বক্সা দুর্গের রহস্যময় রাত

বক্সা দুর্গের রহস্যময় রাত

গাড়িটা যখন বক্সা টাইগার রিজার্ভে ঢুকল, তখন সূর্য মাথার উপর। কুন্তল বলল, ‘হ্যাঁ রে, রাস্তার দু-ধারে যেভাবে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হাতি আর বাঘ নিয়ে ইনফরমেশন দেখছি, সত্যি বাঘটাঘ নেই তো রে?’

প্রতনু সবুজে চোখ ডুবিয়ে গাড়ির জানলা দিয়ে উদাস। কথাটা কানেই গেল না মনে হল।

কুন্তল ফের বলল, ‘কী রে, চুপ করে আছিস যে বড়ো?’

প্রতনু বলল, ‘টাইগার রিজার্ভে বাঘ বেরোবে না তো কি ভূত বেরোবে?’

কুন্তল অবাক গলায় প্রশ্ন করল, ‘এবারেও কি তুই ভূত খোঁজার ঠিকে নিয়ে এসেছিস নাকি? তা হলে আসতামই না তোর সঙ্গে। মিথ্যে একটা ইমেজ তৈরি করে ছুটে বেড়াস।’

প্রতনু হেসে বলল, ‘না রে, এবার শুধুই টাইগার, এলিফ্যান্ট, রাইনো, ব্যাস! তুই শুধু ভূত খুঁজে-বেড়ালি, তা হলে তো হয় না রে। ভূতেরও তোকে খোঁজা দরকার। ওই যেমন ভক্তের ভগবানকে ডাকলেই হয় না, ভগবানেরও ভক্তকে দেখা দেওয়ার মন চাই।’

কুন্তল কিছুটা হতাশ গলায় বলল, ‘যাক, বাঁচা গেল! এবার আর আন্দামানের সেলুলার জেলের মতো ভূত খুঁজে-বেড়াস না যেন!’

দু-ধারে দূষণের আঁচ না লাগা সবুজ। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে সতর্কনামা, ‘এখানে হাতি পারাপারের রাস্তা’, আবার কখনো লেখা ‘বনের প্রাণীকে বিরক্ত করবেন না’, আবার কখনো লেখা ‘বক্সা টাইগার রিজার্ভ’।

বক্সা আসার প্ল্যানটা প্রতনুরই। পাঁচ দিনের প্ল্যান। একদিন জয়ন্তী নদী দেখতে যাওয়া হবে। রং-বেরঙের পাথর-বিছানো নদী। শুকিয়ে যাওয়া নদী নাকি বর্ষায় বানভাসি হয়। এখন অবশ্য পুজোর সময়, তিরতিরে স্রোত। আর একদিন সারাদিন ধরে তক্ষক খুঁজে কাটবে। প্রতনু নাকি কার কাছে শুনেছে, বক্সার জঙ্গলে নাকি খুব তক্ষক আছে। আলিপুর চিড়িয়াখানায় ‘তক্ষক’ লেখা খাঁচায় আঁতিপাতি করে খুঁজেও কেউ তক্ষকের দেখা পেয়েছে বলে শোনা যায়নি কখনো। পৌঁছোনোর দিনটা হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়া। তার পরের দু-দিন বক্সা ফোর্ট।

প্ল্যানটা শোনার পর কুন্তল বলেছিল, ‘জঙ্গল আছে, এতেই আমি খুশি। ওই ফোর্টটোর্ট নিয়ে আমার ভাই কোনো মাথা ব্যথা নেই। অভিষেক বলেছিল, ক-টা ভাঙা দেওয়াল ছাড়া বক্সা ফোর্ট বলতে এখন আর কিছু নেই। ওরা গত বছরই নাকি ঘুরে গেছে।’

সেকথায় কান দেয়নি প্রতনু। প্রতনু ওসব কথায় কান দেওয়ার পাত্র যে নয়, সেকথা কুন্তল জানে। এখন টাইগার রিজার্ভের সবুজ মন ছুঁয়েছে কুন্তলের। তার চোখে-মুখে বেশ খুশি খুশি ভাব। প্রতনু বন্ধু হিসেবে দারুণ। শুধু ওকে নিয়ে একটাই সমস্যা, ওর ওই ভূত-বাতিক। দু-জনে একই অফিসে কাজ করে, আই টি সেক্টরে। কুন্তলের অ্যাকাউন্টস, প্রতনুর রিক্রুটমেন্ট। প্রতনু বেশ লম্বা। বিকেলে ওর ছায়া একটা ছোটখাটো তাল গাছের মতো লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে। ফরসা, মাথায় কোঁকড়া চুল। জিনস পরে। আর টি-শার্ট।

কুন্তল মাঝারি লম্বা, শ্যামলা রং। ফরমাল ড্রেস, কী অফিসে, কী বাইরে। টিপটপ দেখতে।

গাড়িটা ব্রেক কষে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল। ড্রাইভার অভিমন্যু বলল, ‘আপনারা এসে গেছেন!’

কুন্তল চারদিকে চোখ চারিয়ে কোথাও ‘বক্সা ভ্যালি রিসর্ট’ বোর্ড দেখতে পেল না। গাড়ি থেকে নামতে বছর পনেরোর একটা ছেলে এগিয়ে এল। তাকে জিজ্ঞেস করল প্রতনু, ‘ভাই, এটাই বক্সা ভ্যালি রিসর্ট তো?’

ওর কথা কেড়ে নিয়ে অভিমন্যু বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, এটাই বক্সা ভ্যালি রিসর্ট।’

রিসর্টের ছেলেটি ঘাড় নেড়ে সায় দিতে কুন্তলও নেমে পড়ল। ছেলেটি বলল, ‘আমি অজিত ছেত্রী।’ ছিপছিপে, ফরসা, বেশ মিশুকে মনে হল অজিতকে। দৌড়ঝাঁপ করে গেস্টদের দেখভাল তদারকি করছে।

রিসর্টের লোকজন এসে লাগেজ নামিয়ে নিয়ে চলল সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে। প্রতনু অভিমন্যুকে বলল, ‘কাল সকাল ন-টায় চলে এসো ভাই।’

অভিমন্যু গাড়িটা বেশ চালায়। ছেলেটির বাড়ি নাকি এখানেই কোথাও। ওর সঙ্গে দিন হিসেবে চুক্তি হয়েছে। ঘাড় নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে শাঁ করে উধাও হয়ে গেল অভিমন্যু। কুন্তল আর প্রতনু চলল রিসর্টের লোকদের পিছন পিছন। কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙলে একটু সমতল, ফের কয়েকটা সিঁড়ি। ধাপে ধাপে ছোটো ছোটো কটেজ। চারপাশে ঘন জঙ্গল। সাদা রঙের ছোট্ট কটেজগুলো ভারি সুন্দর দেখতে। এক নম্বর কটেজে ওদের বুকিং। তার পাশ থেকেই শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। গল্পে পড়া ঘন জঙ্গল নয়, একেবারে সত্যি জঙ্গল। আকাশ-ছোঁয়া লম্বা লম্বা শাল আর সেগুন। বেশি দূর দৃষ্টি যায় না।

খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিতেই সন্ধ্যে নামল। কুন্তল আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘কী রে প্র, এক্ষুনি সন্ধ্যে নেমে গেল যে?’

উচ্চারণের সুবিধের জন্যে অফিসেও প্রতনুকে সকলে প্র বলেই ডাকে। কুন্তলও।

প্রতনু বলল, ‘জঙ্গলে তাড়াতাড়িই তো সন্ধ্যে নামে। এতদিন জঙ্গলে আসছিস, এটা জানিস না? চল, চেয়ার নিয়ে বাইরে গিয়ে বসি।’

অমন সময় রিসর্ট-বয় চা নিয়ে হাজির। রিসর্টের আপ্যায়ন ভালো। চারদিকে পাখিরা ডাকছে গাছে গাছে। কী পাখি, দেখার উপায় নেই। গাছের ডাল-পাতার আড়ালে কোথায় যে বসে আছে। ক্লান্ত ডানার পাখিরা ঘরে ফিরছে। লোকজনের দেখা নেই। যে ক-জন টুরিস্ট, তাদেরই নীচু স্বরের যেটুকু কথাবার্তা। রিসর্টের লোকরাও হাঁকডাক করে কথা বলছে না। বেশ একটা নির্জনতা ছড়িয়ে আছে। পুজোর সময় মিহি হিম পড়ার কথা। কিন্তু এবার গরমের দাপটে হিমের পাত্তাই নেই।

প্রতনু বলল, ‘কুন্তল, কাল চল, জয়ন্তীটা সেরে নিই?’

কুন্তল বলল, ‘ওসব তোর ব্যাপার। আমি শুধু সবুজের মধ্যে ডুবে থাকতে চাই। যেখানে খুশি নিয়ে যা, আমার কী?’

ঝুপ ঝুপ করে অন্ধকার নামল। তার শাড়ির পাড়ে জোনাকির টিপের জরি বসানো। সবসময় কৃষ্ণপক্ষ দেখে টুর প্ল্যান করে প্রতনু। ভূত-বাতিক আছে বলে ওর অন্ধকারটাই বেশি পছন্দ। এমনকী, সেবার সুন্দরবন বেড়ানোরও দিন ঠিক করেছিল অমাবস্যার গায়ে গায়ে। কুন্তল বলল, ‘কেউ পূর্ণিমা ছাড়া সুন্দরবনে আসে না। তোর মতো আঁধার-পাগল ছাড়া!’

প্রতনু সবসময়ই খুব একটা কারও কথায় কান দেয় না। ও যা বোঝে, সেটাই ঠিক। এ নিয়ে কুন্তলও দরাদরি করে না। হঠাৎ রিসর্টের পাশের একটা লম্বা গাছ থেকে ভেসে এল, ‘কক্কক, কক্কক!’

অমনি লাফিয়ে উঠল প্রতনু, ‘ওই শুনলি তো কুন্তল, তক্ষক ডাকছে?’

কুন্তল বলল, ‘ওটা কোনো রাতপাখির ডাক বলেই তো মনে হচ্ছে ভাই।’

‘না রে না। তক্ষক ওরকম করে ডাকে। তুই চুপ করে শোন, অবিকল ‘তক্ষক, তক্ষক’ করে ডাকছে বলে মনে হবে। একদম চুপ করে থাক। কথা বলিস না!’

সত্যিই একটু পরেই ফের তক্ষক ডাকল, ‘তক্ষক, তক্ষক!’ কুন্তল বলল, ‘হ্যাঁ রে, শুনলে তো তাই মনে হচ্ছে রে! এ সেই আমাদের ‘চোখ গেল’ পাখির ডাকের মতো। ছেলেবেলায় গাছপালার আড়ালে চোখ গেল পাখি যখন ডাকত, আমরাও ‘চোখ গেল’ বলে ভ্যাঙাতাম। ঠাকুমা বলত, ‘কাউকে অমন করে ভ্যাঙাতে নেই। পাখিকেও না।’ কে শুনত কার কথা? আমরা অমন করে ডেকে চলতাম।’

প্রতনু বলল, ‘দাঁড়া, অজিতকে ডেকে আনি।’ বলেই সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নেমে গেল রিসর্টের অফিসঘরের দিকে। তারপর একটু পরে ঠিক ডেকেও আনল অজিতকে।

অজিত বলল, ‘এখানে অনেক তক্ষক আছে। কোনো কোনো কটেজের বাইরের দেওয়ালেও আছে। গাছে তো আছেই!’

প্রতনু ছেলেমানুষের মতো বায়নার গলায় বলল, ‘অজিত, তুমি আমাদের তক্ষক দেখাও আজ রাতে।’

‘দেখাতে পারব। তবে আজ যদি টের পাই ওরা আছে, তবেই না! না হলে কাল চেষ্টা করব।’

প্রতনু নাছোড় গলায় বলল, ‘না, অজিত, আজই দেখাও।’

অজিত বলল, ‘না স্যার, ও কি আর আমি দেখাব বললেই দেখাতে পারি? মাঝে মাঝে তক্ষক কিনতে লোক আসে। সেদিন ওদের পাত্তাই পাওয়া যায় না। আগে থেকে জেনে যায় বুঝি!’

কুন্তল বলল, ‘কিনে নিয়ে গিয়ে কী করে?’

অজিত ঠোঁট ওলটাল, ‘কী করে কে জানে। কেউ বলে ওষুধ বানায়, কেউ বলে যে দরকারে লাগে, বলা যাবে না। তবে এক-একটা তক্ষকের দাম এক-দেড় লাখ টাকা। বড়ো হলে দু-লাখও দেয়।’

ওদিকে অফিসের দিক থেকে অজিতের ডাক পড়তে দৌড়োল। রিসর্টের তারের বেড়ার ওপাশে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা। চুপ করে শুনলে একটা নেশা ধরিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে অনেকক্ষণ পরপর এক-একবার তক্ষকও ডাকছে।

কুন্তল বলল, ‘জায়গাটা বেশ, কী বল প্র? রোমাঞ্চের গন্ধমাখা! বক্সা টাইগার রিজার্ভ। এখানে কি বাঘ আছে?’

প্রতনু বলল, ‘আছে নিশ্চয়ই। না হলে অমন নাম কেন? তবে গভীর জঙ্গলের দিকে দু-চারটে আছে হয়তো। এদিকে তো লোকালয়। বাঘ এলে কি আর লোকালয় গড়ে উঠত?’

রাতের খাওয়া ন-টার মধ্যে দিয়ে দিল। জঙ্গলেও হসপিটালের মতো নিয়ম। সাততাড়াতাড়ি খাওয়া। খেতে খেতে অজিতকে প্রতনু বলল, ‘তুমি ভাই তক্ষক দেখাতে পারলে না।’

অজিত বেশ হাসিখুশি। বলল, ‘কাল দেখাব কথা দিলাম। কাল সকালে স্যার কোন দিকে যাবেন?’

প্রতনু বলল, ‘কাল সকালে জয়ন্তীও যেতে পারি, আবার বক্সা ফোর্টও যেতে পারি। রাতে ঘুমোই তো আগে!’

অজিত বলল, ‘বক্সা ফোর্ট যেতে গেলে লোকাল গাইড নিতে হয় স্যার। এটা বাধ্যতামূলক। আমাকে বলবেন, আমি গাইড হয়ে আপনাদের ঘুরিয়ে আনব।’

প্রতনু খুব একটা আমল দিল না অজিতের কথায়। বলল, ‘সে কাল সকালে দেখা যাবে!’

কটেজে এসে শুয়ে পড়ল ওরা। ঘুম আসেনি, তখন ওদের কটেজের পাশের সোনাঝুরি গাছ থেকে ভেসে এল তক্ষকের ডাক। অমনি তড়াক করে টর্চ নিয়ে লাফিয়ে বেরোতে গেল প্রতনু। কুন্তল বলল, ‘তুই কি পাগল হয়েছিস? এই অন্ধকারে তক্ষক দেখতে যাবি? যদি কামড়েটামড়ে দেয়?’

প্রতনু হাসল, ‘ও আমি জানি। তক্ষক কামড়ায় না। দাঁড়া, দেখি।’

মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এল প্রতনু, ‘না:, এখন আর ডাকল না। দেখতেও পেলাম না। চল ঘুমোই!’

একটু পরে ফের তক্ষক ডেকে উঠল। তক্ষকের ডাক শুনতে শুনতে ঘুমোনো এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল ওদের!

পরদিন সকালে গাছ-পাতায় ঘেরা চারদিক খোলা কটেজের মতো ডাইনিং হলে গিয়ে বসল ওরা দু-জন। ব্রেকফাস্টের টেবিলে প্রতনু ঘোষণা করল, ‘কুন্তল, চল, আজ আমরা বক্সাটা দেখে আসি!’

কুন্তল বলল, ‘বক্সা হলে বক্সা, জয়ন্তী হলে জয়ন্তী! আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে সারাদিন ধরে কি বক্সা দেখার কিছু আছে? শুনেছি তো একটা ভাঙাচোরা ইটের দেওয়াল।’

প্রতনু বলল, ‘না রে, ট্রেক করে উঠতে হবে। তাও প্রায় দু-কিলোমিটার। খাড়াই রাস্তা। গাড়ি যেটুকু যাবে, সেটুকুই। তারপর গাড়িটা ওখানে রেখে হন্টন।’

কুন্তল ঘাড় নেড়ে লুচি, আলুর তরকারিতে মন দিল। প্রতনু রিসর্ট-বয়কে বলল, ‘অজিতকে ডেকে দাও না ভাই!’

সে টুরিস্টদের পরিবেশন করতে করতে বলল, ‘এক্ষুনি আসবে।’

সত্যিই পলক না ফেলতে এসে হাজির হল অজিত। প্রতনু বলল, ‘অজিত, আজ আমরা বক্সা যাব। তুমি গাইড হবে তো? ব্রেকফাস্ট সেরেই চলো বেরিয়ে পড়ি?’

ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে ফের কোথায় উধাও হল অজিত। ততক্ষণে অভিমন্যু এসে গেছে। ছোট্ট একটা কিট ব্যাগ আর ক্যামেরা প্রতনুর কাঁধে। গাড়িতে উঠে প্রতনু বলল, ‘চলো, আজ আমরা বক্সা যাব ভাই।’

অভিমন্যু ঘাড় নেড়ে সায় দিল। ততক্ষণে অজিত ছেত্রী ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসেছে। গাড়ি চড়াই ভেঙে উঠতে লাগল। একবার অভিমন্যু পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘এত সকাল সকাল বক্সা ফোর্ট না গিয়ে স্যার, জয়ন্তীটা দেখে নিলে মনে হয় ভালো হত। দুপুরের পর ফোর্ট গেলে…’

প্রতনু বলল, ‘না না, ফোর্ট দেখতে সারাদিনই লেগে যাবে।’

অজিত চমকে প্রতনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সারাদিন? কী করবেন অতক্ষণ ওখানে?’

কুন্তলও বলল, ‘সত্যিই তো! সারাদিন ওখানে কী করব রে?’

প্রতনু জেদের গলায় বলল, ‘আগে তো যাই। তারপর ফেরার কথা ভাবলে হবে।’

একটা চেক পোস্টে গাড়ি থামল। ফোর্টে যাওয়ার টিকিট আর গাইডের টাকা ওখানে জমা দিয়ে তবে অনুমতি মিলল ফোর্টে যাওয়ার। তারপর বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি থামিয়ে দিল অভিমন্যু। বলল, ‘স্যার, আর গাড়ি যাবে না। এবার ট্রেক করতে হবে।’

কুন্তল সরু পাহাড়ি পথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্র, এ তো খুব সরু রাস্তা? ভীষণ খাড়াই।’

প্রতনু অভিমন্যুকে বলল, ‘তোমার মোবাইল নম্বরটা দাও। আমরা সন্ধ্যের আগে আগে ফিরে আসব। তেমন হলে তুমি কোথাও ঘুরে আসতে পারো। কেন এই জনমানবহীন জায়গায় বসে বসে বোর হবে? দরকার হলে তোমাকে ফোন করে ডেকে নেব।’ তারপর অজিতের দিকে তাকিয়ে প্রতনু হেসে বলল, ‘তোমারও আর গাইডগিরি করে কাজ নেই ভাই। তুমিও অভিমন্যুর সঙ্গে রিসর্টে গিয়ে তোমার অতিথিসেবা করো গিয়ে। তোমারও ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখি! আমরা একা-একাই ফোর্টে যেতে পারব। এর বিনিময়ে তুমি আজ রাতে আমাদের তক্ষক দেখিয়ে দিয়ো, তা হলেই হবে!’ বলে অজিতের ফোন নম্বরটা মোবাইলে সেভ করল। তারপর কুন্তলের দিকে তাকিয়ে প্রতনু সমর্থন চাইল, ‘কী রে কুন্তল, আমরা যেতে পারব না?’ কুন্তল বলল, ‘না পারার মতো ব্যাপার বলে তো মনে হয় না!’

ওদের ছেড়ে প্রতনু আর কুন্তল চড়াই ভাঙতে শুরু করল। পিছন থেকে অজিত চেঁচিয়ে বলল, ‘স্যার, হাঁটতে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে কিন্তু। সাবধানে যাবেন। তড়িঘড়ি করবেন না। সন্ধ্যে পর্যন্ত দেরি না করাই ভালো। তার আগে ফিরে আসবেন। আপনাদের কথা দিলাম, আজ তক্ষক দেখাবই।’

পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল অজিতের কথা। প্রতনুরা শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না। খানিক পরেই চোখের আড়াল হয়ে গেল প্রতনু আর কুন্তল। তখন অভিমন্যু অজিতকে নিয়ে ফিরে চলল নীচে। সত্যিই তো, এখানে বসে থেকে লাভ নেই!

কিছুটা উঠে খানিক বিশ্রাম নিতে পাথরের উপর বসে পড়েছে কুন্তল। এখন ওরা প্রায় হাজার তিনেক ফুট উপরে। প্রতনু বলল, ‘জানিস তো কুন্তল, ভুটানের রাজা তিব্বত-ভারত সিল্করুটকে রক্ষা করার জন্যে এখানে ফোর্টের কথা ভেবেছিলেন। পরে একসময় এখানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দি করে রাখা হত। সেলুলার জেলের পরেই কুখ্যাত বন্দিশিবির হিসেবে নাম ছিল বক্সা ফোর্টের। এখানে নেতাজিকেও বন্দি করে রাখা হয়েছিল বিনা বিচারে।’

কুন্তল বলল, ‘তা তো বুঝলাম। আর কতটা উঠতে হবে সেটা আগে বল?’

পাহাড় বেয়ে ঝরনা নেমে চলেছে এদিকে-ওদিকে। তার শব্দ কলকল করছে এই নির্জন পাহাড়ি পথে। কখনো দু-একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে। রাস্তা কখনো উঁচু, আবার কখনো বেশ নীচে নামছে। সরু চড়াই-উতরাই পথে বড়ো বড়ো পাথর ছড়ানো। পা স্লিপ করতেই পারে। প্রতনুর হাঁটার গতি কুন্তলের চেয়েও কম। কারণ, সে শুধু হাঁটছে না। কোনো একটা ফুল দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বুকে হাঁফ ধরলে তো দাঁড়াচ্ছেই। কখনো প্রকৃতিপ্রেমে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে তো থাকছেই। যেতে যেতে পথের ধারে কাঁচা হাতে লেখা একটা বোর্ড চোখে পড়ল কুন্তলের, ‘বক্সা ফোর্ট মিউজিয়াম’। নীচে তির চিহ্ন এঁকে বোঝানোর চেষ্টা—উপরের দিকে।

কুন্তল আঙুল তুলে বোর্ডটা দেখিয়ে প্রতনুকে বলল, ‘দেখেছিস, উপরে কোথাও একটা বক্সা মিউজিয়ামও আছে। লোকই নেই, তার আবার মিউজিয়াম!’

প্রতনু কুন্তলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘বা:! মনে মনে এটাই ভাবছিলাম। কোথাও পড়েছি মিউজিয়ামটার কথা। চল, উপরে গিয়ে খুঁজে দেখা যাবে।’

কখন দুপুর হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি ওরা।

আজ একজনও টুরিস্ট নেই রাস্তায়। হঠাৎ ওরা দেখল একটা বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেঞ্চ বানিয়ে তার সামনে পাতায় ছাওয়া একটা চায়ের দোকান মতো। কয়েকটা খালি বয়াম, তাতে কস্মিনকালে কিছু রাখা হয়েছিল বলে মনে হল না। একটা উনুন, তাতে শেষ কবে আগুন জ্বালা হয়েছিল কে জানে!

খুব খিদে পেয়েছে কুন্তলের। বলল, ‘প্র, খাব কোথায় রে? খিদেয় যে পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে?’

‘চল, দেখি। শুনেছিলাম, ফোর্টের কাছে নাকি একটা দোকান আছে। বললে ভাত রেঁধে দেয়।’

একটা ছোটো ব্রিজ পেরিয়ে ওরা যখন বেশ কিছুটা খাড়াই বেয়ে উপরে উঠল, তখন ওরা দেখতে পেল তিন-চারটে বাড়ি। টিনের চালা। ইটের দেওয়াল। মুরগি চরে বেড়াচ্ছে। দুটো গোরু খোঁটায় বাঁধা হয়ে আছে।

সেগুলো ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগোতে ওরা দেখতে পেল একটু দূরে একদম ফাঁকায় একটা ছোট্ট বাড়ি। তার সামনে একজন মাঝবয়সি লোক গাঁইতি দিয়ে পাথর খুঁড়ছে। প্রতনু লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ গো, এখানে দুর্গ কোথায়?’

লোকটা পাথরের মতো কালো। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পেটানো চেহারা। ডান হাতে একটা লোহার বালা। নীল রঙের ছেঁড়া বারমুডার মতো প্যান্ট পরে আছে। সে হাত তুলে দেখাল উঁচু ঢিবিটার দিকে। বলল, ‘ওই তো বক্সা দুর্গ।’

ওরা দেখল, গাছ-পাতায় ঢাকা একটা ইটের ভগ্নস্তূপ। লোকটার বাড়ির একদম কাছেই।

প্রতনু জিজ্ঞেস করল, ‘এ জায়গাটার নাম কী?’

লোকটা ফিচ করে হেসে বলল, ‘সদর বাজার।’

কুন্তল অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ওইটাই কি বক্সা দুর্গ?’

লোকটা ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ।

প্রতনু জিজ্ঞেস করল, ‘বক্সা মিউজিয়ামটা কোন দিকে?’ লোকটা আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, ‘কী বললেন বাবু?’

প্রতনু বলল, ‘এখানে ওই যে দুর্গ, ওতে তো একসময় বিপ্লবীদের ধরে এনে বন্দি করে রাখা হত। তাদের নানা জিনিসপত্র নিয়ে এখানে নাকি একটা ঘরে কোথাও রেখে দেওয়া আছে? সেই ঘরটা কোন দিকে?’

লোকটা তখনও উদাস ভঙ্গিতে প্রতনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ দেখে মনে হল, এই প্রথম সে অমন কথা শুনছে।

চড়াই ভেঙে ওঠার ফলে হাত-পা ক্লান্ত ওদের। খিদে পেয়েছে খুব। কুন্তল মোবাইল বের করে দেখল দুটো বেজেছে। মোবাইলে এখন একটাও টাওয়ার নেই।

প্রতনু লোকটাকে ফের জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কোথাও খাবার-টাবার পাওয়া যাবে? খুব খিদে পেয়েছে।’

‘না, এখানে দোকান নেই।’

লোকটা উঠে গিয়ে বাড়ির ভিতরে কারও সঙ্গে নীচু স্বরে কী যেন বলল। তারপর লোকটা বেরিয়ে এসে উঠোনে পাতা একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে বসুন।’

ওরা মন্ত্রচালিতের মতো গিয়ে বসল বেঞ্চে। একটু পরেই স্টিলের থালায় কাঁচা শালপাতা পেতে গরম ভাত, ডাল আর একটা শাকের তরকারি এনে দুটো থালা ওদের পাশে রেখে লোকটা বলল, ‘খেয়ে নিন।’

ঘরের ভিতরে যে আছে, সে-ই রান্না করেছে মনে হল। লোকটা কি ওদের সব খাবার দিয়ে দিল?

প্রতনু বলল, ‘তোমাদের সব খাবার আমাদের দিয়ে দিলে যে! তোমরা কী খাবে?’

‘খেয়ে নিন।’

কুন্তলের এত খিদে পেয়েছে, তার আর তর সইল না। সে গপগপ করে খেতে লাগল। প্রতনুও দেরি করল না। লোকটা যেমন পাথর খুঁড়ছিল, তেমনই পাথর খুঁড়েই চলল। হাত ধোয়ার জল রাখা ছিল। হাত ধুয়ে প্রতনু লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কত দিতে হবে?’

লোকটা কেমন তাচ্ছিল্যের চোখে তাকাল। হিম সে চোখের দৃষ্টি, তারপর ঘাড় নেড়ে না বলল। চোখের পাতাটা স্থির। পলক পড়ছে না।

কুন্তল বলল, ‘এক গ্লাস জল দেবেন?’

লোকটা একবার তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করে নিয়ে সোজা ঘরের দরজার কাছে গিয়ে ভিতরে হাত বাড়াল। একটা শীর্ণ হাত জল ভরতি স্টিলের গ্লাসটা ঘরের ভিতর থেকে বাড়িয়ে দিল লোকটার দিকে। লোকটা গ্লাসটা এগিয়ে দিল কুন্তলের দিকে। কুন্তল এক নিশ্বাসে জল খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিল।

একটু সময় ইতস্তত করে ওরা ফোর্টের দিকে পা বাড়াল। প্রতনু বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ!’

লোকটা প্রতনুর কথা শুনে খ্যা খ্যা করে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। গা হিম করা সে হাসি।

সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছে। ওরা একটু ঘুরে ছোট্ট একটা মাঠ পেরিয়ে বক্সা ফোর্টে পৌঁছোল। সামনে দুটো ফলক। একটা ফলকে উনিশশো একত্রিশ সালে বক্সা দুর্গের বন্দিরা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিল, সেই বন্দনাপত্রের প্রতিলিপি খোদাই করা। আর একটায়, এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা লিখে পাঠিয়েছিলেন, তারও প্রতিলিপি। প্রতনু নীচু হয়ে আবছা হয়ে-আসা ফলকের পাঠোদ্ধার করতে শুরু করে দিল। আবৃত্তি করার মতো করে বলে চলল, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের চরণ কমলে! ওগো কবি, তোমায় আমরা করি গো নমস্কার। সুদূর অতীতের যে পুণ্য প্রভাতক্ষণে তোমার আবির্ভাব, আজ বাংলার সীমান্তে নির্বাসনে বসিয়া আমরা বন্দিদল তোমার সেই জন্মক্ষণটিকে বন্দনা করি…’ এর পর প্রতনু চিৎকার করে বলল, ‘কুন্তল, এর সবটা পড়া যাবে না রে! তুই কোথায় গেলি?’

কুন্তল তখন ঢালু সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেট পেরিয়ে দুর্গের ভিতরে চলে গেছে। নীচ থেকে আবার প্রতনু আবৃত্তি করতে লাগল, ‘কুন্তল, শোন, এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথও একটা পনেরো লাইনের কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। ‘প্রত্যাভিনন্দন, বক্সা দুর্গস্থিত রাজবন্দিদের প্রতি! নিশীথেরে লজ্জা দিবে অন্ধকারে রবির বন্দন/পিঞ্জরে বিহঙ্গ বাঁধা সংগীত না মানিল বন্ধন।/ফোয়ারার রন্ধ্র হতে/উন্মুখ ঊর্ধ্ব স্রোতে…’ ধ্যাত, পড়াই যাচ্ছে না!’

প্রতনু হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দুর্গের ভিতরে চলে গেল। কুন্তল তখন ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আগাছা আর জঙ্গলে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে ইটের ভাঙা দেওয়ালগুলো। মাথায় ছাদ বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রতনু বলল, ‘অজিতকে আনলে ভালো হত রে। ও বলে দিত, কোন ঘরে নেতাজিকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।’ বলে মোবাইলটা বের করে অজিতকে ফোন করতে গেল। তারপর গলায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, ‘একটাও টাওয়ার নেই।’

অমন সময় কে যেন ওদের পিছন থেকে বলে উঠল, ‘গাইড ছাড়াই এসেছ কেন? কী বুঝবে দুর্গের?’

ওরা দু-জনেই চমকে পিছন ফিরে দেখল, সুপুরি গাছের মতো রোগা, লম্বা ঝাঁকড়া-চুলো একটা লোক। ঠিক যেন খ্যাংরা কাঠির চেয়েও ক্ষীণ চেহারা। ময়লা শতচ্ছিন্ন কাপড় হাঁটুর উপর পর্যন্ত নেমে থমকে আছে। গায়ে শতচ্ছিন্ন একটা হলুদ রঙের খদ্দরের ফতুয়া। একমুখ সাদা লম্বা দাড়ি। কালো পাথরের মতো গায়ের রং। চোখ দুটো নিস্তেজ, দৃষ্টিহীন যেন। বয়স আন্দাজ করা কঠিন। কুন্তল রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছে। প্রতনুও যে একদম ভয় পায়নি, তা বলা যাবে না। সে গলা উঁচু করে বলল, ‘তুমি কে?’

‘আমি অবিনাশ দন্ডপাট। এখানে আন্ধারের গাইড। যারা অমাবস্যায় দুর্গ দেখতে আসে, আমি তাদের ঘুরে ঘুরে সব দেখাই।’

প্রতনু বলল, ‘আমরা তোমাকে চাই না। আমাদের গাইড অজিত ছেত্রী আছে। ও একটা দরকারে নীচে গেছে। এক্ষুনি চলে আসবে।’

অবিনাশ বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘অজিত? ও দুর্গের কী চিনবে আর কী-ই বা চেনাবে? ও তো আজকের ছেলে? অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, ও আসবেই বা কী করে?’

প্রতনু বলল, ‘তবু, ওকেই তো আমরা ভাড়া দিয়ে বুক করেছি! তা ছাড়া এখন অন্ধকার নেমে আসছে। আমরা এবার ফিরব। অতটা পাথুরে পথ উতরাই ভেঙে নামতে হবে। দেখার হলে কাল এসে ফের দেখব।’

‘নামবে? দুর্গ দেখবে না?’

কুন্তল বলল, ‘এই তো তোমার দুর্গের ছিরি। এর আবার দেখা! চল রে প্র, এবার আমরা নামি চল।’

প্রতনু অবিনাশকে বলল, ‘এখানে দেখার কী আছে? তুমি মিউজিয়ামটা দেখাতে পারবে কি? তা হলে থাকব।’

‘মিউজিয়াম?’ বলে অবিনাশ দন্ডপাট হা হা করে আকাশ কাঁপিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘আমি তোমাদের এমন সব জিনিস দেখাতে পারি, যার খোঁজ পেলে ভারত সরকারও এখানে এসে হামলে পড়বে।’

উৎসাহী হয়ে প্রতনু বলল, ‘যেমন কী কী দেখাতে পারবে?’

অবিনাশ গলা কাঁপিয়ে বলল, ‘আমার বাড়ি ছিল মেদিনীপুরে। আমাকে এখানে এনে বন্দি করে রেখেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। ক-দিন পরে নেতাজিকে নিয়ে আসা হল। আমি কাছ থেকে তাঁকে আগে কোনোদিন দেখিনি। অত বড়ো বিপ্লবী! ভগবানের মতো কী তাঁর রূপ! পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম একদিন নেতাজিকে। তিনি সেল থেকে বেরিয়ে এসে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন একদিন সকাল বেলা।’ বলে অবিনাশ হাত পাঁচেক দূরে আঙুল তুলে দেখাল জায়গাটা, নেতাজি যেখানটায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

কুন্তল বিস্ময় ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি নেতাজিকে নিজের চোখে দেখেছ? বলছ কী?’

অবিনাশ হাসল মিটিমিটি করে। বলল, ‘ওই যে মাঝের সেলটা দেখছ, ওখানেই তো নেতাজিকে রাখা হয়েছিল! ওখানে বসেই তো নেতাজি…’

তারপর আরও ফিসফিসে গলায় কী যে বলল অবিনাশ, স্পষ্ট শোনা গেল না। অন্ধকার নেমে এসেছে ঘন হয়ে। জঙ্গলের গন্ধ-মাখা একটা গা হিম করা বাতাস ভেসে আসছে পাহাড়ের দিক থেকে। খিনখিনে গলায় একটা রাতপাখি ডেকে চলেছে একটানা। কুন্তল অবিনাশ দন্ডপাটের মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারল না। ভয়ে কেঁপে উঠল যেন। বলল, ‘চল প্র, এখান থেকে পালাই।’

অবিনাশ বলল, ‘চলে যাবে কেন? নিজের চোখে কখনো বিপ্লবী দেখেছ? স্বাধীনতা সংগ্রামী? তা হলে আমাকে দ্যাখো!’

বলে অবিনাশ দন্ডপাট প্রতনুদের দিকে ঝাঁ করে পিছন ফিরল। তারপর তার গায়ের খদ্দরের ময়লা ফতুয়াটা উপর দিকে তুলে ধরল। হঠাৎ মেঘ ফুঁড়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠল আকাশটাকে ফালা ফালা করে। প্রতনু আর কুন্তল সেই ক্ষণেক আলোয় দেখল, অবিনাশের গোটা পিঠ ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া চাবুকের অসংখ্য দাগ!

শাঁ করে ফের ওদের দিকে ফিরে বলল, ‘এসব ব্রিটিশ পুলিশের চাবুকের দাগ! আমি একদিন রাতে নেতাজিকে এখান থেকে পালানোর পথ করে দিতে চেয়েছিলাম। ব্রিটিশ পুলিশ কী করে যেন সব জেনে গেল। তারপর আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেনি বটে। কিন্তু প্রতিদিন তিনজন পুলিশ মিলে আমাকে একশোটা করে চাবুক মারত। এরকম চলেছিল টানা এক মাস। এগুলো তারই দাগ!’

অবিনাশের প্রতি ওদের মায়া জন্মাতে শুরু করল। প্রতনু বলল, ‘তুমি এখনও এখানে আছ কেন? আর ক-জনই বা বিপ্লবী এখন বেঁচে আছেন, যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি? তুমি প্রকাশ্যে গেলে এখনই তোমাকে নিয়ে হইচই পড়ে যাবে! তুমি এমন করে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে আছ কেন?’

‘আমি পড়ে আছি অনেক কারণে। নেতাজি আমাকে কিছু জিনিস দিয়ে গিয়েছেন। সেগুলো রেখে দিতে বলেছেন। তাঁর কথা ফেলতে পারি না। তিনি মাথার যে খদ্দরের সাদা টুপি পরতেন তার একটা, আর একটা দামি ঝরনা কলম, আর একটা গোপন চিঠি, গান্ধীজিকে লেখা। আরও কিছু জিনিস…। সেসব তোমাদের বলে কী হবে? সেসব আগলে রাখার জন্যেই তো আমি এখানে পড়ে আছি। অমাবস্যা রাতে সামান্য গাইডগিরি করি। মাসে শুধুমাত্র একটা রাত। যে যা দেয়, তাতেই আমার চলে যায়।’ একটু চুপ করে থেকে অবিনাশ বলল, ‘তোমরা বিপ্লবী কৃষ্ণপদ চক্রবর্তীর নাম শুনেছ? তিনিও এখানে বন্দি ছিলেন। যুগান্তর গোষ্ঠী আর অনুশীলন সমিতির নাম জানো?’

ওরা অন্ধকারে ঘাড় নাড়ল, না জানে না। প্রতনু বলল, ‘আমরা আজ ফিরব না বক্সা ভ্যালি রিসর্টে। তুমি কি আমাদের নেতাজির ওসব জিনিস দেখাবে?’

হঠাৎ অবিনাশ হাত কয়েক দূরে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল। তখন কুন্তল চাপা গলায় বলল, ‘তুই কি পাগল হলি প্র? এই লোকটা তোকে নেতাজির ওসব জিনিস দেখাবে? লোকটা পাগল! ওর পাল্লায় পড়ে লাভ নেই। চল, পালাই!’

প্রতনু ফিসফিসে গলায় দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘যদি যেতে হয়, তুই চলে যা কুন্তল। আমি যাব না। আমি ওর সঙ্গে থেকে ওই সব মূল্যবান লুকোনো জিনিসের সন্ধান জানব। তুই আমাকে এখান থেকে এক পাও নড়াতে পারবি না।’

মিনিট পাঁচেক পর হুসফুস করতে করতে ফিরে এল অবিনাশ। ওরা অবাক হয়ে দেখল, তার চোখের মণি দুটোর জায়গায় দুটো মিটমিট করে জোনাকি জ্বলছে।

কুন্তল চেঁচিয়ে বলল, ‘এ কী! তোমার চোখের মণি দুটো নেই?’

অবিনাশ হেসে বলল, ‘থাকবে কী করে? আমি অবাধ্য ছিলাম। আমি নেতাজির কাছ থেকে গোপন খবর নিয়ে বাইরে পাচার করার কাজ করতাম বলে সন্দেহ করে করে ব্রিটিশ পুলিশ একদিন আমাকে এই বন্দি শিবিরের প্রাচীরের বাইরে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে ফেলে দিতে চেয়েছিল। পারেনি। তারপর একদিন রাতে আমার চোখের মণি দুটো খুবলে তুলে নিল! সেই থেকে আমি মণিহারা!’ বলে খিক খিক করে হাসল খানিক। তারপর বলল, ‘তোমাদের ওইসব গোপন জিনিস দেখাতে নিয়ে যাব বলে দুটো জোনাকি ধরে মণির জায়গাটায় বসিয়ে নিয়েছি। এবার সব দেখতে পাবে। চলো!’ বলে অবিনাশ এগিয়ে গেল বেশ কিছুটা।

বনের মাথায় অনেক তারা চেয়ে আছে আকাশ থেকে। জঙ্গলের তীব্র বুনো গন্ধ এসে নাকে লাগল কুন্তলের। কুন্তল যাবে কি যাবে না ভাবছে, অবিনাশ অতটা দূর থেকে তার একটা হাত বাড়িয়ে কুন্তলের একটা হাত ধরে ফেলল খপাত করে। মানুষের হাত অত লম্বা হতে পারে? আর অমন বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা? ভাবতেই ধপাস করে পড়ে গেল কুন্তল।

প্রতনু একবার পিছন ফিরে দেখল কুন্তলকে। তারপর মনে মনে নিজেকে শক্ত করল। অমন সময় অবিনাশের আর একটা হাত ধেয়ে এসে জাপটে ধরল প্রতনুকে। হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি পচা গন্ধ ভেসে এল অবিনাশের গা থেকে। সে গন্ধে নিশ্বাস নিতে পারল না প্রতনু। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল প্রতনু। অবিনাশ দন্ডপাট দু-হাতে চেপে ধরল প্রতনুকে। তারপর হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে দুর্গের পশ্চিম দিকের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল প্রতনুকে। একটা খুব লম্বা শাল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল প্রতনুকে। ঘোর লাগা চোখে প্রতনু দেখল, এর পর অবিনাশ তার লম্বা কঙ্কালের মতো হাত দুটো দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। অনেক কষ্ট করে চোখ মেলে রাখার চেষ্টা করল প্রতনু। অবিনাশের চোখের গর্ত থেকে ছিটকে আসা মিটমিটে আলোয় প্রতনু দেখল, অবিনাশ মাটির অনেকটা নীচ থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলল একটা মাঝারি সাইজের কাঠের বাক্স। তারপর হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল বাক্সের ডালাটা। খিনখিনে গলায় অবিনাশ বলল, ‘এই তো নেতাজির সেই সাদা খদ্দরের টুপি!’

অবিনাশের কথাটা প্রতনুর কানে অস্পষ্টভাবে ভেসে এল। কিন্তু প্রতনু চোখ মেলে একটুও তাকাতে পারল না। একটা আশ্চর্য হিম অন্ধকার এসে জুড়ে বসল তার দু-চোখে।

পরের দিন অজিত ছেত্রী, অভিমন্যুরা এসে কুন্তল আর প্রতনুকে খুঁজে পেল বক্সা দুর্গের পশ্চিম দিকের জঙ্গলে।

কুন্তলের কিছুই মনে নেই। কিন্তু প্রতনুর স্থির বিশ্বাস, কেউ যদি বক্সা দুর্গ দেখতে যায়, পশ্চিমের ছোটো ছোটো পোড়ো সেলগুলোর ভগ্নাবশেষের দিকের জঙ্গলে গেলে নিশ্চয়ই অবিনাশের গায়ের সেই বিচ্ছিরি গন্ধটা আজও পাবে। কেননা, অবিনাশ দন্ডপাট যে বক্সা দুর্গের ওদিকটাতেই থাকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *