ফ্রান্সিস ইয়েটস ব্রাউন : যিনি তার জীবনে অনেকগুলো জীবনযাপন করেছেন
বিশ বছর আগে এক সোনালি বিকেলে ফ্রান্সিস ইয়েটস ব্রাউন নামক এক পাতলা গড়নের যুবক ফরেস্ট হিলসে আমার মুখোমুখি বসেছিলেন এবং প্রাচ্যের রহস্যময় কিংবদন্তির দেশগুলোতে তার দুঃসাহসিক ভ্রমণের কাহিনী শুনিয়ে আমাকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। উনিশ বছর বয়স থেকে তিনি অনেক মৃত্যু দেখেছিলেন। তিনি মেসোপটেমিয়ার উত্তপ্ত মরুভূমিতে তুর্কিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং ফেডার্সের জলাভূমিতে জার্মানদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। বাগদাদ ও কনস্টান্টিনোপলে তিনি যুদ্ধবন্দি ছিলেন। ‘দ্য ব্লাডি ইয়ারস’ নামে তার রচিত এক গ্রন্থের মাধ্যমে তার যুদ্ধের চেয়ে কবিতা ও দর্শনপ্রিয়তা প্রকাশ পেয়েছিল।
বিশ বছরের সৈনিক জীবনে ফ্রান্সিস ব্রাউন সামান্যই সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের কাছে লেখাপড়া করেছেন এবং অতিন্দ্রিয়বাদের শিষ্য হয়েছেন।
আমাদের সবার মতো তিনি একটা জীবনযাপন করেন নি। তার ঊনচল্লিশ বছরের জীবনে তিনি অনেকগুলো জীবনযাপন করেছেন। শেষপর্যায়ে তিনি যখন তার কর্মচাঞ্চল্যময় জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন তাতে তিনি আমার কাছে বলা অনেক ঘটনা সন্নিবেশিত করেছেন। বইটার নাম দিয়েছেন তিনি ‘দ্য লাইভস্ অব বেঙ্গল ল্যান্সার।’ ১৯৩০-এর সময়ে বইটা এক যুগান্তকার আলোড়ন সৃষ্টি করে তার সাফল্য এনে দিয়েছিল। এ বই অবলম্বনে হলিউডে চিত্তাকর্ষক ছবি তৈরি হয়েছিল পরবর্তীকালে। ব্রাইন মাত্র ঊনিশ বছ বয়সে রয়্যাল বেঙ্গল ল্যান্সার বাহিনীর পোশাক পরেন। ব্রিটিশবাহিনীর এটাই ছিল সর্বাপেক্ষা অভিজাত ও গর্বিত অশ্বারোহী বাহিনী। এ বাহিনীতে যোগদান করে ব্রাউন ভারত উপমহাদেশসহ প্রাচ্যের অনেক ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের সুযোগ লাভ করছেন।
প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় তিনি শয্যা ত্যাগ করতেন এবং সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত ড্রিল করতেন। তিনি বলেছেন, ভারতবর্ষের সবচেয়ে দুঃসাহসিক ও উত্তেজনাপূর্ণ অভিযানে শূকর শিকারে অংশগ্রহণ করতেন। পৃথিবীর কোনো প্রাণীই আহত বুনো শুকরের মতো বদমেজাজি নয়। কেশয়ালের মতো চাতুর্য, সিংহের মতো সাহস, বাঘের হিংস্রতা এবং অশ্বের ক্ষিপ্রতা এসবের সমন্বয় হল একটি আহত বুনো শূকর। ব্রাউন একটা শূকর শিকারের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন-একদিন শিকারের সময় কাঁটাময় ঝোঁপঝাড় মাড়িয়ে একটা প্রকাণ্ড শূকর বের করলেন। বর্বর শূকরটা মাঠের মাঝখান দিয়ে ছুটতে শুরু করল। তার বড় বড় দাঁতগুলো সূর্যকিরণে ঝকমক করছিল, ব্রাউন ঘোড়া নিয়ে তার পেছনে ছুটতে লাগলেন। তার বর্শা শূকরটাকে বিদ্ধ করার সাথে সাথেই ঘোড়াটা হোঁচট খেয়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাকে নিয়ে। তিনি ঘোড়ার নিচে আটকা পড়লেন। বর্শাবিদ্ধ শূকরটা উঠে দাঁড়াবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। শুকরটা উঠে দাঁড়িয়েই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সরাসরি ব্রাউনকে আক্রমণ করল। তিনি বুঝতে পারলেন নিজের করুণ পরিণতি। অনেক কষ্টে ঘোড়ার নিচ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এক গাছে উঠে পড়লেন। শূকরটা নিরুপায় হয়ে কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ল।
ফ্রান্সিস ব্রাউন অদ্ভুতভবে স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারতেন। তুর্কিদের বন্দিখানা থেকে তিনি যখন পালালেন, তুর্কিবাহিনী তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজল, এমনকি তার মাথার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করল। তুর্কিরা তাকে যখন খুঁজছিল তখন ব্রাউন এক জার্মান গভর্নেসের ছদ্মবেশ ধারণ করে বিচিত্র পোশাক পরিধান করে এক রাশান প্রিন্সের সাথে এক ক্যাফেতে প্রেমাভিনয়ে রত। এতে তুর্কি গোয়েন্দাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হল না বরং তারা হ্যাট খুলে মাথা নুইয়ে সুন্দরী গভর্নেসটিকে অভিবাদন জানাল। এই ছদ্মবেশে তুর্কিবাহিনীর চোখ এড়িয়ে তিনি তুরস্ক থেকে পালাতে ব্যর্থ হয়ে রাতারাতি লিঙ্গ ও জাতীয়তা পরিবর্তন করে গোলাবারুদের কারখানার কারিগরের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন, শেষপর্যন্ত ধারণ করলেন এক কৌতুকাভিনেতার, তাতেও শেষরক্ষা হল না। আবার তিনি গ্রেফতার হলেন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেখানে কারাগারের বাগানে যে সব গ্রিকরা নৈশভোজ করত, তাদের ছদ্মবেশে আবার সুচতুরভাবে দক্ষ অভিনেতার মতো কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হলেন। ফ্রান্সিক ইয়েটস ব্রাউনকে তার যোদ্ধা জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের বর্ণনা করতে বলায় তিনি জানান, যুদ্ধবন্দি অবস্থায় তুর্কিরা তাদের দু’শ মাইল দূরে এক ক্যাম্পে মার্চ করে যেতে বাধ্য করে। পথে তিনি এমন একটা শহরের মাঝখান দিয়ে গেলেন যেখানে এক জন লোকও জীবিত ছিল না। তুর্কিবাহিনী একটা মার্কিন পল্লীর সবাইকে হত্যা করেছিল। সেখানে সর্বত্র মৃত্যুর হিমশীতল নীরবতা বিরাজমান। শুধু জীবিত ছিল কয়েকটা কুকুর ও বাজপাখি। কুকুরগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর বাজপাখিগুলো শহরটির উপরে আকাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল।