ফ্যাসিনেটিং
১
চতুর্দিকে এক অদ্ভুত মৃত্যুর মিছিল! যেন মরণ তার দীঘল ডানায় ভর করে চক্কর কাটছে অবিরত। ক্রমাগতই তার ঈগলের মতো শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে মেপে নিচ্ছে প্রায় কঙ্কাল হয়ে আসা মানুষগুলোকে। আর ভাবছে, আজ ওদের মধ্যে কার প্রাণ ছোঁ মেরে তুলে নেবে নিজের হিংস্র নখরে! ক্ষুধার্ত-দুর্ভিক্ষপীড়িত দেহগুলোতে এমনিতেই জীবন বিশেষ অবশিষ্ট নেই। ওদের চোখের চাউনি মৃত মানুষের মতোই ঘোলাটে, নিষ্প্রভ। দেখলে মানুষ বলেও মনে হয় না! ক্ষুধায় অবশ হয়ে আসা সার সার হাড় আর চামড়ার খোলস মাত্র। শুধু যখন শ’য়ে শ’য়ে হাড়-শিরা বের করা হাত বুভুক্ষুর মতো একটু খাবারের আশায় এগিয়ে আসে, তখনই বোঝা যায় যে ওরা জীবিত! নয়তো জীবন্ত লাশ ছাড়া ওরা আর কিছুই নয়। হৃৎপিণ্ড যেটুকু প্রাণের স্পন্দন এখনও টিকিয়ে রেখেছে, যে কোনও মুহূর্তে তা থেমে যেতে পারে। সেটা শকুনের পালও খুব ভালোভাবেই জানে। তাই পরমোল্লাসে আকাশে নিয়ম করে টহল দিচ্ছে।
ওরা কারা তা নিয়ে আদৌ মাথাব্যথা নেই খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী অরিত্র সান্যালের। ওরা তাঁর কাছে কোনও অস্তিত্ব নয়। স্রেফ সাবজেক্ট! তাঁর ছবির এগজিবিশনের নতুন থিম! এবারের থিম ক্ষুধা, তথা ‘হাঙ্গার’। বেশ কয়েকবছর ধরে এই প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে শুধু এই ছবিগুলো আঁকার জন্যই অনেকদিন যাবত সোমালিয়া ও সাউথ সুদান চষে বেরিয়েছেন! চোখের সামনে দেখেছেন সোমালিয়ার প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষ! সাউথ সুদানের ক্ষুধার হাহাকার তাঁর তুলিতে জীবন্ত রূপ পেয়েছে। এই মারাত্মক ক্ষুধার বিকৃত রূপ তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে বীভৎসভাবে প্রকট! যে কোনও মানুষ সেসব ছবি দেখলে আঁতকে উঠবে! দর্শকের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য একদম পারফেক্ট প্রোডাক্ট!
অরিত্র মনে মনেই হাসলেন। এখনও যে কোনও শিল্পের ক্ষেত্রে চরমতম আবেদনময় বিষয় হল ক্ষুধা! মানুষের ক্ষুধাকে বিক্রি করেই মানুষ কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে! আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই সম্ভবত তাঁর জীবনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রপ্রদর্শনীটি শুরু হবে। দিল্লীর সবচেয়ে বড় আর্ট গ্যালারিতে প্রায় মাসাধিক কাল জুড়ে সাজানো থাকবে অরিত্রর ছবির সম্ভার। লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে এক একটা অতুলনীয় ছবি। এমনিতেই অরিত্রর ছবি বাজারে পড়তে পায় না! এবার তো আরও বেশি লাভ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কারণ এই বিরাট এগজিবিশনে প্রচুর বিদেশি মানুষ আসবেন। তা-ই এবার লাখে নয়, সম্ভবত কোটিতে বিক্রি হবে তাঁর ছবিগুলো। কড়কড়ে ডলারে বিকিয়ে যাবে শিল্প। বিকিয়ে যাবে ক্ষুধা! কারণ সাহেব-মেম সমঝদারেরা আর কিছু না বুঝুক, ক্ষুধার ভাষা খুব ভালোই বোঝে! হাড় জিরজিরে মৃতপ্রায় শিশু, দুর্ভিক্ষপীড়িত ভুখা মানুষের হাহাকার, কান্না ইত্যাদি দেখলেই তাদের চোখ দিয়ে গঙ্গা, ভলগা, টেমস, মিসিসিপি এবং নাইলের মিলিত জলপ্রবাহ দরদরিয়ে পড়তে থাকে! টিস্যু পেপারে নাক-চোখ বারবার মুছতে মুছতে হীরে, প্ল্যাটিনামের দরে ছবি কিনে নিয়ে যায় তারা! তবে এবার অবশ্য ব্যাপারটা টাকার থেকেও আরও কিছুটা বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। রয়েছে এক অভাবনীয় সুযোগের সম্ভাবনাও। দিল্লীর সেই বিশেষ আর্ট গ্যালারিতে আসবেন এই শতাব্দীর সেরা আর্টিস্ট ড্যানিয়েল গ্রে! ড্যানিয়েলের যদি তাঁর কাজ পছন্দ হয়ে যায়, তবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অরিত্রর সঙ্গে স্বয়ং এই পৃথিবীখ্যাত চিত্রশিল্পীর যুগ্ম চিত্রপ্রদর্শনী হবে! ভাবতেই তাঁর গায়ে কাঁটা দেয়। ড্যানিয়েল গ্রে’র সঙ্গে এগজিবিশনে ছবি দেওয়ার সৌভাগ্য খুব কম শিল্পীরই বরাতে জুটেছে। অনেক প্রখ্যাত আর্টিস্টের কাছে এই সুযোগ অদ্ভুত এক অধরা স্বপ্নের মতো। অথচ সেই সুযোগ অরিত্র সান্যালের সামনে দরজা খুলে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
—“আপনার কফি স্যার,”
অরিত্রর তিনতলা বাড়ির গোটা একতলাটাই ব্যক্তিগত স্টুডিও। স্টুডিওর একনিষ্ঠ কর্মী শ্রুতি হাতে কফি আর স্ন্যাকসের ট্রে নিয়ে এসে ঢুকল তাঁর ঘরে। মেয়েটার আঁকার হাত মন্দ নয়। ভাবনা চিন্তায় সামান্য ঘাটতি রয়েছে ঠিকই, তবে সেটুকু অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হয়ে যাবে। অরিত্র ওর ওপর খুব ভরসা করেন। শিল্পী হিসাবে না হোক, চিত্রসমালোচক হিসাবে শ্রুতি অত্যন্ত তুখোড়। ওর মতামত তাঁর কাছে মূল্যবান!
—“থ্যাঙ্কস ডিয়ার,” অরিত্র সদ্যসমাপ্ত ছবিটি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে শ্রুতির দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে একটু অন্যমনস্কতা। অসন্তুষ্টভঙ্গীতে বললেন, “ছবিটা বেশ কিছুক্ষণ হল কমপ্লিট হয়েছে। কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে! সেটা যে কী, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। একবার দেখবে?”
শ্রুতি কফির কাপ, চিজ বিস্কুট আর স্যান্ডউইচের প্লেট অরিত্রর সামনের টেবিলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “আমি কি বুঝতে পারব স্যার? বিশেষ করে এবারে আপনার ছবিগুলো বড় বেশি ডিভাস্টেটিং! দেখলেই ভয় করে। রাতে ঘুম হয় না। এত ভয়ংকর থিম রাখা কি খুব দরকার ছিল?”
—“হাঙ্গার মাই ডিয়ার! ক্ষুধা!” স্যান্ডউইচে একটা বড়োসড়ো কামড় বসিয়ে বললেন তিনি, “এর থেকে মারাত্মক সাবজেক্ট আর দুনিয়ায় নেই। ভেরি ফ্যাসিনেটিং!”
হাঙ্গারের মধ্যে ফ্যাসিনেশন! শ্রুতি কয়েকমুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে যায়। ক্ষুধার মধ্যে কী সৌন্দর্য আছে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে চতুর্দিকে সাজানো ছবিগুলোর দিকে তাকায়। এগুলো আপাতত প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করছে। ক্যানভাসে উলঙ্গ, ক্ষুধার্ত ও মৃত মানুষের মিছিল! মরণাপন্ন মানুষের ক্রন্দনবিকৃত হাঁ করা মুখের মধ্যে কোন্ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তা আজও সে বোঝেনি! বোঝেনি বলেই হয়তো পরিপূর্ণ শিল্পী হয়ে উঠতে পারেনি। এই ছবিগুলো দেখলেই তার বুকের মধ্যে এক অব্যক্ত কষ্ট আঁচড় কাটে। অসম্ভব নির্মম মনে হয়। অথচ স্যার বলছেন, “ফ্যাসিনেটিং!”
অরিত্র তখনও ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন সদ্যসমাপ্ত ছবিটির দিকে। হ্যাঁ, ছবির মতো ছবি হয়েছে বটে! এই ছবিটার জন্যই চিত্রশিল্পী অরিত্র সান্যাল অমর হয়ে যেতে পারেন! এটাই হয়ে উঠতে পারে তাঁর মাস্টারস্ট্রোক। সব ঠিক আছে, অথচ মনে হচ্ছে, কী যেন নেই! মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়েছে! ছবিটা ফুঁসে উঠতে গিয়েও যেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে! এমন তো হওয়ার কথা নয়!
তিনি অতৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, “প্লিজ শ্রুতি, টেক আ লুক। কিছু একটা ত্রুটি রয়েছে যা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
—“শিওর।”
মুখে ‘শিওর’ বললেও শ্রুতি একটু ভয়ে ভয়েই ক্যানভাসের দিকে তাকায়। স্যার এবার যেসব ছবি এঁকেছেন, সেগুলো দেখার অভিজ্ঞতা তার কাছে বিশেষ সুখকর নয়। তবু এতবড় শিল্পী যখন অনুরোধ করেছেন, তখন একবার দেখতেই হয়। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছবিটার দিকে তাকাল সে।
ক্যানভাসে তখন নিষ্প্রভ রঙে ফুটে উঠেছে এক মর্মান্তিক ছবি! চতুর্দিকে মৃত গরুর গলিত, খাওয়া-আধখাওয়া কঙ্কাল! তার কেন্দ্রে এক মৃত কঙ্কালসার শিশুকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে একপাল শকুন। আর শিশুটির হাড় জিরজিরে ক্ষুধার্ত মা আপ্রাণ বাধা দিচ্ছে তাদের! কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না কোলের সন্তানকে! দু’হাত দিয়ে ধরে রেখেছে ছোট্ট শিশুটির মরদেহ। সেই নারী প্রায় নগ্ন! সত্যি কথা বলতে কী তাকে নারী বলে চেনাই দায়! দেহ নগ্ন হলেও কোনওরকম পেলবতা, উত্থান-পতন নেই। শুধু যেন একরাশ হাড়ের একটি কাঠামো! গৃধ্রদলের সঙ্গে অসমযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত! কান্নাবিকৃত মুখ, দু’চোখে আতঙ্ক! কী ভয়ংকর!
মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে ফেলল শ্রুতি। নাঃ, আঁকার দিক দিয়ে কোনওরকম ত্রুটি নেই। প্রতিটি রেখা যেন অগ্নিশিখার মতো লেলিহান ভঙ্গিমায় নেচে নেচে উঠছে। সাবলীল স্ট্রোক! শকুনদের হিংস্রতা ও এক মরণাপন্ন মায়ের অন্তিম লড়াই এত বেশি জীবন্ত যে ভয় করে! এই ছবি দেখতে ইচ্ছে করে না তার। বড্ড হিংস্র…বড় বেশি নিষ্ঠুর…
—“দেখলে? কেমন লাগল?”
অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে জানতে চান অরিত্র। শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “অসাধারণ! কিন্তু আকাশটা স্যার!”
—“আকাশটা কী?” তিনি একঝলক ছবিটার দিকে তাকালেন। ছবির আকাশে কোনওরকম ত্রুটি আছে কি? না তো! রীতিমতো নির্মল নীল আকাশ, সাদা সাদা মেঘও উড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই ডানা মেলেছে করাল মৃত্যু! অরিত্র জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেন, “তোমার মনে হয় ডিফেক্টটা আকাশে?”
—“ইয়েস।” সে মাথা নাড়ল, “ছবিটা মোটেই ব্রাইট নয় স্যার। আই মিন, সুন্দর নয়। বরং ভয়ংকর! কিন্তু এ ছবির সঙ্গে নীল, সুন্দর আকাশ মানাচ্ছে না। আকাশের সাদা মেঘও নয়!”
—“ব্রাভো! এক্সেলেন্ট মাই ডিয়ার!” অরিত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রুতির কাঁধ চাপড়ে দিলেন, “অ্যাবসোলিউটলি রাইট! আকাশটা গ্লুমি বা কালো হওয়া উচিত ছিল। সেইজন্যই বারবার মনে হচ্ছে, কী যেন একটা মিসিং! কী যেন একটা অসঙ্গতি আছে! গ্রেট শ্রুতি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি একদিন অনেকদূর যাবে।”
শ্রুতির ভয়বিবর্ণ মুখে এতক্ষণে রক্তসঞ্চার হল। সে স্মিত হেসে বলে,
—“থ্যাঙ্কস,”
—“আসলে দোষ আমারও নয়,” তিনি এবার চিজ বিস্কুট তুলে নিয়ে বললেন, “দৃশ্যটা বাস্তবে ঠিক যেমন ছিল, আমি অবিকল তেমনই এঁকেছি। প্রকৃতি তো আর তুচ্ছ মানুষের কথা চিন্তা করে রঙ বদলায় না। তাই আসল দৃশ্যে আকাশটা এমন নীলই ছিল। বাস্তব আর শিল্পে সামান্য ফারাক থাকে। আমার বোঝা উচিত ছিল যে ছবিতে নীল আকাশ মানাবে না…”
বলতে বলতেই থেমে গেলেন অরিত্র। বলা ভালো, থামতে বাধ্য হলেন। শ্রুতি তাঁর দিকে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে ভয়, অবিশ্বাস আর অনেকখানি বিস্ময় মেশানো। যেন কোনও ভূত দেখছে! তিনি অবাক,
—“কী হল?”
—“আপনি…” সে কাঁপা গলায় বলে, “আপনি নিজের চোখে এ দৃশ্যটা দেখেছেন! এটা বাস্তবে ঘটেছিল?”
—“অফ কোর্স!” অরিত্র কফির মাগে চুমুক দেন, “শিল্প তো আকাশ থেকে পড়ে না! বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ নিবিড়। আমি যখন সোমালিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন এই এক্সক্লুসিভ দৃশ্যটা চোখে পড়ে গিয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গেই একটা পেপারে রাফ স্কেচটা করে ফেলেছিলাম। বাকিটা অবশ্য পরে ধীরেসুস্থে করেছি। কিন্তু মেইন স্ট্রাকচারটা তখনই করেছিলাম।”
—“মানে!” শ্রুতির কণ্ঠস্বর তখনও কাঁপছে, “যখন মৃত শিশুর শবদেহ নিয়ে অর্ধমৃত ক্ষুধিত মা শকুনের সঙ্গে লড়াই করছিল, তখন আপনি সেই দৃশ্যটা বসে বসে আঁকছিলেন!”
—“নয়তো কী?” অরিত্র নির্বিকারভাবে বলেন, “সেটাই তো আমার কাজ। আই অ্যাম আ প্রোফেশনাল! আমার যা করণীয়, সেটাই তো করব। দেখো না, সাংবাদিকরা কীভাবে বন্যাবিধ্বস্ত লোকদের ছবি তোলে! তারা শুধু ছবিই তোলে। রেস্কিউ করতে যায় না। ওটা ওদের কাজ নয়!”
—“কিন্তু আপনি কি মেয়েটিকে কোনওভাবে হেল্প করতে পারতেন না?”
—“কাম অন ডিয়ার,” অরিত্র মাথা ঝাঁকালেন, “ইমোশন আলাদা আর প্রফেশনালিজ্ম আলাদা। তাছাড়া আমি কী করতে পারতাম? হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরছিল! কতজনকে বাঁচাতে পারতাম?”
“কিন্তু আপনি সেই মৃতপ্রায় মানুষগুলোর ছবি আঁকতে পেরেছেন!” শ্রুতির চোখের কোণ চিকচিকিয়ে ওঠে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
—“কনগ্র্যাট্স্ স্যার। এই ছবিগুলো সত্যিই আপনাকে অমর করে রাখবে।” কথাগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ ছিল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। থাকলেও তাতে কিছুই আসে যায় না। শ্রুতির বয়েস এখনও অনেক কম। কাঁচা মাটির মতো মন। তাই একটু আবেগপ্রবণ। শিল্পীর নির্লিপ্তি আসতে সময় লাগবে। তাই ওর কথায় কিছুই মনে করলেন না অরিত্র। মৃদু হেসে বললেন,
— “এনিওয়ে, থ্যাঙ্কস ফর দ্য কফি।”
২
—“আই চাওয়ি… আই চাওয়ি সাইডো…”
শব্দটা কিছুটা এই জাতীয়ই ছিল। সঠিক উচ্চারণ এটাই, না অন্যকিছু তা বোঝা অসম্ভব। তবু এরকমই কিছু শব্দগুচ্ছ বারবার শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তখন অর্থটা বোঝেননি। সেই মেয়েটি চিৎকার করে এরকমই কিছু বলে যাচ্ছিল। আর প্রবল বিক্রমে লড়ে যাচ্ছিল শকুনগুলোর সঙ্গে। ওর কোলের শিশুটি যে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে বাকি ছিল না! এবং ওকে দেখেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওর আয়ুও বেশিক্ষণ নেই! কালো কুচকুচে চামড়া মাংস পেশীর অভাবে ঝুলে গিয়েছে। অনাবৃত দেহের শুষ্ক স্তনগ্রন্থিটুকু চোখে না পড়লে বোঝাই দায় যে ও নারী না পুরুষ। চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে গৃধ্রুবাহিনী। তাদের নখের আঁচড়ে, ঠোকরে রক্তাক্ত হতে হতেই চিৎকার করে যাচ্ছিল সে, “আই চাওয়ি… আই চাওয়ি…”
কিন্তু সে ডাকে সাড়া দেননি অরিত্র। বরং গাড়ির সিটে বসে এই এক্সক্লুসিভ দৃশ্যটার কাঠামোটাকে খাতাবন্দী করতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি জানতেন, এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। আর এই অভূতপূর্ব মডেলও কোনওদিন পাওয়া যাবে না। জান্তব ক্ষুধার এমন বীভৎস প্রকাশ আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি। এই অদ্ভুত ছবিটাই যে তাঁর এগজিবিশনের অমূল্য মাস্টারপিস হতে চলেছে, তা বুঝতে দেরি হয়নি অরিত্র সান্যালের। তাই দ্রুত, অভ্যস্ত হাতে ছবিটার খসড়া করে নিয়েছিলেন….
পরবর্তীকালে অবশ্য ওই দুর্বোধ্য শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। সোমালি ভাষায় ‘আই চাওয়ি’ মানে ‘হেল্প’। মেয়েটি তার কাছে সাহায্যের আবেদন করছিল। কিন্তু কী করার ছিল তাঁর! কীভাবেই বা সাহায্য করতে পারতেন!
মনে মনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন অরিত্র। আজ রাতেই ছবিটাকে শেষ করে ফেলতে হবে। দু’দিন পরে গ্যালারির লোক এসে নিয়ে যাবে তাঁর এতদিনের সাধনার ধনগুলোকে। এই ছবিগুলোই সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ প্রমাণিত হতে চলেছে। তাই নিজের বুকের পাঁজরের থেকেও বেশি যত্নে রেখেছেন। কোথাও যেন এতটুকুও ত্রুটি না থাকে, সেদিকে তাঁর শ্যেনদৃষ্টি। হাতে আর বেশি সময় নেই। তাই শেষ ছবিটায় নীল আকাশের সৌন্দর্য সরিয়ে দিয়ে একটা বীভৎস কালো বা ঘোলাটে আকাশ আঁকছেন। এইটুকু হয়ে গেলেই ছবিটা একদম নিখুঁত হয়ে যাবে!
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত দুটোর ঘণ্টা পড়ল। ঘড়ির আওয়াজে সংবিত ফিরে পেলেন তিনি। আর তখনই চোখ পড়ল সামনে রাখা ক্যানভাসের ওপরে! এতক্ষণ ধরে এই ছবিটাকেই ঠিক করছিলেন অরিত্র। আঁকতে আঁকতে কখন যে অদ্ভুত একটা ঘোরে ডুবে গিয়েছিলেন তা টের পাননি মনে পড়ে গিয়েছিল সেই মেয়েটির কথা…
ক্যানভাসের দিকে চোখ ফেরাতেই হঠাৎ চমকে উঠলেন শিল্পী! এ কী! এতক্ষণ ধরে কী এঁকেছেন অরিত্র সান্যাল! এমন হওয়ার তো কথা নয়! যতদূর মনে পড়ছে, তিনি শুধু আকাশটাকেই নতুন করে আঁকছিলেন। অথচ গোটা ছবিটাই যে বদলে গিয়েছে! কখন আঁকলেন এই ছবি! এ তো সেই পরিচিত ছবিটা নয়! শকুনের পাল চতুর্দিকে উড়ছে! তাদের সঙ্গে মৃত সন্তানকে বুকে নিয়ে লড়ছে সেই নারী! এই পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু কী অদ্ভুত ম্যাজিকে তার মুখটা ঘুরে গিয়েছে সামনের দিকে। চোখে যন্ত্রণা, অসহায়তা আর নেই। বরং চোখদুটো আগুনের মতো দপদপ করে জ্বলছে! যেন তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অরিত্রর দিকেই। আর ডান হাতটা সাপের উদ্যত ফণার মতো উঠে এসেছে সামনে। তর্জনী উঁচিয়ে সে কিছু একটা নিৰ্দেশ করছে, কিছু বলতে চাইছে অথবা অন্য কিছু!
অরিত্র স্তম্ভিত! আচমকা মনে পড়ল, অবিকল এই ভঙ্গিটা তিনি আগেও কোথাও দেখেছেন! রবি বর্মার একটি ছবিতে ঋষি দুর্বাসা শকুন্তলাকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন। এই নারীর অবয়বটাও একদম সেই ছবির দুর্বাসার মতো! জ্বলন্ত দুই চোখে তীব্র দৃষ্টি! সেই উদ্যত তর্জনী! কোনও অভিশাপবাক্য তার মুখে নেই; থাকা সম্ভবও নয়। অথচ মনে হচ্ছে কোনও এক অশ্রুত অভিশাপ তার ঠোঁট চুঁইয়ে পড়ছে! অদ্ভুত! ছবিটার তো এমন হওয়ার কথাই নয়! এ ছবি তিনি আঁকেননি!
বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ বসে থাকলেন অরিত্র সান্যাল। ছবিটা পালটে গেল কী করে? কে পালটাল! তবে কি এসব শ্রুতিরই কারসাজি! ওই ক্ষুধার্ত, মৃতপ্রায় লোকগুলোর জন্য তার দরদের শেষ নেই। সে-ই কি তবে ছবিটাকে পালটে দিয়ে গিয়েছে? নাঃ, তা-ই বা কীকরে সম্ভব? যতক্ষণ শ্রুতি স্টুডিওতে ছিল, ততক্ষণ অরিত্র এই ছবিটার সামনেই ঠায় বসেছিলেন। শ্রুতির পক্ষে ক্যানভাসে একটি আঁচড় কাটারও সুযোগ ছিল না। তবে?
আচমকা একটা পরিচিত অথচ অসম্ভব অনুভূতি টের পেলেন অরিত্র। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আনক্যানি ফিলিং’। এটা এমন কিছু ভুতুড়ে ব্যাপার নয় ঠিকই; অথচ এই মুহূর্তে আদৌ এই অনুভূতিটার থাকার কথা নয়। তিনি অনুভব করলেন যে পেটের ভেতরটা চিনচিন করছে! অর্থাৎ তাঁর খিদে পেয়েছে! খিদে মানুষের অত্যন্ত স্বাভাবিক এক প্রবৃত্তি। তাতে আপাতদৃষ্টিতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই!
তবুও বিস্মিত হলেন তিনি! কারণ আজ রাতের খাওয়াটা বেশ জম্পেশ হয়েছিল। তাঁর কুক হরি ডিনারে চমৎকার বাসন্তি পোলাও এবং পাঁঠার কষা মাংস রান্না করেছিল। ফলস্বরূপ খাওয়াটা পরিমাণে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। ঘণ্টাদুয়েক আগেও পেট আইঢাই করছিল। তাছাড়া অরিত্র যখন কাজ করেন তখন সময়ে-অসময়ে কাপের পর কাপ কফি, আর কুকিজ বা সল্টেড কাজু খেয়ে থাকেন। হরিই একটা ফ্লাস্কে কফি রেখে দিয়ে যায়। যতদূর মনে পড়ছে, আধঘণ্টা আগেই কফি আর কুকিজ খেয়েছেন। এখন কোনওমতেই খিদে পাওয়া উচিত নয়! কিন্তু খিদে পাচ্ছে যে!
ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর। সত্যিই কি খিদে? নাকি গুরুপাক খাবার খেয়ে অম্বল হল! কিন্তু গ্যাস বা অম্বলে পেট জ্বালা করতে পারে, এরকম চিনচিন তো করে না। এ যে খিদেরই লক্ষণ! নিজের পাকস্থলীর মধ্যে একটা অস্বাভাবিক শূন্যতা টের পাচ্ছেন! নাঃ, গ্যাস বা অম্বল নয়, তাঁর খিদেই পেয়েছে।
একটু বিরক্ত হয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। একেই ছবিটার অস্বাভাবিক পরিবর্তনে মাথাটা কেমন গুলিয়ে গিয়েছে। কীভাবে ছবিটা পালটে গেল তা ঈশ্বরই জানেন! নিজের অবচেতন মন থেকে এঁকে ফেলেছেন কি? কিন্তু তেমন হলেও তো মনে থাকত। অনেক সময় অবশ্য অনেক শিল্পীই একরকম ভরে পড়ে ছবি আঁকেন! অনেক প্রখ্যাত স্রষ্টা অসামান্য সৃষ্টি করার পর জানিয়েছেন যে সেই সৃষ্টি নাকি তাদের নয়! কেউ যেন ঘাড় ধরে তাঁদের দিয়ে সৃষ্টিটা করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওসব তত্ত্বে অরিত্র বিশ্বাসী নন। তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন স্রষ্টা নিজের অন্তরের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি করেন। কোনওরকম অতিলৌকিক শক্তি তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে না। তবে এই মুহূর্তে যেটা ঘটল সেটা ঠিক কী!
অরিত্র বুঝলেন আজ রাতে আর ছবিটা শেষ করা যাবে না। যা পরিবর্তন হয়েছে, সেটা যেভাবেই ঘটুক না কেন, ইপ্সিত নয়। তার ওপর মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে। কাল আবার ছবিটাকে নিয়ে নতুনভাবে পড়তে হবে। হাতে বেশি সময়ও নেই। প্রদর্শনী শুরু হতে আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। সেই মতন গোটা গ্যালারিকে সাজিয়ে তুলতে হবে। গ্যালারির মালিক মি. বাজোরিয়া বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। ছবিগুলো চাইছেন। এত বড় প্রদর্শনীর আয়োজন করতেও তো খানিকটা সময় লাগে! তাছাড়া ড্যানিয়েল গ্রে-ও তিনদিন পরেই এসে পৌঁছোচ্ছেন। তাঁকেও ইমপ্রেস করার একটা বিষয় আছে। একবার যদি ড্যানিয়েল তাঁর কাজ পছন্দ করে ফেলেন, তারপরই খুলে যাবে এক বিশাল দরজা! এখন অরিত্রর আর কিছু ভাবার অবকাশ নেই। সামনে শুধু ড্যানিয়েল এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রদর্শনী!
—“ওঃ!”
পেটের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। খিদেটা এই কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে! পাকস্থলিটা জ্বলছে! হল কী! এত খিদে! এরকম ভয়াবহ খিদে আগে কখনও টের পাননি তিনি। হঠাৎ এমন ভয়ঙ্করভাবে ক্ষুধার উদ্রেক হল কেন! অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলেই কি দেহের সমস্ত সিস্টেম উলটোপালটা কাজ করছে? কে জানে! যাই হোক, এখন কিছু পেটে দেওয়া দরকার। খিদেটা বড্ড জ্বালাচ্ছে।
অরিত্রর রান্নার লোক হরি সবসময়ই ফ্রিজ ভর্তি করে খাবার মজুত রাখে। তাঁর সংসারে হরির অবদান অনস্বীকার্য। মাঝেমধ্যেই অরিত্র বলে থাকেন,
— “যেদিন তোর ভাঁড়ার শূন্য হবে, সেদিন বোধহয় আমি হার্টফেল করব : তুই হচ্ছিস মা অন্নপূর্ণার মেল ভার্শন,”
যথারীতি আজও ফ্রিজ খুলতেই চোখে পড়ল থরে থরে খাবার। ইনস্ট্যান্ট নুডলস থেকে শুরু করে সসেজের প্যাকেট, ব্রেড, দুধ, ফল, ডিম, ফলের রস; সবই স্টোর করা আছে ফ্রিজের অভ্যন্তরে। অরিত্র একসঙ্গে বেশ কয়েকটা ইনস্ট্যান্ট নুডলসের প্যাকেট তুলে নিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। নুডলস তৈরি করা এমন কিছু হাতি-ঘোড়া কাজ নয়। তিনি ওভেনে পরিমাণমত গরম জল চাপিয়ে দিয়েছেন। ফুটে উঠতেই ঢেলে দিলেন নুডলস। আর তো মাত্র কয়েকটা মিনিট। তারপরেই….
—“ও মাই গড!”
এবার পেটের ভেতরটা যেন কামড় দিয়ে উঠল! কী মারাত্মক খিদে! অপ্রতিরোধ্যভাবে চাগাড় দিয়ে উঠেছে। তাঁর মাথাটা পাক দিতে থাকে। চিলড এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছেন প্রখ্যাত শিল্পী! এ কী! এ যে ক্রমাগত অসহ্য হয়ে উঠছে! এইভাবে খিদে পায় নাকি! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কী করে এভাবে পেটে আগুন জ্বলতে থাকে! তা-ও অমন রাক্ষুসে ডিনারের পর! তারপরেও বেশ কয়েকবার কফি আর কুকিজ পেটে পড়েছে। সব বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল কী করে! মনে হচ্ছে, অন্তত কয়েকদিন তিনি কিছুই খাননি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শরীর অবশ লাগছে। এত খিদে কোথা থেকে এল! এ যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ব্যাপার!
ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে নুডলস। খাবারের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে কিচেনে। এবার একটু মশলা ঢেলে দেওয়া দরকার। অরিত্র ইনস্ট্যান্ট নুড্লসে মশলা একটু বেশি পরিমাণেই দেন। তাঁর ভালো লাগে।
অথচ আজ মশলার কথা মনেই এল না! এমনকী সসপ্যান থেকে নুডলস বাটিতে ঢালার সময়টুকুও ব্যয় করলেন না তিনি। সস্প্যানটা নামিয়েই উত্তপ্ত নুডলস হাতে করে বুভুক্ষুর মতো গপগপ করে খেতে শুরু করলেন। হাতে রীতিমতো ছ্যাঁকা লাগল। হয়তো ফোসকাও পড়বে। কিন্তু সেদিকে কোনও খেয়াল নেই অরিত্রর! কাঁটা-চামচের বালাই নেই! যে অরিত্র সান্যাল টেবল্ ম্যানার্সের জন্য প্রসিদ্ধ, যিনি কাঁটা চামচ ছাড়া খান না, খাওয়ার সময় কোনওরকম শব্দ করেন না, সেই মানুষটিই সমস্ত বিদেশি আভিজাত্য ভুলে নিতান্তই অশিক্ষিত লোকের মতো হাত দিয়ে গবগবিয়ে নুড্লস খাচ্ছেন! যেন বহুদিন মানুষটার কোনওরকম খাদ্য জোটেনি! অনেকদিনের উপবাসী, হাভাতে মানুষ যেমন করে খাদ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনভাবেই তিনি আঙুল চেটে চেটে খাচ্ছেন!
চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই নুডলস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু অরিত্রকে দেখে মনে হল, তিনি এখনও তৃপ্ত নন। কপালে অতৃপ্তির ভাঁজ। মুখে অসন্তুষ্টি! এ কী! খিদেটা তো মিটল না! বরং পেটের মধ্যে অনির্বাণ জ্বালাটা রাবণের চিতার মতো লকলকিয়ে উঠল! নুড্লস তো কম খাননি! অথচ পাকস্থলীর একাংশও পূর্ণ হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না! অমন এক সসপ্যান ভরতি নুডলস তবে কোথায় গেল! তিনিই তো খেয়েছেন! নাকি তিনি খাননি! অন্য কেউ খেয়েছে! তাঁর কি স্মৃতিভ্রম হল? এসব কী হচ্ছে! এ কী জাতীয় সর্বনেশে ক্ষুধা!
অরিত্র শূন্য সসপ্যানটার দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেলেন না। আবার! আবার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল! খিদে! ভয়ানক খিদে! গোটা পেট মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। যেন এক বিরাট দৈত্য তান্ডবনৃত্য নেচে বেড়াচ্ছে তাঁর জঠরে।
তিনি তড়িৎগতিতে এক লিটারের ফ্রুটজুসের কনটেনার বের করে আনলেন। কিছু ভাবার সময় নেই। ছিপিটা খুলে তৎক্ষণাৎ ঢেলে দিলেন গলায়। ঢকঢক করে পান করে ফেললেন গোটাটাই। কেক, পেস্ট্রি যা মজুত করা ছিল চেটেপুটে শেষ করলেন। কিন্তু কই? খিদে তো কমছে না! বরং খিদের আগুনে যেন ঘি ছিটিয়ে দিল কেউ! পরম উল্লাসে লকলকিয়ে উঠল দুরন্ত ক্ষুধার লেলিহান শিখা! কী করবেন! কী করবেন অরিত্র! খাবেন? … আরও খাবেন?
তাঁর মাথা থেকে মুছে গেল এগজিবিশনের কথা! ভুলে গেলেন ছবিগুলোকে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ড্যানিয়েল গ্রে অদৃশ্য হয়ে গেলেন! পেটটাকে খামচে ধরে মেঝেতে বসে পড়েছেন তিনি। কোনওমতে ফ্রিজ থেকে বের করে আনলেন যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী। খেতে হবে। খেতে হবে তাঁকে! এই মুহূর্তে দুনিয়ায় আর কিছুই নেই খাদ্য ছাড়া। আর সব মিথ্যে… সব মিথ্যে!
কোলের ওপর সমস্ত খাবার রেখে নিরূপায়ভাবে কাঁচা পাউরুটি চিবোতে শুরু করলেন অরিত্র। এখন স্লাইস বা টোস্ট করার সময়ও নেই! খিদের চোটে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। তাই গোটা রুটিটাই শেষ হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে! এত খিদে কোথায় জমেছিল? সত্যিই খিদে?… নাকি অন্যকিছু…! রুটির পর ডিম! হ্যাঁ কাঁচাই! ওমলেট বা পোচ করতেও সময় লাগে। কে অপেক্ষা করবে? বুভুক্ষু উদর ওই সামান্য সময়টুকুও দিতে রাজি নয়। তারপর ঠান্ডা কাঁচা দুধ, কাঁচা সসেজ…! পাগলের মতো যা পাচ্ছেন, সবকিছুই দু’হাতে মুখে পুরছেন অরিত্র! ঢকঢক করে গলায় ঢালছেন! কষ বেয়ে পড়ে যাচ্ছে পানীয়!
খিদে কিন্তু কমছে না!
৩
রোজ সকালে হরি একেবারে কাঁচা বাজার সেরে তবেই অরিত্রর বাড়িতে ঢোকে। এটা তার প্রাত্যহিক অভ্যাস। অরিত্র নিজে বাজার করা পছন্দ করেন না। তার ওপর আবার বড় ভুলো মনের মানুষ। তিনি বাজার করলে অর্ধেক প্রয়োজনীয় সামগ্রীই ঘরে আসবে না! দোকানিরা তাঁকে অনভিজ্ঞ লোক পেয়ে ঠকিয়েও দেয়। পচা মাছ বা খুঁতো ফল-সব্জি গছিয়ে দেয় অনায়াসেই। তা-ই হরি দৈনন্দিন কাঁচা বাজারটাও নিজের হাতেই করে। বেছে বেছে নিয়ে আসে তাজা মাছ, মাংস বা অন্যান্য শাক-সব্জি। এ বিষয়ে সে এক্সপার্ট! গোটা বাজার চক্কর কেটে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জিনিসটাই নিয়ে আসবে। তার তীক্ষ্ণ নজরকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই।
প্রাত্যহিক নিয়মমতো আজও হরি দুই ব্যাগ ভরতি বাজার নিয়ে এসে হাজির হল অরিত্রর বাড়ির সামনে। তার মনটা বেশ খুশি খুশি। আপনমনেই শিস দিয়ে হিন্দি গানের সুর ভাঁজছে। সকাল সকাল চমৎকার বাগদা চিংড়ি উঠেছিল বাজারে। হরি হাতছাড়া করেনি। বাবুর আবার চিংড়ির মালাইকারি বা কালিয়া ভারি পছন্দ। সঙ্গে চিকেনও আছে। একদম ফ্রেশ মুর্গীর মাংস।
সে হিন্দি গানের কলির সুরে শিস দিতে দিতেই বাইরের দরজাটা চাবি দিয়ে খুলল। অরিত্র এইসময় গভীর ঘুমে থাকেন। তাই একসেট ডুপ্লিকেট চাবি হরির কাছেই থাকে। অনেকদিনের বিশ্বস্ত কর্মী সে। রোজ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই চটপট ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে লেগে যায়। অরিত্র ঘুম থেকে ওঠার আগেই তৈরি হয়ে যায় ব্রেড-বাটার, অমলেট এবং সসেজ। কখনও কখনও পরোটা বা লুচিও বানিয়ে ফেলে। বাবু আঙুল চেটে চেটে খান, আর তারিফ করে বলেন, “হরি, তোর মতো শিল্পীও খুব কম আছে! আমার আঁতুড়ঘর স্টুডিও, আর তোর কিচেন!”
অত বড় বড় দার্শনিক কথা বোঝে না হরি। এইটুকু বোঝে যে তার হাতের রান্না ছাড়া আর কিছু বাবুর মুখে রোচে না। সেজন্য সে নিজেও বেশ গর্বিত! ওই টিভির সাজুগুজু করা দিদিমণিরাও রান্নায় তাকে হারাতে পারবে না! বাবু বলেন, “রান্নায় তুই দ্রৌপদীর নাতি!”
দরজা খুলতেই সামনে বিরাট ড্রয়িংরুম। দু’হাতের ভারি ব্যাগ সামলাতে সামলাতে হরি কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমের ঘড়িতে এখন প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। ন’টার মধ্যেই করে ফেলতে হবে ব্রেকফাস্ট। সে মনে মনে ভাবতে থাকে, আজ ব্রেকফাস্টে কীভাবে বাবুকে চমকে দেবে! জমিয়ে আলুর পরোটা বানাবে? নাকি ছোলা-বাটোরা? অথবা স্ক্র্যাম্বল্ড্ এগ, চিকেন রোস্ট কিংবা বেকন?
মনে মনে নানারকম মেনু ভাবতে ভাবতেই সে কিচেনে ঢুকে পড়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল! কী সর্বনাশ! রান্নাঘরের এহেন দশা হল কী করে! এখানে কি কোনওরকম সাইক্লোন হয়ে গিয়েছে? নাকি কাল রাতে ডাকাত পড়েছিল! হরি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল চতুর্দিকে খাদ্যবস্তু ও উচ্ছিষ্টের ছড়াছড়ি! ফ্রিজ খোলা! ভেতরটা শূন্য! কিচ্ছু নেই! মেঝের ওপর ইতস্তত পড়ে আছে কাঁচা পাউরুটির অবশিষ্টাংশ, প্রায় একডজন কাঁচা ডিমের ভাঙা খোলা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুধ, কাঁচা সবজির অভুক্ত উচ্ছিষ্ট, বিস্কুট-কুকিজের টুকরো! সাদা মারবেলের ওপরে একদিকে আটা, ময়দা, চাল এবং অন্যদিকে গাঢ় কালো গুঁড়ো কফির স্তর অদ্ভুত বৈপরীত্যে ছড়িয়ে আছে! পরোটা বা অন্যকিছু বানাবে কী করে! সবকিছুই কেউ খেয়ে, ছড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে! কর্ণফ্লেক্স, বিস্কুটের শূন্য প্যাকেট ও শূন্যগর্ভ ফ্রিজ হতভম্ব হরির দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। যেন বলছে, “অনন্ত ক্ষুধার কাছে তোমার অন্নপূর্ণার ভাঁড়ারও ফেল পড়ে গেল যে!”
হরি বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখছিল চতুর্দিকটা! তার মাথা তখন কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে! কাল রাতেও তো সব ঠিক ছিল! বাবুকে খাইয়ে দাইয়েই সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। তাহলে এসব কাণ্ড করল কে! দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে কেউ খিদের জ্বালায় হাতের কাছে যা পেয়েছে, তাই খেয়েছে! যতটা খেয়েছে, ততটাই ছড়িয়েছে! কাঁচা কর্নফ্লেক্স নিঃশেষ করেছে! কাঁচা আটা, ময়দা, চালও গোগ্রাসে গিলেছে! এমনকী কফির গুঁড়োকেও ছাড়েনি! এ কী আদৌ কোনও মানুষ করেছে! নাকি প্রচণ্ড ক্ষুধিত কোনও জানোয়ার এসে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সব!
হরি বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই মনে পড়ল অরিত্রর কথা। বাবু ঠিক আছেন তো? তাঁর কোনও বিপদ-আপদ হল কি? আর একমুহূর্তও দেরি না করে সে তড়িৎগতিতে অরিত্রর বেডরুমের দিকে দৌড়োয়! আর্তস্বরে ডাকে, “বাবু… বা-বু!”
বেডরুমের বন্ধ দরজার ভেতর থেকেই ঘড়ঘড়ে স্বরে উত্তর এল, “আমার খিদে পেয়েছে! …খি-দে!”
জীবনে এই প্রথমবার অরিত্রর অনুমতি ছাড়াই দরজা খুলে তাঁর বেডরুমে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল হরি। নক করার সৌজন্য তখন তার মাথায় উঠেছে! কিন্তু ভেতরে গিয়ে যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ! মনে হল, পায়ের তলার মাটি কাঁপছে! কোনওমতে স্খলিত স্বরে বলল, “বা-বু!”
অরিত্র তার দিকে তাকালেন! সে দৃষ্টি আদৌ স্বাভাবিক নয়! রাগ, যন্ত্রণা আর বিহ্বলতা মেশানো এক অদ্ভুত উন্মত্ত চাহনি! সম্ভবত সারা রাত ঘুমোননি! চোখদুটো জবাফুলের মতো টকটকে লাল। চুল অবিন্যস্ত! তাঁর পরনের পাঞ্জাবিতে, সারা মুখে কাঁচা ময়দা, কালো কফির গুঁড়ো তখনও লেগে আছে। খিদের জ্বালায় পাগলের মতো যা পেয়েছেন, তা-ই খেয়েছেন! তখনও পেটের মধ্যে সেই দাবানল থামেনি। বরং যতই খাচ্ছেন, ততই আগুনটা আরও বেশি মাত্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে! কয়েক সেকেন্ডও স্থির থাকতে দিচ্ছে না! কোন্টা খাওয়ার যোগ্য, কোন্টা নয়— সেই চিন্তার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। মনে হচ্ছে কয়েক হাজার বছরের ক্ষুধা তাঁর পাকস্থলিতে এসে জমেছে। অথবা কোনও ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়েছে জঠরে। যা-ই পড়ছে, সেই কৃষ্ণগহ্বর সমস্ত গ্রাস করে কোথায় পাঠিয়ে দিচ্ছে কে জানে!
এই মুহূর্তে তাঁর সামনে পড়ে আছে অন্তত গোটা দশেক পিৎজার খালি বাক্স! কোনওমতে ফোন করে আনিয়েছেন। একটা গোটা পিৎজা খাওয়াই যাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, তিনি দশটা আস্ত পিৎজা খেয়ে ফেলেছেন! সেই খাওয়ার মধ্যে কোনও তৃপ্তি পাননি! কী খাচ্ছেন তাও বোঝেননি। বোঝেননি তার স্বাদ, তৃপ্তিদায়ক সুগন্ধ! শুধু এইটুকু বুঝেছেন যে কিছু একটা গ্রাসনালী বেয়ে নামছে। তার আস্বাদ নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থাও নেই। ভোজনরসিক মানুষটি আজ রাক্ষসের মতো সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছেন! মাথার ভেতরে কে যেন ফিসফিস করে বলছে, “এভরিথিং হিয়ার ইজ এডি! ক্ষুধার কাছে কোনও বাছবিচার হয় না! খাও… খাও… খেয়ে যাও!”
অথচ ক্ষুধা প্রশমিত হয়নি! অরিত্রর মনে হচ্ছিল চতুর্দিক থেকে একটা কালো অন্ধকার তাঁকে ঘিরে ধরেছে! সেই অন্ধকারে জমে রয়েছে অনির্বাণ ক্ষুধা। কতগুলো শুকনো বিকৃত দেহ তাঁর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কঙ্কালসার হাতের তর্জনী উদ্যত হয়ে রয়েছে ওঁরই দিকে! অবিকল সেই ভঙ্গি! দুর্বাসা অভিশাপ দিচ্ছেন।
ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেট আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি। কোনওমতে কাতর কণ্ঠে বললেন, “হরি! প্লিজ হেল্প মি! আমার খিদে পেয়েছে। ভীষণ খিদে…”
হরি বিস্ময়ে, ভয়ে প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিচেনে আর কিছু বাকি নেই যা সে এই ক্ষুধার্ত মানুষটিকে খেতে দিতে পারে। এ কী হল বাবুর! এ কীরকম কাণ্ড করছেন! এখন কী করবে সে! বাড়ির বাইরে বড় বড় রেস্টোর্যান্ট আছে ঠিকই। কিন্তু সে তো সকাল দশটার আগে খুলবে না। তবে?
এবার রীতিমতো কেঁদে উঠলেন অরিত্র, “দুমুঠো খেতে দে আমায়। আমি যে মরে যাচ্ছি!”
সে তাড়াতাড়ি বলল, “এক্ষুনি দিচ্ছি বাবু। এক মিনিট সময় দিন!”
—“এক মিনিট!” তিনি রাগে উন্মত্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এক মিনিট ও সময় নেই। এখনই আমায় খেতে দে, নয়তো… নয়তো…”
বলতে বলতেই প্রায় পাগলের মত ছুটে গেলেন কিচেনের দিকে। এখানেই সবে মাত্র কাঁচা বাজারের থলে এনে রেখেছে হরি। অরিত্র ব্যাগদুটোকে টেনে নিয়েছেন। হরি হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই বের করে এনেছেন কাঁচা মাছ-মাংস। তার বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনেই বুভুক্ষু কুকুরের মতো কাঁচা মুরগির মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছেন! তাঁর খাওয়ার একটা জান্তব শব্দ কানে এসে ধাক্কা মারল। মটমট করে চিবোচ্ছেন হাড়গুলো। কাঁচা বাগদা চিংড়িও খোলা শুদ্ধই কড়মড়িয়ে…. ওঃ!
হরি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। তার বুঝি নড়ার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। এমন বীভৎস দৃশ্য সে আগে কখনও দেখেনি। চোখের সামনে যা দেখছে, তাতে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অরিত্রকে এই মুহূর্তে মানুষের মতো লাগছে না! বরং ক্ষুধার্ত কোনও মাংসাশী পশু বা পিশাচের সঙ্গে তাঁর মিল অনেক বেশি। হরির পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। তবু পালাতে পারছে না। বহু বছরের বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা তাকে অরিত্রকে ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। ভয় করছে। কিন্তু এই অসহায় লোকটাকে কি এভাবে ফেলে যেতে পারে?
যা যা সযত্নে বাজার করে এনেছিল হরি, তাতে একটা মানুষের বেশ কয়েকদিন চলে যায়। আজ আধঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ! রাক্ষুসে খিদের সামনে উড়ে গেল সব কিছু। অরিত্র যেন ক্রমাগত হিংস্র হয়ে উঠছেন! তিনি হিংস্র, উন্মত্ত দৃষ্টিতে হরির দিকে তাকালেন। ঘড়ঘড়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন,
—“আর নেই?”
হরির মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছিল না। কোনওমতে কাঁপা গলায় বলল, “আমায় একটু সময় দিন। সামনের রেস্টোরেন্টটা এখনই খুলবে। আমি আপনার পছন্দসই সব খাবার নিয়ে আসব বাবু। শুধু একটু সময়…”
অরিত্র বন্য জন্তুর মতো তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হরি যা দেখতে পাচ্ছেন না, তিনি তা স্পষ্ট দেখছেন! দেখছেন, হরির চতুর্দিকে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুন! একদল উলঙ্গ-কঙ্কালসার মানুষ তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে আছে। তাদের দু’চোখ যেন জ্বলছে! ছায়াশরীরগুলো অরিত্রের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর ক্রমাগত চিৎকার করে বলছে, “খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। খেতে দা-ও!”
হরির ঠিক পেছনেই যে এসে দাঁড়াল তাকে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি! এই তো সেই মেয়েটি! সেই মা যে নিজের সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে শকুনের সঙ্গে লড়াই করছিল! মেয়েটার দু’চোখে যেন দাবানলের আগুন। একটি কথাও না বলে সে উদ্যত তর্জনী তুলে ধরল তাঁর দিকে। মেয়ে নয়, যেন মূর্তিমতী অভিশাপ! আর সেই অভিশাপ এখন সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছে অরিত্রর অভ্যন্তরে। জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে দিচ্ছে! খিদে, কী প্রচণ্ড খিদে! ওঃ! মরে যাচ্ছেন অরিত্র! এখনই কিছু খেতে না পেলে মরে যাবেন! ক্ষুধা তাঁর প্রদর্শনীর থিম! কিন্তু তখন কি বুঝেছিলেন যে তার মূল্য এভাবে দিতে হবে?
দাঁতে দাঁত চেপে হরির দিকে এগিয়ে গেলেন অরিত্র। এখন আর হরিকে দেখতে পাচ্ছেন না! চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে আসছে। শুধু নাকে আসছে মাংসের গন্ধ। খাবারের গন্ধ। হরির বদলে একতাল মাংস দেখছেন তিনি। সেই মাংস যা তাঁর ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে। তিনি শুকনো ঠোঁট লোভাতুর জিব দিয়ে চেটে বললেন, “আমার খিদে পেয়েছে!”
হরি সভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারল না! তার আগেই বাঘের মতো তার ওপর লাফিয়ে পড়েছেন অরিত্র।
একটা মর্মান্তিক আর্তচিৎকার! তারপরই সব শেষ!
৪
দিল্লীর গ্যালারিতে আর অরিত্র সান্যালের একক প্রদর্শনী হয়নি! ড্যানিয়েল গ্রে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অরিত্র’র সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতও সম্ভব ছিল না। শ্রুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কী যে হয়েছিল লোকটার কে জানে! শেষ ছবিটাকে নিখুঁত করে গড়ে তুলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওই একটি ছবি ছাড়া আর কোনও ছবি অবশিষ্ট ছিল না। যখন গ্যালারির লোকেরা নির্দিষ্ট দিনে ছবিগুলো আনতে গেল, তখন ছবির বদলে ওই বাড়িতে দু-দুটো লাশ আবিষ্কার করল! একটি লাশকে চেনাই যায় না। মনে হয়েছিল কোনও মাংসাশী হিংস্র জন্তু তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। অন্য মৃতদেহটি স্বয়ং অরিত্রর। তাঁর দেহ দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে স্টুডিওতে একটি ছাড়া আর কোনও ছবি নেই কেন! অরিত্রর মুখ ঠাসা ছিল কাগজে! পুলিশ তাঁর মুখ থেকে যা টেনে বের করেছিল তা ক্যানভাসের কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়! যিনি ওঁর পোস্টমর্টেম করেছিলেন, সেই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও স্তম্ভিত! কারণ অরিত্রর পাকস্থলীতে শুধু কাগজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি! পুলিশের অনুমান, কোনও কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন শিল্পী। সেজন্য নিজের আঁকা ছবিগুলোই শেষ পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছিলেন!
পুলিশ অবশ্য এখনও এই সন্দেহজনক জোড়া খুনের তদন্ত করছে। আর অরিত্র সান্যালের একক প্রদর্শনীর বদলে অন্যান্য শিল্পীদের ছবির মিলিত প্রদর্শনী হচ্ছে এই গ্যালারিতে। শুধু সব ছবির মধ্যে জ্বলজ্বল করছে অরিত্রর অন্তিম সৃষ্টি, হাঙ্গার! এই ছবিটাই একমাত্র বেঁচে গিয়েছিল। এই সেই ছবি যেখানে শকুনের উদগ্র ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়ছে এক অসহায় কঙ্কালসার মা। এর মধ্যেই অসম্ভব প্রশংসিত হয়েছে এই সৃষ্টি। সমালোচকেরা প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “প্রয়াত চিত্রশিল্পী অরিত্র সান্যালের ‘হাঙ্গার’ ছবিটি এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প।”
শ্রুতি একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ওই ছবিটারই দিকে। মৃত্যুর আগের দিন তার ফোনে একাধিক মেসেজ করেছিলেন অরিত্র। সব মেসেজেই লেখা ছিল দুটি শব্দ, ‘খিদে পেয়েছে!’ সে স্যারের পাগলামি ভেবে পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল, উনি তো মাঝেমধ্যেই এরকম খামখেয়ালিপনা করেন…
—“হাঙ্গার! মাই গড!”
সে সচকিত হয়ে দেখে এক বিদেশি স্বর্ণকেশী তরুণী এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক ওই ছবিটারই সামনে। উচ্ছ্বসিত স্বরে তার স্বামীকে সম্বোধন করে বলল,
—“লুক হনি! সো ফ্যাসিনেটিং!”
—“ইয়া সুইট পি! ভেরি ফ্যাসিনেটিং,” তার স্বামী জবাব দেয়, “ইউ ওয়ান্ট দিস?”
শ্রুতির আচমকা মনে হয়, ছবির মধ্যে কঙ্কালসার মায়ের চোখদুটো যেন মুহূর্তের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠেছে! অগ্নিদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে শ্বেতবর্ণা বিদেশিনীর দিকে! তার তর্জনী নিমেষে উদ্যত হয়ে উঠল….
সত্যিই কি তাই? নাকি স্রেফ চোখের ভুল!