ফেলিক্সের মহাত্মা – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ফেলিক্সের মহাত্মা – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

কবিতা নিয়ে একটি কাজের সূত্রে গত বছর আমাকে বিদেশে যেতে হয়েছিল। যাঁর কবিতা নিয়ে কাজ, বেলজিয়ামের সেই রবীন্দ্রানুরাগী কবি মরিস কারেমের জন্ম গত শতকের শেষ বছরে। বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স হত নব্বই। নির্বাচিত কিছু কবিতা অনুবাদের, ও কবিকৃতির মোটামুটি মূল্যায়নের, কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ করি। বাকি থাকে কবির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনার কাজ। এই শেষ কাজটির সূত্রে দেখা করবার দরকার হয় এমন কয়েকজনের সঙ্গে, কবির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ যাঁদের হয়েছিল।

তাঁর সমবয়সী কোনও বন্ধুর দেখা পাব, এতটা অবশ্য ভাবিনি। অথচ শুনলুম, ফেলিক্স দ’বুক বেঁচে আছেন। আরও শুনলুম, বয়স যদিও নব্বই—পার, ফেলিক্স এখনও বয়সের ভারে নুয়ে পড়েননি। বার্ধক্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা চমৎকার চালিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন না বটে, কিন্তু সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ফিরিয়েও দেন না। দেখা তো করেনই, সাহিত্য আর শিল্প নিয়ে কথাও বলেন অনর্গল। তার চেয়েও যা বিস্ময়কর ব্যাপার, ফেলিক্সের যে হাত আজ আর রোমান বর্ণমালাকে তেমন স্পষ্ট করে ধরতে পারে না, কিছু লিখতে গেলেই কলম সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে, তুলির উপরে সেই হাতের দখল এখনও কিছুমাত্র শিথিল হয়নি, সটান ঋজু রেখায় আজও তিনি আশ্চর্য সব চিত্র রচনা করে চলেছেন।

ফেলিক্স দ’বুক বেলজিয়ামের সর্বজনের শ্রদ্ধেয় এক বিরাট শিল্পী। মানুষটির সঙ্গে দেখা হবার আগেই আমি রয়্যাল আর্ট গ্যালারিতে তাঁর ছবি দেখেছিলুম। এও শুনেছিলুম যে, ব্রাসেলস থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে যে লোকালয়ের তিনি বাসিন্দা, সেখানে আলাদা একটা সংগ্রহশালাই রয়েছে তাঁর চিত্রাবলীর।

ফেলিক্স ছিলেন মরিস কারেমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মরিস মারা যান ১৯৭৮ সালে। তবে তিনি বছর আগে, ১৯৭৫ সালে, বার হয় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘কঁপ্লাত’। ফেলিক্স এই বইয়ের জন্য যে—সব ছবি এঁকে দিয়েছিলেন, গ্রন্থের গৌরব যে তা আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

কারেম ফাউন্সেশনের কর্ত্রী শ্রীমতী জানিন বুর্নিই ফোন করে তাঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেন। তারপর তিনিই আমাকে ফেলিক্সের কাছে নিয়ে যান। ছবির মতো বাড়ি। দোতলায় স্টুডিয়ো। বাড়ির পিছনে বিশাল বাগান। গায়ে এতটুকু বাড়তি চর্বি জমেনি, ছিপছিপে চেহারার দীর্ঘাঙ্গ মানুষ ফেলিক্স। সাদা চুল, সাদা দাড়ি, দেখতে অনেকটা মকবুল ফিদা হুসেনের মতো। বাগানের দিকে তাকিয়ে পাইপ টানছিলেন। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলায় উঠতেই টেবিলের উপরে পাইপ নামিয়ে রেখে একগাল হেসে ফেলিক্স বললেন, ”আসুন।”

ঘন্টাদুয়েক ছিলুম তাঁর স্টুডিওতে। বিস্তর কথা হল। সাহিত্যের কথা, শিল্পের কথা। দেখা হল বিস্তর ছবি। কথাপ্রসঙ্গে একসময় বললেন, অন্য কোনও রাজনৈতিক মতবাদ নয়, গান্ধীবাদই শেষপর্যন্ত বিশ্ববিজয় করবে। শুনে জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকাতে তিনি শিশুর মতন হেসে বললেন, ”অবাক হচ্ছ কেন? তার সূচনা কি তোমার চোখে পড়ছে না?”

যখন বিদায় নেবার পালা, শিল্পী তাঁর নির্বাচিত চিত্রাবলির একখানা বিশাল অ্যালবাম আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ”এটাই আমার শেষ অ্যালবাম, তুমি যদি নাও তো বড় খুশি হই।”

কুণ্ঠিত হয়ে বলেছিলুম, ”এ অ্যালবাম আমাকে দিচ্ছেন কেন? এমন কাউকে দিন, এর মূল্য যিনি আমার চেয়ে ভাল বুঝবেন।”

ফেলিক্স আবার হেসে উঠলেন। সেই শিশুর মতন হাসি। বললেন, ”তা হলে শোনো। এই অ্যালবামের মধ্যে আছে মহাত্মা গান্ধীর খানকয় ছবি, যা বড় ভালবেসে একদিন এঁকেছিলুম। তুমি তাঁর দেশের মানুষ তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছ। এ—অ্যালবাম তোমারই জন্যে, তুমি নিয়ে যাও।”

সেই অ্যালবাম থেকে গান্ধীজীর দুটি ছবি এখানে ছাপা হল। সেইসঙ্গে ছাপা হল ফেলিক্স দ’বুকের আত্মপ্রতিকৃতি।*

ফেলিক্সের সঙ্গে যে—দিন দেখা হয়, সেই দিনই বাড়ি ফিরে একটি কবিতা লিখি। সেটিও এখানে রইল।

___

* মূল রচনার জীর্ণতার কারণে ছবি দুটি ভাল ছাপা গেল না। কবিতাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *