বই চুরি
বারবার নানা জায়গায় নানা বিষয়ে লিখছি। এবার একটু নিজের ব্যাপারে লিখলে সেটা বোধহয় খুব দোষের হবে না।
ব্যাপারটা অবশ্য মজার নয়, বরং দুঃখের ঘটনাই বলা যেতে পারে।
প্রকাশক মহোদয়ের কাছে শুনলাম এবারের বইমেলায় সর্বপ্রথম যে বইটা চুরি গিয়েছিল সেই বইটা আমার। বলা বাহুল্য, চুরিটা ধরা পড়েছিল, তাই জানা গিয়েছিল।
সামান্য সাদামাটা ছেলেমানুষি হাসিঠাট্টার একটা বই ‘জলভাত’। সেই বইটা চুরি করার আগ্রহ হতে পারে, ভেবে খুব অবাক লাগল।
এই সূত্রে অল্প কিছুদিন আগের অন্য একটা বই চুরির ঘটনা মনে পড়ছে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক এবং বেদনারই। খবরের কাগজে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছিল এবং পরে এ-বিষয়ে সম্পাদকীয় পর্যন্ত লেখা হয়েছিল।
কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে একটি মূল্যবান গ্রন্থ চুরি করে বইটিকে লুকিয়ে বেরিয়ে আসার পথে এক ভদ্রলোক ধরা পড়েন। উৎসাহী কর্মকর্তারা ওই ভদ্রলোককে পুলিশে দেন।
খবরের কাগজের অনবধানতাবশত ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা কাগজে ছাপা হয়। তাঁর পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে। এরপর পুলিশ ওই ব্যক্তির বাড়ি তল্লাশি করে আরও অনেক বই পায়, যেগুলো জাতীয় গ্রন্থাগার সমেত আরও কোনও কোনও লাইব্রেরি থেকে চুরি করে সংগৃহীত।
তবে এর মধ্যে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যায় এই তস্কর ভদ্রলোকটি সামান্য চোর নন। ইনি বই বিক্রি করার জন্য চুরি করতেন না। ইনি ছিলেন প্রকৃত পুস্তকপ্রেমিক। মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ করাই নেশা, চুরি করাটা পেশা নয়।
খবরের কাগজে তখন সংবাদের অভাব চলছিল। তাই এই বই চুরি ধরা পড়ার ব্যাপারটা গুরুত্ব পায় এবং বেশ কয়েকদিন ধরে লেখালেখি চলে।
ইতিমধ্যে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। কাগজে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় অপমানের জ্বালায় ওই তস্কর ভদ্রলোক আত্মহত্যা করলেন। কাহিনীর যবনিকা পতন হল, বিয়োগান্ত নাটকের আদলে। এবং তখনই পুলিশ-প্রশাসন-খবরের কাগজ বুঝতে পারল ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
বই চুরির ঘটনাকে কখনওই খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এমন কোনও শিক্ষিত ব্যক্তি কি আছেন যিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে তাঁর বাড়িতে সমস্ত বইই তাঁর নিজের? নিজের বই যেগুলো নয় সেগুলো যে তিনি চুরি করে, লুকিয়ে কোথাও থেকে নিয়ে এসেছেন তা হয়তো নয় কিন্তু একথা সত্যি যে তিনি ধার করে পড়তে এনে ফেরত দেননি এবং সেও এক্ষেত্রে চুরিরই নামান্তর।
সেই পুরনো গল্পটা তো সবারই জানা আছে। গল্পটা কখনও বার্নার্ড শ, কখনও হরিনাথ দে, কখনও বা অন্য কোনও খ্যাতনামা পণ্ডিতকে নিয়ে বলা হয়।
সেই পণ্ডিতমহোদয়ের বাড়িতে অজস্র বই, ঘরে বারান্দায় সিঁড়িতে মেজের ওপরে ডাঁই করে রাখা। তাই দেখে এক শুভানুধ্যায়ী বলেছিলেন, ‘আপনার এত বই সব এত অযত্নে রেখেছেন, দুয়েকটা আলমারি বা সেলফ তো রাখতে পারেন।’ পণ্ডিত এবার হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ভাই, বইগুলো যে ভাবে সংগ্রহ করেছি, আলমারি বা তাক তো সেভাবে সংগ্রহ করা যাবে না।’
এবার আসল কথায় যাই। সেকথাটা হল আমার বইটা চুরি হওয়া নিয়ে।
এত বড় একটা বইমেলায় এত বইয়ের দোকানের এত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে এই তস্কর ভদ্রলোক হঠাৎ আমার মতো অভাজনের একটি নগণ্য গ্রন্থ চুরি করতে গেলেন কেন?
প্রথমে এই ভেবে মনে মনে গৌরব বোধ করলাম যে পাঠকদের কাছে আমার লেখা বইয়ের আকর্ষণ এতই দুর্বার যে জনৈক পাঠক ন্যায়নীতির সমস্ত সংস্কার ও দ্বিধা ভেঙে আমার বইটি চুরি করেছেন, নিতান্তই মানসিক তাগিদে তিনি এই কাজটি করেছেন।
কিন্তু এর পরেই মনে হল, হয়তো আমার বইয়ের চাহিদা নেই, একেবারে বিক্রি হয় না, তাই প্রকাশকমহোদয় আমার বইগুলো দোকানের কোনও এক অপরিচিত অবহেলিত প্রান্তে ঢেলে রেখেছিলেন, সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা সহজ ভেবে ওই ভদ্রলোক বইটি তুলে নেন এবং দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়েন।
এইরকম খারাপভাল যখন দ্রুত চিন্তা করছি প্রকাশকমহোদয় জানালেন, ‘সব চেয়ে আশ্চর্য এই যে লোকটা ধরা পড়ায় পকেট থেকে টাকা বার করে আপনার বইটা কিনে নিয়ে চলে গেল।’
আমিও খুব আশ্চর্য হলাম এবং এই ভেবে আশ্বস্ত হলাম যে আমার বইটা অন্তত এক কপি বিক্রি হয়েছে।