বঙ্গের গুপ্তকথা – অম্বিকাচরণ গুপ্ত
মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আপন জেলায় ইংরেজিনবিশ দারোগা বহাল করিবার সখ করিয়া হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটকে একজন ইংরাজী-জানা লোক পাঠাইবার জন্য অনুরোধ করেন,—হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট আপন আমলাদিগের মধ্যে সকলকেই মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের অভিপ্রায় অবগত করিয়া তাহাদের কেহ যাইতে ইচ্ছা করেন কিনা জানিতে চাইলে, অনুপচন্দ্র প্রার্থনা করেন। এবং সেকালের দেবদুর্লভ দারোগাগিরি লইয়া মেদিনীপুর যাত্রা করেন। বৈকালে জল ঝড়ের সময় অনুপচন্দ্র নৌকা করিয়া উলুবেড়েয় পৌঁছেন—জল ঝড় থামিলে আহারাদির পর সেই রাত্রেই ডাক পাল্কীতে কয়েকজন চৌকিদার সঙ্গে মেদিনীপুর যাত্রা করেন, এবং উলুবেড়ে ছাড়িয়া রাত্রি আন্দাজ দুই তিনটার সময় দামোদর তীরে উপস্থিত হন। তখন নৌকা পরপারে ছিল। ডাকের পাল্কী শুনিয়া মাঝি তাড়াতাড়ি পশ্চিম পার হইতে নৌকা পাড়ি দিল; নৌকা যতই কিনারার নিকট আসিতে লাগিল, ততই একটা চিৎকার শব্দ শোনা গেল। অনুপচন্দ্র পাল্কীতে নিদ্রা যাইতে ছিলেন, চিৎকার শব্দে তাহার নিদ্রা ভাঙিল। অনুপচন্দ্র পাল্কী হইতে মুখ বাহির করিয়া দেখিলেন নৌকাখানি দামোদরের মাঝামাঝি আসিয়াছে। নৌকার উপরে একটি পাল্কী—পাল্কীর চতুর্দিকে বেষ্টন করিয়া একদল লাঠিয়াল লাঠি খাড়া করিয়া দণ্ডায়মান আছে—পাল্কীর নিকট একটি ভদ্রবেশধারী পুরুষ, সগর্বে দণ্ডায়মান—নৌকাখানি ক্রমশ কূলের অতি নিকটে আসিল; তখন স্পষ্টই বুঝিতে পারা গেল সেই চিৎকার পাল্কীর ভিতর হইতে বাহির হইতেছিল, ‘কেহ থাকেন, স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা করুন,—দস্যু—দস্যু—দস্যু!’
এই শব্দে অভিনব দারোগা অনুপচন্দ্র নূতন কার্যক্ষেত্রে আপনার গুণ গরিমার সুন্দর পরিচয় দিবার সুবিধা পাইলেন। তিনি আপনা চৌকিদারদিগকে বলিলেন, ‘এই সমস্ত লোককে গ্রেপ্তার করতে হবে—’ ইতিপূর্বে তাঁহার ডাকে পাল্কীর বেহারা পরিবর্তন হইয়াছিল। পরিবর্তিত বেহারা সমেত ষোলজন তাহার সঙ্গে। তাহাদিগকে বলিলেন, গ্রেপ্তার করিতে পারিলে তিনি পুরা বকশিস্ দিবেন।—তাঁহার সঙ্গে একজন বরকন্দাজও ছিল। তাহাকে দিয়া নিকটবর্তী ফাঁড়িতে বলিয়া পাঠাইলেন যে একদল চৌকিদার লইয়া ফাঁড়িদার যেন তাহার সাহায্যার্থে ত্বরায় উপস্থিত হয়—বরকন্দাজ দৌড়িল; বেহারা চৌকিদার সারি বাঁধিয়া নদীর ধারে খাড়া হইয়া গেল। আর তিনি আপনি একটি রিভলভারে টোটা পুরিয়া দাঁড়াইলেন। নৌকা তীরে আসিয়া লাগিল। তখন নদীতে ভাঁটা। নদীর জল কমিয়া কূল ভূমির অনেক নিচে গিয়াছিল। অনুপচন্দ্র সদলে কিনারার উপরে দণ্ডায়মান, নিচে নৌকা,—নৌকা হইতে যে অবিশ্রান্ত চিৎকার শব্দ আসিতেছিল তাহার উত্তর দিয়া তিনি বলিলেন, ‘ভয় নাই, ঈশ্বর রক্ষা করিবেন।’
চিৎকার শব্দ আবার বলিল, ‘ভগবান কি এ অভাগীর দিকে মুখ তুলে চাইবেন?’
অনু। ‘স্থির হন, উপায় হচ্ছে।’
এই কথা বলিয়া তিনি বন্দুকে একটা আওয়াজ করিলেন; সেই নিস্তব্ধ নিশীথে বন্দুকের শব্দে বায়ু কাঁপিল, কাঁপিতে কাঁপিতে যত দূর গেল সেই শব্দকে বহিয়া ছুটিল; গ্রামবাসীদিগকে জাগ্রত করিল, অনুপ সদম্ভে বলিলেন, ‘সৎ হও অসৎ হও—ডাকাইত হও, দস্যু হও, ধীরে ধীরে নৌকা হ’তে নামিয়া এস,—নতুবা নিস্তার নাই—’
এই কথায় লাঠিয়ালদিগের মধ্যে একজন নৌকার মাঝিকে সাংঘাতিক আঘাত করিয়া নদীর জলে ফেলিয়া দিল, আপনি হাল ধরিয়া দক্ষিণ দিকে নৌকা ভাসাইয়া দিল। ভাঁটার জোরে নৌকা দক্ষিণ মুখে ভাসিয়া চলিল। দারোগাবাবু অনুচরগণ সহিত কিনারা দিয়া অনুধাবন করিলেন। অনুপ যুবা পুরুষ, নূতন ক্ষেত্রে নূতন উদ্যমে অসীম সাহসে, বিপুল বলে ছুটিতে লাগিলেন,—লক্ষ্যে অলক্ষ্যে গুলি চালাইতে লাগিলেন—নৌকা হইতে তিন চারিজন অচেতন বস্তুর ন্যায় ঝুপ ঝুপ জলে পড়িয়া গেল; নৌকাস্থিত ভদ্রবেশী পুরুষটি উপায়ান্তর না দেখিয়া পাল্কীখানিকে নৌকা হইতে জলে ফেলিয়া দিয়া আপনিও পড়িল।
তখন গ্রামের লোক নদীর উভয়তীরে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। অনুপ গ্রামবাসীদের সাহায্যে পাল্কীখানি জল হইতে তুলিলেন, আপনি নদীতে নামিয়া চৌকিদারদিগকে লইয়া সাতজন লাঠিয়ালের সহিত যুবাকে গ্রেপ্তার করিলেন। সকলকে বাঁধিয়া লইয়া ঘাটে পৌঁছিলেন। ইতিপূর্বে পাল্কী খুলিয়া দেখা হইয়াছিল যে, তাহার মধ্যে একটি যুবতী মুমূর্ষ প্রায়। পশ্চাৎ বেহারাগণ পাল্কীখানিকে লইয়া ঘাটে পৌঁছিল।
অনুপচন্দ্র স্ত্রীলোকটার সেবা শুশ্রূষা করিলে তিনি বমন করিতে আরম্ভ করিলেন; বারম্বার বমনের পর তাঁহার চেতনা সঞ্চার হইল। অনুপচন্দ্র তখন দস্যু যুবককে একটি গাছতলায় লইয়া গিয়া সমস্ত বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিয়া বলিলেন, সত্য কথা বলিলে তাহাকে নিষ্কৃতি দিবেন। দস্যু যুবা উত্তর করিল, ‘স্ত্রীলোকটি তাহার বনিতা—গতরাত্রির পূর্ব রাত্রিতে শ্বশ্রু প্রভৃতি পরিবারস্থ সকলের অসম্মতিতে পিত্রালয়ে পলায়ন করিতেছিল, সে সন্ধান পাইয়া জলঝড়ের সময় রূপনারায়ণের তীরে এক দোকানে একটি ভদ্রলোকের আশ্রয়ে আমি তাহাকে খুঁজিয়া পাইয়া সেখান হইতে ধরিয়া আনিবার কালে সমস্ত পথ সে চিৎকার করিয়া আসিতেছিল।’
অনু। ‘তোমার নাম কি?’
দস্যু। ‘বিপিনবিহারী।’
অনু। ‘কোথায় বাড়ি?’
দস্যু। ‘জগদীশপুর।’
অনু। ‘কি জাতি?’
বিপি। ‘ব্রাহ্মণ!’
অনু। ‘নৌকার মাঝিকে জলে ফেলে দিয়ে নৌকা নিয়ে পালাতে গেলে কেন?’
বিপি। ‘আপনার বন্দুকের গুলিতে সে জলে পড়ে গিয়েছে।’
অনু। ‘ভাল,—পালাচ্ছিলে কেন?’
বিপি। ‘এ পথে বড় দস্যু ভয় আছে, আপনাকে দস্যু মনে করে পালাচ্ছিলাম—’
অনু। ‘পাল্কী কেন জলে ফেলে দিলে?’
বিপি। ‘দস্যু হাতে মরতেই যদি হল তবে স্ত্রী-পুরুষে দুজনেই মরা শ্রেয়, এই বিবেচনায়—’
প্রত্যুত্তেরে অনুপচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, ‘দস্যুকে তো তুমি পেয়েছ, পুলিশে দিবে না?’
বিপি। ‘একটু সুস্থ হইলেই থানায় গিয়া এজাহার দিব।’
অনু। ‘থানায় যেতে হবে না, এখানেই দারোগা আসবেন।’
অনুপচন্দ্র স্ত্রীলোকটির নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি কি একটু সুস্থ হলেন?’
তিনি অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকা দিয়া বলিলেন, ‘আজ্ঞা হ্যাঁ। আপনার অনুগ্রহে জীবন পেলাম।’
অনু। ‘আমার অনুগ্রহে নয়, ঈশ্বরের; বিপন্নকে তিনি ভিন্ন কেহ উদ্ধার করতে পারেন না; মনুষ্য অবলম্বন মাত্র।’
স্ত্রী। ‘আপনিই আমার মনুষ্যরূপী ঈশ্বর—নতুবা এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় কে রক্ষা করতে পারে?’
অনু। ‘আপনার নাম কি?’
স্ত্রী। ‘সৌদামিনী।’
অনু। ‘আপনার নিবাস কোথায়?’
স্ত্রী। ‘শ্রীরামপুর রিষড়া।’
অনু। ‘কোথায় যাচ্ছিলেন?’
স্ত্রী। ‘স্বামী মেদিনীপুরে চাকরি করেন, সেইখানে যাচ্ছিলাম—’
অনু। ‘কিসে যাচ্ছিলেন?’
স্ত্রী। ‘পাল্কীতে।’
অনু। ‘ডাক-পাল্কীতে?’
স্ত্রী। ‘না, দেশ হতে বেহারা আনছিলাম, সঙ্গে একজন ঝি আর দুজন হিন্দুস্থানী দরওয়ান ছিল।’
অনু। ‘তারা কোথায়?’
স্ত্রী। ‘তাদিগে খুন করেছে—’
অনু। ‘কোথায় খুন করেছে?’
স্ত্রী। ‘রূপনারায়ণের তীরে।’
অনু। ‘কোন দিনে?’
স্ত্রী। ‘গত রাত্রিতে দুই-তিন দণ্ডের সময়, যখন খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়—আমি পলাইয়া একটি ভদ্রলোকের আশ্রয় লই, বোধহয় তিনিও একজন পথিক; এরা তার কাছ থেকে আমাকে জোর করে এনেছে।’
অনু। ‘সেই ভদ্রলোকটিকে চিনতে পারেন?’
স্ত্রী। ‘ভালরূপ নয়—তখন আমি অজ্ঞান ছিলাম, ভাল করে তাঁকে দেখি নাই—’
অনু। ‘আপনি লেখাপড়া জানেন?’
স্ত্রী। ‘জানি। সামান্য রূপ—’
অনু। ‘আপনার স্বামীর নাম লিখিয়া দেন দেখি—’ অনুপচন্দ্র আপনার পাল্কী হইতে কাগজ কলম আনিয়া লিখিতে দিলেন। স্ত্রীলোকটি তাহার স্বামীর নাম ‘বিপিনবিহারী মুখোপাধ্যায়, হেড কেরানী ওয়াটসন কোম্পানীর ছুটি—গড়বেতা’ এইমাত্র লিখিয়া দিলেন। নামটি পাঠ করিয়া অনুপচন্দ্র শিহরিয়া উঠিলেন—বিষাদ-হর্ষে তাহার চক্ষে জল আসিল। রিষড়ার বিপিন তাহার সহধ্যায়ী ছিলেন, তাঁহারই বিপদ—সেই বিপদে তিনি উদ্ধারকর্তা।
যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, ‘নাম শুনিয়া আপনার চক্ষে জল আসিল কেন?’
অনু। ‘সে কথা এখন আপনার শুনে কাজ নেই—পরে শুনবেন। আপনি এই যুবা দস্যুকে কখনও দেখেছিলেন?’
স্ত্রী। ‘উনি আমার স্বামীর সম্বন্ধে ভ্রাতুষ্পুত্র। অনেকদিন হতে আমার প্রতি আসক্ত—সময়ে সময়ে আমার সতীত্ব অপহরণেরও প্রয়াস পায়—স্বামী বিদেশে থাকেন, তাঁকে পত্রে লিখি, এতদিন তিনি আমাকে আপনার কাছে লইয়া যান এমন সুবিধা পাননি, অল্প বেতন পেতেন, এখন বেতন বেড়েছে—’
অনু। ‘আপনার স্বামীর ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম কি?’
স্ত্রী। ‘বিনোদ।’
থানার দারোগা মহাশয় যখন রূপনারায়ণের তীরে পৌঁছিলেন তখন বেলা পাঁচটা বাজিয়াছে। তিনি যাইবার পূর্বে রূপনারায়ণের তীরে লোক ধরে না—এগারটা খুন—নানা ভাবনায় গ্রামের কাহারও বাড়িতে সে রাত্রি হাঁড়ি চড়িল না।
দারোগা মহাশয় পাল্কী হইতে অবতীর্ণ হইয়া সৌদামিনীর এজাহার লইলেন, তাঁহাকে দিয়া লাশ সনাক্ত করাইলেন, সৌদামিনী একে একে আপনার দরওয়ান, বেহারা, ও দাসীর লাশ চিনিলেন যে দোকানে পলাইয়া গিয়া আশ্রয় লইয়াছিলেন তাহাও দেখাইয়া দিলেন—খুনী মোকর্দমার তদন্ত চলিতে লাগিল।
অনুপচন্দ্র রাত্রিতে আহারান্তে মেদিনীপুর রওনা হইলেন। চক্কম্লা গ্রামের জমিদার একজন কায়স্থ—তাহার বাড়ি দারোগা তেজচন্দ্র ঘোষের আদি অবস্থিতি। গ্রামের জমিদার নজরবন্দী, এবং মণ্ডল, গোমস্তা, পাইক সকলে এক দড়িতে বন্ধ পড়িলেন; যতক্ষণ মোকর্দমার কিনারা না হয়, ততক্ষণ তাহাদিগের গ্রহ সুপ্রসন্ন নহে।
জমিদার বাড়িতে দারোগা মহাশয় ও অনুপবাবু আহারাদি সমাপন করিলেন। সৌদামিনী সীতারামের অন্তঃপুরে থাকিলেন।
চককম্লা গ্রামের তালুকদার সীতারামের বাটীতে দারোগা-মহোৎসবের দুই দিন কাটিয়া গেল। স্থির হইল সকাল সকাল দারোগাবাবুদিগের স্নানের আয়োজন করিয়া দিবেন। এমন সময় দারোগা তেজচন্দ্রের বরকন্দাজ দুমন সিং ধীরে ধীরে তাহার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল। দারোগা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি দুমন সিং, খাবার-দাবার কোন অসুবিধে হচ্ছে না ত?’
‘আজ্ঞে না। বিশ্বাস মশায়ের এখানে আমাদের কখন কষ্ট হয় না।’ দারোগার পানে চাহিয়া বলিল, ‘আপনাকে একবার আসতে হবে, একটা কথা আছে।’
দুমন দারোগা মহাশয়কে বাটীর বাহিরে অনেক দূরে লইয়া গিয়া তাঁহার মুখপানে চাহিয়া কিয়ৎক্ষণ স্থির হইয়া রহিল,—কোন কথা কহিল না, দারোগা তাহার ভাবভঙ্গি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দুমন, সব ভাল তো?’
দুম। ‘আজ্ঞা না। ভারি বিপদ, এতদিন আপনার কাছে আছি, এমন কখনো হয় না। বড় বড় দায় চলে গেছে—তায় কিছু ভাবনা করি না, আজ ভাবিয়েছে।’
দার। ‘ব্যাপারটা কি বল দেখি—’
দুম। ‘এমন কিছু সঙ্গীন ব্যাপার নয়, তবে এই বেকারবারী নূতন লোকটা থেকেই গোল বেঁধেছে—নাহলে সব চুকে যেত—’
দার। ‘হয়েছে কি?’
দুম। ‘আসামী ক’টা কাল রাত্রে সরেছে—’
দার। ‘সে কি দুমন, খুনী-মোকর্দমার আসামী পালাল কি? কখন?’
দুম। ‘কাল রাত্রে।’
দার। ‘রাত্রে তো জানি। কেমন সময়?’
দুম। ‘তা জানতে পারা গেলে কি ধরা পড়তে বাকি থাকে!’
দার। ‘কে পাহারায় ছিল?’
দুম। ‘এই গ্রামের সাত, বেটা চৌকিদার ছিল।’
দার। ‘দুমন, শেষ বয়সটায় বড়ই বিপদ দেখছি, দুটা বছর গেলে পেন্সন নিয়ে বার হতেম, তা আর অদৃষ্টে ঘটলো না বোধ হচ্ছে।’
দুম। ‘আপনি অত ভাববেন না। এই দুমন থাকতে আপনার কিছু হবে না।’
দার। ‘তা তো জানি। কিন্তু আসামী কোথা পাব? এখন সাক্ষীদেরও সনাক্ত করা হয়নি,—তাই তো, কি হবে?’
দুম। ‘আমি তো চৌকিদার দিয়ে ধরতে পাঠিয়েছি।’
এই সকল কহিতে কহিতে দারোগা তেজচন্দ্র বসিয়া পড়িলেন, তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল। বড় ভয়ানক কথা, খুনী-মোকর্দমার আটজন আসামী ফেরার। দারোগা আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলেন। তাঁহার ভাবনা দেখিয়া দুমন বলিল, ‘বাবু, ভাববেন না, একটা উপায় করা আছে।’
দারোগা। ‘কি বল দেখি?’
দুম। ‘একবার এদিকে আসুন।’
দুমন দারোগা মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া যেখানে আসামীরা আবদ্ধ ছিল সেইখানে লইয়া গেল। গৃহের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দারোগা মহাশয় দেখিলেন আটজন লোক আবদ্ধ রহিয়াছে। তাহারা দারোগা মহাশয়কে দেখিবা মাত্র বলিয়া উঠিল, ‘দোহাই দারোগা, আমরা কাশীজোড়া পরগণার লোক, গঙ্গামায়িদর্শনে যাচ্ছিলাম, আমাদিগে ধরে এনেছে—ধর্ম অবতার, আমরা কিছুই জানি না, আপনি আমাদের মা বাপ।’
এই সকল কথা শেষ না হইতে হইতে দুমন বলিল, ‘চুপ রও,ঘাবড়াও,—মৎ।’
দারোগা মহাশয় গৃহ হইতে বাহির হইয়া দুমনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এরা একবার করে না?’
দুমন উত্তর করিল, ‘চেষ্টা হচ্ছে—’
দার। ‘একরার করলেও টিকবে না—সাক্ষীরা তো সনাক্ত করবে না—’
দুম। একরার তো করুক, তাহলে সাক্ষীরা আর কতক্ষণ সনাক্ত না করে থাকতে পারে—’
দার। ‘সনাক্ত, অনুপবাবুর সনাক্ত—তা ওই ও দুজন লোকও জল ঝড়ের দিন রাত্রে ঘোর অন্ধকারে দেখেছিল, তাও চকিতের ন্যায়—সে সনাক্ত ততটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
দুম। ‘অনুপবাবুও তো পুলিশ, তিনি কি আর অন্য কথা বলতে পারেন—’
দুমনের অবলম্বিত পন্থা তাঁহার প্রীতিকর হইল না। কিন্তু না হইলেও আপনি মারা পড়েন, কি করিবেন, সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে আপনার চৌকীতে গিয়া বসিলেন। চৌকিদারেরা পূর্ববৎ আসামীদিগের সতৈল হস্তে তাহার অঙ্গসেবা করিতে লাগিল। দারোগামহাশয় অনুপের সঙ্গে কথা কহিতেছেন বটে, সর্বদাই অন্যমনস্ক,—প্রাচীন দারোগা লোকটা বড় বিচক্ষণ, বিশেষ সাবধান লইতেছেন অনুপ কোনমতে তাহাকে ধরিতে না পারেন।
দারোগা মহাশয় পান চিবাইতে চিবাইতে ফরসীর মুখনল চুম্বন করিতেছেন—পার্শ্বে অনুপবাবু একটা তাকিয়া হেলান দিয়া কাত হইয়া পড়িয়া আছেন। সম্মুখে দারোগা মহাশয়ের মুন্সী লক্ষণের ফল ধরার ন্যায় কাগজ কলম ধরিয়া বসিল। দুমন যে আসামীটিকে আনিল তাহার নাম, রমানাথ গুছাইত।
দুমন বলিল, ‘রমানাথ, যা যা করেছিস দারোগা মহাশয়ের কাছে সব বল। কিছু ভয় নাই।’
রমানাথ দুমনের মুখের দিকে চাহিল, তাহার পর কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, ‘তবে বলব?’
দুম। ‘হ্যাঁ, বলবি বৈকি, খুব সাহস করে বল, ভয় কি?’
রমা। ‘বলব?’
দুম। ‘বলবি বৈকি।’
রমা। ‘তবে বলি, আমার নাম রমানাথ—’ (থামিল)
দুম। ‘বল, বল, ভয় কিসের?’
রমা। (চুপ) ‘আমি হাজিরা বিপিনবাবুর সঙ্গে এদেশে এসে—’ (থামিল)
দুম। ‘বলতে বলতে থামিস্ কেন?’
রমা। ‘খুন করেছি—’
দারোগা। ‘সে বিপিনবাবু কই?’
দুমন এই আসামীকে পরিষ্কার কাপড়-চোপড় পরাইয়া বাহ্যিক সভ্যভব্য করিয়া আনিয়াছিল, দ্বিতীয় আসামীকে আনিয়া দুমন রমানাথকে বলিল, ‘এর দিকে চেয়ে দেখ দেখি?’
রমা উত্তর করিল, ‘ও আমার পিসতুতো ভাই, হরে জানা।’
দুমন তখন বলিল, ‘বেশ করে দেখ?’
রমা বলিল, ‘বেশ করে দেখেছি, ওর সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে গরু চরিয়েছি, একত্রে হাল করেছি, আর আমার চিনতে দেরি লাগবে!’
দুমন। ‘এই যে তুই আমার কাছে বললি, ওর নাম বিপিনবাবু—’
রমা। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিপিন—’
দুম। ‘তুই ব্যাটা কি ন্যাকামি করবি নাকি?’
দারোগা মহাশয় দুমনকে চক্ষুর ইঙ্গিতে বলিলেন, রমানাথকে যেন স্থানান্তর করা হয়।
অনুপবাবু একটু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, ‘এ তো বিপিন নয়,—বরকন্দাজ তবে আর কাকেও এনে থাকবে।’
তেজচন্দ্র উত্তর করিলেন, ‘এ উৎকণ্ঠার সময় কাজ নাই, আহারান্তে তখন দেখা যাবে।’
অনুপ একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘আমি আর থাকতে পারছি না, আপনি আজ রাত্রে বিদায় করে দিন।’
দার। ‘আপনাকে আজ রাত্রেই বিদায় দেব।’
আহারের পর সীতারামের বৈঠকখানায় অনুপ শয়ন করিয়া আছেন, এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁহার নিকট আসিয়া বলিল, ‘শুনেছেন, মোকর্দমা’ ফায়ের।’
অনুপ। ‘সে কেমন?’
‘আসামী সব কালরাত্রে সরেছে।’
অনুপ তাকিয়ায় মাথা দিয়াছিলেন, উঠিয়া বলিলেন, ‘কেমন করে?’
‘বরকন্দাজ চৌকিদার সকলে ঘুমুচ্ছিল, ফাঁক পেয়ে তারা পিট্টান দিয়েছে—ভোরের সময় এক চৌকিদার জেগে উঠে দেখে যে আসামী নাই—তারপর বরকন্দাজকে জাগায়, সে উঠে চৌকিদারকে সঙ্গে করে নিয়ে কটক রোডের ধার হতে কতকগুলা নিরীহ লোককে ধরে এনে পুরেছে—’
অনু। ‘ঠিক—ঠিক—আমিও তো তাই ভাবি—এ সকল আসামী নূতন লোক; আমি যাদিগে গ্রেপ্তার করেছি, তাদের চেহারা আমার বেশ মনে আছে—কালো, মোটা মোটা লোক তারা, তাদের এক এক জনে দশ দশ জনকে কাত করতে পারে—আর এরা নিতান্ত কৃষ্ণের জীব—’
এই সকল কথাবার্তা চলিতেছে এমন সময় দারোগা মহাশয় আসিয়া পৌঁছিয়া গেলেন।
দার। ‘একবার কেবল সৌদামিনীকে এনে বাবুদের সনাক্ত নিতে হবে, তাহলেই আর কিছু বাকি রইল না।’
অনু। ‘আসামীদিগে চিনবেন না।’
দার। ‘প্রয়োজন নাই।’
অনু। সে কি মশায়, ওরা প্রধান সাক্ষী—’
দার। ওদের সাক্ষী ততদূর বিশ্বাসযোগ্য হবে না—’
অনু। ‘তবে সৌদামিনীর সনাক্ত কেমন করে বিশ্বাসযোগ্য হবে?’
রূপনারায়ণের, তীরে এক দোকানে যে ভদ্রলোকের আশ্রয়ে সৌদামিনী স্থান পাইয়াছিল—সেই বসন্তবাবু ও বলরামকে উপস্থিত করা হইয়াছিল।
দার। ‘বসন্তবাবু ক্ষণেকের জন্য রাত্রিকালে আসামীদের দেখেছিলেন, সেই মুহূর্তের মধ্যে তাদিগে চিনে রেখেছিলেন, একথা শুনলেই হাকিমদের অবিশ্বাস হবে। মোকর্দমা খাস হয়ে যাবে।’
দারোগা মহাশয় সীতারামকে বলিলেন, অবিলম্বে অবগুণ্ঠনবতী সৌদামিনী বাহিরে আসিলেন। আসিয়া বসন্ত ও বলরামকে দেখিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ, বোধহয় এরাই সে রাত্রিতে আমার প্রাণদান করেছিলেন।’
বসন্তকুমারের অনুরোধে সৌদামিনী রাত্রির ঘটনা আনুপূর্বিক সমস্তই বলিলেন। তখন বসন্ত এবং বলরাম তাহা ঠিক বলিয়া স্বীকার করিলেন।
অনুপ, দারোগার অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, যাহাতে তাঁহার চাতুরি সাধারণ্যে প্রকাশ পায়, তাহারই বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। বলিলেন, ‘দারোগা মহাশয়, এই সময় একবার বিপিনকে আনলে হয়,—সে কি বলে দেখা যেত!’
দার। ‘রহস্য দেখবার কাজ নয়। এত ভদ্রলোকের সমক্ষে তাকে এনে অপদস্ত করতে ইচ্ছে করি না।’
অনুপ। ‘ভালোই বিবেচনা করেছেন, কিন্তু আপনার বরকন্দাজ দুমন যে বিপিনকে এনেছিল, সে আমার গেরেপ্তারী আসামী বিপিন নয়—’
দার। ‘সে কি কথা বলেন, যখন সে আপন মুখে একরার করেছে, তখন আপনি ‘না’ বললেই ‘না’ হবে? যদি বলেন, তাহলে আপনাকেই মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হতে হবে।’
‘মিথ্যাবাদী’ শব্দটিতে অনুপ বড়ই মর্মবেদনা পাইলেন, বলিলেন, ‘কে মিথ্যাবাদী আদালতে সাব্যস্ত হবে? এ গ্রামের সকল লোকই জানে—আপনি কখনও সত্য গোপন রাখতে পারবেন না, আগুন কখনও কাপড় চাপা দিয়ে লুকানো যায় না।’
দার। ‘শেষ কালটায় আপনি এরূপ ব্যবহার করবেন, স্বপ্নেও চিন্তা করি না।’
অনুপ সীতারামকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের যাবার ব্যবস্থা করে দিন, আমরা এখনই যাব।’
বেহারা-পাল্কী আনাইতে সন্ধ্যা হইল; রাত্রির আহার সমাপন করিয়া অনুপ, বলরাম, বসন্ত, সৌদামিনী সকলেই চককম্লা হইতে বিদায় লইলেন।