বঙ্গের বাহিরে বাঙালি

বঙ্গের বাহিরে বাঙালি

টমাস মান্ সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন; পক্ষান্তরে হিটলার বিশ্বাস করতেন হটেনটট এবং ফরাসি-জর্মন-ইংরেজ বরাবর নয়; অতএব পৃথিবীটাকে যদি ভালো করেই চালাতে হয় তবে সে-কাজটা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতের ওপরই ছেড়ে দেওয়া সমীচীন। হিটলার মানকে ডেকে পাঠালেন তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে। মান্ নারাজ হলেন। হিটলার চটে গিয়ে বন বিশ্ববিদ্যালয়কে হুকুম দিলেন, মানকে যে অনারারি ডক্টরেট দেওয়া হয়েছিল সেটা যেন প্রত্যাহার করা হয়। উত্তরে মান্ এই সর্বপ্রথম নাৎসি জীবনদর্শন সম্পর্কে আপন মত প্রকাশ করলেন। অতুলনীয় সে পত্র বিশ্বসাহিত্য রাজনীতিতে তার মূল্য কী আছে ওই বাবদে গুণীরা তা বলতে পারবেন। আমি বলতে পারি, সে-পত্র আমার মনে মিলটনের এরিয়োপে-জিটিকার চেয়েও গভীরতম রেখা কেটে গেছে।

ডক্টরেট হারানোতে মা আদৌ মনঃক্ষুণ্ণ হয়নি। স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বলছি, মান তার খোলা চিঠি আরম্ভ করেছিলেন এইভাবে আজ আমি ডাক খোলার সঙ্গে সঙ্গে বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাচার পেলুম, আমাকে একদা যে অনারারি ডক্টরেট দেওয়া হয়েছিল, সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কখনও বিদ্যাভ্যাস করিনি বলে সঠিক জানিনে এ সংবাদটি কীভাবে সর্বসাধারণকে অবগত করানো হয়। আমার অনুমান যদি সত্য হয়, তবে অনুরোধ করি, ওই নোটিশের পাশে আরেকটি নোটিশও যেন সেঁটে দেওয়া হয়–বনের চিঠির সঙ্গে সঙ্গে একই ডাকে হার্ভার্ড (কিংবা অন্য কোনও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়, আমার ঠিক মনে নেই–সৈ-মু-আ) আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা আমাকে অনারারি ডক্টরেট দিয়েছেন। এই সুবাদে এটাও বলে রাখি, বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট আমি কখনও আমার নামের সঙ্গে জুড়িনি কিংবা অন্য কোনও প্রকারে কাজে লাগাইনি; হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেটও কাজে লাগালুম এই প্রথম এবং এই শেষবারের মতো। কিন্তু কেন?

এই বলে মান জর্মনির সংস্কৃতি ঐতিহ্য তথা আদৌ ইয়োরোপীয় সভ্যতা বৈদগ্ধ্য বলতে কী বোঝায়, নাৎসি জীবনদর্শন কিংবা বলি অদূরদর্শন কী, সেই সম্বন্ধে শান্ত, বজ্ৰদৃঢ় কণ্ঠে প্রকাশ করেছেন আপন অতিশয় সুচিন্তিত যুক্তি-তর্ক-অভিজ্ঞতা-প্রসূত অভিমত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, গভীর দরদ দিয়ে। সেই যে জাপানি যক্ষারোগী চিত্রকর, সে তার বুক কেটে তার থেকে তুলি দিয়ে রক্ত তুলে তুলে নিয়ে ছবি এঁকেছিল, ঠিক সেইরকম।

তার পর মা নীরব হলেন। কারণ তিনি রাজনৈতিক নন।

তার পর প্রায় সমস্ত পৃথিবীর ওপর দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাণ্ডব-নৃত্য নেচে নিয়ে চলে গেল। কে তখন স্মরণ করে মানের ক্ষীণ কাকলি? তার পর তথাকথিত শান্তি। মানের বাসনা গেল আপন মাতৃভূমি পুনর্দর্শন করার। পশ্চিম জর্মনিতে তিনি এলেন। শেকস্‌পিয়ার আজ ইংলন্ডে ফিরে এলে এর সিকি সম্মানে তুষ্ট হতেন।

মান কম্যুনিজম পছন্দ করতেন না, তবে কতখানি অপছন্দ করতেন সেটা আমার পক্ষে বলা অসম্ভব, কারণ তাঁর তাবৎ লেখা এদেশে পাবার যো নেই!*[* নেতিবাচক বাক্য বলা বড় কঠিন; অস্তিবাচক বাক্য বলা সহজ। দৃষ্টান্ত : আমাকে যদি কেউ শুধোয়, ঘোড়া শব্দ বাঙলাতে আছে কি না; আমি অতি অবশ্য বলব, নিশ্চয়ই, কারণ এ শব্দ আমি বাঙলা পুস্তকে শতাধিকবার পেয়েছি, কিন্তু কেউ যদি শুধোয়, কটহ শব্দ বাঙলা শব্দ কি না, তবে আমি কী উত্তর দি? এ যাবৎ চোখে পড়েনি, তাই বলে কী বলব, বাঙলা শব্দ নয়– কারণ আমি তো তাবৎ বই, পুঁথি, পাণ্ডুলিপি পড়িনি, হলফ করে বলব, এটা বাঙলা শব্দ নয়।] তাই এক জর্মন তাকে ভীরু কণ্ঠে শুধোলেন, আপনি কি পূর্ব জর্মনি (কম্যুনিস্ট জর্মনি)-ও যাবেন?

মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, জর্মন ভাষা যেখানে পূজা পায় সে ভূমিই আমার মাতৃভূমি।

এত দীর্ঘ অবতরণিকা দেবার কারণ, অনেকেই মনে করেন মান্ এসকেপিস্ট ছিলেন– এই সুবাদে ঘটনাটি উল্লেখ করার সুযোগ হল।

শিলঙ, কটক, পাটনা– এই তিন জায়গায় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের তিনটি বড় কেন্দ্র আছে। এ-তিনটির সঙ্গে আমি সুপরিচিত। ভাগলপুর, এলাহাবাদ, জবলপুর এবং আরও নানা জায়গায়ও আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্ষীণ।*[* ভাগলপুরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আমার অগ্রজপ্রতিম জনৈক বন্ধু ভাগলপুরে বাঙলা ও বাঙালি এই বিষয়ে একখানি প্রামাণিক পুস্তিকা লিখেছেন। সেটির দিকে এই বেলায়ই আমার পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে রাখছি।]

এদের নানারকম সমস্যা আছে। তার চরম নিদর্শন তো হালে আসামের সর্বত্র হয়ে গেল।

প্রধান সমস্যা এই : মনে করুন আমি পাটনায় ডাক্তারি করি। আমার ঠাকুরদা সেখানে গিয়ে প্রথম বসবাস করেন। আদি নিবাস বিক্রমপুরের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র এখন সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আগে রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি ছিল বলে, আমি শিখেছিলুম বাংলা এবং ইংরেজি। হিন্দির বিশেষ প্রয়োজন হত না বলে ওটা আমি মেহন্নৎ করে শিখিনি। ধাই-আয়াদের কাছ থেকে, রাস্তাঘাটে ওটা আমি পিক অপ করে নিয়েছিলুম।

এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। হিন্দি রাষ্ট্রভাষা। আমার ছেলে যদি বিহারিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে চায় তবে তাকে অত্যুত্তম হিন্দি শিখতে হবে। সে যখন কথা বলবে তখন যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও না বুঝতে পারে যে হিন্দি তার মাতৃভাষা নয়; তার উচ্চারণ তার কথনশৈলী নিয়ে যেন কোনও হিন্দিভাষী টিটকারি না দিতে পারে।

এতখানি হিন্দি তাকে শেখানো যদি আমার আদর্শ হয় তবে তাকে অতি ছেলেবেলা থেকেই পাঠাতে হবে হিন্দি পাঠশালায়। শুধু তাই নয়, যেহেতু বাড়িতে সে বাঙলা বলে, সে হ্যাঁন্ডিক্যাপ কাটিয়ে ওঠবার জন্য তার জন্য আমার ফালতো ব্যবস্থাও করতে হবে। এসব তাবৎ ব্যবস্থা যদি করি তবে সে উত্তম হিন্দি শিখবে সন্দেহ নেই কিন্তু সে যদি হরিনাথদের মতন ভাষাবাবদে সব্যসাচী না হয় এবং সে সম্ভাবনাই বেশি তবে তার বাঙলা থেকে যাবে কাঁচা।

অথচ দেখুন, ভদ্রসন্তানই তার পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করে। ভদ্রসন্তানই পুত্রকে শিক্ষা দেয়, পিতাকে মাতাকে, পিতৃপুরুষকে শ্রদ্ধা জানাতে। তার সরল অর্থ, পরিবারগত জাতিগত ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে। এর সব কিছুই করতে হয় মাতৃভাষার মারফতে। ছেলেবেলা থেকে হিন্দি শেখার ফলে মাতৃভাষা হবে অবহেলিত। এবং তারই শেষ ফল : পাটনার সর্বত্র সে সম্মান পাবে তার হিন্দির জোরে কিন্তু আপন বাড়িতে সে পরদেশি, আপন ঐতিহ্য তার ধমনিতে প্রবেশ করতে পারল না, সে বর্বর। এবং তার জন্য দায়ী আমি।

বোম্বায়ের বাঙালি ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা ম্যাট্রিক পাস করে বাঙলা মাতৃভাষা নিয়ে। এরা বড় সুন্দর বাঙলা লেখে। একথা আমি জানি; তার কারণ স্বৰ্গত শ্যামাপ্রসাদবাবুর কল্যাণে (ভুল হলে কেউ শুধরে দেবেন) যখন বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় বাঙলাকে অন্যতম পরীক্ষার ভাষারূপে স্বীকার করে নিলেন তখন আমি হলাম তাদের এগজামিনার। তেরো বৎসর পরে আবার সেই ইস্কুল দেখতে গিয়েছিলুম। বড় আনন্দ হল। সে যুগের দু-চারটি শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর পরিচিত স্মিতহাস্য বয়ানও দেখতে পেলুম।

এঁরা বোম্বায়ে বাঙালা ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার অনুরোধ, ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা যেন মারাঠি ভাষা অবহেলা না করে ॥

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *