ফ্যামিলি পাবের সুন্দরী

ফ্যামিলি পাবের সুন্দরী

লাস ভেগাস থেকে নিউইয়র্ক শহরে যাচ্ছিলাম। গ্রে—হাউন্ড বাসে চেপে। শুনেছিলাম ওই দূরত্ব একটানা গেলে শরীর তো খারাপই হয়, অনেকের নার্ভের সমস্যাও হয়। প্রায় সারাদিন বাসে বসে না থেকে ঠিক করেছিলাম যে জায়গা ভালো লাগবে সেখানেই নেমে যাব। দশ দিন যে কোনো গ্রে—হাউন্ড বাসে যাওয়া যাবে এমন টিকিট কাটায় নামা ওঠার সমস্যা ছিল না। রুক্ষ প্রকৃতি দুধারে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসে দেখতে মন্দ লাগছিল না। হঠাৎ প্রকৃতির চেহারা পালটে যেতে লাগল। ক্রমশ বরফে ঢাকা যে শহরে গিয়ে বাস জিরোবার জন্য থেমেছিল তার নাম ডেটন, নেমে পড়েছিলাম। গ্রে—হাউন্ড বাস টার্মিনাসের ভিতর ঠান্ডা নেই যন্ত্রের কারণে। বাইরে শূন্য ডিগ্রির নীচে। এরকম পরিবেশে কখনও থাকিনি বলে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই অনেক মোটেল পেয়ে যাব।

চাকাওয়ালা স্যুটকেস নিয়ে বাইরের রাস্তায় পা দিতেই জুতো বরফের নীচে। স্যুটকেসের চাকা অকেজো। শুধু বরফ বলেই টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। মোটেলগুলো চোখে পড়ল। তখন প্রায় বিকেল। আকাশে মেঘ থাকায় রোদ নেই। সবকিছু ছায়া ছায়া। কিন্তু মোটেলগুলোর গায়ে নিওন আলোয় লেখা ‘নো রুম। ফুল।’

শেষপর্যন্ত যে মোটেলে ঘর পেলাম তার ভাড়া দৈনিক পঁয়ত্রিশ ডলার। পরিচ্ছন্ন ঘর, টয়লেট, বিছানার চাদর ধবধবে। জামাপ্যান্ট পরেই শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর খিদেটাকে টের পেয়ে উঠে বসলাম। এই মোটেলে ঢোকার সময় কোনো রেস্টুরেন্ট নজরে পড়েনি। আপাদমস্তক গরম পোশাকে মুড়ে বাইরে বেরুতেই দেখলাম প্যাসেজেও বরফ জমছে। পা ফেলতেই অনেকটা পিছলে কোনোমতে সোজা হলাম। বুঝলাম, অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটা বোকামি হবে এখানে।

রিসেপশনিস্ট লোকটি দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো কফি তৈরির মেশিন দেখিয়ে বলল, যত ইচ্ছে কফি খান, দাম দিতে হবে না। খাবার খেতে হলে আপনাকে ফ্যামিলি পাবে যেতে হবে।’

ইংরেজি গল্প উপন্যাসে ফ্যামিলি পাবের কথা পড়েছি। খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলাম দশ মিনিটের পথ। শুকনো রাস্তায় যা দশ মিনিট বরফ ভেঙে গেলে তা পঁচিশ মিনিট লাগতে বাধ্য। সন্ধের সময় যায়নি, রাত নামে বোধহয় দেরিতে। রাস্তায় একটা মানুষ দূরের কথা, প্রাইভেট গাড়িও নেই। মাঝে মাঝে পরপর দুটো বড় বাস বরফ গুঁড়িয়ে চলে গেল। আধঘণ্টা পরে ফ্যামিলি পাবের আলো দেখতে পেলাম। সব জানলা—দরজা বন্ধ। একটা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ব্যাঞ্জোর আওয়াজ কানে এল। অল্প আলোয় টেবিলে টেবিলে কিছু মানুষ বসে সেই বাজনা শুনছেন। উলটোদিকের বার কাউন্টারে সামনের লম্বা টুলে কয়েকজন বসে। আমি সেদিকে এগিয়ে যতেই কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো বারম্যান হাসল, ‘গুড ইভনিং, স্যার। আমাদের এই পাবে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানে বসতে পারেন।’

‘ধন্যবাদ’ বলে সামনের লম্বা টুল টেনে তার ওপর বসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখন কিছু খেতে চাই। কী পাওয়া যাবে?’

লোকটি উত্তর দেওয়ার আগে পাশে বসা এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খিদে কীরকম?’ মোটামুটি।

বৃদ্ধ বারম্যানকে যে খাবার আনতে বললেন তার নাম আমি কখনও শুনিনি। তাছাড়া ওর কথার টান অন্যরকম হওয়ায় ইংরেজি বুঝতে অসুবিধে হল। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি সেই টানটা ব্যবহার করলেন না। ‘আপনি কোন দেশের মানুষ?’

‘ইন্ডিয়া।’

‘মাই গড! ইউ আর ফ্রম দি কান্ট্রি অফ ইন্দিরা?’ বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের সবাই হাত তুলে আমাকে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’, বলতে লাগল। বুঝলাম সেই কবে খুন হওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখনও এঁদের কাছে প্রিয় মানুষ। ওই মুহূর্তে আমি ভুলে গেলাম জরুরি অবস্থার কথা, বরুণ সেনগুপ্ত— গৌরকিশোর ঘোষের কারাবাসের কথা। ইন্দিরাই যেন ইন্ডিয়া হয়ে গিয়েছে এঁদের কাছে।

খাবার এল। আমার কোনো জানা খাবার নয়, কিন্তু খুব সুস্বাদু। পাশে বসা বৃদ্ধ বললেন, ‘এর সঙ্গে এখানে তৈরি এক গ্লাস বিয়ার খাও। ভালো লাগবে।’

আপত্তি করলাম না। দিশি বিয়ারের স্বাদ মন্দ নয়।

‘আপনি এই শীত শীত সন্ধ্যায় বিয়ার খাচ্ছেন?’ প্রশ্নটা কানে আসতেই বাঁ দিকে তাকালাম। বেশ সুন্দরী, তারওপর যত্ন করে সাজগোজ করা এক মধ্যবয়সিনি কখন এসে আমার বাঁ দিকে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। মহিলার সঙ্গে আর কেউ আছেন বলে মনে হল না।

বললাম, ‘উনি বললেন, খেতেও খারাপ নয়।’

‘আপনি বরং এই পাবে তৈরি স্কচ ট্রাই করতে পারেন। বিয়ার তো বৃদ্ধরা পান করে। নিজেকে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মনে করেন না।’ মহিলা হাসলেন।

এতদিন আমেরিকায় ঘুরে জেনে গেছি এখানে হুইস্কিকে স্কচ বলা হয়। তার সঙ্গে স্কটল্যান্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। বিয়ার শেষ করে আমি এক পেগ হুইস্কি চাইলাম। বারম্যান জিজ্ঞাসা করল, ‘লার্জ অর স্মল?’

ডানপাশে বসা বৃদ্ধ হো হো করে হেসে বলল, ‘মাইক’ ইনি আমার মতো বৃদ্ধ নন। ওঁকে লার্জ দাও। স্কচ অন রক।’

সঙ্গে সঙ্গে বরফের টুকরোর মধ্যে সোনালি তরল পদার্থ গ্লাসে করে চলে এল সামনে। মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কিছু নেবেন না?’

মহিলা হাসলেন। আঙুল নেড়ে বললেন, ‘আই অ্যাম ফুল। আপনি ট্যুরিস্ট?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় উঠেছেন?’

‘মোটেলে। মোটেল ভাস্কো।’

‘বাঃ। আমি ওর পাশেই থাকি।’

পান করতে করতে দেখছিলাম পাশে বসে যাঁরা আড্ডা দিচ্ছেন তাঁদের কারও সঙ্গে মহিলা কথা বলছেন না। পর পর দু—গ্লাস হুইস্কি পান করতে করতে আমি মহিলার অনেক খবর জেনে ফেললাম। দু’বছর আগের সামারে ভয়ানক রোড অ্যাক্সিডেন্টে ওঁর স্বামী এবং ছেলে মারা গিয়েছে। পেছনের সিটে বসেছিলেন বলে সাতদিন হাসপাতালে থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ইনস্যুরেন্স থেকে যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তার সুদে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’

মহিলা বললেন, ‘প্রথমত, স্বামীর স্মৃতি ভুলিয়ে দেবে এমন কেউ আসেনি। দ্বিতীয়ত, কাউকে দেখে মনে ভালোবাসা তৈরি হয়নি। কী করব বলুন!’

এরকম অকপট কথা শুনে ভালো লাগল। টেবিলে টেবিলে মানুষ গল্প করছে, পান করছে। কিন্তু চিৎকার নেই, শব্দ বলতে ওই ব্যাঞ্জোর সুর। পাশে বসা বৃদ্ধ বললেন, ‘ওহে, তুমি তো এখানে নতুন। যত রাত বাড়বে তত ঠান্ডাও। আমি এখন বাড়ি ফিরব, তোমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে যেতে পারি।’

বৃদ্ধকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। বললাম না, আমার পাশের সুন্দরী যখন বাড়িতে ফিরবেন তখন তাঁর সঙ্গেই যাব। তিনি তো আমার মোটেল ভাস্কোর পাশেই থাকেন। বৃদ্ধ উঠলেন। দাম মিটিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যে কোনো নতুন জায়গায় নবাগতদের সতর্ক থাকা উচিত। তারপর এমন ঠান্ডার রাত। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভারী ভালো লাগল। আমি জানি, আর কখনও আমাদের দেখা হবে না। কিন্তু ঈশ্বর তোমাকে ভালো রাখুন, শুভরাত্রি।’

ঘড়িতে যখন রাত দশটা তখন মহিলা বললেন, ‘আমি একটু টয়লেটে যাচ্ছি।’ তাঁকে চলে যেতে দেখে বারম্যানকে জিজ্ঞাসা করতে জানলাম যে বৃদ্ধ চলে গিয়েছেন তিনি আমার খাবার এবং বিয়ারের দাম মিটিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হুইস্কির দাম দেননি। বারম্যান হেসে বলল, ‘উনি স্কচ পছন্দ করেন না!’

আমি হুইস্কির দাম দিতেই বারম্যান বলল, ‘গুড নাইট। আপনার মোটেলে ফিরে যেতে অসুবিধে হবে না তো? ওখানে মিস্টার মরিশন বসে আছেন, ঠিক এগারোটার সময় বাড়ি ফেরেন, আপনি ওঁর সঙ্গে ফিরতে পারেন।’

বললাম, ‘অনেক ধন্যবাদ। মোটেলে ফিরতে আমার অসুবিধে হবে না।’ একটু অপেক্ষা করে ফ্যামিলি পাবের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই মনে হল ভয়ংকর ঠান্ডা আমাকে কাঁপিয়ে দিল। চারধারে বরফ আর সেই সঙ্গে কনকনে বাতাসের চাবুক। ধাতস্থ হতে সময় লাগল। মহিলা এতক্ষণ টয়লেটে কী করছেন কে জানে? কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাও যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলাম। সাদা বরফের ওপর ফিনফিনে চাঁদের আলো পড়ায় চারপাশ রূপকথার মতো মনে হচ্ছে। তবে ঠান্ডা যদি একটু কম হত—!

হঠাৎ পেছন থেকে মহিলার গলা ভেসে এল, ‘খুব দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গেল।’ আমি দাঁড়ালাম। মহিলাদের ঠান্ডাবোধ কম বলে শুনেছি। এঁর বোধহয় বেশ কম। পাবের ভেতর স্বাভাবিক উত্তাপে যে পোশাকে ছিলেন তাই পরে বেরিয়ে এসেছেন। পাশে হাঁটতে শুরু করে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন লাগছে?’

‘খুব সুন্দর শুধু ঠান্ডাটা যদি না থাকত।’ বললাম।

‘এই তো জীবন। শুধুই ভালো, শুধুই আনন্দ কখনওই পাওয়া যায় না। ওদের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ, দুঃখ এসে পড়বেই। অবশ্য জীবনটা যদি আনন্দে ভরা হত তাহলে হয়তো ভালো লাগত না। একঘেয়ে মনে হত।’

‘বাঃ, সুন্দর কথা বলেন আপনি।’

‘আপনার ব্যবহারও সুন্দর। আচ্ছা, আমরা কেউ কারও নাম জানি না তাই না?’

নিজের নাম বললাম। শুনলাম তাঁর নাম অ্যানিটা।

অ্যানিটা বললেন, ‘এই যে আপনি যদি এই জায়গায় চিরটাকাল থেকে যেতেন তাহলে আমি একজন ভালো সঙ্গী পেয়ে যেতাম।’ সত্যি কথাই বললাম, ‘থাকতে পারলে ভালো হত।’

আমাকে মোটেলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অ্যানিটা ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেলেন। মদ্যপানের কারণেই ঘুম এল তাড়াতাড়ি।

সকালে মোটেল থেকে চেক আউট করার সময় মনে হল অ্যানিটার সঙ্গে যদি আর একবার দেখা করে যেতাম তাহলে ভালো লাগত। তাছাড়া ওকে আমরা টেলিফোন বা ই—মেল নাম্বারটা দিলে যোগাযোগ হতে পারত। রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি এখানে কতদিন আছেন?’

‘আট বছর।’ লোকটা গম্ভীর গলায় বলল।

‘আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?’

‘বলুন!’

‘আমি আমার টেলিফোন আর ই—মেল একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি। অনুগ্রহ করে যদি আপনাদের এক প্রতিবেশিনী মহিলার কাছে পৌঁছে দেন! ওঁর সঙ্গে গত রাতে এখানকার ফ্যামিলি পাবে আলাপ হয়েছিল।’

লোকটার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘ঠিকানা কী?’

‘জিজ্ঞাসা করা হয়নি। বললেন এই মোটেলের কাছেই থাকেন। ভদ্রমহিলার নাম অ্যানিটা। পদবি জানি না।’

চোখ বন্ধ করে বোধহয় মনে করার চেষ্টা করছিল লোকটা। ওকে সাহায্য করার জন্য বললাম, ‘দু’বছর আগে ওঁর স্বামী আর ছেলে মোটর দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। উনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন।’

এবার লোকটি চোখ খুলল, ‘তাই বলুন। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল ওই ফ্যামিলি পাবের সামনে। একটা লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ওঁরা মারা গিয়েছিলেন।’

‘কিন্তু ভদ্রমহিলা—!’

আমাকে থামিয়ে রিসেপশনিস্ট বলল!’ ‘হ্যাঁ, তিনিও। তাঁর নাম অ্যানিটা। মাঝে মাঝে এই মোটেলে ঢুকে কফি খেতেন। অবশ্য অনুমতি নিয়েই খেতেন। ওদের বাড়িটা ভদ্রলোকের ভাই বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু আপনি অ্যানিটাকে মিট করলেন কী করে?’

আমি আর দাঁড়ালাম না। বরফের ওপর দিয়ে স্যুটকেসটাকে প্রাণপণ টানতে লাগলাম গ্রে—হাউন্ড বাস স্টেশনে পৌঁছবার জন্য। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল পেছন থেকে গলা ভেসে আসবে, ‘খুব দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গেল!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *