বকম বকম – প্রদীপ আচার্য
খোপের ভেতর পায়রা দুটো এক হলেই বকম বকম। ওড়ার প্রবল নেশা। আকাশ কোথায়? উড়বে যে? ফ্ল্যাট বাড়ি। বলতে গাল ভরা। আসলে তো পায়রার খোপ। খোপের ভেতর শুধু দুটো পায়রা। সুমন আর নীতা। পায়রা হতেই সুমন গোবরডাঙার বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে এসেছে। সাধ করে বাইপাসের ধারে এই নিরিবিলি ফ্ল্যাটটা নিয়েছে।
বাপের ভিটেতে ভিড়েভাট্টায় দাম্পত্য জমে না। চঞ্চতে চঞ্চতে ঠোকাঠুকি আর বকম বকম জমে না। ভাল খাওয়াদাওয়া জমে না। গনাগুষ্টির মুখে না তুলে রসনাতৃপ্তি সম্ভব নয়। বাধাবন্ধনহীন, স্বাধীন আয়েসি ঘুম জমে না। রোববারে বেলা দশটায় সূর্যির মুখ দেখার সুখ নেই। এক কথায় সুখের মুখ দেখা বনধ। সুমন বলে, ছোট পরিবার ব্যাকডেটেড। অণুও নয়। চাই ক্লিয়ার আই মিন পরমাণু পরিবার। তা সেই পরমাণু পরিবারে পায়রা হয়ে আছে সুমন আর নীতা। আর শুধু বকম বকম, বকম বকম।
কাল রাত থেকে বকম বকম বন্ধ। শোওয়ার পরে কাল রাতেই কথাটা বলেছে সুমন। সুমনের কথাটা যেন বন্দুকের টোটার মত উড়ন্ত পায়রার ডানা বিদ্ধ করল। কেতরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল অসহায়, আহত পারাবত। সুমনের রূপসী বউ নীতা। প্রায় প্রতি মাসেই এই এক হ্যাপা। কথাটা পাড়তেই হয়। অথচ পরম্পরায় এই একই চিত্রনাট্য। রকমফের নেই কোনও।
এখন গড়িমসির সকাল। অফিসের তাড়া নেই আজ। মুখে মেঘ নিয়েই চা করে দিয়েছে নীতা। সুমন খবরের কাগজের আড়াল সরিয়ে সন্তর্পণে তাকিয়েছে। কিছু বলার ঝুঁকি নেয়নি। অন্য দিন হলে কাগজ হাতে চায়ের কাপে চুমুক জমালে তপ্ত কড়ায় ফুটতে থাকে কথার উড়কি ধান। কোন জল কোনদিকে গড়াচ্ছে, কোন ধামার নীচে কোন তদন্ত কমিশন, লাল ফিতের ফাঁসে কোন রিপোর্ট, কোন প্রকল্প বিশ বাঁও জলে, কাদের স্বার্থে এবারের বাজেট—সব মিলিয়ে হাতে মিনিট পনেরো সময়। কাগজ যত না পড়া, তার চেয়ে বেশি বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ। নীতা বলে, রক্ষে করো বাবা। ওসব অত বুঝি না। বুঝতে চাই না।
সুমন হাসে। মনে মনে বলে, সেই ভাল। রূপচর্চা আর রান্নার রেসিপি। মেয়েরা এর বেশি বুঝতে শুরু করলে সুমনের মতো পুরুষ সিংহেরা ভেড়া হয়ে যাবে। সুমন জানে বাইরের টান বড় সর্বনেশে। স্বাধীনতার স্বাদ চেখে দেখার সুযোগ দিলে নীতার মতো রূপসীদের ওপর ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলকে উঠতে পারে। বেশি এনলাইটেন্ড না হওয়াই ভাল। তাতে ভালমন্দর বিচারবুদ্ধি প্রখর হয়। জাগ্রত হয় স্বতন্ত্র রুচিবোধ। উরিব্বাস! পুরুষের এমন ঘোর সর্বনাশ আর হয় না! বই আর বউ ভাই সামাল সামাল। বুক শেলফ-এ বন্দি থাকুক বই। আর বউ বন্দি থাকুক হেঁসেলে। বউয়ের দৌড় হোক বড়জোর হেঁসেল টু বেডরুম। এসব ভেবে মনে মনে ফন্দিবাজের মতো হাসে সুমন।
.
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয়। ফস করে একটা সিগারেট জ্বালায়। তোয়ালে কাঁধে ফেলে টয়লেটের দিকে পা বাড়ায় সুমন। বেডরুমের দিকে একঝোঁক নজর চালে। নীতা নিঃসাড়ে শুয়ে আছে। যেন অপার অনুকম্পা হল। অসহায়তা যেন সকরুণ ছাপ ফেলল নিরুপায় সুমনের চোখেমুখে। ঠোঁটে সিগারেট চেপে টয়লেটে ঢুকে পড়ে সে।
আজ অফিসের তাড়া নেই। অন্য দিন সুমন পায়রা দশটার অফিস ধরতে উড়াল দিলে নীতা সারাদিন ঠায় একা। ফাঁকা ফ্ল্যাটের চার দেওয়াল তখন রে-রে করে তেড়ে আসে। কেবল নেটওয়ার্কের দৌলতে সারাক্ষণ টিভি চলে। মন দিয়ে দেখে না কিছুই। বু চলে। হাবিজাবি একশো চ্যানেল। আসলে নৈঃশব্দের আর এক নাম অন্ধকার। ফাঁকা ফ্ল্যাটে সেই অন্ধকার একেবারে ঘুটঘুটি। হাঁপিয়ে ওঠে ফাইভ হান্ড্রেড পার্সেন্ট হাউস ওয়াইফ নীতা।
চিলচিৎকারে পাছে বকম বকম চাপা পড়ে যায়, তাই তিন বছর ঘুরলেও সন্তান চায় না সুমন। নীতাও জোর করে না। নীতার তেল চকচকে পালকের জৌলুস পাছে। কমে যায়। পাছে রং ফিকে হয়। সেই ভয়। তা ছাড়া নীতা জেনে গেছে পুরুষের মধ্যে সন্তানের নেশা জাগাতে নেই। সন্তান মানে তো ছেলে চাই। ওই ছেলে চাইতে গিয়ে মিতুদির তিন মেয়ে। এখনও তাড়না করে অলকদা। বলে, নাকি বংশরক্ষা হবে না। কী হরিদাসের বংশ রে তোর? মেয়েরাই ছেলে তৈরির কল? বকম বকম করতে করতেই নীতা ঠারেঠোরে সুমনকে এ শুনিয়েও রেখেছে। তাই ওদের স্বপ্নের মতো সাজানো বেডরুমে স্বর্গীয় পারিপাট্য। রাবার ক্লথ বিছানার কৌলীন্য কাড়তে পারেনি।
টিভিটা যেন দাঁড়ে পোষা ময়না। অনর্গল কথা কয়। সেই কথার তোড়ে, ফাঁকে ফাঁকে কমার্শিয়াল ব্রেক, বিজ্ঞাপনের কোলাহলে একাকিত্ব কাটে। নইলে নিজের পায়ের শব্দই যেন তাড়া করে আসে। খোপের পায়রা ওরা দুজনই। থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারের প্রেজেন্স পছন্দ নয়। বন্ধুবান্ধরে ঝুটঝামেলা ফ্ল্যাটে বয়ে আনে না সুমন। কৌশলে এড়িয়ে যায়। সকালে দুধ নিয়ে আসে ঢ্যাঙা পন্টু। নীতা দরজায় এক বোতল ফাঁক করে। পন্টু দুধের বোতল গলিয়ে দেয়। সঙ্গে খবরের কাগজ। ব্যস নিমেষে পগারপার। সবিতা আসে পাক্কা সাতটায়। ডোর বেল বাজে ডিংডিডং। দরজা খুলে দেয় নীতাই। সুমন তখনও বিছানায়। কাজ সেরে আটটা নাগাদ সবিতা ওর আঁচলে হাতের জল আর মুখের ঘাম মুছতে মুছতে নামে। নীচে এক ঘর সিক্কিদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢোকে। দশটার মধ্যে সুমন নাকে মুখে গুঁজে ডানা মেলে দেয়। তারপর ঘড়ির কাটা বেঁকে বসে। খরগোশ কাটা যেন কচ্ছপ হয়ে যায়। চলতেই চায় না। সারাদিনের জমে থাকা কথার বরফ তাই রাত্রে উত্তাপে গলাতে থাকে নীতা। বকম। বকম। বকম বকম।
কাল রাতেও চলছিল বকম বকম। তাল ঠুকছিল সুমন। কিন্তু আচমকা তালভঙ্গ হল। ছত্রখান হয়ে গেল নীতার তাবত আয়োজন। কথাটা তখনই বলেছে সুমন। বলতে হবেই। না বলে উপায় কী?
টয়লেট থেকে বেরিয়ে সুমন দেখল ব্রেকফাস্ট রেডি। বাটার টোস্ট, পোচ, সঙ্গে মজা মর্তমান। খোসা ছাড়ানো। খাবার টেবিলের কাছে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল নীতা। সুমন বেরতেই ক্ষীণস্বরে বলল, খাবার দিয়েছি। তুমি খাবে না? জবাব পেল না সুমন। নীতা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। পরদা এমন সরানো থাকলে খাবার টেবিলে বসে কর্নিয়ার ক্যামেরায় বেডরুমটা বিলক্ষণ ধরা পড়ে? ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে নীতা। ঝঝ বোশেখ এখন। সকাল আটটা, নটার রোদেই তেতে উঠেছে ব্রহ্মাণ্ড। বেডরুমের সিলিং ফ্যানটা বড় বেয়াড়া পজিশনে ঝুলছে। বিছানা ইস্তক হাওয়ার দৌড় নেই। তাই শখের পেডেস্টাল এল। ঠায় দাঁড়িয়ে নীরবে ঝড় তুলে দেয়। দেখনদারিও বেশ। সেটারই বোতাম চেপে শুয়েছে নীতা। হাওয়ার দাপটে দেওয়ালে দোল খাচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ।
কাল রাতে অমনোযোগী সুমন ধরা পড়ে গেল।
নীতা বলল, তোমার শরীর খারাপ নাকি?
নাহ্। কই তেমন কিছু না।
তবে? কিছু ভাবছ তুমি? বলল কী ভাবছ?
না, ভাবছি ঝামেলা আবার আমার ঘাড়ে চেপেছে। সুমনের চোখে অসহায় কষ্টের ছাপ। নীতা উদ্বিগ্ন হল। উঠে বসল। বলল, ও বুঝেছি। কবে যাচ্ছ? কথা কেঁপে গেল নীতার। কালকে যেতে হবে। মালহোত্রা ইনটেনশনালি আমাকে..নইলে দেবেশও তো আছে। এক-আধবার নয় তাকেই…কিন্তু তুমি…কথা লাট খায় সুমনের। বোঝে মেঘলা হয়ে আসছে। সেই থেকে বকম বকম বন্ধ।
সেলস-এ থাকলে ঘরকুনো হলে চাকরি ছাড়তে হবে। অফিস ট্যুরে কি বেড়ানোর মজা আছে? নীতা বোঝে না সেটা। হয়তো বোঝে। আসলে মাঝেমধ্যেই কদিন করে বাপের বাড়িতে গিয়ে কাটানো অসহ্য লাগে নীতার। তিন বছর ঘুরতে চলল। নীতার বাবা শচীনবাবুর ঘাড় এখনও কাত। বাবাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে নিজের পছন্দের বিয়ে। যে বাড়িতে স্বামীর স্বীকৃতি নেই, সে বড়িতে গায়ে পড়ে গিয়ে থাকতে বাধে। নিজেকে খাটো মনে হয়। সুমন তা বোঝে। তাই অফিস ট্যুর শুনলেই মেঘ ঘনিয়ে আসে। বকম বকম বন্ধ।
তা ছাড়া বুঝেও অবুঝ হওয়ার নামই যেন দাম্পত্য। নীতা অবুঝ হবে। সুমন। সোহাগ ঢেলে হবে। সেটুকুই নীতার দিন তিনেকের সম্বল হবে। সুমনও ভরে দিয়ে যায় সেই সম্বলের ঝুলি। সুমনের পাগলের মতো আদরের অত্যাচারে অবাক হয় নীতা। বলে, অসভ্য। অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট। আসলে আমি একটু বুনো হতে চাই। তবে হিংস্র নয়।
তোমার এই বুনো ভাব দেখলে কেউ বলবে আমাদের তিন বছর বিয়ে হয়েছে?
নীতা একভাবে শুয়ে আছে। ওর মাখন রঙের ফিনফিনে নাইটিতে পেডেস্টলের হাওয়া দৌরাত্ম্য করছে। হাওয়ার চাপে ছাপ পড়েছে। পদ্মের মতো স্পষ্ট ফুটে আছে নীতার গড়ন সৌষ্ঠবে ভরা নিতম্ব। একটু বুনো হতে সাধ হয় সুমনের। কিন্তু আজ তা হয় না। নীতার মর্জি এখন সায় দেবে না। তা ছাড়া সাতসকালে অত কিসের তাড়না? নিজেকে শাসায় সুমন। শব্দ তুলে চেয়ার সরিয়ে খাবার টেবিল থেকে শান্ত পায়ে উঠে যায় সে। নীতার ছড়ানো চুলে আলতো হাত রাখে। আঙুলের কাজে এলো চুল গুছিয়ে দেয়। বলে, তোমায় দেখে কে বলবে আমাদের তিন বছর বিয়ে হয়েছে?
জবাব দিল না নীতা। সুমন বলল, এবার আমি নিশ্চয়ই অপোজ করব। মালহোত্রা তেমন জোর করলে আমি রিজাইন করব, তুমি দেখে নিও। নীতা চকিতে সুমনের চোখে তাকায়। কষ্ট হয়। মানুষটাকে এত অসহায় লাগেনি কখনও। নিজেকে সামলে ক্ষীণস্বরে নীতা বলল আমি কি তাই বলেছি?
সব গোছগাছ করে বিকেল পাঁচটা নাগাদ দুজনেই বেরিয়ে পড়ল। সুমন ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি ঘোরাল। বেরুনোর মুখে নীতা ফের মুখ বার করল। সুমন নীতার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল, ফিরেই ও বাড়িতে ফোন করব। তুমি ভেবো না। নীতার ভেজা চোখে একঝলক হাসি রোদ হয়ে গড়িয়ে গেল।
.
বাইপাসে ট্যাক্সির আকাল। তবু বরাতজোরে পেল একটা। উঠে পড়ে নীতা। ওদের ফ্ল্যাটের সব বাসিন্দা এসে গেলে একটু জমজমাট হত। একা থাকা যেত। হয়তো। কিন্তু এখন ভাবতেই শরীর হিম হয় নীতার। ড্রাইভার মিটার ডাউন করল। ক্লাচ অ্যাক্সেলে ড্রাইভার পা নাচাতেই ছুটে গেল ট্যাক্সিটা। নীতা জানলায় ঝুঁকে পেছনে সুমনকে দেখার চেষ্টা করল। হাত নাড়ল সুমন।
সুমনের ছোট্ট লাগেজ। একদম হালকা। চাপা খুশির দমকে লাগেজটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল। যাক আর কোনও বাধা নেই। ফালতু ঝঞ্ঝাট পার হয়েছে। সুমন পায়রার বুকের খাঁচায় এতক্ষণ ডানা ঝাঁপটাচ্ছিল অযুত পায়রা। দারুণ উচ্ছ্বাসে খাঁচা ছাড়া হয়ে তারা এখন কঁক বেঁধে বেরিয়ে আসছে। আরও একটা ট্যাক্সি যেন উড়েই এল। ‘হেই ট্যাক্সি’ আওয়াজ তুলে ওটাকে থামাল। নিজেকে সেঁধিয়ে দিল ট্যাক্সির পেটে। সোজা গিয়ে উঠল সতীর ফ্ল্যাটে।
সতী সবে ফিরেছে অফিস থেকে। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। সুমনকে বসতে বলে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল সতী। উত্তেজনা নিয়ে বসে থাকে সুমন। সতী এই ফ্ল্যাটে একা থাকে। সুন্দর সাজানো। উত্তরপ্রদেশের মেয়ে সতী। এখন বাঙালি মেয়েই বুঝবে সবাই। একটা নামী কোম্পানির কম্পিউটারের সিস্টেমে আছে। সতী ডিভোর্সি। নীতার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ ওর শরীরে। একটু একটু করে ভাঙিয়ে খেতে মজা। সুমন তাই করে। সতীও বোঝে সুমনটা ভীষণ লোভী।
ঘরময় ঝলমলে আলো। মাথার ওপর বিজলি পাখার সোঁ-সোঁ চক্কর। সতী ওর লোকাট গাউনটা জড়িয়ে একবার এ-ঘরে এল। সুমনের মত নিল। চা না কফি? সুমন বলল, না, না, চা নয়, কফি নয়। আগে দু পাত্র ঢালব। উফ যা গেছে কাল থেকে।
এবার কদিন বলে এসেছ?
কেন? তিন দিন! তিনদিনই তোমার টানা ছুটি। ফোনে তো তাই বললে।
সতী পাত্র সাজিয়ে হুইস্কি ঢেলে দিল। বসল সুমনের মুখোমুখি সোফায়। সুমন বলল, তুমি নিলে না? আমি এখন একটু চা করে খাব। সুমন চুমুক জমায় হুইস্কিতে। সতী উঠে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। মেঝেতে শ্লিপারের ঘষ্টানি। সতীর চলায় একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে। সুমন হুলো বেড়ালের মতো সতীর পেছনটা লক্ষ করে। থাবা দিয়ে গালের কষ বেয়ে পড়া হুইস্কি মুছে নেয়।
খানিকবাদে চা হাতে ফেরে সতী। চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, এ সময় নিজে চা করে খেতে ইচ্ছে করে না।
ঠিক আছে কাল বেড-টি করে খাওয়াব।
বউকে কখনও করে খাওয়াও?
ধুর দরকার হয় না।
একটা সোজা সরল বউ পেয়ে বর্তে গেলে। সতীর একথায় সুমন যেন বা সামান্য আহত হয়। বুঝে চকিতে মুড পালটে নেয় সতী। হাত বাড়িয়ে সুমনকে কাছে টানে। বলে, রাগ করলে? তোমার বউ সোজা সরল না হলে তোমাকে এভাবে ছিনিয়ে এনে রাখতে পারতাম? সতীর কথা কিছু কানে যায় না সুমনের। আদুরে খোকার মতো নাক গুঁজে দেয় সতীর চুলের অরণ্যে। সতীর ছাড়া চুলে হেয়ার স্প্রের অদ্ভুত মায়াবী গন্ধ। আবেশে মেঝেয় কার্পেটের ওপর বসে পড়ে। সতীর কোলে মাথা এলিয়ে দেয়। সুমনের চুলে সতীর ম্যানিকিওর করা আঙুল ডুবে যায়। বিলি কাটে সতী। বলে, তুমি একটুও হ্যাপি নও। ডিভোর্স চাইছ না কেন?
আঁতকে ওঠে সুমন। ডিভোর্স কেন? নীতা ওকে ভালবাসে। বিশ্বাস করে। কেতাবি ভাষা অনেক সময় ভাঙিয়ে বুঝতে হয়। কিন্তু নীতার মুখরিত দু চোখ যে ভাষা উগরে দেয়, সে ভাষা ভাদ্রের দিঘির জলের মতো স্বচ্ছ। সুমনের মতো স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষেরা সে ভাষার বিশারদ। নীতার চোখে তাকিয়ে সুমন শুনতে পায় ওর বাত্ময় দু চোখের মৌন উচ্চারণ। সতীর শরীরটা সুমনকে পতঙ্গের মতো টানে। শাসন মানে না।
হুইস্কির গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে প্রসঙ্গ পালটায় সুমন। এই তিন দিন সূর্যের মুখ দেখব না সতী। তোমার কোলে শুয়ে থাকব কচি খোকার মতো। দুগ্ধপোষ্যের মতো। আর আমি ফিডিং বোতলে মদ ভরে খাওয়াব তোমাকে। তাই তো?
এগজাক্টলি সো। স্টক রেখেছ তো?
রেখেছি। বলেই সতী ভাবে এই তো সুযোগ। এই সুযোগেই ব্যাপারটা গুছিয়ে নিতে হবে। নীতা কেমন গুছিয়ে সংসার করছে, তা একবার অন্তত দেখতে চায় সতী। ভীষণ কৌতূহল। সুমনকে তা জানতে দেওয়া যায়? অথচ নীতার সংসারটা একবার দেখলেই নয়। তা ছাড়া একটা মেয়ের পরম সম্পদই যখন তার হাতের মুঠায়, তখন সেই মেয়ের সংসারে তিনদিন অন্তত রাজত্ব করার অধিকার তারও আছে। তাই বলল, সুমন তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে।
পরামর্শ! আমার সঙ্গে? বলল না।
বলছি, অফিসের দাস বুড়ো ভামটা পেছনে পড়েছে। তিন দিন ছুটি। গন্ধ শুকতে শুকতে ফ্ল্যাটেও এসে পড়তে পারে। তারপর তোমাকে আমার ফ্ল্যাটে দেখলে বিশ্রী স্প্রেড করবে।
তা হলে?
চলো না আউটিং-এ যাই।
ধুর পোষাবে না।
তা হলেতোমার ফ্ল্যাটেই চলো। বউ তো নেই। আমিই না হয় কদিন তোমার বউ-এর রোল-প্লে করে আসি। কী বলো?’ আসল উদ্দেশ্যটাকে এত হালকা চালে উগরে দিতে পারবে নিজেও ভাবেনি সতী। পাছে ধরা পড়ে যায় তাই পালটা তৎপরতা নেয়। বলে, অবশ্য তোমার অসুবিধে হবে। প্রতিবেশীরা আছে না! থাক।
ধুর প্রতিবেশী। গোলি মারো। কেউ কাউকে চিনি না। তা ছাড়া বেশিরভাগ ফ্ল্যাটেই বাসিন্দা আসেনি। আমার উলটোদিকে তত তালায় জং পড়ে গেছে। তাই ও নিয়ে ভাবি না। কথা শেষ করে খানিক গুম মেরে থাকে সুমন। সতী খুবই সতর্ক নজর রাখে সুমনের দিকে। বলটা সুমনের কোর্টে খুবই সন্তর্পণে ঠেলে দিয়েছে সে। সুমনকে আর ঘাঁটায় না। সুমন ভাবতে থাকে। ভাবে, সতীর মতো একটা নষ্টা মেয়েকে সে তার বেডরুমে নিয়ে তুলবে? মনটা খচখচ করে। তাই বলে, দাস এসে পড়তে পারে। এটা তোমার আশঙ্কা। নাও তো আসতে পারে।
শোনো সুমন, এসব পুরুষদের চিনতে ভুল হয় না আমার। কোনও না কোনও ছুতোয় দাস আসবেই। এবার আমাদের অন্তত এই ফ্ল্যাটে থাকা চলবে না। চলো আউটিং-এ যাই। দীঘা যাবে? সুমন চিবুক শক্ত করে। বলে, ঠিক আছে, চলো আমার ফ্ল্যাটেই যাই।
পরদিন খুব ভোরে সুমন ওর ফ্ল্যাটে চলে এল। তিনতলাটা একেবারে ফাঁকা। নিঝুম। সুমনের তর সইছিল না। চাবি বার করে ফ্ল্যাটের তালা খুলতে খুলতেই সতীর কোমর জড়িয়ে নিচ্ছিল। বাধা দেয় সতী। চোখ পাকিয়ে শাসনের ভঙ্গি করে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, আগে ভেতরে চলো, অসভ্য।
ফ্ল্যটের দরজা খুলে ভেতরে পা রেখেই সুমন আর সতী পাথর হয়ে গেল। বেডরুম থেকে ভেসে আসছে বকম বকম। ঠোঁটে তর্জনী চেপে সতীকে ইশারা করে সুমন। বেডরুমের দরজায় সুতো ফাঁক। ভেতরে নজর চেলে দেয়। দেখে ওদের বিছানায় একটা লক্কা পায়রা। সেই লক্কা পায়রার লোমশ বুকে ভোলা বুকের ভার ছেড়ে দিয়ে বকম বকম করছে সুমনের সোজা সরল বউটা। রাতের ঘনিষ্ঠতা ওদের কাটেনি এখনও। সুমনকে সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতে যাচ্ছিল সতী। এক হ্যাচকা টানে সতীকে সরিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে আসে সুমন। দরজা খোলাই পড়ে থাকে। সতীর কাঁধে ভর দিয়ে তরত্র করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে সুমন। আর অবাক হয়ে ভাবে, ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবিটাও তো নিজের কাছেই রেখেছে সে। নীতারা ভেতরে গেল কী করে?