1 of 2

বকুলফুলের দিনগুলি

বকুলফুলের দিনগুলি

এক-একজনের সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেলে মনের ভেতরে এক-একরকমের ঢেউ ওঠে।

কিন্তু রত্নাদির সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছর পর আচমকা দেখা হতেই মনের ভেতরে যে-ঢেউ উথলে উঠল সেটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিল।

কারণ, এই ঢেউটা আমি বুকের অনেক গভীরে অনেক গোপনতায় ঢেকে রেখেছিলাম– ঠিক কবর দেওয়ার মতো।

কিন্তু ওকে দেখামাত্রই বুঝলাম, কবর দেওয়া হতচ্ছাড়া জিনিসটা এখনও মরেনি। দিব্যি নড়েচড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

বকুল! তুই…!

বাস স্টপে আমাকে দেখামাত্রই রত্নাদির চোখমুখ খুশিতে ভেসে গেল। চোখের পলকে ওর বয়েস পাঁচ বছর কমে গেল। বাস স্টপের অত লোকের সামনে আমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমার দুগালে দু-হাতের আঙুল ছুঁইয়ে বলল, তুই ঠিক সেই একইরকম আছিস…

সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিটের বাস স্টপে মানুষজন কিছু কম থাকে না। তাদের সবার সামনে রত্নাদির এই উচ্ছ্বাস আমাকে বিব্রত করে দিল। আলতো করে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি কেমন আছ?

প্রশ্নটা করে রত্নাদিকে দেখছিলাম।

পাঁচটা বছর শরীরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেলেও ব্যাপারটা ততটা বোঝা যায় না। রত্নাদিকে দেখতে সেই আগের মতোই সুন্দরী। ফরসা মুখে টানা-টানা চোখ। ডান গালে ছোট্ট তিল। সুঠাম শরীরে জড়ানো কালো-গোলাপি নকশার সিনথেটিক শাড়ি। কাঁধে লম্বা স্ট্র্যাপে ঝোলানো বাদামি ব্যাগ।

রত্নাদির মুখে একটা আলগা ক্লান্তির ছাপ লক্ষ করলাম। দেখে মনে হল, সারাদিন অফিসের কাজের শেষে বাড়ি ফেরার জন্যে বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমার প্রশ্নের উত্তরে রত্নাদি পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল : তুই কি বাড়ি পালটেছিস? তোকে আমি পরপর চারটে চিঠি দিয়েছিলাম…।

রত্নাদির চারটে চিঠিই আমি পেয়েছি, কিন্তু কোনও উত্তর দিইনি।

সেইজন্যেই মিথ্যে কথা বললাম, হ্যাঁ, বাড়ি পালটেছি। বছর চারেক হল কেষ্টপুরের দিকে চলে গেছি।

আগে আমি হাতিবাগানে থাকতাম। গতবছর বিয়ের পর দমদমের বাসিন্দা হয়েছি। আর রত্নাদির চিঠিগুলো আমি পেয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় তিন-চার বছর আগে হাতিবাগানের বাড়িতে।

জানিস বকুল, হস্টেলের দিনগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না…।

আমি ছোট্ট করে বললাম, হুঁ…আমারও মনে পড়ে…।

এ কথা বললাম বটে, আসলে বোধহয় দিনগুলো আমি ভুলতে চাই। এতদিন পর কয়েক মিনিটের জন্যে রত্নাদির সঙ্গে দেখা হল–সত্যি কথা বলে ওকে আমি আর কষ্ট দিতে চাই না।

রত্নাদি আমার হাত ধরে টান মারল, বলল, চল, কোথাও বসে একটু চা খাই। কোনও তাড়া শুনছি না ।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আমি রত্নাদির সঙ্গে হাঁটা দিলাম। সেই হস্টেলের দিনগুলোর মতো রত্নাদি আমাকে ধীরে-ধীরে অধিকার করে ফেলছিল। মনে হচ্ছিল, এমন কোনও কোনও সম্পর্ক আছে যেগুলো সহজে মরে না। বুকের ভেতরে ওরা শীতঘুম ঘুমিয়ে থাকে সময় এলেই আবার জেগে ওঠে।

বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সি-প্রাইভেট কারের জটলা পেরিয়ে আমরা কিড স্ট্রিটের দিকে এগোলাম। যেতে-যেতে রত্নাদি বলল, এইদিকটা একটু নিরিবিলি…।

একটা ছোট রেস্তোরাঁয় বসলাম দুজনে। রত্নাদি খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল, তুই কিন্তু ব্যাগ খুলবি না। এতদিন পর দেখা হল…আমি খাওয়াচ্ছি…।

আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না। হস্টেলের সেই দিনগুলোতেও আমি রত্নাদির ওপরে কথা বলতে পারতাম না।

রত্নাদির কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম ও আমার সিঁদুরের চিহ্ন দেখতে পায়নি।

আমি চাকরি করি ক্যামাক স্ট্রিটের একটা অফিসে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সিঁদুরের রেখা অস্পষ্ট এবং গোপন থাকলে চাকরির ক্ষেত্রে অসুবিধে কম হয়। আর পুরুষদের মেলামেশার আগ্রহও যেন বেড়ে যায়।

রত্নাদি অনেক কথা বলছিল। ওর বাড়ির কথা, মায়ের কথা, ভাইয়ের কথা। ভাইয়ের একটা চাকরির ব্যাপারে পার্ক স্ট্রিটের কোন-একটা অফিসে খোঁজখবর করতে এসেছিল রত্নাদি। নইলে অফিসপাড়ায় ওর আসাই হয় না।

নানারকম গল্প করতে করতে রত্নাদি হঠাৎই বিষণ্ণ গলায় বলল, জানিস, আমার না কিচ্ছু ভালো লাগে না। হস্টেল ছেড়ে আসার পর থেকেই চারপাশটা কেমন কঁকা-ফাঁকা লাগে। তবে আজ তোর সঙ্গে দেখা হয়ে দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে, পুরোনো দিনগুলো ফিরে এসেছে। এক চিলতে হাসল রত্নাদি। ওর হাসিটা দারুণ মিষ্টি।

কথা বলতে বলতে এক অদ্ভুত আবেগে আমার হাত চেপে ধরল রত্নাদি, নরম গলায় প্রায় ফিশফিশ করে বলল, কেমন আছিস, বোনটি? দিদিভাইকে তোর আর মনে পড়ে না?

আমার ভেতরটা কেমন যেন হয়ে গেল। রেস্তোরাঁর টেবিল-চেয়ার, শৌখিন-বাতি, নকশা কাটা দেওয়াল–সব বনবন করে ঘুরপাক খেতে শুরু করল লাটুর মতো। সেই দিশেহারা আচ্ছন্ন অবস্থাতেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি রত্নাদির হাত চেপে ধরে বলছি, তুমি কেমন আছ, দিদিভাই?

আর রত্নাদির চোখের কোণ বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। ও ফিশফিশ করে বলল, বোনটি আমার..বকুলফুল…।

বকুলফুল!

এই ম্যাজিকশব্দটা ভেতরের কী এক ঝড়ে চোখের পলকে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল বেশ কয়েক বছর পেছনে–আমার হস্টেলের দিনগুলোতে।

.

হস্টেলের কথা ভাবলেই সবার আগে আমার কাঁঠালচাপা গাছটার কথা মনে পড়ে। পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ডের মাঝে গাছ বলতে তো ওই একটাই! বাকি সব ছোটখাটো এলোমেলো সাধারণ ফুলগাছ।

সদরের বড় লোহার গেটটা পেরোলেই বাঁ-দিকে রাজকীয় অহঙ্কারে দাঁড়িয়ে কাঁঠালচাপা গাছটা। তার নীচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকটা ফুল। আমি হস্টেলে প্রথম যখন পা রাখি তখন ওই ছন্নছাড়া ফুলগুলোই আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।

তিনতলা পুরোনো হস্টেল বিল্ডিংটা দেখে আমার সেলুলার জেলের কথা মনে পড়েছিল। তাই দাদা-বউদির হাত ধরে খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। কিন্তু দাদা বুঝতে পেরেছিল হস্টেলে থেকে পড়াশোনা না করলে আমার পক্ষে পড়াশোনা করা অসম্ভব। আর বউদি চায়নি আমার লেখাপড়া হোক। হস্টেলের খরচ নিয়ে আমার সামনেই দাদাকে কম কথা শোনায়নি।

সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে মাতৃস্নেহে আপন করে নিয়েছিলেন রীণাদি আমাদের হস্টেল সুপার। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাদা-বউদিকে বলেছিলেন, কোনও চিন্তা করবেন না–আজ থেকে ও আমাদের মেয়ে।

বেশ মনে আছে। সেদিন চার-পাঁচজন মেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে ভরসা দিয়েছিল, আমার সঙ্গে গল্প করেছিল, মজার কথা বলে আমাকে হাসাতে চেষ্টা করেছিল। আমাকে ছেড়ে ওরা কোথাও যায়নি।

ওদের মধ্যে রত্নাদিও ছিল। রত্নাদি তখন সবে থার্ড ইয়ারে উঠেছে। আর আমি ফার্স্ট ইয়ারের পড়াশোনা শুরু করতে চলেছি।

কটা দিন পেরোতে না পেরোতেই আমার মনটা শান্ত হয়ে এল। আর তখনই সুটকেস থেকে ইনল্যান্ড লেটার বের করে দাদাকে আর মা-কে চিঠি লিখতে বসলাম। দাদা কলকাতায় থাকে, কিন্তু মা থাকে সুলুপে দেশের বাড়িতে। সেখানে রোজই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মায়ের কান্নাকাটিতেই দাদা আমাকে কলকাতায় পড়াতে নিয়ে এসেছে।

আমি একমনে ডেস্কে বসে চিঠি লিখছি, হঠাৎই পেছন থেকে পারফিউমের গন্ধ পেলাম। ঘুরে তাকাতেই দেখি ফার্স্ট ইয়ারের নন্দনা।

নন্দনা সবসময় খুব সেজে থাকে, দামি-দামি শাড়ি পরে, পায়ে রুপোর তৈরি ভারী নূপুর, আর ওর পারফিউমের খুব শখ। ও যখন হাঁটে তখন ছমছম করে মিষ্টি শব্দ হয়। শুনেছি ও নাকি শ্রীরামপুরের রাজপরিবারের মেয়ে। ভীষণ বড়লোক।

আমি চিঠি লেখায় এতই মগ্ন ছিলাম যে ওর নূপুরের শব্দ পাইনি।

কী, লাভারকে চিঠি লিখছ? নন্দনা প্রশ্ন করল।

নন্দনার কথাবার্তাই এইরকম। যা মনে হয় ফস করে তাই বলে দেয়। তাই অন্য বন্ধুরা ওকে সাবধান করে? হুটহাট করে যা খুশি তাই বলিস না। সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ারের দিদিরা কোনদিন খেপে গিয়ে একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে দেবে।

নন্দনা তাতে ঠোঁট উলটে জবাব দিয়েছিল, কী করব বল, অভ্যেস হয়ে গেছে। দিদিরা কী করবে না করবে ওসব আমি কেয়ার করি না।

তাতে আমার রুমমেট ঝরনা চাপা গলায় বলেছিল, কেয়ার করবে কেন? ওর সঙ্গে তো শুক্লাদির দিদিভাই-বোনটি আছে।

তার মানে? খানিক অবাক হয়ে ঝরনাকে প্রশ্ন করেছিলাম আমি।

ঝরনা চোখ মটকে বলেছিল, এখন না–পরে বলব। তারপর একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, আমাকে তো ভগবান ওর মতো রূপ দেয়নি, তাই আমাকে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়েই থাকবে হবে।

সত্যিই নন্দনাকে এত সুন্দর দেখতে যে, আমরা অনেকেই হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঈশ্বর প্রচুর অবসর নিয়ে ওকে গড়ে তুলেছেন।

নন্দনার কথায় আমি ছোট্ট করে বললাম, দাদাকে আর মা-কে চিঠি লিখছি। আমার চিঠি পেলে মা চিন্তা করবে।

তোমার লাভার নেই?

একটু অস্বস্তি পেয়ে বললাম, আছে। তবে ওকে চিঠি দেওয়া একটু অসুবিধে…

নন্দনা হাসল। সামনের তক্তপোশের এক কোণে বসে পড়ল। পায়ের ওপর পা তুলে কিছুক্ষণ পা নাচাল। নূপুরের ছমছম শব্দ হতে লাগল। তারপর একসময় বলল, আমাকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের ডিটেইল্সটা দিয়ো, আমি চিঠি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

এর মধ্যেই জেনেছি, হস্টেল সুপার রীণাদি খুব কড়া ধাতের মানুষ–নিয়মকানুনের এদিক ওদিক মোটেই বরদাস্ত করেন না। সেইজন্যেই বোধহয় নন্দনার কথায় আমার মুখে একটু অবাক ভাব ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে নন্দনা চোখ মটকে মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে বলল, রীণাদি কিচ্ছুটি টের পাবে না। ওকে ম্যানেজ করে তোমার লাভারের চিঠি কুরিয়ার সার্ভিসে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। একদম নো চিন্তা…।

নন্দনা একটু পরেই হিন্দি সিনেমার গান গুনগুন করতে করতে উঠে চলে গেল।

আমি চিঠি লেখা শুরু করলাম আবার। তখনও জানি না, সে-রাতে আমাকে নিয়ে থার্ড ইয়ারের দিদিরা কী কাণ্ড করবে।

মাঝরাতে হঠাৎই আমার ঘুম ভেঙে গেল।

দেখি ঘরে আলো জ্বলছে। আর মশারিটা কারা যেন খুলে দিয়েছে। মশার কামড়ে হাতে পায়ে চাকা-চাকা হয়ে ফুলে গেছে।

আমি জেগে উঠতেই রিনরিনে হাসির হুল্লোড় উঠল। চোখ পিটপিট করে দেখলাম, সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ারের ছ-সাতজন দিদি আমার বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সঙ্গে তখনও আমার তেমন করে পরিচয় হয়নি। ওদের মধ্যে রত্নাদিও ছিল।

আমাদের রুমে আমরা ছজন ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে থাকি। ওদেরই মধ্যে কেউ বোধহয় ঘরের দরজা খুলে দিয়েছে। সেটা থার্ড ইয়ারের দিদিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেও হতে পারে, অথবা ভয়েও হতে পারে।

আমি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। খেয়াল করে দেখি, ওরা পাশের ঘর থেকে হস্টেলে নতুন-আসা আর-একজন মেয়েকেও ধরে নিয়ে এসেছে। শুনেছি ওর নাম শর্মিলা–নন্দনা ওর রুমমেট।

আমাকে আর শর্মিলাকে নিয়ে এরপর যা শুরু হল, পরিভাষায় তার নাম র‍্যাগিং।

ঘরের দরজা বন্ধ করে দুটি হরিণশিশুকে ঘিরে ধরে চলল চিতাবাঘের দঙ্গলের ছেলেখেলা। তবে সব কথাবার্তাই বেশ চাপা গলায় হচ্ছিল, যেন রীণাদি শুনতে না পয়ে। অবশ্য রীণাদি মোটাসোটা গোলগাল মানুষ–ঘুমোনো তাঁর নেশার মতন। তার ওপর তার ঘর তিনতলায়–একেবারে কোণের দিকে।

প্রথমে আমাকে আদেশ করা হল ক্যাবারে নাচ নাচার জন্যে। আর শর্মিলাকে সাজতে হল ক্যাবারে নাচের মাতাল দর্শক। সেইসঙ্গে চলল আমাদের দুজনের নাইটি ধরে দিদিদের টানাটানি।

খুশিতে আর মজায় কেউ-কেউ একেবারে গড়িয়ে পড়ছিল। আর দু-একজন লালসায় টগবগ করে ওঠা দর্শকের মতো আমার শরীরের নানা জায়গায় ছোবল মারছিল।

নাচের পালা শেষ হলে দিদিরা আমাকে আর শর্মিলাকে ঝগড়ার অভিনয়ের নির্দেশ দিল। তাও আবার যে সে ঝগড়া নয়, ফিশফিশে চাপা গলায় ননদ-ভাজের ঝগড়া।

এসব আজগুবি অভিনয় করতে করতে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল, চোখ জ্বালা করছিল। শর্মিলার অবস্থা তো আরও করুণ! কিন্তু উপায় কী!

ঝগড়ার অভিনয়ের পর মুখ ভ্যাংচানোর কম্পিটিশান, খারাপ মেয়েদের মতো কদর্য অঙ্গভঙ্গি, গর্ভবতী বউয়ের হাঁটাচলার ঢং আরও কত কী যে করতে হয়েছিল!

আর সবার শেষে এল চুমু খাওয়ার পালা। আমাকে আর শর্মিলাকে পছন্দ করবে থার্ড ইয়ারের দুই দিদি। ওদের লাভার মনে করে আমাদের আবেগজর্জর চুমু খেতে হবে ওদের ঠোঁটে।

শর্মিলা গাঁয়ের সরল সাদাসিধে রোগাসোগা মেয়ে। বেচারি তো একেবারে কেঁদেই ফেলল।

ওকে কে পছন্দ করবে তাই নিয়ে দিদিদের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত একটু পুরুষালি চেহারার তন্দ্রাদি শর্মিলার কাছে এগিয়ে গেল। এত জোড়া চোখের সামনে ঘটে গেল সেই বিচিত্র ঘটনা। সবাই হেসে আকুল হয়ে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। শর্মিলা একেবারে মুখ ঢেকে বসে পড়ল মেঝেতে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

তারপরই আমার পালা।

রত্নাদি আমাকে পছন্দ করে নিজে থেকেই সামনে এগিয়ে এল। আমি আড়ষ্টভাবে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, ওর সুন্দর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম।

আমার ভেতর থেকে একটা বিতৃষ্ণা উথলে উঠছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি রত্নাদির চাপা আবেগ টের পেয়েছিলাম। ওর সুন্দর ফরসা মুখে লালচে আভা খেলে গিয়েছিল।

আমি সরে আসতেই রত্নাদি বলেছিল, তোর ঠোঁট দুটো কী মিষ্টি রে!

 সঙ্গে-সঙ্গে সকলের খিলখিল হাসি।

এমন সময় একটা মেয়ে দরজার কাছ থেকে আচমকা উঁকি দিল ঘরে। বলল, অ্যাই, সুপার আসছে।

ব্যস! চোখের পলকে ঘর ফাঁকা। শুধু যাওয়ার আগে তন্দ্রাদি শাসনের ভঙ্গিতে বলে গেল, আলো নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়। সুপারের কাছে মুখ খুললে খোঁতা মুখ ভেঁতা করে দেব।

কে যেন ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। আর-একজন দরজাটা বন্ধ করে দিল। কতকগুলো চঞ্চল পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল করিডর আর সিঁড়িতে।

বুঝলাম, দিদিরা সুপারের ঘুমের নেশার ওপরে ঠিক ভরসা করতে পারেনি। তাই ঠিকঠাক জায়গায় গুপ্তচর মোতায়েন করে এসেছিল।

অন্ধকারে এক বিছানায় শুয়ে আমি আর শর্মিলা সে-রাতটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল, আর হস্টেলটাকে বন্দিনিবাস বলে মনে হচ্ছিল।

কিন্তু তারই মধ্যে রত্নাদির উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁওয়া আমি টের পাচ্ছিলাম। আর সেইসঙ্গে তোর ঠোঁট দুটো কী মিষ্টি রে! কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম বারবার।

রতীন একবার আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে এইরকম কথা বলেছিল। নন্দনার ভাষায় রতীন আমার লাভার।

কিন্তু-রতীন আর রত্নাদি তো এক নয়!

দুটো-একটা মুহূর্তের জন্যেও কি এক নয়?

*

রোববার দিনটা রীণাদি কোথায় যেন চলে যান।

সেই সাতসকালে বেরোন, আর ফিরে আসেন রাত আটটা নাগাদ। ফলে রোববার দিনটা আমাদের বেশ স্বাধীনভাবে হইহুল্লোড় করে কাটে। যে যার খুশি মতো গান করি, কবিতা বলি, নিজেদের মধ্যে খারাপ কথা চালাচালি করি, এমনকী পোশাক-আশাকেও একটু বেপরোয়া হয়ে যায় কেউ কেউ।

রীণাদি চলে গেলে ওঁর ঘরের দখল থার্ড ইয়ারের দিদিদের দিয়ে যান। ওঁর ঘরে মিউজিক সিস্টেম আর কালার টিভি আছে। সেগুলো চালিয়ে একটু আমোদ করলে উনি কিছু মনে করেন না।

রীণাদি বিয়ে করেননি কিংবা ডিভোর্সি। অন্তত শুন্য সিঁথি সেই কথাই বলে। কেউ-কেউ বলে, ওঁর কোনও ভালোবাসার লোক আছে–সে আবার নাকি বিবাহিত। আবার কেউ বলে রীণাদি একটু অদ্ভুত ধরনের, পুরুষদের পছন্দ করেন না। ছোটবেলায় নাকি কী একটা হয়েছিল। থার্ড ইয়ারের মৌসুমীদি নানান আত্মীয়ের ডালপালা মারফত ব্যাপারটা আবছাভাবে শুনেছে।

রীণাদির ঘরে বসে আমরা চার-পাঁচজন টিভি দেখছিলাম। তার মধ্যে শর্মিলাও ছিল। সেই রাতের পর থেকে ও আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। আমার সঙ্গে বাড়ির নানা গল্প করে, মনের সুখ-দুঃখের কথা বলে।

সিরিয়াল দেখতে-দেখতে কী একটা মজার ব্যাপার দেখে আমরা হেসে উঠেছি, এমন সময় ঘরে রত্নাদি এসে হাজির।

এখন সবে সকাল নটা, কিন্তু এর মধ্যেই রত্নাদির স্নান শেষ। শ্যাম্পু করা চুল এখনও ভিজে। জানলা দিয়ে রোদের আভা মুখে এসে পড়েছে। মুখটা কী সুন্দর টলটলে দেখাচ্ছে।

ঘরে ঢুকেই রত্নাদি আমাকে ডাকল, অ্যাই বকুল, শোন।

আমি বাধ্য শান্তশিষ্ট বোনের মতো টিভি দেখা ছেড়ে রত্নাদির কাছে গেলাম। অন্য দু-একজন আড়চোখে আমার দিকে তাকাল।

রত্নাদি স্নেহের গলায় বলল, নটা বেজে গেল, এখনও ব্রেকফাস্ট খাসনি, এই করলে শরীর থাকবে! শিগগির নীচে যা, মঙ্গলামাসি গজগজ করছে।

আমি বললাম, শর্মিলাও খায়নি।

রত্নাদি শর্মিলাকে একবার দেখে নিয়েই আমাকে বলল, যা, ওকে নিয়ে খেতে চলে যা।

শর্মিলা উঠে এল আমার কাছে। আমরা দুজনে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছি, রত্নাদি পেছন থেকে ডাকল : বকুল।

আমি ঘুরে তাকালাম রত্নাদির দিকে।

 দুপুরে একবার আমার রুমে আসিস তো, দরকার আছে।

আচ্ছা।

আমি আর শর্মিলা নীচে নামছি, হঠাৎই গ্রাম থেকে আসা সরল সাদাসিধে মেয়েটা মন্তব্য করল, রত্নাদি তোমাকে খুব লাইক করে।

হু সংক্ষেপে বললাম আমি।

ব্যাপারটা আমি যে লক্ষ করিনি তা নয়। এ নিয়ে আমার রুমের কৃষ্ণা আর সোনালিও আমাকে দু-চারবার খেপিয়েছে। তা ছাড়া সেই রাতের র‍্যাগিং-এর পর রত্নাদি একা সন্ধেবেলা আমাকে দোতলার বারান্দায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, বকুল, ওই ব্যাপারটায় কিছু মাইন্ড করিস না, হস্টেলে নতুন কেউ এলে তার সঙ্গে ওরকম একটু মজা করা হয়। তুই ওসব ভুলে যাস।

রত্নাদির বলার মধ্যে এক অদ্ভুত নম্রতা ছিল। সন্ধের আঁধারে কঁঠালাপ ফুলের গন্ধ মাখা বাতাসে আমি সেই নম্রতার ছোঁয়া পেয়েছিলাম।

এইসব ভাবতে-ভাবতেই একতলার ডাইনিং হলে এসে হাজির হলাম। সেখানে দুটো বড় বড় টেবিলে আট-দশজন মেয়ে বসে আছে, নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা-গল্প করছে।

নন্দনা আর শুক্লাদি পাশাপাশি বসেছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই নন্দনা চেঁচিয়ে বলল, শুক্লাদি, বকুলকে জিগ্যেস করে দ্যাখো–ওর তো বাংলায় অনার্স, ও বাংলায় আমাদের চেয়ে অনেক স্ট্রং।

এতে সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ারের তিন-চারজন দিদি একেবারে হইহই করে ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস! বলে উঠল।

শুক্লাদি তখন হেসে আমাকে জিগ্যেস করল, বল তো, আমাদের দারোয়ান দুজনের নামের সন্ধিবিচ্ছেদ কী হবে?

আমাদের হস্টেলে দুজন দারোয়ান : একজনের নাম সত্যেন্দ্র, আর-একজনের নাম বালেশ্বর। একজনের দেশ বিহার, আর একজনের উড়িষ্যা।

আমি বললাম, সত্য প্লাস ইন্দ্র সত্যেন্দ্র।

আর পরেরটা?

আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, জানি না।

একদফা হাসির রোল উঠল ডাইনিং হলে।

তখন সেকেন্ড ইয়ারের অস্মিতাদি জিগ্যেস করল, সন্ধি না জানিস, সমাস আর ব্যাসবাক্য পারবি?

আমি বিরক্ত হয়ে জবাব দিলাম, না, পারব না। তোমরা বরং কে. সি.-কে জিগ্যেস করে নিয়ো–।

কে. সি. আমাদের বাংলা অনার্সের ক্লাস নেন। খুব ভালো পড়ান।

এক পশলা হইচই আর হাসির মধ্যে শুনতে পেলাম কে যেন বলল, আর কিছু বলিস না মাইরি, বকুল খচে ফায়ার হয়ে গেছে।

আমি আর শর্মিলা ব্রেকফাস্ট নিতে কিচেনের দিকে গেলাম। সেখানে দুপুরের রান্নাবান্না নিয়ে হস্টেলের দুই কাজের মাসি সারদামাসি আর মঙ্গলামাসি–এলাহি হিমশিম খাচ্ছে। থার্ড ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ারের তিনজন দিদি ওদের সাহায্য করছে।

সোনালি ওর খাওয়া শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আমার পিঠে একটা টোকা মেরে গেল। বলল, বকুল, তোর কেয়ো কার্পিনটা আজ একটু নেব, আমারটা ফুরিয়ে গেছে

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লাম।

খাবারের প্লেট নিয়ে টেবিলে এসে যখন বসছি, দেখি নন্দনা আর শুক্লাদি রীতিমতন জড়াজড়ি করে ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে গেল। নন্দনার পা ফেলার তালে-তালে ছমছম করে শব্দ হচ্ছিল। আর শুক্লাদি আদরের হাতে নন্দনার কপালে-চলে-আসা চুলের গুছি ঠিকঠাক করে দিচ্ছিল।

ওদের চলে যাওয়া দেখতে-দেখতে সেকেন্ড ইয়ারের জয়শ্রীদি চাপা গলায় বলল, দিদিভাই বোনটিকে তোমরা যেন ওপরে গিয়ে আর ডিসটার্ব কোরো না। এখন ওদের ইয়ের সময়।

ওর বলার ঢঙে আশপাশের কয়েকজন চাপা গলায় হেসে উঠল।

.

ঝরনার কাছ থেকে দিদিভাই-বোনটি-র ব্যাপার পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই আমি সেই রহস্যের মাঝে গিয়ে পড়লাম। তারপর সাগরের ঘূর্ণি যেভাবে খুশি মরজিমতন নিয়ে যায়, আমিও উথালপাতাল ভেসে গেলাম।

সেদিন দুপুরে রত্নাদির কাছে আমি গিয়েছিলাম।

রত্নাদি আমাকে বিশেষ কোনও দরকারে ডাকেনি। তিনতলার ঘরে একটা জানলার ধারে বসে আমার সঙ্গে নানা গল্প করতে লাগল। আমার বাড়ির কথা জিগ্যেস করল, পড়াশোনা নিয়ে কিছু পরামর্শ দিল, কলেজের প্রফেসারদের কারও কারও সম্পর্কে সতর্ক করে দিল। এ ছাড়া আরও অনেক এলোমেলো কথা বলল।

কথা বলার সময় রত্নাদি আমার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছিল, শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিচ্ছিল, আর কখনও বা আমার কানের ইমিটেশান দুল কিংবা গলার হারের ডিজাইন হাতে ধরে পরখ করছিল।

প্রথম-প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও পরে ব্যাপারটা আমি স্নেহ বলে ধরে নিয়েছিলাম। বাড়ির আপনজনদের ছেড়ে আসার পর এখানে যদি কেউ এতটুকুও আপন করে নেয় সেটা কিছু কম পাওয়া নয়।

সেদিন সন্ধের মুখে আমি রত্নাদির কাছ থেকে চলে এসেছিলাম। বলেছিলাম, কিছু নোটস তৈরি করার আছে।

রত্নাদি মিষ্টি করে বলেছিল, পরে আবার আসিস। আর কোনও অসুবিধে হলে আমাকে বলবি কিন্তু।

এরপর ক্লাস নোট আর পড়াশোনায় বেশ কদিন নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। তবে তারই মধ্যে কিছু উটকো ঝাট লেগে থাকত। যেমন জয়শ্রীদির ময়েশ্চারাইজারের কৌটো কোথায় উধাও হয়ে গেল সে নিয়ে হইচই। শর্মিলার একটা সালোয়ার দিয়ে কে যেন পেনের কালি মুছেছে। নন্দনার ব্যাগ থেকে একশো টাকা চুরি গেল একদিন। সে নিয়ে মাসিদের সঙ্গে নন্দনার প্রায় বচসা লেগে গেল।

মাসিরা সকাল-সন্ধে আমাদের ঘর ঝাড়পোছ করে। আমাদের বেশিরভাগের সঙ্গেই ওদের বেশ ভালো সম্পর্ক। ওরা আমাদের অনেক অন্তরঙ্গ কথা শোনে, অন্তরঙ্গ অনেক কিছু দ্যাখে। তাই ওদেরকে বকশিশও দেয় কেউ-কেউ। নন্দনাও দেয়। কিন্তু একশো টাকা চুরি যাওয়াতে নন্দনা খেপে গিয়ে রীণাদিকে ব্যাপারটা জানাল। রীণাদিও ওর ঘরের সব মেয়েকে ডেকে বেশ কড়া ভাষায় বকে দিলেন। সারদামাসি আর মঙ্গলমাসিকেও শাসাতে ছাড়লেন না।

এই ঘটনার ঠিক পরেই একদিন সোনালি বলল, দুপুরবেলা বালেশ্বর নাকি একতলার বাথরুমের ঘষা কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল। থার্ড ইয়ারের দিদিরা ব্যাপারটা শুনে বালেশ্বরকে আড়ালে চেপে ধরল। তারপর সুপারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাঝবয়েসি লোকটাকে একতলার সিঁড়ির পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কান ধরে দশবার ওঠবোস করাল। মাসিরা ব্যাপারটা শুনে যে-ভাষায় বালেশ্বরকে গালিগালাজ করল আগমার্কা রকবাজ ছেলেও সে-ভাষা শুনে লজ্জা পাবে।

এইভাবে একটা সপ্তাহ ঘুরতেই রোববার সকালবেলা চলে এল আবার।

ঝরনার বাড়ি থেকে কাকা এসেছে দেখা করতে। ও তাড়াতাড়ি ড্রেস করে নিচ্ছিল। ব্রা টা কোনওরকমে পরে ও আমার কাছে এসে পেছন ঘুরে দাঁড়াল। বলল, হুকটা লাগিয়ে দে তো!

আমি সোমবারের ক্লাসের জন্যে দরকারি কয়েকটা নোট গুছিয়ে রাখছিলাম। সেটা ছেড়ে ঝরনার ফরসা পিঠে চোখ রাখলাম। তারপর হুকটা লাগিয়ে দিলাম।

ঝরনা রোজ অলিভ অয়েল মাখে, তাই ওর ত্বক খুব মসৃণ। ওর সুন্দর পিঠের দিয়ে তাকিয়ে আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তোর স্কিনটা খুব মোলায়েম।

ঝরনা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ব্রা-র কাপ দুটো ঠিকমতো সেট করতে করতে বলল, তোর আবার এত মোলায়েম ব্যাপারের দিকে নজর কেন রে! তোরটা কি কিছু কম মোলায়েম!

না, তা না– আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম।

ঝরনা ফিক করে হেসে বলল, দাঁড়া আজ রাতে মেপে দেখব কারটা বেশি মোলায়েম

একথায় আর-এক রুম মেট কাকলি ওর পড়া থামিয়ে বলল, উঁহু, আজ রাতে বকুলেরটা মাপবে রত্নাদি।

আমি অবাক হয়ে কাকলির দিকে তাকালাম। এর মানে!

আমার প্রশ্নময় দৃষ্টির উত্তরে কাকলি বলল, আর সিক্রেট রেখে লাভ নেই, কী বলিস, ঝরনা?

ঝরনা শুধু খিলখিল করে হাসল, তারপর কামিজটা পরে নিল অভ্যস্ত ভঙ্গিতে।

কাকলি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, আজ রাতে তোমাকে আর রত্নাদিকে ঝোলানো হবে–

ঘরে আমি, কাকলি, আর ঝরনা। আর সবাই এদিক-ওদিক কোথাও গেছে। আমি কাকলির কথায় আরও অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, আমাকে আর রত্নাদিকে ঝোলানো হবে মানে?

ঝরনা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে-যেতে বলে গেল, কাকলি, তুই বকুলকে যা বলার বলে দে, আমি চললাম।

কাকলি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবদারের সুরে পালটা প্রশ্ন করল আমাকে, আগে বল, রত্নাদিকে তোর কেমন লাগে?

আমি কয়েক লহমা ভেবে ইতস্তত করে জবাব দিলাম, ভালোই।

রত্নাদির সঙ্গে কথাবার্তা মেলামেশার মুহূর্তগুলো মনে পড়ছিল আমার।

কাকলি তখন বলল, তোকে রত্নাদির ভীষণ পছন্দ। হস্টেলের সবাই এটা জানে। তাই তোদের দুজনের মধ্যে দিদিভাই-বোনটি পাতিয়ে দেওয়া হবে। আজ সন্ধেবেলা সেই ফাংশান–সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়ে গেছে।

কাকলির কথায় আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। এ কোন নতুন র‍্যাগিং শুরু করল থার্ড ইয়ারের দিদিরা। আমার আর রত্নাদির সম্পর্কের মধ্যে নতুন কোন মাত্রা যোগ করবে আজ সন্ধের ফাংশান?

সারাদিন আমি আর ঘর ছেড়ে বেরোলাম না। নানা কথা ঘুরপাক খেতে লাগল মনের ভেতরে।

বিকেলে দাদা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। দাদাকে দেখে যতটা খুশি হওয়ার কথা ততটা খুশি হতে পারলাম না। দাদা চলে গেলে পর হস্টেলের ভেতর দিকের মাঠে চলে গেলাম।

আমাদের হস্টেল বিল্ডিংটা ইংরেজি ইউ অক্ষরের ধাঁচের। তারই অন্দরের কোলে ছোট মাপের একটা সবুজ মাঠ আছে। তার চারদিকে নানান ফুলগাছ। আমরা চাঁদা তুলে ফুলগাছ কিনি। ফুলের পরিচর‍্যা করি। সত্যেন্দ্র এই কাজে আমাদের সাহায্য করে। আমাদের ফাইফরমাশের জিনিসপত্র আনার ব্যাপারে ও আর বালেশ্বরই আমাদের ভরসা।

সন্ধে সামান্য গাঢ় হতেই আমি মাঠের কিনারে একটা করবী গাছের গোড়ায় চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লাম। তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও নন্দনা আর শুক্লাদির কথা ভাবতে লাগলাম। ওদের নিয়ে বেশ কিছু মজা আমার কানে এসেছে। সেগুলো সব সত্যি বলে বিশ্বাস করতে মন চায় না। তবে তার মধ্যে কমবেশি রোমাঞ্চও আছে।

শুনেছি, নন্দনা নাকি প্রায়ই রাতে ওর বিছানায় থাকে না–তিনতলায় শুক্লাদির কাছে গিয়ে শোয়। সকালবেলা ঘর ঝাট দিতে গিয়ে সারদামাসি ওদের বহুবার বেআব্রু অবস্থায় দেখেছে–তবে সুপারকে কিছু বলেনি।

এও শুনেছি, থার্ড ইয়ারের ঈশিতাদি একদিন ভীষণ তাড়াহুড়োর সময় স্নান করতে গিয়ে বাথরুম বন্ধ দেখে হইচই শুরু করে দিয়েছিল। কারণ, একটা বাথরুম নাকি আধঘণ্টা ধরে বন্ধ শুক্লাদি আর নন্দনা একসঙ্গে স্নান করছে। পাশের বাথরুমে মেয়েরা তখন সবে ঢুকে দরজা দিয়েছে। তাদের চেঁচামেচি, ঈশিতাদির রাগী মন্তব্য ইত্যাদির মাঝে শুক্লাদি নাকি দরজা খুলে ঈশিতাদিকে ডেকে নিয়েছে। বলেছে, আমাদের দেরি হবে–তুই বরং আয়, চট করে চান করে চলে যা–।

ঈশিতাদি সেই বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সেটুকু সময়ে ও দিদিভাই আর বোনটি-কে যে অবস্থায় দেখেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ থার্ড ইয়ারের দিদিদের কাছ থেকে চোরাপথে চুঁইয়ে ফার্স্ট ইয়ারের আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। এবং সেটুকু খবরই আমাদের গাল এবং কান লাল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

কিন্তু তার সঙ্গে-সঙ্গে কৌতূহলও কি মনের মধ্যে উঁকি মারেনি? সাধ হয়নি অ্যাডভেঞ্চারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার? ঝরনার ভাষায় সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন থেকে ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন হতে কি ইচ্ছে করেনি?

আমাদের অনেকের মনেই বোধহয় এই গোপন ইচ্ছে উঁকিঝুঁকি মারে। তা নইলে নন্দনাকে সকলে এত হিংসে করে কেন?

মাঠে হাওয়া খেলছিল, গাছের পাতা উথালপাতাল করছিল। আর রান্নাঘরের দিক থেকে ফোড়নের ঝাঁঝ ভেসে আসছিল। একইসঙ্গে শুনতে পাচ্ছিলাম মাসিদের কথাবার্তার টুকরো, টেপরেকর্ডারে বাজানো গানের কলি।

হঠাৎই তন্দ্রাদি, কাকলি আর সোনালি আমাকে ডাকতে এল।

কী রে, তুই এখানে বসে আছিস! তন্দ্রাদি হেসে বলল, চল, চল সাড়ে ছটা বাজে। আর দেরি করলে সুপার এসে পড়বে। ওপরে সবাই রেডি হয়ে বসে আছে।

একটা দোলাচল নিয়ে উঠে পড়লাম।

হাসাহাসি করতে করতে ওরা আমাকে টেনে নিয়ে গেল তিনতলায় রত্নাদিদের ঘরে।

সেখানে গিয়ে দেখি রত্নাদির বিছানায় রজনীগন্ধা আর জুই ফুল ছড়ানো। ঘরের একপাশে ধূপকাঠি জ্বলছে। রত্নাদি কপালে চন্দনের টিপ পরে খোঁপায় ফুলের মালা লাগিয়ে বিছানায় একপাশে বসে আছে। আর বিছানা ঘিরে যথারীতি মেয়ের দঙ্গল।

আমাকে সাজাতে এগিয়ে এল সেকেন্ড ইয়ারের চন্দ্রা আর সুদক্ষিণা।

এক অদ্ভূত ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম আমি।

সাজগোজের পর আমাকে বসিয়ে দেওয়া হল বিছানায় রত্নাদির মুখোমুখি। তারপর রজনীগন্ধার দুটো গোড়ে মালা ধরিয়ে দেওয়া হল দুজনের হাতে।

তারপর?

তারপর যা ভবিতব্য তা-ই হল। সকলের হাসি-ঠাট্টা উলুধ্বনির মধ্যে মালাবদল। রত্নাদি আমাকে বোনটি বলে ডাকল। উত্তরে আমাকে দিদিভাই বলে ডাকতে হল।

তারপর সবার শেষে, শুক্লাদি জানাল, পরস্পরকে চুমু খাওয়ার পালা।

র‍্যাগিং-এর দিনের ব্যাপারটা একরকম ছিল…আর আজ…অন্যরকম।

 আমি কেমন যেন সঙ্কোচহীন হয়ে গেলাম। বেশ সপ্রতিভভাবেই চুমু খেলাম রত্নাদির ঠোঁটে।

সঙ্গে-সঙ্গে হইহুল্লোড় নাচ-গানের ঝড় উঠল। সেইসঙ্গে কত রসালো মন্তব্য।

ঝড় থামলে শুরু হল মিষ্টিমুখ।

 সবাই মিষ্টি খেল। আমি রত্নাদিকে মিষ্টি খাইয়ে দিলাম, আর রত্নাদি আমাকে।

 এইভাবে শেষ হল আমাদের ঝোলানো-র অনুষ্ঠান।

সে-রাতে, বলাবাহুল্য, রত্নাদির বিছানায় রত্নাদির সঙ্গে আমাকে শুতে হয়েছিল। ফুলশয্যার রাতের অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম।

গোটা ঘরটা আমাদের ছেড়ে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিয়ে অন্য মেয়েরা চলে গেল। রত্নাদি বেশ স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দরজায় খিল তুলে দিল।

আমাদের আজ রাতে খাওয়া বারণ কারণ এটাই নাকি নিয়ম। চলে যাওয়ার আগে তন্দ্রাদি হেসে বলে গেছে, আজ তোদের ডাইনিং হলে খাওয়া বারণ। যা খাওয়া-খাওয়ি সব তোদের ওই বিছানায় সারতে হবে।

অন্ধকারের মধ্যে আমরা ঘন হয়েছিলাম।

আমি কাঠ হয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকলেও রত্নাদি চঞ্চল হয়ে পড়ছিল। বারবার বোনটি, বোনটি– বলে চুমুতে-চুমুতে আমাকে ভরিয়ে দিচ্ছিল। আর ওর হাত অবাধ্যভাবে যততত্র আমাকে আদর করছিল।

প্রথম দিকে রত্নাদির আদরের মধ্যে স্নেহের ভাব থাকলেও একটু পরেই সেটা পালটে গেল। ওর স্নেহের পোশাক ছেড়ে ভালোবাসা যেন আলতো করে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর ক্রমেই তা বেপরোয়া প্রগলভ হয়ে উঠল। বহুদিন ধরে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা নদীর জল বাঁধ ভাঙার পর যেভাবে পাগলপারা ছুটে যায়, রত্নাদির অবস্থাও যেন হল অনেকটা তাই।

বকুল বকুল–বোনটি আমার…বকুলফুল.. রত্নাদি বিড়বিড় করে বলছিল।

আর আমার ভেতর থেকে একটা অবাঞ্ছিত আমি ধীরে ধীরে জেগে উঠতে লাগল। একসময় শুনতে পেলাম, আদর খেতে-খেতে আমারই গলায় আমার মুখ দিয়ে কে যেন বলছে, রত্নাদি… দিদিভাই..আরও আদর করো আমাকে…।

বকুল…বকুলফুল…।

আদরে-আদরে আমায় শেষ করে দাও, দিদিভাই…।

প্রায় সারা রাত ধরে আমরা পাগলের মতো যা করেছিলাম পরদিন ঘুম থেকে উঠে সে কথা ভেবে একটা গ্লানিবোধ আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। অথচ আমার পাশটিতে আলুথালু বেশে শুয়ে থাকা রত্নাদির মুখে কী সুন্দর নিষ্পপ তৃপ্তির ছাপ!

সকাল আটটায় মেয়ের দল এসে আমাদের দুজনকে হইহই করে জাগিয়ে তুলেছিল। তারপর আবার হাসি-মশকরা মন্তব্য।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার হস্টেলের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেল সবাই। শুধু আমার আর তেমন করে ফেরা হল না।

কিন্তু না-ফেরা জীবনটাও আমার কাছে বোধহয় খুব একটা অপছন্দের ছিল না।

আমি সবসময় রত্নাদির কাছে কাছে থাকতাম। আর রত্নাদিও চাইত আমার কাছে থাকতে। অন্যান্য মেয়ের কাছ থেকে এরকম মন্তব্যও শুনতাম, ওরা দেখছি নন্দনা আর শুক্লাদিকেও ছাড়িয়ে গেল। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করার কোনও প্রশ্নই ছিল না।

আমার সামান্য জ্বর হলে রত্নাদি রাত জেগে শিয়রে বসে আমার সেবা করত। দু-বেলা আমাকে নিয়ম করে হরলিক্স তৈরি করে দিত। পরীক্ষার সময় ডাব আর টিফিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কলেজের দোতলার বারান্দায়। কোনও কারণে কলেজ থেকে আমার ফিরতে দেরি হলে হস্টেলের দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত। আমি ছুটিতে বাড়ি গেলে ঘন-ঘন চিঠি দিত।

সব মিলিয়ে আমাকে ভালোবাসার ব্যাপারে রত্নাদি লজ্জাহীন হয়ে পড়েছিল।

রত্নাদির এই ভালোবাসা, যত্ন, আদর–সবই আমার ভালো লাগত। বাড়ি থেকে এত দুরে এসে আপন করে কাউকে পাওয়া কিছু কম নয়। আমি যেন সত্যি একটা আশ্রয় পেয়েছিলাম রত্নাদির কাছে। আমাদের রাতের ভালোবাসা যেমন মিথ্যে ছিল না, দিনের ভালোবাসাও তাই। প্রথম দিকে রাতে রত্নাদির আদরের সময় আমি ভাবতাম রতীন আমাকে আদর করছে। পরে আমি সরাসরি রত্নাদিকেই ভাবতে পারতাম।

সত্যিই বড় অদ্ভুতভাবে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি।

এইভাবে দেখতে-দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেল।

রত্নাদির হস্টেলের পালা শেষ হয়ে এল, আর আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম।

কিছুদিন ধরেই মনের ওপরে একটা চাপ পড়ছিল, তার প্রকট ছাপ ফুটে উঠেছিল চোখেমুখে। আমি, নন্দনা, শুক্লাদি আর রত্নাদি আমাদের সবারই একই দশা। যেন ফাঁসির দিন শিগগিরই এগিয়ে আসছে।

একটা অদ্ভুত আতঙ্কে আমি সবসময় রত্নাদির খুব কাছাকাছি থাকতে লাগলাম। এমনিতে সপ্তাহে দু-তিনদিন ওর কাছে গিয়ে শুতাম–এখন সেটা প্রায় রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।

অন্ধকারে চোখের জল ফেলতে-ফেলতে রত্নাদির বলে, বকুলফুল, এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

আমি দিদিভাইয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলি নিজেই ও দিদিভাই, আমাকে ছেড়ে তুমি কিছুতেই যেয়ো না।

কয়েকটা দিন এভাবে কাটতে না কাটতেই রত্নাদির দিন ফুরোল।

ওর চলে যাওয়ার দিন আমি একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েরা আমাকে ধরে রাখতে পারছিল না। কেঁদে চিৎকার করে আমি রত্নাদির ট্যাক্সির দরজায় আছড়ে পড়ছিলাম বারবার। আর ট্যাক্সির ভেতরে ওর বাবার কাঁধে মাথা রেখে রত্নাদি হাউহাউ করে কাঁদছিল।

ট্যাক্সিটা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই আমি নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

এরপর স্বাভাবিক হয়ে উঠতে আমার প্রায় একমাস সময় লেগেছিল।

নতুন থার্ড ইয়ারে ওঠা অস্মিতা, জয়শ্রী, চন্দ্রাদিরা আমার অবস্থা দেখে অন্য কারও সঙ্গে দিদিভাই-বোনটি পাতানোর পরামর্শও আমাকে দিয়েছিল, কিন্তু আমি রাজি হইনি। নতুন করে কষ্ট পেতে আর আমি রাজি নই।

কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল ততই আমি ভেতর থেকে বদলে যেতে শুরু করলাম। শুক্লাদি চলে যাওয়ার দিন আমি ঘর ছেড়ে বেরোইনি। নন্দনা আর শুক্লাদির হাহাকার কান্না আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি কানে আঙুল চেপে পাথর হয়ে পড়েছিলাম।

এরপর একদিন মনে হল রত্নাদির সঙ্গে দিদিভাই-বোনটি ব্যাপারটা আমার নয়–অন্য কোনও বকুলের হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আমার ভেতরের দুটো বকুল ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল।

এইভাবে একসময় একটা বকুল প্রায় হারিয়ে গেল। রত্নাদির চিঠি ওকে আর উতলা করে না। রত্নাদির কথা তেমন করে আর মনে পড়ে না ওর।

যে হারিয়ে গেল তার নাম বকুলফুল।

আর আমার ভেতরে যে পড়ে রইল সে শুধু বকুল।

.

রত্নাদির ডাকে হারিয়ে যাওয়া ঘুমিয়ে পড়া বকুলফুল আবার ফিরে এল আমার ভেতরে।

কফির কাপ সামনে রেখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতার হাত ধরে বসে রইলাম দুজনে। অনেক অর্থহীন কথা বললাম।

রত্নাদি পুরোনো দিনের পৃষ্ঠাগুলো খুলে বকুলফুলকে লোভ দেখাল আবার। সেই বিচিত্র দাম্পত্যজীবন লাস্যময় হাতছানি দিতে চাইল আমাকে।

আমি চোখের জল মুছে নিয়ে জড়ানো গলায় বললাম, রত্নাদি, আমি বিয়ে করেছি।

রত্নাদি স্থিরচিত্র হয়ে গেল পলকে। ওর ফরসা মুখের রক্তকণা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। তারপরই ওর সুন্দর মুখের জ্যামিতি ভাঙচুর হয়ে ও কান্নায় ভেঙে পড়ল। এ কান্না ঠিক একটু আগের আবেগের কান্নার মতো নয়। এ কান্না যেন সর্বহারার লজ্জাহীন কান্না। টেবিলে ঝুঁকে পড়ে ফুলে-ফুলে কাঁদতে লাগল রত্নাদি।

অনেক-অনেকক্ষণ পর নিজেদের সামলে আমরা উঠে পড়লাম। মামুলি কিছু কথা বলে যে যার পথ ধরলাম। রত্নাদির শরীরটা সন্ধের আঁধারে মিশে যেতে লাগল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমার দিদিভাইয়ের চলে যাওয়া দেখলাম।

আচ্ছা, আবার যদি তিন-চার বছর পর রত্নাদির সঙ্গে আমার দেখা হয় তা হলে কি আমরা আবার এরকম বিষণ্ণ হয়ে পড়ব? আমাদের অন্যরকম ভালোবাসার এই অদ্ভুত স্মৃতি আমার বুকের ভেতরের কবর খুঁড়ে আবার বেরিয়ে আসবে নিয়তির মতো?

হয়তো আসবে। সেদিনের সেই বকুলফুল বোধহয় একেবারে মূল্যহীন নয়। আমি জানি, যতবারই বকুলফুল সামনে এসে দাঁড়াবে, ততবারই এই বকুল দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলে ওকে সত্যিকারের ভালোবাসবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *