পারলেও অথবা আঞ্চলিক ইতিহাস রচনা-পদ্ধতিতে সেভাবে উৎকর্ষতা না পেলেও আলোচনা বা চর্চার ব্যাপকতা অনস্বীকার্য। দীর্ঘ দিনের আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার মধ্যে দিয়ে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে তাতে আঞ্চলিক বা স্থানীয় অসংখ্য বিষয় সম্পর্কিত বহু উপাদান বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং সেটির মূল্য অপরিসীম। অনেকক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকারীর ইতিহাসের প্রতি অনাবিল ভালোবাসা, উঠে এসেছে তাঁদের শ্রম-নিবিড় গভীর অনুসন্ধিৎসার ফসল। আর এই সমস্ত জেলা, মহকুমা, ব্লক বা গ্রামের ইতিহাসের উপাদান দিয়ে তৈরি হয় একটি রাজ্যের বা প্রদেশের ইতিহাস, আর প্রদেশের ইতিহাস দেশের ইতিহাস রচনা করতে সাহায্য করে। কারণ কোনো একটি অঞ্চলের মানবসমাজের বিবরণের মধ্যেই ইতিহাসের বীজ লুকিয়ে থাকে। আর একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন মনে করি। সেটি হল কুটবুদ্ধিসম্পন্ন বিদেশি ব্রিটিশ শাসককুল ‘ভাগ করে শাসন করো’ নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাকে খন্ডিত করলেও অথবা আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় যেকোনো ধরনের অন্তরায় থাক-না কেন জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা থেকে বাঙালি সরে আসেনি। কারণ জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক স্লোগান ছিল নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরকেই লিখতে হবে। সুদীর্ঘ অতীতকাল থেকে যাঁরা এ কাজে ব্রতী হয়েছেন তাদের কাছে আমরা ঋণী এবং বর্তমান সময়ে গবেষণার কাজে সাধারণভাবে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করছে, তাতে আমরা গর্ববোধ করতেই পারি।

ঋণস্বীকার

ইতিহাসচর্চা—নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০১)

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা ও গ্রন্থপঞ্জী—যজ্ঞেশ্বর চৌধুরি (২০০৮)

ইতিহাস অনুসন্ধান—পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ৬ষ্ঠ ও ৯ম খন্ডের কয়েকটি প্রবন্ধ

বাংলার ইতিহাস সাধনা—প্রবোধচন্দ্র সেন (১৯৯৪)

ইতিহাস ও ঐতিহাসিক—অমলেশ ত্রিপাঠী (১৯৮৬)

ইতিহাসের উত্তরাধিকার—পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মুখের কথায় ইতিহাস—পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ

ইতিহাসচর্চা, জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা—গৌতম চট্টোপাধ্যায় (১৯৮৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *