তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

বই আর বউ

বই আর বউ

আমরা বইয়ের কথা বলতে গেলেই বউয়ের কথা বলি। কারণটা কী! বর্ণমালায় ই আর উ প্রায় পাশাপাশি আছে। স্লিপ করে এক ঘাট এগিয়ে যাই। এইটাই কী কারণ? স্লিপ অফ পেনের মতো স্লিপ অফ টাং। নাকি, দুটিই আমাদের সমান প্রিয় বলে। রোমান্টিক উপন্যাস পড়ে সেই আমাদের কচি গোঁফের কালে প্রেমিকা সম্পর্কে একটি ধারণা গজায়। সে ছাতের আলসেতে চুল এলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। পরদা সামান্য ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। প্রবল বৃষ্টিতে একই আশ্রয়ে মাথা বাঁচাবার জন্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। সে আমার সহপাঠিনী হতে পারে। জীবনের সেই জ্বালাময়ী যৌবনের দিনে উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে দাঁড়ায় আমার কল্পপ্রেমিক। সময়টা বসন্ত হতে পারে। জানলায় গোল চাঁদ লেগে থাকতে পারে। একটা কোকিল বিরহের ডাক ছাড়তে পারে। পুবে কোনও বিয়েবাড়িতে সানাই বাজতে পারে। আমার পাশের বাড়ির মেয়েটি চোখে কোনও বার্তা নিয়ে ঠিক ওই সময়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে পারে। মৃদু গলায় ডাকতেও পারে।

বই থেকে জীবন খুব বেশি দূরে নয়। অক্ষরের প্রেমিকা শরীর ধারণ করে ময়দানের গাছতলায় আমার পাশে বসতে পারে। ঘাসের টাকনা দিয়ে চিনেবাদাম খেতে খেতে আমাদের ভবিষ্যৎ সংসারে পরিকল্পনাটা ছকে ফেলতে পারি। শেষ ট্রামে চড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে, মনে হতে পারে আমি এক বিদেহী আনন্দ। শেলির এরিয়াল আমি। কিটসের গ্রিসিয়ান আর্ন-এর গায়ে উৎকীর্ণ জীবনলীলার চরিত্র আমি। আমি সুইনবার্ন। গোলাপ হাতে জাহাঙ্গির। বুড়ো সাজাহান কখনওই নই। এই প্রেম যদি ট্র্যাজেডি হয়ে যায়, তাহলেও কোনও আপত্তি নেই। বউয়ের শোক বই পড়ে ভুলব। দেবদাসের মতো বোতলে প্রবেশ করব না। আর যদি মিলনান্তক হয়, তাহলে বউয়ের পেছন পেছন কিছু বইও এসে ঢুকবে বাড়িতে।

একালে অবশ্য বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ কমে গেছে। এখন হল ইউটিলিটি গুডস দেওয়ার প্রথা। সুন্দর করে মোড়া একটা ফুলঝাড়ু, অথবা একটা তোলা উনুন। বিশাল এক সুটকেস। তোমাদের নতুন সংসারে কাজে লাগবে। হয়তো এমনও হবে, উপহার দিয়ে গেল একজন কাজের মেয়ে। এই তো, আর একটি প্রাণ এল বলে। ড্রাইজিনের মতো ড্রাই প্রেম তো আর হয় না, ফল ধরবেই, তাই এই দুর্লভ উপঢৌকেন। মাস গেলে তিনশো ম্যানেজ করে দিয়ে দিয়ো।

বই আর বউ এই নিয়েই সংসার। দুজনের স্বভাবও মনে হয় এক। লেপকে খোলে ঢোকানোর মতো বউকে যদি চ্যাপটা করে কোনও কায়দায় দু-মলাটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা হলেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি অলিখিত বই হয়ে যাবে। বই জ্ঞানদায়িনী, বউও জ্ঞানদায়িনী। উঠতে বসতে, চলতে ফিরতে, শুতে ঘুমোতে, প্যারার পর প্যারা খালি জ্ঞান। সেই জ্ঞানে আলস্যমোচনের কথা থাকবে, স্বভাব সংশোধনের কথা থাকবে। বউ-এর ফার্স্ট চ্যাপটার হল প্রেম। তার আগে সামান্য ভূমিকা। তিনি এলেন। ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে। অস্ফুট প্রেমের মৃদু গুঞ্জন। সুবাস, সৌরভ। যেমন বলে, বই পড়, জীবনের কমপ্লেকসানটাই পালটে যাবে, সেই রকম, বউ এলে জীবনের সব কিছু পালটে যায়। আলাদা একটা ঘর হয়। খাতিরের বিছানা। ড্রেসিং টেবিলে আত্মদর্শনের আয়না। সামনে সাজানো সৌন্দর্য বর্ধনের শিশি, বোতল। মানুষের বিয়ে হলে চিরুনিরও বিয়ে হয়। মেল, ফিমেল, পাশাপাশি। বই যেমন অক্ষরের ভাষায় রং ছড়ায়, বউও সেইরকম শাড়ির ভাষায় ঘরে ছড়িয়ে দেয় বর্ণমালা। ভালো উপন্যাসের মতো নিজেকে এসট্যাবলিশ করতে থাকে। প্রথম প্রথম ঘরেই বেশিক্ষণ থাকা। এর মানে, এই নয় যে প্ট আটকে গেছে। বউ নামক বইটি প্রথমে মূল পাঠকটিকে চিনতে চায়। আগে তার মগজধোলাই করো। সংসার-কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণসারথি। কয়েক বছরের মধ্যেই তো গীতার অমৃতময় বাণীতে সবাই কাত হবে। ধৃতরাষ্ট্র শ্বশুর, স্নেহান্ধ শাশুড়ি গান্ধারী, ভ্রাতা কৌরবকুল। মধ্যরাতের নিভৃতিতে প্রেম-বিনিময়ের অবসরে স্খলিত-গাণ্ডিব পার্থকে বলবেন, ‘ ক্লৈব্যং মাস্ম গম: পার্থ’। হতাশায় উঠে বোসো, ‘তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়:’ উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত, কেরিয়ারের সঙ্গে যুদ্ধ করো, আনওয়ান্টেড আত্মীয়স্বজন ছেঁটে ফেল, নিট অ্যান্ড ক্লিন সংসার, নো ওল্ডম্যান, ওল্ড ওম্যান নৈব চ। ফ্ল্যাট চাই, ফোন চাই, চাই চারচাকা, না পারলে দু-চাকা। তোমার একটা পুং হেলমেট, আমার একটা স্ত্রীং হেলমেট। তোমার মধ্যপ্রদেশটিকে কাল্টিভেটেড করে অ্যাটলাসের মতো করো, যাতে আমি জাপটে ধরে বসতে পারি, মাঝখানে, দুই রুটির মাঝে মাখনের মতো আমাদের ননিগোপাল। থ্রি অন এ রাইডার। প্রশ্নটা এইখানেই, বই আমাদের বেশি উদ্বুদ্ধ করে না বউ করে! বলছে, পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড। হতে পারে। সেকালে হয়তো তাই ছিল, একালে, ওয়াইফ ইজ মাইটিয়ার দ্যান বুক। সে কারণেই, বউকে যদি ঠিকমতো পড়ে ফেলতে পারো, তাহলেই তুমি প্রবুদ্ধ, আদারওয়াইজ তুমি বুদ্ধু; কিন্তু স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম, অত সহজ নয়। যত পড়বে ততই নিত্যনতুন ব্যাখ্যা বেরোবে।’

এক ধরনের বউ আছেন যাঁরা বইয়ের পোকা। যে সব বই পুরুষরা পড়তে পারে না, সে সব বইও তাঁরা নির্বিচারে পড়েন ও রসগ্রহণ করেন। খুব মোটা ঢাউস বইও তাঁদের ভয় দেখাতে পারে না। ঝুড়িঝুড়ি অক্ষর নেশা, অ্যাডিকশন। বই নাকে বসে আছেন। সংসার প্রায় রসাতলে।

‘এক কাপ চা হবে?’

‘হুঁ।’

আধঘন্টা পরে, ‘এক কাপ চা চেয়েছিলুম কিন্তু। আধঘন্টা হয়ে গেল।’

গম্ভীর গলায়, ‘ঠিক সময়ে পাবে।’

‘বইটা এইবার রাখো না। সংসারে তো আগুন জ্বলে গেল। সেই সকাল থেকেই তো চলছে। দুধ পড়ে আছে। মাছ বেড়াল টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাজার গড়াগড়ি যাচ্ছে। এইবার দয়া করে ওঠো না। অফিসটফিস আছে তো।’

‘অতই যদি তাড়া, একদিন নিজে করে খাও না। অত পরমুখাপেক্ষী কেন?’

হয়ে গেল। যাদের বউকে বইয়ে ধরেছে তাদের হাতে হারিকেন। মেয়েরা আবার এক ধরনের বই-ই বেশি পছন্দ করেন। বেশ একটা রগরগে সিনেমা-মার্কা গল্প চাই। উত্তমকুমারের মতো নায়ক, সুচিত্রা সেনের মতো নায়িকা। প্রেমের রং ধরেই একটা বিচ্ছেদ। দুজনে দুপ্রান্তে। একজন বড়লোক, একজন মধ্যবিত্ত। বড়লোকের সম্পদ, অহঙ্কার, মধ্যবিত্তের আদর্শ। ধুন্ধুমার কাণ্ড। মাঝখানে আর একজন ঢুকবে। আর একটি মেয়ে। একটা ত্রিভুজ হবে। কড়া লিকার ডায়ালগ। শেষে মিলন। নিউ থিয়েটার্স-মার্কা উপন্যাস। চুম্বকের গায়ে পেরেকের মতো আটকে যাবেন মহিলারা। এইরকম বইপ্রেমী বউ এক সমস্যা। রাত বারোটা বাজে, একটা বাজে। চোখের ওপর চড়া আলো। এবার শোও না!

তুমি ঘুমোও না। আমার যখন খুশি তখন ঘুমোব। তোমার কীসের অসুবিধে!

চোখে আলো পড়লে ঘুমোনো যায়। সঙ্গে সঙ্গে মশারির চালে চাদর চাপা পড়ে গেল। যাতে কর্তাটি অমাবস্যার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে পারেন। গৃহিণী তখন উপন্যাসের ভয়ঙ্কর জায়গায়। নায়ক আর নায়িকা গৃহত্যাগ করে ট্রেনে উঠছে। একটা লুম্পেন টাইপের লোক উলটোদিকে বসে ঘোলাটে চোখে তাকাচ্ছে। প্রেমের ঢেউয়ে ভেসে দুজনে সম্বলপুরে চলেছে। সেখানে এক কমান ফ্রেন্ড আছে। জীবিকা তো একটা চাই। তা না হলে প্রেম তো ফেঁসে যাবে। ভিলেনটা উপকারী বন্ধু সেজে ঢোকার তাল খুজছে। রাত বাড়ছে, শীত বাড়ছে, ট্রেন ছুটছে, প্লট জমছে। কর্তা ঘুম-জড়ানো গলায় বলছেন, ওগো, এইবার দয়া করে শোও না গো।

সঙ্গে সঙ্গে ধমক, চুপ করো।

কিছু মানুষ আছেন ক্রিমিন্যাল টাইপ। তারা বই ছাড়া কিছু বোঝেন না। ড্রাগ অ্যাডিকটের মতো, বুক অ্যাডিকট। বই কিনেই ফতুর। দেওয়াল, আলমারি, টেবিল, মোঝে সব বইয়ে বইয়াক্কার। সর্বত্র বই। যখনই ফাঁক পান তখনই বই নিয়ে বসে পড়েন। আর এখন হয়েছেও সেইরকম, এত বিষয়ে এত বই বেরোচ্ছে—এক জীবন পড়ে শেষ করা যাবে না। আর একবার বই যাকে ধরে, তার আর ঘর সংসারে তেমন মন থাকে না। এমন মানুষের স্ত্রীদের মহাক্ষোভ। লোকটা যত পড়ছে ততই গাধা হয়ে যাচ্ছে। পাঁচশো টাকার রাসেল না কিনে একটা শাড়ি কিনলে কী ক্ষতি হয়! মাছ, মাংস খেলে রক্ত হয়, ভালো ভালো শাড়ি পড়লে সৌন্দর্য বাড়ে, লোকে ফিরে তাকায়, কনফিডেন্স বাড়ে, বই পড়লে কী হয়! চোখ খারাপ হয়। টাক পড়ে, বদহজম হয়। চোখ খারাপ হয়। সর্বোপরি মানুষ দরিদ্র হয়ে যায়।

মানুষকে উদ্যোগী হতে হবে। রেঢ়ির তেলের প্রদীপের পৃথিবী আর নেই। হ্যালোজেন ওয়ার্লডে, জেটসেট ম্যান। দালালি করো, ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট হও, প্রাোমোটার হও। মাল বেচো, নিজেকে বেচো, গোল্ডেন আইডিয়ালস লকারে রেখে ধান্দার পৃথিবীতে লাফ মারো। বইপত্তরের ডেডওয়ার্লডে হরিশচন্দ্রের মতো বসে থেকো না। স্মরণ করো পুরোনো প্রবাদ—লেখাপড়া করিবে মরিবে দু:খে, মৎস্য ধরিবে খাইবে সুখে। প্র্যাকটিক্যাল বউ ঝনঝন, খনখন করে উঠবেন, ‘এইবার যেখানে যত আবর্জনা আছে সব কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দোব, প্লাতো, সোক্রাতেস, সার্ত্র, উমবের্তো, কুন্ডেরা, বেলো, কামু, কাফকা, বুভ্যেয়ার, ব্রেশট, সব এক গতি, এ হ্যান্ডফুল অফ ডাস্ট। থাকবে শুধু তিনটে বই—রূপচর্চা, রকমারি রান্না আর কেরিয়ার গাইড।

‘বুড়ো বয়সে আমি পড়বটা কী।’

‘শোনো ছোকরা, বুড়ো বয়সে তোমার মাথার ওপর পারিবারিক ছাত থাকবে কি! স্নেহের বন্ধন! বৃদ্ধনিবাসেই হয়তো থাকবে। সেখানে, কোথায় তোমার পার্সোন্যাল লাইব্রেরি। সেখানে আমেদপুর সুগার ফ্যাকট্রি হয়ে বসে থাকবে বিছানায়। ব্লাডসুগার ফোর ফিফটি। চোখে ভারী পরদা। ডায়াবিটিক হার্ট কিডনি। প্রেশারের উত্থানপতন। আধুনিক হাইটেক জীবন চল্লিশের মধ্যেই তোমার সব শুষে নিয়ে হিউম্যান গার্বেজে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। দিস ইজ ইওর ফিউচার।

‘ডালিং। তাহলে, তোমার উপদেশটা কী! বই তো কেবল ভাঁওতা দেয়। বউ কী বলে শুনি।’

আমি বলি, বুদ্ধিমান প্রাণী হও। আদিখ্যেতার বই না কিনে ইউনিট কেনো। জ্ঞান অনন্ত, জীবন সীমিত, অতএব শেষ জীবনের ইনসুলিনের ব্যবস্থা করাটাই হল ধ্রুব জ্ঞান। অ্যান্ড দাস সেজ মাই বউ। আমার বাইবেল। বাইবেলের নতুন মানে পেয়েছি—বেল মানে ঘণ্টা, বাই মানে পাশে। বিবাহসূত্রে যে ঘণ্টাটি আমার গলায় ঝুলেছিল, সেই বউ আমার সব কেতাবের সেরা কেতাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *