ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ
নাসেরের দৃষ্টিদ্বয় হতে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বের হচ্ছে। পিস্তল হস্তে যমদূতের মত এসে দাঁড়িয়েছে সে। পৈশাচিক নিষ্ঠুর মুখোব।
নীহার বনহুরকে আড়াল করে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, তীব্র কঠিন কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–নাসের সাহেব, এতো বড় স্পর্ধা আপনার কি করে হলো?
মুখোভাব আরও কুৎসিত হয়ে উঠলো তার, দাঁতে দাঁত পিষে বললো–স্পর্ধা আমার, না ঐ ছোটলোকটার? সরে দাঁড়াও নীহার, এই মুহূর্তে ওকে আমি হত্যা করবো।
আমি ওকে হত্যা করতে দেবো না। দেখি আপনি কেমন করে ওকে হত্যা করেন।
ওঃ– এ তো দরদ! নীহার, একটা নাবিকের জন্য তুমি নিজকে বিপন্ন করতে চাও?
হাঁ, আমাকে হত্যা করে তারপর ওকে…রাগে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে নীহারের।
ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হাসে নাসের–ওর জন্য মরতেও রাজি আছো দেখছি। নীহার, মনে রেখো তোমাকে আমি হত্যা করবো না, কারণ তোমাকে হত্যা করলে আমার সব আশা-আকাক্ষা মাঠে মারা যাবে। তোমাকে আমার প্রয়োজন।
বনহুর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, সরল-সহজভাবে দৃষ্টি শুধু স্থির হয়ে আছে নাসেরের মুখে।
নীহার তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললো–তোমার আকাঙ্ক্ষা কোনোদিনই পূর্ণ হবে না শয়তান।
শয়তান আমি না তোমার ঐ নাবিক বন্ধু?
নাসেরের কথা শেষ হতেই বনহুরের এক শটে ওর হাতের পিস্তলখানা ছিটকে পড়লো গিয়ে কেবিনের দেয়ালে, ধাক্কা খেয়ে সে পড়লো এসে মেঝেতে।
বনহুর বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরলো নাসেরের জামার কলার।
ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠলো নাসেরের মুখ। মুহূর্তে এমন একটা পরাজয়ের কালিমা লেপন হবে তার মুখে, ভাবতেও পারেনি সে। প্রথমে হকচকিয়ে গেলো নাসের কিন্তু পরক্ষণেই নিজকে সামলিয়ে নিয়ে রুখে দাঁড়ালো।
নীহার তখন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
নাসের বনহুরের মাথা লক্ষ্য করে প্রচণ্ড এক ঘুষি চালালো।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর মাথাটা সরিয়ে নিলো, ঘুষিটা ব্যর্থ হলো তার। পরক্ষণেই বনহুরের দক্ষিণ হস্তটা গিয়ে পড়লো নাসেরের মুখে। একটা পাক খেয়ে ঘুরে পড়ে গেলো নাসের মেঝেতে।
এক চক্র দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নাসের, পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়লো বনহুরের উপর। বনহুর হুট করে ওর হাত ধরে মোচড় দিলো খুব জোরে।
নাসেরের মুখ কালো হয়ে উঠলো, দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি দিলো বনহুরের হাঁটুতে।
বনহুর তার আগেই ওর হাত ছেড়ে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে পড়ে গেলো নাসের।
বনহুর নাসেরের হাত থেকে ছিটকে-পড়া পিস্তলখানা আলগোছে তুলে নিলো হাতে। নাসের এবার কেঁচোর মত কুঁকড়ে গেলো যেন। কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের পিঠে নাকের মাথাটা একবার মুছে নিয়ে আড়চোখে তাকালো বনহুরের হস্তস্থিত তারই পিস্তলখানার দিকে।
নাসেরের দৃষ্টি এবার স্থির হলো বনহুরের চোখে, আজ যেন প্রথম দেখলো নাসের নাবিক আলমের নতুন রূপ।
বনহুর গম্ভীর দৃঢ়স্বরে বললো বেরিয়ে যাও এই মুহূর্তে।
বনহুরের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বরে নাসেরের হৃৎপিন্ড কেঁপে উঠলো থর থর করে। আর এক দন্ড দাঁড়াবার সাহস হলো না তার। বেরিয়ে গেলো অনুগত ভুত্যের মত পিছু হটে।
নাসের বেরিয়ে যেতেই ফিরে তাকালো বনহুর নীহারের দিকে।
রাজ্যের বিস্ময় যেন ঝরে পড়ছে ওর দু’চোখে। স্ফীত উজ্জ্বল দীপ্তময় নীহারের মুখমন্ডল। শুধু। আশ্চর্যই হয়নি সে ওর শক্তির পরিচয়ে, তার প্রতি অনুরাগ আরও গভীরতম হয়ে উঠেছে।
কয়েক পা এগিয়ে আসে নীহার।
বনহুর হস্তস্থিত রিভলভারখানা বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বসে পড়ে বিছানায়। আঙ্গুল দিয়ে নিজের এলোমেলো চুলগুলো সংযত করে নিয়ে বলে–মেমসাহেব, আপনি মাফ করবেন। আমাকে। একজন নাবিক ছাড়া আমি কিছু নই। এখানে আসাটা আপনার মোটেই উচিত নয়।
আলম, তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে?
না।
তবে অমন করে কথা বলছো কেন?
আপনি জানেন আমার ক্যাবিনে আসাটা আপনার জন্য সম্পূর্ণ অসঙ্গত। আমি অনুরোধ করছি, আপনি আমার ক্যাবিনে আর আসবেন না।
আলম!
হা মেম সাহেব।
নাসেরের আগমনে তুমি আমাকে..
আমাকে মাফ করবেন মেম সাহেব, আমি অক্ষম…
নীহার নতমুখে বেরিয়ে যায় মন্থর গতিতে আলমের ক্যাবিন থেকে।
বনহুর শয্যায় বসেছিলো, উঠে পায়চারি শুরু করলো। মনটা বড় এলোমেলো লাগছে, নীহারের সঙ্গে একটু পূর্বে তার যে সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিলো, অশোভনীয় লাগছে এখন। তবে অসঙ্গত এমন কিছু নয় যা তার এবং নীহারের জীবনকে কলুষিত করেছে। নীহারকে ‘তুমি’ সম্বোধনটা খুশি করেছিলো যথেষ্ট এবং ওকে খুশি করবার জন্যই বলেছিলো সে। কিন্তু এতোটা নিচে নেমে আসা হয়তো তার পক্ষে সমীচীন হয়নি। নীহার এবং তার দু’জনার জন্যই অমঙ্গলজনক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বনহুর যতই ভাবে ততই বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে…নীহার আজকাল সব সময় তাকে ঘিরে রাখতে চায়। তার শরীরে যেন আঁচড় না লাগে। জানে বনহুর, নীহারের আশঙ্কা অহেতুক নয়। নাসের যেভাবে তার পিছু নিয়েছে তাতে নিজকে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত মনে হয় না।
যত বেশি ভাবে বনহুর, নীহারের প্রতি একটা মায়াময় মনোভাব আচ্ছন্ন হয়ে আসে। দোষ কি ওর–আর তারই বা ত্রুটি কোথায়? নীহার তাকে ভালবেসে তার মঙ্গলের জন্যই সে এতোটা করে জানে বনহুর। তাই আজ সে নীহারকে অনেকটা ঘনিষ্ঠ আপনজন মনে করে।
এরপর আর এলো না নীহার নাবিক আলমের কক্ষে।
কিন্তু নীহার না এলেও সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতো, তার বিশিষ্ট এক ভৃত্যের দ্বারা সন্ধান নিতো সে সর্বক্ষণ আলমের।
দুটো দিন কেটে গেলো।
জাহাজ ইরুইয়া বন্দরে নোঙ্গর করলো তৃতীয় দিনে।
আবু সাঈদ স্বয়ং কন্যাসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করার উদ্দেশ্যে ইরুইয়া বন্দরে অবতরণ করবেন জানালেন।
এ দুদিনের মধ্যে নাসের নানাভাবে যুক্তি-পরামর্শ করেও নাবিক আলমকে কাবু করার কোনো উপায় অবলম্বন করতে সক্ষম হলো না। যত রাগ-ক্ষোভ আর বিষপূর্ণ মনোভাব অন্তরে চেপে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো দারুণভাবে।
জলিল, শম্ভু আর জম্বুও সাহস পেলো না আলমকে সহসা আক্রমণ করতে।
কদিন বেশ নিশ্চিন্তেই কাটলো বনহুরের।
ডিউটির সময় ইঞ্জিন-ক্যাবিনে কাটে তার, অবসর তার বেশিক্ষণ নয়–সামান্য কয়েক ঘন্টা মাত্র। আজকাল সেই সময় টুকুই যেন কাটতে চায় না। যতক্ষণ ইঞ্জিনের কাজে ব্যস্ত থাকে ততক্ষণ বেশ থাকে, তারপর ছুটি হলেই একটা ক্লান্তি আর অবসাদ তার সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে। ফেলে। নানা চিন্তা জট পাকায় এক সঙ্গে তার মনের গহনে।
*
ইরুইয়া বন্দরে জাহাজ নঙ্গোর করার পর জাহাজের যাত্রিগণ সবাই বন্দরে অবতরণ-আশায় চঞ্চল হয়ে উঠলো। কয়েকটি দিন একটানা জাহাজে কাটিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে যেন ওরা বেলুনের বদ্ধ হাওয়ার মত।
সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলো বন্দরে নামবার জন্য।
ক্যাপ্টেন জানালেন, ইরুইয়া বন্দরে মাত্র একটি দিন তারা অপেক্ষা করবেন। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সব সংগ্রহ করে নিতে হবে।
বনহুরের নিজের জন্য কয়েক বান্ডিল সিগারেট ছাড়া আর কিছু প্রয়োজন নেই। বললো বনহুর এক সময় কেশবকে–কেশব, তোমার যদি কিছু দরকার মনে করো নিতে পারো ইরুইয়া থেকে।
কেশব মাথা চুলকালো–আপনি নামবেন না বাবু?
হ, ইরুইয়া বন্দরটা দেখবার সখ আমার আছে, নামবো।
তাহলে চলুন না বাবু, মেম সাহেব আপনাকে যাওয়ার জন্য আমাকে বললেন।
ভ্রূ কুঁচকে তাকালো বনহুর–মেম সাহেব আমাকে যাওয়ার জন্য তোমাকে বলেছে?
হাঁ, তিনি বললেন আমাকে ডেকে–কেশব, তোমার বন্ধুকে বলো ইরুইয়া বন্দরে অবতরণকালে সে যেন আমার সঙ্গে যায়।
তার এ সখ কেন, জানতে চাইলে না?
বাবু…কেশব কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মুখ দিয়ে বের হলো না।
এমন সময় আবু সাঈদ এসে পড়লেন–পাশে নীহার। বললেন আবু সাঈদ আলম, আমাদের সঙ্গে তোমাকেও যেতে হবে।
চোখ তুলে তাকালো বনহুর। আবু সাঈদের মুখ থেকে দৃষ্টিটা একবার ফসকে গেলো নীহারের নতমুখে। অনুমানে বুঝতে পারলো, পিতার ইচ্ছার পিছনে কন্যার একটা যোগাযোগ আছে। বললো–আমি বরং ইঞ্জিনের মেশিনগুলো ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখে নিই। কথাটা বলে আর একবার সে তাকালো নীহারের দিকে।
নীহারও সেই সময় চোখ দুটো তুলে তাকিয়েছিলো একবারের জন্য। বনহুরের সঙ্গে চোখা চোখি হতেই পুনরায় মাথাটা নত করে নিলো।
আবু সাঈদ বললেন–ইঞ্জিন পরীক্ষার কাজ চালাবে ইঞ্জিনিয়ার, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে আলম। কারণ নতুন এক জায়গায়, বিশেষ করে নীহার আমার সঙ্গে থাকবে কিনা, বুঝলে?
বনহুর বুঝতে পেরেছে প্রথম কথাতেই, এবার রাজি না হয়ে উপায় রইলো না কিছু। বললো–বেশ, যাবো।
তৈরি হয়ে নাও আলম, আমরা এক্ষুণি জাহাজ থেকে বন্দরে অবতরণ করবো।
বনহুর দেখলো, নীহারের মুখে একটা আনন্দের দ্যুতি খেলে গেলো। দীপ্ত চোখে তাকালো একবার ওর মুখের দিকে। মনোভাব–তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকো, ভয় কিসে!
ওরা চলে গেলো।
বনহুর স্বাভাবিক নাগরিক ড্রেসে সজ্জিত হয়ে নিলো। কিন্তু সেদিনের নাসেরের গুলীভরা পিস্তলখানা প্যান্টের পকেটে গোপনে লুকিয়ে নিতে ত্রুটি করলো না।
আবু সাঈদ ও নীহারের সঙ্গে বনহুরও চললো।
অন্যান্য সবাই যার-যার ইচ্ছামত নেমে পড়ছে।
সিঁড়ি বেয়ে বন্দরে অবতরণ করছে সবাই। আবু সাঈদ এবং নীহার প্রধান সিঁড়ি দিয়ে। এগুচ্ছেন। বনহুর আসছে তাদের পিছনে। সিঁড়িটা শূন্যের উপরে দুলছে, নিচে প্রচন্ড জলস্রোত। নীহার বড় ভয় পাচ্ছিলো। সিঁড়ির সঙ্গে দুলছে নীহারের কম্পিত দেহটা।
আবু সাঈদ বয়স্ক লোক; তিনি কন্যাকে এগিয়ে নেবেন কিন্তু তারও সাহস হচ্ছিলো না যেন। নীহার তখন সিঁড়ির মাঝখানে এসে গেছে।
অসহায় ভীতি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নীহার বনহুরের দিকে। বনহুর তখনও সিঁড়ির উপরে পা রাখেনি, কারণ মালিক এবং মালিক-কন্যা পার হবার পর সে এগুবে। নীহারের করুণ অবস্থা দেখে বনহুর ভড়কে গেলো কিছুটা, হঠাৎ যদি পড়ে যায় তাহলে যে প্রখর স্রোত, নিচে ওকে খুঁজে পাওয়াই মুস্কিল হবে। হঠাৎ বনহুরের চোখের সম্মুখে লুসীর করুণ মুখখানা ভেসে উঠলো ক্ষণিকের জন্য। বনহুর দক্ষিণ হাতখানা বাড়িয়ে ধরে ফেললো ওকে, বললো–সাবধানে আমার হাত ধরে চলুন মেম সাহেব।
নীহার বনহুরের হাতখানা মুঠায় আঁকড়ে ধরলো। এই বিপদ মুহূর্তেও একটা তড়িৎ-প্রবাহ যেন বয়ে গেলো নীহারের শিরায় শিরায়। ভয়-ভীতি মুছে গেলো সঙ্গে সঙ্গে, গভীর জলতরঙ্গে পড়ে গেলেও আর সে মরবে না জানে।
বনহুরের সাহায্যে নিচে নেমে এলো নীহার।
আবু সাঈদ হেসে ফেললেন ফ্যাকাশে মুখে, কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কণ্ঠে ধন্যবাদ জানালেন–সাধে কি মা মনি তোমাকে এতো সমীহ করে! দেখো দেখি, কত বড় উপকারটা হলো তোমার দ্বারা…গদগদ হয়ে এলো আবু সাঈদের গলার স্বর।
নীহার চোখ তুললো, কোনো কথা না বললেও তার দৃষ্টির মধ্যে একটা কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠলো।
বনহুর ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো–এমন কি আর করলাম!
আবু সাঈদ, নীহার আর নাবিক আলম যখন সিঁড়ির উপর এগুচ্ছিলো তখন নাসেরের দল ডেকের অদূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিলো। বনহুর যখন নীহারের হাত ধরে সিঁড়ি পার করে নিচ্ছিলো তখন নাসের বললো–দেবো নাকি শেষ করে দুটোকে?
জলিল ক্ষিপ্রহস্তে নাসেরের পিস্তলের মুখটা নিচু করে দিয়ে বললো–প্রকাশ্যে এ কাজ করলে সব ফাস হয়ে যাবে। আমও যাবে, বস্তাও যাবে। সবুর করেন ছোট স্যার, সব ঠিক করে নেবো।
জম্বু দাঁত পিষে বললো–সেদিন আমার হাঁটুতে যেভাবে শটু করেছিলো, আজও ভাল করে হাঁটতে পারি না। সুযোগ পেলে দেখাবো না মজাটা কেমন?
জলিল পেটের দক্ষিণ দিকটা টিপে ধরে মুখটা কালো করে বলে–খেলে এখনও পেটে ব্যথা করে। ভাগ্যিস, পেটের নাড়ী ছিঁড়ে যায়নি সেদিন, তাই রক্ষা।
এতোক্ষণ শম্ভু তার ভীমকায় দেহ নিয়ে পান চিবুচ্ছিলো, বললো–আমাকেও কম আছড়ে দেয়নি বেটা। যতদিন বেঁচে থাকবো মনে থাকবে। দাঁতটা আজও নড়ছে, তবে রক্ত পড়ে না, এই যা।
রক্ত পড়ে না বলেই ছেড়ে দেবে নাকি ওকে?
ছেড়ে দেবো মানে? এই দাহ দিয়ে ওর বুকের রক্ত শুষে নেবো না?
জলিল বললো–দেখা যাবে কে কতটুকু বাহাদুর।
বললো নাসের–শয়তানটা এতো শক্তি পেলো কোথায়? ওকে সাধারণ মানুষ বলে মনে হয় না। জানো ওর এক একটা ঘুষির ওজন কতো?
জানি ছোট স্যার, জানি। কিন্তু জলিলের কাছে সব মিছে হয়ে যাবে। জলিল যখন কৌশল প্রয়োগ করবে তখন আলম কেন, আলমের বাবা এলেও পারবে না মনে রাখবেন। জলিল এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে এক খিলি পান মুখে গুঁজে দিলো।
নাসের বললো–চলো এবার। আমরাও নেমে পড়ি, কিন্তু মনে রেখো ওদের পূর্বেই আমরা জাহাজে ফিরবো এবং যে সিঁড়ি দিয়ে ওরা জাহাজে ফিরে আসবে সেই সিঁড়ির একটা দিক নষ্ট করে দিতে হবে।
ঠিক বলেছেন ছোট স্যার, একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
নাসেরের সঙ্গে হাত মিলালো জলিলের দল।
জলিলের দলের একজন লাঠিয়াল–নাম তার ফুলমিয়া, এতোক্ষণ ওদের পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। যদিও সে ওদের লোক কিন্তু তার মন এতোখানি হীন নয়। অন্তরে তার মায়া-দয়া সব আছে, আছে বিবেক-বিবেচনা। এদের কথাবার্তা মোটেই তার যুক্তিসঙ্গত বিবেচিত হয় না। বিশেষ করে নাবিক আলম সম্পূর্ণ নিরপরাধ, কিন্তু তাকে হত্যার জন্য কিই না ষড়যন্ত্র চলেছে দিবারাত্রি!
ফুলমিয়া এতোদিন ধৈর্য ধরে এদের অন্যায় মেনে নিয়েছে নীরবে। শুনে গেছে কিন্তু কোনো জবাব সে দেয়নি কোনোদিন, জানতো, বলে কোনো ফল হবে না। হয়তো তাকেও সন্দেহ করে বসবে ওরা রীতিমত।
আজ ফুলমিয়া সহ্য করতে পারে না জলিলদের কুৎসিত নির্মম পরামর্শ। একটা নিষ্পাপ মানুষকে এরা সাগরবক্ষে প্রচন্ড জলস্রোতে ডুবিয়ে মারবে, এতোবড় অন্যায় হতে দেবে না সে।
ফুলমিয়া আস্তে সরে গেলো সেখান হতে। বড় ইচ্ছা ছিলো ইরুইয়া বন্দরে অবতরণ করে বন্দরটা একবার দেখবে ঘুরেফিরে কিন্তু সব বাসনা মুছে ফেললো সে মন থেকে, চিরদিন ওদের দলে থেকে ওদের কুৎসিত সংস্পর্শে অনেক কুকর্ম করেছে সে। হঠাৎ আজ ফুলমিয়ার মন ফিরে যায়, মনে মনে শপথ করে–আর লোকের মন্দ সে কোনোদিনই করবে না। বরং যদি জীবন দিয়ে কারো উপকার করতে পারে তবেই সার্থক হবে এ পৃথিবীতে আসা তার।
কাজেই ফুলমিয়া বন্দরে অবতরণ না করে একটা ক্যাবিনের আড়ালে লুকিয়ে রইলো, দেখবে কি করে সিঁড়ির মুখ ওরা নষ্ট করে। প্রকাশ্যে কিছু বলতে বা করতে পারবে না ফুলমিয়া, কারণ জানে, কতবড় হৃদয়হীন নরপিশাচ তার দলের লোক। এতোটুকু যদি টের পায় তার মনোভাব তাহলে তাকে হত্যা করবে সর্বপ্রথমে। যেমন নাবিক মকবুলকে হত্যা করা হয়েছে। তার চেয়ে নিশ্চুপ থেকে যদি কিছু করা যায়!
ফুলমিয়া আসলেই গরিবের ছেলে ছিলো না। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান সে। যদিও প্রচুর অর্থ বা ঐশ্বর্য ছিলো না কিন্তু মন ছিলো বড়। পরের জন্য যতটুকু পারে করতো সে মন দিয়ে। ছোটবেলায় ফুলমিয়া লেখাপড়াও শিখেছিলো কিছুটা। তবে সংসারে মা না থাকায় এবং পিতা বৃদ্ধ হওয়ায় তাকেই সংসারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছিলো। কাজেই বেশি লেখাপড়া করা তার ভাগ্যে ঘটে ওঠেনি।
বৃদ্ধ পিতা এবং ছোট-ছোট ভাই-বোনদের অন্ন-সংস্থানের জন্য ফুলমিয়াকে চাকরীর সন্ধানে ফিরতে হয় এখানে-সেখানে। অল্প লেখাপড়া এবং ভাল ব্যাকিং না থাকার জন্য কোথাও কোন চাকরি মেলে না। এদিকে সংসারের অভাবের তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে–এমন দিনে বাপ মারা যায়। মাঝখানে বিয়েও করে নিয়েছিলো সে। ছোট-ছোট ভাই-বোন এবং নতুন বৌ-এর খাওয়া-পরা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লো ফুলমিয়া।
এমন দিনে জলিলের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো কোনো এক মুহূর্তে। ফুলমিয়ার বলিষ্ঠ চেহারা দেখে পছন্দ করে নিলো তাকে। তারপর হতে ফুলমিয়া জলিলের দলে লাঠিয়ালের কাজ করে।
যদিও লাঠিয়াল জীবন তার কাছে ভাল লাগে না তবু বাধ্য হয় সে এ কাজ করতে। জলিলের আদেশে তাকে অনেক কু-কর্ম করতে হয়। নিরীহ কত মানুষের মাথায় আঘাত করেছে সে ঐ জলিলের নির্দেশে। কত অসহায় মানুষের সর্বনাশ করতে হয়েছে তাকে। অবশ্য এসব করার পর অনুশোচনায় মন তার ভরে উঠেছে, কিন্তু কি করবে–এ কাজ না করেও কোনো উপায় নেই। বাধ্য হয়েই সে আজও টিকে আছে জলিলের দলে।
জলিলের আদেশে কু-কর্ম করলেও মন তার কোনোদিন সায় দেয়নি একাজে। তবুও তাকে করতে হয়েছে, না হলে সংসার চলবে না। কিন্তু আজ তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। একজন নিরপরাধ ব্যক্তির জীবননাশ করতে এতো তৎপরতা কেন তাদের। মিথ্যা নয়–কেন যেন নাবিক অলিমকে ওর ভাল লাগে। ওর সান্নিধ্য লাভের কামনা জাগে মনে। কিন্তু মনের ইচ্ছা প্রকাশের কোনো উপায় নেই। তাদের দলের সবাই ঈর্ষা করে ওকে। যদি কোনোক্রমে প্রকাশ পায় ফুলমিয়া নাবিক আলমকে মনে মনে সমীহ করে–তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু তাতে কোনো ভুল নেই।
ফুলমিয়া অন্তরের কথা কোনোদিন ব্যক্ত করে না এসব কারণেই। মনের বাসনা গোপনে চেপে নিশ্চুপ থাকে সে। কিন্তু আজ আর যেন সহ্য হয় না, বিবেক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার মধ্যে।
ফুলমিয়া আড়ালে লুকিয়ে পড়ে, দেখবে সে কি করে জলিল আর তার দলবল। কেমন করে ঝুলন্ত সিঁড়ির মুখ নষ্ট করে দেয়। দেবে না ফুলমিয়া এতোবড় একটা হৃদয়হীন অন্যায় করতে।
অনেকক্ষণ হয় চলে গেছেন আবু সাঈদ নীহার আর আলম সহ। জাহাজের প্রায় সবাই নেমে গেছে।
কয়েকজন জাহাজে আছে, এখনও তারা ইঞ্জিন পরিস্কারে ব্যস্ত। আর আছে জলিলের দলবল, কয়েকজন অবশ্য নেমে গেছে যদিও, তবুও ফুলমিয়া যায়নি।
ফুলমিয়া আড়ালে আত্বগোপন করে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ।
কিছুক্ষণ কেটে যায়–হঠাৎ ফুলমিয়ার নজর পড়ে তাদের দলেরই একজন একটা হাতুড়ি এবং বাটাল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সিঁড়িটার দিকে। এ দুটো জিনিস গোপনে কাপড়ের তলায় লুকিয়ে নিয়েছে লোকটা। জলিল, শম্ভু, ও জম্বুও এলো, ওরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে চারদিকে লক্ষ্য করছে সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে।
আশেপাশে কেউ নেই।
জলিল লোকটাকে ইংগিত করলো এবার কাজ শুরু করতে–কারণ এইতো সুযোগ। ধূর্ত শিয়ালের মতই সে ইশারা করতে লাগলো–সেইভাবে কাজ করে চললো বাদল। বাটাল আর হাতুড়িওয়ালা লোকটার নাম ছিলো বাদল।
জলিল জানে, হঠাৎ যদি কেউ দেখে ফেলে বা কারো নজরে পড়ে যায় তাহলে বাদলকে খুব করে ধমকে দেবে সে এই কাজের জন্য। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ থেকে যাবে এ ব্যাপারে।
বাদল সিঁড়ির মুখ এমনভাবে নষ্ট করে দিলো যে, সিঁড়িতে পা দিতেই সিঁড়ি খসে পড়বে সাগরবক্ষে।
কাজ শেষ করে চলে গেলো বাদল।
জলিল আর তার অন্যান্য অনুচর খুশি হলো, কারণ এ সিঁড়িতে শুধু আবু সাঈদ, নীহার আর আলমই উঠে আসবে। বিপদ ঘটবে ওদেরই।
ফুলমিয়া আলগোছে সরে পড়লো। দ্বিতীয় সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো বন্দরে। যেমন করে থোক। প্রথম সিঁড়িতে ওরা যেন না আসে সেই কাজ তাকে করতে হবে।
নিজের দলের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে তার। এমন নিষ্ঠুর হৃদয়হীন কাজ তার সহ্য হবে না কিছুতেই। বিদ্রোহী মন নিয়ে সে এগিয়ে চললো কিন্তু ইরুইয়া বন্দর ছোটখাট নয়– কোথায় খুঁজে ফিরবে সে ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ, তার কন্যা নীহার এবং আলমকে। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগোয় ফুলমিয়া।
বন্দরের সংলগ্ন ইরুইয়া নগরী।
কৌশলী শিল্পীর নিপুণ হস্তের তুলিতে আঁকা ছবির মত সুবিস্তৃত ইরুইয়া। উঁচু-নীচু টিলা আর সমতলভূমির উপরে ছোট-বড় কাঠের ঘরগুলো ঠিক গুছিয়ে তৈরি না করলেও দেখতে প্রায়। সবগুলোই এক সমান এবং একই ধরনের। কাঠের খুঁটি আর তক্তা দিয়ে মজবুত করে তৈরি এগুলো। তক্তার তৈরিই ছাদ। খাচ-কাটা সুন্দর নক্সা-করা ঘরের ধারগুলো দেখতে বেশ ঝালরের। মত মনে হয়।
টিলা আর ঢিবির পাশ কেটে সরু পথ চলে গেছে আঁকা-বাঁকা হয়ে দূর হতে দূরে। পথের দু’ধারে দোকানপাট রয়েছে আর মাঝে মাঝে সরাইখানা। কোথাও বা ফলমূলের দোকান আছে। ফুল এবং ফুলের মালার দোকানও আছে এ শহরে।
জিনিসপত্র কেনার পর আবু সাঈদ, কন্যা নীহার ও আলম সহ ফিরে চললেন। হঠাৎ নীহারের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সামনে ফুল ওয়ালার দোকানে। গোলাপ আর বেল ফুলের সমারোহ নীহারকে মুগ্ধ করে ফেললো।
এগিয়ে গেলো নীহার একটা মালা ক্রয়ের উদ্দেশ্যে।
সেই সময় ফুল ওয়ালার দোকানে ইরুইয়ার রাজমন্ত্রী ফারহু তার দু’জন অনুচরসহ ফুলের মালা ক্রয় করছিলো। নীহারকে দেখামাত্রই ফারহুর দৃষ্টি ফুলের মালা হতে চলে এলো ওর উপর। ফারহু ছিলো ইরুইয়ার একজন অতি অসৎ কু-মনোবৃত্তিপূর্ণ লোক। নীহারকে দেখে হঠাৎ তার মধ্যে একটা লোলুপ লালসাপূর্ণ মনোভাব জেগে উঠলো।
নীহার বা তার পিতা আবু সাঈদ কোনো দিকে লক্ষ্য করেনি, তারা ফুল ওয়ালার দোকানের ভিতর প্রবেশ করে দেখছে কোন্ মালাটা ক্রয় করবে।
আবু সাঈদ এবং নীহার যখন ফুলের মালা পছন্দ নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছেন, নাবিক আলম বেশি দস্যু বনহুর তখন কিছুটা পিছন হতে লক্ষ্য করছিলো। ফারহু’র পোশাক পরিচ্ছদ এবং তার দেহরক্ষীদ্বয়ের সাজসজ্জা দেখেই সে বুঝতে পেরেছিলো, এরা ইরুইয়ার কোনো রাজকর্মচারী। এক নজরেই অনুমান করে নিয়েছিলো তাদের মতলবটা, কাজেই বনহুর প্রস্তুত হয়ে ঠিক নীহারের পিছনে এসে দাঁড়ালো।
নীহার যখন একটি মালা হাতে তুলে নিয়েছে এবং নেড়েচেড়ে দেখছে সেই সময় রাজমন্ত্রী ফারহু খপ করে নীহারের হাতখানা চেপে ধরলো, মুখে তার বিদঘুঁটে কুৎসিত হাসি। ইরুইয়া ভাষায় বললো–সুন্দরী ফিরে চাও আমার দিকে..
ফারহু’র কথা শেষ হয় না, বনহুরের প্রচন্ড এক ঘুষি গিয়ে পড়ে তার চোয়ালে। ঘুরপাক খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ফারহু। দু’চোখে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে ফারহু’র দেহরক্ষীদ্বয় ধরে ফেলে বনহুরকে।
বনহুর এক ঝটকায় নিজকে ওদের হাত থেকে মুক্ত করে নেয়।
আবু সাঈদ এবং নীহার থ’মেরে গেছে। হঠাৎ এমন একটা ব্যাপার ঘটবে কল্পনাও করতে পারেনি তারা।
ফারুহু দাঁত পিষে নিজ ভাষায় বললো–জানো আমি কে?
বনহুর ইরুইয়া ভাষা না জানলেও অনুমানে কতকটা বুঝে নিলো তার কথা বলার ভঙ্গী দেখে। শুদ্ধ ইংরেজিতে বললো বনহুর–তোমার ব্যবহারেই আমি তোমার পরিচয় পেয়েছি।
নাবিক আলমকে সুন্দর ইংরেজি বলতে দেখে আবু সাঈদ মুগ্ধ হলেন। আরও বেশি বিমুগ্ধ হয়েছেন তিনি আজ তার শক্তির চাক্ষুস পরিচয় পেয়ে।
বনহুর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা বলে একটি ঝুড়ি কাঁধে তুলে নিলো, যেন তার কিছু হয়নি, বললো–চলুন।
এতক্ষণ অদূরে দাঁড়িয়ে ফুলমিয়া সব লক্ষ্য করছিলো। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখা পেয়েছিলো আবু সাঈদ, নীহার এবং আলমের। কিন্তু এমন সময় সন্ধান পেলো সে, যখন আলম রাজমন্ত্রীর চোয়ালে মুষ্ঠিঘাত করে ফেলেছে।
স্তব্ধ হয়ে দেখছিলো ফুলমিয়া নাবিক আলমের অদ্ভুত রূপ। শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে আসছিলো ওর। সে আরও লক্ষ্য করলো, আলম ঘুষি চালানোর পর দেহরক্ষীদ্বয় যখন তাকে ধরে ফেললো তখন এক ঝটকায় ওদের কবল থেকে নিজকে অতি সহজে মুক্ত করে নিলো আলম। কিন্তু এরপর বিপক্ষদল আর যেন ওকে ঘাটতে সাহসী হলো না। বৃথা আস্ফালন করে ক্রুদ্ধভাব প্রকাশ করতে লাগলো রাজমন্ত্রী এবং তার সঙ্গীদ্বয়।
বনহুর বোঝাটা তুলে নিয়ে সচ্ছভাবে অগ্রসর হলো। তার চলার ভঙ্গী দেখে মনে হলো কিছু যেন হয়নি।
ফুলমিয়া এবার সামনে এসে দাঁড়ালো, আলমকে লক্ষ্য করে বললো–ভাই, বোঝাটা আমাকে দাও, আমি তো খালি হাতে যাচ্ছি।
বনহুর ফুলমিয়াকে চিনতো, ও-যে লাঠিয়াল জলিলের একজন–তাও জানতো, বললো বনহুর–আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
ফুলমিয়া নাছোড়বান্দা–সে জেদ ধরে বললো, সে খালি হাতে যাচ্ছে অথচ আলম বোঝা বয়ে নিয়ে যাবে এটা বড় অশোভনীয়।
আবু সাঈদ বললেন–আলম, বোঝাটা ওকে দাও।
অগত্যা বাধ্য হলো বনহুর নিজের বোঝাটা ওকে দিতে।
আবু সাঈদ, নীহার আর বনহুর এগিয়ে চললো।
ফারহু ইংগিৎ করলো তার সঙ্গীদ্বয়কে ওদের অনুসরণ করতে। তৎক্ষণাৎ গোপনে রাজকর্মচারীদ্বয় অনুসরণ করে চললো।
সিঁড়ির মুখে এসে বুকটা কেঁপে উঠলো ফুলমিয়ার। বহু চিন্তা করে সে মনস্থির করে নিয়েছে, নিজের জীবন দিয়েও রক্ষা করবে আলম এবং মালিক আবু সাঈদ ও তাঁর কন্যা নীহারকে। সিঁড়ির মুখ নষ্ট করার কথা এদের কাছে বললে জলিলের দল তাকে ক্ষমা করবে না। উত্তপ্ত লৌহশলাকা দ্বারা তার চক্ষুদ্বয় অন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ সে জানে, তাদের দলের কেউ অবিশ্বাসী কাজ করলে তার এই শাস্তিই দেওয়া হয়ে থাকে। নৃশংস পরিণতির চেয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু তার কাছে। অনেক শ্রেয়ঃ। মরতে হয় এদের বাঁচিয়ে তবে মরবে।
ফুলমিয়া বোঝাটা নিয়ে পথ চলতে চলতে এ কথাই ভাবছিলো–মন বলছিলো, কি হবে অন্যের জন্য নিজকে বিসর্জন দিয়ে? বিবেক মাথাচাড়া দিয়ে মনকে দাবিয়ে দিচ্ছিলো, একটি জীবন দিয়ে যদি তিনটি জীবন রক্ষা করতে পারো তাহলে তুমি নশ্বর পৃথিবীর বুকে একটা কাজের মত কাজ করে যাবে। মরতে তোমাকে হবেই একদিন, তবু যদি পারো মানুষের কিছু উপকার করে যাও। ফুলমিয়ার মন পরাজয় স্বীকার করেছিলো তার বিবেকের কাছে।
ফুলমিয়া বোঝাটা কাঁধে নিয়ে তাকালো সিঁড়ির নিচে সাগরের উচ্ছল জলরাশির দিকে। কি প্রচন্ডভাবে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে সরে যাচ্ছে জলরাশি। একবার পড়ে গেলে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ফুলমিয়া ইচ্ছা করলে দ্বিতীয় সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারতো বা ওদের সেইভাবে যেতে বলতে পারতো কিন্তু সে জানে, আজ জলিলের দল নিতান্ত মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করে চলেছে, কোনোরকম চালাকি তার চলবে না। ইচ্ছা করলে এদের বাঁচাতে পারে কিন্তু তাকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হবে, তার চেয়ে সাগরের জলে জীবন দেওয়া অনেক শ্রেয়ঃ।
ফুলমিয়া বোঝাটা মাথায় খোদার নাম স্মরণ করে ঝুলন্ত সিঁড়ির ধাপে পা রাখলো।
সঙ্গে সঙ্গে ফুলমিয়া এবং বোঝাটাসহ সিঁড়িটা ঝপাং করে খসে পড়লো সাগরবক্ষে।
আর্তচিৎকার করে উঠলো আবু সাঈদ এবং নীহার।
বনহুর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো না, মুহূর্তে দেহ থেকে কোটটা খুলে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো জলতরঙ্গের মধ্যে।
জাহাজের উপর থেকে সব লক্ষ্য করছিলো নাসেরের দল। ভেবেছিলো এক, হলো আলাদা। ফুলমিয়া সাগরবক্ষে নিমজ্জিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই জলিল তার লোকদের আদেশ দিলো শীঘ্র জাহাজে বিপদসংকেত ধ্বনি করতে এবং কয়েকখানা বোট পানিতে নামিয়ে নিতে। ব্যস্ত হয়ে পড়লো জলিলের দল, কারণ ফুলমিয়া তাদের দলের লোক, ফুলমিয়ার এ অবস্থার জন্য জলিল বেশ ঘাবড়ে গেলো। অবশ্য জলিল জানে না ফুলমিয়ার মনের কথা তাই, না হলে ওকে বাঁচানোর জন্য ওরা এমন ব্যস্ত হয়ে পড়তো না।
নীহার তো পিতার জামার আস্তিনে নিজের দু’চোখ ঢেকে ফেলে রোদন করে উঠলো–আব্বা একি হলো? সর্বনাশ হলো যে! ফুলমিয়ার সঙ্গে আলমও যে মারা পড়লো।
আবু সাঈদও ব্যস্তভাবে বন্দরে ছুটাছুটি করতে লাগলেন আর চিৎকার শুরু করলেন–শীঘ্র। বোট নামাও…শীঘ্র বোট নামাও…
নীহার মন-প্রাণে খোদাকে স্মরণ করছে। তার নারী-হৃদয় একেবারে ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। কি ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক অবস্থা!
নীহার নিজকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছিলো না, সে অবিরত রোদন করে চলেছে।
ওদিকে জলিলের দল এবং জাহাজের অন্যান্য নাবিক জাহাজের পিছনে এবং সম্মুখভাগে কয়েকখানা বোট নামিয়ে নিয়েছে। দু’জন সাঁতারুও বোটে চেপে সাগরবক্ষে অবতরণ করেছে।
বনহুর কিন্তু ফুলমিয়াকে অনেক কষ্টে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো। ফুলমিয়া যেন জাহাজের চাকার ফাঁকে আটকে না যায় সেজন্য সে আপ্রাণ চেষ্টায় চাকার বিপরীত দিকে সাঁতার কাটছিলো।
প্রচন্ড জলস্রোতে ফুলমিয়ার মত একজন বলিষ্ঠ জোয়ান লোককে ধরে নিয়ে সাঁতার কাটা কম কথা নয়। যদিও বনহুর হাপিয়ে পড়ছিলো তবু কিছুতেই ওকে মুক্ত করে দেয়নি।
ততক্ষণে বোটসহ উদ্ধারকারিগণ জাহাজের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। নানাভাবে জলতরঙ্গ ভেদ করে সন্ধান করে ফিরছিলো ওরা নাবিক আলম আর ফুলমিয়ার।
নীহার এবং আবু সাঈদ বন্দরের জেটিতে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে দেখছিলো, বুকের মধ্য ঢিপ ঢিপ করছিলো তাদের। জেটিতে ডেকের উপর আশেপাশে লোকজনে ভীড় জমে। উঠেছে। সকলের চোখেমুখেই ভীতিকর আশঙ্কাভরা ভাব।
দু’খানা জাহাজ ইতিমধ্যে বন্দর ত্যাগ করবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। জাহাজ ‘পর্যটন’ থেকে বিপদসঙ্কেত ধ্বনি প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে সে জাহাজ দুটি স্থির হয়ে পড়েছে।
দিনের আলো বলেই রক্ষা, উদ্ধারকারী বোটগুলো অল্পক্ষণেই ফুলমিয়াসহ বনহুরকে উদ্ধার করে বন্দরে নিয়ে এলো।
সর্বপ্রথমে নীহার সব ভুলে বনহুরের অর্ধ-সংজ্ঞাহীন দেহটার উপর ঝুঁকে পড়লো–আলম, এখন কেমন বোধ করছো?
বনহুর একেবারে জ্ঞান হারায়নি, সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো, বললো–আমি ভাল আছি, ফুলমিয়া কেমন আছে?
অদূরে সংজ্ঞাহীন ফুলমিয়াকে তখন ডাক্তার চিকিৎসা করছেন। আবু সাঈদ একবার আলম, একবার ফুলমিয়ার কাছে ছুটছেন। ডাক্তার ফুলমিয়ার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানালেন। তিনি নাবিক আলমের প্রশংসা করে বললেন–ফুলমিয়াকে কিছুতেই রক্ষা সম্ভব হতো না যদি আলম তাকে ঠিকভাবে ধরে রাখতে সক্ষম না হতো। ফুলমিয়া অনেক আগেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলো, নাবিক আলম তাকে কঠিন-মজবুত হস্তে ধরে রেখেছিলো বলেই উদ্ধারকারিগণ তাকে উদ্ধার করতে পেরেছে।
বনহুর অল্পক্ষণ মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলো।
ফুলমিয়ার তখনও জ্ঞান ফিরে আসেনি। তাকে অজ্ঞান অবস্থাতেই জাহাজ ‘পর্যটনে উঠিয়ে নেওয়া হলো।
জাহাজে গমন করেই আবু সাঈদ খেয়াল করলেন সিঁড়ির মুখ হঠাৎ কি করে নষ্ট হলো ভাগ্যিস, নীহার বা তিনি যদি সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেন তাহলে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা হতো কিছুতেই বাঁচতেন না। শিউরে উঠলেন আবু সাঈদ সাহেব। তৎক্ষণাৎ গভীরভাবে অনুসন্ধান শুরু করলেন।
সিঁড়ির মুখ পরীক্ষা করে বিস্মিতই শুধু হলেন না তিনি, স্তম্ভিত হলেন। বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন–কে বা কারা সিঁড়ির মুখ বাটাল বা ঐ ধরনের অস্ত্র দ্বারা নষ্ট করে দিয়েছিলো। সেই স্থানে ছিলো নাসের এবং জলিলের দল। নাসের ভীড় ঠেলে সম্মুখে এসে বললো-স্যার, নিশ্চয়ই আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো সেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্য ফুলমিয়াকে উদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে সাগরবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো..
নাসের নাম ধরে না বললেও চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো,–সিঁড়ির মুখ নষ্ট করেছে আলম।
আবু সাঈদ ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন–খবরদার, অমন কথা বলো না। আলম প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলো, তাছাড়া সে তেমন লোক নয়।
অনেক সন্ধান করেও আবু সাঈদ সিঁড়ির মুখ নষ্টকারিগণকে আবিষ্কারে সক্ষম হলেন না। তিনি ইরুইয়া বন্দর ত্যাগ করার জন্য জাহাজের নাবিকগণকে আদেশ দিলেন।
জাহাজ ‘পর্যটন’ ইরুইয়া বন্দর ত্যাগ করে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের দিকে রওয়ানা দিলো। জাহাজে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলেও আবু সাঈদের মন সচ্ছ হলো না। পর পর একটার পর একটা দুর্ঘটনা তাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এবারের মত কোনোবার তাঁর জীবনে এমন বিপর্যয় আসেনি বা ঘটেনি। এবার যেন কেমন একটা এলোমেলো ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তার পর্যটনে’।
ফুলমিয়া ক্রমে সংজ্ঞা লাভ করে।
একটু সুস্থ হয়েই সে জানতে পারে, নাবিক আলম নিজের প্রাণ বিপন্ন করে তাঁকে সাগরবক্ষ হতে উদ্ধার করেছে। অনাবিল এক আনন্দে আপ্লুত হয় ফুলমিয়ার মন। নাবিক আলমের প্রতি তার হৃদয়তা আরও গম্ভীর হতে গভীরতম হয়ে উঠে।
ফুলমিয়া আরোগ্য লাভ করলো।
আবু সাঈদ আর নীহার সবচেয়ে খুশি হয়েছে। দিন দিন আলমের প্রতি পিতা এবং পুত্রীর অনুরাগ আরও বেশি নিগূঢ় হয়ে উঠেছে। আলম যেন তাদের অতি আপন জন একটি মুহূর্ত ওকে না হলে তাদের যেন চলবে না।
ফুলমিয়াকে মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য আবু সাঈদ নাবিক আলমের কাছে। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলেন। সেই বিপদকালে নিজের জীবন বিপন্ন করে কেউ সাহসী হতো না ভীষণ জলতরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কত বড় মহান আর হৃদয়বান হলে সে এমন কাজ করতে পারে– ভেবে আবু সাঈদ অবাক হলেন।
নীহারও কম বিস্মিত হয়নি। দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই যেন আলমের আত্মপরিচয়ে সে আশ্চর্যের পর আশ্চর্য হচ্ছে। নাবিক আলম মানুষ না অন্য কিছু।
সাধারণ মানুষের মধ্যে তো এমন অদ্ভুত গুণ পরিলক্ষিত হয় না! আলম সম্বন্ধে নীহার যত ভাবে ততই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, আরও গভীরভাবে ভাবতে যেন ইচ্ছা করে ওর কথা। নীহারের জীবনে আলম যেন এক জ্যোতির্ময় দ্যুতি এনে দিয়েছে। একটি মুহূর্ত যেন ওকে না দেখে থাকতে পারে না সে।
নীহার আলমের কথা যতই ভাবুক, যতই ওকে পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠুক, আলম ততই নীহারকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে; নীহারের মনে সে দাগই শুধু কাটেনি, গভীরভাবে স্থান দখল করে নিয়েছে। কিন্তু সেকি তার অপরাধ? আলম নিজের মনকেই প্রশ্ন করে।
নীহারের সান্নিধ্য সে কোনোদিন কামনা করে না, তবে নীহার যখন তার পাশে এসে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়ায় তখন পারে না সে তাকে নির্মমভাবে উপেক্ষা করতে। হয়তো এটা তার মনের সৎসাহস–দুর্বলতা নয়। কারণ তার জীবনে বহু নারী ধমনীতে প্রবাহিত হয়েছে উষ্ণ রক্তের ধারা, তবু সে সংযমচ্যুত হয়নি! কঠিন লৌহমানবের মত নিজকে শক্ত করে রেখেছে। আজ বনহুর নীহারের কাছে পরাজিত হবে না।
জাহাজ অবিরাম একটানা চলেছে।
রাত গভীর না হলেও বেশ রাত হয়েছে।
আকাশে আজ পূর্ণচন্দ্র।
জ্যোৎস্না-প্লাবিত সমস্ত পৃথিবী। উচ্ছল জলতরঙ্গের উপর জ্যোৎস্নার আলো পড়ে অপূর্ব লাগছিলো।
ডেকের রেলিং-এ ঠেশ দিয়ে সিগারেট পান করছিলো বনহুর। মনের মধ্যে নানা চিন্তার উদ্ভব হয়ে চলেছে। চিন্তাস্রোতে গা ভাসিয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিলো সে।
এমন সময় চমকে উঠে বনহুর, ফিরে তাকিয়ে বলে–মেম সাহেব আপনি! সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটটা নিক্ষেপ করে দূরে।
নীহারের সম্মুখে নাবিক আলম সিগারেট পান করতো না। কারণ সে তার মনিব-কন্যা, তাই আজও বনহুর নীহারের আগমনে অর্ধদগ্ধ সিগারেট দূরে নিক্ষেপ করলো। অসময়ে মালিক কন্যাকে তার পাশে আসতে দেখে অবাক না হলেও সে বিব্রত হলো।
নীহার হঠাৎ এসে পড়েছে; সেও বেশি করে ভেবে দেখেনি–কেন সে এলো, কি চায় সে নাবিক আলমের কাছে। আলম যখন বললো, “মেম সাহেব আপনি! ‘–তখন হঠাৎ নীহার জবাব দিতে পারলো না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সেদিনের পর থেকে–যেদিন নীহার আলমের ক্যাবিন থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছিলো, বলেছিলো আলম, মেম সাহেব, আমার ক্যাবিনে আপনি আর আসবেন না। এখানে আসাটা আপনার মোটেই উচিৎ নয়। আমাকে আপনি মাফ করবেন।
নীহার অস্ফুট ধ্বনি করে উঠেছিলো, আলম, তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে?
জবাব দিয়েছিলো আলম, না।
তবে অমন করে কথা বলছো কেন? বলেছিলো নীহার।
আপনি জানেন না, আমার ক্যাবিনে আসাটা আপনার জন্য সম্পূর্ণ অসঙ্গত। আমি অনুরোধ করছি, আপনি আমার ক্যাবিনে আর আসবেন না।
*
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলো নীহার–’আলম!
হাঁ মেম সাহেব! আমাকে মাফ করবেন, আমি অক্ষম
নীহার বেরিয়ে গিয়েছিলো আলমের ক্যাবিন থেকে। তারপর আর সে আসেনি আলমের পাশে। একটি ক্ষুদ্ধ অভিমান গুমড়ে কেঁদে ফিরেছে সদা তার মনের গহনে। নিজের মনেই নিজে ছটফট করে মরেছে তবু নাবিক আলমের কাছে সে যেতে পারেনি। কিন্তু ইরুইয়া বন্দরে ফুলওয়ালার দোকানে আলম যখন তাকে শয়তান ফারহু’র কবল থেকে উদ্ধার করে নিলো তখন সমস্ত মান-অভিমান ভুলে গিয়েছিলো নীহার। একটা অভূতপূর্ব অনুভূতি উপলব্ধি করেছিলো সে মনে–আলম তাকে নিশ্চয়ই ভালবাসে। সেই আত্নবিশ্বাসেই নীহার আজ আবার তার পাশে এসে। দাঁড়িয়েছে। আলম যখন কথা বললো তখন নীহার চট করে কোনো সাড়া দিতে পারলো না। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো পুতুলের মত মাথা নত
মৃদু হাসলো বনহুর, নীহারের অন্তরের কথা সে জানে। এ ক’দিন নীহার ক্যাবিনে না এলেও তার শ্যেনদৃষ্টি থেকে রেহাই পায়নি সে। লক্ষ্য করেছে বনহুর–গভীর রাতে কার যেন পদশব্দ তার ক্যাবিনের আশেপাশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কার নিশ্বাসের শব্দ শুনেছে তার শিয়রে। কোনোদিন আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে কোনো এক কোমল হস্তের স্পর্শে, কে যেন আলগোছে হস্তসঞ্চার করেছে তার কেশে। চমকে চোখ মেলেছে বনহুর, কাউকে দেখতে পায়নি। দেখতে না পেলেও বুঝতে পেরেছে নীহার ছাড়া এ কেউ নয়। নীহারের অন্তরের বেদনা উপলব্ধি করে স্নান হাসি হেসেছে, নির্বোধ যুবতী নীহার; জানে না সে কোনোদিন তার কামনা পূর্ণ হবার নয়। প্রেম-প্রীতি-স্নেহ-ভালবাসা কোনোদিন জোর করে আদায় করা যায় না।
একটু নড়ে দাঁড়ালো বনহুর, নিজেকে সচ্ছ করে নেবার জন্যই সে এমনভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, বললো শান্তকণ্ঠে–নীহার, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?
বনহুরের স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠস্বর নীহারকে আশ্চর্য করলো। একজন সাধারণ নাবিকের গলায় এমন সুর বের হবার কথা নয়। সম্মুখে অবাক হবার মত কিছু দেখলে মানুষ যেমন করে তাকায় তেমনি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নীহার নাবিক আলমের মুখে, হঠাৎ কোনো শব্দ বের হলো না তার ঠোঁট দুটির ফাঁকে।
বনহুর তার বলিষ্ঠ বাহু দুটি বুকের উপর রেখে তাকালো জ্যোত্সা-প্লাবিত সীমাহীন জলরাশির দিকে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে কি যেন ভাবলো, তারপর বললো–এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষ কি চায়? কিসের মোহে মানুষ বাঁচতে চায় বলতে পার?
নীহারের বিস্ময় চরমে উঠে–কি বলতে চায় আলম তাকে? কি-ই বা জবাব দেবে সে আলমের প্রশ্নে! নীহার ঢোক গিললো, সাধারণ এক নাবিক যুবকের কাছে আজ সে বাকহীন হয়ে পড়েছে যেন।
বনহুর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললো–মানুষ চায় প্রেম-প্রীতি-স্নেহ-ভালবাসা আর সেই মোহেই আকৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে চায়…থামলো সে।
নীহার নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে বনহুরের দীপ্ত মুখ-মন্ডলের দিকে–তার সমস্ত অনুভূতি যেন লুপ্ত হয়ে গেছে, নির্বাক হয়ে শুনছে ওর কথাগুলো।
বলে চলেছে বনহুর–এসবের কিছু নেই আমার মধ্যে। নীহার, আমি একটা শুষ্ক নারিকেলের ছোবড়ার মতই উচ্ছিষ্ট।
এবার অস্ফুট ধ্বনি করে নীহার–আলম!
হাঁ, জানো না বলেই তো তুমি আমাকে তোমার মনের কোণে স্থান দিয়েছে। যদি আমার ভিতরের কথাটা জানতে…
না না, আমি কোনো কথা তোমার জানতে চাই না আলম…নীহার বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়। তারপর বলে মিথ্যা কথা! মিথ্যা কথা বলছো তুমি। প্রেম-প্রীতি-স্নেহ-ভালবাসা ছাড়া মানুষ কোনোদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে না। এসব যদি তোমার মধ্যে না থাকবে তাহলে তুমি বেঁচে আছো কি করে?
সেই প্রশ্নই আমি তোমাকে করেছিলাম নীহার। তুমি জানো, আমি বেঁচে আছি কিন্তু আসলে আমি মৃতের চেয়েও অধম। অবাক হচ্ছো আমার কথা শুনে, তাই না?
নীহার নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে, নাবিক আলম বলে কি?
বনহুর এবার রেলিং-এ ঠেশ দেয়–কেন মৃতের চেয়েও অধম জানো? সব বলবো তোমাকে। কারণ মানুষ হয়েও আমি মানুষ নই। মানুষ কোনোদিন পারে না মানুষকে পরিহার করে চলতে। আমি পারি…বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে বনহুরের কণ্ঠ। নিজকে সংযত করে নেয় বনহুর, একটু কেশে নিয়ে বলে সে মায়ের একমাত্র সন্তান হয়ে মাকে কোনোদিন সুখী করতে পারিনি। মায়ের চোখের পানি আমাকে কোনোদিন বিচলিত করতে সক্ষম হয়নি। মায়ের স্নেহ আমাকে পারেনি। আবদ্ধ করতে। স্ত্রীর প্রেম আমাকে…
অস্ফুট ধ্বনি করে নীহার–আলম, তুমি বিবাহিত!
হাঁ, আমি বিবাহিত। বিয়ে দিয়ে মা আমাকে গৃহকোণে আটকে রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি, স্ত্রীর প্রেম আমাকে আকৃষ্ট করতে পারলো না। শুধু তাই নয়, আমার সন্তান আছে। সন্তানের মায়াও আমাকে কোনোদিন চঞ্চল করেনি–নীহার, বলো আমি জীবিত না মৃত?
বনহুর তাকিয়ে দেখলো, নীহারের মুখ ফ্যাকাশে ছাই-এর মত বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। দুলছে। নীহার, হয়তো এই মুহূর্তে পড়ে যাবে সে। বনহুর ধরে ফেললো সাবধানে ওকে।
অল্পক্ষণে নিজকে সামলে নিলো নীহার, গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।
বনহুর বললো–তাই আমি পারি না কাউকে ভালবাসতে বা কারো ভালবাসা গ্রহণ করতে…
নীহার মাতালের মত টলতে টলতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, কোনোরকম উক্তিই আর তার মুখ দিয়ে বের হলো না, এগুলো সম্মুখের দিকে।
বনহুর বললো–চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
না, লাগবে না! কথাটা বলে নীহার কোনোরকমে দ্রুত চলে গেলো সেখান থেকে।
বনহুর প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট-কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো, তারপর চললো নিজের ক্যাবিনের দিকে।
বনহুর ক্যাবিনের দিকে পা বাড়াতেই আড়াল থেকে সরে গেলো একজন, সে এতোক্ষণ বনহুর আর নীহারের সব কথাবার্তা শুনছিলো। বনহুর ক্যাবিনে প্রবেশ করবার পূর্বেই সে শয়ন করলো নিজ বিছানায়।
বনহুরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে সে আত্মগোপন করতে পারলো না, ক্যাবিনে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলো, কেশব এতোক্ষণ কক্ষে ছিলো না, সে এইমাত্র শয্যা গ্রহণ করলো।
বনহুর সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বেলে ফেললো, তারপর শয়ন করে বললো– কেশব, এতোক্ষণ ঘুমাওনি কেন?
নড়ে উঠলো কেশব, ঘুমের ভান করে রইলেও সে ঘুমায়নি জানতে পেরেছেন বাবু; সে। নড়েচড়ে বললো–বড় গরম বাবু…
ওঃ তাই ডেকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে?
আমতা আমতা করে বললো কেশব–না বাবু, ক্যাবিনের বাইরে যাইনি।
কেশব, আমার চোখে তুমি ধূলো দিতে চাও?
বাবু!
তুমি আড়ালে দাঁড়িয়ে নীহার আর আমার কথাবার্তা শুনছিলে না?
বাবু, আপনার জন্য আমার সব সময় আশঙ্কা, তাই…
পাহারা দিচ্ছিলে আমাকে, তাই না?
ঠিক পাহারা নয় বাবু, দেখছিলাম হঠাৎ কেউ…
আক্রমণ করে কিনা?
কেশব কোনো কথা বলে না, নিশ্চুপ থাকে। অবশ্য সে কথা মিথ্যা নয়। এ জাহাজে আসার পর বাবু কতবার যে কতরকম বিপদে পড়েছে তার ঠিক নেই। আবার কখন কোন বিপদ যে তার জন্য কোথায় ওৎ পেতে আছে তাই বা কে জানে। কেশবের সদা ভয় তার বাবুকে নিয়ে। বোন। ফুলকে হারিয়েছে–এখন একমাত্র বাবু তার সম্বল। এ জাহাজে আর কে আছে তার–
কেশব!
বনহুরের ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে কেশবের। ধমমড় করে বিছানায় উঠে বসে বলে–বাবু!
কেশব, তুমি আমাকে অত্যন্ত ভালবাস জানি, কিন্তু আমি বড্ড অপদার্থ, তার প্রতিদানে তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না।
কেশব উঠে এসে বনহুরের হাত দু’খানা চেপে ধরে–বাবু, আপনি যা দিয়েছেন তা আমাকে মানুষ হিসেবে অনেক উপরে তুলে দিয়েছে। আপনি আমাকে কোনোদিন দূরে সরিয়ে দেবেন না।
বনহুর কেশবের কথায় মুগ্ধ হলো বললো–পারবে আমার সঙ্গে দিন কাটাতে?
পারবো।
অনেক কষ্ট হবে আমার সঙ্গে থাকলে।
হোক, সব কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো বাবু।
বেশ, যদি তাই মনে করো থেকে আমার সঙ্গে।
কেশবের মুখ দীপ্তময় হয়ে উঠলো, বললো–বাবু, আজ আমি শান্তি পেলাম!
*
নীহার একেবারে যেন মুষড়ে পড়েছে। সেই জ্যোত্স প্লাবিত রাত্রির কথাগুলো তাকে যেন দুঃস্বপ্নের মতই চঞ্চল করে তোলে। সর্বক্ষণ কি যেন ভাবে, নির্জন ক্যাবিন ছেড়ে বাইরেই আসে সে আর। নাবিক আলমকে সে নিজের অজ্ঞাতে ভালবেসে ফেলেছিলো, শুধু ভালই বাসেনি, মনের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো ওকে। কত আকাশ-কুসুম স্বপ্ন যে দেখেছিলো তাকে নিয়ে। কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড়ের মত এক নিমিষে সেই রাতে তার মনের সাজানো সৌধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
আবু সাঈদ কন্যাকে হঠাৎ এমন বিমর্ষ আনমনা হয়ে যেতে দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নীহার এমন তো কোনোদিন ছিলো না। কন্যার মনে আনন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন।
প্রথমেই বলেছি, আবু সাঈদ সাহেব তার পর্যটনে সব কিছুরই ব্যবস্থা রেখেছিলেন। খেলাধুলো, গান-বাজনা করার জন্য নিপুণ ব্যবস্থা ছিলো। লাইব্রেরীতে ছিলো সবরকম বই পুস্তক, যার যার ইচ্ছামত পড়াশোনা করতে পারতো। টেলিভিশনও ছিলো সন্ধ্যায় ভীড় জমাতো সবাই টেলিভিশন ক্যাবিনে। জাহাজ পর্যটনে আবু সাঈদের সঙ্গিগণের কোনো রকম অসুবিধা যেন না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিলো তার।
নীহার আবু সাঈদের চঞ্চলা কন্যা, ইচ্ছামত সে সমস্ত জাহাজে বিচরণ করে ফিরতো। খেলাধুলো, গান-বাজনায় দক্ষ ছিলো সে। পড়াশুনাও করতো সে যখন ইচ্ছা তখন লাইব্রেরী ক্যাবিনে বসে। সন্ধ্যায় সবার পূর্বে এসে বসতো সে টেলিভিশন ক্যাবিনে।
সেদিনের পর থেকে নীহার এসব ছেড়ে দিয়েছে, সদা বিমর্ষ মনে নিজের ক্যাবিনের মুক্ত গবাক্ষে বসে তাকিয়ে থাকে ফেনিল জলরাশির দিকে।
বনহুর জাহাজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও সে লক্ষ্য করেছে– নীহার সেদিনের পর হতে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে, কোনো রকম সাড়াশব্দ নেই তার মধ্যে। যতক্ষণ বনহুর তার ইঞ্জিনের কাজে ব্যস্ত থাকতো ততক্ষণ সে ভুলে থাকতো, তেমন করে কোনোকিছু ভাববার সময় হতো না। যখনই সে অবসর পেতো তখন মনটা আনচান করতো, কেমন যেন একটা উদাস ভাব এসে আচ্ছন্ন করে ফেলতো তাকে। মাঝে মাঝে বনহুর টেলিভিশন ক্যাবিনে এসে বসতো বা দেয়ালে। ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। দেশ-বিদেশের সংবাদ পেতে রেডিও আর টেলিভিশনের মাধ্যমে।
আজকাল বনহুর খেলাধুলোর জায়গায় বা লাইব্রেরী ক্যাবিনে কিংবা টেলিভিশন কেবিনে কোথাও নীহারকে দেখতে পেতো না। আবু সাঈদ বা জাহাজের কেউ নীহারের এই নীরবতার কারণ না জানলেও জানতো একমাত্র বনহুর।
কখনও কখনও বনহুর ব্যথিত হতো, নীহারকে সেদিন ওভাবে কথাগুলো না বললেও চলতো, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতো, বলে সে ভালই করেছে কারণ নীহার ক্রমান্বয়ে তাকে যেভাবে নিবিড়তম আকর্ষণে আকৃষ্ট করে চলেছিলো তাতে অমঙ্গলের আশঙ্কা কম ছিলো না। এখন বনহুর নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে চলে, সময়-অসময়ে এসে নীহার তাকে আনমনা করে তোলে না।
ইরুইয়া বন্দর ত্যাগ করার দুদিন পরই জাহাজ ‘পর্যটন ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে পৌঁছানোর কথা। ছিলো, কিন্তু হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং রেডিও আবহাওয়া সংবাদে বিপদ-সংকেত জানা যাওয়ায় আবু সাঈদ সাহেব সম্মুখে ছোটখাটো যে-কোন এক বন্দরে জাহাজ নোঙর করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। এসব কারণেই পথে কয়েকদিন বিলম্ব ঘটে গেলো।
এখন জাহাজ সোজা ফৌজিন্দিয়া মুখে অগ্রসর হচ্ছে। আকাশ স্বচ্ছ–মেঘমুক্ত। দ্বাদশীর চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ!
রাত গভীর।
হঠাৎ তীব্র একটা শব্দ সমস্ত জাহাজের আরোহিগণকে সজাগ করে তুললো। শব্দটা যেন দূর। দূরান্ত থেকে শোনা যাচ্ছে। ঠিক যেন ট্রেনের ইঞ্জিনের হুইসেলের শব্দ।
যারা জেগে ছিলো তারা ঘুমন্ত জনকে জাগিয়ে দিলো। সবাই কান পেতে শুনতে লাগলো। শব্দটা। যদিও বহুদূর হতে ভেসে আসছে তবু তীক্ষ্ণ ছুরিফলার মতই মনে হচ্ছে আওয়াজটাকে।
আবু সাঈদ বুঝতে পারলেন তাঁরা ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের অনতি দূরে পৌঁছে গেছেন। তাঁর মুখমন্ডল দীপ্ত হয়ে উঠলো বটে কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভীতি ভাব উঁকি দিলো তার সঙ্গে।
পিতার সঙ্গে নীহারও জেগে উঠেছিলো, ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললো–আব্বা, তোমার সেই শব্দ না?
হাঁ মা, আমরা ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের নিকট এসে পড়েছি।
আব্বা, শব্দটা শুনে আমার কেমন ভয় হচ্ছে।
ছিঃ মা ভয় কি! ঐ শব্দটা কিসের জানার জন্যই তো আমাদের আগমন। চলো আমরা ডেকে গিয়ে দাঁড়াই নিশ্চয়ই দ্বীপের সেই অজ্ঞাত আলোকরশ্মি দেখতে পাবো।
সেই মুহূর্তে নাসের ছুটে এলো দূরবীক্ষণ হস্তে, আবু সাঈদ এবং নীহারকে লক্ষ্য করে বললো–আপনারা আসুন, দেখবেন আসুন, দূরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর টুকরা দেখা যাচ্ছে।
আবু সাঈদ ওভারকোটটা গায়ে জড়িয়ে বললেন–নীহার, চল মা দেখিগে।
নীহারের বুকের মধ্যেও দুরু দুরু করে কম্পন শুরু হয়েছে, ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার মুখ; পিতার কথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্লিপিং গাউনটা গায়ে দিয়ে বললো– চলো আব্বা।
আবু সাঈদ ডেকে এসে দাঁড়ালেন, হুইসেলের শব্দটা একটানা শোনা যাচ্ছে। গভীর রাত্রির নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে কেমন যেন এক ভয়ঙ্কর আঁতঙ্কময় শব্দ। জাহাজের পর্যটক দল প্রায় সবাই এসে আবু সাঈদের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। যেমন তাঁরা সাহসী তেমনি উৎসাহী কিন্তু সকলের মুখেই যেন একটা ভীতিকর ভাব ফুটে উঠেছে। কেউ কেউ দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে দেখছেন। প্রায় সকলেরই ইচ্ছা, জাহাজ আর অগ্রসর না করাই শ্রেয়।
আবু সাঈদ দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে দেখলেন–সত্যিই দূরে বহু দূরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু যেন ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। কখনও বা জ্বলছে কখনও নিভছে। কখনও একেবারে আলোর বিন্দুগুলো মিশে গিয়ে শুধু গাঢ় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে সব।
আবু সাঈদ বন্ধুর মুখে যা শুনেছিলেন এ যে একেবারে খাঁটি সত্য। তিনি বিস্ময়কর ঘটনা উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন নাবিক আলমকে। আবু সাঈদের দক্ষিণ বাহু যেন ঐ নাবিক আলম। জাহাজে সে না থাকলে তিনি যেন বিব্রত হয়ে পড়তেন।
অন্যদিন হলে নীহার আপত্তি তুলে বসতো, হয়তো বলতো, থাক না আব্বা আলমকে না হলে কি তোমার চলে না? কিন্তু আজ সে নিশ্চুপ রইলো বরং আলমকে না হলে এ বিপদ যেন কাটবে না। অন্ধকারে আলম যেন একটি উজ্জ্বল আলো।
বনহুর জাহাজের ইঞ্জিন-ক্যাবিনে ছিলো, কাজেই সে এই অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়নি এবং আলোকরশ্মি সম্বন্ধেও জানতে পারেনি। ইঞ্জিন-ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই এই তীব্র শব্দটা সে শুনতে পেয়ে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, কয়েক মিনিট কান পেতে শুনেছিলো বনহুর স্তব্ধ হয়ে।
আবু সাঈদের পাশে আসতেই তিনি ব্যস্তকণ্ঠে বললেন– আলম, শুনতে পাচ্ছো?
হাঁ স্যার, শুনতে পাচ্ছি।
তোমার কি মনে হয়?
হঠাৎ বলে উঠে নাসের–আপনি একজন অভিজ্ঞ পর্যটক হয়ে একটা অজ্ঞ নাবিককে জিজ্ঞাসা করছেন এসব কথা? ওকি জানে যে বলবে? আমি বলছি–
নীহার নাসেরের কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে, রাগতঃ কণ্ঠে বলে–নাসের সাহেব, আপনাকে তো কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি?
থেমে যায় নাসের, ডেকে অন্ধকারে তাকায় সে নীহারের মুখে ক্রুদ্ধভাবে।
বনহুর বলে–স্যার, আমার মনে হয় শব্দটা কোনো যন্ত্রের নয়।
বলে উঠে নাসের–দেখলেন তো কেমন নিরেট মূর্খ। এমন তীব্র শব্দ তবে কি কোনো মানুষ বাঁশী মুখে নিয়ে ফুঁ দিয়ে করছে?
আবু সাঈদ বললেন–মানুষ তো নয়ই, কিসের শব্দ জানার জন্যই আমাদের আগমন।
বনহুর বললো–স্যার, আমার মতে জাহাজ আজ রাতে এখানেই নোঙর করা উচিত। কাল দিনের আলোতে অগ্রসর হলেই চলবে। কারণ আমরা ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের প্রায় নিকটে এসে পড়েছি।
নাসের মনে মনে কম ভীত হয়নি, তবু মুখে সাহস টেনে বললো–স্যার, এতো দূর অগ্রসর হয়ে মাঝপথে থেমে পড়া মোটেই উচিৎ নয়। আমরা কাপুরুষ নই যে ভয়ে মুষড়ে পড়বো।
নাসেরের বীরত্বপূর্ণ কথায় মৃদু হাসলো বনহুর।
আবু সাঈদ নাসেরের কথায় কান না দিয়ে বললেন–আলম, দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে দেখো আমাদের আর অগ্রসর হওয়া চলবে কি না? দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা বনহুরের হাতে দেন আবু সাঈদ।
আলম আবু সাঈদের হাত হতে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখলো তারপর বললো–স্যার, এক্ষুণি জাহাজ নোঙর করতে হবে। কারণ সম্মুখে আমাদের জন্য নানারকম বিপদ ওৎ পেতে থাকতে পারে।
হাঁ, তোমার কথাই শ্রেয় আলম, জাহাজ নোঙর করতে বলো। নাসের কোনো কথা না বলে চলে গেলো সেখান হতে। বনহুর একবার নীহারের মুখে তাকিয়ে দেখলো তারপর চলে গেলো সে জাহাজে, ইঞ্জিন-ক্যাবিনের দিকে।
জাহাজ ‘পর্যটন’ মাঝ-সাগরে নোঙর করলো।
রাত্রির অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না তাদের অবস্থান-জায়গা হতে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ কত দূর। এখন সেই তীব্র হুইসেলধ্বনি সম্পূর্ণরূপে থেমে গেছে। কিন্তু দূরে বহু দূরে আলোক রশ্মির টুকরোগুলো তখনও অসংখ্য তারার মত ছুটাছুটি করে ফিরছে। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অনেকেই দেখছে এই অদ্ভুত আলোর খেলা।
কিন্তু কতক্ষণ সবাই জেগে কাটাতে পারে, এক সময় যে-যার ক্যাবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
একটা নিভৃত কামরায় তখনও চলেছে নাসের আর জলিলের দলের গোপন আলোচনা। যতক্ষণ আলমকে তারা এই জাহাজ থেকে সরাতে না পেরেছে ততক্ষণ তাদের কোনো শান্তি নেই। বা নেই কোনো কাজে কৃতিত্ব। মালিক সব সময় সব কাজে শুধু ঐ বেটা নাবিক আলমটাকেই ডাকবেন। একেবারে এ ব্যাপারটা অসহ্যনীয় তাদের কাছে। কাজেই ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের বিস্ময়কর এই রহস্য উদ্মাটনের পূর্বেই সরাতে হবে ওকে, নাহলে কোনো কৃতিত্বই তাদের হবে না, সব সুনাম দখল করে নেবে ঐ বেটা নাবিক।
রাত গম্ভীর হতে গভীরতম হয়ে আসে।
জাহাজের সবাই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে। শুধু গোপন সলা-পরামর্শ চলেছে নাসেরের গোপন কামরায়।
নিচের ক্যাবিনে বনহুর আর কেশব ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে বনহুরের নিদ্রা খুব গাঢ় হয়নি, সে একটু তন্দ্ৰামত হয়ে পড়েছিলো।
আবু সাঈদ কিছুতেই ঘুমাতে পারছেন না, তাঁর মনে নানা-রকম চিন্তার উদ্ভব হচ্ছে। তিনি ঐ শব্দ এবং আলোকরশ্মি নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিলেন।
সমস্ত জাহাজ নিস্তব্ধ।
জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন চারিদিক।
ডেকের উপর কয়েকজন খালাসী শুয়ে আছে কম্বলমুড়ি দিয়ে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমন সময় হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো জাহাজের ডেক থেকে। রাত্রির জমাট অন্ধকার যেন সে শব্দে ভেঙে পড়লো খান খান হয়ে।
যে যেদিক থেকে পারলো ছুটে এলো ডেকে, আর্তনাদের শব্দটা যেখান হতে ভেসে এসেছিলো সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালো, সকলের চোখেমুখেই আতঙ্ক–ব্যাপার কি?
আবু সাঈদ এবং নীহার এসেছেন–আবু সাঈদের হস্তে পিস্তল।
ওদিক থেকে নাসের, জলিল এরাও গোপন সলা-পরামর্শ ভুলে লাঠি,শরকী বল্লম নিয়ে বীর পুরুষের মত হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
বনহুর ও কেশব এসে দাঁড়ালো এক পাশে।
সবাই তাকিয়ে দেখলো, ডেকে যে কয়জন খালাসী শুয়েছিলো তারা থর থর করে কাঁপছে, সকলেরই চোখেমুখে ভয়ঙ্কর ভীতি-ভাব। আবু সাঈদ বললেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে–কি হয়েছে তোদের?
খালাসিগণ কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না, কেমন যেন বোবার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে।
ধমক দিলেন আবু সাঈদ–কে আর্তনাদ করেছে?
একজন কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো, ভয়-বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে বার বার তাকাতে লাগলো ডেকের রেলিং পেরিয়ে সাগরের দিকে।
পুনরায় ধমক দিলেন আবু সাঈদ–ওদিকে কি দেখছিস?
কাঁপতে কাঁপতে বললো খালাসিটা–হুজুর, হাতির মত মোটা একখানা হাত—
বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো সবাই, হাতির পায়ের মত মোটা হাত। সকলের মুখ ছাই এর মত বিবর্ণ হলো। সবাই নড়েচড়ে সরে এলো ঘনিষ্ঠ হয়ে।
বললেন আবু সাঈদ –একি বলছিস?
হাঁ হুজুর একটা হাতির পায়ের মত মোটা হাত অন্ধকারে সাগর-মধ্য থেকে উঠে এসে আমাদের একজনকে তুলে নিয়ে আবার ডুব মেরেছে–কথা শেষ না করে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকে লোকটা।
বনহুর লোকটার কাঁধে হাত রাখে–তুমি সঠিক দেখেছো হাতটা?
হাঁ, দেখেছি। অন্ধকার হলেও আমি স্পষ্ট দেখেছি যে, ইয়া মোটা হাত; জমকালো ভূতের মত দেখতে–
এক দন্ডে জাহাজের ডেক ফাঁকা হয়ে গেলো।
কোথায় বা নাসের আর লাঠিয়াল সর্দার জলিল ও তার দলবল, সবাই যে-যার ক্যাবিনে লুকিয়ে পড়ে আত্মগোপন করলো। চাচা-আপন জান বাঁচা নীতি গ্রহণ করলো।
একটু পূর্বে যে নাসের আর জলিল বনহুরের হত্যার পরামর্শ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো এখন তাদের কারো মুখে কথা নেই। যে-যার ক্যাবিনে প্রবেশ করে খিল এঁটে দিলো।
বনহুর আবু সাঈদ ও নীহারকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে এসে খালাসিদের বিভিন্ন ক্যাবিনে শোবার ব্যবস্থা করে দিলো, তারপর ফিরে গেলো সে নিজের ক্যাবিনে। কিন্তু বাকি রাতটা জাহাজের কারো ঘুম আর হলো না।
সকলের মনেই ভয় আর আতঙ্ক, সবার চোখের সামনে ভাসছে বিরাট মোটা জমকালো একটা হাত।
*
পরদিন প্রভাতে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটন জেগে উঠলো। জেগে উঠলো পর্যটনের যাত্রিগণ, কিন্তু সকলেরই মুখ ভয়-বিহ্বল আতঙ্কগ্রস্ত। গত রাতের ব্যাপারটা সবাইকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
আবু সাঈদ স্বয়ং সমস্ত রাত আর ঘুমাতে পারেননি। সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে নীহার, একেবারে কুঁকড়ে গেছে সে। এতোবড় বীর পালোয়ান লাঠিয়াল দল জলিল, শম্ভু, জম্বু এরাও ভয় পেয়েছে ভীষণভাবে।
জাহাজ ‘পর্যটন ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে পৌঁছানোর পূর্বেই এমন অঘটন ঘটবে ভাবতে পারেননি আবু সাঈদ। বিশেষ করে খালাসিগণ মিথ্যা বলেনি, তারা দেখেছে–সত্যিই একটা বিরাট মোটা হাত সাগর-মধ্য হতে উঠে এসে জাহাজের ডেক থেকে একজন ঘুমন্ত খালাসিকে তুলে নিয়ে গেছে।
বনহুরও বাকি রাতটুকু ঘুমাতে পারেনি, গভীরভাবে চিন্তা করেছে–খালাসির ভয়-বিহ্বল কণ্ঠের কথাগুলো নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করে দেখেছে। রাতের ঐ হাতখানা কিসের হাত হতে পারে সেটা? আফ্রিকার জঙ্গলে বনহুর অনেক ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর জীবের কবলে পড়েছিলো। গরিলার লোমশ বাহুও খুব মোটা বটে, তাই বলে সাগরগর্ভে গরিলা বা কিং কং থাকতে পারে না। তবে কি অক্টোপাশের বাহু ছিলো সেটা? বনহুরকে একবার অক্টোপাশের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও তার সাহসী মন শিউরে উঠে। কি সাংঘাতিক কি ভয়ঙ্কর সেই নাগপাশের বন্ধন!
বনহুর আবু সাঈদের পাশে এসে দিনের আলোতে দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে তীক্ষ্ণভাবে দেখতে লাগলো। দূরে অনেক দূরে কচ্ছপের পিঠের মত উঁচু জমকালো বিরাট একটা কিছু নজরে পড়ছে। ঐ কচ্ছপের পিঠের মত জিনিসটাই হলো ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আবু সাঈদ যেখানে দাঁড়িয়ে দূরবীক্ষণ চোখে দেখছিলেন সেই স্থানে জাহাজের প্রায় সবাই। এসে ভীড় জমিয়েছিলো-ব্যাকুল আগ্রহে সবাই দেখছে, সকলের মুখেই গভীর উদ্বিগ্নতার ছাপ।
এতো লোক থাকতে আবু সাঈদ নাবিক আলমকে লক্ষ্য করে বললেন–আলম, এখন কি। আমাদের এগুনো চলে?
বনহুর বললো–হাঁ স্যার, দিনের আলোতে আমাদের ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে অবতরণ করতে হবে।
তাহলে জাহাজ ছাড়ার জন্য বলো—
আচ্ছা স্যার।
হ শোন আলম, তুমি কিন্তু সব সময় আমার সঙ্গে থাকবে, জাহাজের কাজে অন্যান্য নাবিককে লাগিয়ে দাও।
আবু সাঈদ যখন কথা বলছিলেন তখন বনহুরের দৃষ্টি একবার তার অজ্ঞাতেই চলে গেলো নীহারের মুখে, দেখলো নীহার ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বললো বনহুর–আচ্ছা স্যার, তাই থাকবো।
জাহাজ এবার ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ অভিমুখে অগ্রসর হলো। সম্মুখ ডেকে দাঁড়িয়ে স্বয়ং আবু সাঈদ এবং তাঁর পর্যটক সঙ্গিগণ। নাসেরও রয়েছে, সে সব সময় আবু সাঈদের নিকট ঘনিষ্ঠ হয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। তার মনোভাব, ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের নতুনত্ব আবিষ্কারের কৃতিত্বটা। যেন তারই হয়।
আবু সাঈদ কিন্তু নাসেরকে তেমন করে গ্রাহ্যই করছিলেন না। তিনি তাঁর পর্যটকদলকে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যে আলমকেই বার বার এটা-ওটা নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন এবং তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা চলছিলো।
এমন এক অবস্থাতেও আলমের প্রতি নাসেরের ঈর্ষা কমলো না বরং বেড়েই চললো অগ্নিশিখার মত। মুখে-প্রসন্ন থাকার চেষ্টা করলেও মনে মনে কটমট করতে লাগলো হিংস্র শার্দুলের মত।
নীহার কিন্তু পিতার পাশে থেকে নীরবে সব লক্ষ্য করছিলো, যদিও সে আজকাল একেবারে নীরব হয়ে গেছে তবু পিতার সঙ্গ ছাড়া হয় না। কারণ কখন কি বিপদ এসে পড়ে কে জানে! আলমের সেদিনের কথার পর মন ভেঙে গেলেও তার উপর ভরসা কম ছিলো না নীহারের। এ জাহাজে তাদের কোনো বিপদ ঘটলে এক খোদাতায়ালা আর ঐ আলম ছাড়া কেউ যেন রক্ষার নেই। ওকে দেখলেই নীহারের মন যেন স্ফীত হয়ে উঠে। হৃদয়ের নিভৃত কোণে উঁকি দেয় একটা। আশার আলো। এ জাহাজে একমাত্র আলম ছাড়া তাদের আপন জন যেন কেউ নেই।
নীহার ভেবে পায় না, এতো জানার পরও কেন ওকে এতো বিশ্বাস হয়, কেন এত ভাল লাগে। কেনই বা আলমকে পাশে পাবার জন্য মন তার সদা উদগ্রীব থাকে। যতই সে আলমের। সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতে চায় ততই নিজের কাছে নিজেই পরাজিত হয়। একদিন সে মনের সঙ্গে অনেক তর্ক করেছে কিন্তু জয়ী হতে পারেনি। আলমের প্রতিচ্ছবি মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে কিন্তু আরও গভীরভাবে দাগ কেটে বসেছে। ওকে একটিবার দেখার জন্য ক্যাবিনে ছট ফটু করেছে। কিন্তু জোর করে ধরে রেখেছে সে নিজকে।
কিন্তু গত রাতের ঘটনার পর আর পারেনি নীহার ক্যাবিনে আত্মগোপন থাকতে। একরকম বাধ্য হয়েই সে বেরিয়ে এসেছে আলমের সম্মুখে।
সম্মুখে এলেও নীহার কথা বলেনি একটিবারের জন্য আলমের সঙ্গে। ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারেনি, একটি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নীহারের গলা টিপে ধরে।
ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই জাহাজ ‘পর্যটন ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের সন্নিকটে পৌঁছে গেলো।
জাহাজ নোঙর করা হলো দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। ঐ জায়গাটা কিছু সমতল বলে মনে হলো। অবশ্য নাবিক আলমের মত অনুসারেই জাহাজ নোঙর করা হলো। আবু সাঈদ আলমের। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি-কৌশলের জন্য মুগ্ধ হলেন।
জাহাজ নোঙর করার পর সবাই ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে অবতরণ করলো। রাতের অন্ধকারে দ্বীপটাকে কত ভয়ংকর একটা কিছু মনে হয়েছিলো–দিনের আলোতো সব ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেলো। এক এক করে নেমে পড়লো সবাই।
আবু সাঈদ ক্যামেরাম্যান এবং পর্যটকদল সহ ব্যস্তভাবে নেমে পড়লেন, ভুলে গেলেন তখন নীহারের কথা। নীহারও ইচ্ছা করেই চুপচাপ রইলো নিজের ক্যাবিনে।
সবাই অবতরণে ব্যস্ত।
আবু সাঈদ দলবলসহ নেমে গেছেন।
সবাই ভুলে গেলেও বনহুর কিন্তু লক্ষ্য করেছিলো, আবু সাঈদের পাশে নীহার নেই। আলগোছে সে সরে পড়েছিলো কখন, টের পাননি আবু সাঈদ।
বনহুর সোজা নীহারের ক্যাবিনে এসে দাঁড়ালো।
নীহার চেয়ারে বসে তাকিয়েছিলো বাইরের দিকে, পদশব্দে ফিরে তাকালো কিন্তু বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই পুনরায় চোখ দুটোকে মুক্ত গবাক্ষে নিবদ্ধ করলো।
বনহুর আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই–এগিয়ে গেলো নীহারের নিকটে, কাঁধে হাত রাখলো–নীহার, যাবে না?
বনহুর আজ প্রথম তাকে এভাবে স্পর্শ করলো। উপেক্ষা করতে পারলো না নীহার তাকে, নিজের মাথাটা কাৎ করে ওর হাতের উপরে গন্ডটা রাখলো, তারপর বললো–না যাবো না।
আশ্চর্য কণ্ঠে বললো বনহুর–কেন?
নীহার কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করলো।
বনহুর নীহারের চিবুকটা উঁচু করে বললো–একি, তুমি কাঁদছো? নীহারের চোখে পানি দেখে অবাক হলো সে।
নীহার উঠে দাঁড়ালো, নতদৃষ্টি তুলে ধরলো সে বনহুরের মুখে।
বনহুর পারলো না নিজকে সংযত রাখতে, নীহারের চোখের পানি নিজের হাত দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ডাকলো–নীহার।
নীহার হঠাৎ উচ্ছ্বসিতভাবে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বনহুরের বুকে মুখ লুকালো।
বনহুর কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইলো। একি এক সমস্যা তার জীবনে বিপর্যয় শুরু করলো। সে তো কোনো সময় নীহারকে প্রশ্রয় দেয়নি বা তার সান্নিধ্যে আসেনি, যতটুকু পেরেছে ওকে সে প্রথম থেকেই পরিহার করে চলেছে। তবু সে রেহাই পেলো না এই সমস্যা থেকে। বনহুর শান্ত কণ্ঠে বললো–তোমাকে ব্যথা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমাকে ক্ষমা কর নীহার।
আলম–নীহারের ক্রন্দন যেন থামতে চায় না।
বলো? বনহুর স্থির কণ্ঠে বললো।
নীহার বনহুরের হাতের পিঠে নিজের গন্ড রেখে বললো–তোমার দেওয়া ব্যথা আমার জীবনের সম্বল হয়ে থাকবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে শোনা যায় নাসেরের কণ্ঠর নীহার, নীহার–
নীহার দ্রুত হস্তে চোখের পানি মুছে ফেলে সরে দাঁড়ালো।
নাসের এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। নীহারের ক্যাবিনে আলমকে দেখে মুখমন্ডল তার গম্ভীর কঠিন হয়ে উঠলো, চোখ দুটো দিয়ে যেন অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে।
বনহুর একবার নাসেরের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো–আসুন মেম সাহেব।
বনহুর নীহারের অনুরোধেই তাকে নাম ধরে এবং তুমি’ বলে সম্বোধন করতো কিন্তু লোকসম্মুখে নীহারকে ‘মেমসাহেব’ আর ‘আপনি’ বলতো।
বনহুর এক্ষণে এমন ভাব দেখালো সে যেন নীহারকে ডাকতেই এসেছে। নীহারও বললো– চলো আলম।
নাসেরকে সে গ্রাহ্যই করলো না, আলমের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো ক্যাবিন থেকে।
নাসের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর গট গট করে চলে গেলো সে বনহুর আর নীহারের পাশ কাটিয়ে। কোনো কথাই সে আর বললো না তাদের।
নীহারের মন সম্পূর্ণ সচ্ছ না হলেও কিছুটা হাল্কা হয়ে এসেছে, বনহুরের সঙ্গে সে পাশাপাশি অবতরণ করলো ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের বুকে।
দূর থেকে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপটাকে কচ্ছপের পিঠের মত মনে হলেও এখন তারা দেখলো, দ্বীপটা একেবারে ছোট খাটো বা সমতল নয়। বেশ বড় এবং কয়েক মাইলব্যাপী তার পরিধি।
পর্যটকদলসহ আবু সাঈদ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। জাহাজের প্রায় সকলেই দ্বীপে অবতরণ করেছে। নাসেরের দলও বাদ যায়নি।
আলম আর নীহার এগিয়ে যাচ্ছে আবু সাঈদের দলে মিলিত হবার জন্য।
নাসের আর জলিল তাদের হতে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো, বললো নাসের জলিলকে লক্ষ্য করে–ফৌজিন্দিয়া থেকে নাবিক আলম যেন ফিরে যেতে না পারে বুঝেছো?
হাঁ ছোট স্যার সে কথা বলতে হবে না। জলিলের মুখটা যেন প্রতিহিংসায় বিকৃত হয়ে উঠলো। পকেট থেকে একটা ছোরা বের করে মেলে ধরলো–এটা দিয়েই ওকে শেষ করবো।
নাসের পিঠ চাপড়ে দিলো জলিলের।
ততক্ষণ দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে আলম আর নীহার।
নীহার অবাক হয়ে দেখছে সব। উঁচুনীচু আর অদ্ভুত টিলার মত সব জায়গাগুলো। কোথাও গাছ-গাছড়া বা কোনো রকম উদ্ভিদ জন্মেনি এখনও। শুধু বালি আর লালচে মাটির স্তূপ।
বনহুর নিপুণ দৃষ্টি মেলে সব লক্ষ্য করছে আর এগুচ্ছে। শরীরে তার স্বল্পদামী নাবিকের ড্রেস। পায়ে মজবুত বুট, মাথায় নাবিকের ক্যাপ। সকলের অজ্ঞাতে বনহুর পকেটে লুকিয়ে নিয়েছে সেদিনের নাসেরের হস্তচ্যুত সেই রিভলভারখানা। এখনও সেটাতে কয়েকটি গুলীই মওজুদ রয়েছে কারণ একটিও খরচ হয়নি।
নীহার এগুচ্ছে আর এটা-সেটা নিয়ে বনহুরকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে। তাকে আজ বনহুর নতুন রূপে দেখতে পাচ্ছে যেন। এমন সচ্ছভাবে নীহার কোনোদিন আলমের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ পায়নি, কোনো দ্বিধা নেই যেন আজ ওর মধ্যে।
অনেক দিন পর বনহুর নিজেও আজ বেশ আনন্দ উপভোগ করছে নতুন একটা দ্বীপে নতুন। কিছু আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছে সে।
চলতে চলতে হঠাৎ বনহুর মাটির উপর বসে একটা কিছু হাতে উঠিয়ে নিলো, নীহার বললো–ওটা কি আলম?
বনহুর জিনিসটা মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করে বললো “এটা একটা ইটের টুকরা বলে মনে হচ্ছে।
হেসে উঠলো নীহার ওটা এমন আর আশ্চর্যের কি?
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মানুষের বসবাস থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে সাগরবক্ষে নিমজ্জিত এক দ্বীপে মানুষের তৈরি ইটের টুকরা কম আশ্চর্য নয়, নীহার। .
এতোক্ষণে নীহার বনহুরের ভাবান্তরের কারণ কিছুটা উপলব্ধি করলো। নীহার বনহুরের হাত থেকে ইটের টুকরাটা নিয়ে বললো–বহুকাল আগের ইট হবে, দেখছোনা কেমন অদ্ভুত ধরনের তৈরি?
হাঁ, বহুকাল আগের ইটই বটে! কিন্তু এই দ্বীপে ইট এলো কি করে? বনহুর চলতে শুরু করলো।
নীহার ওকে অনুসরণ করছে।
বললো বনহুর চলো এবার তোমার আব্বার কাছে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
কেন, তোমার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
হেসে বললো বনহুর–আমার নয় তোমার হচ্ছে হয়তো। তাছাড়া শুধু অসুবিধা নয় নীহার, তোমাকে এতোক্ষণ না দেখে তোমার আব্বা হয়তো উদ্বিগ্ন হয়েছেন।
চলো তাহলে–বিমর্ষ কণ্ঠে বললো নীহার।
বনহুর বললো দ্বীপটা সত্যি অদ্ভুত।
আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছিলো। কি সুন্দর সকাল, চলো না একটু বসি ওদিকে।
উঁ, কি বললে?
বললাম ঐ উঁচু টিবিটার উপর একটু বসি, পা ধরে গেছে আমার।
বেশ চলো।
বনহুর আর নীহার সামনের উঁচু একটা জায়গা দেখে বসে পড়লো। সেখান থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে নিচে সমুদ্রের ঢেউগুলো ছুটে এসে আছাড় খেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে।
সেদিকে তাকিয়ে বললো নীহার–আলম, তোমার মা-স্ত্রী সন্তান কি জীবিত আছে?
হ তারা জীবিত।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ত্যাগ করে বললো নীহার–আলম, তোমার জননী সৌভাগ্যবতী মা–সত্য তিনি রত্নগর্ভা। আর তোমার স্ত্রী গৌরবান্বিতা নারী, তোমার মত স্বামী যার সে যে বড়। গর্বিতা–
হেসে উঠলো বনহুর নীহার তুমি ভুল বলছো। আমার সান্নিধ্যে যে এসেছে যে শুধু ব্যথা। আর দুঃখই পেয়েছে। তোমাকে সেদিন কি বলিনি আমার মা, আমার স্ত্রী এদের মত ভাগ্যহীনা নারী এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
আলম, আমি বিশ্বাস করি না তোমার একথা। আমি জানি, তুমি কোনোদিন মাকে কষ্ট দিতে পারো না। আমি জানি তোমার মত স্বামী পেয়েও কোনো নারী অসুখী হতে পারে না–
নীহার, তোমার কথা সত্য কিনা আমি জানি না, কারণ কারো মন নিয়ে ভাববার সময় আমার হয় না। আমি যতটুকু জানি, তাতে মনে হয় ওরা কেউ সুখী বা আনন্দিত নয়। জানো নীহার, আমি যার কাছে যখন গিয়েছি একটু আনন্দ নিতে সেই আমাকে উপহার দিয়েছে অশ্রু। অশ্রু ছাড়া আমি কারো কাছে আনন্দ খুঁজে পাইনি। বলো বলো নীহার তাহলে আমি কি করে জানবো তারা আমাকে পেয়ে খুশি বা সুখী।
বনহুরের মুখে তন্ময় হয়ে তাকায় নীহার, তার কথাগুলো ঠিক গভীরভাবে বুঝতে পারেনা।
বনহুর নীহারের মনকে সচ্ছ করার জন্য অন্য কথা পাড়ে–এখানে এভাবে বসে সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়, চলো ওঠা যাক।
চলো! উঠে পড়ে নীহার আর বনহুর।
হঠাৎ পিছন ফিরতেই একটা ফাটল নজরে পড়লো বনহুরের। এগিয়ে গিয়ে ফাটলটার মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো সে, বেশ বড়সড় ফাটলটা। ঠিক কোনো সিঁড়ির ধাপ ছিলো পূর্বকালে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলো, ফাটলটার মুখ বালি আর মাটিতে বন্ধ হয়ে গেছে। বনহুর অনেক্ষণ লক্ষ্য করলো ফাটলটা গভীর মনোযোগ সহকারে, তারপর বললো–নীহার, এ দ্বীপটা। কোনোকালে লোকালয় ছিলো, এই দেখো ফাটলের মধ্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ।
হাঁ, ঠিক সেইরকম মনে হচ্ছে কিন্তু।
চলো দেখি, তোমার আব্বা এবং ওরা নিশ্চয়ই কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
বনহুর আর নীহার চলতে লাগলো।
বনহুরের কথাগুলো এখনও নীহারের কানে ভাসছে যেন।–আমার সান্নিধ্যে যে এসেছে সে শুধু ব্যথা আর দুঃখই পেয়েছে। যার কাছে যখন গিয়েছি এতোটুকু আনন্দ নিতে, সেই আমাকে উপহার দিয়েছে অশ্রু। অশ্রু ছাড়া আমি কারো কাছে আনন্দ খুঁজে পাইনি।–নীহারের মন করুণায় ভরে উঠে, সত্যি আলম বড় অসহায়। কি করে ওকে সুখী করা যায় ভাবতে লাগলো সে। আলম কি পেলে আনন্দ পাবে, কি চায় সে?–
হঠাৎ নীহারের চিন্তাধারায় বাধা পড়ে, কয়েকজন লোক-সহ আবু সাঈদ এদিকেই এগিয়ে আসছেন, আলম আর নীহারকে দেখে তাদের সম্মুখে এলেন, কন্যাকে সম্বোধন করে বললেন এই যে মা এসে গেছো? তবে যে নাসের বললো আলম তোমাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে?
নীহার একবার নাসেরের দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললো–আলম আলম আমাকে নিয়ে যায়নি আব্বা, আমিই আলমকে সঙ্গে করে দ্বীপের ওদিকটা দেখছিলাম।
ও তাই বলো। এসো আলম, হ নতুন কিছু দেখলে ওদিকে?
হাঁ স্যার দেখেছি এবং আমি একটা স্থির সিদ্ধান্তেও পৌঁছেছি।
বলো কি আলম? আমরা এতোদূর অগ্রসর হলেও এখনও এ দ্বীপ সম্বন্ধে কোনোরকম কিছু আবিষ্কারে সক্ষম হলাম না। আচ্ছা বলো দেখি কি ব্যাপার?
স্যার, আমি ওদিকে একটা ইটের টুকরা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।
ইটের টুকরা!
হ্যাঁ স্যার।
নাসের বলে উঠলো–এ আবার এমন কি জিনিস?
বলো কি নাসের, এইরকম মনুষ্যবিহীন দ্বীপে ইটের টুকরা কম কথা।
অন্য একজন বলে উঠলো–কোনো জাহাজ থেকে হয়তো ইটের টুকরাটা দ্বীপে নিক্ষেপ করা হয়ে থাকবে।
নাসের লোকটার কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলোহ, আমারও ঐরকম মনে হয়।
বনহুর নিশ্চুপ রইলো কারণ সে তর্ক ভালবাসে না।
নীহার বললো এবার–শুধু ইটের টুকরাই নয় আব্বা, এই অল্প সময়ে আলম এমন একটা জিনিস আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে যা আপনারা এখনও পারেননি।
আবু সাঈদ হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তমুখে তাকালেন।
বললো নীহার–আরও পরে বলবো, তার পূর্বে তোমরা কি আবিষ্কার করেছো দেখি?
এখনও তেমন কিছু আবিষ্কারে সক্ষম হইনি মা, তবে দ্বীপটা বড় আশ্চর্য এবং অদ্ভুত। কোথাও কোন বন-জঙ্গল বা আগাছা জন্মায়নি আজও। শুধু বালি আর মাটি। হাঁ আজ বেশিক্ষণ এ দ্বীপে বিলম্ব করা উচিৎ নয়।
নীহার এবং আলম সম্পূর্ণ গোপন করে গেলো সেই ফাটলে সিঁড়ির ধাপের কথা।
সেদিন বেশিক্ষণ দ্বীপে বিলম্ব না করে সবাই ফিরে এলো জাহাজে। কারণ নতুন দ্বীপ, তাছাড়া নানারকম বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।
নীহার পিতার নিকটেও কোনোরকম কিছু বললো না। আলম বলেছিলো প্রথমে সে দেখবে ঐ সিঁড়ির ধাপের নিচে কি আছে। কাজেই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ রইলো সে।
দ্বীপে রাতে কিসের আলো দেখা যায়, কিসের শব্দ শোনা যায়, জানার বাসনায় উদগ্রীব রইলো সবাই। দ্বীপের অনতিদূরে জাহাজ নোঙর করে রাখা হলো। গতরাতে একজন খালাসি নিরুদ্দেশ হয়েছে, কাজেই সকলের মনেই আতঙ্ক–আজ রাত কেমন কাটবে কে জানে!
প্রত্যেকেই রাত্রির জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছে।
আবু সাঈদ জানেন, এ দ্বীপে এমন কিছু আছে যার জন্য এ দ্বীপ সম্বন্ধে আজও কেউ সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ নয়। মনের মধ্যে নানারকম চিন্তাধারা নিয়ে রাত্রির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন আবু সাঈদ এবং জাহাজের সবাই।
ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আসতে লাগলো। অজানা দ্বীপটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এলো, জাহাজের ডেকেও নেমে এলো গভীর অন্ধকার।
পর্যটকগণ প্রত্যেকেই যার যার ক্যাবিনে আশ্রয় নিলেন। নাসের আবু সাঈদের পাশে পাশে রইলো তার লাঠিয়াল সর্দার জলিলকে নিয়ে। কারণ কোনো বিপদ দেখা দিলে লাঠিয়াল পাহারাদারগণ যেন তাদের রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে আবু সাঈদের সন্তুষ্টির কারণে মনোযোগী হয়েছে নাসের।
সন্ধ্যার পরই খাওয়া-দাওয়া পর্ব চুকিয়ে নেয় সবাই। আবু সাঈদ সাহেবের নির্দেশে সকলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলো।
রাত বেড়ে আসছে।
সমস্ত জাহাজ নিস্তব্ধ। যার-যার চ্যাবিনে সবাই স্তব্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে, কিন্তু সকলের দৃষ্টিই রয়েছে শার্শীর মধ্য দিয়ে অদূরস্থ দ্বীপটার দিকে। ত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপটা জমাট অন্ধকারে গাঢ় হয়ে উঠেছে।
আবু সাঈদ দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে দেখেছেন, পাশে দাঁড়িয়ে নাসের–তার হস্তেও একটি দূরবীক্ষণ।
জলিল এবং আরও কয়েকজন লাঠিয়াল ক্যাবিনের সম্মুখস্থ ছোট ক্যাবিনটার মধ্যে বসে বসে বিড়ি ফুকছে। ক্যাবিনের দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রেখেছে তাদের লাঠি আর শরকীগুলো।
যে-যার ক্যাবিনের কাঁচের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে দেখছে, দ্বীপের আলোগুলো কখন জ্বলে উঠে।
বনহুর রিভলভার হাতে ক্যাবিন থেকে বাইরে বের হতে যাচ্ছিলো, কেশব পথরোধ করে দাঁড়ালোবাবু, জাহাজের ডেকে একটি প্রাণীও নেই, আমি আপনাকে যেতে দেবো না।
হেসে বললো বনহুর–দ্বীপের রহস্য ভেদ করতে এসে সবাই যদি আমরা ক্যাবিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকি, তাহলে রহস্য উঘাটন হবে কি করে? যেতে দাও কেশব।
তাহলে আমিও যাবো আপনার সঙ্গে?
বেশ তাই চলো। আবু সাঈদ সাহেব তোমাকে দেহ রক্ষার্থে যে বন্দুক দিয়েছেন ওটা তাহলে সঙ্গে নিয়ে নাও।
কেশব এবার খুশি হলো বনহুরের কথায়, সে দ্রুত তার বন্দুকটা নিয়ে বললো–চলুন বাবু।
বনহুর আর কেশব ক্যাবিন থেকে যখন বাইরের ডেকে বেরিয়ে এলো তখন অন্ধকারে কে যেন সম্মুখে এসে দাঁড়ালো তাদের।
বনহুর বললো কে?
আমি! চাপা একটা কণ্ঠস্বর।
তুমি কে?
ফুলমিয়া!
ফুলমিয়া?
হ।
এখানে কি করছিলে?
কিছু না। কেমন যেন সঙ্কোচিত কণ্ঠস্বর।
বনহুর বললো–আমাকে হত্যা করতে এসেছিলে বুঝি?
ফুলমিয়ার গলা থেকে প্রথমে কোনো কথা বের হলো না, অন্ধকারেও তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো, বললো সে–বাবু! বাবু আপনাকে হত্যা করবো আমি! আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন–কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে ফুলমিয়ার।
বলে বনহুর–তবে কি জন্য এসেছিলে ফুলমিয়া?
বাবু, শুধু আজ নয়, আমি রোজ রাতে আপনার ক্যাবিনের দরজায় পাহারা দেই।
হেসে বললো বনহুর–কেন?
বাবু, এ জাহাজে আপনার শত্রুর অভাব নেই।
তা জানি, কিন্তু তুমি—
বাবু ঐ দিন সিঁড়ির মুখ নষ্ট করে দিয়েছিলো ওরা আপনাকে বাঁচানোর জন্যই আমি জেনে শুনে সিঁড়িতে পা দিয়েছিলাম–
বলো কি ফুলমিয়া!
হ বাবু, আমাদের লাঠিয়াল সর্দার ছোট স্যারের যুক্তিতে আপনার পিছু লেগেছে।
সব জানি, তোমাকে বলতে হবে না ফুলমিয়া। যাও এভাবে বাইরে থাকা তোমার কোনোমতেই ঠিক নয়। হঠাৎ কোনো বিপদ ঘটতে পারে।
ফুলমিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বনহুর বললো–চলো তোমার ক্যাবিনে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি, রাত দুটো বেজে গেছে, বাইরে কেউ নেই।
ফুলমিয়াকে ক্যাবিনে রেখে ফিরে চললো বনহুর আর কেশব। নির্জন ডেকে একটিও জনপ্রাণী নেই, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্যাবিনে আত্মগোপন করে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে।
সাগরবক্ষ অমাবস্যার অন্ধকারের মতই কালো। ডেকের উজ্জ্বল আলোকরশ্মিও কেমন নিষ্প্রভ স্নান লাগছে।
বনহুর আর কেশব পাশের ডেকে এসে দাঁড়ালো, বনহুরের হস্তে রিভলভার আর কেশবের হাতে বন্দুক। ডেকে দাঁড়িয়ে তাকালো তারা দুজন ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের দিকে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো বনহুর আর কেশব। দেখতে পেলো, কতকগুলো নীলাভ আলোর বল দ্বীপটার বুকে। ছুটোছুটি করছে।
কেশব ভীতকণ্ঠে বললো–বাবু, ভূতের আলো—
বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে সত্যি আলোগুলো যেন কোনো অদৃশ্য হস্তের উপর নড়াচড়া করছে। আলোগুলো আকারে ছোটবড় অনেক রকম কিন্তু প্রায় সবগুলোই নীলাভ।
এই তো ঘন্টাকয়েক আগেও তারা ঐ দ্বীপে বিচরণ করে ফিরেছে কিন্তু কোথাও তো কিছু দেখতে পেলো না।
বনহুর যখন ডেকে দাঁড়িয়ে আলোর খেলা দেখছে তখন কেশব ভয়বিহ্বল কণ্ঠে বললো বাবু, বাইরে থাকবেন না।
বললো বনহুর–কেন?
বাবু, ভূতেরা অশরীরী–ওদের আমরা দেখতে না পেলেও ওরা আমাদের ঠিক দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ এদিকে এসেও পড়তে পারে।
হাতে অস্ত্র থাকতে কোনো ভয় নেই কেশব।
বাবু, অস্ত্র ভূতের কিছু করতে পারে না, ওদের তো দেহ নেই। দেখছেন না আলোগুলো কেমন শূন্যের উপর যেন নেচে বেড়াচ্ছে। দেহ থাকলে তো গুলী ছুঁড়বেন?
বেশ চলো, তোমার যখন এতো ভয়! বনহুর কথাটা বলে ফিরে দাঁড়াতেই দু’জন লোক এসে দাঁড়ালো তার পাশে। একজন বললো–স্যার আপনাকে ডাকছেন।
বনহুর বুঝতে পারলো, দ্বীপের আলোকরশ্মির ব্যাপারেই তাকে ডাকছেন আবু সাঈদ, বললো–চলো।
কেশব বললো–বাবু, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে।
বেশ চলো। বনহুর অগ্রসর হলো।
বনহুরের পিছনে চললো কেশব আর ঐ লোক দু’জন।
কেশব যেমন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে তেমনি লোক দু’টিও ভয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে যেন, মুখে। যেন কারো কথা সরছে না। মালিকের হুকুম বলেই লোক দু’টি এই ভীতিকার মুহূর্তেও বাইরে বেরিয়ে এসেছে আলমকে ডাকতে। কোনোরকমে পৌঁছতে পারলে তবে হয়। লোক দুটি এবং কেশব বার বার ভয়াতুর দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছিলো দূরে দ্বীপের বুকে আলোর বলগুলোর দিকে। এখন আরও বেড়ে গেছে যেন।
বনহুর কেশব, আর লোক দু’জন আবু সাঈদের ক্যাবিনে এসে হাজির হলো।
আবু সাঈদ কক্ষমধ্যে উদ্বিগ্ন মুখে পায়চারি করছেন। অদূরে কাঁচের শাশীর পাশে দাঁড়িয়ে নীহার এবং আরও বেশ কয়েকজন লোক। তাদের মধ্যে নাসেরও আছে দেখতে পেলো বনহুর। নাসেরের মুখেও ভীতির ভাব। কেমন যেন বিবর্ণ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে সবাইকে।
বনহুর, কেশব আর লোক দু’টি ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই আবু সাঈদ দাঁড়ালেন, এগিয়ে এলেন বনহুরের পাশে–দেখেছো আলম?
বললো বনহুর–হ্যাঁ স্যার।
কিসের আলো বলে তোমার মনে হয়?
বনহুর কিছু বলবার পূর্বেই বলে উঠে কেশব–স্যার, ওগুলো ভূতের আলো ছাড়া কিছু নয়। দেখছেন না আলো গুলো কেমন শূন্যের উপর নড়াচড়া করছে। ভূত অশরীরী কিনা, তাই ওদের দেখা যায় না, শুধু ওদের মুখের আগুন দেখা যায়।
নীহার তো পিতার পাশে কুঁকড়ে দাঁড়িয়েছে, ভয়ে বিবর্ণ তার মুখমন্ডল। কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয়ের জন্য মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে সে নাবিক আলমের মুখে। ভূতের নামে তার হৃদকম্প শুরু হয়েছে, দেহটাও কাঁপছে বলে মনে হচ্ছে।
নাসেরের মুখেও অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে। সেও ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে তাদের পাশে।
আবু সাঈদ বললেন–বাজে কথা, ভূত বলে কিছু নেই।
বললো বনহুর–স্যার, ভূত না থাকলেও এমন কোনো জিনিস ঐ দ্বীপে আছে যাদের শক্তি ভূতের শক্তির চেয়েও বেশি।
বনহুর কথাটা এমন করে বললো যাতে কক্ষমধ্যে সকলের মনে ভীতি-ভাবটা আরও দৃঢ় হয়।
আবু সাঈদ বললেন–তবে কি কোনো–
হাঁ স্যার, কোনো অশরীরী আত্মা ছাড়া এমন আলো কে জ্বালতে পারবে বলুন? দেখছেন না আলোগুলো কেমন নীলাভ?
আবু সাঈদ আলমের মুখে কথাটা শুনে একটু হকচকিয়ে গেলেন, কারণ তিনি কোনো ভূত প্রেত বা অশরীরী আত্মা বিশ্বাস করেন না। শুধু আবু সাঈদ কেন, ক্যাবিনে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা এসব কোনোদিন কানেও নেননি বা নেন না। নাসেরের তো কোনো কথাই নেই, সে কোনোদিন কোনো সময় এসব বিশ্বাস করে না। আজ এমন এক মুহূর্তে কথাটা তাদের কানে গেলো যখন তারা দিনকে রাত আর রাতকে দিন বললেও বিশ্বাস করে বসতো।
আলমের কথায় কারো মুখে কোনো উক্তি উচ্চারণ হলো না। সবাই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে কোনো এক ক্যাবিনের মধ্য হতে ভেসে এলো তীব্র ভয়ার্ত একটা আর্তনাদ। পরক্ষণেই পরপর বন্দুকের আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো-বাচাও বাঁচাও গেলো গেলো–
ভয়ে থর থর করে কাঁপছে সবাই, এমনকি আবু সাঈদের মুখমন্ডলও ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।
নাসের এবার বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার মুখও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
বনহুর কান পেতে শুনছিলো, বললো–নিশ্চয়ই গত রাতের সেই হস্ত আজ আবার কাউকে টেনে নিয়ে গেছে–
আবু সাইদ আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন–একি আজগুবি কান্ড শুরু হলো আলম?
তাই তো ভাবছি স্যার। পরক্ষণেই বনহুর পা বাড়ালো ক্যাবিনের দরজার দিকে–স্যার দেখে আসি–
আবু সাঈদ বাধা দিলেন–আলম, এখন যেও না। যেও না বাইরে—
বনহুর আবু সাঈদের নিষেধ শোনার জন নয়, তার ধমনির রক্ত তখন উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
নীহার হঠাৎ আচমকা ধরে ফেললো বনহুরের জামার পিছন অংশটা–আলম, যেও না।
এবার বনহুর দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো, ফিরে দাঁড়িয়ে বললো–বাধা দিবেন না মেম সাহেব। ছেড়ে দিন আমাকে।
না না, তুমি যেও না আলম। বললেন আবু সাঈদ।
নীহার বনহুরের জামার অংশ আরও দঢ়হস্তে চেপে ধরলো–আমি তোমাকে যেতে দেবো না।
রাগতকণ্ঠে বললো বনহুর-সমস্ত মাটি করে দিলেন আপনারা! আবু সাঈদের দিকে লক্ষ্য করে বললো আবার –এতো ভীতু হলে কোন রহস্যই উঘাটন হবে না। ছেড়ে দিন আমাকে–
নীহারের শিথিল হাতখানা আস্তে খসে এলো, বনহুরের জামার অংশ মুক্ত হওয়ায় সে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। কেশবও অনুসরণ করলো বনহুরকে।
আবু সাঈদ নাসেরকে লক্ষ্য করে বললেন–যাও নাসের, জলিলকে বলো লাঠিয়ালদের সবাইকে নিয়ে আলমের সঙ্গে যেতে–
নাসের ভয়-বিহ্বলভাবে তাকলো লাঠিয়াল সর্দার জলিলের দিকে।
জলিল বললো–স্যার, এ সব ভূতের ব্যাপার, লাঠিতে কিছু হবে না—
ধমক দিলেন আবু সাঈদ –যাও, কোনো কথা বাড়িও না।
অগত্যা জলিল আবু সাঈদের ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেলো, সম্মুখের একটা ক্যাবিনে অপেক্ষা করছিলো তার দলবল, মালিকের হুকুম–না গেলেও নয়। জলিলের দল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বের হলো বটে কিন্তু এক পা এগোেয় তো তিন পা পিছোয়।
ওদিকে বনহুর আর কেশব দ্রুত পৌঁছে গেলো যেদিক থেকে আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছিলো সেইদিকে।
নিকটে পৌঁছতেই বিস্মিত হলো বনহুর–একটা ক্যাবিনের ভিতর হতেই আর্তনাদের শব্দ বেরিয়ে আসছিলো। বনহুর ক্যাবিনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলো–দরজা খোল, দরজা খোল
অনেক ডাকাডাকির পর দরজা খুলে গেলো।
বনহুর আর কেশব ভিতরে প্রবেশ করে প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না, জিজ্ঞাসা করলো সে–কি হয়েছে?
হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো একজন –ঐ দেখো, ঐদিকের শার্শী ভেঙে একজনকে নিয়ে গেছে। সেকি ভয়ঙ্কর মোটা কালো একখানা হাত–
বলো কি, হাত?
অন্যান্য সবাই বললো এক সঙ্গে–হাঁ ঠিক হাতের মত।
অন্য একজন ভীতকণ্ঠে বললো–হাতের মত কিন্তু হাত নয় ভাই, হাতির শুড়ের মত দেখতে
আর একজন বললো–যেমন মোটা তেমনি কালো।
ওদিকে একজন ঠক ঠক করে কাঁপছিলো সরে এলো সামনে ভাই আমি স্পষ্ট দেখেছি, দুটো চোখ আছে–যেন আগুনের গোলা–ওরে বাবা, ভাগ্যিস আমাকে তুলে নেয়নি বাচ্চু ঠিক আমার পাশেই শুয়েছিলো ওকে ধরে নিয়েই সড় সড় করে বেরিয়ে গেলো সুড়টা ভাঙা শাশী দিয়ে–
প্রথম ব্যক্তির হস্তে বন্দুক ছিলো সে বললো–আমি তাড়াতাড়ি গুলী ছুঁড়লাম, কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চুকে নিয়ে শুড়টা অন্ধকারে পানির মধ্যে তলিয়ে গেছে–
বনহুর দ্রুত ভাঙ্গা শার্শীর মধ্য দিয়ে ঝুঁকে পড়লো কিন্তু গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে পড়লো না।
ততক্ষণে আবু সাঈদ আরও কয়েকজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে ভয়চকিত চিত্তে হাজির হলেন, তাঁর পিছনে নাসের এবং জলিলসহ লাঠিয়ালগণ।
সব শুনলেন এবং দেখলেন আবু সাঈদ। বাচ্চু নাবিকদের একজন ছিলো, দক্ষ কর্মঠ নাবিক ছিলো সে।
আবু সাঈদ একেবারে যেন বিহ্বল হয়ে পড়লেন। অন্যান্য সকলের মনেই ভয় আর আতঙ্ক না জানি কোন মুহূর্তে কার মৃত্যু ঘটতে পারে!
খালাসি এবং নাবিকদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিলো, তারা আর এ দ্বীপে একটি দিনও থাকতে রাজি নয়। পয়সার জন্য তারা জীবন দিতে পারবে না। হতো যদি কোনো অসভ্য জংলী বা বাঘ ভলুকের আক্রমণ তবু তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতো এবং লড়াই করে তবে মরতো। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর মৃত্যু তারা গ্রহণ করতে চায় না।
আজকের রাতটাও কাটলো নানা উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। সমস্ত রাত কেউ ঘুমাতে পারলো না।
ভোর হতেই সবাই ধরে বসলো, এবার তারা ফিরে যেতে চায়। গত প্রভাতে একজনকে হারিয়েও খালাসিদের মনে ছিলো অফুরন্ত উৎসাহ আর আজ ঠিক তার বিপরীত–সবাই মুখ। কালো করে ফেলেছে, কেউ আর দ্বীপে অবতরণে সম্মত নয়।
আবু সাঈদ হৃদয়ে এতোদিন যে একটা চুড়ান্ত জানার বাসনা নিয়ে বিপুল আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলেন, সব যেন আজ প্রভাতে নিঃশেষ হয়ে যায়। খালাসি এবং নাবিকদের নিরুৎসাহ ভাবভঙ্গী তাকে একেবারে হতোদ্যম করে দেয়। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন, তাঁর আদেশও অমান্য করেছে আজ তার বিশ্বস্ত কর্মচারিগণ।
বেলা বেড়ে আসছে। ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন আবু সাইদ, এখন কি করবেন–এতোদূর এসে এতো অর্থব্যয় করে শেষ পর্যন্ত বিফলকাম হয়ে ফিরে যাবেন! শুধু অর্থব্যয়ই নয় পথে অনেক বিপদ-আপদ গেছে কয়েকটি জীবনও বিনষ্ট হয়েছে, এতো হওয়ার পর ফিরে যাওয়া কেমন যেন একটা চরম পরাজয়–চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন আবু সাঈদ।
আবু সাঈদ যতই মুষড়ে পড়ছেন ততই জাহাজে কর্মচারীবৃন্দ বেঁকে বসছে, কেউ আর একটি দিন এ দ্বীপে রাত্রি কাটাতে রাজি নয়।
শেষ পর্যন্ত আবু সাঈদ প্রচুর অর্থের লোভ দেখালেন, যা টাকা তাদের দেওয়া হয় তার দ্বিগুণ পরিমাণ দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুতেই তারা এ দ্বীপে অবতরণে সম্মত হলো না।
আবু সাঈদ যখন হতাশায় ভেঙে পড়েছেন তখন বনহুর তার পাশে এসে দাঁড়ালো–স্যার, ভাববেন না! চলুন আমি যাবো আপনার সঙ্গে।
আলম!
হাঁ স্যার। আর যতদিন আমাদের সন্ধান-কার্য শেষ না হবে ততদিন জাহাজ এ দ্বীপেই থাকবে।
আবু সাঈদ কথাটা ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেন জাহাজের সবাইকে।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত খালাসি এবং নাবিকগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠলো, সবাই দল বেঁধে এসে দাঁড়ালো। আবু সাঈদের ক্যাবিনের সম্মুখে, সমস্বরে বললো সবাই আমরা আর এক দিনও এ দ্বীপে অবস্থান করতে রাজি নই।
আবু সাঈদ অসহায়ভাবে তাকালেন বনহুরের মুখের দিকে, বললেন–এখন উপায়?
নীহারও পিতার পাশে পঁড়িয়েছিলো এখন তাদের একমাত্র ভরসা যেন নাবিক আলম। জাহাজের সকলের মুখই ভয়-বিহ্বল, এমন কি আবু সাঈদের সঙ্গী-সাথী যারা এতোদিন তার একান্ত বন্ধু হিসাবে পর্যটন জীবনের সহচর ছিলেন তাঁরাও সবাই কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, কারো মনেই যেন আর উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। সবাই আবু সাঈদের কথায় অমত জানিয়ে ফিরে যাবার বাসনা জানাচ্ছেন কারণ সকলেরই তো স্ত্রী-পুত্র-সন্তান-সন্ততি আছে, কে এভাবে মরতে চায়? চারিদিকে যখন নিরুৎসাহের চরম অবস্থা, তখনও নাবিক আলমের মুখ দীপ্ত ভয়শূন্য; ঠিক পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক।
শুধু নীহারই নয় স্বয়ং আবু সাঈদ পর্যন্ত তাকে যত দেখেন ততই বিস্মিত হন, সত্যি এমন ব্যক্তি তিনি খুব কমই দেখেছেন। শত বিপদেও যার মধ্যে কোনোরকম ভাবান্তর পরিলক্ষিত হয় না। নির্ভীক যুবক এই আলম।
আবু সাঈদের প্রশ্নে জবাব দিলো বনহুর–স্যার, বিচলিত হবেন না। আমি সবাইকে ঠান্ডা করে নিচ্ছি।
বনহুর ক্যাবিনের বাইরে বেরিয়ে এলো।
জাহাজের প্রায় কর্মচারী–খালাসি হতে নাবিক, ক্যাপ্টেন সবাই এসে জড়ো হয়েছে, সবাই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে–আর তারা এ দ্বীপে বিলম্ব করতে চায় না।
বনহুর এসে দাঁড়ালো সবার মধ্যে।
এ জাহাজে একমাত্র নাসের এবং জলিলের দলের কয়েকজন সঙ্গী ছাড়া সবাই আলমকে গভীরভাবে ভালবাসতো এবং সমীহ করতো। বনহুর এসে দাঁড়াতেই ক্ষণিকের জন্য সবাই স্তব্ধ। হলো, উন্মুখ হৃদয় নিয়ে তাকালো তার দিকে।
বনহুর শান্ত-ধীর-স্থির কণ্ঠে বললো-”ভাইগণ, আমরা যে অবস্থায় উপনীত হয়েছি তাতে ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। মৃত্যু ভয় কার না আছে! কিন্তু মৃত্যু প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই অবশ্যম্ভাবী। জন্মালে মরতে একদিন হবেই, কাজেই মৃত্যু-ভয়ে অত্যন্ত কাতর হওয়া আমাদের কোনো সময় সমীচীন নয়।
সবাই এক সঙ্গে বলে উঠলো–আলম ভাই, আমরা আর কোনো কথাই শুনতে রাজি নই।
বললো বনহুর–দেখো আমি জানি এবং নিজেও বেশ উপলব্ধি করছি, এ দ্বীপটা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল একটা ভয়ঙ্কর জায়গা। কিন্তু আমরা কাপুরুষ নই–আমরা যে কারণে বা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ দ্বীপে এসেছি সে কাজ আমাদের সমাধা করা একান্ত কর্তব্য। এর চেয়েও যদি ভয়াবহ স্থানে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন হয় তাই যেতে হবে। নূতন কিছু আবিষ্কার করতে হলে বিপদ-আপদ আসবেই–ভয়ঙ্করকে জয় করাই হলো পুরুষোচিত কাজ। বন্ধুগণ, আমার অনুরোধ, তোমরা মৃত্যু ভয়ে কাতর না হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে শেখো। মরতে যখন একদিন হবেই তখন ভয় কি মরণে–
বনহুরের দীপ্ত গম্ভীর কথাগুলো শুনে অনেকের মনেই পরিবর্তন আসছিলো কেউ কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ শুনতে লাগলো। আলম যা বলছে, মিথ্যা নয় একটি বর্ণও।
বলে চলেছে বনহুর তখনও ঠিক তার পিছনে কখন যে আবু সাঈদ আর নীহার এসে দাঁড়িয়েছেন বনহুর বুঝতে পারেনি। আবু সাঈদ আর নীহারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে–সামান্য একজন নাবিক বৈতো কিছু নয় আলম, কিন্তু তার মধ্যে এতো বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ভাব! তাদের চোখেমুখে বিস্ময়ভাব ফুটে ওঠে।
বনহুর বলে চলেছে–কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করে সেকাজ যদি সমাধা না কর তাহলে তৃপ্তি কোথায়? কাজেই আমাদের মন থেকে ভয়-ভীতি আতঙ্ক মুছে ফেলতে হবে। দুর্দমনীয় সাহসে বুক বাঁধতে হবে। দেখতে হবে এর শেষ কোথায় এবং কি? ভাইগণ, তোমরা কোন্ মনে ফিরে যেতে চাও? যে শত্রু তোমাদের বন্ধু-সাথীদের এমন নির্মমভাবে নিহত করেছে তোমরা চাও না কি তার প্রতিশোধ নিতে?
এবার প্রায় অর্ধেকের বেশি লোক বলে উঠে–চাই, প্রতিশোধ চাই আমরা–
বনহুর আনন্দধ্বনি করে উঠে–সাবাস! তাহলে তোমরা সবাই এসো আমার সঙ্গে। মৃত্যুকে আমরা জয় করে আমাদের বন্ধুদের হত্যাকারী সেই অদ্ভুত জীবকে আবিষ্কার করি। বলো– তোমরা আমাকে সাহায্য করতে রাজি আছো?
এক সঙ্গে বললো এবার সবাই রাজি!
মরতে যদি হয় মরবে?
হাঁ মরবো!
বনহুরের মুখে অদ্ভুত এক আনন্দের দ্যুতি খেলে যায়। আবু সাঈদ তার পিঠ চাপড়ে বলেন– আলম, তোমাকে আমি কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
বনহুর বললো–স্যার, এতে ধন্যবাদ জানাবার কিছু নেই, এখন চলুন দ্বীপে অবতরণের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিন।
চলো আলম, তাই চলো।
নীহার বনহুরের সম্মুখে এগিয়ে এলো, দু’চোখে কৃতজ্ঞতার আভাস। মুখে কিছু না বললেও অন্তরে শ্রদ্ধা জানালো সে মনে মনে।
আর কেউ না বুঝলেও বনহুর বুঝলো নীহারের মনের কথা। বনহুর একটু হেসে বললো– মেম সাহেব, আপনিও নামবেন তো?
হাঁ, আমিও নামবো। বললো নীহার।
বনহুর এবার সমস্ত নাবিক এবং খালাসিকে নিয়ে দ্বীপে অবতরণ করলো। আবু সাইদ আর তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ কেউ বাদ রইলো না। অগত্যা নাসের জলিলের দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে নেমে পড়লো ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের উপর।
বনহুর আর নীহার আজ আবু সাঈদকে প্রথমেই সেই স্থানটিতে নিয়ে হাজির করলো, তাঁকে দেখালো গতদিন যে ফাটলটার মধ্যে তারা সিঁড়ির ধাপের মত কিছু আবিষ্কার করেছিলো।
আবু সাঈদের আনন্দ আর ধরে না, তিনি জড়িয়ে ধরলেন বনহুরকে–আলম, তুমি সত্যিই একজন জ্ঞানবান লোক। তোমার জন্য এতো সহজে আমি কৃতকার্য হতে চলেছি।
বনহুর শ্রমিকদের নিয়ে সিঁড়ির ধাপটির খননকার্যে আত্ননিয়োগ করলো। অন্যান্য শ্রমিকদের বিভিন্ন স্থানে খননকাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো।
আবু সাঈদ নিজেও একটি শাবল নিয়ে এখানে-সেখানে মাটিতে আঘাত করতে লাগলেন।
সমস্ত দ্বীপময় চললো নানাভাবে গবেষণা।
অনেক স্থান খনন করে ইট-পাথর বা ঐ ধরনের কিছু কিছু পাওয়া গেলো। আবু সাঈদের বিস্ময়ের অন্ত নেই, তিনি মনোযোগ সহকারে সব লক্ষ্য করে চলেছেন।
বনহুর শ্রমিকদের নিয়ে ফাটলটা খনন করে চলেছিলো। অল্পক্ষণেই দেখা গেলো, সেটা কোনো দোতলায় উঠার সিঁড়ির ধাপ।
একজন শ্রমিক এসে জানালো, প্রায় মাইলখানেক দূরে মাটির নিচে একটি দালানের ছাদের কিছুটা অংশ দেখা গেছে।
আবু সাঈদ এবং বনহুর চললেন সেই জায়গাটায়।
অল্পক্ষণেই আজ তারা আবিষ্কারে সক্ষম হলো–এ দ্বীপটা কোনো এক ডুবন্ত নগরী। একদিন এখানে ছিলো অসংখ্য লোকের বাস। কালক্রমে সেই নগরী সাগরবক্ষে নিমজ্জিত হয়েছিলো এবং সেই নগরীর লোকজন সবাই জলের অতলে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলো।
সেদিন বেশি কিছু আবিষ্কার না হলেও দ্বীপের আসল অস্তিত্ব খুঁজে পেলো তারা। সবচেয়ে আনন্দে আপ্লুত হলেন আবু সাঈদ। তার এতো শ্রম সার্থক হলো। ফৌজিন্দিয়া দ্বীপটা যে একটি ডুবন্ত শহর বা নগর তাতে কোনো সন্দেহ রইলো না। এই দ্বীপের তলায় আছে অসংখ্য দালান কোঠা আর ইমারত। কিন্তু রাতের বেলায় এতো আলোর খেলা হয় কি করে? এবং গভীর রাতে ট্রেনের হুইসেলের মত কিসের শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয়। এসব রহস্য রয়ে গেলো অজ্ঞাত। বেলা পড়ে আসতেই সবাই ফিরে এলো জাহাজে।
আজ জাহাজের নিচের ডেকে কেউ থাকবে না বলে জানানো হলো এবং জাহাজ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে নোঙর না করে গভীর সাগরবক্ষে ভাসমান অবস্থায় থাকবে।
সেইমতই কাজ হলো, বনহুর নিজে জাহাজ চালনা করে এমন এক জায়গায় জাহাজ নোঙর করলো যেখানে কোনো রকম বিপদের আশঙ্কা রইলো না।
জাহাজের কোনো শ্রমিক, নাবিক বা খালাসি নিচের ডেকে বা ক্যাবিনে রইলো না। সবাইকে উপরের ক্যাবিনে রাখা হলো এবং সাবধানে প্রত্যেকটা জানালার শাশী আটকে দেওয়া হলো।
এতো সাবধানতা সত্ত্বেও সকলেরই মনে ভয় আর আশঙ্কা না জানি আজ আবার কার মৃত্যু ঘটতে পারে–কে জানে।
আবু সাঈদ আর নীহারের অনুরোধে বনহুর আর কেশব তাদের ক্যাবিনে রয়েছে। কারণ নীহার অত্যন্ত ভয় পেয়েছে, সে কিছুতেই শয্যা গ্রহণ করতে পারছিলো না।
রাত হয়।
সমস্ত জাহাজ নিস্তব্ধ।
কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
প্রত্যেকটা ক্যাবিনে সবাই জেগে, সকলেরই মনে উৎকণ্ঠা কখন কি ঘটে!
বনহুর আর কেশবকে বসিয়ে আবু সাঈদ আলাপ-আলোচনা করছিলেন।
নীহার জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ কদিন তার ঠিকভাবে ঘুম নেই, হাজার হলেও মেয়েমানুষ তো নেতিয়ে পড়েছে একেবারে।
যতই ভীত এবং আতঙ্কগ্রস্ত হোক, বেশিক্ষণ নিস্তব্ধ থাকায় সকলেরই কেমন যেন প্রচন্ডভাবে দুলে উঠলো।
মুহূর্তে জাহাজের মধ্যে একটা আর্তগুঞ্জনধ্বনি ফুটে উঠলো যে যেখানে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো সবাই জেগে উঠেছে তৎক্ষণাৎ। নীহারও বিছানা হতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলো, জেগে উঠে আঁকড়ে ধরলো খাটের ধারটা।
আবু সাঈদ এবং বনহুর সজাগ হয়ে রিভলভার বাগিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই ভয়বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে এ-ওর দিকে।
নীহার পিতাকে আঁকড়ে ধরলো-আব্বা!
ভয় নেই মা, ভয় নেই–কন্যাকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে লাগলেন আবু সাঈদ।
জাহাজখানা খানিকক্ষণ ভীষণভাবে দুলতে লাগলো। তারপর একবার একেবারে সম্পূর্ণ কাৎ হয়ে যাবার মত হলো। এইবার বুঝি আর রক্ষা নেই, জাহাজটা এবার ডুববে।
কিন্তু পরক্ষণেই জাহাজ একটা ঝাঁকি খেয়ে সোজা হয়ে গেলো। আর নড়ছে না জাহাজটা।
ক্রমে জাহাজের অভ্যন্তরে ভয়-বিহ্বল আর্তনাদ থেমে এলো। জাহাজের ক্যাপ্টেন মাইকে বার বার ঘোষণা করছেনঃ কেউ যেন ক্যাবিনের বাইরে বের না হয়।
জাহাজখানা স্থির হলেও মনে হলো, সাগরের ঢেউ-এর উপর যেন ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছে।
বনহুর দ্রুত ক্যাবিনের শাশীর পাশে গিয়ে সাগরের জলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো। কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
কয়েক মিনিট পর হঠাৎ সেই হুইসেলের তীব্র শব্দ। কানফাটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ। যেন। জাহাজের অনতিদূরে কোথাও ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে।
জাহাজের সবাই কানে হাত-পা চাপা দিয়ে কাঁপতে লাগলো। এবার আর রক্ষা নেই, জাহাজের সঙ্গে বুঝি ট্রেনের সংঘর্ষ হবে।
নীহার আর্তকণ্ঠে ডাকলো–আলম এসো–সরে এসো, আমার বড় ভয় করছে—
বনহুর শান্ত এবং চাপা স্বরে বললো–ভয় নেই, এখানে কেউ আসতে পারবে না।
আবু সাঈদের মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
আজকের রাতটাও এভাবেই কাটলো। কারো চোখে ঘুম এলো না। ভোর হলো যখন তখন। সবাই ঢলে পড়লো নিদ্রার কোলে কারণ আজ রাতে কেউ মারা পড়েনি।
বনহুর কখন নিদ্রিত হয়ে পড়েছিলো হঠাৎ জেগে উঠলো সে। ইচ্ছা করেই সে নিদ্রাকে ঠেলে দিয়ে হাই তুলে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো। বনহুর চেয়ারে বসতেই নিজের কাঁধে একটা কোমল কিছুর স্পর্শ অনুভব করলো।
রাতে যখন হুইসেলের ধ্বনি হচ্ছিলো তখন নীহার ভয় পেয়ে তাকে নিকটে এসে বসার জন্য। বার বার বলছিলো। আবু সাঈদও বলেছিলেন খাটের পাশে এসে বসতে। অগত্যা বনহুর নিজের চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসেছিলো এসে খাটের পাশে।
একি, নীহার কখন যে বনহুরের চেয়ারের পাশে মাথা রেখে এমন করে ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানে না। কখন যে তার মাথাটা গড়িয়ে চলে এসেছে বনহুরের কাঁধের ধারে তাও টের পায়নি। বনহুর দেখলো নীহারের গন্ডটা ঠিক তার চিবুকের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে ললাটে।
বনহুরের সমস্ত দেহে একটা অনুভূতি নাড়া দিয়ে গিলো। হঠাৎ সে নীহারের মাথাটা সরিয়ে দিতে পারলো না। আস্তে তার ঠোঁট দু’খানা স্পর্শ করলো নীহারের শুভ্র গন্ডটার উপর। পরক্ষণেই বনহুরের সম্বিৎ ফিরে এলো, নীহারের মাথাটা সাবধানে নামিয়ে রেখে সোজা উঠে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখলো বৃদ্ধ আবু সাঈদ খাটে ঠেস দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। কেশবও তার চেয়ারে বসে বসে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে হয়তো।
বনহুর রিভলভারটা পকেটে রেখে বেরিয়ে এলো বাইরে।
*
আজ রাতে নানারকম ভয়ঙ্কর কিছুর উদ্ভব ঘটলেও কোন প্রাণনাশ ঘটেনি। আবু সাঈদ আশ্বস্ত হলেন–আজকের সাবধানতা তাহলে ব্যর্থ হয়নি। এজন্য বারবার ধন্যবাদ দিলেন তিনি নাবিক আলমকে। কারণ তার পরামর্শেই আবু সাঈদ এভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সকলের মনে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক থাকলেও কেউ দ্বীপে অবতরণ নিয়ে আজ কোনো রকম মতবাদ করলো না। সবাই দ্বীপে নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য উদগ্রীব হয়ে কাজ করে চললো।
বেশ কিছু সময়ের মধ্যে দ্বীপটার ভিতর হতে বেরিয়ে এলো নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসপত্র আর নানারকম দালান-কোঠার ভগ্নাংশ।
এককালে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপটা যে মস্তবড় একটা শহর ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ রইলো না।
বনহুর নিজেও আবু সাঈদের সঙ্গে গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করলো। যতই মৃত্তিকা খনন করে চললো ততই দ্বীপটাকে রহস্যময় বলে মনে হতে লাগলো। অনেক নীচ অবধি খনন করায়। বেরিয়ে এলো সব চাপা-পড়া কক্ষের মেঝের অংশ। বনহুর কয়েকজনকে নিয়ে পূর্বের ঐ সিঁড়ির ভগ্নধাপ লক্ষণীয় জায়গাটা খনন করে চললো। নিজ হস্তে সে শাবল চালাতে লাগলো।
প্রখর রৌদ্রে বনহুরের সুন্দর মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। ঘামে ভিজে গেলো তার জামাকাপড়। তবু অক্লান্তভাবে মৃত্তিকা খনন করে চলেছে।
কেশব তাকে বাধা দিয়ে বললো–বাবু, আপনি এসব করছেন কেন? আপনি শুধু আদেশ করুন, আমরাই তো আছি।
কেশবের কথার কোনো জবাব দিলো না বনহুর, সে যেমন কাজ করে যাচ্ছিলো তেমনি করে চললো।
অগত্য কেশবও নীরবে কাজ করতে লাগলো।
বেলা ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠেছে।
সূর্যের তাপ আরও তীব্র জ্বালাময় হয়ে উঠেছে।
শ্রমিকগণ যে যার কাজে ব্যস্ত।
বৈকালের আগেই তাদের কাজ শেষ করে ফিরে যেতে হবে জাহাজে। কাজেই কেউ বিশ্রাম গ্রহণ না করে অবিরাম মৃত্তিকা খনন করে যাচ্ছে।
এমন সময় আবু সাঈদের সঙ্গে নীহার এসে দাঁড়ায় সেইস্থানে যেখানে বনহুর কয়েকজন শ্রমিকসহ কাজ করে চলেছে।
বনহুরকে নিজ হস্তে শাবল চালাতে দেখে আবু সাঈদ এবং নীহার বিস্ময় প্রকাশ করলো। আবু সাঈদ বললেন– আলম, তুমি নিজে না করে শ্রমিকদের আদেশ করলেই পারতে?
নীহারের আঁখি দুটিতে প্রশংসনীয় দৃষ্টি, নিষ্পলক নয়নে সে তাকিয়ে আছে বনহুরের ঘর্মাক্ত পৌরুষদীপ্ত মুখমন্ডলের দিকে। সমস্ত দেহ ভিজে চুপসে উঠেছে বনহুরের–নীহারের বড় মায়া হলো।
বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো হাতের পিঠে ললাটের ঘাম মুছে নিয়ে বললো–স্যার, আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
তাহলেও এই প্রখর রৌদ্রে–বললো নীহার।
হেসে বললো বনহুর অভ্যাস আছে মেম সাহেব।
বনহুর কথাটা বলে পুনরায় কাজে আত্মনিয়োগ করলো। আবু সাঈদ আর নীহার এগিয়ে চললো অন্যদিকে। চলতে চলতে বললেন সাঈদ–সত্যি আলম অদ্ভুত ছেলে।
বললো নীহার–হাঁ আব্বা বড় অদ্ভুত।
দেখো মা, ওকে আমি যত দেখি ততই যেন আশ্চর্য হই। ওর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে আমি হতবাক স্তম্ভিত হয়ে যাই। শুধু তাই নয়, এমন চেহারার যুবক আমার চোখে আজ পর্যন্ত একটিও পড়েছে কিনা সন্দেহ—
আবু সাঈদ কথাগুলো বলতে বলতে এগুচ্ছিলেন। নীহারের মনে বয়ে যাচ্ছিলো একটা আনন্দের উৎস। পিতার উক্তিগুলো যেন তার কানে মধু বর্ষণ করছিলো।
আবু সাঈদ বললেন আবার ছেলেটা যদি নাবিক না হয়ে কোনো অভিজাত ঘরের হতো। তাহলে আমি নাসেরের সঙ্গে তোমার বিয়ে না দিয়ে আলমকেই জামাতা করে নিতাম–
পিতার কথাটা শুনে মুহূর্তে নীহারের মুখমন্ডল বিষণ্ণ মলিন হয়ে উঠলো, কারণ পিতার আশা বাসনা কোনো দিনই সফল হবার নয়। আলম বিবাহিত এবং তার একটি সন্তানও আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে নিয়ে বললো নীহার–কেন আব্বা, অভিজাত ঘরে জন্মালে কি নাবিক হয় না?
হাঁ, সে কথা অবশ্য সত্য। আমার মনে হয় আলম নাবিক হলেও সে অভিজাত ঘরের সন্তান।
ঐ সময় পিছন থেকে শোনা যায় একজনের উচ্চ কণ্ঠস্বর–স্যার, স্যার–
থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাতেই দেখতে পান আবু সাইদ এবং নীহার একজন শ্রমিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে।
অল্পক্ষণেই নিকটে এসে পড়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে সে স্যার দেখবেন চলুন, একটা সুড়ঙ্গপথ বেরিয়ে পড়েছে। একটা সুড়ঙ্গ মুখ—
আবু সাঈদ এবং নীহার একরকম প্রায় ছুটেই চললেন যেখানে বনহুর শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে চলেছে। নিকটে পৌঁছতেই অবাক হলেন আবু সাঈদ এবং নীহার। কিছুক্ষণ পূর্বে যে স্থানটিতে ওরা খনন করছিলো এক্ষণে সেই স্থানে একটা গভীর গর্ত বেরিয়ে পড়েছে এবং সেই গর্তমধ্যে নেমে গেছে পূর্বের ঐ ভগ্নসিঁড়ির ধাপগুলো।
আবু সাঈদের মুখে ফুটে উঠলো বিস্ময়, তিনি কন্যা নীহার সহ বনহুর এবং শ্রমিকদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বনহুর বললো–স্যার, নিশ্চয়ই এই সিঁড়ির ধাপগুলো নিচে কোনো কক্ষমধ্যে নেমে গেছে।
হাঁ, আমারও সেইরকম মনে হচ্ছে আলম।
বনহুর এবার বললো-”স্যার, আমি নিচে নেমে দেখতে চাই।
আবু সাঈদ এবং নীহার এক সঙ্গে বলে উঠলো–কি ভয়ঙ্কর কথা বলছো বাবু ও কিছুতেই হবে না।
বনহুর বললো–আমাকে আপনারা বাধা দেবেন না। কারণ আমি এই সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করবোই।
নীহারের মুখ ফ্যাকাশে হলো, বললো সে–আলম এই বিপদসঙ্কুল দ্বীপে ভয়ঙ্কর এক গর্তে প্রবেশ করতে চাও?
না প্রবেশ করলে ভিতরে কি আছে মোটেই জানা যাবে না।
আবু সাঈদ এবং নীহারের নিষেধ উপেক্ষা করে, কেশবের বাধা না মেনে বনহুর দুর্গম ভয়ঙ্কর গতমধ্যে অবতরণে প্রস্তুত হয়েছিলো। কিন্তু ঐ দিন সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করা আর সম্ভব হলো না। বনহুরের। কারণ বেলা গড়িয়ে এসেছে, এবার জাহাজে ফিরতে হবে।
নীহার যেন নিশ্বাস নিলো এতোক্ষণে, যাক আজকের দিনটা এবং রাতটা তবু নিশ্চিন্ত সে। কেন যে ওর জন্য নীহারের এতো চিন্তা, নিজেই ভেবে পায় না যেন সে।
কেশব কিন্তু ভয়ানক ঘাবড়ে গেছে, বাবুকে সে কিছুতেই সুড়ঙ্গমধ্যে একা প্রবেশ করতে দেবে না। শত শত বছর আগের ধ্বংসপ্রাপ্ত সুড়ঙ্গমধ্যে না জানি কত কত ভয়ঙ্কর জীব বাস করছে। ওর মধ্যে প্রবেশ করলে আর সে ফিরে আসবে না।
এক সময় সবাই ফিরে গেলো জাহাজে।
আজও পূর্বদিনের মত জাহাজটিকে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ হতে প্রায় মাইলকয়েক দূরে সাগরবক্ষে ভাসিয়ে রাখা হলো এবং নিচের ডেকে বা ক্যাবিনে কেউ রইলো না। সবাই আশ্রয় নিলো জাহাজের উপর ক্যাবিনগুলোতে।
খাওয়া-দাওয়া-পর্ব সন্ধ্যার অনেক আগেই চুকিয়ে নেওয়া হলো।
বনহুর আজ আবু সাঈদকে বললো–স্যার আমি আজ নিচের কোনো ক্যাবিনে থাকতে চাই।
সঙ্গে সঙ্গে আবু সাঈদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–জাহাজের সবাই যদি আমার কাছে অনুরোধ জানায় তবু আমি তোমাকে নিচের কোনো ক্যাবিনে থাকতে দিতে পারি না।
নীহার বনহুরের কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলো, স্থির হলো পিতার উক্তি শুনে। বললো। নীহার–আলম তুমি সাহসী জানি, কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি কিছুতেই ভাল নয়, বুঝলে?
হ বুঝেছি মেম সাহেব। কিন্তু কি সেই জীবটা যা আমাদের জাহাজের দু’জনকে ভক্ষণ করেছে, তা জানাও তো প্রয়োজন? বেশ, আমি নীচে না থাকলেও উপরে যে কোন অন্য ক্যাবিনে থাকতে চাই।
নীহার অভিমানভরা গলায় বললো বুঝতে পেরেছি তুমি আমাদের ক্যাবিনে থাকলে বাইরে বেরুতে পারবেনা, এজন্যই তো অন্য ক্যাবিনে থাকতে চাও, না?
হাঁ, কারণ আমি জানতে চাই সেই ভয়ঙ্কর হস্তিশুড়ের ন্যায় মোটা হস্তখানা কোন জীবের এবং যতক্ষণ না আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি ততক্ষণ আমাকে কেউ আপনারা আটকাতে পারবেন না।
নীহার মাথা নীচু করে বসে রইলো, অজানিত এক আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠলো তার।
আবু সাঈদ বললেন–হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়, তাই বলছিলাম রাতে ক্যাবিনের বাইরে বের না হওয়াই সমীচীন।
কিন্তু কোনো আপত্তিই বনহুর শুনলো না, জীবনে ভয় কাকে বলে সে জানে না। আর আজ তাকে আবু সাঈদ বা নীহার ক্ষান্ত করতে সক্ষম হবে।
বনহুর পাশের ক্যাবিনে রইলো–যেখানে রয়েছে নাসের এবং জলিলসহ লাঠিয়ালগণ। কেশবও রইলো তার কাছে। সে কোনোমতেই বনহুরের সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি নয়।
রাত এখনও বেশি হয়নি।
কারো চোখে এখনও নিদ্রাদেবী আসন গেড়ে বসেনি, সবাই নানারকম গল্প-সল্প নিয়ে ব্যস্ত আছে। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তিই অতি নিম্ন ও চাপাস্বরে আলাপ-আলোচনা করছিলো।
সকলের মনেই রয়েছে আতঙ্ক, কখন সেই অদ্ভুত জীবের মোটা হাতখানা এসে কাকে তুলে নিয়ে সাগর মধ্যে ডুব মারবে।
এমন সময় হঠাৎ শোনা গেলো সেই কানফাটা তীব্র হুইসেলের শব্দ।
সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ পর্যটনের প্রত্যেকটা ব্যক্তির মুখশুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। সাহসী জলিলের লাঠিয়ালদল পর্যন্ত কুঁকড়ে গেলো কেঁচোর মত।
নাসের এসে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে, ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে তার মুখটা।
সবাই প্রতীক্ষা করতে লাগলো না জানি কখন দুলে উঠবে জাহাজখানা ভীষণভাবে। কিন্তু আশ্চর্য আজ হুইসেলের তীব্র শব্দ এদিকে না এগিয়ে ক্রমান্বয়ে সরে যাচ্ছে দূরে–আরও দূরে। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে এলো শব্দটা।
জাহাজের সবাই কান পেতে শুনছিলো এই শব্দ সম্বন্ধে নানাজনে নানারূপ মতবাদ করতে লাগলো। ততক্ষণে দূরে বহু দূরে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের উপর জ্বলে উঠেছে অসংখ্য আলোর প্রদীপ। আলোগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
হুইসেলের শব্দটা মিশে আসতেই কতকটা আশ্বস্ত হলো জাহাজের আরোহীগণ কিন্তু একেবারে ভয়শূন্য হলো না কেউ। আবার কোন মুহূর্তে জীবটা এসে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে বসে বলা যায় না। সবাই শাশীর পাশে দাঁড়িয়ে দ্বীপের আলোর খেলা দেখতে লাগলো।
দিনের আলোতে যেখানে নেই কোনো কিছুর চিহ্ন, নেই কোনো মশাল বা প্রদীপের ভগ্নাংশ। অথচ এখন সেই দ্বীপে অসংখ্য আলোর বন্যা।
আজকের রাতটা তেমন কোনো বিপদের সম্মুখীন হলো না। অবশ্য কৃতিত্ব বনহুরেরই কারণ সে আজ নিজে ইঞ্জিন চালিয়ে জাহাজটাকে একেবারে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ ছেড়ে অনেক দূরে নিয়ে। গিয়ে নোঙর করেছিলো।
আবু সাঈদ আর অন্যান্য পর্যটক পরদিন সবাই বনহুরকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন।
সবাই যখন দ্বীপে অবতরণ নিয়ে ব্যস্ত তখন একসময় নীহার নীচের ডেকে বনহুরের ক্যাবিনে প্রবেশ করলো।
বনহুর তখন তার নাবিক ড্রেস পরা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কয়েক মিনিট পূর্বে জাহাজ দ্বীপের সন্নিকটে এসে নোঙর করেছে। এবার বোটযোগে সবাই নামছে।
বনহুর জামাটা পরে নিয়ে সম্মুখে তাকাতেই চমকে উঠলো। নীহার কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার ক্যাবিনের মধ্যে। একটু পূর্বে কেশব বেরিয়ে গেছে খনন যন্ত্রপাতি নিয়ে। বনহুর আজ ঐ অদ্ভুত সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করবে, কাজেই সেইভাবে ড্রেসটা মজবুত করে নিয়েছিলো।
হঠাৎ নীহারকে দেখে দৃষ্টি স্থির হলো বনহুরের, বললো–নীহার তুমি নেমে যাওনি?
গম্ভীর কণ্ঠে বললো নীহার–না।
সে কি, যাবে না? কয়েক পা সরে এলো বনহুর নীহারের পাশে।
বনহুরের কথা কানে না নিয়ে বললো নীহার–আলম, সুড়ঙ্গ মধ্যে তুমি প্রবেশ করতে পারবে না।
অবাক হয়ে বললো বনহুর-নীহার, তুমি আজও নাবিক আলমকে চিনলে না? সে যা একবার বলে তা সে করবেই। শত বাধাও তাকে তার সঙ্কল্প থেকে বিরত করতে সক্ষম হয় না।
নীহার বনহুরের জামার সম্মুখভাগ এটে ধরে বলে–তুমি আমার অনুরোধ রাখবে আলম? আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। তুমি যেও না, যেও না, আলম ঐ মৃত্যুভয়াল সুড়ঙ্গ-মধ্যে–
নীহারের হাত দু’খানা চেপে ধরলো বনহুর নীহার, এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আর মরণে আমার দুঃখও নেই। নীহার, আমার জীবনটাও বড় অভিশপ্ত জীবন–গলা ধরে আসে বনহুরের।
নীহার অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে বনহুরের ছলছল আঁখি দুটির দিকে। হঠাৎ নীহার বনহুরের বুকে মাথা রেখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে–আলম, জানি না কেন আমি নিজকে হারিয়ে ফেলেছি তোমার মধ্যে। অনেক ভেবেছি, আকাশের চাঁদ চাইলেই কোনোদিন পাওয়া যায় না, তবু কেন কেন পারি না নিজকে সংযত রাখতে..
নীহার, এ তোমার মনের দুর্বলতা, না হলে আমার মত একজন নগণ্য নাবিককে তুমি এভাবে মনে স্থান দিতে পারতে না।
না না, তুমি নগণ্য নও আলম, তুমি নগণ্য নও। তুমি অমূল্য সম্পদ, যা কল্পনা করা যায়– কিন্তু পাওয়া যায় না। নীহার বনহুরের বুকে গলায় গণ্ডে হাত বুলিয়ে চলে।
বনহুর নির্বাক নিস্পন্দ, কোনো কথা সে বলতে পারে না। তার সমস্ত দেহমনে যেন একটা শিহরণ নাড়া দিয়ে যায়। বনহুর সংযত রাখতে পারে না নিজেকে, গভীর আবেগে নীহারকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে। ওর মুখখানা তুলে ধরে নিজের মুখের কাছে।
নীহার ওকে বাধা দেয় না।
তারপর বনহুর নীহারকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে বলে–চলো নীহার, বড্ড দেরি হয়ে গেলো।
নীহার আর বনহুর জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালো, প্রায় সকলেই অবতরণ করেছে। একখানা বোট সিঁড়ির মুখে অপেক্ষা করছে বনহুরের জন্য।
বনহুর নীহারের হাত ধরে নামিয়ে নিলো জাহাজ থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নীহারের দেহটা যেন কাঁপছিলো, ভয়ে নয়–আশঙ্কায়। হয়তো আলমের সঙ্গে এই তার শেষ জাহাজ ত্যাগ। হয়তো আলম ঐ সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করে আর ফিরে আসবে না। হয়তো তাকে ঐ ভয়ঙ্কর দ্বীপে চিরদিনের জন্য বিসর্জন দিয়ে আসতে হবে…।
বোটে বসে বললো বনহুর–অমন গম্ভীর হয়ে কি ভাবছো নীহার?
কিছু না। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিলো নীহার।
বনহুর বুঝতে পেরেছে, তার সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ-আশঙ্কায় নীহার বেশি উতলা এবং চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
এরপর বনহুর আর কোনো কথা বলে না, নিশুপ হয়ে বসে বোটের স্পীড বাড়িয়ে দেয়।
অল্প সময়ে বনহুর আর নীহারসহ বোটখানা দ্বীপের কিনারে গিয়ে পৌঁছে যায়।
জাহাজখানা ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের কয়েক রশি দূরে নোঙর করেছিলো।
বনহুর বোট থেকে নেমে পড়ে নীহারকে হাত ধরে সাবধানে নামিয়ে নেয়। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে যাতে পড়ে না যায় সেইদিকেও খেয়াল রাখে।
বনহুরের হাতে হাত রেখে যখন নীহার বোট থেকে নামছিলো তখন অদূরে দাঁড়িয়ে নাসের এবং জলিল লক্ষ্য করছিলো। ইদানীং নাবিক আলমের প্রতি তাদের ঈর্ষাগত মনোভাব বলিষ্ঠ না। থাকলেও একেবারে বিনষ্ট হয়নি। তবে সম্প্রতি ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের মৃত্যুভয়াল ভয়ঙ্কর অবস্থার জন্য শান্ত আছে তারা, কারণ আলমের মত দুঃসাহসী শক্তিশালী একজন ব্যক্তির নিতান্ত প্রয়োজন তাদের কর্তব্য। তাই আজকাল নাসের বা জলিলের দল হিংসায় জ্বলে মরলেও প্রকাশ্যে কোনোরকম কু-মতলব আঁটে না। তারা চায় দ্বীপ থেকে কোনোরকমে উদ্ধার পেয়ে ফিরে যাবার পথে ওকে খতম করতে হবে এবং সেই প্রতীক্ষাতেই আছে তারা।
বনহুরের সঙ্গে নীহার যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন নাসের দাঁত কটমটিয়ে বলছিলো– বেটাকে আর কটা দিন ফুর্তি করে নিতে দাও জলিল, তারপর ওকে হজম করে ফেলবো।
জলিল বলে উঠে-দ্বীপটা ভয়ঙ্কর স্থান, কখন কোন বিপদ ঘটে, তাই আমিও চুপচাপ আছি, নইলে ওকে এতোদিনে যমালয়ে পাঠিয়ে তবে ছাড়তাম।
জলিল আর নাসেরের যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন ফুলমিয়া এবং দলবল এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। পিছনে চলতে চলতে সব শোনে ফুলমিয়া।
জলিল এবং নাসের তাদের সবাইকে একবার দেখে নেয়। এরা সবাই তাদেরই লোক, কাজেই কথাবার্তা চলতে থাকে, বলে নাসের–কতদিন আগেই বেটা চলে যেতো যমালয়ে, কিন্তু ভাগ্য ভাল তাই বেঁচে গেছে বারবার।
জলিল বললো–সেকথা অবশ্য ঠিক বলেছেন ছোট স্যার। না হলে কতবার আলমকে হত্যা করার চেষ্টা করেও আমরা বিফল হলাম কেন?
বললো নাসের–দ্বীপের বিপদটা একবার কেটে যাক তাহলে..
নাসেরের কথার মাঝখানে বলে উঠে জলিল–এবার শেষ বান নিক্ষেপ করবো ছোট স্যার, দেখে নেবেন বেটা কুপকাৎ না হয়ে যাবে না। কিন্তু স্যার–মোটা বখশীস চাই…জলিল, নাসেরের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।
ফুলমিয়া সজাগ হয়ে সব শুনছিলো, শিউরে উঠলো সে। কিন্তু মুখোভাবে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো না তার। নীরবে শুনছে আর দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফুলমিয়ার মনে ঠিক বিপরীত চিন্তা, নাসের এবং জলিল চায় আলমকে ধ্বংস করতে, আর ফুলমিয়া চায় তার মঙ্গল।
ওদিকে আলমসহ নীহার তখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে। অবশ্য তাদের সকলেরই গন্তব্যস্থান আজ একই জায়গায়–যে স্থানে বেরিয়েছে সেই সুড়ঙ্গমুখটা।
বনহুর আর নীহার যখন পৌঁছলো তখন সেখানে সবাই এসে জড়ো হয়ে গেছে। আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে চলেছে তখন খননকাজ।
অনেক দালান-কোঠার ভগ্নাংশ বেরিয়ে এসেছে মাটির তলা হতে। অনেক জীবজন্তুর কঙ্কাল। এবং নর-কঙ্কালও বেরিয়েছে প্রচুর। আবু সাঈদ এবং ভূতত্ববিদগণ গবেষণা করে আশ্চর্য হলেন– শত শত বছর আগের মাটিচাপা-পড়া জীবের কঙ্কাল কি করে আজও বিনষ্ট না হয়ে ঠিক আছে!
গবেষণা চলতে লাগলো এ ব্যাপার নিয়ে।
এদিকে বনহুর সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন। কেশবের মুখ ফ্যাকাশে কালো হয়ে উঠেছে।
নীহার যেন মনকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না, বার বার তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে। বনহুরের দিকে চাইতেই দৃষ্টি বিনিময় হলো, আশ্চর্য হলো নীহার-ওর মুখে নেই। এতোটুকু ভয় বা দুশ্চিন্তার ছাপ।
বনহুর সড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশের জন্য টাইট জামা-কাপড় পরে নিলো। পায়ে বুট, মাথায় ক্যাপ, হাতে গ্লাবস্। বামহস্তে তীব্র আলোদায়ক টর্চ এবং দক্ষিণ হস্তে গুলীভরা রিভলভার।
আবু সাঈদের অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার বনহুরের পর-পর ফটো নিয়ে চলেছে। যদিও এতোক্ষণ সে দ্বীপের খনন অংশের বিভিন্ন ছবি সংগ্রহ করছিলো, এখন সে ব্যস্ত হয়ে উঠলো বনহুরের ছবি গ্রহণে।
বনহুর যখন সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করলো তখন সে সকলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো, তার মুখমন্ডল দীপ্ত উজ্জল। ফটোগ্রাফার ছবি নিলো সেই মুহূর্তে।
উপস্থিত সকলের মুখ বিষাদময় হলো, আবু সাঈদ এবং অন্যান্য সকলের মুখেও গভীর একটা দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। নীহার ও কেশব অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো।
শুধুমাত্র খুশি হলো নাসের এবং জলিল ও তার দলবল। কিন্তু ফুলমিয়ার মুখ কালো হয়ে উঠেছে, তার জীবন যে রক্ষা করেছে সে আজ মৃত্যুর গহ্বরে প্রবেশ করলো। মনেপ্রাণে ফুলমিয়া খোদাকে স্মরণ করছে, তিনি যেন আলম সাহেবকে সুস্থদেহে ফিরিয়ে আনেন।
কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে চললো, আলমের ফিরবার কথা নেই। সুড়ঙ্গমুখে সবাই বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করছে। সমস্ত জাহাজের লোকজন সবাই এসে জড়ো হয়েছে সেই স্থানে।
বেলা গড়িয়ে এলো কিন্তু আলমের আর সন্ধান নেই। আবু সাঈদ এবং বয়স্ক পর্যটকগণ সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন, তা ছাড়াও অন্যান্য সকলের মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। কেশব আশঙ্কিতভাবে সুড়ঙ্গমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
নীহার বারবার পিতাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে, এতোক্ষণও আলম আসছে না কেন? কোনো বিপদ ঘটেনি তো তার? এতোক্ষণ আসছে না সে, আর একজন গিয়ে দেখা উচিত নয় কি?
কেশব এবার অধৈর্য হয়ে উঠেছে, হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে সে। আবু সাঈদের মুখে কোনো কথা সরছে না, কারণ আলমের যদি কোনো অমঙ্গল ঘটে থাকে তাহলে এজন্য দায়ী যে তিনিই। আবু সাঈদ নিজে পায়চারি শুরু করে দিয়েছেন, ললাটে ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তারেখা।
সম্পূর্ণ কয়েকটা ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে চলেছে।
বিপুল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে সবাই।
সূর্য পশ্চিম আকাশে গড়িয়ে গেছে অনেকদূরে। শ্রমিক এবং নাবিকদের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা। দিলো, সবাই জাহাজে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিয়েছে।
আবু সাঈদ ক্ষিপ্তের ন্যায় উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছেন, সহকারী এবং সঙ্গিগণ সবাই আবু সাঈদের উৎকণ্ঠায় যোগ দিয়ে নানাজনে নানারকম মতবাদ প্রকাশ করছেন।
শুধু নাসেরের দল মনে মনে খুশি হয়েছে চরম আকারে। এতোদিন নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েও যা করতে সক্ষম হয়নি আজ তা আপনা আপনি হয়ে গেলো। নাসের জলিলসহ দলবল নিয়ে জাহাজে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। আনন্দ তাদের ধরছে না যেন।
আবু সাঈদ ক্রমান্বয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন, সকলের নিকটে অনুরোধ জানালেন আরও এক ঘন্টা অপেক্ষা করার জন্য।
কেশব তো হাত জুড়ে সকলের নিকটে অনুনয়-বিনয় শুরু করলো–তারা যেন তার বাবুকে ছেড়ে না যায়।
নাসের সবাইকে উস্কানি দিতে লাগলো, যাতে তারা আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করতে রাজি না হয়।
আবু সাঈদের কথামত আরও একটা ঘন্টা কেটে চললো। তবুও ভিতর হতে ফিরে এলো না। আলম। এবার সকলে জাহাজের দিকে রওয়ানা দিলো।
তখনও আবু সাঈদ কেশব আর নীহার এবং কয়েকজন আবু সাঈদের বন্ধুত্থানীয় লোকজন অপেক্ষা করছেন। আর দেখা গেলো, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ফুলমিয়া। তার মুখে-চোখেও দারুণ উদ্বিগ্নতার ছাপ।
কিন্তু আর যে অপেক্ষা করা চলে না, এবার দ্বীপের বুকে নেমে আসবে সন্ধ্যার অন্ধকার। তার সঙ্গেই শুরু হবে দ্বীপময় এক মৃত্যুভয়াল আলোর খেলা। অসংখ্য প্রেত-আত্নার অদৃশ্য হস্তের কঠিন চাপে প্রাণ দিতে হবে সকলের।
আর বিলম্ব করা চলে না।
মৃত্যুভয় কার না আছে!
সবাই যখন জাহাজে ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তখন আবু সাঈদ আলমের আশা ত্যাগ করে নীহারকে বললেন–মা, এবার আমাদের ফিরে যেতে হবে।
নীহার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো-আব্বা, আলমকে এই মৃত্যুকূপে নিক্ষেপ করে কোন মন নিয়ে তুমি বাঁচতে চাও।
মা!
বাবা, তোমরা সবাই চলে যাও, আমি একা প্রতীক্ষা করবো আলমের।
একি বলছিস মা? তুই কি পাগল হলি?
কেশব এগিয়ে এলো-স্যার, আপামনি পাগল হয়নি। তিনি ঠিকই বলেছেন, বাবুকে এই বিপদে ফেলে আপনারা কি করে ফিরে যেতে চান? সবাই চলে গেলেও আপামনির সঙ্গে আমি থাকবো। মরতে হয় বাবুর সঙ্গে আমরাও মরবো।
কয়েকজন গণ্যমান্য বয়স্ক লোক ছিলেন আবু সাঈদের সঙ্গে, তাঁরা চরম বিপদে পড়েছেন– আবু সাঈদ সাহেবকে ছেড়ে যেতেও পারছেন না অথচ জীবনের মায়া কাটানোও মুস্কিল। নীহারের কথায় এবং কেশবের উক্তি শুনে সবাই প্রতিবাদ করে বসলেন।
প্রবীণ এক ব্যক্তি বললেন–একজনের জন্য এতোগুলো জীবন বিনষ্ট করার কোনো যুক্তি নেই। কেশব তার বাবুর জন্য অপেক্ষা করতে চায় করুক কিন্তু আমরা মা নীহারকে এই ভয়ঙ্কর স্থানে রেখে যেতে পারি না।
আবু সাঈদ কন্যাকে অনেক বোঝাতে লাগলেন।
আশ্চর্য, নীহার কিছুতেই ফিরে যাবে না জাহাজে!
ওদিকে লোকজন সবাই ফিরে চলেছে, নাসের দলবল নিয়ে এগিয়ে গেছে অনেকদূর।
আবু সাঈদ যখন ব্যথিত মর্মাহত হয়ে ফিরে চলার জন্য মন স্থির করে নিয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে ঐ ভয়ঙ্কর মৃত্যুভয়াল সুড়ঙ্গমধ্য হতে ভেসে আসে গুলীর শব্দ।
সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠে আবু সাঈদ, নীহার এবং উপস্থিত অন্যান্য সকলের মুখ। কেশব তো খুশিতে চিৎকার করে উঠলো–বাবু–বাবু…
ফুলমিয়া অন্যান্যের মধ্যে আত্নগোপন করে এতক্ষণ খোদার নাম স্মরণ করছিলো। সেও ভুলে যায় তার সর্দার আর দলবলের হিংসার কথা, ছুটে চলে আসে সুড়ঙ্গমুখে।
ঠিক সেই দন্ডে সুস্থদেহে সুড়ঙ্গমধ্য হতে বেরিয়ে আসে নাবিক আলম। সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিতে তাকে পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক মনে হয়। আবু সাঈদ ছোট্ট বালকের মতই ছুটে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর চোখে ঝরে পড়ে আনন্দ-অশ্রু। আবেগভরা মধুর কণ্ঠে ডাকলেন–আলম!
নীহারের চোখ খুশিতে জ্বলে উঠলো যেন, সেও পিতার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চোখে দেখছে, সত্যি আলম জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে।
কেশবের কণ্ঠে কোনো কথা সরলো না, সে কি করবে যেন ভেবে পাচ্ছে না।
ফুলমিয়া এবার হাত তুলে খোদার কাছে শুকরিয়া করতে লাগলো।
অন্যান্য সবাই এগিয়ে এসে বনহুরের সঙ্গে করমর্দন করতে লাগলো। নাসের আর জলিলের দল যদিও অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো তাদের মুখ পুনরায় কালো হলো। কারণ, তারা মনে করেছিলো, আলম আর সুড়ঙ্গমধ্য হতে ফিরে আসবে না। এ দ্বীপেই হবে তার জীবন্ত সমাধি, কিন্তু সে কল্পনা তাদের ধূলিসাৎ হলো।
আবু সাঈদ দলবল নিয়ে আলমসহ ফিরে এলেন জাহাজে। জাহাজে পৌঁছেই তিনি আনন্দ আপুত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আলম ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের গোপন রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছে, তাকে তিনি অন্তরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
জাহাজের প্রতিটি ব্যক্তি এ সংবাদে খুশি হলো। এবার সবাই আশ্বস্ত হয়েছে, ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের গোপন রহস্য জানতে পারবে বলে। কিন্তু জাহাজের একটি গোপন স্থানে নাসের জলিলের দলসহ সলা-পরামর্শ শুরু করলো, কোনোরকমে আলম যেন এ কৃতিত্ব লাভ করতে সক্ষম না হয়। সুড়ঙ্গ মধ্যের রহস্য উদঘাটনের পূর্বেই তাকে শেষ করতে হবে, রুদ্ধ করে দিতে হবে চিরতরে তার কণ্ঠ। এবার ছোরা দ্বারা বা জাহাজের ইঞ্জিনে নিষ্পেষিত করে নয়, পিস্তলের গুলীতে হত্যা করতে হবে। অতি সাবধানে কাজ করতে হবে যাতে এবার রেহাই না পায়।
নাসের জলিলকে একশত স্বর্ণমুদ্রা দিতে রাজি হয়েছে। কার্যসিদ্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হবে। তাকে এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো।
এতোবড় একটা লোভ কম নয়, একশত স্বর্ণমুদ্রা পেলে আজীবন বসে চলে যাবে তার। লাঠিয়ালদের সর্দারী আর তাকে করতে হবে না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার কিছু পরই তাদের জাহাজ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ ত্যাগ করে কয়েক মাইল দূরে চলে এলো। পূর্বদিনের জায়গা হতেও আজ আরও কিছুটা দূরে জাহাজ নোঙর করলো।
পর-পর কয়েকটা দিন বেশ ভালই কেটে চলেছে। এ ক’দিন সাংঘাতিক তেমন কোনো বিপদ ঘটেনি বা প্রাণহানি হয়নি। জাহাজে সকলের মনেই অনেকটা সাহস এসেছে।
জাহাজ নোঙর করার পর সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিলো সবাই। আবু সাঈদ জানিয়েছেন, রাত্রি দশ ঘটিকায় আলম ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের মৃত্তিকা তলের রহস্য ব্যক্ত করবে, যা সে আজ সেখানে স্বচক্ষে দেখে এসেছে।
নাসের জলিলকে সেই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত করে নিলো। আলম যেন রহস্য উদঘাটনে সক্ষম না হয়।
জাহাজের প্রতিটি ব্যক্তি বিপুল আগ্রহ নীয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলো, না জানি কি রহস্য আজ ব্যক্ত করবে আলম। রাত্রি নয় ঘটিকার মধ্যেই সবাই আজ আবু সাঈদের ক্যাবিনে এসে জড়ো হলো। জাহাজের সবচেয়ে বড় এবং প্রশস্ত হলো এই ক্যাবিনটা।
অন্যান্য দিনের মত আজও নিচের ডেকে বা ক্যাবিনে কেউ রইলো না। সবাই আশ্রয় নিলো জাহাজের উপরের ক্যাবিনগুলোতে।
আবু সাঈদের অন্তরে আজ এক পূর্ণতার আনন্দ। পিতার মতই আনন্দিতা নীহার, দ্বীপের রহস্য উদঘাটনের জন্য নয়, আলম সুস্থ দেহে মৃত্যুভয়াল সুড়ঙ্গমধ্য হতে ফিরে এসেছে বলে।
আলমকে আবু সাঈদ তাঁর নিজ হস্তের মূল্যবান হীরক আংটি খুলে উপহার দিয়েছেন, আরও প্রচুর অর্থ তিনি তাকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। আলম এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব, পুরস্কার-আশায় সে উন্মুখ বা উদগ্রীব নয়।
ফৌজিন্দিয়ার ভূগর্ভ-রহস্য জানার বাসনায় আবু সাঈদের ক্যাবিনে রীতিমত ভীড় জমে গেছে। নাসের এবং জলিলের দল ছাড়া সবাই আজ এসে জমায়েত হয়েছে এই ক্যাবিনে। সকলেরই চোখেমুখে বিপুল আগ্রহ।
আবু সাঈদ নিজের পাশে বসিয়েছেন নাবিক আলমকে। নীহারও ঠিক তার অনতিদূরে বসেছে, স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে সে আলমের দীপ্তময় মুখমন্ডলের দিকে। নীহার যেন আনন্দে আত্নহারা হয়ে পড়েছে, আলম যে ঐ মৃত্যুভয়ঙ্কর সুড়ঙ্গমধ্য হতে ফিরে আসবে, এ আশা তার ছিলো না এবং সেই কারণে সে বেশি মুষড়ে পড়েছিলো।
কেশবও দাঁড়িয়ে আছে আলমের পাশে, আনন্দে আপুত সে। আর একজনও ঠিক কেশবের মতই খুশি হয়েছে–সে হলো ফুলমিয়া। যদিও সে এখনও জলিলের সঙ্গেই রয়েছে তবু তার মনে তৃপ্তি, তার জীবন রক্ষকের জীবনলাভ ঘটেছে।
আবু সাঈদের ক্যাবিনে যখন বনহুর সেই ভয়ঙ্কর সুড়ঙ্গমধ্যের কাহিনী শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছিলো তখন নাসেরের ক্যাবিনে তৈরি হয়ে নিচ্ছে জলিল। পিস্তলে গুলী ভরে নাসের। পিস্তলটা জলিলের হাতে দেয়–এই নাও, অত্যন্ত সাবধানে কাজ শেষ করবে।
জলিল পিস্তলটা লুকিয়ে রাখলো পকেটে, তারপর হেসে বললো–সাবধান আমাকে করে। দিতে হবে না ছোট স্যার। ঠিক আমি আজ আলম বেটাকে খতম করে তবে ছাড়বো। কিন্তু আমার বখশীসটা..
ও ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, পথের কাঁটা সরে গেলেই আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করবো।
নাসের আর জলিল যখন আলমকে হত্যা করা নিয়ে গভীর আলোচনায় মত্ত, তখন ফুলমিয়া সব শুনছিলো দলের মধ্য হতে। ভাবছিলো, এবার জলিলের হাত থেকে পরিত্রাণ নেই আলম সাহেবের, হায় কি করে তাকে বাঁচানো যায়। কোনো উপায় স্থির করতে না পেরে ফুলমিয়া খোদাকে স্মরণ করতে লাগলো। হে পাক পরওয়ার দেগার, আমি একজন গোনাহগার বান্দা, তোমার কাছে আমি অপরাধী,তবু একটি দোয়া আমার কবুল করো, আমার জীবন যে রক্ষা করেছে তার জীবন তুমি রক্ষা করো, এই আমার মোনাজাত…
*
সমস্ত ক্যাবিন নিস্তব্ধ। সবাই ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে আলমের মুখে। বলে চলেছে আলম–সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করতেই একটা তীব্র ভ্যাপসা গন্ধ আমার নিশ্বাসকে রুদ্ধ করে দিতে লাগলো! প্রথমে মনে হলো, আমি এ গন্ধ সহ্য করতে পারবো না। হতাশ হয়ে পড়লাম, সুড়ঙ্গে প্রবেশ করা আমার বৃথা হলো, এবার ফিরে যেতে হবে, তবু আমি সহ্য করার চেষ্টা করতে লাগলাম, ভাগ্যিস আমার সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণের যন্ত্রটা ছিলো তাই রক্ষা পেলাম। আমি মুখে মুখোস পরে অক্সিজেন গ্রহণ করতে লাগলাম। থামলো আলম।
কক্ষমধ্যে সকলে স্তব্ধ হয়ে শুনে চলেছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
পুনরায় বলতে শুরু করলো আলম–কিছুদূরে অগ্রসর হতেই বুঝতে পারলাম, সেটা কোনো সুড়ঙ্গপথ বা গুহা নয়। কোনো এককালে এখানে বাড়িঘর ছিলো, তাই বসে গেছে গভীর মাটির তলায়। টর্চের আলোতে আমি সব স্পষ্ট দেখতে লাগলাম। কক্ষগুলো শত শত বছর আগের অথচ ঠিক পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক রয়েছে। কোনো কোনো স্থানে যদিও কিছু কিছু অংশ ধসে পড়েছে তবু কক্ষগুলোর কোনো রকম বিকৃতি ঘটেনি। আরও আশ্চর্য হলাম, কক্ষগুলোর মধ্যে নানা রকম আসবাবপত্র সাজানো রয়েছে, তবে মাটি এবং ধূলোবালিতে সেসব জিনিসপত্র কিসের তৈরি বা কি জিনিস বোঝা মুস্কিল। যদিও আমার খুব ভয় হচ্ছিল, হয়তো বেশিক্ষণ এখানে ঠিক থাকতে পারবো না ভাবছিলাম–কারণ অক্সিজেন গ্রহণেও আমি ঠিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না।
বললেন আবু সাঈদ–কি ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে তুমি ফিরে এসেছো আলম!
হাঁ স্যার, সে কথা মিথ্যা নয়। আমি টর্চের আলো নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলাম। ভেবেছিলাম, বহুকালের ভূগর্ভে ধসে পড়া এসব কক্ষে নিশ্চয়ই নানারকম জীবজন্তু বসবাস করছে। কিন্তু অবাক হলাম, একটি মাকড়সাও আমার নজরে পড়লো না। সাপ বিছা বা ইঁদুর কিছুই নেই। হঠাৎ আমার টর্চের আলোতে এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম–ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম একেবারে, দেখলাম মেঝেতে পড়ে আছে পাশাপাশি দুটো মানুষের দেহ…
আবু সাঈদ এবং আরও কয়েকজন পর্যটক মহোদয় একসঙ্গে বিস্ময়-ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন–মানুষের দেহ!
হাঁ, মৃতদেহ! প্রথমে চমকে উঠলেও অল্পক্ষণেই বুঝতে পেরেছিলাম–দেহ দুটো প্রাণহীন। আমি টর্চের আলো ফেলে এগিয়ে গেলাম দেহ দুটির পাশে।
ক্যাবিনে যেন টু শব্দটি নেই, সকলে নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলো আলমের কথাগুলো।
আলম যখন বলে চলেছে–ওদিকে তার মৃত্যুদূতের মত অন্ধকারে আত্নগোপন করে এগিয়ে আসছে জলিল, দক্ষিণ-হস্তে তার গুলীভরা পিস্তল। মুখে গালপাট্টা বাধা, দেহে লাঠিয়াল সর্দারের মজবুত পোশাক।
সমস্ত জাহাজ নিশ্চুপ নিঝুম।
যার-যার ক্যাবিনে সবাই বসে বসে খোদার নাম স্মরণ করছে। আর বেশির ভাগ লোকই আবু সাঈদের ক্যাবিনে। সকলে তারা উপস্থিত বিপদ-আপদের কথা ভুলে গিয়ে আলমের রহস্যময় উক্তিগুলো শুনছিলো।
নাসের বসে আছে দলবল নিয়ে, তার চারপাশে ঘিরে বসেছে শম্ভু, জম্বু আর অন্যান্য লাঠিয়াল। জলিল একশত স্বর্ণমুদ্রা পাবে, সেই লোভে সে একাই চলে গেছে আলম-হত্যায়। কাউকে সঙ্গে নিতে রাজি নয়, একশত স্বর্ণমুদ্রায় ভাগও দেবে না জলিল–এই তার ইচ্ছা।
ক্ষুব্ধ শার্দুলের মত জলিল অন্ধকারে এগুচ্ছে।
ঠিক তার কয়েক হাত দূরে অতি গোপনে তাকে অনুসরণ করছে ফুলমিয়া, হাতে তার সূতীক্ষ্ণ। ধার ছোরা। জলিল ফাঁকে পিস্তলের আগা প্রবেশ করিয়ে লক্ষ্য ঠিক করবে, তখন ফুলমিয়া পিছন থেকে আচমকা তার পিঠে ছোরা বসিয়ে দেবে। এই অভিসন্ধি নিয়েই সে এক্ষণে অগ্রসর হচ্ছে।
যাকে হত্যা করার নেশায় জলিল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, সেই নাবিক আলম–দস্যু বনহুর তখন সেই দ্বীপের অভ্যন্তরের রহস্যময় কাহিনী ব্যক্ত করে চলেছে…বলছে বনহুর–ভালভাবে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম, একটি পুরুষ দেহ অন্যটি নারী, কিন্তু তাদের দেহে কোনো আবরণ ছিলো না, ধূলো-মাটি আর কাদা ছাড়া। আমার বিস্ময় চরমে উঠলো, মৃতদেহগুলো কেমন যেন লোহার মত কালো মনে হচ্ছিলো। ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমি মৃতদেহের গায়ে হাত দিয়ে চাপ দিলাম, অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর মৃতদেহগুলো দেখতেও যেমন লৌহ-রং তেমনি লৌহের মতই শক্তও বটে। চোখমুখের আকার তেমন স্পষ্ট বোঝা যায় না। নারী এবং পুরুষ-দেহ চিনবার উপায়। একমাত্র তাদের দেহের আকার, তাছাড়া কারো মাথায় কোনো রকম কেশ নেই। মৃতদেহগুলো যে শত শত বছর পূর্বের তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আবু সাঈদ বিস্ময়-বিস্ফোরিতভাবে তাকিয়ে কথাগুলো যেন গিলছিলেন, অস্কুট ধ্বনি করলেন–মৃতদেহগুলো শত শত বছর পূর্বের–কিভাবে বুঝলে আলম?
বললো বনহুর–কারণ দেহগুলো শুকনো কাঠের মত এবং লোহার মত শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। শুধু ঐ দুটি মৃতদেহই আমি দেখিনি স্যার, হঠাৎ আমার নজর পড়লো, ঐ মৃতদেহ দুটির অনতিদূরে। একটি শিশুর দেহ এবং তার পাশে একটি কুকুর বা ঐ ধরনের কোনো জীবের দেহ পড়ে আছে। শিশু এবং কুকুরটির দেহ পরীক্ষা করেও আমি ঐ রকম শক্ত-কঠিন মনে করলাম। থামলো বনহুর, হাই তুলে বললো–আমার তখন নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, কাজেই দ্রুত সবকিছু দেখা শেষ করার বাসনায় উঠে পড়লাম। টর্চের আলো ফেলে এগুতে লাগলাম সন্তর্পণে।
বললো নীহার–আলম, তোমার ভয় হলো না?
হাসলো বনহুর–মৃত্যুর গহ্বরে প্রবেশ করে ভয়! কিসের ভয় করবো মেম সাহেব?
ঐ মৃতদেহগুলোর জন্য তোমার মনে একটুও আশঙ্কা জাগলো না?
না। কারণ জানি, মৃত সে মৃতই–জাগবে না কোনোদিন। হাঁ, তারপর কিছুটা এগুতেই দেখলাম মাঝখানে একটা দরজা কিন্তু দরজার মুখে মাটির চাপ দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, তবে খুব বেশি জমাট নয়। অল্প চেষ্টাতেই দরজাটা খসে পড়লো, তখন বুঝতে পারলাম–আসলে দরজায় মাটির চাপ জমাট হয়েছিলো না, ও দরজাটাই ঠিক দেখতে ঐ রকম মাটির চাপের মত মনে হচ্ছিলো, দরজাটা খসে পড়ে অন্ধকার একটা গহবর বেরিয়ে এলো। আমি টর্চের আলো ফেলে এবং রিভলভার বাগিয়ে ধরে সেই গহ্বরে প্রবেশ করলাম।
উঃ কি সাংঘাতিক লোক তুমি! বললো নীহার।
আবু সাঈদ বলে উঠলেন–এবার বুঝতে পারছি কেন এতো বিলম্ব হলো তোমার সুড়ঙ্গমধ্যে।
বললো বনহুর–হাঁ স্যার, এসব কারণে আমার বিলম্ব ঘটেছিলো।
তারপর–সেই গহ্বরে প্রবেশ করলে তুমি?
হ, টর্চের আলো ফেলে অন্ধকারময় গহ্বরে প্রবেশ করে আমি স্তম্ভিত হলাম। এ কক্ষটা আরও জমাট অন্ধকার, কারণ সম্মুখ কক্ষটায় সুড়ঙ্গমুখের কিছুটা আলোকরশ্মি প্রবেশ করছিলো তাই কিছুটা সচ্ছ মনে হচ্ছিলো। দ্বিতীয় কক্ষটায় প্রবেশ করতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, দড়বড় উঠে টর্চের আলো ফেলতেই শিউরে উঠলাম। মেঝেতে কয়েকটা কয়লার মত কালো। মৃতদেহ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে। এবার যেন আমি সত্যি ভড়কে গেলাম। মৃতদেহগুলো অত্যন্ত ভয়ঙ্কর কুৎসিত দেখাচ্ছে। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না, চটপট সরে যাবো, ঠিক ঐ সময় দেখলাম কক্ষমধ্যে নীলাভ আলোর বেলুন ভেসে উঠলো। আশ্চর্য হলাম–এ যে ঐ আলো যে আলো, আমরা জাহাজে বসে অন্ধকারময় দ্বীপের বুকে দেখে থাকি।
কক্ষমধ্যে নীরব, সূঁচ পতনের শব্দও যেন শোনা যায়। সবাই যেন বনহুরের কথাগুলো গিলছে একটির পর একটি করে। আবু সাঈদ স্তম্ভতি হতবাক হয়ে শুনে চলেছেন।
নীহারের মুখেও কোনো কথা নেই, সেও যেন নির্বাক হয়ে পড়েছে। অন্যান্যেও চুপচাপ শুনে। যাচ্ছে–বলে চলেছে বনহুর। ওদিকে জলিল ডেকের অন্ধকারে সন্তর্পণে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক আবু সাঈদের ক্যাবিনের পিছনে, দক্ষিণ হস্তে পিস্তল। কোনদিক দিয়ে সে গুলী ছুঁড়বে তাই ভাবছে। মনোযোগ দিয়ে।
জলিলের নিকট হতে কিছুটা দূরে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ নিশ্বাসে সুযোগের অপেক্ষা করছে ফুলমিয়া। জলিলকে আজ সে খতম না করে ছাড়বে না, অন্ধকারে ফুলমিয়ার চোখ দুটো যেন জ্বলছে, তার সঙ্গে জ্বলছে তার হস্তস্থিত সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরাখানা।
ঠিক ঐ সময় নিশ্চিন্ত স্বাভাবিকভাবে বলে চলে বনহুর–একটি নয়–তাকিয়ে দেখলাম সেই অন্ধকারময় গহ্বরে আরও কয়েকটি আলোর বেলুন কেউ যেন অদৃশ্য হস্তে নাড়াচাড়া করছে, আমি মুহূর্ত বিলম্ব না করে গুলী ছুঁড়লাম আলোর বেলুন লক্ষ্য করে–কিন্তু আশ্চর্য! আলো যেমন ভেসে বেড়াচ্ছিলো তেমনি বেড়াতে লাগলো। আরও অবাক হলাম, কোনোটা জ্বলছে আবার নিভে যাচ্ছে আলগোছে…
আমি আর বিলম্ব না করে দ্রুত বেরিয়ে এলাম বাইরে। অবশ্য আরও থাকবার এবং দেখবার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু আমার অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে আসছিলো, কাজেই আর দেরি করা সমীচীন মনে করিনি।
বললেন আবু সাঈদ–আর বিলম্ব করা তোমার মোটেই উচিত হতো না আলম, কারণ জাহাজে ফিরবার সময় হয়ে এসেছিলো, তাছাড়াও আমরা সবাই তোমার জন্য অত্যন্ত অস্থির বোধ করছিলাম। কিন্তু তুমি যে রহস্যময় কথাগুলো বললে তা সত্যিই বিস্ময়কর। শত শত বছর পূর্বের ধসে-পড়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আজও মনুষ্য-মৃতদেহ কি করে এভাবে থাকতে পারে?
বনহুর বললো–ঠিক আমার মনেও ঐ প্রশ্ন জেগেছিলো স্যার…
বনহুরের কথা শেষ হয় না, জাহাজখানা হঠাৎ একপাশে হুমড়ি খেয়ে কাৎ হয়ে যায়, পরক্ষণেই আবু সাঈদের ক্যাবিনের ঠিক পিছন হতে ভেসে আসে তীব্র আর্তনাদ।
ক্যাবিনের মধ্যে সবাই এ-ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে আচমকা, কেউ কেউ মেঝেতে লুটোপুটি খায়। কেউ বা দেয়াল ধরে কোনোরকমে সামলে নেয় নিজকে। জাহাজের প্রত্যেকটা ক্যাবিনের মধ্যে একই অবস্থা।
এই বুঝি জাহাজখানা কাৎ হয়ে তলিয়ে যাবে সাগরবক্ষে। প্রত্যেকটা ক্যাবিন-মধ্যে ভয়ার্ত আর্তনাদের গুঞ্জনধ্বনি জেগে উঠে।
সেই তীব্র মর্মভেদী আর্তনাদ হঠাৎ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তখনই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। জাহাজ থেকে বিরাট কিছু সাগরবক্ষে পতনের শব্দ হলো। মনে হলো, কোনো একটা গাছের গুঁড়ি যেন জাহাজ থেকে সাগরের গভীর জলে গড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজখানা একটা ঝুঁকি খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এবার ভীষণভাবে দুলছে জাহাজ পর্যটন। মনে হচ্ছে সাগরের জলে প্রচন্ড ঢেউ-এর সৃষ্টি হয়েছে, তারই আঘাতে দোল খাচ্ছে জাহাজখানা।
কিছুক্ষণ ক্যাবিনে কারো মুখে কথা সরলো না।
বিভিন্ন ক্যাবিন থেকে তখনও ভয়ার্ত আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিলো। বনহুর কোনোরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব না করে দ্রুত বেরিয়ে গেলো ক্যাবিন থেকে, আবু সাঈদ বা নীহার কিছু বলবার আগেই চলে গেলো সে। তার নিকটেই ছিলো রিভলভার, রিভলভার নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রসর হলো।
বাইরে বেরিয়ে আসতেই ডেকের ঝাপসা আলোতে দেখলো–কে একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
বনহুর বললো–কে তুমি?
হাঁপাচ্ছে লোকটা, বললো–বাবু বাবু, আমি ফুলমিয়া…
ফুলমিয়া ভালভাবে তাকিয়ে দেখলো, ফুলমিয়া বলির পাঠার মত থরথর করে কাঁপছে। তার মুখ যেন মরার মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ভয়ার্তভাবে দেখাচ্ছে সে–বাবু, ঐদিকে দেখুন– ঐ যে ঐ দিকে…সাগরবক্ষে অন্ধকারে কি যেন দেখাচ্ছে ফুলমিয়া।
বনহুর হঠাৎ কিছু বুঝতে না পেরে দ্রুত ডেকের ধারে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলো। গভীর জলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আড়ষ্ট হলো বনহুর, জমাট অন্ধকারে তালগাছের গুঁড়ির মত বিরাট লম্বা কিছু নজরে পড়লো, ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে তালগাছের মত লম্বা জিনিসটা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যই তার দৃষ্টিতে পড়েছিলো। বনহুর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কালো লম্বা জিনিসটা সাগরবক্ষে অদৃশ্য হতেই ফিরে তাকালো ফুলমিয়ার দিকে।
ফুলমিয়া তখনও কাঁপছিলো ঠক্ ঠক করে।
অল্পক্ষণেই আবু সাঈদ, কেশব আরও কয়েকজন এসে হাজির হলেন জাহাজের ডেকে। সকলেরই চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ। প্রত্যেকের হস্তে রাইফেল এবং রিভলভার।
আবু সাঈদের হস্তে রিভলভার, তিনি বললেন–কি ঘটলো আলম? কি হয়েছে?
বনহুর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ফুলমিয়া বাধা দিয়ে বলে উঠে–স্যার, এখানে আর একদন্ড থাকবেন না, চলুন ক্যাবিনে চলুন, সব আমি বলবো…।
আবু সাঈদ এবং অন্যান্যে ফুলমিয়াকে ভয়-বিহ্বলভাবে কথা বলতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছেন, তেমনি আশঙ্কিত হয়েছেন–না জানি কি দুর্ঘটনা আজ ঘটেছে!
ততক্ষণে নাসের এবং জলিলের দলের লোকজনও ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে আসে, ঘিরে দাঁড়ায় সবাই ফুলমিয়া আর আলমকে। কিন্তু জলিল কোথায়, নাসের জলিলের অন্বেষণে চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকায়। অনেক সন্ধান করেও নাসের জলিলকে দেখতে পায় না। অবাক হয় নাসের মনে মনে, জলিল যাকে হত্যা করতে এসেছে সেই আলম সুস্থ-সবল দেহে দাঁড়িয়ে আছে, আর সে উধাও হয়েছে। তবে কি ঐ আর্তনাদের শব্দটা জলিলের কণ্ঠের…নাসের হতভম্ব হয়ে যায়।
ফুলমিয়ার ভয়ার্ত দৃষ্টি তখনও সাগর-জলে বারবার চলে যাচ্ছিলো, বললো সে চঞ্চল কণ্ঠে আপনারা ক্যাবিনে চলুন বাবু, আপনারা ক্যাবিনে চলুন। আমি সব বলবো…
আবু সাঈদ বললো–তাই চলো আলম, দেখি ফুলমিয়া কি বলে।
আবু সাঈদের সঙ্গে সবাই তার প্রশস্ত ক্যাবিনে এসে জড়ো হলো। এমন কি নাসের, শম্ভু, জম্বু ও অন্যান্য লাঠিয়ালও এসে পড়েছে। সকলের মুখেই দুশ্চিন্তার কালো মেঘ।
ফুলমিয়াকে আবু সাঈদ একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো কারণ সে এখনও ঠক্ ঠক করে কাঁপছিলো।
বনহুর বললো–স্যার, অত্যন্ত ভয়াবহ সংবাদ। আমার মনে হয় আজও কাউকে সেই অদ্ভুত জীবটা ভক্ষণ করে সাগরগর্ভে অন্তর্হিত হয়েছে।
অবাক কণ্ঠে বললেন আবু সাঈদ–সর্বনাশ ঘটেছে! আমারও ঐ রকম সন্দেহ হচ্ছিলো। কারণ জাহাজটা কাৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকারের শব্দ আমাদের কানে এসেছিলো। কিন্তু আশ্চর্য, আর্তনাদের আওয়াজটা ঠিক আমার ক্যাবিনের পিছন থেকেই ভেসে এসেছিলো বলে মনে হয়েছিলো।
ফুলমিয়া বলে উঠে–স্যার, আপনি যদি অভয় দেন তাহলে আমি যা জানি এবং দেখেছি সব খুলে বলবো।
ফুলমিয়ার কথায় আবু সাঈদ বিস্মিত হলেন, তিনিই শুধু নন, অন্যান্যেও অবাক হলো তার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে। বনহুরও আশ্চর্য হয়ে গেলো–কি বলতে চায় ফুলমিয়া!
আবু সাঈদ বললেন–ভয়ের কোনো কারণ নেই, তুমি নির্ভয়ে বলো।
ফুলমিয়া নাসেরের দিকে এবং তার নিজের দলবলের মুখের দিকে একবার সন্দিহানভাবে তাকিয়ে নিয়ে বললো–আমি সব সত্য কথা বলবে এবং সত্য কথা বলার পর আমার মৃত্যু ঘটবে…ছোট স্যার এবং আমার দলবল আমাকে হত্যা করবে স্যার!
নাসেরের এবং লাঠিয়াল দলের মুখে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠলো। ফুলমিয়ার কথা তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
কক্ষস্থ সকলে একবার ফুলমিয়া এবং নাসের ও লাঠিয়াল দলের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো, সকলেই ফুলমিয়ার কথার মানে বুঝে উঠতে পারছিলো না।
নীহার এবং বনহুর নিশ্চুপ শুনছিলো।
বললেন আবু সাঈদ-ফুলমিয়া, তুমি যা বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো। তারপর তুমি যদি নিহত বা নিরুদ্দেশ হও তাহলে আমি কাউকে ক্ষমা করবো না। সে যাই হোক আমি সমুচিত শাস্তি দেবো।
তখনও ক্যাবিন-মধ্যে কারো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি।
ফুলমিয়া বলবার পূর্বে আবার একবার নাসের এবং লাঠিয়াল দলের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয়, বলে সে–স্যার, প্রথমে একটি কথা জেনে রাখবেন, নাসের সাহেব এবং আমার দলবল মানে আমাদের সর্দার জলিল মিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গ–এরা সবাই আলম সাহেবকে মন্দ চোখে দেখে। তাকে হত্যা করার জন্য ওদের অত্যন্ত আগ্রহ। বিশেষ করে নাসের সাহেবই এদের এ ব্যাপারে উৎসাহ…
গর্জন করে উঠে এবার নাসের, কারণ এতোক্ষণে সে ফুলমিয়ার মনোভাব স্পষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
নাসের হুঙ্কার ছাড়তেই আবু সাঈদ বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে উঠেন–চুপ করে শুনে যাও নাসের, কোনো রকম গন্ডগোল করলে আমি নিজ হস্তে গুলী চালাবো।
নীহার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাসেরের দিকে।
ফুলমিয়ার এবার সাহস হলো, সে আলমকে হত্যা-ব্যাপার নিয়ে হেডনাবিক মকবুলের হত্যা এবং জাহাজের ইঞ্জিনে আলমকে নিষ্পেষিত করে তাকে হত্যা করার চেষ্টা আরও পর পর। আলমকে নিহত করার জন্য নাসেরের কার্যাবলি সব সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বললো।
নাসের, এবং শম্ভু, জম্বু রাগে ফুলতে লাগলো হিংস্র জন্তুর মত; কিন্তু তারা টু শব্দটি করতে সাহসী হচ্ছে না, কারণ স্বয়ং আবু সাঈদ এবং তাঁর প্রতিটি অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধব সকলেই উপস্থিত এ ক্যাবিনে। তাছাড়া স্বয়ং আলম রয়েছে সেই স্থানে, জানে ওরা আলমের শক্তির পরিচয়। আলমের হস্তে এখনও গুলীভরা রিভলভার–ক্যাবিনের উজ্জ্বল আলোতে চক্ করছে। নাসের এবং শয়তানের দল বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো খাঁচার বন্দী ধূর্ত শিয়ালের মত।
ফুলমিয়া সব বললো, আলমকে হত্যার জন্য সিঁড়ির মুখ নষ্ট করে দিয়েছিলো ঐ নাসেরের যুক্তিতে জলিলের দল এবং আলমকে বাঁচাতে যেয়েই সে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলো সাগরগর্ভে। কিন্তু মহান হৃদয় আলম তাকে মৃত্যুর কবল থেকেও বাঁচিয়ে নিয়েছে।
সব শুনে নীহার ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস্ ফেস্ করতে লাগলো। তখনই নাসেরকে জীবন্ত সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করার জন্য পিতাকে অনুরোধ জানাতে লাগলো।
কিন্তু আলমের মুখ সচ্ছ-স্বাভাবিক, সে আজ কথাগুলো নিজ কানে নতুন করে শুনলেও বহু। পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলো, নাসের এবং জলিলের দল তাকে হত্যা করতে চায়। বনহুর বুঝেও নীরব ছিলো, কোনোদিন সে বলেনি বা জানায়নি কারো কাছে। আজ শুনে সে বিন্দুমাত্র বিস্মিত হলো না। নীরবে শুনে যেতে লাগলো ফুলমিয়ার কথাগুলো।
নীহার শুধু অবাকই হচ্ছে না, প্রত্যেকটি ছবি ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। কি ভয়ঙ্কর হৃদয়হীন জানোয়ার এই শয়তান নাসের। নীহারের মুখ কঠিন রক্তাভ হয়ে উঠেছে, এই দন্ডে সে যেন নাসের এবং জলিলের দলকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
ফুলমিয়া সমস্ত ঘটনা একটির পর একটি ব্যক্ত করে চলেছে। এবার শুরু করে আজকের ঘটনা। নাসেরের কাছে জলিল একশত স্বর্ণমুদ্রার লোভে আজ এই মৃত্যুভয়ঙ্কর রাত্রির অন্ধকারে আত্নগোপন করে কিভাবে সে এসেছিলো নির্দোষ নিষ্পাপ আলম সাহেবকে হত্যা করতে, কিভাবে সে গোপনে সব জেনে নিয়ে জলিলের পিছু নিয়েছিলো, কি ভাবে একখানা সুতীক্ষ্ণ ধার ছোরা লুকিয়ে নিয়েছিলো কাপড়ের মধ্যে। জলিল যখন আলম সাহেবকে গুলী ছুঁড়তে যাবে ঠিক তখন। তার পিঠে ছুরিখানা বসিয়ে দেবে ভেবেছিলো কিন্তু সে ভাগ্য তার হলো না। ফুলমিয়া কাপড়ের তলা থেকে ছোরাখানা বের করে আবু সাঈদের সম্মুখে টেবিলে রাখে।
কক্ষমধ্যে কারো মুখে কথা নেই। আবু সাঈদের ক্যাবিন যেন বিচারকের আদালত কক্ষ বনে গেছে। সবাই ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে শুনে চলেছেন। আসামীর মত মুখ চুন করে বিবর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে নাসের ও তাদের দলবল।
আবু সাঈদ যেন স্বয়ং বিচারক।
গম্ভীর মুখে তিনি সব শুনে যাচ্ছেন, ক্ষণে ক্ষণে তার মধ্যে ভাবের পরিবর্তন আসছে, ফুলমিয়ার কথাগুলো তিনি মনোযোগ সহকারে শুনছেন।
বলে চলেছে ফুলমিয়া স্যার, জলিল সর্দার যখন ঠিক আপনার ক্যাবিনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন আমিও কিছুটা দূরে একটা থামের আড়ালে এসে লুকিয়ে পড়ি। ছোরাখানা বের করে নেই হাতে, যেমনি জলিল সর্দার পিস্তল লক্ষ্য করবে তখনি আমি কাজ শেষ করবো। কিন্তু স্যার, কি বলবো গা আমার কাঁপছে। জলিল সর্দারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি–জাহাজের গা বেয়ে উঠে এলো গাছের গুঁড়ির মত জমকালো একটা লম্বামত কি যেন। সেই ভয়ঙ্কর জীব, সঙ্গে সঙ্গে জাহাজখানা কাৎ হয়ে গেলো এক পাশে। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম কিন্তু আমার চোখ দুটো জলিল সর্দারের দিকেই রয়েছে। গাছের গুঁড়ির মত জীবটা জলিল সর্দারকে তুলে নিলো টপ। করে। আমার কানে এলো জলিল সর্দারের করুণ আর্তনাদ, আমি কি দেখলাম, সে কি ভয়ঙ্কর…
এবার নাসের এবং জলিলের দলবল ভয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। তাহলে জলিল আর আমাদের জাহাজে নেই? সে ঐ ভয়ঙ্কর জীবটার উদরে চলে গেছে। এই তো কয়েকমিনিট পূর্বে সে তার কাছ থেকে পিস্তলটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। আলমকে হত্যা করা তার হলো না। জলিলের মত একটা পালোয়ান লোকের এই চরম পরিণতি! নাসের হঠাৎ ছুটে গিয়ে বনহুরের হাত দু’খানা চেপে ধরলো–ভাই আলম, আমাকে মাফ করে দাও; আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। সত্যি আমি বড় অকৃতজ্ঞ, না হলে তোমার মত একজন গুণীব্যক্তিকে হত্যার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠতাম। আজ আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেছে, দেখলাম কারো সর্বনাশ করতে চাইলেই করা যায় না, বরং তারই পাল্টা সর্বনাশ ঘটে বসে। জলিল সর্দারই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। বন্ধু, বলো আমাকে ক্ষমা করেছো?
বনহুর হেসে বললো–নাসের সাহেব, আপনি আমার কাছে কোনো দিনই অপরাধী নন। নিজেকে নিজেই ক্ষমা করে নিন, তাহলেই দেখবেন আপনি সচ্ছ হয়ে এসেছেন।
বনহুরের শান্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠস্বরে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
নাসের অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আজ সে নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্তই নয়, লজ্জিত-ব্যথিতও।
জলিলের লাঠিয়ালদের মাথাও নত হয়ে গেলো। সকলের মুখেই লজ্জা,ক্ষোভ আর অনুতাপের ছাপ ফুটে উঠেছে। সর্দারের নির্মম মৃত্যু তাদের মনকে যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। সাহসী শম্বু জন্ধুও ঠিক হাওয়া বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে গেছে। কারো মুখে কোনো কথা সরছে না।
ফুলমিয়ার মুখ দীপ্ত উজ্জ্বল, বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
সবচেয়ে নীহার বিস্মিতা স্তম্ভিতা, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সে নাবিক আলমের দিকে। ওকে যতই সে দেখছে ততই যেন গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, সমস্ত অন্তর দিয়ে অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছা করছে তার।
আবু সাঈদ বললেন–এবার–আলম, হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলো যার জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় কথাগুলো শেষ না করেই আমরা অন্যমনস্ক হতে বাধ্য হয়েছিলাম। অন্যান্যের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন–আপনারা বসুন; দ্বীপের ভূগর্ভে যে রহস্য আলম উদঘাটন করেছে তা এখনও সম্পূর্ণ ব্যক্ত করা হয়নি।
ক্যাবিনস্থ সকলে আসন গ্রহণ করলেন।
বনহুরও বসলো আবু সাঈদের পাশে।
আবু সাঈদ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন–বহুকাল পূর্বে সাগরতলে ধ্বসে-পড়া ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ যে এককালে বিরাট একটি শহর ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আশ্চর্য, বহুদিন এইসব বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা গভীর জলের নিচে ডুবন্ত অবস্থায় থেকে আবার জেগে উঠেছে। দ্বীপ আকারে। অনেক দিন শহরটা সাগরতলে নিমজ্জিত থাকায় শ্যাওলা, বালি, কাদা এবং নোনা মাটির স্তর পড়ে গেছে। কাজেই বাড়ি-ঘরের ধ্বংসস্তূপের উপরে দেখলে বোঝা মুস্কিল যে, এখানে এককালে কোনো শহর বা বাড়ি-ঘর কিংবা ঐ ধরনের কিছু ছিলো। থামলেন আবু সাঈদ, তিনি নতুন মানুষ নন, অভিজ্ঞ পর্যটক এবং ভূতত্ববিদ। আলমের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনাটা শোনার পর তিনি সব কিছু বুঝতে পেরেছেন। তিনি পুনরায় বলতে শুরু করলেন–আলম যে লাশগুলো ঐ ভগ্নস্তূপের মধ্যে দেখেছে, আশ্চর্য আজও সেই শত শত বছর পূর্বের লাশ অবকৃত অবস্থায় রয়েছে। এর বিশেষ কারণ আছে যার জন্য লাশগুলো আজও পঁচে নষ্ট হয়ে যায়নি।
ক্যাবিনের মধ্যস্থ ব্যক্তিগণ সকলেই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই।
বলছেন আবু সাঈদ–শত শত বছর গভীর সাগরতলে শহরটা নিমজ্জিত ছিলো বটে কিন্তু ঐ ভগ্নস্তূপের সব স্থানেই সাগর-জল প্রবেশে সক্ষম হয়নি। তার প্রমাণ হলো, আলম সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করে যে ধসে-পড়া কক্ষগুলো চোখে দেখে এসেছে, ঐ কক্ষগুলো গভীর জল-মধ্যে নিমগ্ন হলেও ওগুলোতে সাগরের নোনা জল প্রবেশ করেনি, কিন্তু সাগরের জলের যে একটা তীব্র নোনা স্বাদ আছে তারই গ্যাস বদ্ধ ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষমধ্যেও প্ররেশ করেছে। সেই তীব্র নোনা গ্যাসের জন্য মৃতদেহগুলো গলে পঁচে যায়নি। নোনা জিনিসে যেমন কোনো বস্তু অতি শীঘ্র নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু নোনা গ্যাসের দ্বারা যে-কোনো জীবের মৃতদেহ যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়। এখন আমরা বুঝতে পারছি, ঐ ভূগর্ভস্থ কক্ষমধ্যে মৃতদেহগুলো কেন আজও অবিকৃত রয়েছে।
বনহুর বললো–স্যার, আপনি যা বললেন সেই কথা সম্পূর্ণ সত্য। আমারও ঐ রকমই মনে। হয়েছিলো।
হাঁ, ঠিক তাই; ঐ মৃতদেহগুলো নোনা গ্যাসের দ্বারা মমি আকারে শক্ত হয়ে গেছে এবং পাশের ধসে-পড়া কক্ষে যে আলোর বেলুনগুলো আলমের দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো সেগুলোই আমরা ঐ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের বুকে জাহাজ থেকে দেখে থাকি।
একজন বিজ্ঞ পর্যটক বলে উঠলেন–মিঃ সাঈদ, ঐ আলোগুলো সম্বন্ধে আপনার কি মনে হয়?
আবু সাঈদ বললেন–ঐ আলোর বেলুন সম্বন্ধে এখন আমি নিশ্চিন্ত। ঐ আলোগুলো কোনো আত্মা বা আলোকরশ্মি নয়।
তবে কি? বললো এবার নীহার।
বললেন আবু সাঈদ–আলেয়ার আলো!
আলেয়ার আলো? অবাক কণ্ঠে বললো নীহার পুনরায়।
হাঁ, বহু জীবজন্তু মাটির নিচে চাপা পড়ায় একরকম গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে, সে গ্যাস থেকে ঐ অস্পর্শীয় আলোর সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশেও মাঝে মাঝে শ্মশান বা করবস্থানে ঐ রকম আলো দেখা গিয়ে থাকে, তার নাম–আলেয়ার আলো।
ক্যাবিন-মধ্যে একটা সাফল্যজনক আনন্দধ্বনি ফুটে উঠলো। আবু সাঈদ বললেন–এবার আমরা ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের আলোর রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছি। এখন বাকি রইলো সেই তীব্র হুইসেলধ্বনির রহস্য উদঘাটন … একটু থেমে বললেন তিনি পুনরায়–জানি না সে রহস্য ভেদ করা আমাদের সম্ভব হবে কিনা। আমি সত্যি দুঃখিত এবং অনুতপ্ত কারণ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের জাহাজের অনেকেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন…বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো তার কণ্ঠস্বর।
সেদিনের মত আর কোনো আলাপ-আলোচনা হলো না। রাত গম্ভীর হয়ে এসেছে বলে যে যার ক্যাবিনে চলে গেলো। সাবধানতা এবং সতর্কতার সঙ্গেই সবাই নিজ নিজ ক্যাবিনে গিয়ে আশ্রয় নিলো অবশ্য জাহাজের উপরের ক্যাবিনগুলোতেই সকলের জন্য ব্যবস্থা ছিলো।
সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং অনেক রাত অবধি নিদ্রা জাগরণে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিদ্রিত হয়ে পড়লো। কয়েকজন পাহারাদার অবশ্য পাহারার কারণে জাগ্রত রইলো, কিন্তু তারা ক্যাবিনের বাইরে বের হওয়ার সাহসী হলো না।
বনহুর আর কেশবের বিশ্রামের জন্য আবু সাঈদের পাশের ক্যাবিনের ব্যবস্থা ছিলো। কেশব আর বনহুর শয্যা গ্রহণ করলো।
নিদ্রা-কাতুরে কেশব অল্পক্ষণেই নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়লো। জেগে রইলো বনহুর, চোখে তার নিদ্রা নেই। ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের আলোক-রহস্য উদঘাটিত হয়েছে বটে কিন্তু ঐ তীব্র হুইসেলের শব্দ-রহস্য এখনও ভেদ করা সম্ভব হয়নি। তবে শব্দটা যে কোনো এক ভয়ঙ্কর জীবের তাতে কোনো ভুল নেই এবং সেই জীবটাই তাদের জাহাজে বার বার আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজনকে গলধঃকরণ করেছে।
বনহুর শয্যায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, এই রহস্যটা ভেদ না হওয়া পর্যন্ত তারা নিশ্চিন্ত। নয়। কি সে জীব? সামান্য একটুখানি দেখবার সুযোগ পেয়েছিলো সে অতি অস্পষ্টভাবে, কি ভয়ঙ্কর জমকালো–ঠিক গাছের গুঁড়ির মত মোটা এবং মস্ত লম্বা বলেই মনে হয়েছিলো। অক্টোপাশ মনে করেছিলো সে প্রথমে, কিন্তু অক্টোপাশ নয় বুঝতে পেরেছে। কি সে জীব হতে। পারে? গভীরভাবে বনহুর চিন্তা করতে লাগলো।
এমন সময় জাহাজটা যেন দুলছে বলে মনে হলো। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে শয্যা ত্যাগ করলো, বালিশের তলা হতে রিভলভারটা টেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঠিক ঐ জীবটা পুনরায় জাহাজে উঠে আসছে বলে সন্দেহ হলো তার। সতর্কভাবে তাকালো ক্যাবিনে কেশবই শুধু নয়, আরও কয়েকজন লোকও ঐ ক্যাবিনে নিদ্রিত রয়েছে। বনহুর লঘুপদে বেরিয়ে এলো ক্যাবিন হতে। বাইরে দাঁড়িয়ে ক্যাবিনের দরজা বন্ধ করে দিলো ভালভাবে।
চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্ধকারে এগুতে লাগলো বনহুর, যেদিক বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে বিরাট লম্বা দেহী জীবটা অন্তর্হিত হয়েছিলো।
সমস্ত জাহাজখানা নিস্তব্ধ, নীবর-নিঝুম। জনপ্রাণী জাহাজের ডেকে কেউ নেই। প্রায় সকলেই নিদ্রিত, যারা জেগে আছে তারাও কেউ বাইরে নেই।
জাহাজখানা এতোক্ষণ বেশ দুলছিলো, এখন হঠাৎ এক দিকে খানিকটা কাৎ হয়ে গেলো আচমকা। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাবিন থেকে ভেসে এলো নিদ্রাজড়িত আর্তনাদ। ভয়ার্তকরুণ গুঞ্জনধ্বনি। ক্যাবিন মধ্যে এ-ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, নিদ্রা ছুটে গেলো মুহূর্তে সকলের চোখ হতে।
জেগে উঠলেন আবু সাঈদ, নীহারের ঘুমও ভেঙে গেলে সঙ্গে সঙ্গে। আবু সাঈদ আশঙ্কা ভরা কণ্ঠে বললেন–সর্বনাশ হয়েছে, আবার সেই নরখাদক ভয়ঙ্কর জীব হানা দিয়েছে আমাদের জাহাজে–এখন উপায়?
নীহার কম্পিতকণ্ঠে বললো–আব্বা, আমার বড্ড ভয় হচ্ছে। তখন জলিলকে খেয়েছে, এখন কাকে খাবে কে জানে। হায়, একি হলো আব্বা, আলম আর কেশবকে ছেড়ে দেওয়া তোমার উচিত হয়নি।
মা তাই তো দেখছি, আমি মস্তবড় ভুল করেছি।
বিভিন্ন ক্যাবিন থেকে তখন আর্ত কোলাহল ভেসে আসছে। জাহাজখানা কাৎ হয়ে গেছে। একপাশে, না জানি কখন সাগরবক্ষে নিমজ্জিত হবে কে জানে।
ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে আবু সাঈদ আর নীহারের মুখমন্ডল।
পাশের ক্যাবিনে কেশব আর অন্যান্য নাবিকও জেগে উঠেছে; সবাই ঈশ্বরের নাম স্মরণ করছে।
হঠাৎ কেশবের হুশ হয়, বাবু কোথায়? তার বাবু…কেশব বনহুরের বিছানা শূন্য দেখেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। চিৎকার করে ডাক দেয়–বাবু–বাবু–বাবু…
কিন্তু অজস্র ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরের মধ্যে তলিয়ে যায় কেশবের কণ্ঠস্বর। কেশব কারো কোনো বাধা না শুনে ছুটে যায় আবু সাঈদের ক্যাবিনে, হাউ মাউ করে কেঁদে বলে–স্যার, বাবু নেই, আমার বাবু নেই, বাবু নেই স্যার…
আবু সাঈদ এবং নীহার কথাটা শুনে বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে যান।
আবু সাঈদ বলে উঠলেন–কেশব, এ তুমি কি বলছো? আলম ক্যাবিনে নেই?
না না স্যার, বাবু ক্যাবিনে নেই।
তবে কোথায় গেলো?
নীহার হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো দু’হাতে মুখ চেপে ধরে–আলম, শেষ অবধি তোমার অদৃষ্টে এই ছিলো…আব্বা তুমি ওকে খুঁজে দেখো আব্বা…
কিন্তু কার সাহস আছে ঐ মুহূর্তে ক্যাবিন ত্যাগ করে বাইরে যায়। কেশব বাইরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো কিন্তু আবু সাঈদের আদেশে অন্যান্য লোক তাকে ধরে ফেললো। কেশব ক্যাবিনের দেয়ালে মাথা ঠুকে বিলাপ করে চললো।
এদিকে জাহাজ তখন একটা মোচার খোলার মতই দুলছে। না জানি কোন মুহূর্তে তলিয়ে যাবে। প্রত্যেকটা ক্যাবিনে আর্ত-কোলাহল, মৃত্যু ভয়ে সবাই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
বনহুর তখন উদ্যত রিভলভারহস্তে সন্তর্পণে অন্ধকারে এগুচ্ছে, যেদিকে জাহাজখানা সম্পূর্ণভাবে কাৎ হয়ে রয়েছে ঐ দিকে সে আজ দেখতে চায়, জীবটা কি এবং কেমন দেখতে। দুর্দান্ত সাহস আর মনোবল নিয়ে সে অগ্রসর হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে তার মৃত্যু ঘটতে পারে।
বনহুর আজ নাবিক আলম নয়–সে দস্যু বনহুর।
তার মধ্যে জেগে উঠেছে ভয়ঙ্কর প্রাণ। সে প্রাণে নেই ভয়-ভীতি বা কোনো আতঙ্কের ছাপ। এই দন্ডে যদি কেউ বনহুরের আসল রূপ দেখতো নিশ্চয়ই সে স্তম্ভিত হয়ে যেতো। কঠিন হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল, চোখ দুটি দিয়ে যেন অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে। নাসিকাতে দ্রুত নিশ্বাস পতনের শব্দ হচ্ছে যেমন পশুরাজ শিকারের সন্ধান পেয়ে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে ঠিক তেমনি। বনহুর ক্ষিপ্তের ন্যায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে, আজ সে দেখবে জীবটা কি।
অত্যন্ত সাবধানে জাহাজের ক্যাবিনের কোল ঘেষে কখনও বা উবু হয়ে মাথা নিচু করে বনহুর এসে পড়লো পিছন ডেকে অন্ধকারময় এক স্থানে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো, কারণ এইস্থানে তিন পাশে বিভিন্ন ক্যাবিনের দেয়াল–সম্মুখভাগ খোলা, কাজেই ঐ স্থানে দাঁড়ালে জাহাজের প্রায় সম্পূর্ণ ডেকে নজর পড়ে অথচ তাকে সহসা পিছন থেকে কেউ আক্রমণে সক্ষম হয় না। বনহুর এই স্থানে দাঁড়িয়ে তাকালো সম্মুখস্থ সাগরবক্ষে। হঠাৎ বিস্ময়ে চমকে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিনের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে মিশে দাঁড়ালো, দেখতে পেলো বনহুর-তার নিকট হতে অনেকটা দূরে খোলা ডেকের উপরে অন্ধকারে একটা জমকালো গাছের গুঁড়ির মত কি যেন গড়াচ্ছে। ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখলো, সেই গাছের গুঁড়ি অর্ধেকটা এখনও সাগরবক্ষে ডুবন্ত অবস্থায় রয়েছে। দুটো টর্চলাইটের মত কি যেন জ্বলছে গুঁড়িটার অগ্রভাগে।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রিভলভার থেকে গুলী ছুঁড়লো ঠিক ঐ টর্চলাইটের মত জ্বলন্ত বল দুটি লক্ষ্য করে। পর-পর কয়েকটা গুলী সে এক সঙ্গে করে বসলো নিশ্বাস বন্ধ করে। ভুলে গেল বনহুর নিজের অস্তিত্ব, বিস্মৃত হয়ে গেছে সে সমস্ত দুনিয়াটাকে। বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করেছে। ঐ ভয়ঙ্কর জীবটাকে।
বনহুরের রিভলভারের পর পর গুলীর আঘাত খেয়ে জীবটা তীব্র হুইসেলধ্বনির মত কানফাটা আওয়াজ করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো ভীষণ এক তান্ডবলীলা। জাহাজখানা সাইক্লোন ঝড়ের মুখে মোচার খোলার মত দোল খেতে লাগলো। পর মুহূর্তে জীবটা গড়িয়ে পড়লো সাগরবক্ষে।
এবার সাগরের জলের মধ্যে শুরু হলো সেকি সাংঘাতিক তোলপাড়! জাহাজ ডুবু ডুবু অবস্থা, সমস্ত জাহাজ আর্তনাদ আর কোলাহলে ভরে উঠেছে। আর বুঝি রক্ষা নেই, এই বুঝি শেষ!
বনহুর একটা থাম ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, সমস্ত দেহ তার জলের ঝাপটায় ভিজে উঠেছে। চুল, জামা-কাপড় সব একাকার হয়ে গেছে। দক্ষিণ হস্তে এখনও তার রিভলভার বুঝতে বাকি নেই বনহুরের গুলী খেয়ে জীবটার চরম অবস্থা হয়েছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাগরবক্ষের প্রচন্ড আলোড়ন ক্রমান্বয়ে স্থির হয়ে এলো। সাগরে জলোচ্ছাস শান্ত হওয়ার সঙ্গে জাহাজখানাও যেন শান্ত হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। আশ্বস্ত হলো বনহুর, এতোক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে এলো তার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে চোখমুখের পানি মুছে ফেললো।
জাহাজ শান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজের ক্যাবিন-মধ্যের ভয়ার্ত আর্ত চিৎকার থেমে এলো, তবে মৃদু গুঞ্জন থামলো না। ক্যাবিন-মধ্যে নানারকম ভয়-বিহ্বল আলোচনা চলছে তীব্রভাবে। কিন্তু কারো সাহস হচ্ছে না বাইরে বেরিয়ে আসে।
আবু সাঈদের মত অভিজ্ঞ এবং দুঃসাহসী পর্যটক পর্যন্ত আজ একেবারে হকচকিয়ে গেছেন, তিনি কি করবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না যেন। আলমই যে আজ ঐ ভয়ঙ্কর জীবটার খোরাক হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না আবু সাঈদের। নীহারও পিতার মনোভাব বুঝতে পেরে কেঁদে-কেটে আকুল হয়েছে, কিন্তু ভয় আর দুর্ভাবনাই তাকে বেশি উদভ্রান্ত করে তুলেছে, এবার আর বুঝি রক্ষা নেই কারো।
হঠাৎ রিভলভারের পর-পর আওয়াজ শোনার পর আবু সাঈদ কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না কোথায় থেকে এ গুলীর শব্দ আসছে। পরক্ষণেই শুরু হয়েছিলো সাইক্লোন ঝড়ের মত ভীষণ অবস্থা। আবু সাঈদ সব ভুলে কন্যাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বুকের মধ্যে–মা, আর বুঝি রক্ষা পেলাম না আমরা। এবার সাগরবক্ষে জাহাজডুবি হয়ে সবাই মরবো।
নীহার ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলো, কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না। থরথর করে কাঁপছিলো সে পিতাকে আঁকড়ে ধরে।
কিন্তু যেই দন্ডে জাহাজ একেবারে স্থির হয়ে পড়লো তখন আবু সাঈদ নিজের রিভলভারখানা নিয়ে দ্রুত বের হতে যাচ্ছিলেন ঠিক ঐ সময় তার ক্যাবিনের দরজায় আঘাত পড়ে।
চমকে উঠেন আবু সাঈদ, তবে কি জীবটা এবার তার দরজায় এসে হানা দিলো? দরজা খুলে বের না হয়ে তিনি এক পাশে দাঁড়িয়ে রিভলভার উদ্যত করে ধরলেন।
সেই সময় পুনরায় দরজায় আঘাত হলো এবং শোনা গেলো বনহুরের কণ্ঠস্বর–স্যার, দরজা খুলুন। দরজা খুলুন–
আবু সাঈদ দরজা খুলবার পূর্বেই তাঁর পাশে দন্ডায়মান নীহার দ্রুতহস্তে দরজা খুলে দেয়, চোখেমুখে তার ফুটে উঠে আনন্দোচ্ছাস।
বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে।
নীহার ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে–আলম। আলম–
আবু সাঈদও কম খুশি হননি, এতোক্ষণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন–আলম আর জীবিত নেই। আবু সাঈদ নিজেও বনহুরকে বুকে আঁকড়ে ধরলেন।
ক্যাবিন-মধ্যে আরও অনেকে ছিলো, সবাই বনহুরকে ঘিরে ধরে নানারকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো।
বনহুর শান্ত কন্ঠে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো। কিন্তু জীবটা এখনও জীবিত আছে না তার মৃত্যু ঘটেছে বলতে পারলো না। তবে যতদূর সম্ভব জীবটা নিহতই হয়েছে বলে মনে করছে সে, কারণ পর-পর কয়েকটা গুলীই জীবটার মাথায় গিয়ে বিদ্ধ হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনার মধ্যেই একসময় পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে এলো। এমন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার পর কেউ আর ঘুমাতে পারেনি।
ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই জাহাজের ক্যাবিন থেকে বের হয়ে এলো। বনহুর, আবু সাঈদ, কেশব আর নীহার সবার আগে, পিছনে অন্যান্যে। জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়াতেই একজন খালাসি ছুটে এলো পিছন ডেকের দিক হতে।
সবাই তাকালো খালাসিটার দিকে।
হাঁপাচ্ছে খালাসি বেচারী, দু’চোখ ছানাবড়ার মত বড় হয়ে উঠেছে। বারবার ভয়-কাতর দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে পিছন ডেকের দিকে, কিছু যেন বলতে চাইছে কিন্তু সহসা বলতে পারছে না, কণ্ঠ যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে তার।
আবু সাঈদ বললেন–কি হয়েছে বলো? কোনো ভয় নেই এখন আর।
খালাসি লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো–ঐদিকে গিয়ে দেখুন স্যার জাহাজের গায়ে–আর বলতে পারলো না সে।
আবু সাঈদ বললেন–চলো দেখি আলম কি ব্যাপার।
বনহুর এবং অন্যান্য আবু সাঈদকে অনুসরণ করলো। জাহাজের পিছন দিকে এসে সাগরবক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সকলেরই চক্ষুস্থির হলো, কারো মুখে যেন কথা বের হলো না সহসা। বনহুর আর আবু সাঈদ উভয়ে একবার তাকালো উভয়ের দিকে, বনহুর বুঝতে পারলো, রাত্রির অন্ধকারে তার একটি গুলীও বিফলে যায়নি।
তালবৃক্ষের মত মোটা বিরাট এক অজগর সাপ মৃত অবস্থায় জাহাজের গায়ে ভেসে রয়েছে। লম্বায় কত হাত হবে বলা মুস্কিল দেহটা গাছের গুঁড়ির মত মোটা আর কয়লার মত কালো।
নীহার ভয়ে চেপে ধরলো পিতাকে, দুরু দুরু কাঁপছে তার দেহটা।
আবু সাঈদ বললেন–মা, সব ভয় দূর হয়ে গেছে। শুধু ভয়ই দূর হয়নি নীহার, আজ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের সবকিছু রহস্যই উঘাটিত হয়েছে। এই সর্পরাজেরই কণ্ঠের তীব্র হুইসেলধ্বনি। এতোদিন আমরা শ্রবণ করে এসেছি। এপথে যতগুলো জাহাজ গেছে তারা সবাই এই শব্দ শুনতে পেয়েছিলো এবং যত নাবিক বা জাহাজের আরোহিগণ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তাদের প্রায় ব্যক্তিই এই সর্পরাজের উদরে প্রবেশ করেছে। আজ সেই নরখাদক সর্পরাজের জীবন নাশ ঘটেছে। ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে আজ আর কোনো ভয় রইলো না। থামলেন আবু সাঈদ, ফিরে দাঁড়ালেন তিনি বনহুরের দিকে, পিঠে হাত রেখে বললেন–এ সবের কৃতিত্বের মূলে হলো আলম। আলম শুধু ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের আলোক-রহস্যই উদঘাটন করেনি, সে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের। তীব্র হুইসেলধ্বনিও চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছে। আর কেউ এ শব্দ পাবে না এবং কাউকে আর এভাবে জীবন বিসর্জন দিতে হবে না।
জাহাজের সাবই আনন্দধ্বনি করে উঠলো। সবাই বনহুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো যেন। নাসের এবং জলিলের দল সবাই এসে তাকে মোবারকবাদ জানাতে লাগলো।
আবু সাঈদ এবার সর্পরাজের কতকগুলো ফটো গ্রহণের জন্য ফটোগ্রাফারকে আদেশ দিলেন। সেদিনটা সর্পরাজের দেখা এবং ফটো তোলা নিয়েই ব্যস্ত রইলো সবাই। তারপর বিশ্রাম এবং আনন্দ-উৎসব।
নীহার এক সময় নিজে এসে বনহুরকে অভিনন্দন জানালো। নিজের হাতের একটি অংগুরী খুলে পরিয়ে দিতে গেলো সে ওর আঙ্গুলে। কিন্তু বাধা দিয়ে বললো বনহুর–নীহার, তোমার পিতার উপহার আমি সানন্দে গ্রহণ করেছি, কিন্তু তোমার অংগুরী আমি গ্রহণে অক্ষম।
নীহারের মুখ গম্ভীর হলো, অভিমান-ভরা কণ্ঠে বললো–কেন? আমি কি তোমার কাছে। এতোই হেয়?
বনহুর নীহারের হাত মুঠায় চেপে ধরলো–নীহার, তোমার তুলনায় আমি অতি নগণ্য, তাই তোমার অংগুরী গ্রহণ আমার সাজে না, আমি নাবিক ছাড়া কিছুই নই–
নীহার বনহুরের মুখে হাতচাপা দিলো, একথা আমি তোমার মুখে আরও কতবার শুনেছি। কিন্তু আলম, আমি জানি তুমি নাবিক নও–
নীহার!
আমার আংটি তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে।
যদি খুশি হও তাহলে দাও।
আলম! নীহার অস্ফুট আনন্দধ্বনি করে উঠে, বনহুরের হাতখানা হাতে তুলে নিয়ে নিজের আংগুল থেকে একটি আংটি খুলে নিয়ে পরিয়ে দেয় বনহুরের হাতের আংগুলে।
নীহার অংগুরী পরিয়ে দেয়, মৃদু মৃদু হাসে বনহুর।
*
ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ ত্যাগ করবার পূর্বে আবু সাঈদ একটা আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করলেন! নানারকম গান-বাজনা এবং খাওয়া-দাওয়া হবে। খালাসি হতে নাবিক এবং পর্যটকগণ সবাই এ। উৎসবে যোগদান করবেন।
পর্যটনের যাত্রীগণের মনে আনন্দ আর ধরে না। আবু সাঈদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ–তার এ যাত্রা জয়যুক্ত হয়েছে। সার্থক হয়েছে আলমকে পাওয়া। আবু সাঈদ আলমের কাছে সর্বতোভাবে কৃতজ্ঞ। শুধু আবু সাঈদই নন, জাহাজের প্রত্যেকটা ব্যক্তি বনহুরের সঙ্গে করমর্দন করে নিজকে ধন্য মনে করতে লাগলো। সবাই অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে লাগলো তাকে।
আনন্দ-উৎসব শুরু হলো।
‘পর্যটনে’ যে যা গান-বাজনা জানেন তিনি তাই পরিবেশন করলেন। নীহারও গীটার বাজিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলো।
নানারকম গান-বাজনা চলেছে।
বিকেল থেকে শুরু হয়েছে উৎসব, সন্ধ্যায় উৎসব শেষ হবে।
যে ক্যাবিনে আনন্দ-উৎসব চলেছে ঐ ক্যাবিনটা ছিলো সবচেয়ে বড় এবং প্রশস্ত। এই ক্যাবিনে নানারকম বাদ্যযন্ত্র এবং খেলাধুলোর সরঞ্জাম সাজানো ছিলো। তাছাড়াও আছে রেডিও এবং টেলিভিশন সেট।
নানারকম অশান্তি আর উত্তেজনায় এ ক’দিন কারো টেলিভিশন দেখা সম্ভব হয়ে উঠেনি। আজ সবাই মনস্থ করেছে, উৎসব-শেষে সবাই টেলিভিশন দেখবেন। কারণ আজ তারা নিশ্চিন্ত, উৎসব এবং খাওয়া-দাওয়া-পর্ব শেষ হলেই ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ ত্যাগ করবে জাহাজ ‘পর্যটন’। কারণ আবু সাঈদের কাজ শেষ হয়েছে।
আনন্দোচ্ছাসে জাহাজ-মধ্যে খুশির উৎস বয়ে চললো। কয়েকজন নাবিক নানারকম বাজনা বাজিয়ে শোনালো। কেউ বা গান গাইলো, কেউ বা নাচ দেখালো। ক্যাবিনের চারদিকে সোফায় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ বসে আছেন। আবু সাঈদের পাশেই বসেছে নীহার আর আলম। নাসেরও আছে তাদের পাশে। আর অন্যান্য চারদিকে ভিড় জমিয়ে দেখছে।
নানারকম হাসি-তামাশা আর গান-বাজনার মধ্যে একসময় শেষ হলো জাহাজ ‘পর্যটনের’ আনন্দ-উৎসব।
খাওয়া-দাওয়া-পর্ব শেষ হলো।
অল্পক্ষণ পরেই টেলিভিশন প্রোগ্রাম শুরু হলো।
আবু সাঈদ এবার সোফায় হেলান দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট ধরালেন।
ক্যাবিনের মধ্যে সকলেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো টেলিভিশনে।
পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের পর শুরু হলো এডভারটাইজমেন্ট। বিভিন্ন কোম্পানীর প্রচারপত্রসহ নানারকম ছবি দেখানো আরম্ভ হলো। ব্যাঙ্ক লিমিটেড কোম্পানী থেকে শুরু করে কটন স্পিনিং এবং সিনেমা বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত।
বনহুর অন্যমনস্কভাবে কিছু চিন্তা করছিলো, হয়তো গত রাতের ঘটনাটাই ভাবছিলো সে, দৃষ্টি ছিলো তার টেলিভিশন সেটে। এবার ‘স্বয়ংবরা’ ছায়াছবির এডভারটাইজমেন্ট দেখানো হচ্ছে।
প্রডাকশান, প্রডিউসার ও পরিচালকের নামসহ স্বয়ংবরা ছবির বিজ্ঞপ্তি ভেসে উঠলো টেলিভিশনের পর্দায়। ছবির দু’একটি বিশেষ আকর্ষণীয় দৃশ্যও দেখান শুরু হলো। হঠাৎ চমকে উঠলো বনহুর, দ্রুত সোজা হয়ে বসে অস্কুটধ্বনি করে উঠলো– নূরী।
নিস্তব্ধ কক্ষে বনহুরের কণ্ঠস্বরে সবাই তার দিকে ফিরে তাকালো।
নীহার অবাক হয়ে বললো-আলম, তুমি ওকে চেনো নাকি?
টেলিভিশনে তখন স্বয়ংবরা’ ছবিতে নূতন পার্শ্বনায়িকা নূরীকে স্থিরচিত্রে দেখানো হচ্ছিলো। ভীবালার বেশে নূরী দাঁড়িয়ে আছে। যদিও নূরী হাসছে কিন্তু বনহুরের দৃষ্টিতে সে দেখলো, ওর বিষাদময় করুণ রূপ, চোখেমুখে তার উদ্বিগ্নতার ছাপ। বনহুর সম্বিৎহারার মত আসন ত্যাগ করে ছুটে গিয়ে টেলিভিশন সেট দু’হাত চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো, কিন্তু ততক্ষণে স্বয়ংবরার এ্যাডভারটাইজমেন্ট শেষ হয়ে গেছে।
আলমের এই অদ্ভুত কান্ড দেখে ক্যাবিনস্থ সবাই অবাক হয়ে গেলো। বিস্মিত হলেন আবু সাঈদ। নীহার হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
বনহুর এবার বিষণ্ণ মনে উঠে দাঁড়ালো টেলিভিশন সেট ত্যাগ করে। ফিরে এসে আপন আসনে বসে পড়লো ধপ করে, চোখেমুখে ফুটে উঠেছে এক ব্যাকুলতার ছাপ।
আবু সাঈদ আগ্রহ কণ্ঠে বললেন–আলম, হঠাৎ তুমি এভাবে–কথা শেষ করলেন না তিনি।
নীহারও উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে বনহুরের দিকে।
ক্যাবিনের সকলের দৃষ্টিই তখন বনহুরকে লক্ষ্য করছে, যদিও তাদের দৃষ্টি মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছিলো টেলিভিশনে। সকলের মনেই প্রশ্ন–ব্যাপার কি?
আবু সাঈদের কথায় বললো বনহুর–স্যার, ঐ মেয়েটি আমার আত্মীয়া।
বিস্ময়-ভরা কণ্ঠে বললেন আবু সাঈদ–তোমার আত্মীয়া?
হাঁ, বেশ কিছুদিন পূর্বে জঙ্গলে–ঢাকা এক অজানা পর্বতে সে হারিয়ে গিয়েছিলো–আনমনা। হয়ে যায় বনহুর। এবার তাকে অত্যন্ত গম্ভীর চিন্তাযুক্ত মনে হয়।
টেলিভিশনে তখন চীনা-নৃত্যের দৃশ্য শুরু হয়েছে। কতকগুলো চীনা যুবতী তাদের দেশীয় নৃত্য পরিবেশন করছিলো। ক্যাবিনের প্রায় সকলেই চীনা-নৃত্যে আত্মমগ্ন হয়ে পড়লেন, বনহুর সেই ফাঁকে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
আবু সাঈদও এই অদ্ভুত নৃত্যে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন।
কিন্তু নীহারের দৃষ্টি কোনো সময় আলমের মুখমন্ডল ছাড়া টেলিভিশনের পর্দায় আকৃষ্ট হলো না। বনহুর বেরিয়ে যেতেই নীহার আলগোছে আসন ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো বাইরে।
ভাগ্যিস ক্যাবিনে কেশব ছিলো না তাই রক্ষা, তাহলে নূরীর ছবি টেলিভিশনে দেখে সে ব্যাকুল হয়ে উঠতো। সে কোনো কাজে তখন ক্যাবিনের বাইরে গিয়েছিলো।
বনহুর তার নিজের ক্যাবিনে ফিরে আসে, আজ কদিন হলো এ ক্যাবিন ত্যাগ করে সে উপরের ডেকে চলে গিয়েছিলো। নীরব-নির্জন কক্ষের শয্যায় এসে চীৎ হয়ে শুয়ে পড়লো বনহুর, গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো সে।–নূরীর অন্তর্ধানের পর কেটে গেছে কয়েকটা দিন! ভেবেছিলো বনহুর, নূরীকে আর কোনোদিন সে খুঁজে পাবেনা, নিশ্চয়ই সে জংলীদের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে কিংবা কোনো জন্তু তাকে ভক্ষণ করে ফেলেছে। আজ সে সন্ধান পেয়েছেনূরীর মৃত্যু হয়নি–না না কোনো ভুল নেই, নূরীকে চিনতে তার এতোটুকু ভুল হবে না কোনোদিন। এক সঙ্গে তার কেটেছে শিশুকাল; কৈশোর জীবন, তারপর এখনও নূরী তাকে আবেষ্টনীর মত আঁকড়ে রেখেছিলো সর্বক্ষণ। কিন্তু নূরী কি করে বোম্বে গিয়ে হাজির হলো–শুধু তাই নয়, একেবারে চিত্রজগতে–
হঠাৎ শিয়রে কারো উপস্থিতি অনুভব করে বনহুর, পরক্ষণেই চুলে স্পর্শ একটি কমল হস্তের–আলম।
সম্বিৎ ফিরে আসে বনহুরের, উঠে না বসে যেমন শুয়েছিলো তেমনি থাকে, শুধু চোখ দুটি তুলে ধরে নীহারের মুখে, কোনো জবাব দেয় না।
বনহুর তখন চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নীহারও বেরিয়ে এসেছিলো এবং সন্তর্পণে অনুসরণ করছিলো তাকে।
বনহুর সোজা তার পূর্বের ক্যাবিনে ফিরে এসে দাঁড়ালো ঠিক তার ক্যাবিনের মেঝেতে। অনেকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো, লক্ষ্য করলো–আলম টেলিভিশনে সেই চিত্র তারকার এ্যাডভারটাইজমেন্ট দেখার পর হতে সম্পূর্ণ যেন পাল্টে গেছে। নীহার বনহুরের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো–আলম, সত্যি করে বলো ঐ মেয়েটি তোমার কে?
বনহুর দৃষ্টি নীহারের মুখ থেকে ফিরিয়ে তাকালো ক্যাবিনের লাইটের উজ্জ্বল আলোর দিকে– আমার সঙ্গিনী?
তোমার স্ত্রী?
অস্ফুট কন্ঠে বললো বনহুর হাঁ।
বনহুরের চুল থেকে নীহারের হাতখানা সরে আসে, চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–আলম, একটা চিত্রতারকা তোমার স্ত্রী!
নীহার উঠে দাঁড়াতেই বনহুর শয্যায় বসে পড়লো অবাক হয়ে তাকালো সে ওর মুখের দিকে। নীহারের হঠাৎ এমন বিস্ময়কর কণ্ঠস্বরে কম আশ্চর্য হয়নি বনহুর।
নীহার গম্ভীর কণ্ঠে বললো–চিত্রতারকাগণ কোনোদিন সতীসাধ্বী মেয়ে হতে পারে না, কারণ নানারকম পুরুষের সঙ্গে তাদের মিশতে হয়, নানাভাবে মন যুগিয়ে চলতে হয় তাদের–
মুহূর্তে বনহুরের মুখমন্ডল রক্তাভ হয়ে উঠে, চক্ষুদ্বয় হতে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, কঠিন কণ্ঠে চিৎকার করে উঠে–নীহার?
বনহুরের অগ্নিমূর্তি নীহারকে স্তব্ধ করে দেয়, কিছুক্ষণ কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হয় না। ধীরে ধীরে নীহারের চোখ দুটো নত হয়ে আসে, বলে সে আমাকে ক্ষমা করো আলম।
নীহার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই বনহুর ডাক দেয়-নীহার যেও না।
দাঁড়িয়ে পড়ে নীহার।
বনহুর নীহারের কাঁধে হাত রাখেনীহার, আমার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছে, আমি পারছি না কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে–বনহুর ছুটে গিয়ে বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠে ছোট্ট বালকের মত।
নীহার ওকে ত্যাগ করে চলে যেতে পারে না, সেও এসে বসে বনহুরের পাশে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে–আলম, তুমি শান্ত হও। শান্ত হও, কেঁদো না, কেঁদো না তুমি–
নীহার!
আলম! আলম, কেঁদো না–শান্ত হও। নীহার আজ অবাক না হয়ে পারে না, যে আলমকে সে লোহার মতই কঠিন সংযমী পুরুষ বলে জানে, আজ সে ভুল যেন ভেঙে যায়। আলমের চোখের পানি তার চোখেও অশ্রুর বন্যা এনে দেয়।
এক সময় শান্ত হয়ে আসে বনহুর, নীহারের কোমল হস্তের স্পর্শ তার দেহ-মনে সান্ত্বনা-এনে দেয়। কখন ঘুমিয়ে পড়ে সে, নীহার তখনও ওর চুলের ফাঁকে আংগুল চালনা করে চলেছে।
বনহুরের মাথাটা বালিশের উপর ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে দেহে চাদরখানা টেনে দেয়, তারপর বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।
পরদিন জাহাজ ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ ত্যাগ করার পূর্বে বনহুর আবু সাঈদের নিকটে এসে বললো–স্যার, আমাকে বোম্বে যেতে হবে।
বেশ তো, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।
বললেন আবু সাঈদ। জাহাজ ছাড়ার পূর্বে বনহুর নিজে নাবিকের ড্রেসে সজ্জিত হয়ে ইঞ্জিন-কক্ষে প্রবেশ করলো।
জাহাজ ‘পর্যটন’ এবার রওয়ানা দিলো বোম্বে অভিমুখে।