বউ কথা কও
এই রচনার নাম হওয়া উচিত ‘বর কথা কও’। কিন্তু যেহেতু ‘বউ কথা কও’ একটি সর্বজনবিদিত সুকণ্ঠী পাখি আছে, তাই নামকরণে সেই বিখ্যাত বিহঙ্গকে উড়িয়ে আনলাম।
ভণিতা বেশি করে লাভ নেই।
মূল খবরটি রীতিমতো ফলাও করে প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না।
সংবাদটি এসেছে খোদ চিন দেশ থেকে, সেখানকার রাজধানী পিকিং তথা বেজিং থেকে প্রেরিত সংবাদ এটা। সমাজতান্ত্রিক দেশের থেকে আসা সুতরাং বিশ্বাস করতেই হবে। সংবাদটি প্রথম বেরিয়েছে, বেজিং ইভনিং নিউজ নামক দৈনিক সান্ধ্য পত্রিকায়, সেখান থেকে উদ্ধৃত করেছে প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া।
সংবাদটির বিশ্বাসযোগ্যতার সম্পর্কে কারও মনে কোনও সন্দেহ না দেখা দেয় তাই এত কথা বলতে হল।
এবার মূল ঘটনায় যাই। দুঃখ ও আনন্দ মেশানো এমন চমকপ্রদ কাহিনী গল্প-উপন্যাসেও মিলবে না। বলিউডি সিনেমায় কিংবা চিৎপুরের যাত্রায় হয়তো এর কাছাকাছি গল্প পাওয়া যেতে পরে।
ঘটনাস্থল হল পূর্ব চিনের জেসিয়াং প্রদেশের একটি মফস্বল শহর। কাহিনীর নায়ক হলেন শ্ৰীযুক্ত লি নেংলৌ।
নেংলৌ সাহেবের ঘটনাটি অতি সংক্ষিপ্ত করে বলছি।
একদা, সে বহুকাল আগে নেংলৌ সাহেবের বিয়ে হয়েছিল। সে বিয়ে কতদিন স্থায়ী হয়েছিল, কিংবা কী কারণে ভেঙে যায় সেসব কিছু জানা যাচ্ছে না, তবে খবর পাওয়া গেছে, আজ থেকে একুশ বছর আগে সেই উনিশশো ছিয়াত্তর সালে শ্রীযুক্ত লি নেংলৌর আগের বিয়ে ভেঙে যায়।
এই প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর শ্রীযুক্ত নেংলৌ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন। বোধহয় বিবাহ-বিচ্ছেদের বেদনাতেই তিনি মূক হয়ে যান। সেই উনিশশো ছিয়াত্তর সালের পরে নেংলৌকে কেউ কখনও কথা বলতে দেখেনি। কথা বলেননি তিনি, সেই যাকে বলে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া, নেংলৌ সাহেবের তাই হয়ে গিয়েছিল। তিনি বাকশক্তিরহিত হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সম্প্রতি ঘটনা এক রোমাঞ্চকর বাঁক নিয়েছে। নেংলৌ পুনর্বিবাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই বিয়ের দিন বিয়ের আসরে এতদিনের শোকভার লাঘব করতে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নেংলৌ সাহেব প্রচুর মদ্যপান করেন।
মদ্যপান করতে করতে হঠাৎ নেংলৌ সাহেব উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে সুদীর্ঘ একুশ বছর পরে কথা বলতে শুরু করেন। ঝরঝর করে কথা বলে যান তিনি, সঙ্গে অঝোরে কান্না।
নেংলৌ সাহেব আবার কখনও কথা বলতে পারবেন, তাঁর আত্মীয়স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা একথা কখনও আশা করেনি। সাশ্রুলোচন, সবাক নেংলৌকে এতটা আবেগবিহ্বল আগে কখনও দেখা যায়নি।
এই ঘটনায় প্রতিবেদক প্রশ্ন করেছেন, কারণটা কী হতে পারে:—
(১) অতিরিক্ত মদ্যপান।
(২) বিবাহবিচ্ছেদের নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি।
(৩) পুনর্বিবাহের আনন্দ।
আমার মনে হয় এই তিনটি কারণই একত্র হয়েছিল এই ক্ষেত্রে।
তবে এক অর্থে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। বিবাহিত জীবনে অনেকে রুদ্ধবাক হয়ে যায় কিন্তু বাকশক্তি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। আর ফিরে পেয়েই বা ফয়দা কী? বিয়ের পর কয়জন পুরুষমানুষই বা কথা বলার স্বাধীনতা পায়।
ফরাসি দেশে এ রকম একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বিয়ের পরে প্রথম দিকে স্বামী কথা বলবে স্ত্রী শুনবে। তারপর শুধু স্ত্রী কথা বলবে স্বামী শুনবে। তারপর স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কথা বলবে। কেউ কারও কথা শুনবে না। এবং অবশেষে স্বামী-স্ত্রী কেউই কিছু বলবে না, কেউই কিছু শুনবে না।
একটু অন্যরকম একটা গল্প একদা শুনেছিলাম।
স্বামী বেচারা বিছানায় শয্যাশায়ী। চোখ লাল, জিব শুকনো, নাক দিয়ে অনর্গল ধারায় জল পড়ছে, গায়ে বেশ জ্বর।
ডাক্তারবাবু এসেছেন। তিনি যথারীতি কয়েকটা নিয়মমাফিক প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক কোনও জবাব না দিয়ে বোবার মতো ‘আ’-’আ’ করলেন। ডাক্তারবাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ রকম কথা বলতে পারছেন না কতদিন?’ রোগী হাতের আঙুল তুলে দেখালেন আটদিন।
অতঃপর ডাক্তারবাবু রোগীর স্ত্রীকে বললেন, ‘আপনার স্বামী যে কথা বলতে পারছেন না।’
শুনে ভদ্রমহিলা অবাক, ‘সে কী? উনি তো একবারো আমাকে বলেননি যে উনি কথা বলতে পারছেন না।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আজ আটদিন আপনার স্বামীর এই অবস্থা চলছে। ওঁর কাছে এইমাত্র জানলাম। আর আপনি জানতে পারেননি।
ভদ্রমহিলা কপালে করাঘাত করে উচ্চস্বরে বললেন, ‘হায় রে, আমার কপাল! কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু ডাক্তারবাবু আপনি নিজের চোখে দেখে নিজের কানে শুনে গেলেন, আজ আটদিন আমার স্বামী কথা বলতে পারছেন না। এই আটদিন এত কথা আমি তাঁকে বলেছি এই কথাটা উনি আমাকে একবারের জন্যও বলেননি।’