ফৌজিতন্ত্র ও নারী
২৫ হাজার সেনা সদস্য মোতায়েন করা সেখানে। এক সময় ওই জায়গার নাম ছিল নাগাম। এখন তা পরিচিত এলাকা-এ-চারার-ই-শরীফ। ভাবখানা এমন যেন, একটা বিজয়ী সৈন্যবাহিনী পরাজিত শত্রুর ঘাটিতে প্রবেশ করছে। কয়েক ডজন বিদ্রোহীকে দমনের জন্য তাদের গতি দেখে মনে হচ্ছিল তারা এলাকার সব জনগণকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গোলাম হাসান শাহ দুঃসাহস করে একজন জেসিওকে এই ঔদ্ধত্যের কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি ওই কর্মকর্তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন কাশ্মীরের মাটিতে ভারতের দূতের ভূমিকা পালন করে। অফিসার এর বিপরীতে জবাব দিয়েছিল, দেখনি, পাকিস্তানি আর্মি ঢাকায় মুসলমানদের ওপর কী করেছিল? একটা মেয়ে এক অফিসারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনলেও তা বৈধতা পায় এ কারণে যে, পাকিস্তানের একজন সৈন্যও একই কাজ করেছিল!)
এভাবেই একটি সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকায় নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়। এভাবে ফৌজিতন্ত্র তার পূর্ণরূপে হাজির হয় একটা সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকায়। এক এলাকায় সৈন্যরা তাদের অপরাধগুলোকে এভাবে বৈধতা দেয় অন্য এলাকার দোহাই দিয়ে। ২০০৯ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কাশ্মীরকে গ্রহের সর্ববৃহৎ সৈন্যমোতায়েনকৃত বিরোধপূর্ণ এলাকা। সেখানে আনুমানিক ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৬৩৮ থেকে ৭ লাভ ৫০ হাজার ৯৮১ জন সৈন্য মোতায়েন (২০১৫) আছে বলে ধরা হয়”। এই অবস্থা বুঝতে হলে ফৌজিতন্ত্র (Militarism) সম্পর্কে একটু আলোচনা জরুরি।
ফৌজিতন্ত্র এমন এক দর্শন যা বিশ্বাস করে অন্যের ওপর বল প্রয়োগে। বল প্রয়োগের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হয় এটা ফৌজিতন্ত্রের মূল বিশ্বাস। সংঘাত নিরসনের জন্য সহিংসতাই সমাধান। রাষ্ট্রীয়-অরাষ্ট্রীয় সবাই ফৌজিতান্ত্রিক হতে পারে। কাশ্মীরিদের মধ্যে কাশ্মীরি জাতিবোধ আছে। তারা মনে করে কাশ্মীরি জাতিসত্তাকে ‘স্বাধীন’ বা মুক্ত করতে হলে শক্তিপ্রয়োগ করতে হবে। এডমন্ড বার্ক) বলেছেন, প্রত্যেকটা দেশই বলপ্রয়োগে বিশ্বাস করে। জাতীয়তাবাদ সবসময়ই মানুষকে ‘আমরা’ বনাম ‘অন্যরা’ এভাবে আলাদা করে। আর যখন জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয় ফৌজিতন্ত্রের সঙ্গে তখন ওই ‘অন্যরা হয়ে পড়ে শত্রুরা। আর তখন তাদের হত্যা করা বৈধ হয়ে পড়ে। ফৌজিতন্ত্রের এই চরিত্রের মধ্যে
সবসময়ই নারীকে ভাবা হয় দুর্বল ও অক্ষম হিসেবে। ভাবা হয়, নারী হচ্ছে এমন একটা পক্ষ যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুরুষদের। আর এই ভাবনার কারণেই নারী হয়ে পড়ে নির্ভরশীল। এই ধারণার ভিত্তিতেই যুদ্ধকালে একপক্ষের নারীরা হয়ে পড়ে অন্যপক্ষের টার্গেট। শত্রুপক্ষের নারীদের অমর্যাদা করা হলো তাদের সুরক্ষিত বুহ্য ভেঙে দেওয়ার শামিল। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই পৃথিবীর প্রায় সব যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর মর্যাদাহানিকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে কল্পনা করা হয়। কাশ্মীরের চিত্রও তার ব্যতিক্রম নয়।
অধিকাংশ গবেষক একমত যে, নারীরা নিজেরাও এই অবস্থাটিকে মেনে নেয় তাদের ভাগ্য হিসেবে। অনেক সময় মা নিজেই একজন সামাজিকীকরণের এজেন্ট হিসেবে তার সন্তানকে গড়ে তোলেন এই শক্তিপ্রয়োগের মন্ত্রে। উদাহরণস্বরূপ, সায়রা বানু, একজন কাশ্মীরি বিধবা যার স্বামী নিহত হয়েছেন যুদ্ধে। তিনি তার ১০ বছরের
ছেলেকে একটা খেলনা বন্দুক নিয়ে খেলতে উৎসাহ দেন। আর গর্বের সঙ্গে বলেন, একজন যোদ্ধার সন্তান যোদ্ধাই হবে। ৬৭ বছর বয়সী এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকার নাম হানিফা বেগম। স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্রবাহিনীর গুলিতে জীবন দিয়েছিল তার দুই ছেলে। তিনি বলেছিলেন, আমি আমার দুইটি সন্তানকেই কওমের জন্য উৎসর্গ করলাম। আরও কিছু যদি থাকে আমার, আমি তাও উৎসর্গ করব। কাশ্মীরের সাহিত্যও একইভাবে তুলে ধরে বলপ্রয়োগের সংস্কৃতির প্রতি মানুষের সহজাত আস্থা ও বিশ্বাসের কথা। আখতার মুহিউদ্দীন নামে এক লেখক। (প্রয়াত) ১৯৯০ সালে তার এক গল্পে লিখেছেন,
এক মা তার শিশুকে কোলে করে যাচ্ছিলেন। পথে দাঁড়িয়েছিল সশস্ত্র জওয়ান। শিশুটি তাকে দেখে কাঁদছিল। জওয়ান এগিয়ে এসে শিশুটির গালে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। বললেন, ‘কুচ পরওয়া নেহি। গোলি নেহি কারুঙ্গা’। মা জবাব দিলেন, ‘ও ভয় পাচ্ছে কে বলেছে? ওতো তোমার হাতের বন্দুকটা নিতে চায়। জওয়ান চিৎকার করল, বাস্টার্ড!
এভাবেই সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠে ‘আতঙ্কবাদী’। গল্পটির নাম হচ্ছে, ‘আতঙ্কবাদী। এই গল্পটি থেকে উপলব্ধি করা যায়, সংঘাতপ্রবণ এলাকায় কিভাবে শিশুরা বেড়ে ওঠে আর সেখানকার সাহিত্যও কিভাবে সেই চিত্র তুলে ধরে। ফিলিস্তিনের ফ্রন্টলাইনার্স বা আলজিরিয়ার স্বাধীনতা যোদ্ধাদের ইতিহাসেও এমন অসংখ্য অনুষঙ্গ আছে। নাদীরা সালাউব কিভরকেন (Nadera ShalhoubKevorkian) তার লেখায় বলছেন, আমেরিকার গণমাধ্যম মনে করে ফিলিস্তি নের মায়েরা খারাপ।
তারা তাদের সন্তানদের সন্ত্রাসের প্রতি উৎসাহ দেন। তারা চরমপন্থা সমর্থন করেন। এবং সাধারণত সহিংসতার পৃষ্ঠপোষকতা করে। অনুরাধা এম চিনয় (২০০২) তার বইয়েও লিখেছেন একই কথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতে। কাশ্মীরের মেয়েরাও মনে করে, তাদের ছেলেরা বিপুল সংখ্যায় জীবন দিয়েছে, মেয়েরা মর্যাদা ও ইজ্জত হারিয়েছে কওমের স্বার্থে। তাদের অধিকারের জন্য এই সংগ্রামের বৈধতা আছে তারা মনে করে। কাশ্মীরি নারীদের অবস্থা বুঝতে হলে ধর্মের সঙ্গে তাদের অবস্থানও স্পষ্ট হওয়া জরুরি। সাধারণত কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে বলা হয়, একটি মুসলিম জনপদে হিন্দু সৈন্যবাহিনী।
আর সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহকে স্থানীয়ভাবে ব্যাখ্যা করা হয় মুসলিম ভূখণ্ড এবং মুসলিম নারীদের নিরাপত্তার জন্য হিন্দু’রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসেবে। এমনকি কাশ্মীরি জনগণের অধিকাংশই পাকিস্তানি বা আফগান লোকদের বেশি ভালবাসেন এবং বিশ্বাস করেন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের চেয়ে। যদিও পণ্ডিতরা জাতিগতভাবে কাশ্মীরি ভাষা ও সংস্কৃতির অংশ। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক বশির আহমেদ ডাবলা তার এক গবেষণায় তুলে ধরেছেন, উত্তরাধিকার বণ্টনে ধর্ম বঞ্চিত করেছে বলে আপনি মনে করেন কি?’ এমন প্রশ্নের
জবাবে ৬২.১৬% নারীই বলেছেন না। বঞ্চিত হইনি। এ থেকে স্পষ্ট হয়, কাশ্মীরে ধর্মকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস সামান্য সংখ্যক লোকই করে। ধর্মের প্রতি এই অগাধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে সশস্ত্রপন্থাকে বৈধতা দেওয়া সহজ হয়েছে কাশ্মীরে। ফলে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রীয় ফৌজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে অরাষ্ট্রীয় ফৌজের প্রতিরোধকে সমর্থন করেছে। যেমনটা হানিফা বেগম বলছিলেন তার সন্তানের মৃত্যুর পর, আমি আমার সন্তানকে আজকের দিনটির জন্যই বড় করেছিলাম। আমি তার শাহাদাতে গর্বিত। এভাবে, ধর্ম ‘প্যাট্রিয়টিক মাদার’ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। অপর একটি বিশেষ ব্যাপার হলো, একজন পুরুষের যখন মৃত্যু হয় এই যুদ্ধে তখন তাকে শহীদ হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। আর একজন নারী নিপীড়িত বা ধর্ষিত হলে কিংবা তারপর মারা গেলে তাকে তেমনভাবে স্মরণ করা হয় না।
তার পরিবার বরং এটাকে অমর্যাদার বিষয় মনে করে, যা ধর্ম সাধারণত বলে না। এটা একটা দ্বৈততা। মূলত, একদিকে ধর্মের প্রতি মানুষের রয়েছে অগাধ বিশ্বাস অন্যদিকে ধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো ব্যাপকভাবে পিতৃতান্ত্রিক এবং সামাজিক বিধি দ্বারা প্রভাবিত। অনস্বীকার্যভাবেই, কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় পক্ষ বেশি ক্ষমতাধর এবং তারা সেটা ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রীয় ফৌজিতন্ত্র ব্যাপক সহিংসতা, মৃত্যু ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ফলে, দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক মূল্য (Social Cost) দিতে হয়েছে। কাশ্মীরি নারীদের। এবং এর সমাপ্তির ব্যবস্থা হয়নি আজও। জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক প্রধান বিচারপতি বাহাউদ্দিন ফারুকী মন্তব্য করেছিলেন, তিন রকমের সহিংসতা আছে।
শাসকদের দ্বারা সংঘটিত টাইরানিক্যাল ভায়োলেন্স (সহিংসতা), যা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটা বিপরীত দিক থেকে বিপ্লবী সহিংসতার জন্ম দেয়, যা মূলত আত্মরক্ষার নামে শুরু হয়। এরপরে শোষকরা (টাইরান্টস) বিপ্লবীদের জবাব দেয় রিপ্রেসিভ (ধ্বংসাত্মক) সহিংসতা দিয়ে।(১২)। ইয়োহান গালটুং এজন্যই সহিংসতাকে বলেছেন একটি চক্র যা শেষ হয় না। তিনি সহিংসতাকে বলেছেন কাঠামোর মধ্যে লুকায়িত।
কাশ্মীরি কলামনিস্ট মেহমুদউর-রসিদ লিখেছেন, একটা সংঘাতপ্রবণ এলাকায় দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান কাঠামোবদ্ধ সহিংসতাগুলোর গভীর ভিত্তিভূমি থাকে। হঠাৎ করে, একটা নতুন ধরনের সহিংসতার উদ্ভব হওয়া সেখানে সবসময়ই স্বাভাবিক। স্বাভাবিকতাই সেখানে অস্বাভাবিক। যেমনটা এক যুবক মন্তব্য করেছিল, আমি সংঘাতের মধ্যে জন্ম নিয়েছি ১৯৯২ সালে। এই সংঘাতের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি। সৈন্য নেই, সংঘাত নেই- এমন
শান্তিপূর্ণ অবস্থা কেমন তা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। সুতরাং, এখন যদি কাশ্মীরে ফৌজিতন্ত্রের অবসান হয় আমার আচরণ কেমন হবে? আমি আমার মা, বোন কিংবা অন্য কোনো নারীর সঙ্গে কী আচরণ করব? উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে কাশ্মীরের ফৌজিতন্ত্র এবং নারীর ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করা সম্ভব। ১. কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় উভয় ধরনের ফৌজিতন্ত্র উপস্থিত। ২. ধর্ম ও তার সমাজপ্রদত্ত ব্যাখ্যাসমূহের একটা ভূমিকা আছে ফৌজিতন্ত্র বিকাশের সঙ্গে। এর মাধ্যমে নারীকেও ফৌজিতন্ত্রের অনুসরণে আগ্রহী করে তোলা হয়।
সমাজের মধ্যে নিজেদের লোকেরা শত্রুপক্ষের কোনো নারীর সম্রমহানি করলে তা ‘দায়মুক্তি পেয়ে যায়। আর, নিজেদের সমাজের কোনো নারী শত্রুপক্ষ’ দ্বারা আক্রান্ত হলে তা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা হয়, অস্বীকার করার চেষ্টা হয়, গোপন করার চেষ্টা হয়। সংঘাতে আমাদের কোনো পুরুষ প্রাণ দিলে তাকে মহান হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু, কোনো নারী জীবন দিলে তা খুব একটা স্মরণ করা হয় না। ৩. যেহেতু কাশ্মীরের সংঘাত সীমিত হয়ে পড়েছে। এখন সেখানকার ফৌজিতন্ত্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মানুষের ঘরে, পরিবারে- সবখানে ঢুকে পড়েছে ফৌজিতন্ত্র। সর্বোপরি, নারীরা সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধর্ষিত হয়, নিপীড়িত হয় এ পক্ষ অথবা ওই পক্ষের হাতে। যেমনটা, নাঈমা মেহজুর লিখেছেন,
১৯৯৫ সালে চারার-এ-শরীফে অভিযানের পর সেখানে অনিরাপদভাবে হনুফা নামে এক যুবতীকে রেখে চলে যায় সবাই। তার ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, মা-বাবা নিহত হয়েছিল, ভাইয়েরা আত্মগোপন করেছিল, তার বাগদত্ত যুবক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল প্রতিবেশীর করুণার উপর। তারা তাকে ফেলে গিয়েছিল আজাদি পছন্দী’দের ভরসায়, তারাও ওকে ফেলে গিয়েছিল মূলধারার ক্ষমতাসীনদের কাধে সর্বশেষ সে এসে পড়ল সমাজের ঘাড়ে। শেষমেশ, তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ‘অমুক-তমুক গ্রুপের সমর্থক বলে।“১৫)
উপরের বর্ণনায় ফৌজিতন্ত্রের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রর মধ্যে নারীর অবস্থাকে ওই চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। স্বভাবতই, যেকোনও সংঘাতপ্রবণ এলাকায় নারীর ভোগান্তির কয়েকটি সাধারণ দিক থাকে। সেগুলো হলো, ১. সেখানে নারীর শরীরকে আলাদা যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে মনে করা হয়। ফলে নারীদের নিপীড়ন করা হয়। মনে করা হয় প্রতিপক্ষের নারীর অমর্যাদা করা মানে হলো তার কওমকে অমর্যাদা করা। এজন্য ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে প্রায় সবখানে। ২. কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী নিজেই যুদ্ধে যোগ দেয়। সেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ৩. নারী নানাবিধ কারণে পতিতাবৃত্তিসহ নানা অসম্মানজনক কাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হতে পারে। ৪, সর্বোপরি, নারীর
জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় সামাজিক অবমূল্যায়ন’ (Social Cost)। এই চারটি দিক থেকেই কাশ্মীরি নারীদের অবস্থা ব্যাখ্যা করা দরকার। প্রথমত, নারীকে কল্পনা করা হয় জাতীয় নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতীক। এ কারণে, কোনো জাতির নারী ধর্ষণ করাকে মনে করা হয় ওই জাতিকেই ধর্ষণ করা। কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ১৯৯৫ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা যেসব নারীকে বিদ্রোহীদের সহানুভূতিদানকারী বলে মনে করে তাদের টার্গেট করে ধর্ষণ করে থাকে। তাদেরকে ধর্ষণের মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা পুরো জাতিকে মর্যাদাহানির মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে থাকে।
সাধারণত মিলিটারি টহল দলের ওপর কোনো হামলা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় তারা আশপাশের দুই-একটা এলাকায় ঢুকে সেখানকার নারীদের ধর্ষণ করে আসত। এমন একটা ঘটনা ঘটে ১৯৯২ সালের ১ অক্টোবর। হাডওয়ারা জেলার বাখিকার গ্রামে একটা অপারেশন চালিয়ে ফেরত যাওয়ার সময় বিএসএফের একটা দলের ওপর হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। একজন বিএসএফ সদস্য এতে প্রাণ হারান। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএসফের ওই দলটি পাশের বাতেকাত গ্রামে হামলা চালিয়ে ১০ জন মানুষকে হত্যা করে। ঘরবাড়ি ও ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই গ্রামে হামলার পর তারা পাশের গুরিকার গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে ১৭)। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে একই রকম কিছু ঘটনা ছিল যেখানে বিদ্রোহীরা নারীদের ধর্ষণ করেছে এ কারণে যে, তাদের পরিবারের লোকেরা সরকারি বাহিনীকে তথ্য সরবরাহ করেছে অথবা বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করেছে, অথবা অন্য বিদ্রোহী গ্রুপের সমর্থক ছিল।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, একটি বিদ্রোহী গ্রুপের লোকেরা নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে অন্য বিদ্রোহী গ্রুপের পরিবারের হওয়ার কারণে। কোথাও নারীকে জিম্মি রাখা হয়েছে তাদের স্বজনদের ধরার জন্য। অন্য এক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এক দল বিদ্রোহী একসঙ্গে কোনো নারীকে আটকে রেখে অপমানিত করেছে এবং তার পরিবারের বাকি সবাইকে হুমকি দিয়েছে যে বিদ্রোহীদের নেতার কাছে ওই নারীকে তুলে না দিলে সবাইকে হত্যা করা হবে। এমন ঘটনাকে ‘জোরপূর্বক বিয়ে’ হিসেবে স্থানীয়রা স্বীকার করেছিল। এভাবেই নারীর শরীরকে আলাদা যুদ্ধের ময়দান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কাশ্মীরেও। দ্বিতীয়ত, অনেকে মনে করেন পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও সশস্ত্র হওয়া দরকার। এ নিয়ে জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রে পুরুষ যেমন সৈন্যবাহিনীতে অংশ নেয়, নারীকেও সমান হারে অংশ নিতে হবে। আবার অন্যপক্ষ মনে করে, নারীরা শান্তির দূত। নারী যুদ্ধবাজ হতে পারে তারা যুদ্ধ ও অন্ত্রের বিরুদ্ধে মায়া, মমতা, সহানুভূতির ছোঁয়া দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। অনেকে আবার মনে করে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীরা অনিরাপদ।
গ্যালিয়া গোলান (১৯৯১) ইসরাইলের প্রেক্ষিতে যেমন বলছিলেন, “ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সে পুরুষরা হলো একমাত্র লিঙ্গ যারা থাকতে পারে। কেননা, নারীরা শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি হতে বা ধর্ষিত হতে পারে। এই অবস্থা কেবল ইসরাইল নয় অন্যত্রও আছে। ভারতে সর্বমোট ২৬টি সৈনিক স্কুল আছে যেগুলোতে শিশুদের সেনাবাহিনীর উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা কারিকুলাম রয়েছে। এ সব স্কুল সম্পূর্ণভাবেই ছেলেদের জন্য। অনুরাধা এম চিনয় লিখেছেন, এমনকি যদি কোনো মেয়ে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয়, তাকে শেখানো হয় তোমার মধ্যে লুকায়িত নারীটিকে হত্যা করো। অর্থাৎ, ফৌজিতন্ত্রে শক্তি প্রয়োগের যে দর্শন তাতে ‘কোমলমতি নারীর কোনো স্থান নেই। এ কারণেই অনেকে নারীর সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের বিরোধিতা করেন।
কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহ বা স্বাধীনতার জন্য জিহাদ চলেছে প্রায় তিন দশক ধরে। কিন্তু, কোনো নারী অস্ত্র তুলে নিয়েছে বা বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়ে জঙ্গলে অবস্থান করেছে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নারীদের সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের কিংবা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মাওবাদীদের মধ্যে। ১৯৫৪ সালের ফরাসিদের বিরুদ্ধে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে দেখা গেছে মুসলিম নারীদের সরাসরি অস্ত্র হাতে নিতে। কাশ্মীরি নারীরা সরাসরি অস্ত্র তুলে না নিলেও তারা যে মনস্তাত্বিকভাবে তীব্র ভারতবিরোধী তা বলার অবকাশ নেই। তারা বরং ছেলেদের চেয়ে বেশি আপসহীন। উইমেন্স টেস্টিমনিতে লেখা হয়েছে, কাশ্মীরের প্রত্যেক নারী হচ্ছেন একজন সত্যিকার মুজাহিদ- ন্যায়ের পথে যুদ্ধরত। তারা একটা অহিংস প্রতিরোধ পরিচালনা করে যা স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্নকে সাহসের সঙ্গে বাঁচিয়ে রেখেছে।
কাশ্মীরি নারীরা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নিষ্ঠুর নিপীড়নের টার্গেট ছিল এই সংগ্রামে তাদের সমর্থনের শাস্তি হিসেবে।২২) অর্থাৎ কাশ্মীরি সশস্ত্ৰতায় নারীর অংশগ্রহণ পরোক্ষ। নারী সেখানে সশস্ত্রতার সমর্থক এক সক্রিয় এজেন্ট। কিন্তু, সশস্ত্ৰতায় সরাসরি অংশ নেয়া কোনো পক্ষ নয়। তৃতীয়ত, ইরাক যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যেখানে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা নানাভাবে পতিতাবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সশস্ত্র গাড়িতে করে কুয়েত থেকে বাগদাদে পতিতাদের পরিবহন করা হয়েছে (হাফিংটন পোস্ট ২০০৮)। বসনিয়ায় মার্কিন কোম্পানি ডিনকর্প (DynCorp) সৈন্যদের জন্য যৌনদাসী সরবরাহের অভিযোগও প্রচারিত হয়েছিল ২০০২ সালে। ডিনকর্পের কর্মকর্তারা ধরা পড়েছিল নারী পাচারের সময় বসনিয়ায়। কিছু কিছু তথ্য প্রমাণ করে, এমন ঘটনা ইরাকেও ঘটেছিল। ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডেও মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আছে। গালফ ওয়ার, আফগান ও ইরাকের যুদ্ধেও আমেরিকান সৈন্যরা মধ্যপ্রাচ্যে নারীপাচারে জড়িত হয়েছিল।
গালফ ওয়ারের পরে কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ অনেক ইরাকি নারীকে পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। যৌন ব্যবসা এতটা বেড়েছিল যে, ১৯৯৯ সালে সাদ্দাম হোসেন বাগদাদে একটা এলাকা গুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা অনেক নারীর জীবন কেড়ে নেয়। ইরাকের মধ্যে চীনা, ফিলিপিনো, ইরানি ও পূর্ব ইউরোপের নারীদের আমেরিকান ও অন্যান্য পশ্চিমা সৈন্যদের বিনোদনের জন্য ইরাকে সাপ্লাই দেওয়া হয়। আফগানিস্তান-কাতারসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে যেখানে স্থানীয় নারীদের সহজে পাওয়া সম্ভব নয় সেখানে চীনা মেয়েদের পাচার করা হয়েছে।
এসব তথ্য থেকে নিশ্চিত করে বলা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। অনুসন্ধান ছিল যে, কাশ্মীরে এমন ব্যাপার ঘটেছিল কিনা? বা ঘটে থাকলে তা কী মাত্রায় হয়েছিল। বস্তুত কাশ্মীরের প্রেক্ষিতে এই বিষয়টির পক্ষে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, দুই দেশের গণমাধ্যম এখানে সুস্পষ্টভাবেই পরস্পরবিরোধী তথ্য হাজির করে থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিষয়ে কিছু তথ্য দু-একটা পাকিস্তানি খবরের মাধ্যমে এসে থাকে, যা যথেষ্টই অতিরঞ্জিত মনে হয়। এমনকি পশ্চিমা গণমাধ্যমও সেখানে বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। ডেইলি মেইল ২০১০ সালে লিখেছে,
‘ভারতীয় বাহিনীতে নিযুক্ত প্রথম নারী ব্যাটালিয়ান মূলত যৌন কর্মীদের দিয়ে গঠিত। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে গোয়েন্দা সংস্থা র’ তাদের সংগ্রহ করে এনে কাশ্মীরের সীমান্তে মোতায়েন করেছে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। তারা মূলত সেনাদের, যাদের অনেকেই আত্মহত্যা করেছে, বিনোদনের কাজে নিয়োজিত। ওই ব্যাটালিয়ানের নারীরা অনিরাপদ যৌনতার ফলে এখন কিছু সিরিয়াস স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে। সেখানে মোট ১৭৮ জনের মধ্যে অন্তত ৬৩ জন নারী সৈন্য, যারা নর্দার্ন কমান্ডের অধীনে নিয়োজিত ছিল, প্রেগনেন্সি পরীক্ষায় পজিটিভ চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের মিলিটারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে অনেক পুরুষ সৈন্যও মারাত্মক যৌন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে।”(২৭)
এই প্রতিবেদনটি মিথ্যা হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রিপোর্টটি প্রকাশের পর এর প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল ভারতীয় পক্ষ থেকে। সেই প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করে লন্ডনভিত্তিক টেলিগ্রাফ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভারতীয় পক্ষের বরাত দিয়ে টেলিগ্রাফ লেখে, ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনটি ‘ভুয়া’ এবং এটা ভারতীয় সৈন্যদের ডিমোরালাইজ করতে আইএসআই-এর প্রপাগান্ডা। যাই হোক, এখানে সন্দেহ রয়েছে এই খবর ও পাল্টা খবরের সত্যতা নিয়ে। তবে, সৈন্যবাহিনীর দ্বারা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, সে সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। কাশ্মীরের নারী অধিকার কর্মী ও সাংবাদিক আলিয়া বশির তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, কাশ্মীরের ১৯৯০-এর ফৌজি সহিংসতা অনেক মেয়েকে
শিশু যোদ্ধা বা সেনাদের যৌন দাসী (Concubines) হতে বাধ্য করেছে। এসবের পাশাপাশি ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার হলেও এর বিরুদ্ধে নালিশ করার ক্ষমতা কাশ্মীরে নারীদের নেই।(২৫) এই মন্তব্যটির মাধ্যমে অনুমান করা যাচ্ছে যে, সংঘাত কাশ্মীরি নারীদের পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলছে। তবে, এর সঠিক সংখ্যা অনুমান করা কঠিন। প্রসঙ্গত কাশ্মীরের কোথাও প্রকাশ্যে কোনো যৌনপল্লীর খবর পাওয়া সম্ভব নয়। এমনকি সিনেমা হলোগুলোও বন্ধ সেখানে। জম্মুতে অবশ্য সবই মেলে। ফৌজি ব্যবস্থার অধীনে নারীর কষ্টের আরেকটি দিক রয়েছে যাকে উন্নয়ন গবেষকরা ‘সোশাল কস্ট’ বলে উল্লেখ করে থাকেন।
এটা হলো নারীর জন্য সবচেয়ে কষ্টকর এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই কষ্টের শুরু হয় যুদ্ধের সময় আর তা চলতে থাকে শান্তিকালেও। যুদ্ধের শেষ হলেও নারীর কষ্টের শেষ আর হয় না। যে নারী তার স্বামীকে হারিয়েছে তার হয়তো আবার বিয়ে হয়। কিন্তু শিশু সন্তানগুলোর জন্য কে থাকে? ওই শিশু সন্তানটির কষ্টই হলো সামাজিক মূল্য’, যা অর্থের অঙ্কে পরিমাপযোগ্য নয়। ১৯৯২ সালে মোহাম্মদ আমীন নামে ২৩ বছর বয়সী এক হাসপাতাল কর্মী সৈন্যদের হাতে নিহত হন। তার স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই মাকে তার দুটি সন্তান ফেলে রেখে যেতে হয় ওদের দাদা-দাদির কাছে। মুনীরা নামের এক নারী তার স্বামী নিহত হওয়ার পর নিজেই মাঠে কাজ আর কাঠখড়ি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
পাহাড়ে বসবাসকারী পশুপালন নির্ভর গুজার সম্প্রদায়ের বৃদ্ধ নাদের আলী খান (৬৫) সোপুর এলাকার একটি বাড়িতে কাজ করতেন। ওই বাড়িতে সৈন্যরা আগুন ধরিয়ে দিলে আরও তিনজন মানুষসহ বৃদ্ধ নাদের আলী পুড়ে মারা যান। তার স্ত্রী মারজান এবং পাঁচটি মেয়ে, যারা সবাই ছিল অশিক্ষিত, জীবিকার প্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেয়। এভাবেই দারিদ্র্যের কষাঘাতে নারী জর্জরিত হয়ে আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা এই অবস্থাকে বলে থাকেন ফেমিনাইজেশন অব পভারটি। নিপীড়িত নারীদের সামাজিকভাবে হেয় করার নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা সেখানে নারীকে আরও বেশি অসহায় করে তোলে।
কুনান নামের একটি গ্রামে ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৩০ জন নারীকে একযোগে ধর্ষণ করে সশস্ত্র বাহিনীর একটি পাটুন। সর্বাধিক আলোচিত ওই গণধর্ষণ নিয়েও আছে সংখ্যার রাজনীতি। প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া অনুসন্ধান শেষে ওই ঘটনার উপসংহার টেনে বলেছে, সেখানে কেউ ধর্ষিত হয়নি। কারণ, ‘ধর্ষিত মেয়েদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার পর তারা হাসছিল।২৭) যদিও কোনো কোনো রিপোর্টে ধর্ষিত নারীদের এই সংখ্যা বলা হয়েছে ৬০। আর তাদের সেই বেদনার স্মৃতি রোমহর্ষক।
ওই গ্রামে পরের তিন বছরে কোনো বিয়ের প্রস্তাব যায়নি। ধর্ষিত এবং অ-ধর্ষিত সকল মেয়েই ছিল ‘বিবাহঅযোগ্য’। বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে যারা ধর্ষিত হয়েছিলেন তাদের পরিত্যাগ করেছিল তাদের স্বামীরা। সশস্ত্র যোদ্ধা ও বয়স্কদের প্রচেষ্টায় দুজন স্বামী তাদের স্ত্রীদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়েছিল। একজন নিয়েছিল এই শর্তে যে, তাদের মধ্যে কোনো দাম্পত্য সম্পর্ক থাকবে না। অন্যজনের শর্ত ছিল যে, সে তার স্ত্রীর থেকে দূরে শহরে গিয়ে বসবাস করবে। ছয় সন্তানের মা শরীফা এবং অন্য এক ধর্ষিত আত্মহত্যা করেছিলেন। সাত সহোদর বোনকে একই সঙ্গে ধর্ষণ করা হয়েছিল। সমাজ পরিত্যাগ করেছিল ওই সাতবোনকে। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী আটজন জওয়ানের কাছে ধর্ষিত হয়েছিলেন। তার তিন দিন পর ওই নারীর সন্তানটি দুই হাত ভাঙা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয় (২৮)
১৯৯৩ সালে মরিয়ম নামে অপর এক গ্রামের এক নারীকে জনসম্মুখে ধর্ষণ করা হয়। তার স্বামীকে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের পর তিনি ১৯৯৪ সালে একটি সন্তান জন্ম দেন। গ্রামের কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এ হলো সামাজিক মূল্য, যা নারীকে পরিশোধ করতে হয় প্রতিনিয়ত। সমাজ নিজেও ফৌজিতন্ত্রকে বিশ্বাস করে। সমাজ নিজেকে লজ্জিত ও অপমানিত বোধ করে যখন তার নারীরা অন্যের দ্বারা ধর্ষিত হয়। তাই তারা ধর্ষিত নারীকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই তারা শত্রুসৈন্যের দ্বারা ধর্ষণের ফলে তাদের নারীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুকে আপন ভাবতে পারে না।
এভাবেই নারী ‘অনিরাপদ থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আর অগ্রাহ্য হয়ে যায় যুদ্ধের পরেও’। যুদ্ধের পরও নারীকে মোকাবিলা করতে হয় আরেক যুদ্ধ। যেখানে নারীর নিজের সমাজের লোকেরাই হয়ে ওঠে নতুন শত্রু। ধর্ষিত যুবতীরা রাস্তায় বের হতে পারেনি। স্কুলে যেতে পারেনি। কারণ, বন্ধুরা তাদের জিজ্ঞাসা করত, ‘তুমি তখন আনন্দ পেয়েছিলে? আরও চাও?’। এভাবেই ফৌজিতন্ত্র নারীকে সার্বক্ষণিক হয়রানির মধ্যে রাখে। ওই গ্রামের ছেলেদের অন্য গ্রামের লোকেরা চিহ্নিত করত, তুমিতো ধর্ষিত গ্রাম থেকে এসেছে। এভাবে, একটা নারীর ধর্ষিত হওয়াকে একটা গ্রামের বা একটা সম্প্রদায়ের ধর্ষণ হিসেবে তরজমা করা হয়। এভাবে ফৌজিতন্ত্রের অধীনে নারীর কষ্ট পরিমাপযোগ্যতার ঊর্ধ্বে চলে যায়।
ফৌজিতন্ত্র নারীকে উভয় দিক থেকে আক্রমণ করে। নারী আক্রান্ত হয় তার নিজের সমাজ দ্বারা রক্ষার নামে, অন্যদিকে নারী আক্রান্ত হয় শত্রুর দ্বারা। কাশ্মীরের প্রায় ১৫০০ নারী (কোনো কোনো তথ্য অনুসারে ২৩০০) আছে যাদের বলা হয় অর্ধবিধবা (Half widow)। তাদের স্বামীরা নিখোঁজ। তার এখনও স্বামীর আগমনের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু, তারা জানেন না যে আদৌ ওইসব স্বামী বেঁচে আছে কিনা। আলেমরা বিষয়টির ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঐক্যমতে আসতে ২২ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রথম কোনো নারীর স্বামী নিখোঁজ হওয়ার ২২ বছর পর কাশ্মীরের আলেমরা ফতোয়া দিয়েছেন ২০১৪ সালে। ফতোয়ায় তারা বলেছেন, কাশ্মীরের নারীরা তাদের স্বামী নিখোজ হলে চার বছর পর পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন। আল জাজিরার প্রতিবেদন (২০১৩) অনুসারে ওইসব নারীসহ নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ১৯৯২ সালে
অন্তঃসত্ত্বা নারী জুনা, প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেন, তাকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ বাইরে ছিল কারফিউ। ২১ বছর বয়সী খালেদাও বরণ করেছিল একই ভাগ্য। কাশ্মীরের খবরের কাগজ খুললে এখনও এমন খবরের দেখা মেলে। এভাবেই ফৌজিতন্ত্রের অধীনে মানুষের নিরাপত্তা অবহেলিত থেকে যায়। যদিও সরাসরি তুমুল যুদ্ধ এখন আর নেই কাশ্মীরে। সশস্ত্র স্থবির হয়েছে।
হয়তো অনেকে ধারণা করবেন, নারীরা তাহলে নিরাপদ আছে। কিন্তু, এখনও সেখানে মিলিটারির উপস্থিতি আছে। এখনও জারি আছে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (আফসপা), যা সৈন্যদের দিচ্ছে অপরাধের দায়মুক্তি। কাশ্মীরের এক সাংবাদিক একবার জানালেন, ওখানে গৃহে নারীর ওপর নির্যাতন বাড়ছে। কিন্তু, খবরের কাগজে ঘরোয় নির্যাতন তেমন একটা প্রচার হয় না। কারণ, ওখানে যুদ্ধের খবরই বেশি চলে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম আর জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অ্যাকশনই ওখানে খবরের ভাল আইটেম। মৃত্যুর সংখ্যা হিসেবে খবরের গুরুত্ব বাড়ে। এভাবেই ফৌজের উপস্থিতিতে নারীর ঘরোয়া নিরাপত্তার কথা চাপা পড়ে যায় সেখানে।
[নোট: কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হুমায়রা শওকত এবং এই লেখকের যৌথভাবে লেখা ইংরেজি নিবন্ধ Militarism in Kashmir: Looking the World from Kashmir ২০১৬ সালের মার্চে ব্যাঙ্গালুরু ভিত্তিক গবেষণা Grafica (International Journal of Management and Social Science Research Review; Vol.1, Issue.3, Pp: 284-291) প্রকাশিত হয়। এ অধ্যয়টি মূলত ওই নিবন্ধের একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। এখানে নতুন কিছু সংযোজিত হয়নি।]
নোট/সূত্র
১. Gauhar, G.N; Military Operation in Kashmir: Insurgency at Charar-e-Sharief, New Delhi: Manas Publication; 2001. 184-5.
২. Umar, Baba; The dilemma of kashmir’s half-widows; 13th October, 2013; http://www.aljazeera.com/news/asia/2013/09 (Accessed on: 13th June, 2015)
৩. Iqbal, Javid; Structures of Violence: A Comprehensive report on HR Violations in JK; Greater Kashmir; September 19, 2015; P:11.
৪. Burke, Colleen (2012); http://wilpf.smilla.li/wpcontent/uploads/2012/10/Unknownyear_Women_and_Militarism.pdf; (Accessed on: 23rd May, 2015).
৫. Choudhury, Gouri & et al; Women’s Testimonies from Kashmir, Bombay: Women’s Initiative, 1994: 1
৬. Greater Kashmir; 2015:1
৭. Handoo, Bilal; Literature: The Prophecy; Kashmir Life, July (5-11), 2015; P: 22-23.
৮. Kifurkiyan, N Shalhub-; Introduction, Militarisation and Violence Against Women Conflict Zones in Middle East: Palestinian Case Study; http://www.cambridge.org/us/academic/subjects/law/human-right (accessed on 15th May’2015).
৯. Chenoy, Anuradha M; Militarism and Women in South Asia; New Delhi: Kali for Women; 2002:3
১০. Dabla, Bashir Ahmed; Multi-Dimensional Problems of Women in Kashmir; New Delhi: Gyan Publishing House; 2007: 171.
১১. Greater Kashmir; 2015: 1
১২. Choudhury, Gouri & et al; Women’s Testimonies from Kashmir, Bombay: Women’s Initiative, 1994: 34.
১৩. Gultung, Johan; Violence, peace and peace research; Journal of Peace research, Vol: 6; 1969; 167-185.
১৪. Rashid, Mahmood-Ur-; Discontents of Massage; Srinagar: Greater Kashmir; 6th June, 2015; P: 11.
১৫. Mahjoor, Nayeema Ahmad; Un-wed widows: A heart rending story of pain and longing; Srinagar: Greater Kashmir; 25th May 2015;
১৬. Human Rights Watch Report, 1995; 56.
১৭. প্রাগুক্ত, 68.
১৮. প্রাগুক্ত, 75.
১৯. Golan, Galia; Militarisation and Gender: The Israeli Experience; 1997; (journals.lub.lu.se /index.php/st/article/download/3049/2611)
২০. Chenoy, Anuradha M; Militarism and Women in South Asia; New Delhi: Kali for Women; 2002: 3.
২১. Leonhardt, Adrienne; Between Two Jailers: Women’s Experience during Colonialism, War, and Independence in Algeria; Portland State University: network.bepress.corn (Accessed on: 12th June, 2015).
২২. Choudhury, Gouri & et al; Women’s Testimonies from Kashmir, Bombay: Women’s Initiative, 1994: 21
২৩. Mcnutt, Debra; http://www.commondreams.org/views/2007/07/11/iraqoccupation-enabling-prostitution (accessed on: 22/05/2015).
২৪. Nelson, Dean (Sep 2009); http://www.telegraph.co.uk/news/worldnews/asia/india/6 239790/First-female-Indian-troops-are-prostitutes.html (Accessed on: 29th May 2015).
২৫. Bashir, Aliya; http://womennewsnetwork.net/2012/07/03/kashmirindia-sex-workers-victims-victimless/ (Accessed on: 29th May 2015).
২৬. Choudhury, Gouri & et al; Women’s Testimonies from Kashmir, Bombay: Women’s Initiative, 1994: 9
২৭. প্রাগুক্ত: 10
২৮. প্রাগুক্ত: 11
২৯. Kandwal, Ana; The Shocking Tale Of Half Widows And Half Orphans: Enforced Disappearances In Kashmir!; http://www.youthkiawaaz.com (Accessed on: 13th June, 2015).
৩০. Indian Express, 2nd March, 2014
৩১. Umar, Baba; The dilemma of kashmir’s half-widows; 13th October, 2013; http://www.aljazeera.com/news/asia /2013/09 (Accessed on: 13th June, 2015).