বকুলগন্ধ

বকুলগন্ধ

ঠিক কানামাছি খেলা নয়; তবে কানামাছির মতনই। কে যেন পা টিপে টিপে এগিয়ে এসেছে, হাত রেখেছে অঞ্জনার গায়ে বিকেল-বিকেল আলোয়। অঞ্জনা তখন জল দেখছে কুয়োয় গা ঝুঁকিয়ে। কে এল, কার হাত তার গায়ে? শিউরে উঠেছে অঞ্জনা, ধুকধুক করেছে বুক অথচ স্পর্শসুখে ঢিলপড়া পুকুরজলের মতই কেঁপে উঠেছে চুপি চুপি। সে কাঁপন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুভবে অনুমান করেছে অঞ্জনা তাকে—যার হাত ওর গায়, পায়ে পায়ে যার শব্দ নেই, কথা নেই ঠোঁটে। যেন এরই অপেক্ষায় ছিল অঞ্জনা একা একা, কুয়োতলায়, বিকেল-বিকেল আলোয়। মুখ ফিরিয়ে তাকে চট করে চিনে নিতে মন চায়নি অঞ্জনার। একটু দেরি করেছে ও। সেই আশ্চর্য আনন্দে যখন গা-মন ভর-ভর তখন অঞ্জনা মুখ ফিরিয়েছে। এর জন্যে দুঃখ হচ্ছে ভীষণ, এখন, যখন স্বপ্ন ভেঙে গেছে, সেই কানামাছির মিষ্টি স্বপ্ন। দেখা হল না আর সেই মুখ, চিনেও চেনা গেল না; ভেঙে গেল স্বপ্ন। শুধু অনুমানটাই কাঁটার মত বিঁধে থাকল।

ঘুম-ভাঙা চোখে বিছানায় উঠে বসল অঞ্জনা। সবে ভোর। এখনও আবছা অন্ধকার ফরসার সঙ্গে বুনন দেওয়া। সিরসির হাওয়া। গাছ-গাছালি ছেড়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশে একটি-দুটি করে। তাদের কাকলি। হালকা গন্ধ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে—মিষ্টি গন্ধ, বকুল ফুলের।

জানলা দিয়ে বকুল গাছের মাথাটা দেখা যায়; কম্পাউণ্ড-ওয়ালের আড়ালে ঢাকা পড়েছে বকুলতলা। অঞ্জনা আনমনা-চোখে সেই দিকেই তাকিয়ে থাকে। বাতাসে গন্ধ।

বিছানা ছেড়ে যখন নেমে এল অঞ্জনা, রাতশাড়ির ভাঁজে তখনো অনেক আলস্য। গা থেকে সে-আলস্য না মুছে ও শুধু একটু গুছিয়ে নিল; আঁচলটা জড়াল গায়ে। মা আর মিন্টু অঘোর ঘুমে। দরজা খুলে আস্তে আস্তে বাইরে পথে এসে দাঁড়াল অঞ্জনা।

—এত সকালে এখানে দাঁড়িয়ে?

কে? কে কথা বললে? অঞ্জনা চমকে উঠে চোখ তুলল। শ্যামল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। উস্কখুস্ক চুল। এখনও ঘুম জড়িয়ে আছে ওর চোখে। এইমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে আসছে মনে হল। হাসছে শ্যামল। তেমনি চুপহাসি, একটু ঠোঁট কাঁপানো, গাল ছড়ানো।

অঞ্জনা যেন মাটিতে পা পেল এতক্ষণে। পায়ে পায়ে বুকলতলাতেই এসে দাঁড়িয়েছে ও। কখন, কতক্ষণ—; আশ্চর্য তো!

—এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? শ্যামল মুখে-মুখেই হাসল আবার।

—বেড়াতে বেরিয়েছি। অঞ্জনা মৃদুস্বরে জবাব দিল, ঝরা বকুলের দিকে চেয়ে।

মনে পড়ল শ্যামলের। কাল বিকেলে স্টেশন থেকে ফেরার পথে অঞ্জনা বলেছিল বটে।

—মর্নিং ওয়াক? কিন্তু কই, বেড়াচ্ছ কই? তোমার বাড়ির গেট থেকে বকুলতলা বড়জোর বিশ পা, কী পঁচিশ পা— এতেই বেড়ানো হয়ে গেল? কাল সকালেও তোমায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এ-বেড়ানোয় শরীর সারে না।

কথাটা শ্যামল বাড়িয়ে বলেনি। কাল সকালে, এত ভোরেই হবে, শ্যামল ওকে বকুলতলাতেই দেখেছে। সারারাত ট্রেন-জার্নি করে শ্যামল আসছিল। লাল-চোখ, উদ্বিগ্ন, ক্লান্ত; হাতে সুটকেস। অঞ্জনা তখন এই বকুলতলাতেই। অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে। শ্যামলকে দেখেও যে দেখেনি। কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়াল শ্যামল। আর সেই মুহূর্তেই চেনাচিনি হয়ে গেল। চার বছরের না-দেখা দুটি মুখ এক নিমেষে চার বছর পিছিয়ে এল। খুবই অবাক হয়েছিল শ্যামল কাল সকালে। অঞ্জনা অতটা অবাক হয়নি। ও জানত শ্যামল আসবে, শ্যামল আসছে; হয় তুফান এক্সপ্রেসে, নয় বম্বে মেলে, বড়জোর বেলা দশটার প্যাসেঞ্জারে তো নিশ্চয়ই। মাসিমার— শ্যামলের মার অসুখ। টেলিগ্রাম গেছে কলকাতায়। সবই জানত অঞ্জনা, সবই। পাশাপাশি বাড়ি। বহুদিনের পরিচয় পরিবারে পরিবারে। অঞ্জনারাই যা এখন এখানে থাকে না বরাবর। কিন্তু বাড়ি আছে। আসে ছুটিছাটায়। বিশেষ করে যখন হাওয়া বদলাবার দরকার হয়, শরীর সারাবার প্রয়োজন। এ-বাড়ি ও-বাড়ির পারিবারিক বন্ধনটুকু তাই এখনো অটুট। অন্তত ওপরে ওপরে তাই; বাবা, মা মাসি, মেসো, গুরুজনে গুরুজনে কোনো মনান্তর নেই। সবই আগের মতন। তেমনি হৃদ্যতা। সেই পুরনো অন্তরঙ্গতা শুধু দু-টুকরো সুতোর মতো আলাদা হয়ে গেছে একটি জায়গায়। সে জায়গায় আর কেউ নেই, কারুর ছায়াও না, সেখানে শুধু শ্যামল আর অঞ্জনা।

—তোমার সঙ্গে আমিও একটু মর্নিং ওয়াক্‌ করব নাকি? শ্যামল তেমনিভাবেই তাকিয়ে, এখনো সেই চুপ-হাসি।

অঞ্জনা কি জবাব দেবে? না, আপত্তি জানাবে মাথা নেড়ে? মুখে আপত্তিটা তুলতে পারলে ভালোই হত। শ্যামলের সঙ্গে দেখা নতুন করে, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বড় কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে ও। এতটা ভাল নয়। কাল সকালে সেই হঠাৎ দেখা, মুখোমুখি দাঁড়ানো, শ্যামলের একটি প্রশ্ন, চার বছর পরে একটি কথা— ‘মা কেমন আছে’— বিকেলে সেই একটি কথাই শত কথা হয়ে দেখা দিল। উচিত হয়নি অঞ্জনার পিছন-ডাক শুনে দাঁড়ানো। মিন্টুকে সঙ্গে করে স্টেশনে বেড়াতে গিয়েছিল রোজকার মতই বিকেলে। ফেরার পথে অঞ্জনার একাই পথ হাঁটা উচিত ছিল। কিন্তু ওভারব্রিজের নীচে নামতেই পিছন থেকে ডাক দিল শ্যামল। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ফিরছে। অঞ্জনা দাঁড়াল, মিন্টু ছুটে গিয়ে শ্যামলের হাত ধরে ফেলল। তারপর ওরা পাশাপাশি হেঁটেছে কাঁকর-ছড়ানো, গাছগাছালি ঢাকা শূন্য পথ দিয়ে, মাঠ ভেঙে। তখন গোধূলি। রাজপাহাড়ের মাথায় আকাশ রং খেলছে। জংলি বাতাস আসছে ঝাপটা দিয়ে। পথ হাঁটছে ওরা— ওরা দুজনে, পাশাপাশি। মিন্টু ছুটতে ছুটতে এগিয়ে গেছে অনেক, অনেকটা। চার বছর পরে আবার এই পাশাপাশি পথ হাঁটা। চার বছর আগের কথাটাই মনে পড়েছে দুজনেরই। আর অস্বস্তি, অদ্ভুত অস্বস্তিতে দুজনেই কেমন গুমট মন। শেষ পর্যন্ত গুমট ভাবটা কাটিয়ে উঠল শ্যামলই। সকালের সেই একটা কথায় যেন পথ খুলে গিয়েছে আবার— চার বছর পরে অঞ্জনার সঙ্গে আলাপ-আলাপনের।

আশ্চর্য, প্রথম প্রথম শ্যামলের গলা কেঁপেছে, সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত কথাগুলো জড়িয়ে গেছে জিবে। ধীরে ধীরে কখন যেন সেই ভাবটাও কেটে গেল। অঞ্জনাও প্রথম প্রথম মুখ বুজে ছিল— একেবারেই বোবা হয়ে। একটি দুটি হাঁ-না আর বুক চাপা নিশ্বাস ছাড়া অঞ্জনা দ্বিতীয় কোনো শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি। ভয় ভয় করেছে। ঘা লেগেছে কোথায় যেন, আত্মসম্মানেই বোধ হয়। নাকি আর কিছুতে, অন্য কোথাও! সেই অঞ্জনাও কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাক হল; মোটামুটি কথা বলল, এক সঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফিরে এল। আশ্চর্য! কেমন করে যে এতটা সহজ হতে পারল ওরা পরস্পরের কাছে কে জানে। অথচ এই শ্যামল যখন সবেমাত্র একটি দুটি কথা বলে আবার পুরনো হতে চেষ্টা করছে— অঞ্জনার তখন গা ছমছম করছিল, হঠাৎ না জানি কেন সে কাপড় তুলে দিয়েছে মাথায়। জনবিরল সেই পথে, সন্ধেবেলায় শ্যামলের কাছে হঠাৎ মাথায় কাপড় তুলে দেওয়ার কোনো কি দরকার ছিল? তবু যদি সেটা থাকত! পথ হাঁটতে হাঁটতে কথায় কথায় কখন যেন খসে গেছে। এই বকুলতলার কাছাকাছি এসে শ্যামল যখন বললে, ‘তোমার স্বামী শুনেছি ডাক্তার, কিন্তু ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্য তো ফেরাতে পারলেন না। একেবারে তেমনি আছ তুমি, তেমনি রোগা’— তখন, ঠিক তখনই অঞ্জনার মনে পড়ল মাথায় কাপড়ের কথা। হাত দিয়ে বুঝল ওটা খসেছে। কিন্তু আর ইচ্ছে হয়নি মাথায় কাপড় তুলে দিতে। বরং কোথায় যেন একটা অস্বস্তি ছিল, সরে গেছে— আর সেই স্বস্তিতে অঞ্জনা মৃদু শব্দ করে হেসেছে। বলেছে শ্যামলকে, হাতের কাছে আয়না থাকলে তোমার মুখের সামনে তুলে ধরতাম।

—কেন?

—নিজেকে একবার দেখতে। কত মোটাই হয়েছ তুমি নিজে যে আমায় বলছ?

—আমার স্বাস্থ্য— ওর কথা বাদ দাও। এ-কাঠামোয় আর বদলাবে না।

—কেন? শুনেছি বউদি তোমায় খুব আদর-যত্ন করেন। শরীর সারা উচিত ছিল।

—তাই নাকি? তা বউদির আর কি কি গুণের কথা শুনলে?

—অনেক। সত্যি, তোমার বউয়ের প্রশংসায় এখানে সকলে পঞ্চমুখ। বড়ো ইচ্ছে করে একবার দেখতে। অঞ্জনা হঠাৎ থামল। গলাটা একটু বুঝি ভারী শোনাল; বললে, অমন বউ তোমার—।

শ্যামল যেন কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। অঞ্জনাও কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির পথ ধরল।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে অঞ্জনার কত কথাই মনে পড়েছে। সকালের এই দেখায় আবার যেন সেই পুরনো কথাই গুনগুনিয়ে উঠেছে। এতটা ভাল নয়। ভাল নয়। কী লাভ এতে? বরং ক্ষতি— অনেক ক্ষতি।

—ব্যাপার কি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে যে! যাবে না বেড়াতে? চল, একটু ঘুরে আসি সকালবেলায়।

কথা বললে না অঞ্জনা, শুধু পা বাড়াল। কটি বকুল ঝরল পথে।

ধবধবে ফরসা হয়ে এসেছে আকাশ-বাতাস। হু হু হওয়া বয়ে যাচ্ছে একটানা; খানিকটা পথ হেঁটে ওরা মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে।

—বসবে নাকি? শ্যামল বললে।

—না। অঞ্জনা মাথা নাড়ল।

—হাঁটবে আরো?

—চল!

না, অঞ্জনা বসবে না। কখনোই বসবে না এই মাঠে। এমনিভাবে ওরা একসময় অনেক বসেছে, সকালে, সন্ধেয়, পূর্ণিমায়। দুজনে ঘন হয়েছে তখন, কথা বলেছে কি বলেনি, হাতে হাত রেখে পাতা পড়ার শব্দ শুনেছে। তখন যা মনে হত— আর মনে হলে যে সুখে, আশায় সর্বাঙ্গ অসহ্য আনন্দে টনটন করে উঠত— এখনও যদি তাই মনে হয় আর তেমনিভাবে সুখ আসে চোখে, মনে, বুক দুরুদুরু করে তাহলে কী করবে অঞ্জনা? পারবে সহ্য করতে? উচিত হবে সহ্য করা?

না, না, সে অসম্ভব। অসম্ভব।

—সূর্য উঠল; চল ফিরি। বলল অঞ্জনা, আরো খানিকটা এগিয়ে এসে।

—চল। ফিরতিপথ ধরল শ্যামল।

পুকুরের পাশ দিয়ে ফিরতে ফিরতে শ্যামল হঠাৎ দাঁড়াল। আঙ্গুল দিয়ে দেখালে পুকুরপাড়ে হেলে জল-ছুঁই-ছুঁই কামরাঙা গাছটা। বললে, দেখেছ, সেই গাছটা; এখনও তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে।

অঞ্জনা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল।

—ওই গাছটা দেখলেই আমার সেই সাপের ছোবল খাবার কথা মনে পড়ে যায়। আর একটু হলেই—

অঞ্জনারও মনে পড়েছে সে-কথা। একদিন ঘোর বর্ষায় দুপুরবেলায় ওরা দুজন মিলে বর্ষায় ভিজতে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি ছেড়ে। কী ছেলেমানুষিই করত তখন। টো টো ঘুরে জলে কাদায় একশা। পুকুরপাড় দিয়ে আসছে। হঠাৎ চেপে জল নামল আবার। ছুটতে ছুটতে শ্যামল আর অঞ্জনা এসে দাঁড়াল ওই গাছতলায়। কামরাঙার পাতায় কতটুকু জল আটকে ছিল আজ আর মনে নেই, কিন্তু মনে আছে সেই চিৎকার। শ্যামল অঞ্জনাকে টেনে নিতেই দুজনে পুকুর জলে। সাপ-সাপ। ভয়ে কাঠ অঞ্জনা। কামরাঙার ডালের গা বেয়ে লিকলিক গা দুলিয়ে একটা সাপ ঝুলছে। অঞ্জনা শ্যামলকে আঁকড়ে ধরেছে সবটুকু জোর দিয়ে সেদিন।

অঞ্জনা মনে মনে সমস্ত ঘটনাটাই একবার ভেবে নিলে। এখনও ফিকে হয়ে আসেনি। সে-দৃশ্য।

—ভালই হত। অঞ্জনা বলল, ঠোঁটের কোণে একটু ম্লান হাসি এনে।

—কী আর ভাল হত!

—মরে যেতাম।

শ্যামল তাকাল অঞ্জনার দিকে। একটি শিরা নীল হয়ে ফুটে উঠেছে গলায়। দপ্‌দপ্ করে কাঁপছে। কপালে কটি রেখাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অঞ্জনার।

—রাগ করছ নাকি? শ্যামল পথ চলতে শুরু করলে।

—না।

—আমি কি আর তোমার রাগ বুঝি না?

—তবে আর মিছেমিছি জিগ্যেস করছ কেন?

দুজনেই চুপ। পথ শেষ হয়ে এল প্রায়। আর কতটুকু।

—তোমায় একটা কথা বলব ভেবেছিলাম। শ্যামল অগোছালভাবে কথা বলছে। মুখে চোখে চাপা আবেগ।

অঞ্জনা অপেক্ষা করছে। ভয়-কৌতূহলে দুরুদুরু বুক।

—দেখ অঞ্জনা, যা হয়ে গেছে তা অপ্রিয়। আমি চাইনি—কখনও ভাবিনি, অমন বিশ্রী একটা কাণ্ড হতে পারে। সে সমস্ত কথা ভাবতেই যেন কেমন লাগে। নিজেকে বড়ো ছোট মনে হয়; কেমন একটা গ্লানি অনুভব করি।

এই কটি কথা বলতেই পথ শেষ। শ্যামলদের বাড়ির গেটের কাছে তারা পৌঁছে গেছে। দাঁড়াল দুজনেই। একটু ইতস্তত করে শ্যামল আবার বললে, আবার যদি কখনও দেখা হয়, আমরা যেন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে পারি। কুশল প্রশ্ন করতে পারি। শুধু এইটুকুই।

শ্যামলের যেন আরও কত কথা বলার ছিল; বলল না। গেট খুলে চলে গেল।

অঞ্জনা পাথর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল শ্যামলকে, সেই শ্যামলকে যে একদিন ওকে সাপের ছোবলের মুখ থেকে বাঁচিয়েছে, আর একদিন নিজেই সাপের মতো ছোবল দিয়ে সরে গেছে।

অদ্ভুত মানুষ! অঞ্জনার বুকে কোথায় যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠছে। পা পা করে ও এগিয়ে যেতে লাগল। সেই বকুলতলা। তেমনি গন্ধ। বড়ো মিষ্টি, সব কিছু ভুলিয়ে দেয়, উন্মনা করে তোলে, মুঠো মুঠো ঘুম ছড়িয়ে দেয় চোখে।

হঠাৎ যেন অঞ্জনার সেই কানামাছির মিষ্টি স্বপ্ন আবার ভেসে এল চোখে। সেই না-দেখা মুখ, সেই গা-ছোঁয়া হাত।

বকুলতলায় দাঁড়িয়ে থাকল অঞ্জনা।

পরের দিন সকালে আবার দেখা।

—চললাম। হাতের সুটকেস মাটিতে নামিয়ে শ্যামল একটু দাঁড়াল। সিগারেট ধরিয়ে নিলে। হাসল এই সকালের মতনই, স্বচ্ছ হাসি, শীঘ্রি আবার দেখা হবে।

—কলকাতায়?

—কলকাতায় কেন এখানেই। কলকাতায় কি বকুলতলা আছে? ঢিলে গলা, হাসিখুশি জড়ানো। বললে শ্যামল, মা একটু ভাল। তবে বিশ্রাম চাই। তোমার বউদিকে নিয়ে হপ্তাখানেকের মধ্যে আবার আসছি। টানা ছুটি নেব এক মাসের। তোমরাও তো এখন আছ কিছুদিন। বেশ হইচই করে কাটানো যাবে। শ্যামল সুটকেস তুলে নিল, লিখে দাও তোমার শ্রীমৎ প্রভুকে— ডাক্তারি শিকেয় তুলে চলে আসুক এখানে কিছুদিনের জন্যে। আচ্ছা যাই, বম্বে মেল বুঝি এসেই পড়ল। শ্যামল এক পলকের জন্যে অঞ্জনার চোখে চোখ রাখল।

—আসি। শ্যামল চোখ ফিরিয়ে নিলে।

—এস। অঞ্জনা মাটিতে চোখ নামাল।

চোখ তুলে অঞ্জনা দেখে শ্যামল হনহন করে এগিয়ে চলেছে। সামনের রাস্তায় আর কেউ নেই; একেবারেই ফাঁকা। একটাই শুধু মানুষ। তার সাদা পাঞ্জাবি হাঁটার তালে মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। অবিকল সেই ভঙ্গি। তেমনি পুরনো।

নিজের দীর্ঘনিশ্বাসে অঞ্জনা নিজেই যেন চমকে উঠল। বুকে কনকনে ব্যথা, হাত-পা ভার ভার। মন যেন নয়, মেঘ। হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে চলেছে। ভুরভুরিয়ে উঠেছে সেই মিষ্টি গন্ধ বকুলফুলের। ডুবে যাচ্ছে কি যেন। কেউ কি হারিয়ে গেল? কেন এই খুঁজি-খুঁজি মন, এলোমলো চোখ? কে এল, কে গেল?

।। ২ ।।

চিঠি এল একটু বেলায়। সুধাংশুর চিঠি।

—কী লিখেছে রে, সুধাংশু? মা জানতে চাইলেন হাতের কাজ সারতে সারতে, ভালো আছে সব?

—আজ আসছে, তুফান এক্সপ্রেসে।

—আজ? মা চোখ তুলে মেয়ের দিকে চাইলেন, হঠাৎ—?

—এমনিই। ফুরসত পেয়ে গেছে বোধ হয়।

—ভালই হল। মা খুশি হলেন।

চিঠি হাতে অঞ্জনা ঘরে ঢুকল। সুধাংশুর আসার খবরে সেও খুশি। শুধু কি খুশি, তা ছাড়াও যেন আরো কিছু। সকাল থেকেই মনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল, কেমন যেন নিঃসঙ্গ, অসহায়। কোথায় বুঝি কেউ ডাকছে— আর বার বার সেই ডাকে কান পেতে থাকা, স্পষ্ট করে না বোঝা কেন ডাকছে।

চিঠিটা সযত্নে রেখে দিয়ে অঞ্জনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ঘড়ি দেখল; দশটা বেজে গেছে। আর ঘণ্টা ছ-সাত। তারপর তো সুধাংশু এখানে। অঞ্জনা তখন আর একা নয়। সেই প্রথম সন্ধের অন্ধকারে ওর সব ভয় কেটে যাবে, কেটে যাবে এই মন-ভার।

তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুলগুলো আর-একবার ভাল করে মুছল অঞ্জনা। সদ্য স্নান সেরে এসেছে। শাড়ি-জামা গুছিয়ে পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুলে নিল চিরুনি।

চুলে চিরুনি ছুঁইয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখে অঞ্জনা নিজেই অবাক। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। সারারাত জেগে থাকলে যেমন দেখায়, অনেকটা তেমনই। একটু ছলছল করছে চোখ দুটো। ঠোঁটে গালে অদ্ভুত কতকগুলো সূক্ষ্ম রেখা ফুটে ভুরু পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

তবে কি জ্বর এল আবার? ভয় হল অঞ্জনার। নিজের হাতেই গা কপাল পরখ করলে। না, জ্বর তো নয়। জ্বর হলে স্নান করার সময়ই বুঝতে পারত। তবে? জ্বর কি আসবে? কে জানে আসলেও আসতে পারে। যদি আসেই, কি আর করবে অঞ্জনা! সুধাংশু রাগ করবে। নিশ্চয়ই ভাববে, অঞ্জনা এখানে এসে শরীরের ওপর যত্ন নেয়নি, অত্যাচার করেছে। তাই আবার জ্বর।

চুল আঁচড়ে আঁচল দিয়ে মুখটা ভাল করে মুছে নিল অঞ্জনা। একটু পাউডার বুলিয়ে নিল। না, তবু সেই ম্লান ভাবটা মুছল না পুরোপুরি।

সরে এল আয়নার কাছ থেকে জানলায়। হঠাৎ মনটা তার আবার মুষড়ে পড়েছে। কদিন আগেও সে বেশ ছিল। মা পর্যন্ত বলেছে, শরীর সারছে এবার ওর। সুধাংশু যা যা বলেছিল অঞ্জনা প্রতিটি কথা মেনে চলেছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম। রোজ সকাল-সন্ধে নিয়ম করে বেড়ানো।

বেড়ানোর কথাতেই মনে পড়ল আবার শ্যামলকে। শ্যামলই না আজ সকালে বলছিল, সুধাংশুকে চিঠি লিখে আনাতে। আর-একটা দিন থেকে গেলেই শ্যামলের সে-কৌতূহল মিটে যেত। সুধাংশু তো আসছেই। দেখতেই পেত শ্যামল। না, না। ভালোই হয়েছে, চলে গেছে শ্যামল। অনর্থক কি হতে কী হত! হয়ত, হয়ত সুধাংশুর চোখে ধরাই পড়ে যেত সব। এমনিতেই তো আজ দু-তিন দিনে অঞ্জনা কেমন শুকিয়ে গেছে। এত বিশ্রী লাগে, সব কথা ভাবলে। ভূতের মতন ভর করেছিল সেই সমস্ত ভাবনাই এ-কদিন।

অঞ্জনার চোখ দুটো আবার জ্বালা করে উঠল, ভীষণ জ্বালা। সারা গা যেন জ্বালা করছে।

ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে, পাশের ঘর থেকে সোজা বারান্দায় এসে দাঁড়াল অঞ্জনা। কী যেন খুঁজছে ও। মা কই, মা? ওর কি জ্বর এল আবার?

—মিন্টু—অঞ্জনা ডাক দিয়েই থেমে গেল। বারান্দার এক কোণে বসে মিন্টু তার খেলনাপাতি পুতুল সাজিয়ে বসে এক মনে মালা গাঁথছে। ফ্রকের কোঁচড় ভরে ফুল কুড়িয়ে এনেছে, বকুল ফুল।

ফুল আর মালা চোখে পড়তেই অঞ্জনা চুপ করে গেল। মাথার মধ্যে কোথায় যেন একটা শিরাতে কেউ জ্বলন্ত দেশালই কাঠি ছুইঁয়ে দিলে। হঠাৎ। একেবারেই হঠাৎই। দ্রুত পায়ে মিন্টুর কাছে এসে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলে গালে। পায়ে করে ঠেলে ফেলে দিল খেলনাপাতি। হেঁচকা টানে মালা ছিঁড়ে দূর করে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাঠে। কোঁচড় থেকে ফুলগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। মিন্টু প্রথমটায় থতমত খেয়ে তারপরে ডুকরে কেঁদে উঠল।

—কাঁদছিস কী? মিন্টুর চুলের বিনুনি ধরে ঝাঁকিয়ে দিল অঞ্জনা, যা বারণ করব, তাই। বুড়ো ধাড়ি মেয়ে। নিয়ে আয় শীঘ্রি ঝাঁটা, এনে পরিষ্কার কর এই সমস্ত জঞ্জাল। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে কতকগুলো বকুল ফুল ঠেলে ফেলে দিল অঞ্জনা; যত নোংরামি আর অসভ্যতা। যা নিয়ে আয় শীঘ্রি ঝাঁটা।

মিন্টুর কান্নায় মা এসে দাঁড়ালেন। মিন্টু ঝাঁটা এনে বারান্দা পরিষ্কার করতে লাগল কেঁদে কেঁদে, তারই ফাঁকে অভিযোগটা দিদিমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল।

—তোর বড়ো হাত হয়েছে অঞ্জনা। মা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, অযথা ওকে মারলি কেন?

—মারব না তো কি পুজো করব? যত রাজ্যের রাস্তার জঞ্জাল কুড়িয়ে এনে ঘরদোর নোংরা করছে মেয়ে। গলায় অসম্ভব ঝাঁজ অঞ্জনার।

—জঞ্জাল? মা অবাক হয়ে মেয়ের রাগ-টকটকে মুখের দিকে তাকালেন, ওমা, বাড়ির পাশের বকুলতলা, সেখান থেকে ফুল কুড়িয়ে এনে ও বেচারী গাঁথছে। এর মধ্যে আবার জঞ্জালটা পেলি কোথায়?

—তুমি যাও তো মা, নাতনিকে আদর দিয়ে দিয়ে আর মাথাটি খেয়ো না।

—জানি না বাপু অত শত। তুইও তো সেদিন পর্যন্ত ওই বকুলতলা থেকে ফুল কুড়িয়ে এনে মালা গাঁথতিস; ঘরে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখতিস—।

—মা—। অঞ্জনা বিশ্রীভাবে চিৎকার করে উঠল। এত বিশ্রীভাবে যে, সেই কর্কশ স্বর ওরও কানে লাগল।

মা মিন্টুকে নিয়ে চলে গেলেন।

জ্বর নয়, তবে জ্বরের মতন। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর শেষ হয়ে বিকেল হল, অঞ্জনা ভাল করে বুঝতেই পারল না। গা ধুয়ে সারা দিনের জ্বালা অনেকটা তবু জুড়িয়ে নিল ও। পরিপাটি করে প্রসাধন সারল। খুশি হল মনে মনে। সুধাংশু কি বুঝতে পারবে তার মনপীড়ন, চোখে-মুখে কোথাও কি তার চিহ্ন থাকল? না, না, সাজে সজ্জায় সে-কলঙ্ক ও মুছে ফেলেছে, ঢেকে ফেলেছে।

মিন্টুকে নিয়ে সময়মত স্টেশনে পৌঁছে অঞ্জনা দেখে ট্রেন সবে এসেছে। সুধাংশুকে দেখে অঞ্জনার বুকের মধ্যে হঠাৎ যেন একরাশ হাওয়া তাল হয়ে পাকিয়ে নিস্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিলে কয়েক মুহুর্তের জন্যে। তারপর সব ঠিক। বুকের বোঝা ধীরে ধীরে কোথায় যেন সরে গেল। তার বদলে বেশ সাহস পেয়েছে এতক্ষণে ও। রোগের সময় ডাক্তার এলে যেমন হয়, তেমনি।

বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে সুধাংশু বলল, ওয়ান্ডারফুল জায়গা। তুমি তো তেমন কছু ইমপ্রুভ করনি। সামান্য। থাকো কিছুদিন আরও, ভালই হবে।

আ, কী স্বস্তি। অঞ্জনা আরও যেন হালকা বোধ করল নিজেকে। বেশি হোক, কম হোক— শরীর তো তার সেরেছে একটু। সুধাংশুর চোখ নিশ্চয়ই ভুল করবে না। অযথাই সে সকালে অতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সত্যিই তো শরীর না সারার কী আছে? মনটা হয়ত কদিন— কদিন আবার, মাত্র দু-তিনদিন— কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল, কিছু ভাল লাগেনি খেতে; শুতে, বসতে। তাতে আর কি এমন হতে পারে? কিছুই না। কিচ্ছু না।

আশ্বিন কী ফাল্গুনের কোনও কোনও সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলে হঠাৎ যেমন খুশিতে মন ভরে ওঠে, গুনগুন করে ওঠে গান, আশ্চর্য আরাম লাগে সারা সকাল, সারা বিকেল— তেমনি মিষ্টি খুশিতে ভরে উঠল অঞ্জনার মন স্টেশন থেকে ফিরে এসে। বাড়িতে ফিরে এসে ও যেন অন্য মানুষ। কোমরে আঁচল জড়িয়ে বসে গেল সুধাংশুর জন্যে চা, খাবার তৈরি করতে। ভোরের হাওয়ার মতো মিঠে সুর গুনগুন করছে ওর গলায়। কথার আর কমতি নেই, অভাব নেই উৎসাহের: তুমি ছেড়ে দাও মা, ডিমের তরকারিটা আমিই রাঁধি। তুমি বরং ও-বাড়ি গিয়ে গল্পসল্প করগে যাও। আমি সব সেরে নেব। মিন্টু আমায় একটু জল খাওয়া না রে লক্ষ্মীটি।

মা মনে মনে হাসলেন। মুখে বললেন, পারবি তো সব, না আবার মাথা ধরিয়ে বসে থাকবি? অবশ্য জবাবের অপেক্ষা না রেখেই তিনি ওবাড়ি যাবার জন্যে পানের ডিবেটা তুলে নিলেন।

বাড়ি ফাঁকা। মা আর মিন্টু ও-বাড়ি চলে গেছে। চাকরটা সমানে অঞ্জনার ফাইফরমাশ খাটছে। সুধাংশু এসে দাঁড়াল অঞ্জনার কাছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প, হাসি, সুযোগ বুঝে খুনসুটি। তিন হাতের রান্নাঘর হঠাৎ যেন বাসরঘর হয়ে উঠল।

সুধাংশু হাসে, অঞ্জনাও। গায়ে গা ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কানে কানে কি যেন বলে বা বলে না। চিমটি কাটে অঞ্জনা। সুধাংশু আচল ধরে টেনে দেয়। হু হু সময় বয়ে যায়। সন্ধের ঘোর গাঢ় হয়ে রাত নামে, লণ্ঠনের আলোয় রান্নাঘরে দুটি ছায়া আরও কালো হয়ে ওঠে।

হঠাৎ ডাক এল ও-বাড়ি থেকে। জামাইবাবুকে ডাকছে।

—কী হয়েছে, বিশু? মাসিমার আবার শরীর খারাপ হল নাকি?

—কই না, দিদিমণি।

—কী ব্যাপার গো? সুধাংশু বলল।

—মাসিমা—শ্যামলদার মার অসুখ! মা তোমায় ডাকছেন।

—শ্যামলবাবুর মা? ও—বুঝেছি। আচ্ছা, চল বিশু।

সুধাংশু চলে গেল। অঞ্জনা একা। রান্নাঘরের দরজা ভেজিয়ে ও গেল কলঘরে। সেখান থেকে শোবার ঘরে। শাড়ি, জামা বদলে ফেলল অঞ্জনা। পাউডার ছিটিয়ে ক্লান্তিটুকু মুছে নিলে। কুমকুমের টিপ পরল যত্ন করে। সময় কাটছে তবু। কটা বাজল? নটা বাজে প্রায়। সুধাংশু এতক্ষণ কী করছে ও-বাড়িতে? মাও যেন কী? ও-বাড়িতে গেলে সব ভুলে যায়। সারাদিন গাড়িতে গাড়িতে কাটিয়ে এসেছে একটা লোক; কোথায় সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বে তা না সেই রাত-দুপুর।

সাড়ে-নটা বাজতে চলল। মনে মনে অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছে অঞ্জনা। ছটফট করছে ঘরময়। একা একা। হল কী লোকগুলোর? সব ও-বাড়িতে গিয়ে যে দিব্যি জমিয়ে বসল? এখানে ও একা পড়ে রয়েছে কারুর কি সেদিকে হুঁশ নেই?

শোবার ঘরের পর্দা সরিয়ে অঞ্জনা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ফুরফুরে হাওয়া দিয়েছে। আকাশ যেন ততটা কালো নয়; জ্বলজ্বল করছে অজস্র তারা। চুপটি করে অঞ্জনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। কিন্তু মনে মনে কেমন যেন অস্বস্তি, উদ্বিগ্নতা। তবে কি মাসিমার কিছু হল নাকি? আবার বাড়াবাড়ি? শ্যামল যে বললে, মাসিমা ভাল আছে। কে জানে কি হল আবার হঠাৎ। আর বিশুটাও একটা উজবুক। দিব্যি বলে দিয়ে গেল, কিছু না দিদিমণি। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, নয়তো এত দেরি করে সুধাংশু? কপাল দেখ, আজই আবার শ্যামল কলকাতায় ফিরে গেল। আশ্চর্য ছেলে! শুধু কর্তব্যটুকুই ওর জানা আছে। আর কিছু না। দরদ, ভালোবাসা, টান— কিছুই ওর নেই। এমন কি মার ওপরেও। বউয়ের ওপর আছে কিনা তাই বা কে জানে? নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর। ওপর থেকে শ্যামলের সেই নির্মম মনকে বোঝা যায় না। কাছে গেলে, ওর বুকে বুক দিয়ে নির্ভর করতে চাইলেই তবেই বোঝা যায়।

গেট খোলার শব্দ হল। সুধাংশু আসছে। একা।

—এত দেরি যে!

—এমনি। শ্যামলবাবুর মার অসুখবিসুখের কথা হচ্ছিল। তারপর ও-বাড়ির কর্তাদের পাল্লায় গিয়ে পড়লাম। গল্প-গুজব হল খানিকক্ষণ। বেশ লাগল।

—মা এল না?

—আসছেন।

অঞ্জনা চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকল। সুধাংশু ওর পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

—তোমার জন্যে একটা ওয়ান্ডারফুল জিনিস নিয়ে এসেছি।

সুধাংশু হাত পিছু করে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল।

অঞ্জনা তাকাল স্বামীর দিকে।

—তাকাচ্ছ কি? এ-বস্তুটি সহজলভ্য হলেও সিম্‌প্লি চারমিং। সুধাংশু পিঠের আড়াল থেকে হাত বের করে অঞ্জনার মুখের কাছে তুলে ধরল, কি মিষ্টি গন্ধ! বুকল ফুল গো, বুকল ফুল!

গন্ধই। ধক্‌ করে গন্ধটা অঞ্জনার নাকে গেল। এক পলকের হতচকিত ভাব, তারপর অঞ্জনার নাক, মাথা, গলা যেন সেই গন্ধে বিষিয়ে উঠল মুহূর্তেই। স্নায়ু আর সুষুম্নার স্বাভাবিক স্থৈর্য হঠাৎ কিসের স্পর্শে যেন ভেঙে গেল, উত্তপ্ত হয়ে উঠল। জ্বলে গেল সারা গা— দম আটকে এল অঞ্জনার। সাপের ছোবল থেকে মানুষ যেমন করে চমকে সরে যায়, অঞ্জনা তেমনিভাবে পিছু সরে গেল ঝটকা একটা থাবড়া দিয়ে সুধাংশুর হাতে। বুকল ফুলগুলো ঝরে পড়ল মাটিতে।

সুধাংশু বিমূঢ়, বিস্মিত। অঞ্জনাও কথা বলতে পারছে না। শুধু ভয় আর অসহ্য ঘৃণা মেশানো একজোড়া উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে সুধাংশুর দিকে।

কথা বলতে সময় লাগল অঞ্জনার। অনেক কষ্টে যখন ওর গলায় স্বর ফুটলো তখন বিরক্তি আর ঝাঁঝে সারা মুখ বিশ্রী হয়ে উঠেছে, তেতো হয়ে উঠেছে গলার স্বরও।

—রাস্তা থেকে কতকগুলো জঞ্জাল কুড়িয়ে আনলে?

বিহ্বল ও ব্যথিত সুধাংশু স্ত্রীর ঝাপসা মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারল না।

—যা ভালবাসি না, সহ্য করতে পারি না, তাই। কেন তোমরা আমায় জালিয়ে পুড়িয়ে মারছ? অঞ্জনার কথাগুলো কান্নায় জড়িয়ে বড়ো করুণ হয়ে উঠল।

সেই অদম্য কান্নাকে রোধ করতেই বুঝি ঘরে গিয়ে ঢুকল অঞ্জনা। সুধাংশু বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকল একা, চুপ করে। কি খেয়াল হয়েছিল, সুধাংশুর বকুলতলা দিয়ে আসার সময় গন্ধে থমকে দাঁড়িয়ে কিছু ফুল কুড়িয়ে নিয়েছিল অঞ্জনাকেই খুশি করবে বলে। অথচ!

রাত্রে পাশাপাশি শুয়েও দুজনে চুপ। সুধাংশু কয়েকবারই চেষ্টা করল অঞ্জনার মন পাওয়ার। ফল হল না। অঞ্জনা সেই তখন থেকেই যেন কেমন হয়ে গেছে। না-কথা, না-হাসি, না আর কিছু।

অসম্ভব একটা ক্লান্তি ছাড়া ওর মুখে অন্য কোনও চিহ্ন খুঁজে পেল না সুধাংশু। শেষ পর্যন্ত ভাবতে ভাবতে, একটু বোধ করি অভিমানবশেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল ও। ঘুমিয়ে পড়ল।

স্বামীর পাশে শুয়ে শুয়ে নিস্তব্ধ রাতের প্রহর গুনে গেল অঞ্জনা, কখনও চোখ বুজে, কখনও চোখের পাতা খুলে অন্ধকারে চেয়ে চেয়ে। কী যে অস্বস্তি তার, কী অদ্ভুত এই চোখ, মন ডুবানো অসাড় নিষ্পেষণ। অর্ধলুপ্ত আত্মচেতনা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত বিকারের মতো কোথাও কোথাও যেন ঈষৎ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। অঞ্জনার সাধ্য কি সেই বিকার থেকে মুক্ত করে নেয় নিজেকে। পারে না, পারে না সে। স্বামীর পাশে শুয়ে শুয়ে যদি অনেক পুরনো কথাই মনে পড়ে— কী করতে পারে অঞ্জনা? ভাবতে তো চায় না, তবু স্মৃতি যদি সব কিছুর আগল টপকে অন্ধকারে এসে দাঁড়ায়, কেমন করে তাড়িয়ে দেবে অঞ্জনা তাকে! সে-সাধ্য তার কই।

রাত যায়-যায়—পাখা দিয়ে সময় যেন উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। ঘর নিঝুম, মাঠ নিঝুম। সব অসাড়। ছুঁচ পড়ারও শব্দ নেই। শুধু নিজের দীর্ঘনিশ্বাস, নিজেকেই যেন আরও ক্লান্ত করে রেখে যায়।

শেষ রাতে চাঁদ উঠল আকাশে। খোলা জানলা দিয়ে তারই আলো এল। বিছানায় উঠে বসল অঞ্জনা। সুধাংশুর আধখানা মুখ চাঁদের আলোতে কেমন যেন দেখাচ্ছে। অনেক দূরের একটা দেওয়ালে টাঙানো ছবির মতন। এখন যা অর্থহীন, সম্পর্কহীন বলেই মনে হয়। সত্যি, এই লোকটা যে কে, কিসের এত অধিকার তার, অঞ্জনা আজ আর বুঝতে পারে না। কোথায় ছিল ও এতকাল? উনিশ বসন্তের কোনও একটা ফুলও অঞ্জনা ওর মুখ মনে করে তোলেনি, একটিও মালা গাঁথেনি একদিনও। অথচ যার জন্যে চোখের মণিতে বুকের সোহাগ দিয়ে রত্নমুকুর গড়ে তুলল, সে তো কই এল না। কেন— কেন? কী দোষ অঞ্জনার? তুচ্ছ একটা শোনা কথা আর অভিমানে সব কি ভেসে গেল? ভগবান জানেন, ওই বুকলতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যেদিন মন দেওয়া-নেওয়ার মুহূর্তটুকু আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতন হঠাৎ পিছলে এসে পড়েছিল সেই দিন— সেদিন অঞ্জনা শ্যামলের হাতে হাত রেখে বলেছে, ‘তোমাকেই ভাবি সারাদিন; তোমার কথা। আর তো কিছু ভাবতে পারি না।’—সত্যি তারপর বা তার আগে আর তো কিছু ভাবেনি অঞ্জনা। কারুর কথা নয়। তবু কেন এমন হল? কেন?

চোখের জলটুকু থাক। কি হবে মুছে, কে দেখছে এখন? অঞ্জনা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সরে এল জানলার কাছে। চাঁদের আলোয় বকুলগাছের পাতাভর মাথাটা দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট। মাঝে মাঝে হাওয়ায় একটু যেন গন্ধও ভেসে আসছে।

কতক্ষণ যে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জনা তা জানে না। তবে মনে হল যেন আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। হাওয়া দিয়েছে, ভোরের হাওয়া। আর বাইরের ওই আশ্চর্য আকাশ তাকে হাতছানি দিচ্ছে। কে যেন নাম ধরে ডাকছে— চুপি চুপি, টোকা দিয়ে: অঞ্জনা, অঞ্জনা, অঞ্জু। (যাই—যাই। দাঁড়াও। মা উঠে পড়বে। একটু লক্ষ্মীটি, একটু দাঁড়াও। কোথায় গেল আবার চশমাটা। থাক বাবা, আর পারি না।)

ঘুম, সকলে অঘোর ঘুমে। দরজা খুলে পা টিপে টিপে অঞ্জনা বইরে এসে দাঁড়াল। বারান্দায় কেউ নেই, কেউ না। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশ্চয়ই। এত দুষ্ট। দাঁড়াও জব্দ করব আজ। বরাকর নদীতে বান দেখতে কিছুতেই যাব না সাইকেলের পেছনে। চিৎকার করব। পড়ে যাব।

গেট খুলে রাস্তায় এল অঞ্জনা। লাল কাঁকরের সড়কে পা দিল না। গাছের ছায়ায় ছায়ায় পথ কালো। মাঠের ঘাসে পা ফেলে কম্পাউণ্ড-ওয়ালের শেষ সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াল।

বকুলতলায় ও কে? শ্যামলদাই তো? গাছের আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইস্‌, ও যেন অন্ধ, কিছুই দেখতে পায় না। নাই বা থাকল চশমা। তবুও শ্যামলকে চিনতে কি কষ্ট হয়!

পা টিপে টিপে আসছে অঞ্জনা। হাওয়া বইছে ঝিরঝির। ঠাণ্ডা হাওয়া। শীত শীত করছে একটু। কাঁটা দিচ্ছে গা। গন্ধ, গন্ধ। কী মিষ্টি, কী সুন্দর। মন সিরসির করে। গন্ধে গন্ধে সারা জায়গাটা ভরা; মাঠ ঘাস, বাতাস, গাছ, পাতা। আর অঞ্জনাও। আবেশ চোখে নিশ্বাস নিচ্ছে। বুক ভরে ভরে, হৃৎপিণ্ডটাকে গন্ধ দিয়ে মুড়ে দেবে, ছেয়ে দেবে। ভরে রাখবে উনিশ বসন্তের সেই স্বপ্ন, সেই স্বর্গ।

বকুলতলার নিচে এসে দাঁড়াল অঞ্জনা। মাথার ওপর বকুলশাখার পাতা কাঁপছে। পায়ের নিচে ঘাস অসাড়। বরফের কুচি ঝরার মতো বুকল ফুল ঝরে পড়েছে। ঝরছে থেকে থেকে, নিঃশব্দে, চুপিচুপি।

আবার যেন ফিরে এসেছে অঞ্জনা। ফিরে এসেছে সেই মন-দেওয়া-নেওয়ার রাতে। আকাশ-বাতাস নিঝুম। পাশে শ্যামল। উষ্ণ স্পর্শ, দুটি হাত দুটি হাতে। ঠোঁট কাঁপছে, কথা কই! বুকে ঢেউ, তবু জোয়ার আছড়ে পড়ে না। শুধু চোখে চোখ, চাঁদের আলোয় ছলছল; তাতেই অনেক কথা বলা হয়ে যায়। (তোমাকেই ভাবি। সারাদিন তোমার কথাই মনে পড়ে।)

হেঁট হয়ে এক মুঠো ঝরা বকুল তুলে নিল অঞ্জনা। আশ্চর্য নরম; এক মুঠো সোহাগ। আস্তে আস্তে ঠোঁটের কাছে হাত নিল, পাপড়ি খোলার মতন আঙুলগুলো খুলে গেল, নাকে ঠোঁটে ছোঁয়া লাগল কটি ফুল। ভুরভুরে মিষ্টি ছোঁয়া, আলতো করে কেউ বুঝি ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছে। কি কাঁপছে থরথর, বুক না মুখ? কোথায় এক ছুঁচ-ব্যথা ফুটছে যেন, কে ফিসফিস কথা বলছে কানে কানে? (আর না—আর না—আর কিছু তুমি বলো না। বিশ্বাস কর, সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবি। আর কিছু ভাবতে পারি না। কেমন হয়ে যাচ্ছি যেন দিন দিন। এমন করে কি বাঁচব আর মরে যাব। আমি মরে গেলে কটা বকুলফুল দিও তুমি, শ্যামলদা। হাতের মুঠোয় দিও আগুনে পুড়তে যেন দেরি হয়।)

ভোর হয়ে এল; পাখি উড়ছে কি উড়ছে না। ডানা নাড়ছে। কিচ্‌মিচ্‌। আকাশ সাদা, শুকতারা বলছে যাই যাই। হাওয়া বইছে ঝিরঝির। বকুলতলায় চুপটি করে বসে রয়েছে অঞ্জনা। যেন সারা রাত গাছতলায় ঘুমিয়ে ছিল। এখন উঠে বসেছে—সর্বাঙ্গে ঘুম মেখে। নাকি অঞ্জনা পাথর হয়ে গেছে অহল্যার মতন। হয়ত তাই। অনেক সোহাগে গা মন ভরে, অনেক গন্ধ আর ফুল নিয়ে ও গাছপাথর হয়ে গেল এ-জীবনে।

—অঞ্জনা, অঞ্জনা।

কে ডাকছে কে? ঘোর চোখে তাকাল অঞ্জনা।

—কী করছ এখানে বসে? এখনও যে ভাল করে সকাল হয়নি। সুধাংশু নাড়া দিল অঞ্জনাকে।

চোখের ঘোর কাটল; অঞ্জনা ভাল করে দেখলে। সুধাংশু। চমকে উঠল, সারা গায়ে কাঁটা ফুটল। বুকটা ধকধক করছে। কোথায় ও? কখন এল?

—কি সাঙ্ঘাতিক! তুমি ঘুমোতে ঘুমোতে দরজা হাট করে রাস্তায় চলে আস? ওঠ, ওঠ, শীঘ্রি। সুধাংশু অঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করাল।

উঠে দাঁড়াল অঞ্জনা। উঠতে গিয়ে হাতের মুঠি অবশ হল, খুলে গেল আঁচল। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল একরাশ বকুলফুল ওরই পায়ে, ঘাসে। অঞ্জনা তাকাল। আঁচল ভরে এত ফুল ও তুলেছে। কখন? কেন? আশ্চর্য তো?

সুধাংশুরও চোখে পড়েছে। সেই বকুল ফুলই তো! অঞ্জনার চোখে চোখ রেখে তাকাল সুধাংশু। বকুল ফুলের মতোই সাদা তার মুখ। আশ্চর্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *