ফ্রেয়ার অস্বাভাবিক পরিণয়
বজ্রের দেবতা, এসিরদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে সাহসী আর যুদ্ধের ময়দানে সবচেয়ে অকুতোভয় যোদ্ধা থর তখনো ঘুম থেকে পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, আধো ঘুমের মধ্যেই সে অনুভব করল, কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। সে তার হাতুড়ির জন্য হাত বাড়াল, যেটাকে সে ঘুমের সময়ও হাতের কাছেই রাখে।
সে তার চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বিভ্রান্ত বোধ করল। সে তার হাত এদিক ওদিক করে তার হাতুড়ির আরামদায়ক ও পরিচিত হাতলটি ধরতে চাইল।
কিন্তু হাতুড়িটি কোথায়?
থর তার চোখ খুলল। সে উঠে বসল। দাঁড়াল। সে রুমের চতুর্দিকে হেঁটে বেড়াল।
হাতুড়িটা কোথাও নেই। সেটা গায়েব হয়ে গেছে।
থরের হাতুড়িকে বলা হতো মিওলনির। এটা তার জন্য বামন ব্রুক আর এইত্রি বানিয়েছিল। এটা ছিল দেবতাদের একটা মূল্যবান রত্ন। যদি থর এটা দিয়ে কোনো জিনিসকে আঘাত করত, সেটা ধ্বংস হয়ে যেত। যদি সে এটাকে কোনোকিছুর দিকে নিক্ষেপ করত, এটা কখনোই নিশানায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হতো না আর সর্বদা বাতাসের বুক চিরে আবার তার হাতে ফিরে আসত। সে তার হাতুড়িটি ছোট বানিয়ে পোশাকের পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে পারত, আবার সেটাকে অনেক বড়ও বানিয়ে ফেলতে পারত। এটা সব দিক দিয়েই ছিল একটা নিখুঁত হাতুড়ি, শুধু এটার হাতল একটু ছোট ছিল, ফলে থরকে সেটা এক হাতেই ব্যবহার করতে হতো।
পরের হাতুড়ি এসগার্ডের দেবতাদের সকল ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করত। তুষার দানব, ওগর, ট্রোল আর সব দৈত্য-দানো থরের হাতুড়িকে খুব ভয় পেত। থর তার হাতুড়িটি খুবই পছন্দ করত। আর হাতুড়িটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না।
কোনো গড়বড় হলেই থর দুটি কাজ করত। সে প্রথমেই নিজেকে জিজ্ঞেস করত, কাজটা লোকি করেছে কি না। থর কিছুক্ষণ ভাবল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, লোকির সাহস হবে হাতুড়ি চুরি করার। তখন সে দ্বিতীয় কাজটি করল, কোনো গোলমাল হলে যা সে সাধারণত করে থাকে, সে লোকির কাছে পরামর্শ করতে গেল।
লোকি খুব চালাক। সে তাকে উপদেশ দেবে, কী করতে হবে।
“কাউকে বলো না,” লোকিকে বলল থর, “দেবতাদের হাতুড়িটা চুরি হয়ে গেছে।”
“এটা মোটেই ভালো খবর নয়,” দুঃখিত মুখ করে লোকি বলল, “দেখি আমি হাতুড়িটা খুঁজে পাই কি না।”
লোকি সোজা ফ্রেয়ার মহলে গেল। ফ্রেয়া ছিল দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। তার সোনালি চুল তার কাঁধে এসে পড়েছিল আর সকালের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। ফ্রেয়ার দুইটা বেড়াল হলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারা রথকে টেনে নেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। তার গলায় ছিল চুলের মতোই উজ্জ্বল এক কণ্ঠহার, যেটা বামনরা ফ্রেয়ার জন্য বানিয়েছিল।
“তোমার পালকের আলখেল্লাটা আমাকে দাও”, বলল লোকি, “যেটা পরে তুমি উড়ে বেড়াতে পারো।”
“মোটেই না,” বলল ফ্রেয়া। “এই আলখেল্লা আমার সবচেয়ে দামি সম্পদ। এটা সোনার চেয়েও দামি। আমি চাই না তুমি এটা পরে ঘুরে বেড়াও আর কোনো অনর্থ ঘটাও।”
“থরের হাতুড়ি চুরি হয়ে গেছে”, বলল লোকি। “আমি সেটা খুঁজতে যাব।”
“আমি তোমাকে আমার আলখেল্লাটি দেব,” বলল ফ্রেয়া।
লোকি পালকের আলখেল্লাটি পরে নিল আর বাজপাখির রূপ ধরে আকাশে উড়ে গেল। সে উড়তে উড়তে এসগার্ডের বাইরে চলে গেল। সে দানবদের রাজ্যের অনেক ভিতরে ঢুকে গেল আর অস্বাভাবিক কোনোকিছু দেখা যায় কি না খোঁজ করল।
একসময় লোকি দেখল নিচে এক বিশাল গোরক্ষেত্র, আর সেখানে বিশাল আর কুৎসিত এক ওগর (এক ধরনের দানব) বসে বসে কুকুরের কলার বুনছে, এত বড় আর কুৎসিত ওগর লোকি কখনো দেখেনি
বাজপাখির রূপ ধরে থাকা লোকিকে ওগরটি যখন দেখল, সে তার দাঁত বের করে হাসল আর হাত নাড়ল।
এসিরদের কী খবর লোকি? এলফদের কোনো খবর আছে? তুমি কেন একা একা দানবদের রাজ্যে এসেছ?”
লোকি ওগরের কাছে নামল। “এসগার্ডে শুধু দুঃখের খবর, আর এলফদের রাজ্যে শুধু খারাপ খবর।”
“তাই?” বলে ওগর হাসতে থাকল, যেন সে এমন কিছু একটা করেছে যেটা নিয়ে সে অনেক খুশি। লোকি এই ধরনের হাসি চিনতে পারল। সেও অনেক সময় এমন হাসি দিয়ে থাকে।
“থরের হাতুড়ি হারিয়ে গেছে,” বলল লোকি। “তুমি এই সম্পর্কে কিছু জানো?”
ওগর তার বগল চুলকাল আর হাসল। “হয়তো জানি,” সে স্বীকার করল। তারপর সে বলল, “ফ্রেয়া কেমন আছে? লোকে যেমন বলে সে কি আসলেই ততটা সুন্দরী?”
“যদি তুমি জানতে চাও, তবে বলি, সে আসলেই অনেক সুন্দরী”।
“হ্যাঁ, আমি আসলেই জানতে চাই।”
দুজনেই তারপর চুপ করে থাকল। ওগরটি কুকুরের কলারটি একটা কলারের স্তূপে ফেলল আর আরেকটা কলার বানাতে শুরু করল।
“থরের হাতুড়ি আমার কাছে আছে,” ওগরটি লোকিকে বলল। “আমি সেটা মাটির অনেক গভীরে পুঁতে রেখেছি। এত গভীরে পুঁতে রেখেছি যে, কেউ সেটা খুঁজে পাবে না, এমনকি ওডিনও না। একমাত্র আমিই সেটা মাটির নিচ থেকে তুলে আনতে পারব। আমি যেটা চাই যদি সেটা যদি তুমি আমাকে এনে দিতে পার, আমি হাতুড়িটা থরকে ফেরত দেব।”
“আমি হাতুড়িটির জন্য মুক্তিপণ দিতে পারি,” বলল লোকি। “আমি তোমাকে স্বর্ণ আর মণিমুক্তা এনে দিতে পারি, অগণিত রত্ন এনে দিতে পারি…”
“আমি ধনরত্ন চাই না,” বলল ওগর। “আমি ফ্রেয়াকে বিয়ে করতে চাই। ফ্রেয়াকে আগামী আট দিনের মধ্যে এখানে নিয়ে এসো, আমি বিয়ের রাতে বিয়ের উপহার হিসেবে দেবতাদের থরের হাতুড়ি ফিরিয়ে দেব।”
“তুমি আসলে কে?” জানতে চাইল লোকি।
ওগরটি তার নোংরা দাঁত বের করে হাসল, “কেন, লাউফির পুত্র লোকি? আমি থাইরাম, ওগরদের রাজা।”
“আমার কোনো সন্দেহ নেই, আমরা একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করতে পারব, মহামান্য থাইরাম”, বলল লোকি। সে ফ্রেয়ার পালকের আলখেল্লাটা নিজের ওপর জড়িয়ে নিল, আর নিজের হাত দুইদিকে ছড়িয়ে আকাশে উড়ে গেল।
লোকি নিচে তাকিয়ে দেখল, সবকিছু অনেক ছোট দেখাচ্ছে। গাছপালা আর পাহাড়-পর্বত যেন বাচ্চাদের খেলার বস্তু, দেবতাদের সমস্যাও তার কাছে খুবই ক্ষুদ্র বিষয়ই মনে হলো।
দেবতাদের সভায় থর লোকির জন্য অপেক্ষা করছিল, এমনকি লোকি নিচে নামার আগেই থর তার বিশাল হাত দিয়ে তাকে ধরে ফেলল।
“লোকি, মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা জানো। আমি তোমার চেহারা দেখেই বুঝেছি। তুমি যা জানো এক্ষুনি বলো। আমি চাই তুমি তাড়াতাড়ি সবকিছু বলো, অন্য কোনো পরিকল্পনা করার আগেই।”
লোকি ছিল খুবই চালাক, অন্যরা নিশ্বাস ফেলতে যতটা সময় নেয়, লোকি সেই সময়ের মধ্যে নানা পরিকল্পনা ফেঁদে ফেলতে পারে। লোকি থরের রাগ আর সরলতা দেখে হাসল। “ওগলদের রাজা থাইরাম তোমার হাতুড়ি চুরি করেছে”, বলল সে। “আমি তাকে সেটা তোমাকে ফেরত দিতে রাজি করিয়েছি। কিন্তু বিনিময়ে সে একটা দাবি করেছে।”
“খুব ভালো,” বলল থর, “কী সেই দাবি?”
“ সে ফ্রেয়াকে বিয়ে করতে চায়।”
“ওহ-হো,” বলল থর। “ফ্রেয়া এটা মোটেই পছন্দ করবে না। তুমি তাকে খবরটা দাও, আমার হাতে হাতুড়ি থাকলে আমি যে কাউকে মানাতে পারি, কিন্তু সেটা যখন নেই, তুমিই ফ্রেয়াকে খবরটা দাও, তুমি তো যে কাউকে কথা দিয়েই বশ করতে পারো।”
তারা আবার দুজনে মিলে ফ্রেয়ার প্রাসাদে গেল।
এই নাও তোমার পালকের আলখেল্লা,” বলল লোকি।
ধন্যবাদ,” বলল ফ্রেয়া। “তুমি কি জানতে পেরেছ কে থরের হাতুড়ি চুরি করেছে?”
“থাইরাম, ওগরদের রাজা।”
“আমি তার সম্পর্কে শুনেছি। খুবই কুৎসিত দেখতে। হাতুড়ির বদলে সে কী চায়?”
তোমাকে,” বলল লোকি। “সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়।”
ফ্রেয়া মাথা ঝাঁকাল।’
ফ্রেয়া বিষয়টাতে রাজি হয়েছে মনে করে থর খুশি হয়ে উঠল।
“বিয়ের মুকুট পরে নাও, ফ্রেয়া, আর তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, বলল থর। “তুমি আর লোকি দানবদের রাজ্যে যাবে। থাইরাম মত পরিবর্তন করার আগেই আমরা তোমাকে তার সাথে বিয়ে দিতে চাই। আমি আমার হাতুড়ি ফেরত চাই।”
ফ্রেয়া কিছুই বলল না।
থর অনুভব করল, মাটি কাঁপছে, চারপাশের দেওয়ালও কাঁপছে। ফ্রেয়ার বিড়ালগুলো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ডেকে উঠল আর আর একটা পশমি সিন্দুকের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
ফ্রেয়া শক্ত করে হাতের মুষ্টি পাকাল। তার গলা থেকে কণ্ঠহারটি খুলে মাটিতে পড়ে গেল, সেদিকে তার কোনো খেয়ালই ছিল না। সে থর আর লোকির দিকে এমনভাবে তাকাল যেন তারা কীটের চেয়েও অধম।
থর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল যখন দেখল ফ্রেয়া আবার কথা বলতে শুরু করেছে।
“তোমরা আমাকে কী মনে করো, হ্যাঁ?” সে খুব শান্তভাবে জানতে চাইল। “আমি কি এতই বোকা? আমি কি এতই সস্তা? তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য আমি একটা ওগরকে বিয়ে করব? যদি তুমি ভেবে থাক আমি বিয়ের তাজ পরে সেজেগুজে দানবদের রাজ্যে গিয়ে একটা ওগরকে বিয়ে করব তবে… ফ্রেয়া চুপ করে গেল। দেওয়ালগুলো আবার কাঁপতে লাগল। থরের মনে হলো, ফ্রেয়ার প্রাসাদটি বুঝি এখুনি ভেঙে পড়বে।
“বেরিয়ে যাও,” বলল ফ্রেয়া। “আমাকে তোমরা কেমন মেয়ে মনে করো?
“কিন্তু আমার হাতুড়ি…”
“চুপ করো, থর,” বলল লোকি।
থর চুপ করে গেল। তারা ফ্রেয়ার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেল।
“ফ্রেয়া যখন রাগে, তাকে আরো সুন্দর দেখতে লাগে,” বলল থর। “বুঝতে পারছো কেন ওগর তাকে বিয়ে করতে চায়?”
“চুপ থাকো, থর,” আবার বলল লোকি।
দেবতারা মূল মহলে এক জরুরি সভায় মিলিত হলো। সকল দেবতা আর দেবীরা এলো, শুধুমাত্র ফ্রেয়া এলো না, সে তার প্রাসাদ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানাল।
সারা দিন ধরে তারা আলাপ-আলোচনা আর তর্ক-বিতর্ক করল। সবাই মিওলনির ফেরত চায়, এই বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু কীভাবে সেটা ফেরত আনা যাবে? সকল দেব-দেবীগণ তাদের অভিমত জানাল, আর লোকি সেগুলোর সবগুলোই একে একে বাতিল করে দিল Į
শেষে দেখা গেল, শুধু একজন তার পরামর্শ দেয়নি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হাইমডেল, যে নয় দুনিয়ার ওপর নজর রাখে। হাইমডেলের দৃষ্টির অগোচরে কিছুই ঘটে না, সে এমনকি সেসব ঘটনাও দেখে, যেটা এখনো ঘটেনি।
“তাহলে হাইমডেল,” জানতে চাইল লোকি। “তোমার কোনো পরামর্শ আছে?”
“আছে,” বলল হাইমডেল। “কিন্তু তোমাদের সেটা পছন্দ হবে না।”
থর টেবিলে মুষ্টি পাকিয়ে আঘাত করল।
“আমরা পছন্দ করব কি করব না, সেটা কোনো বিষয় নয়,” বলল সে, “আমরা দেবতা। দেবতাদের হাতুড়ি মিওলনির ফেরত আনার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যেটা আমরা করতে পারব না। তোমার পরামর্শ বলো। যদি সেটা ভালো পরামর্শ হয়, আমরা সেটা অবশ্যই পছন্দ করব।”
“তুমি সেটা পছন্দ করবে না,” বলল হাইমডেল।
“আমরা সেটা পছন্দ করব,” জোর দিয়ে বলল থর।
“ঠিক আছে,” বলল হাইমডেল। “আমার মনে হয় আমাদের থরকে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমরা তাকে গলায় কণ্ঠহার পরিয়ে, মাথায় বিয়ের মুকুট পরিয়ে দেব। তাকে এমন পোশাক পরাব যাতে তাকে নারীদের মতো দেখতে লাগে। আমরা তার মুখ ঘোমটা দিয়ে ঢেকে দেব। তাকে স্বর্ণালংকার পরিয়ে…”
“আমার এই আইডিয়া একদম পছন্দ হচ্ছে না” বলল থর। “একেবারেই না। আমার বিষয়টা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। আমি কখনো কনের পোশাক পরতে পারব না। আমাদের কারোরই এই পরামর্শ পছন্দ হচ্ছে না, তাই না? খুবই জঘন্য পরামর্শ। আমার মুখে দাড়ি আছে, আমি আমার দাড়ি কাটতে পারব না।”
“চুপ করো, থর,” বলল লাউফির পুত্র লোকি। “এটা চমৎকার পরামর্শ। যদি তুমি চাও দানবরা এসগার্ড আক্রমণ না করুক, তুমি কনের পোশাক পরবে, আর ঘোমটা দিয়ে তোমার মুখ ঢেকে রাখবে, তাতে তোমার দাড়ি দেখা যাবে না।”
সর্বদ্রষ্টা একচক্ষু দেবতা ওডিন বলল, “এটা আসলেই চমৎকার একটা পরামর্শ। খুব ভালো, হাইমডেল। আমরা হাতুড়িটা ফেরত চাই, আর এটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা সেটা ফেরত আনার। দেবীরা, থরকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করো।”
দেবীরা থরকে পরানোর জন্য বিয়ের পোশাক নিয়ে এলো। ফ্রিগা আর ফুলা, সিফ, ইডুল আর অন্য দেবীরা, এমনকি ফ্রেয়ার সত্মা স্কেডিও থরকে সাজাতে এগিয়ে এলো। তারা তাকে উত্তম পোশাকে সজ্জিত করল, একজন দেবী তার বিয়েতে যেমন পোশাক পরে, ঠিক তেমনি। ফ্রিগা ফ্রেয়ার কাছে গেল আর তার কণ্ঠহারটি নিয়ে ফিরে এলো আর সেটা থরের গলায় পরিয়ে দিল।
থরের স্ত্রী সিফ, তার চাবির গোছা থরের আঁচলে বেঁধে দিল।
ইডুন তার সকল স্বর্ণালংকার এনে থরকে পরাল, সেগুলো চাঁদের আলোয় চমকাতে লাগল। ইডুন একশটি স্বর্ণের আর রুপার রিং এনে থরের আঙুলে পরিয়ে দিল।
তারা তার মুখ ঘোমটায় এমনভাবে ঢেকে দিল যাতে শুধু তার চোখ দুটো দেখা যায়। বিয়ের দেবী ভার থরের মাথায় একটি রাজকীয় মুকুট পরিয়ে দিল, একটা বিয়ের মুকুট, বড় আর সুন্দর।
“চোখগুলো নিয়ে আমি অস্বস্তিতে আছি,” বলল ভার। “এগুলোকে মোটেই নারীদের মতো লাগছে না।”
“আমি সেটা চাইও না,” বিড়বিড় করল থর।
ভার থরের দিকে তাকাল। “যদি আমি মাথার মুকুটটা একটু নামিয়ে দেই, চোখগুলো ঢেকে যাবে, কিন্তু সে তখনো সব দেখতে পাবে।”
“যতটা সম্ভব করো,” বলল লোকি।
সে থরের দিকে ফিরল, “আমি দাসীর বেশ ধরব আর তোমাকে দানবদের রাজ্যে নিয়ে যাব।” লোকি তার আকার পরিবর্তন করে ফেলল। এখন তাকে দেখতে একজন সুন্দরী দাসীর মতো লাগছিল।
“আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?” জানতে চাইল লোকি।
থর তার ঘোমটার ভিতর থেকে বিড়বিড় করে কী যেন বলল, যদিও কেউ কিছু শুনতে পায়নি, সে নিশ্চয়ই ভালো কিছু বলেছিল।
লোকি আর থর থরের রথে চেপে বসল। যে দুটো ছাগল থরের রথকে টেনে নিয়ে যায়, সারলার আর গ্রাইন্ডার, রথ টেনে আকাশপথে রওনা হয়ে গেল। তাদের যাত্রাপথে পাহাড় বিদীর্ণ হয়ে যেতে লাগল আর নিচের ভূমিকে আগুন গ্রাস করল।
“আমার মনে কেমন যেন কু ডাকছে,” বলল থর।
“তুমি কোনো কথা বলবে না,” দাসীরূপী লোকি বলল। “কথা যা বলার আমি বলব। মনে থাকবে? তুমি যদি ভুলেও একটা শব্দ উচ্চারণ করো, সব ভজঘট হয়ে যাবে।”
থর রাগে গজগজ করল।
তারা থাইরামের আঙিনায় নামল। সেখানে কিছু বিশালাকৃতির বলদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একেকটা আকারে একটা ঘরের চেয়েও বড়। তাদের শিং এর মাথা সোনায় মোড়ানো ছিল আর চতুর্দিক তাদের গোবরের গন্ধে ভারী হয়ে ছিল। বিশাল মহলের ভিতর থেকে উচ্চস্বরে চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছিল।
“সরে যাও, বোকার দল। টেবিলের ওপর খড় বিছাও। কী করছো এসব তোমরা? ফ্রেয়া আসছে আজ, জগতের সবচেয়ে সুন্দরী, জর্ডের কন্যা ফ্রেয়া আমাদের ঘরে আসছে। সে এগুলো দেখে মোটেই খুশি হবে না।”
আঙিনায় অতিথিদের জন্য নতুন খড়ের গালিচা বিছানো ছিল। রথ থেকে নামার পর ফ্রেয়াবেশী থর আর দাসীরূপী লোকি তাদের স্কার্ট একটু তুলে খড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল, যাতে তাদের পোশাকে গোবর না লেগে যায়।
এক বিশালাকৃতির নারী দরজায় তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল। সে নিজেকে থাইরামের বোন বলে পরিচয় দিল আর নিচু হয়ে লোকির গাল টিপে দিল, সে তার ধারালো নখ দিয়ে থরকে খোঁচা দিয়ে বলল, “এই তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী? আমার কাছে তো তেমন মনে হচ্ছে না। আর যখন সে স্কার্ট তুলে আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল, তার পায়ের গোছা গাছের গুঁড়ির মতো মোটা।”
“আলো আঁধারির কারণে এমনটা মনে হয়েছে। সে সত্যিই দেবদেবীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী,” বলল দাসীরূপী লোকি সাবলীলভাবে।
“তার ঘোমটা যখন খোলা হবে, তুমি তার রূপে বিমুগ্ধ হয়ে যাবে। এখন বলো, বর কোথায়? বিয়ের ভোজের কী আয়োজন? কনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, আমি তাকে কোনোমতে চুপ করিয়ে রেখেছি।”
বিয়ের ভোজসভার বিশাল কক্ষে যখন তারা প্রবেশ করছিল, সূর্য অস্ত যাচ্ছিল।
“তারা যদি আমাকে থাইরামের সাথে বসতে বলে?” ফিসফিস করে থর লোকিকে বলল।
“তোমাকে তার পাশেই বসতে হবে। কনে বরের পাশেই বসে, এটাই নিয়ম।
“কিন্তু সে আমাকে ধরতে চাইতে পারে।”
“আমি তোমাদের দুজনের মাঝখানে বসব, আমি তাকে বলব, এটাই আমাদের রীতি।”
থাইরাম টেবিলের মাথায় বসল, লোকি তার পাশে বসল, তারপর থর বসল।
থাইরাম হাতে তালি দিল আর বিরাট আকারের পরিবেশনকারীরা খাবার নিয়ে প্রবেশ করল। তারা পাঁচটা আগুনে ঝলসানো আস্ত বলদ নিয়ে এলো, উপস্থিত সব দানবদের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। তারা নিয়ে এলো বিশটি বিশাল ঝলসানো স্যামন মাছ, একেকটা প্রায় একটা দশ বছরের ছেলের চেয়েও বড়। তারপর এলো কয়েক ডজন ট্রেভর্তি পেস্ট্রি আর ডেজার্ট, যা বিশেষত নারীদের জন্য।
এরপর নিয়ে আসা হলো পাঁচটি বিশাল ব্যারেলভর্তি মদিরা, যেগুলো বহন করতে বিশাল দানবদেরও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল।
“এই ভোজ সুন্দরী দেবী ফ্রেয়ার উদ্দেশ্যে নিবেদিত,” বলল থাইরাম।
সে হয়তো আরো কিছু বলত, কিন্তু ফ্রেয়াবেশী থর ইতোমধ্যে খেতে আর পান করতে শুরু করেছে। কনে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, এই মুহূর্তে আর কিছু বলা খারাপ দেখায়, তাই থাইরাম চুপ করে গেল।
এক ট্রে পেস্ট্রি নারী অতিথিদের জন্য থর আর লোকির সামনে রাখা ছিল। লোকি সাবধানে সেখান থেকে সবচেয়ে ছোট দেখে একটা পেস্ট্রি তুলে নিল। থর সাবধানে বাকি পেস্ট্রিগুলো ঘোমটার ভিতর নিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই সাবাড় করে দিল। অন্যান্য নারীরা, যারা পেস্ট্রিগুলোর দিকে ক্ষুধার্তভাবে তাকিয়ে ছিল, তার সুন্দরী ফ্রেয়ার আচরণে খুবই অসন্তুষ্ট হলো।
কিন্তু সুন্দরী ফ্রেয়া তো এখনো খাওয়া শুরুই করেনি!
থর একাই পুরো একটা বলদ খেয়ে ফেলল। সে পুরো সাতটা স্যামন মাছ খেয়ে ফেলল, শুধু কাঁটাটা পড়ে থাকল। যখনই একটা পেস্ট্রির ট্রে তার সামনে রাখা হচ্ছিল, বাকি সব নারীদের জন্য কিছুই না রেখে সে একাই সব সাবাড় করে দিচ্ছিল।
লোকি বারবার টেবিলের নিচে থরের পায়ে লাথি মেরে তাকে থামাতে চাইল, কিন্তু থর তাকে পাত্তাই দিল না, সে তার মতো খেয়ে যেতে লাগল।
থাইরাম লোকির কাঁধে টোকা দিল। “সুন্দরী ফ্রেয়া তিন ব্যারেল মদিরা খেয়ে ফেলেছে।”
“ঠিকই বলেছ,” বলল দাসীরূপী লোকি।
“চমৎকার। আমি কোনো নারীকে এত গোগ্রাসে কখনো খেতে দেখিনি। কখনো কোনো নারীকে এত খেতে আর পান করতে দেখিনি।”
“ঠিকই বলেছ,” বলল লোকি। “এর উপযুক্ত ব্যাখ্যাও আছে।”
সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল আর দেখল থর একটা গোটা স্যামন মাছ তার ঘোমটার মধ্যে ঢুকিয়ে নিল আর এক মুহূর্ত পরে কাঁটাটা বের করে দিল। যেন একটা ম্যাজিক। উপযুক্ত ব্যাখ্যাটা কী দেওয়া যায়, সে সেটাই ভাবল।
“এই নিয়ে তার আটটা স্যামন মাছ খাওয়া হয়ে গেল,” বলল খাইরাম।
“আট দিন আর আট রাত!” বলে উঠল লোকি হঠাৎ, “সে আট রাত আর আট দিন ধরে কিছুই খায়নি, সে দানবদের রাজ্যে আসতে আর তোমার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে খুবই উদ্গ্রীব ছিল। এখন যখন সে তোমার কাছে পৌঁছেছে, সে অবশেষে আবার খাবার খাওয়া শুরু করেছে।”
দাসী থরের দিকে ফিরল। “তোমাকে আবার খেতে দেখে খুব ভালো লাগছে, প্রিয়,” বলল সে।
থর ঘোমটার ভিতর থেকে লোকির দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাল।
“আমি এখন কনেকে চুম্বন করতে চাই,” বলল খাইরাম।
“এখনই না,” বলল লোকি, কিন্তু থাইরাম ইতোমধ্যে নিচু হয়ে থরের ঘোমটা খুলতে শুরু করেছে। দাসীরূপী লোকি তাকে বাধা দেওয়ার জন্য হাত তুলল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
থাইরাম বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতো চমকে আর কেঁপে উঠে পিছনে সরে গেল।
থাইরাম দাসীরূপী লোকির কাঁধে টোকা দিল। “আমি কি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?”
“অবশ্যই”
তারা ভোজসভার খাবারের টেবিল থেকে উঠে এক কোনায় গেল।
ফ্রেয়ার চোখ এত ভয়ংকর দেখাচ্ছে কেন?” জানতে চাইল থাইরাম। “মনে হচ্ছে তার চোখে আগুন জ্বলছে। সেগুলো কোনো সুন্দরী নারীর চোখ বলে মনে হচ্ছে না।”
“অবশ্যই না,” বলল দাসী সাবলীলভাবে। “তুমি এমনটা অবশ্যই আশা করনি। কিন্তু সে আট দিন আর আট রাত ধরে ঘুমায়নি, মহামান্য থাইরাম। সে তোমার প্রেমে এতটাই পাগল হয়ে গেছে, সে একবিন্দুও ঘুমায়নি। এই কারণে তার চোখগুলো এমন দেখাচ্ছে। তার চোখে ভালোবাসার আগুন তুমি দেখেছ।”
তাই?” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল থাইরাম। সে তার জিহ্বা বের করে ঠোঁট ভেজাল, যেটা একটা বালিশের চেয়েও বড় ছিল। “তাহলে ঠিক আছে।”
তারা টেবিলে ফিরে এলো। থাইরামের বোন থরের পাশে লোকির আসনে এসে বসেছে, সে তার ধারালো নখ দিয়ে থরের হাতে খোঁচা দিল।
“তুমি যদি নিজের ভালো চাও, তোমার আংটিগুলো আমাকে দাও,” বলল সে, তোমার সবগুলো আংটি আমাকে দিয়ে দাও। এই প্রাসাদে তুমি একেবারেই নতুন। যদি কেউ একজন তোমাকে দেখেশুনে না রাখে, তাহলে তুমি বিপদে পড়বে। তোমার অনেকগুলো আংটি আছে, কয়েকটা আমাকে বিয়ের উপহার হিসেবে দাও না। এগুলো খুবই সুন্দর, স্বর্ণ আর পাথরের তৈরি।”
“এখনো কি বিয়ের সময় হয়নি?” জিজ্ঞেস করল লোকি।
“হয়েছে,” বলল থাইরাম, সে উচ্চস্বরে বলল, “হাতুড়িটি নিয়ে আসো। আমি ফ্রেয়াকে বিয়ের উপহার হিসেবে সেটি দিতে চাই। বিয়ের দেবী ভার আমাদের বিয়েতে আশীর্বাদ করুক।”
থরের হাতুড়িটি আনতে চারজন দানব প্রয়োজন হলো। তারা প্রাসাদের অভ্যন্তর থেকে হাতুড়িটি বয়ে নিয়ে এলো। এটা আগুনের আলোয় হালকা চমকাতে থাকল। তারা হাতুড়িটি থরের কোলে রাখল।
“এখন,” বলল থাইরাম, “আমাকে তোমার কমনীয় কণ্ঠস্বর শুনতে দাও, প্রিয় ফ্রেয়া, আমার ভালোবাসা। বলো তুমি আমাকে ভালোবাস। বলো তুমি আমাকে বিয়ে করত চাও, আমার স্ত্রী হতে চাও। সবাইকে বলো, তুমি আমার জন্মজন্মান্তরের সাথি হবে।”
থর তার আংটি পরানো হাত দিয়ে হাতুড়িটির হাতল ধরল। সে হাতলটি শক্ত করে চেপে ধরল আর তার পরিচিত আর আরামদায়ক অনুভূতি পেল। তার মুখ থেকে অট্টহাসি বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
“আমি বলি কী,” বজ্রকণ্ঠে বলল থর, “আমার হাতুড়ি চুরি করা তোমার একেবারেই উচিত হয়নি।”
সে থাইরামকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল, একবারই, এক আঘাতেই থাইরাম ধরাশায়ী হলো। ওগরদের রাজা খড় বিছানো মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে থাকল, আর উঠল না।
সব দানব আর ওগর থরের হাতুড়িতে ঘায়েল হলো, যারা বিয়ের অতিথি ছিল, যে বিয়েটা আর কখনো হবে না। এমনকি থাইরামের বোন, যে একটা বিয়ের উপহার চেয়েছিল, এমন একটা উপহার পেল, যেটা সে আশা করেনি
যখন বিয়ের মহল একেবারে নীরব হয়ে গেল, থর ডাকল, “লোকি!”
লোকি একটা টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো স্বরূপে। সে চতুর্দিকে তাকিয়ে হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখল। “দেখা যাচ্ছে,” বলল সে, “তুমি সমস্যাটার সমাধান করে ফেলেছ।”
“যেমন ভয় পেয়েছিলাম, তেমন কিছুই ঘটেনি,” বলল থর আনন্দের সাথে। “আমি আমার হাতুড়ি ফেরত পেয়েছি। সাথে একটা ভালো ভোজও খাওয়া হলো। চলো, এবার বাড়ি যাই।”
‘ফ্রেয়ার অস্বাভাবিক পরিণয়’ গল্পের এখানেই সমাপ্তি।