বইপাড়া
সবাই বলে বইপাড়া। মেয়েদের সেখানে খুব একটা দেখা যায় না। মেয়েরা বই পড়ে, বই কেনে, বই পড়ায়, বই লেখে, বইয়ের সম্পাদক প্রকাশক পর্যন্ত হয়, অথচ বইপাড়ার বইয়ের দোকানে তাদের খুব কম দেখা যায়। অবিশ্যি তা সত্ত্বেও ওই নারীবিবর্জিত ঘন বনে রোমাঞ্চের এতটুকু অভাব নেই। সত্যি কথা বলতে কী ওটি হল কলকাতা শহরের সব চাইতে চাঞ্চল্যকর জায়গা। খুব একটা বিস্তৃত অঞ্চলও নয়। এই ধরুন কলেজ স্ট্রীট আর মহাত্মা গাঁধী রোডের সংযোগস্থলে কম্পাসের খোঁচামতোটাকে গেড়ে, যদি সেখান থেকে কলুতলার মোড় অবধি ব্যাসার্ধ নিয়ে একটা গোলমতো আঁকা যায়, তাহলেই বই-পাড়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলো ওর মধ্যে পড়ে যাবে। অবিশ্যি ইদিকে-উদিকে কিছু শুঁড়টুড় বেরিয়ে থাকবে! এই অঞ্চলের মধ্যে আবার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট বলে একটা রাস্তা, যেখান দিয়ে চারজন মোটা মানুষ পাশাপাশি হাঁটলে, অন্য পথচারীদের কাঁকড়ার মতো পাশ ফিরে এগোতে হবে।
ওই রাস্তার প্রত্যেকটি বাড়িতে বোধ হয় তিন থেকে পাঁচটি বইয়ের দোকান। সব চাইতে ভাল ব্যাপার হল যে সেখানে বই বেচা-কেনা ছাড়া আর কিছু হয় না, হবার চেষ্টাও থাকে না, দরকারও নেই। যাদের মেঝে থেকে ছাদ অবধি থাকে থাকে শুধু নতুন নতুন বই, তাদের আবার ঘর সাজাবার কী দরকার?
অবিশ্যি ‘কিছু হয় না’ ভুল বললাম। কারণ ভারী মনোহর অতিথি আপ্যায়ন হয়। এত বেশি অতিথিবৎসল মানুষ এত কাছাকাছি পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। তা ছাড়া উৎকৃষ্ট সন্দেশের দোকানও নিশ্চয় আছে, কিন্তু কোথায় আছে। চোখে পড়ে না।
একটা বাড়ি আছে ওই রাস্তায়, তার একতলার সামনের ঘরগুলোতে অপেক্ষাকৃত বড় বইয়ের দোকান। তারই এক পাশে অন্দরে যাবার খিড়কি দোর। সেটা সর্বদা খোলা থাকে। সেখান দিয়ে ঢুকলে একটা উঠোনে পৌঁছনো যায়। সাবেকি উঠোন। এককালে কার গেরস্থালির অন্দরমহল ছিল, এখনও দেখলে মনকেমন করে। চারদিকে রক্ বাঁধানো। সেই রকে বেশ কিছু বইয়ের দোকান। একজন পথপ্রদর্শক ওই পর্যন্ত আমার সঙ্গে গিয়ে, ছায়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিন্তু দোকানে যারা ছিল, তারা আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। কী দিয়ে যে আমাকে সুখী করবে তা তারা ভেবে পাচ্ছিল না। বই না, চা না, লিম্কো না, পান না। অন্য কিছু বই আমদানি করে দেবে? না, তাও না। মোট কথা বিশ্বনাথ বলে আমি যে সুন্দরপানা খোঁচা নাক, রোগা লোকটিকে ছাড়া, মনে হল দুনিয়ার যাবতীয় সামগ্রী ওরা আমার জন্য এনে দিতে পারে। এমন কী আমি মিষ্টি খাই না শুনে, ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ চপ-কাটলেটের প্রসঙ্গও তুলেছিল। শেষপর্যন্ত বিশ্বনাথ যে ব্যবস্থা করে দেবে ভেবেছিলাম, সম্পূর্ণ অচেনা একটি ছেলে তার সবই করে দিল।
ওই রাস্তায় আরেকটা দোকান আছে, সে এত ছোট যে বইপত্র ছাড়া মাত্র তিনজনের জায়গা হয়। তাও একজনকে রাস্তার দিকে আর বাকি দুজনকে তার দিকে মুখ করে বসতে হয়। সে দুজনের নিচু টুল, অন্য জনের উঁচু আসন। নইলে তিন জোড়া হাঁটু রাখার জায়গা কুলোয় না। কিন্তু বড় ভাল জায়গা। ওখানে আমি জীবনের অনেকটা সময় কাটাতে রাজি আছি। অজেয় রায় বলে আমার চেনা একজন অপেক্ষাকৃত কমবয়সি লেখককে একবার ওখানে দু’ঘণ্টা বসে কিছু পাণ্ডুলিপির সংশোধন করে দিতে হয়েছিল। তিনি হাত-পা এলিয়ে দোকান জুড়ে বসে কাজ করছিলেন বলে তো আর প্রখ্যাত অতিথিসৎকার বন্ধ থাকতে পারে না! কিছু পরেই দেখা গেল রাস্তায় টুল পেতে—ফুটপাথের বালাইও নেই, জায়গাও নেই—তার ওপর দাঁড়িয়ে মালিকের ছেলে প্লেটে করে একটা গরম ডবল ডিমের মামলেট্ বাড়িয়ে ধরে আছে!
তাই বলে এহেন স্বর্গেও যে হিংসাত্মক ব্যাপার ঘটে না এমন নয়। অকুস্থলের চাক্ষুষ দর্শকদের কাছে শুনেছি, কয়েক বছর আগে, বেলা গড়িয়ে যখন প্রায় বিকেল, তখন এক হাতে একটা করে নারকোল প্যাটার্নের জিনিস উঁচু করে ধরে, কয়েকজন ভদ্র চেহারার যুবকের আবির্ভাব হল। তাদের দেখে সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠতেই, তারা বলল, ‘এগুলো নারকোল নয়, বোমা। যে যার নিজের জায়গায় বসে থাকলে কোনও ভয় নেই। কিন্তু রাস্তায় নেমে এলেই ইয়ে—!’
এই বলে বিশ্রী করে হাসতে হাসতে একটা বিশেষ দোকান থেকে সদ্য প্রকাশিত একটা বিশেষ বইয়ের যতগুলো কপি পেল রাস্তার মাঝখানে জড়ো করে, পা দিয়ে চেপে খানিকটা হাত দিয়ে ছিঁড়ে—অন্য হাতে সমানে নারকোল তুলে ধরা বলে সেটা কাজে লাগানো যাচ্ছিল না—কেরোসিন ঢেলে—হ্যাঁ, তখন পাওয়া যেত—অগ্নিসংযোগ করে, আধ ঘণ্টার মধ্যে কাজ সেরে, যেমন নারকোল হাতে এসেছিল, তেমনি নারকোল হাতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রতি বছরের মতো সেবারও আমি ওখানে নববর্ষ করতে গেছিলাম। সারা বছরে ওইটি আমার একটি প্রিয় অনুষ্ঠান। প্রথমে আনন্দ পাবলিশার্সে ডাবের জল আর বিনা-চিনির সন্দেশ। সেখান থেকে মিত্র ঘোষে দেখি মালিকদের প্রায় সবাই শুধু যে অদর্শন তা নয়, অন্য যাঁরা আছেন তাঁদেরও এমন একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, উসকো-খুসকো চুল আর পাঞ্জাবির হাত গুটোনো, যা অতিথিবৎসল গৃহস্বামীর মধ্যে একেবারেই শোভা পায় না।
অথচ আতিথ্যের ত্রুটি ছিল না। ক্ষীরের ছাঁচ খেল সবাই। রহস্যটি ক্রমে প্রকাশ পেল, যখন একটু গরম চেহারা নিয়ে কয়েকজন গুরুস্থানীয় ফিরে এলেন। শোনা গেল যে মোটা রিবেট দিয়ে একখানা বই ওই একদিনের জন্য বিক্রি হবে। বইটিকে ধর্মবিষয়কও বলা চলে। তা দুপুরের মধ্যে ৫ হাজার কপির গোটা সংস্করণ শেষ। কিন্তু গলিতে তখনও হাজার দুই লোক। তারা আবার বইয়ের আন্দোলন করছে। আমার আবার ওই গলিতেই তিন জায়গায় নেমন্তন্ন। তা ছাড়া যথেষ্ট কৌতূহলও ছিল।
ওঁদের বারণ না শুনে গলিতে ঢুকে আমি থ! একটা নলের মধ্যে যদি তিন-চারটে দড়ি লম্বালম্বিভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, গলির প্রায় সেই অবস্থা। কিন্তু সেরকম চ্যাঁচামেচি শুনলাম না। কারণ মালিকরা ছাপ দেওয়া স্লিপ বিলি করতে শুরু করেছিলেন। সেই স্লিপ দেখালে সকলে নতুন মুদ্রণের বই পেয়ে যাবেন। মিত্র ঘোষের বইয়ের দোকানের গ্রিল মনে হল গায়ের জোরে বন্ধ করা হয়েছিল। তবে ততক্ষণে পরিস্থিতিটা থিতিয়ে পড়েছিল।
আমি বলতেই আন্দোলনকারীরা পথ ছেড়ে দিলেন। গন্তব্য স্থানে গিয়ে দেখি দরজা ভেতর থেকে এঁটে বন্ধ। ততক্ষণে ভিড়ের মেজাজ ভাল হয়ে গেছিল। তাঁরা মহা উৎসাহে আমাকে সাহস দিতে লাগলেন, ‘হাঁক পাড়ুন, দরজা পেটান। আমাদের ভয়ে সবাই ভেতরে বসে আছে। ধাক্কাধাক্কি করুন।’ বলে সবাই হাসতে লাগল।
বাস্তবিক দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে বললাম, ‘ছি! ছি! ভিতু! কাপুরুষ! সিংহের সে তেজ কই?’ বন্ধুরা বললেন, ‘তা বলতে পারেন। কিন্তু যদি ইয়ে করে দিত!’ বলেই একটা লিমকো আর এক বাক্স সন্দেশ উপস্থিত করলেন।
পরে বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিক ফাঁকা, শান্তিপূর্ণ, নববর্ষের মধুর গুঞ্জনে মুখর। আন্দোলনকারীরা কেউ কেউ পান কিনছেন। এমন রোমাঞ্চ আর কোথায় পাব?