বইমেলায় পটলবাবু
পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে এমন কেউ কি এখনও আছেন, যাঁর কাছে পটললালের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন?
পটললাল অবশ্যই কোনও বিখ্যাত লোক নন। তবে অসংখ্য লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। তাঁরা তাকে নানা কারণে চেনেন। তারাপদ রায়ের মতো ঘরকুনো, অলস লেখক পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে নয় নয় করে অন্তত আট-নয়টি গল্প লিখে ফেলেছেন।
পটললাল।
শ্ৰীযুক্ত পটললাল পাল।
অনেকেই তাঁকে পটলবাবু কিংবা পটলদা বলেন। তেমন কেউ কেউ অবশ্য তাঁকে মি. পাল নামেও ডাকেন। আবার যেমন হয়, যাঁরা তাঁকে বহুকাল ধরে চেনেন, তাঁরা তাঁকে নিতান্তই পটল বলে ডাকেন।
এই গল্পে আমরা অবশ্য তাঁকে পটলবাবুই বলব।
পটলবাবু সিনেমা লাইনের লোক। তিনি কিন্তু নায়ক বা অভিনেতা নন। প্রযোজক বা পরিচালক কিছুই নন। কখনও কখনও বাংলা সিনেমায় টাইটেলের মধ্যে পটলবাবুর নাম দেখা গেছে সহকারি পরিচালক হিসেবে কিংবা ব্যবস্থাপনার সহায়ক রূপে কিন্তু আসলে তিনি ইন্ডাস্ট্রির মানে সিনেমা শিল্পের সর্বঘটে কাঁঠালি কলা।
মেট্রোরেলের কামরায় নায়কের সঙ্গে নায়িকার প্রথম দেখা। ডিরেক্টর বললেন, পটলবাবু, ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করুন।
সোজা কাজ নয়, নায়ক-নায়িকা, ডিরেক্টর এবং অন্যরা না হয় টিকিট কেটে ঢুকে যাবে, কিন্তু ক্যামেরা যাবে না, তা ছাড়া ছবি তোলার অনুমতি ইত্যাদি জোগাড় করতে হবে।
প্রগতিশীল এক প্রযোজক সরকারের টাকা নিয়ে বই করছেন। তাঁর বইয়ের নায়ক ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। বইয়ে পুলিশের গুলি চালনার ছবি থাকবে, তখনকার পুলিশের পোশাক, রাইফেল বা বন্দুকের চেহারা এগুলো পটলবাবুকে সংগ্রহ করতে হল।
অবশ্য খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি। খাদ্য-আন্দোলন নিয়ে একটা তথ্যচিত্র হয়েছিল অনেকদিন আগে, পুরনো রিল সরকারি গুদামে পড়েছিল। দারোয়ানকে পঞ্চাশ টাকা ঘুষ দিয়ে ছবির রিলটা সংগ্রহ করে এনেছিলেন। তাতেই কাজ চলে যায়।
অবশ্য কখনও কখনও বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। একটা ছবিতে পাগলা গারদের একটা দৃশ্য ছিল। পরিচালক আদেশ দিলেন, পাগলা গারদের ভিতরটা একবার দেখে আসুন পটলবাবু, সেট সাজাবার সময় কাজে লাগবে।
একদিন ভোরে শহরতলির একটা পাগলা গারদের মধ্যে ঢুকে গোপনে পাগলদের থাকা-খাওয়া, ব্যাপার-স্যাপার সব দেখে যখন দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসছিলেন, গারদের দারোয়ান তাঁকে আটকিয়ে দেয়।
সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া সোজা কথা নাকি! পটলবাবু যত বলেন, আমি পাগল নই,দারোয়ান বিশ্বাস করে না। পাগলদের সম্পর্কে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, সব পাগলই বলে, মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে সে পাগল নয়।
আরও বিপদ হল অন্য কারণে। দেয়াল টপকানোর সময় দুজন ঘরবন্দি পাগল তাদের জানলা দিয়ে তাকে বাহবা দিচ্ছিল পালানোর জন্য, এবার তারাই চেঁচাতে লাগল, ছাড়বেন না দারোয়ানজি। এ ব্যাটা এক নম্বরের পাগল। ছাড়লে আপনার চাকরি যাবে।
এরপরে দারোয়ান আর ছাড়ে?
সেদিন সারাবেলা পটলবাবুকে অভুক্ত অবস্থায় বন্দি থাকতে হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় গারদের ঘরে ঘরে তালা দেওয়ার আগে, পাগলদের মাথাগুনতি হয়, মাথাগুনতি করে প্রত্যেককে যে যার ঘরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় ধরা পড়ে যে একজন বেশি আছে। তখন পটলবাবু সব বলে হাতে-পায়ে ধরে সেই পাগলা গারদ থেকে বেরিয়ে আসেন।
সম্প্রতি পটলবাবু একটি ঘোরতর সমস্যায় পড়েছেন। বি সি এল নামে খ্যাত, প্রযোজক বিমলচন্দ্র লাহিড়ির আগামী আকর্ষণ বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি ছবির ক্লাইম্যাক্সে বইমেলার সিন রাখা হয়েছে।
পরিচালক গোবিন্দ দাশগুপ্ত ঝানু লোক, তিনি খেয়াল করেছেন আজকাল ইংরেজি বছরের গোড়ার দিকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা কলকাতায় একটা ক্রেজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু কলকাতায় কেন, আশপাশে বিরাটি থেকে সোনারপুর, গ্রামে-গঞ্জে, মফস্সলে, জেলায়-মহকুমায়, আঁদাড়ে-বাঁদাড়ে, যেকোনও খালিমাঠে বইমেলা আর বইমেলা।
এই রকম জনপ্রিয় বইমেলাকে লাহিড়ি এবং দাশগুপ্ত তাঁদের সিনেমায় ব্যবহার করবেন। একটি বিচ্ছেদ কাহিনি। কাহিনির মধ্যে বইমেলার নানা অনুষ্ঠান, মণ্ডপ, ছবি-গান-কবিতা, মাছ-ভাজা, দই সবই অল্প অল্প করে থাকবে। নায়ক-নায়িকা হাত ধরাধরি করে দিনের পর দিন ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ দৃশ্যে তাদের বিদায়ের পালা। দেখা যাবে দুদিকের দু গেট দিয়ে নায়ক-নায়িকা আলাদা আলাদা বেরিয়ে যাচ্ছে। নায়কের হাতে বুদ্ধদেব গুহর বিরহের উপন্যাস আর নায়িকার হাতে জয় গোস্বামীর কবিতার বই।
অবশ্য এর কয়েকদিন আগে কমিক রিলিফ হিসেবে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনাকে আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে দেখা যাবে তারাপদ রায়ের কাণ্ডজ্ঞান বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে হাসাহাসি করছে।
তা পটলবাবুর উপরে গুরুদায়িত্ব পড়েছে বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি সিনেমায় বইমেলার দৃশ্যগুলির চলচ্চিত্র গ্রহণের বন্দোবস্ত করা।
এর মধ্যে অবশ্য উটকো ঝামেলা দেখা দিয়েছিল। বইয়ের প্রযোজক লাহিড়িবাবুর ধারণা বইয়ের নাম, বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি। ওদিকে পরিচালক দাশগুপ্ত সাহেবের ধারণা কথাগুলো হবে বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি।
মহরত অনুষ্ঠানের সংবাদ যেসব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তার কোনওটায় বরের ঘরের পিসি… কোনওটায় বরের ঘরের মাসি…।
ব্যাপারটা দাশগুপ্ত সাহেবের চোখে পড়ে এবং চিন্তার কারণ হয়। লাহিড়িবাবু প্রযোজক, তিনি যদি জানতে পারেন, তাঁর দেওয়া নাম বদল করা হয়েছে, টাকাপয়সার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
পটলবাবুকে পাঠানো হল বাংলা আকাঁদেমির সচিব শ্রীযুক্ত সনৎ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। সনৎবাবু অভিজ্ঞ ব্যক্তি। বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি নাকি বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি সমস্যাটির জটিলতা অনুমান করে তিনি পটলবাবুকে অধ্যাপক পবিত্র সরকারের কাছে পাঠালেন।
বাংলা ভাষার ব্যাপারে অধ্যাপক সরকার এক নম্বর লোক। কিন্তু তাঁর খুব ঠাণ্ডা মাথা, পিসি-মাসি মনের মধ্যে দু-চারবার ঘুরপাক খাইয়ে বললেন, ব্যাপারটা গোলমেলে। দুটোই তো ভুল মনে হচ্ছে। তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি বরং একবার জ্যোতিবাবুর কাছে যান।
জ্যোতিবাবু? প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যপারে কী বলবেন, পটলবাবু ঠাহর করে উঠতে পারেন না। পবিত্রবাবুই তাঁর ভুল ভাঙালেন। জ্যোতিবাবু মানে জ্যোতিভূষণ চাকী। পণ্ডিত মানুষ। বালিগঞ্জ কাঁকুলিয়ায় থাকেন।
তবে কাঁকুলিয়া পর্যন্ত যেতে হয়নি। তার আগেই লাহিড়িবাবু নিজেই একটা সমাধান করেছেন, দাশগুপ্ত সাহেব সেটা মেনে নিয়েছেন।
সমাধানটি আর কিছু নয়, দুটোই থাকবে। ওপরে থাকবে বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি নীচে বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি। ব্যাপারটা এই রকম।
বরের ঘরের মাসি কনের ঘরের পিসি নাকি
বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি।
লাহিড়িবাবুর মতে আর কিছু না হোক বিশ্বের দীর্ঘতম নামের সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। চাই কী এজন্য টিমবাকটু কিংবা দামাস্কাস ফিলম ফেস্টিভ্যাল থেকে প্রাইজ আনতে পারে।
এইভাবে নামকরণের ঝামেলাটা পটলবাবুর ঘাড় থেকে নামল। কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার জো নেই।
বইমেলায় সিনেমার শুটিং-এর বন্দোবস্ত করার পুরো ঝামেলা পড়ল পটলবাবুর ঘাড়ে। এদিকে আসল সমস্যা হল বইমেলা বিষয়ে পটলবাবুর কোনও পরিষ্কার ধারণা নেই।
প্রত্যেক বছর শীতকালে ট্রামবাসে যাতায়াতের পথে দেখেন বটে, চৌরঙ্গির একধারে ময়দানের মধ্যে বড় সার্কাসের মতো ঘেরা মাঠ, জমজমাট ব্যাপার। দেখেছেন রাস্তাঘাটে, হাটে বাজারে, এমনকী টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো পাড়ায় অতি বড় গোমূর্খেরাও বইমেলা বইমেলা করে হন্যে হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু পটলবাবুর কখনওই উৎসাহ হয়নি বইমেলায় যাওয়ার।
আসলে লেখাপড়া, বই-খাতার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ চুকে গেছে তিরিশ বছর আগে। সেই নাইনটিন সেভেনটিতে, তখন তিনি পাইকপাড়া গদাধর মল্লিক হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ক্লাস নাইনের ছাত্র। আঠারো বছরের টগবগে তরুণ। কয়েকজন নকশাল বন্ধুর সঙ্গে সরস্বতী পুজোর গভীর রাতে ইস্কুলের পুজোমণ্ডপে হানা দেন।
সেইদিন রাতে তিনি স্বহস্তে সরস্বতাঁকে ছিন্নমস্তা করেছিলেন। সরস্বতীর রাজহাঁসকে কোলে তুলে ইস্কুলের দোতলায় ছাদে উঠে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় হাঁসটি না উড়ে নীচে গেটের কাছে দণ্ডায়মান ইস্কুলের দারোয়ান রাম তেওয়ারির মাথায় পড়ে। এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়েছিল :
সরস্বতী পূজায় নকশালি তাণ্ডব
সরস্বতী প্রতিমার ভাঙচুর
সরস্বতীর রাজহাঁস উধাও
এগুলো ছিল হেডলাইন, প্রথমটি বড় টাইপে, পরেরগুলি মাঝারি টাইপে, এর নীচে দীর্ঘ প্রতিবেদন, যার মধ্যে এক জায়গায় রয়েছে :
…বিদ্যালয়ের প্রবীণ ও বিশ্বস্ত দ্বাররক্ষক শ্রীযুক্ত রাম তেওয়ারি নকশালদের বাধা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন। তিনি অজ্ঞান অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
.
আসল কথাটা এই যে অজ্ঞান হওয়ার পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তেওয়ারিজির জ্ঞান ফিরে আসে। হাসপাতালে চেক আপ করে পরদিন সকালেই বাড়ি ফিরে আসেন।
অন্যদিকে পটললালের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। স্কুলের ছেলেরা যারা সেই রাতে পুজোর ভলান্টিয়ারি করছিল তারা সবাই পটললালকে চিনে ফেলেছিল। সেই সূত্র ধরে পুলিশ পটললালকে খোঁজা শুরু করে। ফলে পটললালকে বেশ কয়েকবছর গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়।
মা সরস্বতীর সঙ্গে পটললালের বিচ্ছেদ সেই থেকে শুরু।
লেখাপড়া, বই-খাতা এসবের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তিনি সেই থেকে চুকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভাগ্যদোষে এবার পুরো বইমেলাটা তাঁর ঘাড়ে পড়ে গেছে।
কী করবেন? কীভাবে কী করবেন?
বইমেলা নিয়ে ভাবতে ভাবতে পটলবাবুর খেয়াল হল খাঁড়াদা-র কথা।
খাঁড়াদা মানে গজপতি খাঁড়া। আজ থেকে পনেরো-বিশ বছর আগে টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় গজপতিবাবুকে সবাই একবাক্যে খাঁড়াদা বলত।
পটলবাবু যখন টালিগঞ্জ পাড়ায় প্রথম আসেন খাঁড়াদা তাঁকে খুব সাহায্য করেছিলেন। খাঁড়াদা ছিলেন সিনেমা লাইনের সাহিত্যিক, সহকারী চিত্রনাট্যকার, কখনও-সখনও সহযোগী গীতিকার।
বেনামে খাঁড়াদা অনেক গান লিখতেন, সেই যে আশির দশকের বিখ্যাত গান
চুনচুন চুরচুর মুড়মুড়
চানাচুর-চানাচুর-চানাচুর
শাশুড়ি খাবেন খাবেন শ্বশুর
হুড়মুড় গুড়মুড় চুড়মুড়
কিংবা সেই অশ্রুসজল গীতি–
জীবনে মরণে হায় তোমার বিহনে
মাঠে ঘাটে গৃহকোণে
ফুল ঝরে শিশিরের সনে
পাখি ডাকে বনে বনে
আমি কাঁদি মনে মনে।
এরকম বিপরীতমুখী দুরকম চূড়ান্ত মেজাজের সব গান রচনার হাত ছিল খাঁড়াদা-র।
খাঁড়াদা নামটি প্রথম পটলবাবুকে আকৃষ্ট করে।
খাঁড়া হল রামদা। বড় দা খড়গ বা রামদাকে বলে খাঁড়া। ফলে খাঁড়াদা কথাটাই খুব বিশিষ্ট মনে হয়।
আসলে ঘটনা অন্যরকম।
ভদ্রলোকের উপাধি খাঁড়া। তাই খাঁড়াদা। যেমন বোসদা, চৌধুরিদা, রহমানদা।
এই খাঁড়াদা আসলে ছিলেন একজন কবি। অত্যন্ত গোলমেলে চরিত্র। বঙ্গীয় পানশালা খালাসিটোলার আতঙ্ক। একটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড় বড় কবিদের টয়লেট পেপার পাঠিয়ে বলতেন, আপনি যা কবিতা লেখেন সাধারণ কাগজে লিখবেন না। আপনার কবিতার উপযুক্ত কাগজ এই টয়লেট পেপার।
অবশেষে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। রাত-বিরেতে মন্ত্রী, আমলা, পুলিশকর্তা এমনকী লাটসাহেবের বাড়িতে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতেন, আজ কোনও কবিতা পড়েছেন কি না?
এই করতে করতে একদিন পুলিশ তাঁকে ধরে, লালবাজারে মুচলেকা লিখিয়ে নেয়, জীবনে গজপতি খাঁড়া আর কবিতা লিখবে না।
কিন্তু খাঁড়াদার বুদ্ধি পুলিশ বুঝবে কী করে?
তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ছিলেন রঞ্জিত গুপ্ত। খাঁড়াদা রঞ্জিত গুপ্ত ছদ্মনামে কবিতা লিখতে লাগলেন।
.
বইমেলার দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় এই খাঁড়াদার কাছেই যাওয়া মনস্থির করলেন পটলবাবু।
এক সকালে খাঁড়াদার সঙ্গে তার বেহালার বাড়িতে গিয়ে দেখা করলেন পটলবাবু।
পটলবাবুকে দেখে খাঁড়াদা খুব খুশি।
আরে পটল… এতদিন পরে?… এসো এসো। ঠিক সময়েই এসে গেছ। একটা ফাইভার হবে তোমার কাছে? এই বলে ডানহাতটা পটলবাবুর সামনে পাতলেন খাঁড়াদা।
ফাইভ থেকে ফাইভার।
যেমন টেন থেকে টেনর।
ফাইভার মানে আগে ছিল পাঁচ টাকা। এখন আর পাঁচ টাকা কে চায়? এখন ফাইভার মানে পাঁচশো টাকার একটা নোট।
না। পাঁচশো টাকার নোট কেন বিশেষ কিছু টাকা পটলবাবুর কাছে নেই। কখনও থাকে না।
তা ছাড়া পাঁচশো টাকার নোট শুনলেই পটলবাবুর বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।
গত বছর ভুটানের এক প্রযোজক দোজেন দোরজি টালিগঞ্জের স্টুডিয়োতে একটা ভুটিয়া ছবির কাজ করেছিলেন। সে বইয়ে ব্যবস্থাপনার কিছু কাজ পেয়েছিলেন পটলবাবু। কাজের শেষে পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট মোট আড়াই হাজার টাকা পারিশ্রমিক পটলবাবুকে মি. দোরজি দিয়েছিলেন।
সেই নোট ভাঙাতে গিয়ে পটলবাবুকে পুলিশের হাতে পড়তে হয়। পাঁচটি নোটই জাল, এবং একই নম্বরের। লালবাজারের জালিয়াতি শাখায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে গিয়ে দেখেন তাঁর আগেই হাজতে রয়েছেন মি. দোজেন দোরজি, সেই ভুটানি প্রযোজক।
মি. দোরজিকে দেখামাত্র পটলবাবু পুলিশকে বলেন যে তিনি টাকাগুলো এর কাছ থেকেই পেয়েছেন। একটু জেরা করার পর পুলিশ অফিসাররা পটলবাবুর কথার সত্যতা বুঝতে পারেন। দোজেন দোরজিকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সেই মামলা এখনও চলছে। দোরজি আসামি, সরকারপক্ষে প্রধান সাক্ষী পটলবাবু।
সে যা হোক, আজ খাঁড়াদাকে পটলবাবু বললেন, দাদা এই মুহূর্তে আমার কাছে কোনও টাকা নেই তবে আমার কাজটা করে দিলে আপনাকে আমি অন্তত দুটো ফাইভারের ব্যবস্থা করে দেব।
খাঁড়াদা পটলবাবুর কথা শুনে খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। কিন্তু টাকার লোভেই কেসটা হাতছাড়া করলেন না।
সমস্ত কিছু শুনে নিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, বইমেলায়, সুষ্ঠুভাবে শুটিং করাটাই এই বইয়ের সমস্যা। একে বইমেলায় গিজগিজে ভিড় তার উপরে হিরো-হিরোইন, ক্যামেরা এসব যুক্ত হলে কেলোর কীর্তি হওয়া মোটেই আশ্চর্য নয়।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে খাঁড়াদা প্রথমে পটলবাবুকে পাঠালেন কলেজ স্ট্রিটে বইমেলার প্রধানদের কাছে। কিন্তু সেখানে বিশেষ কোনও সুবিধে হল না।
প্রধান কর্তাদের অন্যতম মিত্র ও ঘোষের ভানুবাবু মৃদুভাষী স্থিতধী মানুষ। সব কথা ভেবেচিন্তে বলেন। কখনও কোনও বিষয়ে সহজে হ্যাঁ কিংবা না বলেননি।
ভানুবাবু সব শুনে বললেন, একটু ভেবে দেখি আপনি সামনের সপ্তাহের শেষের দিকে ফোন করবেন।
পরের সপ্তাহের শেষদিকে তিনি বললেন, আরেকটু ভাবি। এক সপ্তাহ পরে আসুন।
এদিকে আনন্দ পাবলিশার্সের বাদলবাবুর কাছে যেতে তিনি তেড়ে এলেন। আসলে পটলবাবু ভুল করেছিলেন, বাদলবাবু মোটেই তেড়ে আসেননি ওটা ওঁর কথা বলার স্টাইল।
এর চেয়ে বিপদ হয়েছিল দেজ পাবলিশিংয়ের সুধাংশু দের কাছে। তাঁকে যাই বলা হোক, তিনি চোখের কোনায় হাসেন আর বলেন, খুব ভাল কথা।
.
ভাল কথা বটে। কিন্তু কোথাও কোনও সুবিধে হল না। পুরো ডিসেম্বর মাসটা পার হল পটললালের। ছিন্নপাদুকা, ভগ্নহৃদয়, নিরাশ মনে পটললাল খাঁড়াদার কাছে ফিরে এলেন।
এদিকে পরিচালক, প্রযোজক দুজনেই পটলবাবুকে চাপ দিচ্ছেন ইনডোরের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। এখন বইমেলার আউটডোরটার প্রস্তুতি নিতে হবে। আর বইমেলার তো খুব বেশি দেরি নেই।
সব কথা শুনে খাঁড়াদা বললেন, আমারই ভুল হয়েছে। বড় বড় ঘোড়েল লেখকেরা পর্যন্ত ডিগবাজি খায় যেখানে, সেখানে পটল কী করতে পারবে। আমারই বোঝা উচিত ছিল।
এরপর বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি চলচ্চিত্রের বইমেলায় যে শুটিং হয়নি, তা কিন্তু নয়।
খাঁড়াদাই মতলব করলেন।
বইমেলা আরম্ভ হওয়ার আগে মানে প্রথম রবিবারের আগে, ভিড় জমতে না জমতে একদিন সকালের দিকে এসে বাইরের গেট, দেয়াল তারপর ভিতরের দোকান-টোকানের ছবিগুলো তুলে ফেলা।
তারপর একদিন সন্ধ্যায় এসে বাইরের জমজমাট ভিড়, কাউন্টারে এবং প্রবেশদ্বারে দীর্ঘ লাইন এসবের ছবি তুলে ফেলতে হবে।
তবে বইমেলার ভিড়ের মধ্যে ক্যামেরা, ডিরেক্টর, নায়ক-নায়িকা এদের ঢোকানো বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া পুলিশ কিংবা কর্তৃপক্ষ অনুমতিই হয়তো দেবে না।
কিন্তু এ সমস্যার চমৎকার সমাধান করে দিলেন খাঁড়াদা।
এই শীতের মরশুমে পাড়ায় পাড়ায় বইমেলা হচ্ছে। সবই একরকম, একইরকম সব বইয়ের দোকান, খাবারের দোকান। কলকাতা বইমেলার গেট দেখিয়ে এইরকম যে কোনও একটা হালকা বইমেলার মধ্যে ঢুকিয়ে শুটিং করলেই দর্শকেরা কিছু ধরতে পারবে না।
সবই ঠিকঠাক হয়েছে।
শুধু এক জায়গায় অবশেষে ঠেকে গেছে।
স্টুডিয়োয় শুটিংয়ের প্রয়োজনে একটা বইমেলা গেট বানানো হয়েছে। বানাতে বানাতে পটললালের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কলকাতা বুক ফেয়ার, নাকি ক্যালকাটা বুক ফেয়ার? কোনটা ঠিক হবে?
পটলবাবু খাঁড়াদার কাছে গিয়েছিলেন। খাঁড়াদা বললেন, এই কঠিন প্রশ্নের জবাব আমি জানি না।