দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

বইপাড়ায় নববর্ষ

বইপাড়ায় নববর্ষ

পঁচিশ পার্সেন্ট, তেত্রিশ পার্সেন্টের জট ছাড়াছাড়ি নেই। নেই লেখকে প্রকাশকে, প্রকাশকে মুদ্রকে মন-কষাকষি। বইপাড়ার পয়লা বৈশাখ বড় পবিত্র। জ্ঞান যেখানে দুই মলাটে স্যান্ডউইচ, কোনওটি প্লেন, কোনওটি সুপুষ্ট, ক্লাব-স্যান্ডউইচ, মা সরস্বতীর পীঠস্থান, সেখানে নববর্ষ তো এইভাবেই শুরু হওয়া উচিত। প্রকাশক দু-বাহু বাড়ায়ে লেখককে আবাহন করছেন, আসুন-আসুন। প্রতি ঘরেই যেন বৃহস্পতি সভা। প্রবীণ, নবীন, ডাকসাইটে, উঠতি লেখক কুলের পাশাপাশি অবস্থান। কেউ বাঙালি পোশাকে, কেউ বিজাতীয় বেশে। প্রবীণের পাশে নবীনকে মনে হয় সন্তানের মতো। সাহিত্যের উত্তরাধিকারী। রণক্লান্ত, স্মিতমুখ প্রবীণ গান্ডীব নবীনের হাতে তুলে দিয়ে বসে আছেন নিশ্চিন্ত আরামে। বঙ্গসাহিত্যের সুফলা জমিতে বীজ ছড়িয়েছি, কর্ষণ করেছি, ফসল তুলেছি। কর্ষক, এবার তোমাদের পালা। নতুন ভাবনা আনো, নতুন চিন্তা। চিন্তাকে পারো তো আরও একটু ঠেলে দাও। সকাল থেকেই বইপাড়ায় সাজো-সাজো রব। নতুন বছর এল। নবীন প্রবীণ হলেন বছরের হিসেবে। প্রবীণ পেরিয়ে গেলেন আরও একটি বছরের সীমানা। কারুর পিঠে খ্যাতির স্নিগ্ধ হস্তস্পর্শ, কেউ স্বীকৃতির দ্বারপ্রান্তে। কারুর মুখে বীরের প্রশান্তি। কারুর মুখে প্রত্যাশার উৎকণ্ঠা। বড় মনোরম দৃশ্য। এমনটি সারা বছর কোথাও কোনও দিন দেখা যাবে না। নববর্ষের বইপাড়াতেই এই গ্রহ-সম্মেলন সম্ভব।

বড় প্রকাশক, ছোট প্রকাশক সর্বত্রই সাধ্যমত আয়োজন। সাদা চাদর ঢাকা লম্বা টেবিল। পুষ্পস্তবক। ডাব, বোতলপানীয়, মিষ্টান্ন এবং চায়ের ফলাও ব্যবস্থা। ঘোল দিয়ে বছর শুরুর বিধান নেই। ঘোল তো সারা বছর খেতেই হবে। সাহিত্যের জল সব সময় নির্মল নয়। নানাভাবেই ঘুলিয়ে উঠতে পারে। পারস্পরিক সন্দেহ আর ভুল-বোঝাবুঝি তোলা থাক। ফয়সালার জন্য পড়ে আছে সারা বছর। রয়্যালটির হিসেব, সে তো পাঞ্জার লড়াই, দ্রৌপদীর বস্ত্র খামচে ধরে কৌরবের আকর্ষণ। সখা কৃষ্ণের আশ্বাসবাণী—মা ফলেষু। ছাপা হয়েছে, মলাটে নাম চমকাচ্ছে, এই না কত! সম্পর্ক তিক্ত করো না বৎস। বরং কলমে ধার লাগাও। বেস্ট সেলার হয়ে সিংহাসনে বসো। তবে জেনে রাখো, দিন তো সমান যাবে না। ওঠা পড়া প্রেমের তুফান। পাঠক আজ তোমাকে মাথায় তুলে নাচছে, কাল তোমাকে ভুঁয়ে ফেলে ঋণ শোধ করবে। স্মৃতি থেকে বিস্মৃতিতে যেতে বেশি দেরি হবে না। রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি সকলের, কিন্তু কালের প্রহরণ কজন পারে এড়াতে। নতুন বছরে পা রাখার আনন্দ যেমন আছে, নিরানন্দও কম নেই। মনের কোণে আশঙ্কার মৃদু মেঘগর্জন—এইরে ফুরিয়ে যাচ্ছি না তো! শক্তি কমে আসছে না তো।

জনৈক প্রকাশক বড় রসিক । মনে হয় মনস্তাত্বিক। তাঁর আলমারিতে সারি সারি সেই সব বই। একদা ছাপা হয়েছিল। রমরমা ছিল। এখন আউট অফ প্রিন্ট। আর ছাপা হবে না। লেখকের দিন ফুরিয়েছে। স্মৃতির জাদুঘরে দণ্ডায়মান। আজ যাঁরা আসর সাজিয়ে বসেছেন তাঁদের দিকে মৃতের নয়নে তাকিয়ে আছেন—হেসে নাও দুদিন বই তো নয়। কার যে কখন সন্ধ্যা হয়।

না, এমন দিনে মন খারাপের কথা চলে না। গোটা-দুই ডাব খেয়ে নাও। কাজু সহযোগে বইপাড়ার সন্দেশ। তারপর কোল্ড ড্রিংকস চালাও। সাবধানীর জন্য চা। আড়চোখে দেখে নাও কোনও ভাগ্যবানের কটি বই বছরের পয়লা তারিখেই ভূমিষ্ঠ হল। যাঁদের মস্তকে পাঠকের রাজমুকুট তারা সামান্য অধিক মনোযোগ আকর্ষণ করবেন, তাতে দু:খের কিছু নেই। ফার্স্ট বয় বুক ফুলিয়েই চলে। প্রকাশক সর্বসমক্ষেই তাঁকে আপ্যায়ন করে বলবেন, এবার আপনার একটা বই আমাদের দিতেই হবে। কবে যাব বলুন। তিনি হাসবেন। মন-কেমন করানো হাসি। যেন পূর্ণিমার ঝাপসা আলো কাঁপছে ঝাউবীথির মাথায়। বড় মায়াবী হাসি। অদূরে বসে সবই লক্ষ্য করছেন আরেকজন, লাজুক-লাজুক মুখে, যাঁর একটি বই ছাপা হয়েছিল কিন্তু তেমন কাটেনি। প্রকাশক দেখা হলেই লজ্জা দেন—ধ্যার মশায় ডুবিয়ে দিলেন। ওই দেখুন, মাল পড়ে আছে তাগাড় হয়ে। কী লেখেন ঘোড়ার ডিম। পাবলিক খায় না। এমন জিনিস ছাড়তে পারেন না, যা হড়হড় করে বেরিয়ে যাবে। তিরস্কৃত তখন পুরস্কৃতকে দেখে ভাবেন তুমি কেমন করে গান করো গুণী হে। বইপাড়ার নববর্ষে দু চেহারাই দেখা যাবে। সফলের কোঁচানো গিলে করা চেহারা। আর অসফলের ম্রিয়মাণ উপস্থিতি। নববর্ষে প্রকাশকের প্রার্থনা গণেশের কাছে গোটা কতক বেস্ট-সেলার লড়িয়ে দাও বাবা গজাণন। সরস্বতীর কাছেও। ঘরে একটা অ্যাকাডেমি তুলে দে মা। নিদেন, রবীন্দ্র, কি বঙ্কিম। যাঁরা একই সঙ্গে লেখক এবং প্রকাশক, তাঁদের আয়োজনে আভিজাত্যের আর এক চেহারা। নববর্ষ সেখানে যেন সাহিত্য সম্মেলন। কলম যাঁরা ফেলে দিয়েছিলেন তাঁরা এসেছেন সতীর্থ মিলনে। কলম যাঁরা তুলে নিয়েছেন তাঁরা এসেছেন গুরুগৃহে। অহংকার খাটো, একটু বিনীত। কয়েকটি যুগের মহামিলনে এসে বেশি বোলচাল চলে না। এঁরা দেখেছেন অনেক। অনেক ঝাড় বাছাই করেছেন। যুগকে যাঁরা অতিক্রম করেছেন তাঁরা বসে আছেন এইসব ঘরে। অতীতের নাড়ি টিপে এঁরা ভবিষ্যত ধরার ক্ষমতা রাখেন। যাঁরা উঠতি প্রকাশক বোলচাল চলবে সেখানে। ‘তুমি’ সম্ভাষণে কথা। একবার দর্শন দিয়েই প্রভাবশালী লেখকের চলে যাওয়া। প্রকাশকের মুখে কৃতার্থের হাসি। চেষ্টা চলছে। জাল পড়ছে। মাছ কিছুতেই ধরা পড়ছে না। চায়ের তেমন জোর নেই। এ জগতের চার হল মানি। তাছাড়া নামী লেখকরা আজকাল সহজে ঘর পাল্টাতে চান না, ঠেকে শিখেছেন। শুধু তাই নয় বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রকাশন জগতে আদিমভাবে বিদেশি আধুনিকতার আমদানি করেছে। র‌্যান্ডাম প্রচার চাই, তা না হলে ড্যাং-ড্যাং করে বই সেল হবে না।

বই-পাড়ার নববর্ষে সেখানকার রাস্তাঘাটেও একটা আলাদা মেজাজ এসে যায়। অন্যদিন একটা হিজিবিজি চেহারা। রাস্তার চরিত্র পাঁচমিশালি। নববর্ষে স্বতন্ত্র। যেন পাঁচশো বছর আগেকার নবদ্বীপ। লেখক আর অধ্যাপক, চেহারায় আর হাবেভাবে ধরা পড়ে যান। একদল এঘর থেকে ওঘরে চলেছেন ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে। পরনে নিপাট ধুতি পাঞ্জাবি। ফুরফুরে চুল অথবা মৃদু টাক। মুখে অনেক দেখা অনেক লেখার ফুলো ফুলো অভিজ্ঞতা। অন্য দল আসছেন বিপরীত দিক থেকে। রাজপথেই ভাব সম্মেলন। কোলাকুলির প্রথা থাকলে জাপটাজাপটি হত। হলই বা ভিন্ন শিবির। সকলেই তো বাগদেবীর আশীর্বাদ ধন্য। সকলেরই হাতিয়ার কলম। কলমের বেয়নেট দিয়ে জীবন ফুঁড়ছেন। নবীনরা পটাপট প্রবীণদের পা তাক করে ছোঁ মারার জন্য নিচু টর্পেডো। আজকের দিনে আশীর্বাদ চাই। মন্ত্রপুত হাতের ছোঁয়া চাই। মাথার মধ্যস্থলে দ্বার খুলে দাও। দ্বার খুলে দাও। হে রে রে রে রে। হঠাৎ দেখা যাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে আর একজন আসছেন। তিনি খবর পেয়েছেন। আর একজন কেউ কোথাও বসে আছেন। ধরি-ধরি করি ধরিতে না পারি। চোর-চোর খেলা চলেছে। যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই শুনছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ তো এই ছিলেন।

নববর্ষের বইপাড়ায় কিছু সাঙ্কেতিক ভাষা শোনা যাবে, যেমন ‘ধরেছেন?’ তার মানে, পুজোর উপন্যাসে হাত লাগিয়েছেন কি না! পুজোর দামামা বছরের পয়লাতেই শোনা যাবে। এরপর ‘কোথায়?’ তার মানে কোন কাগজে? ‘কে নিলে?’ অর্থাৎ দীর্ঘ ধারাবাহিক কোন ঘরে ঢুকল? ‘দিয়েছে?’ তার মানে টাকা নিয়ে যিনি ন্যাজে খেলছিলেন, তিনি উপুড় হস্ত করেছেন কিনা? আজ আর বেশি কথা নয়। একটি দুটি শব্দে খবরের আদান-প্রদান।

ডাবের পর ডাবের মুখ খুলতে-খুলতে, বোতলের পর বোতলে স্ট্র ভরতে ভরতে, ডিশের পর ডিশে খাবার সাজাতে-সাজাতে, নটেগাছের মতো দুয়ারের কলাগাছটি প্রায় নেতিয়ে আসবে। নতুন প্রকাশিত বইয়ের ল্যামিনেটেড কভারে ধুলোরা পাউডার পুরু হবে। ঝরা আমপাতার মতো বৎসরের পল্লব থেকে দিনটি হঠাৎ এক সময় খুলে পড়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *