ফ্যান – দেবাশিস সেন

ফ্যান – দেবাশিস সেন

ফাঁকা ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে বাইরে যাবার দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন পীযূষকান্তি। ফ্ল্যাট থেকে সবার শেষে বেরিয়েছে ওঁর এক ভাইপো। দরজাটা বাইরে থেকে ওই টেনে দিয়েছে। খচ করে দরজার ল্যাচটা লক হবার শব্দও পেয়েছেন পীযূষকান্তি। দরজার বাইরেই কার একটা গলা, ”দরজায় তালা দেবে না রবিদা?”

ভাইপো রবির নিশ্চিন্ত স্বর শুনতে পেলেন পীযূষকান্তি, ”দরকার নেই। ফ্ল্যাট বাড়ির এইতো মজা। দরজা টানো আর বেরিয়ে যাও। সিকিউরিটি নিয়ে খুব একটা ভাবতে হবে না। তা ছাড়া শ্মশানে খুব লাইন না-থাকলে আমরা তো ঘন্টা চার-পাঁচের মধ্যে ফিরেই আসব।”

ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে রবির কথায় সায় দিয়ে পীযূষকান্তি স্বগতোক্তি করলেন, ”আরে সেই ভরসাতেই তো বাড়িতে থেকে গেলাম। তোরা ফিরে আসার আগেই নিশ্চয় ইন্ডিয়া ম্যাচ শেষ করে দিতে পারবে। সিডিউলড টাইমতো সাড়ে তিন ঘন্টা। তোরা সুষ্ঠুভাবে আমার সৎকারটা সেরে আয়, আমিও নিশ্চিন্তে ইন্ডিয়াকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখি।” দরজা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পীযূষকান্তি কয়েক পা এগিয়ে টেবিলে পড়ে থাকা রিমোটটার দিকে হাত বাড়ালেন।

রিমোটটা হাতে তুলে নিতে গিয়েও থমকে গেলেন পীযূষকান্তি। তাঁর এই সূক্ষ্ণ শরীর কি রিমোটটা ধরতে পারবে? এতোক্ষণ তো ঘর ভর্তি লোক ছিল। কেউ তাঁর এই শরীরটাকে দেখতে পায়নি। তিনিও এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়িয়েছেন। এর শরীরের মাঝখান দিয়ে, তার শরীরের ভেতর দিয়ে এমনকী নিরেট দেয়ালের মাঝখান দিয়েও দিব্যি গলে গেছেন, কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পীযূষকান্তি নিজেকে দেখতে পাননি। নিজের দিকে তাকিয়ে শরীরটাকে কেমন যেন ছায়াছায়া মনে হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল পীযূষকান্তির। টিভিটা যদি চালুই করতে না-পারেন তবে আর ফাঁকা ঘরে থেকে লাভ কি? কিছুক্ষণ আগে তাঁর মৃত শরীরটা জড়িয়ে ধরে তাঁর বড়ো মেয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছিল, ”বাবাগো, তুমি আর ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালটা দেখে যেতে পারলে না। এতো খেলা ভালোবাসতে তুমি, আর সেই তুমি কিনা ফাইনাল শুরু হবার আগেই চলে গেলে…।”

শোকের বাড়ি হলেও বিশ্বকাপ ফাইনাল বলে কথা। ভেতরের ঘরে বিছানায় শোওয়ানো ছিল পীযূষকান্তির পার্থিব দেহটা। ড্রইংরুমে টিভি চলছিল। বাড়ির লোকজনেরা পীযূষকান্তির আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা আসা-যাওয়া করছে। তারই ফাঁকফোকরে সকলেই টিভির সামনে দু-চার মিনিট দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পীযূষকান্তির সূক্ষ্ম শরীর কিন্তু সেই প্রথম ওভার থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে টিভির সামনে। বিজ্ঞাপন বিরতিতে শুধু একবার করে দেখে আসছেন নিজের ছেড়ে আসা শরীরটাকে। সঙ্গে আত্মীয়-পরিজনদেরকেও। হরভজন সিং-এর ওভারের প্রথম বলটার সময়েই বড়োমেয়ের বিলাপটা কানে এসেছিল। ওভার শেষ হতে পাশের ঘরে গিয়ে বড়োমেয়ের মাথায় আলতো করে হাতটা রেখে বলেছিলেন, ”নারে মা, খেলা আমি ঠিকই দেখছি। শেষ বল অবধি দেখব। ভারতকে আজ চ্যাম্পিয়ন করতেই হবে। আঠাশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি। আজ একটা বলও মিস করব না।”

বড়োমেয়ে অনেকদিন পর এবাড়িতে এসেছে। আর কিছুক্ষণ মেয়ের পাশে বসার ইচ্ছে ছিল পীষূষকান্তির। কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দর্শকদের চিৎকার কানে এসে পৌঁছোতে দ্রুত পায়ে বেড়রুমের দেয়ালের মাঝখানে দিয়ে এঘরে চলে এলেন পীযূষকান্তি। পরের ওভার শুরু করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে যুবরাজ সিং।

ছটফট করে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালেন পীযূষকান্তি। ভারতের ইনিংস যেকোনো মুহূর্তেই শুরু হবে। আর নষ্ট করার মতো সময় নেই। আশেপাশের কোনো ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়তে হবে। টিভিতো চলছে সব বাড়িতেই। ভুরু কুঁচকে এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন পীযূষকান্তি। কার ফ্ল্যাটে যাবেন তিনি। ইন্ডিয়ার জেতা-হারার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। যার-তার ফ্ল্যাটে তো যাওয়া যায় না। একটু ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল পীযূষকান্তির। দোতালার দত্তদের ফ্ল্যাটে সেদিন কীসের যেন পার্টি ছিল। ওখানে বসেই লর্ডস-এর সেই ম্যাচটা দেখেছিলেন না? নর্থ-ওয়েস্ট ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হবার পর সৌরভের সেই জার্সি খুলে মাথার ওপর ওড়ানো! সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন পীযূষকান্তি। বন্ধ দরজার মাঝখান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবার জন্য দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি।

বন্ধ দরজায় সজোরে আঘাত করে পীযূষকান্তির শরীরটা ছিটকে পড়ল ধরের ভেতরের মেঝেতেই। অবাক হয়ে দরজাটার দিকে তাকালেন তিনি। এতো বড়ো আঘাতেও ব্যথা লাগেনি ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম হল কেন। এতক্ষণ তো দিব্যি সব কিছুর মধ্যে দিয়েই চলে যেতে পারছিলেন। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন পীযূষকান্তি। ওর শরীরটা আর ছায়াছায়া লাগছে না-তো। দুটো হাত তুলে ধরলেন মুখের সামনে। দৃষ্টি আটকে গেল হাতের এপাশেই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালে টাঙানো ছোটো আয়নাটার দিকে তাকালেন। গোল আয়নায় পরিষ্কার দেখতে পেলেন নিজের মুখ। আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন পীযূষকান্তি। থাক। এবার টেলিভিশন সেটটা অন করতে কোনো অসুবিধে হবে না। নিজের ঘরে, তার সেই পয়মন্ত চেয়ারটাতে বসেই ইন্ডিয়ার ইনিংসটা দেখতে পাবেন তিনি। পরক্ষণেই একটা চিন্তা এল মাথায়। তাহলে কি আর সূক্ষ্ম শরীরে ফিরে যেতে পারবেন না। ভাবনাটা মাথায় আসতে-না-আসতেই শরীরটা যেন হালকা হয়ে গেল। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শরীরটা আবার সেই আগের মতো ছায়াছায়া হয়ে গেছে। আয়নাতেও দেখাও যাচ্ছে না তাঁর মুখটা। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পীযূষকান্তির বেশি দেরি হল না। নিজের ইচ্ছেতেই তিনি এখন শরীরী বা অশরীরী হতে পারছেন। বার কয়েক হাতে-কলমে পরীক্ষা করে খুশিমনে সেন্টার টেবিলের দিকে এগোলেন পীযূষকান্তি। রিমোটটা হাতে তুলে শোফার দিকে এগোতে গিয়েই থমকে গেলেন তিনি। দেয়ালে লাগানো ছ-ফুট লম্বা আয়নাটায় নিজের পুরো শরীরটা দেখতে পেয়েই লজ্জায় জিব কাটলেন তিনি। ছি ছি, এ কী অসভ্যতা। রিমোটটা সোফায় ছুড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে খোলা দরজার মাঝখান দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন পীযূষকান্তি। আলমারি খুলে ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি বার করে শরীরে গলিয়ে ফিরে এলেন ড্রইংরুমে। আর সময় নষ্ট না-করে ঢিভি সেটটা চালু করে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সামনের টুলে পা দুটো তুলে দিলেন। টিভিতে খেলা দেখার সময়। এটাই ওর চিরকালের বসার ভঙ্গি।

শচীন, সেহওয়াগ ক্রিজে পৌঁছে গেছে। মালিঙ্গার হাতে বল। চোখ বন্ধ করে দু-হাত জড়ো করে শচীনের শততম সেঞ্চুরির জন্য সবে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন পীষূষকান্তি, ঠিক তখনই ডোরবেলাটা বেজে উঠল।

চমকে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন পীষূষকান্তি। এখন আবার কে এল? দ্রুতপায়ে দরজায় সামনে পৌঁছে ডোর আইতে চোখ রাখলেন পীষূষকান্তি। সর্বনাশ। বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর বন্ধু মনতোষ! আশেপাশে আর কেউ নেই. মনতোষ কি তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে ছুটে এসেছে? কিন্তু ও জানল কী করে? দুপুর থেকে ওঁর ছেলে-মেয়েরা অনেক ফোন করেছে ঠিকই, কিন্তু মনতোষকে তো কেউ ফোন করেনি। ঠিক তখনই শুনতে পেলেন দরজার ওপাশে অধৈর্য গলায় মনতোষ বলছে, ”এতো দেরি করে কেন দরজা খুলতে। খেলাতো শুরু হয়ে যাবে। প্রথম বল থেকে ম্যাচ না-দেখলে কী ভালো লাগে!”

যাক, নিশ্চিন্ত হলেন পীষূষকান্তি। ব্যাটা খেলা দেখার জন্য সেই গড়িয়া থেকে দমদম ছুটে এসেছে। ওঁর মৃত্যু সংবাদ এখনো পায়নি।

দরজাটা খুলে ধরে খেঁকিয়ে উঠলেন পীযূষকান্তি, ”তোমার কি কোনো দিনই কাণ্ডজ্ঞান হবে না? শচীনের একটা সেঞ্চুরির জন্য ওপরওয়ালার কাছে আর্জি জানাচ্ছি, আর ঠিক সেই সময়েই তোমাকে বেলটা বাজাতে হবে?”

পীযূষকান্তির কথাটাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না-দিয়ে টিভির সামনের সোফাটায় দু-পা তুলে আসন পিঁড়ি হয়ে বসে মনতোষ বললেন, ”বাবা বীরু মালিঙ্গার প্রথম বলেই একটা চার হাঁকাও দেখি।”

গজগজ করতে করতে নিজের আসনে বসে পীযূষকান্তি বললেন, ”দিয়েছ আমার প্রার্থনাটার বারোটা বাজিয়ে। এখন শচীন যদি তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যায় তবে তোমাকে ঘাড় ধরে বার করে দেব।”

”নাঃ’ প্রথম বলে রান পেল না বীরু। ভাবলাম বাউন্ডারি মারবে। যাকগে। হ্যা, কী বলেছিলে? শচীনের সেঞ্চুরি! তার জন্য প্রার্থনা! ভগবানকে ডাকো যেন সেঞ্চুরি না-পায় শচীন। ও সেঞ্চুরি পেলে তো ম্যাচ জেতে না ভারত। ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকার খেলা দুটো ভুলে গেলে?”

একটু ঢোক গিলে প্রসঙ্গ পালটালেন পীযূষকান্তি, ”তা হঠাৎ এতোদিন পরে আমার বাড়িতে এলে যে? বেশ কয়েকবছর তো এদিকে আসছই না। অবশ্য আমারও যাওয়া হয় না। বয়স হয়েছে তো?”

একটু ইতস্তত করে মনতোষ বললেন, ”আসলে আজকে বাড়িতে… মানে… ইয়ে—আরে আরে দেখেছো কাণ্ড… পায়ে লাগল যে… আরে আউট দিয়ে দিল। কোনো মানে হয়। সেকেন্ড বলেই উইকেট!”

পীষূষকান্তি বিমর্ষস্বরে বললেন, ”রিভিউ চেয়েছে। দেখা যাক। তবে মনে তো হচ্ছে কারেন্ট ডিসিশনই দিয়েছে আলিমদার।”

পীযূষকান্তি আর মনতোষ। সত্তর বছরের খেলা-পাগল মানুষ দুটির বন্ধুত্বের বয়স বছর পঞ্চাশ। ইডেন গার্ডেনসে পাশাপাশি দুটি আসনে বসার সূত্রে দুজনের আলাপ। ইডেনের কোনো টেস্ট ম্যাচই কেউ বাদ দিতেন না। গত বছর দশেক ধরে অবশ্য মাঠে যাওয়া কমে এসেছে দুজনেরই। কিন্তু যেকোনো ধরনের ক্রিকেট ম্যাচ থাকলেই দুজনের কেউই টিভির সামনে থেকে ওঠেন না। একসময় দুজনে পাশাপাশি বসে টিভিতে খেলা দেখতেন। গত কয়েকবছর বয়সের ভারে কাবু হয়ে যে-যার নিজের বাড়িতে বসেই খেলা দেখেন। দুজনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ঝগড়া চলত দুজনের। ভারতের বাইরে মনতোষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভক্ত, পীযূষকান্তি অস্ট্রেলিয়ার। মনতোষের মতে সোবার্সই পৃথিবীর চিরকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার, পীযূষকান্তির মতে ডন-এর আশেপাশে কেউ নেই। মনতোষ বিশ্বনাথের সমর্থক। পীযূষকান্তি গাভাসকারের। পাশাপাশি বসে খেলা দেখার সময় গত পঞ্চাশ বছর ধরেই ওরা দুজনে সমানে তর্ক করে চলেছেন। কিন্তু সৌরভ ভারতের হয়ে খেলা শুরু করার পর দুজনের তর্কের বিষয় শচীন-সৌরভ। পীযূষকান্তির মতে শচীন শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ব্যাটসম্যান। মনতোষ বাজি ধরেন সৌরভের ওপর। সৌরভ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছে, তারও আগে দুজনের যোগাযোগ কমে এসেছে, পাশাপাশি বসে খেলা দেখা বন্ধ হয়ে গেছে, তাই শচীন-সৌরভকে নিয়ে দুজনের তর্কের সুযোগ নেই, কিন্তু টপ ফর্মের ওই দুই তারকা যখন একসঙ্গে বড়ো ইনিংস খেলত তখন পীযূষকান্তি আর মনতোষের ভাবভঙ্গি থাকত একই রকম। কোলে বালিশ নিয়ে সোফার ওপরে আসন করে বসে মনতোষ, পাশে টুলে দু-পা তুলে পীযূষকান্তি। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন দুজনে টিভির দিকে। শরীর না-নড়লেও মুখের কোনো বিরাম থাকত না।

…”ফ্যান্টাস্টিক। এরকম পুল শচীন ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। ম্যাকগ্রাথের বলে ওভাবে ছয় মারা রাজা-প্রজা কারোর কম্মো নয়।”

”ধুর ফিল্ডারটাকে স্টিভ ওখান থেকে সরিয়ে দিল কেন? ও থাকলে তো সোজা হাতে ক্যাচ। পুলে ছয় পাওয়া বেরিয়ে যেত।”

”আরে ছিঃ ছিঃ এটা রানিং বিটুইন দ্যা উইকেটস? ওসব মহারাজকীয় চালচলন রাজপ্রাসাদে চলে, বাইশ গজে নয়।”

”লাভলি। শ্যেনকে স্টেপ আউট করে কী ছয়টাই না মারল।

এরকম অ্যাফোর্টলেস শর্ট হোল ওয়ার্ল্ডে কেউ মারতে পারে না। এটাকেই বলে ‘বাপী বাড়ি যা’ শট।”

”এবার বাড়িই যাবে। শ্যেনকে ছয়! শ্যেন এবার গুগলি দেবে।”

”আহাহাহা, চোখ জুড়িয়ে গেল, কী দারুণ কাভার ড্রাইভ। রাহুল ঠিকই বলেছিল। অফ সাইড শর্টে ভগবান ফার্স্ট পজিশানে থাকলে সৌরভ অবশ্যই সেকেন্ড।”

”আরে ম্যাকগ্রাথের লাইন লেংথ তো সব নষ্ট করে দিচ্ছে শচীন। ভাবা যায়। থ্রি কন্সিকিউটিভ ফোর্স।”

এভাবেই খেলার সঙ্গে সঙ্গে ধারা বিবরণী চালাতেন দুই বন্ধু।

মালিঙ্গার প্রথম ওভারটা শেষ হতে মনতোষ বললেন, ”ওহে পীযূষ, আমার সেই লাকি কুশনটা কোথায়? ওটাকে কোলে না-রাখলে হবে না।”

ডান হাত দিয়ে কুশনটা এগিয়ে পীযূষকান্তি বললেন, ”শচীন এই ওভারে প্রথম ফেস করবে, দয়া করে একটু ওকে সাপোর্ট করো। তোমার মহারাজতো আর এখন দলে নেই।”

গর্জে উঠলেন মনতোষ, ”ওকে তো অন্যায়ভাবে অবসর নিতে বাধ্য করা হল। অবশ্যই ওর এখনো এই টিমে থাকা উচিত ছিল।”

”দাঁড়াও, কথা বোলো না। শচীন ফেস করবে। কুলশেখর বল নিয়ে আসছে।”

ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ঠেলে শচীন এক রান নিল। একটু নিশ্চিন্ত হলেন পীযূষকান্তি। প্রথম রানটা না-পাওয়া অবধি বড্ড টেনশন থাকে। আড়চোখে একবার মনতোষের দিকে তাকালেন পীযূষকান্তি। একদৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন মনতোষ। পীযূষকান্তি ভাবলেন বেচারা জানেও না যে ও একটা ভূতের পাশে বসে খেলা দেখছে। ভূত! শব্দটা মনে হতেই হাসি পেল পীযূষকান্তির। ভূত আর মানুষ কী কখনো পাশাপাশি বসে খেলা দেখেছে। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল পীযূষকান্তির। খেলাতো সবে শুরু হল। সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টাতো সময় লাগবেই। এই সময়ের ভিতর কেউ যদি ফ্ল্যাটের বেল বাজায় তাহলে কী হবে? … যাকগে। সেরকম পরিস্থিতি হলে তখন ভাবা যাবে। এখনতো খেলাতে মন দেওয়া যাক।

খেলা গড়িয়ে চলেছে। চমৎকার খেলছে শচীন, গম্ভীর দুজনেই। কুলশেখরার দ্বিতীয় ওভারে নিখুঁত দুটো বাউন্ডারিও মেরেছে শচীন। মনতোষও মাথা নেড়ে তারিফ করেছেন।

সপ্তম ওভারেই ছন্দপতন, আবার সেই মালিঙ্গা। ওর চুতর্থ ওভারের প্রথম বলেই অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মারল শচীন। পীযূষকান্তির মুখ থেকে ‘এইরে’ শব্দটা শুরু হয়ে শেষ হবার আগেই সাঙ্গাকারা লুফে নিল ক্যাচটা।

দু-হাতে মুখ ঢাকলেন পীযূষকান্তি। পাশ থেকে গলা খাঁকারি দিলেন মনতোষ। মুখ থেকে হাত সরিয়ে পীযূষকান্তি বললেন, ”তখনই জানি। আমার প্রার্থনার মাঝখানে যখনই তুমি বেল বাজলে, তখনই বুঝেছি আজকে অঘটন ঘটবেই। হল না। আঠাশ বছর অপেক্ষা করে আছি। এবারো হল না। আবার চার বছর অপেক্ষা। কিন্তু তখন কি আর শচীন খেলবে?”

মনতোষ হেসে বললেন, ”আরে পীযূষ, এটা আমাদের শাপে বর হল। শচীন সেঞ্চুরি পেলে ইন্ডিয়া জিতত না। এবার আমি সিওর ইন্ডিয়া আজকে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেই।

দুঃখ ভুলে খেঁকিয়ে উঠলেন পীযূষকান্তি, ”শচীন ওয়ানডেতে আটচল্লিশটা সেঞ্চুরি করেছে। ওই ম্যাচগুলোর একটাতেও কী ইন্ডিয়া জেতেনি?”

”আহা আমি ফাইনালের কথা বলছি।”

”কেন নাইনটি এইটে সারজায়?”

” কুড়ি বছরে দু-বার। সারজায় আর গত বছর অস্ট্রেলিয়ায়।”

উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলেন পীযূষকান্তি। ওভারের দ্বিতীয় বলে মালিঙ্গার বাউন্সার। ডাক করল তরুণ কোহলি। পীযূষকান্তি মৃদুস্বরে বললেন, ”মালিঙ্গাই শেষ করে দেবে।”

খেলা এগোচ্ছে। গম্ভীর আর কোহলি মসৃণভাবে ইনিংস গড়ছে। পুরোনো দিনের মতো পরিস্থিতি নয়। দুজনেরই প্রায় নিশ্চুপভাবেই খেলা দেখছেন। একসময় কোহলিও আউট হয়ে গেল। ওদের দুজনকে অবাক করে মাঠে নামল ধোনি। প্রথম দিকে ধোনি একটু বেশি মাত্রায় সতর্ক। পীযূষকান্তি একটু অসহিষ্ণু, ”আঃ আস্কিংরেট বেড়ে যাচ্ছে, ধোনি করছে কী?”

আস্তে আস্তে ধোনি খোলস ছেড়ে বেরুল। গম্ভীর সমান সাবলীল। টিভির সামনে বসে থাকা দুই দর্শকের মাথায় চাপটা একটু কম। একটু আড়মোড়া ভেঙে পীযূষকান্তি বললেন, ”ওহে মনতোষ, তোমাকে চা খাওয়াতে পারলাম না। বউমা আজ আর ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রেখে যায়নি।”

”চা’। একটু নড়েচড়ে বসলেন মনতোষ, ”নাঃ চা আর খেতে ইচ্ছে করছে না।”

অবাক হয়ে মনতোষের দিকে তাকালেন, পীযূষকান্তি, ”সে কি! তোমার আবার চায়ে অনীহা হল কবে? শরীরটরীর ঠিক আছে তো?”

”নাহে। ক-দিন ধরে তেমন ভালো ঠেকছে না।”

”তবে আজ আর এলে কেন? বাড়িতে বসে খেলা দেখলেই পারতে।”

”তাই তো ভেবেছিলাম। কিন্তু বাড়ির টিভিটা বন্ধ করে রেখেছে। বললাম চালিয়ে দে, খেলটা দেখি। তা কেউ কথাটা কানেই নিল না। তাই তোমার এখানেই চলে এলাম। আর এটাতো সত্যি, এই সোফাটায় বসেই তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালটা দেখেছিলাম। সেদিন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, আজও হব।”

পীযূষকান্তি কিছু বলার আগেই টেলিফোনটা বেজে উঠল। পীযূষকান্তি বসেই ছিলেন, ইচ্ছে ছিল ওটা বেজে বেজে থেমে থাক। কিন্তু মনতোষ বলে উঠলেন, ”কী হল ফোনটা ধরো।”

বেজার মুখে উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নীচু গলায় বললেন পীযূষকান্তি, ”হ্যা।”

”কাকু বলছেন?” উলটো প্রান্তে মনতোষের ছোটোছেলে রঞ্জিতের ভারি গলা, ”কাকু, বাবা চলে গেছেন।”

বিরক্তিতে কপালের ভাঁজটা আরেকটু বাড়ল পীযূষকান্তির। বেশি কথা না-বাড়িয়ে ছোট্ট উত্তর দিলেন, ”জানি।”

”সেকি!” বিস্ময় ঝরে পড়ল রঞ্জিতের গলায়, ”এতো তাড়াতাড়ি গড়িয়া থেকে দমদমে কে খবরটা পৌঁছে দিল। এখনোতো কাউকে জানানো হয়নি।”

”কেউ জানায়নি। চোখের সামনেইতো দেখতে পাচ্ছি। আমার পাশেই আছে ও।”

”হ্যাঁ কাকু।” এবার রঞ্জিতের গলা আরেকটু ভারি, ”জানি, আপনাদের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ ছিল। তবে আপনি বেশি ভাববেন না। বাবা খুব শান্তিতেই গেছেন। ক-দিন ধরেই শরীরটা একটু খারাপ ছিল। তবে তেমন কিছু নয়। আজ সকালেও বলেছিলেন খেলাটা দেখতেই হবে। চেঁচিয়েই আজ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন করতে হবে ইন্ডিয়াকে। কিন্তু খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণ আগেই বুকে ব্যথা শুরু হল। ডাক্তার ডাকার আগেই সব শেষ। ঠিক আছে। এখন রাখছি কাকু। অনেক টেলিফোন করতে হবে।”

রিসিভারটা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে মনতোষের দিকে তাকালেন পীযূষকান্তি। মুরলিধরনের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলটাকে একস্ট্রা কভার দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে অর্ধশতরান পূর্ণ করল ধোনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাজার মুখে বসে রয়েছেন মনতোষ। পীযূষকান্তি ওঁর দিকে তাকাতেই বললেন, ”ছোটকুটা ফোন করেছিল, তাই না? ব্যাটাদের আর তর সয়না।”

”হ্যাঁ, কিন্তু রঞ্জিত এসব কী বলছে? তুমি নাকি ইয়ে… মানে…”

ঘাড় নাড়লেন মনতোষ, ”ঠিকই বলেছে ছোটকু। আমি আজ দুপুর দুটোয় মারা গেছি।”

”অ্যাঁ।” বিস্মিত পীযূষকান্তির হাত থেকে রিসিভারটা পড়ে গিয়ে কয়েক টুকরো হয়ে গেল।

”অ্যাই পীযূষ, ভয় পাচ্ছ নাকি? আরে তুমি ভয় পেলে তো আমাকে এখান থেকেও চলে যেতে হবে। আর এখন এই সিট ছাড়া মানেই ইন্ডিয়া নিঘ্ঘাত জেতা ম্যাচটা হেরে যাবে।” একটু থেমে মনতোষ আবার বললেন, ”আর এগারো দিন পরে তো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে জানি না কোথায় যেতে হবে। এটাই তো আমার দেখা শেষ ওয়ান ডে। আর মাত্র বারো ওভার খেলা বাকি রয়েছে। দেশের স্বার্থে একটু সাহসী হও। প্লিজ ভয় পেয়ো না।”

মনতোষকে অবাক করে হো হো করে হেসে উঠলেন পীযূষকান্তি তারপর একলাফে সোফার সামনে এসে মনতোষকে জড়িয়ে ধরলেন। মনতোষ ছটফট করে উঠতে হাসি থামিয়ে পীযূষকান্তি বললেন, ”সারাজীবন আমরা সোবার্স-ডন থেকে শুরু করে শচীন-সৌরভ নিয়ে শুধু তর্ক করে গেলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে এতো মিল! আরে ভাই আমিও তো তোমার মতোই দুটোর আগেই শেষ নিশ্বাসটা ফেলেছি।”

মনতোষ হতবাক। সোফায় বসে সামনের টুলে পা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত গলায় পীযূষকান্তি বললেন, ”আর কোনো কথা নয়। চল এবার একসঙ্গে গম্ভীর আর ধোনিকে সাপোর্ট করে যাই। ইন্ডিয়াকে আজ চ্যাম্পিয়ন করতেই হবে।

মালিঙ্গার সপ্তম ওভারের পঞ্চম বল। দুরন্ত গতির ইয়র্কারটাকে ধোনি স্কোয়ার লেগের পাশ দিয়ে ঠেলে একরান নিতে ছুটল।

পাশাপাশি বসে দুই বন্ধু একসঙ্গে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন। আর মাত্র সাতষট্টি রান দরকার ভারতের ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে। আত্মা সর্বজ্ঞ কিনা জানা নেই তবে পীযূষকান্তি আর মনতোষের কোনো সন্দেহ নেই ভারত আজ আঠাশ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *