দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

বকরাক্ষস

বকরাক্ষস

খোকন-দা-আ-আ, খোকোনদা—রক্ত! রক্ত!

থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলুম। দোতলার বারান্দা থেকে শরীরের আধখানা গাছের ডালের মতো আধঝোলা করে অবিনাশ বলল, ভয় নেই। সোজা ওপরে চলে এসো। আসল রক্ত নয়, নাটকের রক্ত।

সাহস পেয়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলুম। নীচের কোনও একটা ঘর থেকে আবার সেই চিৎকার, কিশোরকণ্ঠের আতঙ্ক-আশ্রিত আর্তনাদ, রক্ত! রক্ত! পঁচিশ পাওয়ারের ফ্যাকাসে আলো পানাপুকুরের জলের মতো সিঁড়ি বেয়ে পাতলা স্রোতে নেমে এসেছে। চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা। ভিটামিনের ঘাটতিতে প্রায় রাতকানা। নীচে রক্তের ধারা বইছে, পা ঘষে-ঘষে ওপরে উঠছি। অসুস্থ অবিনাশের খবর নিতে।

কেমন আছ অবিনাশ ভাই!

গোটাকতক ক্যানভাস ব্যাগ, মরচে ধরা বিবর্ণ শিশু-দুধের টিন আর তেলচিটে এক সেট রেশন কার্ড হাতে গেরুয়া-পাঞ্জাবি গায়ে তোমাকে সাপ্তাহিক রেশনের লাইনে দেখছি না বেশ কয়েক সপ্তাহ। বাসের কিউতে তোমার টোল-খাওয়া মুখ একই সঙ্গে ধোঁয়া আর জ্ঞান উদগিরণ করছে না কতদিন। বাজারে তোমাকে মাছের পোস্টমর্টেম আর বাটখারার তলা এগজামিন করতে দেখছি না ইদানিং! তুমি কি ভাই সরে পড়ার তালে আছ!

ঘুঙুরের শব্দ পাচ্ছি যেন ! নীচে রক্ত, ওপরে ঘুঙুর। তার মানে তুমি মরবে না। মরো, মরো। গেঞ্জি-গায়ে বারান্দায় রেলিঙে পা তুলে বেতের গোল চেয়ারে মাথাটা পেছনদিকে ঝুলিয়ে অবিনাশ পেছনের আকাশের তারা গুণছে, এক তারা, দু-তারা, তারা তিন-চার। তা ধিন, ধিন তা, তা ধিন ধিন তা, না তিন তিন তা, তেটে ধিন ধিন তা—ঝুম। হল না, হল না, একমাত্রা শর্ট হয়ে গেল, পা মিলছে না, পা মিলছে না, আবার, এক দুই তিন চার, এক দুই তিন, স্টার্ট, ঝুমঝুম। অবিনাশের বড় বড় কাঁচা পাকা চুল, ঝুলঝাড়ুর মতো পেছনে ঝুলছে।

এটা তোমার কী পোজ বাবা! কত কায়দাই জানো!

অবিনাশের ঝোলা মাথা উলটোদিকের মোড়ায় বসতে-না বসতেই প্রশ্ন করল, ক’টা বাজে? সাতটা বাজতে মিনিটখানেক বাকি আছে। ধরো, সাতটাই। অবিনাশ বললে, আমাদের কৈশোরে সন্ধে সাতটার সময় বাড়িতে-বাড়িতে কী দেখতে? একটা থমথমে আবহাওয়া দেখতুম। এখনকার কালের কারফিউ জারি হলে শহরের যেমন অবস্থা হয়। আর কি দেখতে? চোখের সামনে দেখতুম পিতা কিংবা প্রবীণ গৃহশিক্ষকের প্রস্তরকঠিন মুখ। কী শুনতে? পলাশীর আমবাগানে ক্লাইভ, অ্যাঁ অ্যাঁ ক্লাইভ, পলাশীর আমবাগানে সিরাজউদ্দৌলা অ্যাঁ, অ্যাঁ। এখন কী শুনছ? রক্ত! রক্ত! ঘুঙরু কী বোল। আর একটু কান খাড়া করে আরও কিছু শোনার চেষ্টা করো, কী শুনছ! ম্যায় চুপ রহুঙ্গি, ম্যায় চুপ রহুঙ্গি, হি হি হি হি হি, হো হো হো হো। ঠিক শুনেছ। পাশের বাড়িতে টি ভি চলেছে। তারকার স্ত্রীলিঙ্গ কী হে? তারকার কোনও লিঙ্গ আছে কী? যে লিঙ্গে লাগবে তাতেই ফিট করে যাবে। যাক, তাহলে ভালোই। ওই টিভি-র কাঁচে এখন চিত্রতারকা নৃত্য করছেন। হোল-পাড়া ঝেঁটিয়ে এসেছে। আমার বাড়িরও একটি আছেন ওখানে।

অবিনাশের ঘাড় সোজা হয়েছে এতক্ষণে। ঘাড় সোজা করেই বললে, ওই শুরু হল। জ্বালিয়ে মারলে দেখছি। আবার কী হল? আর ওইটা তো আমার রোগ। ধরতেই পারছে না কেউ! সিমপটমটা তোমার কী হচ্ছে, বলো না! দাওয়াই কি সব সময় চিকিৎসকদের হাতেই থাকে! ভেটারেন রোগীদের হাতে অনেক মোক্ষম জিনিস থাকে। ওই জন্যে বাসে-ট্রামে-ট্রেনে-হাটে-বাজারে অসুখের কথা বলতে হয়। দেখলে না সেই থ্রি-সি বাসে যেই আমার দুরারোগ্য ব্রঙ্কাইটিসের কথা বললুম, সঙ্গে-সঙ্গে সেই নীলজামাপরা ভদ্রলোকের প্রেকক্রিপশন। প্রেসক্রিপশনে আমার কিছু হয়েছে! হয়নি। সাহস চাই অবিনেশ, সাহস চাই। তুমি তো বললে, ডাবের জলে ঘোল করে, সেই ঘোল ফুটিয়ে খেলে কী সব কেমিকেল রি-অ্যাকশন মি-অ্যাকসন হয়ে মরেই যাব, মরেছি? কী হয়েছে বলো।

তুমি কখনও দিনের বেলায় জঙ্গলের পাশ দিয়ে পথ হেঁটেছ! হেঁটেছি! অসংখ্য ঝিঁঝিঁ-র ডাক শুনেছ! মাথা সোজা করলেই আমার কানে সেই ঝিঁঝিঁ শুনছি। শুনছি মানে, আর কিছু শুনতেই পাচ্ছি না। এই ব্যাপার! এটা অসুখই, না দুর্বলতা। ভালো খাওয়াদাওয়া করো, একটা টনিক খাও, দিনকতক রেস্ট নাও, ঠিক হয়ে যাবে। আর একাল-সেকাল নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। কারুর বাপের ক্ষমতা নেই কালকে থামায়! শোনোনি, কালস্য কুটিলা গতি। দেখে যাও, সাক্ষীপুরুষের মতো স্রেফ দেখে যাও, আর মনে-মনে প্রার্থনা করে যাও, মঙ্গল হোক, মঙ্গল হোক, মঙ্গল হোক। কী বললে? অবিনাশ চিৎকার করে উঠল। ভুলেই গিয়েছিলুম, অবিনাশ অনবরত ঝিঁঝিঁ-র ডাক শুনছে। একটু জোরে কথা বলতে হবে। তা ছাড়া নাচের তেহাই আছে। অবশ্য জোরে কথাটা আবার বলার আগেই অবিনাশ বেতের চেয়ারটা আর একটু কাছাকাছি এনে বললে, দাঁড়াও তোমার সব কথা শুনতে পাব, আগে নিজের ঘাড়টাকে আবার মটকে দি। যে-রোগের যে-দাওয়াই, ঘাড় মটকালেই ঝিঁঝিঁ স্টপ। ঘাড় মটকে অবিনাশ মাথাটা আগের মতো পজিশানে নিয়ে এল। বলছিলুম সব ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামিও না, একটু অ্যালুফ হয়ে কর্তব্য করে যাও, আর মনে-মনে মঙ্গলচিন্তা করে যাও।

কার মঙ্গল? তোমার, তোমার পরিবারের, সমাজের, সংসারের, জগতের। ও, চিন্তা করে যাব, তাতেই কাজ হবে, বলব না কিছু, তাই তো! ঈশ্বরের ভূমিকা। তাহলে ঈশ্বর হয়ে যেতেই বা আপত্তি কী! ঈশ্বর অবিনাশ চন্দ্র। আজ কত তারিখ! মাঝামাঝি হল। নভেম্বরের চোদ্দো কি পনেরো। রানিং এগারোশো পঞ্চাশ বুঝেছ। বুঝলে কিছু! এগারোশো পঞ্চাশ টাকা শেষ। এগারোশো পঞ্চাশকে চোদ্দো দিয়ে ভাগ করো, ভাগফলকে পনেরো কি ষোলো দিয়ে গুণ করো। পকেটে নেই, বুঝলে, কলকাতার হাওয়ায় উড়ছে, ধরে আনতে হবে। আমাদের সময় এটাকে কী কাল বলত! শীতকাল। সে না, সে না, এটা হল পরীক্ষার কাল। আর বারো দিন, চোদ্দো দিন পরে সব ফাইনাল পরীক্ষা হবে। তাই তো! একজনকে হাবুদা ধরেছে, একজনকে হেমা মালিনী ধরেছে, আর একজনকে হেলেনে ধরেছে, আমাকে ঝিঁঝিঁ-তে ধরতে আর একজনকে যোগে ধরেছে, শেষ যে ছিল, তাকে ধরেছে ভবসাগর-তারণে।

এনে দে রেশমি চুড়ি নইলে যাব বাপের বাড়ি, স্টপ। বিশাল বিপুল যাত্রা অনুষ্ঠান। পাঁচ দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠান। ওই শোনো। পাঁচ দিন ব্যাপী এই উৎসবে পরিবেশিত হচ্ছে আধুনিক যুগের বেদব্যাস, যুগল হালদারের চক্ষু দিও না গেলে। খুন আছে, জখম আছে, প্রেম আছে, পুণ্য আছে, রহস্য আছে, রোমাঞ্চ আছে, ভোগ আছে, ত্যাগ আছে, দগদগে সামাজিক এই পালায় আর যিনি আছেন তিনি হলেন নৃত্য-জগতের বেপথু হুতাশন, সাড়া-জাগানো হৃদয়-মোচড়ানো, হাড়ে দুব্য-গজানো মিস, মিস পামেলা। এরপর পতির মুখে আগুন, পালাসম্রাট পাঁচুগোপাল কর্মকার, এরপর পরপর সতীর মুখে ছাই, রেভলিউশান, চিমনির ধোঁয়া, সিজন টিকিট পঁচিশ, ডেলি দশ, পাঁচ, দুই। এনে দে রেশমি চুড়ি নইলে যাব…।

কী বলছিলে—ধরেছে, ধরেছে। ক্লাশ নাইনকে ধরেছে হাবুদা। নীচে রক্ত-রক্ত করছে। এপাড়ার সংস্কৃতির পীর পয়গম্বর। সারা দুপুর, ওই দ্যাখো আমি অঙ্ক কষে কষে মরচি। তিনি কখন এদিকে একটু দয়া করবেন, হাবুদাই জানেন। হু ইজ অবিনাশ? সোস্যাল ক্যালকাটায় অবিনাশরা হল মিডফাদার। ওয়াইফের পুংলিঙ্গ তো ফাদার। ওর এডুকেশানে মাসে দুশো টাকা, ভরণপোষণে আরও একশো, তিনশো ইনটু বারো মা-গঙ্গার জলে। মঙ্গল-চিন্তায় খরচটা একবার হিসেব করো, মানিক। দুবার লাট খেয়ে বড় মেয়ের ধারণা হয়েছে, তাঁর আসল প্রতিভা হল স্ক্রিনে। তিনি হেমা হচ্ছেন। আমি এদিকে হে মা! হে মা! করে ছেলেধরার ডিপোজিট বাড়াচ্ছি নিজের ভিটামিন নিজেই গ্যাঁড়া করে। ধরলে হয় তো আমাকে সেই কাঞ্চনমূল্যে আমার সান-ইন-লকে তুলতে হবে। বস্তুটিকে বাজিয়ে নেওয়ার আর অবকাশ রাখলে না। পাশের ঘরে আর এক মিস পামেলা তৈরি হচ্ছে। সাতদিন পরেই তার স্কুলের পরীক্ষা, গানের পরীক্ষা, নাচের পরীক্ষা, যোগ-প্রদর্শনী, নৃত্য-প্রদর্শনী। ভালোই তো হে! সব ক’টা লাইন একসঙ্গে খুলে যাচ্ছে। একাধারে লক্ষ্মী, সরস্বতী, রম্ভা, তিলোত্তমা! অবিনাশ হিহি করে হেসে বললে, ফলেন পরিচীয়তে। সেই বেতসপত্রীকে একটু পরেই কোরামিন দিয়ে দেড়শো টাকার শিক্ষকের কাছে পড়তে বসাতে হবে। নস্যির ডিবে-হাতে গৃহিণী থাকবেন পাহারায়। প্রেম চলবে না, ঘুম চলবে না, চলবে শুধু পড়া।

মেজোভাই, তিনি শীর্ষাসন করতে গিয়ে গলায় স্ট্রাস বেঁধে পড়ে আছেন সাতদিন। ঘাড়ের খিল খুলে গেছে। সামনের মাঘে বিয়ের দিন ঠিক। ঘাড়-ভাঙা জামাই আর কি কেউ নেবে! দাদা! লিভার, পিলে, কিডনি, হার্ট মাঝে-মাঝে উলটে দিয়ে দ্যাখো, সব রোগ সেরে গিয়ে তুমি একটা বিউটিফুল বাটারফ্লাই হয়ে গেছ। হোল ওয়েস্ট ইস্ট সাধে যোগ-যোগ করে খেপে উঠেছে। মর্ডান ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটির একমাত্র প্যানেসিয়া যোগ। সেই যোগে তার মুণ্ডু বিয়োগ হয়ে গেছে। সোনার এখন কত ভরি হে! ছশো-টশো হবে। অবিনাশ অনামিকাটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, কতটা আছে বলে মনে হয়, ভরিটাক হবে! হতে পারে। সামনের স্টেশনারি দোকানটা দেখছ। আসলে বন্ধকীর কারবার। আর একটু পরে একশো গ্রাম চানাচুর কেনার ছুতো করে যাব। তারপর আঙুলে দাগটাই থাকবে কিছুকাল বিয়ের স্মৃতি হয়ে। নভেম্বর বড় সাংঘাতিক মাস হে, হিম, গরম-ঠান্ডা, চাঁদা, ভাইফোঁটা, টিউশান ফি, স্কুল ফি, পরীক্ষার ফি, আরও কত কী!

অবিনাশের স্ত্রী এসে পিচিক, পিচিক করে গায়ে জল ছিটিয়ে দিলেন ছোট্ট একটা তামার ঘটি থেকে। একটা শিশি থেকে ড্রপারে করে কানে দু-ফোঁটা তেল দিয়ে চলে গেলেন। জলপড়া, তেলপড়া। গুরুদেব বলেছেন—ওই ঝিঁঝিঁ হল অন্তরাত্মার ক্রন্দন—দাও ফিরে সে অরণ্য, দাও ফিরে সে অরণ্য।

অবিনাশ অপ্রকট হলেন। শহর তাঁর হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ করে দিয়েছে। যাওয়ার আগে ছেলের অঙ্কর খাতায় লিখে গেছেন, ভবসিন্ধুর ওপারে চলিলাম। যাইবার পূর্বে সূক্ষ্ম শরীরে এই শহরের বিভিন্ন পরিবারে একটি স্যাম্পল সার্ভে করিয়া বুঝিলাম, শহর বকরাক্ষসে ভরিয়া গিয়াছে। প্রতিটি পরিবার প্রতিদিন তাজা-তাজা প্রাণ, সংস্কৃতির বক, রাজনীতির বক, সমাজসেবার বক, ধর্মের বক, ব্যাবসায়ের বক শাসক, শোষক বকেদের উৎসর্গ করিয়া দিতেছে। যে লোকে চলিলাম সেখানে গিয়া যদি সম্ভব হয় কয়েকটি ভীম পাঠাইবার চেষ্টা করিব, যাঁহারা দুখিনী ব্রাহ্মণীকে বলিবেন—মা কেঁদো না, তোমাদের সন্তান তোমাদের ঘরেই থাক। আমি ভীমসেন চলিলাম বকরাক্ষসকে তাহার আহার্য পরিবেশনে। বেশ বুঝিয়াছি, ইহা একটি ভীমের কর্ম নয়, শত-শত ভীম ওপার হইতে ডেসপ্যাচ করিতে হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *