বংশের বাতি – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়

বংশের বাতি – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়

চোখ বুজলে নিতাই, চোখ খুললেও নিতাই। মহা ঝামেলা হল দেখছি। কি মন্ত্র যে ছোঁড়াটা ওর কানে ঢেলে দিয়ে গেল, এখনো তাই মাথায় ঘুরছে। নগদানগদ দু’শ টাকা তো কম কথা নয়, সঙ্গে আবার একখান শাড়িও। না বাবা, বলাবলির দরকার নেই। কথাটা কারো কাছেই ভাঙেনি হৈমন্তী। শুনলেই তো কাণ্ড ঘটবে। রোজকার মতোই সোয়ামীর সঙ্গে ব্যবহার করেছে, কোলের বাচ্চাটার গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, তারপর—হ্যাঁ, তারপরও এতটুকু আঁচ করতে দেয়নি ও লোকটাকে।

বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলে চরণের দিকে আবার তাকায় হৈম। লোকটা ঘুমুচ্ছে, মুখ দিয়ে এখন ফরফর করে শব্দ হচ্ছে। কী জাপটাজাপটিই না করতে পারে, মাগো, ভাবা যায় না। তিন কুড়ি বয়স হতে আর কত দেরি, কিন্তু রস মরেনি। বলে কিনা এবার একটা ছেলে কবরে। হৈম গা ঢাকতে ঢাকতে বলেছিল, এবার ক্ষেমা দাও দেখি, শরীরে আর সয় না। যত বুড়ো হচ্ছ, তত যেন—

আই দেখ, আমি বুড়ো?

তো কি, চুল পেকেছে, গোঁফদাড়ি পেকেছে, বুড়ো নও তো কি খোকা?

চরণের সামনের দুটো দাঁত তেঁতুলবিচির মতো কালো। তাই মেলে ধরে হাসতে হাসতে একটা বিড়ি ধরিয়েছিল, বুড়ো তো বুড়ো, বুড়োর হাড়ে যে ভেল্কি আছে বোঝ না?

হৈমন্তীও মুখ ঝামটা দিয়েছিল, ভেলকি না ছাই। ভেল্কি যত আমার ওপর। ওদিকে মেয়ে তিনটের কি হাল করে রেখেছ খেয়াল আছে? কুকুরছানার মতো এদোর-ওদোর ঘুরে ঘুরে কুটো-কাটা খায় দেখ না?

লোকটা লম্পটের মতো হাসতেই থাকে, ফুক ফুক করে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, মেয়ে দিয়ে ছাই হয়। ছেলে না হলে বংশ রাখবে কে শুনি? বংশে বাতি তো মেয়েরা দেয় না, ওই ছেলেই দেবে।

নিকুচি করেছে বংশের। এদিকে তো ঘর দিয়ে জল পড়ে, না খেতে পেয়ে আমসি মেরে যাওয়া। মরেই যদি গেলাম, বংশে কে বাতি দিল না দিল, কি আসে যায়।

বটে! চরণ হাসে, একেই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি। কোন্‌টা ভাল, কোন্‌টা মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকলে তো!

চিড়বিড় করে জ্বলে ওঠে হৈমন্তী, মেয়েমানুষের যদি সব খারাপ, তালে মেয়েমানুষের অত গন্ধ শোঁক কেন, অ্যাঁ? একটা রাতও তো মেয়েমানুষ না হলে চলে না দেখছি।

চরণ আবার দাঁত বার করে হাসে, কথার কোন উত্তর দেয় না। লুঙ্গি ঠিক করে উঠে গিয়ে ঢকঢক করে এক ঘটি জল ঢালে গলায়। তারপর বিছানায় এসে লাশটাকে ফেলতে ফেলতে বলে, ঘুমোও এবার। সারা রাত ধরে আমি ঝগড়া করতে পারব না, ঘুমোও।

সেই যে লোকটা বিছানায় পড়ল সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। ঘুমোয় বড় বিশ্রী করে। তাছাড়া ফরফর করা শব্দটায় বড় বিরক্তি লাগে হৈমন্তীর। কিন্তু আজ আর কোন দিকেই মন নেই ওর। মাথার মধ্যে কেবল নিতাই আর নিতাই।

আবছা আবছা অন্ধকার ঘর। খাওয়ার পাট চুকে যেতেই কুপিটা নিবিয়ে ফেলেছিল। কুপি নেবালেও দাপনার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো এসে আবছা আবছা করে রেখেছিল ভেতরটা। ঘরের কোথায় কি আছে সবই দেখা যায়। হৈমন্তীও উঠে গিয়ে ঢকঢক করে এক ঘটি জল খেয়ে এল। জল খেয়ে শরীরটা একটু জিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে টান-টান হল বিছানায়। নামেই বিছানা, স্যাঁতসেঁতে ভেজা ভেজা খান দুয়েক কাঁথা আর চট। বালিশটা যেন ইঁটের টুকরো। ব্যবহারে ব্যবহারে দড়চা মেরে শক্ত হয়ে উঠেছে। বলে কি না ছেলে করবে। হৈমন্তীকে ছেলে বিয়োতে হবে। আর সেই ছেলে বংশে বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকবে। আগে দুটো কাঁথা বালিশ কিনে দেখা, তবে তো বুঝব ক্ষেমতা।

মনে মনে বেশ খানিকক্ষণ বিড়বিড় করে হৈমন্তী। বড় মেয়ে হাসি, কতই বা বয়েস! বারো হয়েছে কি হয়নি। কলকাতায় এক বাবুর বাড়িতে ওকে রেখে এসেছে ওরা। বাসন-কোসন ধোয়, জল তোলে, বাবুর খোকাকে ইস্কুলে পৌঁছে দেয়, নিয়ে আসে। মাস গেলে তিরিশ টাকা মাইনে, সঙ্গে খাওয়া আর থাকা। বাবুটি বড় ভাল, ভরসা করেই হাসিকে ওখানে রাখ। কখনো-সখনো হাসি যখন বাড়ি আসে, দেখে তো মনে হয় না খারাপ আছে।

তা, হাসির পর বছর চারেক যেতে না যেতেই পেটে এল খুশি। সেবার কিন্তু ওরা বড় আশা করেছিল ছেলে হবে। হল না। পেট থেকে বেরিয়েই জানিয়ে দিল, ও মেয়ে। সেই মেয়েও দেখতে দেখতে আটে পা দিল। ঝি-চাকরের মেয়ে, আজ এখানে কাল ওখানে বেড়ালছানার মতো ঘুরঘুর করে। শেষটায় কালী সাঁতরাকে ধরে-করে রাখার বন্দোবস্ত করা হল ওর দোকানে, রাখো না কালী, তোমার তো লোকের দরকারই। কাজ যদি না পারে ফেরত দিয়ে যেও।

শেষ পর্যন্ত খুশিকে কালী সাঁতরাই দোকানে রাখল। মাস গেলে দশ টাকা মাইনে, ব্যস। চায়ের দোকানে দু-এক কাপ চা সব সময়ই ফ্রি। সকালে একটা গোটা পাউরুটিও ফ্রি। তবে, দু’বেলা ‘মিল’ খাওয়াতে পারবে না কালী। ওর সাফ কথা, দুপুরের মিল বাড়ি এসেই খেয়ে যেতে হবে। তবে রাতে যেহেতু দোকানেই থাকতে হবে, রাতের মিলটা না হয় কালীই খাওয়াবে। তাতে যদি রাজি থাক বাপু, আপত্তি নেই।

আপত্তি করার সাহস কার। মাসে মাসে দশ টাকা পাওয়া যাবে তাই বা কম কি! যাই হোক, ওইভাবেই হিল্লে হল খুশির। আর খুশির পর আর একটা জন্মালো, মেয়েই। রাগে কালাপাহাড় হয়ে উঠেছিল চরণ। শেষটায় অনেক কষ্ট করে ওর মাথা ঠাণ্ডা করতে হয়। আগের দুটোর সঙ্গে নাম মিলিয়ে এটার নামও রাখা হল, শশী । দেখতে দেখতে এই শশীরও পাঁচ বছর হয়ে গেল। এইটুকু মেয়েকে কাছছাড়া করা যায় না, হৈমন্তী ওকে সঙ্গে সঙ্গেই রাখে।

হাত বাড়িয়ে দেখল ক্ষুদ্রাকৃতি মেয়েটা একপাশে হাত-পা গুটিয়ে ঘুমুচ্ছে। খালি গা, বুকের হাড়-পাঁজরগুলো ডিগডিগ করছে, চামড়ার নিচে হয়তো কেবল রক্ত আছে, মাংস নেই। কোন কালে যে মাংস গজাবে তার সম্ভাবনাও নেই। মাংস হতে হলে পেটে যা পড়া দরকার তার কিছুই পড়ে না।

সংসারের এই হাল, বলে কিনা ছেলে চাই, কত শখ! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হৈমন্তী। তারপর হাই কেটে মুখের কাছে আঙুল এনে তুড়ি মারে বার তিনেক।

ঘরের বাইরে তখন একটানা ঝিঁঝি ডাকছে। রাত বেশ অনেকখানিই হয়েছে মনে হয়। এবার ঘুমোন দরকার। চোখ বুজল হৈমন্তী। আর চোখ বুজতেই সেই জ্বালা, ভেসে উঠল ছোঁড়াটার মুখ। নিতাইয়ের মুখ। পঁচিশ-তিরিশ বছরের ছোকরা, সরু গোঁফ, মোটা জুলপি। বাবুদের মতো পোশাক-আশাক। কাঁধের ব্যাগটার মধ্যে যেন পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য লুকোন আছে। হৈমন্তীর যদি দোজবরে বিয়ে না হয়ে সময়কালে বিয়ে হত তাহলে ওই রকমই একটা ডাগর-ডোগর ছেলে থাকত ওর। কপাল খারাপ, তাই ছেলের মুখ দেখা হল না। কপাল জুড়ে তিন তিনটে মেয়ে, এর মধ্যে বুড়ো কিনা আশা করে ছেলে হবে। হওয়াচ্ছি ছেলে! দাঁড়াও, দেখাচ্ছি তোমায় মজা।

আবার চোখ খুলে অন্ধকারের মধ্যে তাকায় হৈমন্তী। তাকিয়েও রেহাই নেই, সেই সরু গোঁফ, মোটা জুলপি, নিতাই।

কেমন বেহায়ার মতো পিছু পিছু হেঁটে গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে এল। হৈমন্তী তখন একা, তায় সন্ধে। শশী কোন আদাড়ে-বাদাড়ে গিয়ে ঘুরছে কে জানে!

ছোঁড়াটা পেছন থেকে ডাকল, বউদি, একটা কথা ছিল গো, শুনবে?

অবাক হয়ে তাকিয়েছিল হৈমন্তী, জানা নেই শোনা নেই, হঠাৎ বউদি ডাকে যে বড়! তব ভাল, বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে ও।

একটা জরুরি কথা ছিল বউদি। ছোঁড়াটা একেবারে আপনজনের মতো হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে, বসব?

হৈমন্তীর চোখে বিস্ময়, ভদ্রলোকের ছেলে বলেই তো মনে হয়। জিজ্ঞেস করল, কি কথা?

কথা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হয় নাকি? একটু বসতে বলবে তো!

ঘরের ঠিক সামনেই বাঁশের চটা দিয়ে একটা বেঞ্চ মতো বানান, ছোঁড়াটা ‘তাতেই বসে পড়ল পা ঝুলিয়ে। তারপর এ-পাশ ও-পাশ একবার তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদা নেই বাড়িতে?

ও মা গো, এ যে বসেই পড়ল। এমন লোককে যে কিভাবে আপ্যায়ন করতে হয় ওর জানা নেই। বলল, তোমার দাদা এখন বাড়ি থাকে নাকি! যেদিন কাজকৰ্ম্ম কিছু পায় না, সেদিন থাকে। আজ মিত্তিরদের পুকুর কাটার কাজে লেগেছে, কখন ফিরবে ঠিক নেই।

ছোঁড়াটা কাঁধের ঝোলান ব্যাগটা বেঞ্চের ওপর রাখে। মাটি কাটা কি রাতেও চলে নাকি বউদি?

হৈমন্তী ছোঁড়াটার আপাদমস্তক আর একবার দেখে নিল, বদ বুদ্ধি মাথায় আছে বলেও তো মনে হয় বলল, মাটি কাটা রাতে না হলেও, কাটাকুটির হিসেব বুঝিয়ে আসতে হয়।

তা তো ঠিকই। আমি ভাবলাম সন্ধে হয়েছে দু’জনকেই পেয়ে যাব। কথাটা সেরে বাড়ি চলে যাব।

তুমি কে হে বাপু? তোমায় তো চিনলাম না?

ছোঁড়াটা হাসল, আমার নাম নিতাই দাস। আসলে নিত্যানন্দ দাস, সবাই নিতাই ডাকে। তোমরাও আমাকে নিতাই বলেই ডাকতে পার।

হৈমন্তী ভাবল কথায় বাতায় তো খারাপ মনে হয় না, কিন্তু কি মনে করে যে বউদি পাতাতে এল আগে জানা দরকার। জিজ্ঞেস করল, বউদি না হয় বুঝলাম, কিন্তু কি মনে করে বাপু? ঝেড়ে কাস দেখি?

নিতাইয়ের মুখে সেই মিষ্টি হাসিটা লেগেই আছে। হাসতে হাসতেই ঝোলার ভেতর হাত ঢোকায়, কিছু কাগজপত্র বার করে। দুলদুলির স্কুল বাড়িতে যে ক্যাম্প বসেছে, জানো বউদি, আমি সেই ক্যাম্প থেকেই আসছি।

দুলদুলির ক্যাম্প! হৈমন্তীর মুখের রঙ কেমন বদলাতে শুরু করে এবার। ছোঁড়াটা তা হলে এই কর্ম করে! ভদ্দর ঘরের ছেলে হয়েও এই কাজ! কি জানি বাবা আজকাল কত কিছুই না হয়।

মনে পড়ে গেল দুলদুলির সেই ক্যাম্প নিয়ে কত ফিসফাস চার দিকে। মুখার্জিবাবুর বাড়িতে বাসন মাজতে যায় হৈমন্তী, সেখানেও সেই কথা। মুখার্জি বউ এক সময় একা পেয়ে ওকে শুধাল, কি লো হৈমন্তী, ক্যাম্পে গেলি না?

হৈমন্তী মুখ টিপে টিপে হাসে, আমার দরকার হবে না।

ওমা, দরকার হবে না মানে, তোর বয়স কত এখন, এর মধ্যেই তো তিনটে মেয়ে। বাঁচতে চাস তো ঘুরে আয় হৈমন্তী।

হৈমন্তী আর কথা বাড়ায়নি, ঠোঁটে প্রায় এসে গিয়েছিল, আপনি একবার যান না মা, পথ দেখান, তা হলে তো যাব! কিন্তু একথা কখনো বলা যায় না, চুপ করে থাকাই ভাল।

মুখার্জি-গিন্নি বললেন, বাসিনী তো ঘুরে এসেছে শুনলাম। একদিন মাত্র কামাই করেছে, আবার কাজে লেগেছে।

বাসিনীকে হৈমন্তী চেনে। পাশের বাড়িতেই কাজ করে ও। লেভেল ক্রসিংয়ের কাছেই থাকে। কিন্তু বাসিনী যে ক্যাম্পে গিয়েছিল একদম বলেনি ওকে। গোপনে গোপনে কে কি করে কোন কিছুরই হদিস পায় না হৈমন্তী

ফ্যালফ্যাল করে ছোঁড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু।

নিতাই একগাদা ফর্ম বার করে এগিয়ে ধরে, দেখ না বউদি, কত জনাই সই করেছে। বাড়ি বাড়ি যেতে হয় না, এমনিতেই কত এসে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে।

একটু থামে নিতাই, তারপর আবার শুরু করে, আসলে এটা যদি সরকারের ক্যাম্প হত আমি তোমায় কিছু বলতে আসতাম না। এটা হচ্ছে মিশনের ব্যাপার। বাছা বাছা সব ডাক্তার, নার্স। কাজটা সারা হয়ে গেলেই গুনে গুনে দু’শ টাকা হাতে তুলে দেবে, তাছাড়া একটা শাড়ি, তাছাড়া—

হৈমন্তী বাধা দেয়, তুমি বুঝি দালাল? শেষটায় আর কাউকে না পেয়ে এখানে।

নিতাই একগাল হাসে, তা দালালই বলতে পার। আসলে বউদি, অনেকে আছে যেতে ভয় পায় ; ভাবে. কি না কি! আমি শুধু ভয়টুকুই ভাঙিয়ে দিই। তাছাড়া আমি যেটা বলছিলাম, এসব কাজে কে কবে দু’শ টাকা করে হাতে পেয়েছে বল দেখি। টাকা ছাড়া একটা নতুন শাড়ি, নিজের পছন্দমতো দেখে-শুনে নিতে পারবে শাড়িটা। এর পর আবার দুধ খাওয়াবে, ফল খাওয়ারে। ফল মানে কলা, আঙুর। আঙুর আমরা পয়সা দিয়ে ক’জন কিনে খেতে পারি বল! তা, এসব তো যেমন-তেমন, আসলে সকালে গেলে বিকেলেই আবার হাসতে হাসতে ফিরে আসতে পারবে। কেউ টের পাবে না, তুমি নিজেই টের পাবে না তো অন্যের কথা আলাদা।

ছোঁড়াটা বেশ কথা বলতে পারে, শুনতে বেশ ভালই লাগছিল ওর। কিন্তু চরণের কথা মনে পড়ল, জানতে পারলে লোকটা ওকে ছিড়ে খাবে। প্রথমেই বলবে, খোদার ওপর খোদকারি করার দরকার নেই, খবরদার। হৈমন্তী বলল, বেঁচে থাকলে অনেক ঘি দুধ খেতে পারব, তোমার কথা তো হয়েছে, এবার যেতে পার।

আই দেখ। তোমাকে বউদি ভালর জন্যই বলতে এলাম, রাগ করছ? ক্যাম্পে তুমি না যেতে চাও যাবে না, সেটা তো আর বড় কথা নয়, তোমার সঙ্গে আলাপ হল, তোমায় বউদি বলে ডাকলাম, না হয় এক গ্লাস জলই খাওয়াও।

হৈমন্তী বলল, গেলাস কোথায় পাব, আমাদের গেলাস নেই।

সে কি বউদি, তোমরা জল খাও না?

খাব না কেন, ঘটি থেকে খাই।

তা হলে ঘটিতেই দাও, ও আমি আলতো করেই ঢেলে খাব।

জল চাইলে জল না দেওয়া পাপ। হৈমন্তী বলল, বস আনছি।

ঘরের ভিতর ঢুকল হৈমন্তী। ঘর বলতে বাঁশের চাঁচের বেড়া, ওপরে খড়। মেঝেটা গোবর দিয়ে নিকিয়েও টান-টান রাখা যায় না, এবড়ো-খেবড়ো। একপাশে একটা ধোকড়া বিছোন, তার উপর পাকিয়ে পাকিয়ে কাঁথা চটের বিছানাটা গোটান। উলটো দিকে একটা উনুন, তারই পাশে একটা জল রাখার মাটির হাঁড়ি, ঘটি। আর একপাশে ঝটিা লাঠি, কলাইকরা গোটা তিনেক সানকি, হাঁড়ি কড়া খুন্তি। খান চারেক টিনের কৌটোও রয়েছে।

হাঁড়িটা কাত করে ঘটিতে জল ঢালল হৈমন্তী। জলের একেবারে তলানিটাই রয়েছে। সারাদিন আজ সময়ই পায়নি জল তোলার। সকালে বিকেলে বাড়ি বাড়ি ঝি-খাটা, সময় কোথায়! ছোঁড়াটা বিদেয় হলে সবার আগে জল ভরে নিতে হবে হাঁড়িতে।

জলের ঘটি নিয়ে আবার বাইরে এল, ঘটিটা এগিয়ে ধরল, খাও। খেয়ে এবার বিদেয় হও, মেলাই কাজ পড়ে আছে আমার।

নিতাই ঘটিতে মুখ না লাগিয়ে জল ঢালল গলায়। খানিকটা চলকে পড়ে ওর জামা ভিজল। হাসল, টিউকলের না পুকুরের গো?

টিউকলের। জামাটা ভেজালে তো!

ও কিছু না, এখনি শুকিয়ে যাবে। নিতাই পকেট থেকে সিগারেট বার করল, ধরাল। তোমার ছেলেমেয়ে কটি বউদি?

ছেলে নেই, তিন মেয়ে। কেন, কি হবে?

না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম, আসলে এইটুকু তো ঘর, ক’জন থাক এখানে, কষ্ট হয় না?

আ মরণ। আমাদের কষ্টে যেন ঘুম আসছে না বাবুর।

নিতাই ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, কষ্টটা অবশ্য যার যার, তার তার, তা দাদা না হয় কাজে বেরিয়েছে, কিন্তু মেয়েদের দেখছি না? মেয়েরা বড় না ছোট গো?

হৈমন্তী আবার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখে ছোঁড়াটার। বলে, দুটি মেয়ে কাজ করে, আর ছোটটা এদিক-ওদিক কোথাও হয়তো গেছে। এখনই ফিরে আসবে।

কাজ করে, ও বাবা, তা হলে তো বেশ বড়ই বলতে হয়। কোথায় কাজ করে?

একজন একটা চায়ের দোকানে, আর একজন এক বাবুর বাড়িতে। ওখানেই থাকে, রাতে ফেরে না।

তাই বুঝি! তা তিনটে তো মেয়ে রয়েই গেছে তোমার, আর বাড়িয়ে কি লাভ আছে বউদি? কিছু মনে কোরো না, আমি ক্যাম্পের লোক বলে বলছি না, ছেলেমেয়ে যত বাড়ে ততই দুর্দশা বাড়ে, তাড়াতাড়ি শরীরও ভেঙে যায়, তাই না?

ভাঙুক। তোমার মাথা ঘামাতে হবে না, এবার বিদেয় হবে না, লোক ডাকব? মুখের চেহারা বেশ শক্ত করে ফেলে হৈমন্তী।

নিতাইও কেমন নির্বিকার। লোক ডাকতে হবে না বউদি, সবার বাড়িতেই আমি যাব। আমার কাজই হল বাড়ি বাড়ি যাওয়া। হাসে।

হৈমন্তী হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ছোঁড়াটার সঙ্গে কথায় পারা যাবে না। মুখে যেন সরস্বতী।

নিতাই হাসতে হাসতেই আবার ব্যাগ ঘাঁটে, ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবার কয়েকটা ফর্ম বার কবে, এই দেখ না বউদি কত ভদ্র ঘরের বউরাও সই করেছে। সবাই কি আর টাকার জন্য সই করেছে নাকি, আসলে বাঁচতেই যদি হয় মানুষের মতো বাঁচা উচিত। একগাদা বাচ্চাকাচ্চা হলে বাচ্চাকাচ্চাদের বাঁচাবে, না নিজে বাঁচবে।

কথাটা যে খুব একটা খারাপ বলছে তাও নয়। বড়লোকদের কাছে দু’শ টাকার কোন দাম না থাকতে পার কিন্তু ওর কাছে যে অনেক তাতে সন্দেহ নেই। একসঙ্গে দু’শ টাকা জীবনে কখনো দেখেছে নাকি হৈমন্তী! তাছাড়া আবার শাড়িও!

দেখবে নাকি একটা ফর্ম। জিজ্ঞেস করে নিতাই।

হৈমন্তী কেমন নরম সুরেই কথা বলে, ও সব দেখে আমি কি করব। আমি কি লেখাপড়া জানি নাকি!

তালে খালি ফর্ম একটা রেখেই দাও, যারা লেখাপড়া জানে তাদের দেখিয়ে নিতে পার। নিচে, এই জায়গাটায় কেবল একটা টিপসই দিতে হবে, ব্যস।

হৈমন্তী আড় চোখে একবার দেখে নেয় কোথায় টিপসই মারতে হবে, তারপর আবার তাকিয়ে থাকে।

নিতাই বলে, রাতে দাদার সঙ্গেও একটু কথা বলে নাও না। আমার তো মনে হয়; দাদা আপত্তি করবে না।

হৈমন্তী মনে মনে হাসে, কত যেন চেনে দাদাকে। এ সময় যদি লোকটা সামনে থাকত. শাবল তুলে মারতে আসত।

ফর্মটা নাও তা হলে, কাল একসময় এসে আমি না হয় জেনে যাব। কেমন? ক্যাম্প এখনো দশ দিন চলবে, অনেক সময় আছে।

উঠে দাঁড়ায় নিতাই। হৈমন্তীর যে কি হল, হাত বাড়িয়ে ফর্মটা নিয়েই নিল।

দাঁড়িয়ে আবার ঝোলার ভেতর হাত ঢোকাল নিতাই, তারপর এক মুঠো কি যেন বার করে এনে তুলে ধরল।

কি এগুলো? হৈমন্তী অবাক হয়ে তাকায়। তারপর হাতে তুলে দেখে লাল নীল কাগজের মোড়কে ঢাকা লজেন্স। ওমা, এতগুলো!

নাও না, মিশন থেকে বিলি করতে দিয়েছে। তোমার মেয়েদের দিও।

বোকার মতন লজেন্স হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হৈমন্তী।

নিতাই হাসে, তুমিও খেও, দাদাকেও দিও। মিশনের লোকগুলো কিন্তু সত্যি সত্যি বড় ভাল। ক্যাম্পে তোমাকে যখন নিয়ে যাব, তখনই দেখতে পাবে। আমি তা হলে এখন যাই বউদি, ওই কথা রইল, কাল এসে কিন্তু জেনে যাব।

হৈমন্তী কথা খুঁজে পায় না।

ছোঁড়াটাও আর দাঁড়ায় না, হাসিমুখে ঝোলাটা কাঁধের ওপর ফেলে হাঁটা শুরু করে দেয় সামনের দিকে। কিছুক্ষণ পর চোখের বাইরে মিলিয়েও যায়।

আর তারপর থেকেই চোখ বুজলে নিতাই, চোখ খুললেও নিতাই। সরু গোঁফ, মোটা জুলপি, চোখে মুখে যেন কথা বলে। কাগজের মোড়ক খুলে একখানা লজেন্স মুখে পুরল হৈমন্তী, চুষতে শুরু করল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হল, ওর পুচকে মেয়েটা সারা সন্ধ্যা রেল স্টেশনে ঘুরঘুর করে দু-চার পয়সা যা পেয়েছিল, তাই দিয়ে আলুরদম খেয়ে এসেছে। তাই শুনে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। হৈমন্তীর। কিন্তু আজ আর বকাঝকা নয়। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ওর। চরণ ফিরল একটু রাত করেই। ততক্ষণে ভাত আর আলুসেদ্ধ নামিয়ে ফেলেছে ও। ঘরে তেল বাড়ন্ত, ফলে আর কিছু রান্না নেই। কতদিন তো কেবল নুন ছড়িয়ে ছড়িয়ে শুধু ভাতই খেতে হয়, আজই বা ক্ষতি কি!

নিতাইয়ের দেওয়া ফর্মটা সারাক্ষণ কোমরে কোমরে রেখেছিল ও। খাওয়ার পাট চুকতেই ফর্মটা লুকিয়ে এক ফাঁকে একটা টিনের কৌটোর মধ্যে ঢোকাল, তারপর হাসিমুখে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বিছানায় এসে গড়িয়ে পড়ল কুপি নিবিয়ে।

॥ ২ ॥

দুলদুলি হেঁটে গেলে বড়জোর তিরিশ-চল্লিশ মিনিট লাগে, প্রায় দু কিলোমিটার পথ। বাসেও যাওয়া যায়। কিন্তু বাসের কি ঠিক আছে, পর পর হয়তো দুটোই এল, আবার হয়তো একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাক, একটাও নেই। হৈমন্তী ঠিক করেছিল, বাসরাস্তার মুখে ও দাঁড়িয়ে থাকবে আর নিতাই ওখান থেকে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। চরণকে ঘুণাক্ষরে ও কথাটা জানায় নি। জানালেই তো যত রাজ্যের ঝামেলা বাধিয়ে রাখবে। লোকটাকে ও আগাপাশতলা চেনে, না জানানোই ভাল। গুনে গুনে দু’শ টাকা বাড়ি নিয়ে আসতে হবে, টাকার কথাও জানাবে না। তবে শাড়িটা তো দেখবেই। দেখুক গে, বলা যাবে, দুলদুলির হাট থেকে কিনে আনলাম।

দুলদুলি বেশ বড় জায়গা, সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে।সেই হাটে কি না পাওয়া যায়! মনে পড়ল, গত মাসেই তো বাসিনীকে নিয়ে দুলদুলি গিয়েছিল কাচের চুড়ি কিনতে। চুড়িগুলো তো আর সব সময় পরা যায় না; আজ পরেছে। শাড়িটা কাল সোডাকাচা করেছিল, সেটাও আজ পরেছে। চুলটুল বড় একটা বাঁধার সময় পায় না হৈমন্তী, আজ চরণের সামনেই বসে বসে চুল বেঁধেছে। কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়েছে।

চরণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, চুল বাঁধছ?

কাজ সেরে একবার দুলদুলির হাটে যাব।

কেন?

বাসিনীকে নিয়ে যাব, ও কাপড় কিনবে।

বাসিনী একা যেতে পারে না?

পারবে না কেন, তবে বলছে আমাকে যেতে, তাই যাওয়া। তোমার তো আজও মাটি কাটা, ফিরতে ফিরতে সেই রাত।

পান্তা খাচ্ছিল চরণ। একটু হাসল, দিন পনেরো চলবে মনে হয়। মাঝখানে ওই ফড়ে দালালগুলো না থাকলে অনেকগুলো করে টাকা পাওয়া যেত।

হৈমন্তী আর কথা বাড়ায়নি। টাকা তো ছাই, হৈমন্তী যদি ঝি না খাটত টেরটা পেত তা হলে।

দরজার ঝাঁপ বন্ধ করে বেরিয়ে পড়েছিল হৈমন্তী। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল একেবারে বাসরাস্তায়। জায়গাটা ফাঁকা, ছোঁড়াটা কখন আসবে কে জানে! ফর্মে তো টিপসই করিয়ে নিয়েছে। কি জানি বাবা, কি আছে আজ কপালে কে বলবে!

রাস্তার একধারে হাঁটু মুড়ে একটু বসল হৈমন্তী। মুখার্জিবাবুর বাড়িতে একগাদা বাসন জমে থাকে সকালে। আজ তো রেগে কাঁই হয়ে থাকবে। থাকুক। সব কাজে ছুটি থাকে, আমাদের এক-আধ দিন কামাই হলেই যত দোষ। অবশ্য আর দুটো বাড়ির জন্য অত ভাবে না হৈমন্তী। শরীর খারাপ ছিল বললেই মিটে যাবে। মুখার্জি-গিন্নির মতো অত খিটখিটে নয় ওরা।

হু-হু করে একটা বাস আসছে দেখতে পেল। ওমা, বাসের যেন গা দেখা যায় না, এত মানুষ। ছাদেও লোক, সবাই হাটের সওদা নিয়ে চলেছে। একগাদা মুরগির ঝুড়িও উপরে। এই বাসে কি মানুষ উঠতে পারে। উঠে রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা তফাতে দাঁড়ায় হৈমন্তী। বাসটা হর্ন দিতে দিতে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, লোক নামবে।

মুখটা একটু ঘুরিয়ে রাখল হৈমন্তী। আবার কোন চেনাশোনা লোক বেরিয়ে পড়ে কি না কে জানে! দেখলেই জানতে চাইবে, কোথায় চলেছি, কেন চলেছি। লোকের তো আর সন্দেহের শেষ নেই। সবাই যেন মুখিয়ে থাকে।

দু-তিনজন নামল। হ্যাঁ, নিতাইকেও দেখতে পেল হৈমন্তী, সঙ্গে দু’জন মহিলা। কে রে বাবা, এ আবার কারা! এ অঞ্চলের বলে তো মনে হয় না। কোনদিন এদের দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না হৈমন্তী।

বাসটা আবার একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল। কণ্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, দুলদুলি দুলদুলি। চেঁচানিটা মিলিয়ে গেল।

নিতাই এগিয়ে এল, এই যে বউদি, এসে পড়েছ! যাক বাবা বাঁচালে। দাঁড়াও তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, এ হচ্ছে সুধাদি আর ইনি মল্লিকা।

হাত তুলে নমস্কার জানাল ওরা। হৈমন্তী কি এসব পারে, লজ্জা পেয়ে গেল।

নিতাই বলে, বুঝলে সুধাদি, বউদি কিন্তু এককথাতেই রাজি হয়ে গেছে।

খুব ভাল! এ সুযোগ কি কেউ হাতছাড়া করে। তা, দাদা আসেননি?

হৈমন্তী নিতাইয়ের দিকে তাকায়, না বাপু তোমার দাদাকে বলতে পারলাম না। তাছাড়া এত ব্যস্ত লোক, ভোর না হতেই কাজে বেরিয়ে গেছে।

নিতাই ব্যাপারটা খানিকটা আঁচ করে নিল। বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে। দাদা না থাকলেও চলবে। বিকেলে বাড়ি ফিরে গিয়ে দাদাকে সব বলে দিও তা হলেই হবে।

হৈমন্তী কথা বলে না, কেমন যেন ভয়-ভয় লাগতে থাকে ওর। এ যেন অনেকটা চুরি করতে যাওয়ার মতো ব্যাপার। কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়া। কাজটা ও ভাল করছে কি না কে জানে! অন্তত ওব সোয়ামীর কাছে কথাটা না বলে যেন ও অন্যায়ই করেছে।

মল্লিকা বলল, সুধাদি চল, আমরা ওদের নিয়ে আসি। ওরা তো বাড়িতেই আমাদের জন্য বসে থাকবে বলেছিল।

নিতাই বলল, হ্যাঁ সুধাদি, তোমরা নিয়ে এস গে : আমরা কি দাঁড়াব?

বাস যদি ফাঁকা পাও চলে যেও। আমরা দেখি গে আবার কি বলে ওরা।

মল্লিকা বলল, ওরা তো কথাই দিয়েছে, আবার কি বলবে?

সুধা চাপা গলায় ফিসফিস করে, মত পাল্টাতে কতক্ষণ, ও আমার অনেক জানা আছে। আড়চোখে একবার হৈমন্তীর দিকে তাকায়, বুঝলে বউদি, আসলে সবাই না এসব ব্যাপারে বড় ভয় পায়। অথচ ভয়ের কি আছে বলো! মাত্র তো একটা দিনের ব্যাপার, তাই না? তারপর কত নিশ্চিন্তে বাঁচা যায় বলো!

হৈমন্তীও আড়চোখে একবার নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে নেয়, ছোঁড়াটা পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাচ্ছে। সুধাদিকে ইশারায় একটু আড়ালে ডাকে হৈমন্তী।

সুধা বুঝতে পারে, কোন গোপন কথা হয়তো বলবে। এগিয়ে এসে খানিকটা কাছে টেনে নেয় হৈমন্তীকে, কি গো বউদি, কিছু বলবে?

হৈমন্তীর চোখে কিছুটা লজ্জার আভা, একটা কথা জিজ্ঞেস করে নেব ভাবছিলাম।

কি কথা বলো না? লজ্জা কি; আমার কাছে বলতে পার।

হৈমন্তী মুখ নিচু করে বলল, সোয়ামীর সঙ্গে আবার শুতে পারব তো? লোকটা বড় পাগল গো সুধাদি।

ওমা, শুতে পারবে না কেন! তোমার তো সব ঠিকই থাকবে, কেবল বাচ্চা হবে না। তুমি বরং আরো বেশি করে তোমার স্বামীকে ভালবাসতে পারবে।

কিন্তু—

কিন্তু কি আবার? সুধা ওর গায়ে হাত বোলায়।

কিন্তু লোকটার বড় ইচ্ছে ছিল গো, আমাদের একটা ছেলে হয়। আমাদের তো ছেলে নেই, তিন মেয়ে।

ওমা, তিন মেয়ে তো অনেক। মেয়েরা কি আজকাল ফেলনা নাকি! মেয়েরা কি আজকাল ছেলেদের চেয়ে কম যায় নাকি! অ্যাঁ?

চুপ করে শোনে হৈমন্তী, কি করে বোঝাবে বংশের বাতি তো মেয়েরা জ্বালাতে পারে না, ওটা ছেলে সন্তান থাকলে তারাই জ্বালায়।

কি হল, চুপ করে রইলে যে, দিনরাত এত লোক আমাদের ক্যাম্পে আসছে, সব কি এমনি এমনি আসে নাকি! সবাই কি বোকা? তুমি তো জান না, কত সাহেবসুবোর বউরাও আসে। যাদের একটু বুদ্ধি আছে, তারাই ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলার জন্য ছুটে আসে। কি হল, বিশ্বাস হল না বুঝি? বেশ তো, যাও না ওখানে, গেলেই দেখতে পাবে কি কাণ্ড চলছে।

হৈমন্তী ফিসফিস করে বলে, না না, যাব বলেই তো বেরিয়েছি, কিন্তু সোয়ামীর জনাই একটু মনখারাপ লাগছে গো।

আই দেখ কি বোকা, সোয়ামী বরং খুশিই হবে শুনলে। আমরা তো দিনরাত এই করছি, কত দেখলাম। স্বামীরাই বরং অনেক জায়গায় আগ্রহ দেখায়। আসলে তোমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কথা। দেখে নিও, শরীরে তোমার এতটুকু আঁচড় লাগবে না। যাও। তোমরা বরং ফাঁকা বাস পেলেই উঠে পড়, আমরা আরো দু-তিনজনকে নিয়ে আসছি। ও নিতাই, তোমার বউদিকে বরং তুমি নিয়ে আগেই চলে যাও। আমরা পরেই আসছি।

নিতাই বলল, তাই ভাল। বিকেল বিকেল আবার ফিরতে হবে।

সুধা আর মল্লিকা হাঁটা দিল গাঁয়ের দিকে।

নিতাই বাস আসে কি না দেখার জন্য রাস্তার শেষ প্রান্ত অবধি তাকাল। ধুধু করছে ফাঁকা। এখানকার বাসের মাথামুণ্ডু কিছুই ঠিক থাকে না। বউদি, তোমাদের এদিকে বাসের কোন নিয়মকানুন নেই গো।

হৈমন্তী বড় একটা বাসে চড়ে না। চড়ার দরকার হয় না। দুলদুলির হাটে যতবার ওরা গেছে হেঁটেই গেছে। বলল, চল তা হলে হেঁটেই যাই। কতক্ষণ আর লাগবে।

হাঁটবে! হৈমন্তীর মুখের ভাবটা দেখে নিল নিতাই, ঠিক আছে, তা হলে চল হেঁটেই যাই, ফেরার সময় না হয় বাসেই ফিরব।

হৈমন্তী জানে, হাঁটাপথ মানে বাসরাস্তা দিয়ে নয়, এদিক-ওদিক দিয়ে, কখনো টানা মাঠের মধ্য দিয়ে। ফলে কিছুটা সুবিধেই হবে ওর। চেনা লোকজন চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। বাসে। যাওয়া মানেই বাসভর্তি লোক ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকাবে, নির্ঘাত সন্দেহ করবে ও ক্যাম্পে যাচ্ছে।

চল। হাঁটা শুরু করে দেয় হৈমন্তী।

নিতাইও এগিয়ে এসে পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতেই বলে, আসলে মিশনের তিনটে গাড়িও আছে, কিন্তু তার মধ্যে একটা গেছে কলকাতায়, কালই ফেরার কথা। একটা গাড়ি খারাপ, মিস্ত্রি সারাই করছে। আর একটা ছুটোছুটি করছে ঠিকই, কিন্তু সেই গাড়িতে যেতে হলে বিকেলের আগে আর যাওয়ার উপায় নেই। তার মানে রাতটা ওখানে থেকে পরদিন আসতে হয়।

হৈমন্তী ঠিক বুঝতে পারে না কি বলতে চাইছে নিতাই। উত্তর দেয় না।

নিতাই বলে, তবে আমি কিন্তু চেষ্টা করব, ফেরার সময় বাসে-ফাসে না উঠে গাড়িতেই যাতে ফেরা যায়।

ফেরার ব্যাপার তো পরে। হৈমন্তীর কেমন খারাপ লাগতে থাকে, বড্ড বকতে পারে ছোঁড়াটা। ওদিকে চরণ টের পেয়ে গেল কি না কে জানে! বাসিনীর তো শয়তানি বুদ্ধির শেষ নেই, দেখা হলে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে। অথচ ও নিজেই তো দুলদুলি গিয়ে দু’শ টাকা নিয়ে এসেছে।

হৈমন্তী একবার একটু নিতাইয়ের দিকে তাকায়, সুধাদি ওরা কাকে আনতে গেল গো?

কাকে আবার! স্টেশনের কাছাকাছি দু-তিনটে বাড়ির সঙ্গে ওরা কথা বলে এসেছিল, সেখানেই যাবে।

হৈমন্তীর চোখের ওপর রেলস্টেশন এলাকাটা ভেসে উঠল, কিন্তু কিছুতেই আঁচ করতে পারল না কে হতে পারে।

নাম জান না?

নিতাই হাসলো, অত নাম কি মনে থাকে! ওদের তো নিয়েই আসছে, দেখতে পাবে তখন।

হৈমন্তী আর কথা বাড়ায় না। পথ ক্রমশ যেন ফুরিয়ে আসছে। কি জানি বাবা, কি আছে কপালে! বুকের ভেতর ধুকধুক করতে থাকে। ধুকধুকুনিটা যেন বেড়েই চলেছে।

আরো কিছুক্ষণ পর নিতাই আবার সিগারেট বার করে, ধরায়, তারপর সামনের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, বউদি, শুনতে পাচ্ছ?

কেমন যেন চমকে উঠেছিল হৈমন্তী, কি?

শুনছে পাচ্ছ না, মাইক বাজছে। আমরা এসে গেছি গো।

কান পাতে হৈমন্তী, হ্যাঁ, মাইকের শব্দই মনে হচ্ছে, গান হচ্ছে।

দুলদুলির স্কুলবাড়িটাকে কত সুন্দর করে সাজান হয়েছে, দেখে মনে হবে যেন পুজোমণ্ডপে এলাম।

বুকের ভেতর যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছিল হৈমন্তীর। কান পেতেই হাঁটতে লাগল। মাইকের শব্দ একটু একটু করে যেন স্পষ্ট হচ্ছে। অথচ গানের কোন কথাই ওর মাথায় ঢুকছে না, কেমন যেন ঝাঁ ঝাঁ করছে চোখ-মুখ। এক ফাঁকে একটু তাকিয়ে নিল ছোঁড়াটার দিকে, কিন্তু আর কিছুই জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না।

বাতাসে গায়ের কাপড়টা উড়তে শুরু করেছিল, দ্রুত সেটা টেনে নিয়ে শক্ত করে কোমরে গুঁজল, গায়ে জড়াল। তারপর কেমন এক ঘোরের মধ্যে যেন এগিয়ে চলল সেই মণ্ডপের দিকে।

॥ ৩ ॥

চরণ বাড়ি ফিরে দেখল, হৈমন্তী নেই। ঘরে দরজাটা খোলা। ভেতরে অন্ধকারে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে।

এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল ও, কোথায় যেতে পারে। ওদিকে খিদেয় পেট জ্বলছে, ভাত রেঁধেছে বলেও তো মনে হয় না। উনুনের দিকে এগোল, হাঁড়ি ফাঁকা। সকালবেলার ওর পান্তা খাওয়া সানকিটাও পড়ে আছে। আশ্চর্য, কোথায় যেতে পারে! তবে কি সেই যে সকালে বেরিয়েছে এখনো ফেরেনি! কেমন যেন সন্দেহ হয় ওর।

দেশলাই জ্বালিয়ে কুপিটাকে ধরিয়ে নিল, তারপর বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে এল, শশী, এই শশী।

শশী হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে গুটলি মেরে পড়ে আছে। খেয়েছে কি না তাও বোঝার উপায় নেই।

শশী, এই শশী। একটা থাবা কষিয়ে দিল মেয়েটার গায়।

উম্!

উম্ কি? তোর মা কই?

উঠে বসে শশী, চোখ কচলায়, কাঁদে।

মর জ্বালা, কোথায় গেছে বলবি তো!

শশী কাঁদতে কাঁদতেই বলে, জানি না।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে চরণ, জানিস না মানে, তোর মা বাড়ি ফেরেনি? দুপুরে ফেরেনি?

মেয়েটা ফোঁপায় আর কাঁদে।

আশ্চর্য! মাথাটা গরম হতে থাকে চরণের। সকালে যে অত সাজগোজ করছিল, চুল বাঁধছিল, তবে কি—

এই ওঠ। মেয়েটাকে একটা থাবা মেরে তলে ধরে চরণ, যা মুখার্জিবাবুর বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়।

মেয়েটা চোখ কচলাতে কচলাতেই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চরণ চেঁচিয়ে ওঠে, কেবল মুখার্জিবাবুর বাড়ি না, সব বাড়ি যাবি। জিজ্ঞেস করবি কাজ করেছে কি না, কোথায় গেছে, কখন ফিরবে। বুঝলি?

বাইরের অন্ধকারের মধ্যে ততক্ষণে মিশে গেছে শশী।

চরণ ঘরের ভেতর বার দুয়েক এদিক-ওদিক করল, বউটা এমন হাবা যে ভাবাই যায় না। এমন মেয়েছেলে নিয়ে কে কবে ঘর করতে পারে। আশ্চর্য, কোথাও যদি যায়ই, বলে যাবে তো!

হঠাৎ মনে পড়ল, বাসিনীকে নিয়ে দুলদুলির হাটে যাবে বলেছিল। শাড়ি কিনবে বাসিনী, তাতে তোর কি, তুই কেন সঙ্গে যাবি! বোকা না হলে এমন হয়। চরণের মাথার মধ্যে দপদপ করতে থাকে। সকালে চারটি পান্তা খেয়েছিল, ব্যস! সারাদিন মাটি কাটতে কম ধকল গেছে নাকি শরীরে। কে বোঝে!

আবার দুপদাপ করে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক করল চরণ, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল, ঝিমঝিম করছে অন্ধকার। ঝিঝি ডাকছে। বাইরের সেই বাঁশের বেঞ্চে বসল। কিন্তু বসা কি যায়, আবার উঠে দাঁড়াল। নাহ, বাসিনী ফিরেছে কি না দেখা যাক। হনহন করে পা চালিয়ে দিল ও বাসিনীদের বাড়ির দিকে।

বাসিনীর কথাবার্তা ধরন-ধারণ কোনদিনই ওর ভাল লাগে না। বড় চালবাজ। থাকিস তো আমাদেরই মতো উটকো জমিতে। কবে এসে বাড়িঘর ভেঙেচুরে তুলে দিয়ে যাবে, ফুটুনি বেরুবে।

বিড়বিড় করতে করতে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হাঁটে চরণ। হাঁটতে হাঁটতে লেবেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে বাসিনীদের ঝুপড়িটা দেখতে পায়। ভেতরে আলো জ্বলছে। আলো জ্বললেই যে বাসিনী থাকবে এমন কোন কথা নেই। এগিয়ে গিয়ে চরণ ডাকল, বাসিনী আছ নাকি গো?

এক ডাকেই উত্তর, কে?

আমি চরণ।

বাসিনীই বেরিয়ে এল ঘরের ভেতর থেকে, ওমা চরণদা! কি খবর, হৈমদি ফেরেনি?

চরণ অবাক হয়ে তাকায়, ফেরেনি মানে, তোমার সঙ্গে ও দুলদুলি গিয়েছিল না? তুমি কখন ফিরলে?

বাসিনী অবাক হয়ে তাকায়, আমি যাব কেন, আজ তো ও একাই গেছে। ক্যাম্পে গেছে, তুমি জান না?

ক্যাম্পে গেছে। চরণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। ক্যাম্পে গেছে মানে?

দুলদুলিতে ক্যাম্প বসিয়েছে সাহেবরা, জান না? তোমায় বলেনি? ওমা, ঘরের লোককে না জানিয়ে কেউ একা একা যায় নাকি!

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে চরণ।

বাসিনী বলে, রাতে ফিরতে না পারলে সকালে ফিরবে। ও তুমি কিচ্ছু ভেব না চরণদা। তোমার বউকে কেউ চুরি করেনি, ও ঠিক ফিরবে। আমি তো বাবা দিনে দিনেই ফিরে এসেছিলাম। আমার কোন কষ্টই হয়নি।

তুমিও ক্যাম্পে গিয়েছিলে? কবে?

ওমা জান না। তিন দিন হয়ে গেল? ডাক্তারগুলো খুব ভাল চরণদা। মা ছাড়া কথাই বলে না। তাছাড়া দেখ না, হৈমদি নতুন শাড়ি পরে নগদ দু’শ টাকা নিয়ে ঘরে আসবে।

মাথার ভেতরটা যেন সামসুম করছে ফাঁকা, সৌঁ-সৌঁ করে বাতাস ছুটোছুটি করছে সেখানে।

বাসিনী বলে, তুমি ঘরে যাও চরণদা। রাতে যদি না ফেরে ও সকালেই ফিরবে। কিচ্ছু ভেব না, ঠিক ফিরে আসবে।

চরণ টলতে টলতে ফিরে এল। ফিরে দেখল, শশী বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়েছে। চরণ ডাকল, শশী শুবি আয়। ঘরে ঢুকে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। তারপর জুলজুল করে তাকিয়ে রইল শূন্যে। তাকিয়ে রইল অথচ কিছুই ও দেখছে না। হঠাৎ একবার চমকে উঠল, কার পায়ের শব্দ না!

লাফিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় চরণ, না, কেউ নেই। একটানা কেবল ঝিঝির ডাক ছাড়া কিছুই নেই। বেঞ্চের ওপর হাঁটু ভাঁজ করে মাথা মুড়ে বসল। বসেই রইল।

আর, কতক্ষণ পর, খেয়াল করতে পারে না চরণ, মল বাজিয়ে ঝুমঝুম করে কে যেন একটা ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কে? কে যাচ্ছে, কে যায়?

চরণ দেখল, সুন্দর গোলগাল নধরকান্তি একটি শিশু। দু হাতে বালা, মাথার চুল ঝুঁটি করে বাঁধা, পায়ে আঙুরদানার মতো মল। ঝুমঝুম করে হেঁটে যাচ্ছে।

কে, কে যাচ্ছে! চরণ লাফিয়ে বাচ্চাটাকে ধরবার জন্য ছুটল, আর তক্ষুনি ওর তন্দ্রা কেটে গেল।

তাকিয়ে বুঝল, মাঝরাত, হৈমন্তী তখনো ফেরেনি।

১৩৯৫ (১৯৮৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *