মাননীয় ফেরোজ শা মেটা ভারত মন্ত্রীসভায় পুলিস বিলের যে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন তাহা আমাদের কর্তৃপুরুষদিগের সহ্য হয় নাই। হঠাৎ একটা বজ্রের শব্দ শুনিলে ছেলেরা কাঁদিয়া উঠে– তাহারা মনে করে কে যেন উপর হইতে তাহাদের প্রতি ভারি একটা অন্যায় করিল, যেন তাহাদের কোথায় এক জায়গায় ঘা লাগিয়াছে– শ্রীযুক্ত মেটা ভারতসভায় যে বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাহাতে যদিও তিনি কাহাকেও আঘাত করেন নাই তথাপি হঠাৎ তাহার শব্দে এবং নূতন আলোকের ছটায় সাহেবদের খামকা মনে হইল তাঁহাদের সিবিল সর্বিসের সুকোমল পৃষ্ঠে বুঝি কে মুষ্টিপাত করিল অমনি তাঁহারা বিচলিত হইয়া উঠিলেন। একটা নূতন আলোক অকস্মাৎ একটা জ্যোতির্ময় করাঘাতের মতো মন্ত্রীসভার আকাশের গায়ে চমক দিয়া গিয়াছিল– তাই সাহেবরা অকস্মাৎ এতই চকিত হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, তাঁহারা মনে করিতে পারেন নাই তাঁহাদিগকে কেহ আঘাত করে নাই।
মেটা বলিয়াছিলেন– বিনা বিচারে দোষী সাব্যস্ত করিয়া তাহার আপিলের অধিকার না দিলে অবিচারের সম্ভাবনা আছে। কর্তৃপুরুষেরা ক্ষাপা হইয়া বলিয়া উঠিলেন– কেন, আমরা কি তবে সকলেই অবিচারী? গম্ভীরভাবে ইহার উত্তর দিতে বসিলে আমাদরে কর্তাদের বুদ্ধির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়– কেবল, এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করি, তবে কোনো অপরাধের জন্য কোনা প্রকার বাঁধা বিচারপ্রণালী থাকে কেন? আমাদের স্বর্গসম্ভব সিবিল সর্বিসের সভ্যগণকেও আইন পালন করিয়া বিচার করিতে হয় এ অপমান তাঁহারা স্বীকার করেন কেন? নিয়ম মাত্রই তো মানুষের স্বেচ্ছাধীন বিবেচনা, স্বাধীন ধর্মবুদ্ধি এবং অবাধ হৃদয়বৃত্তির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ।
তাহার পরে আবার বাজেটের আলোচনাকালেও আমাদরে বাংলাদেশের ছোটো বিধাতা ইকুলমাস্টারের মতো গলা করিয়া শ্রীযুক্ত মেটাকে বিস্তর উপদেশপূর্ণ ভর্ৎসনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, মেটা সাহেব খুব ভালো ছেলে শুনিয়াছিলাম কিন্তু তিনি আমাদের আশানুরূপ উচ্চ নম্বর রাখিতে পারিতেছেন না, অতএব তাঁহাকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা যায়। কর্তাদের মতে, বাজেটের আলোচনায় শ্রীযুক্ত মেটা কোনো প্রকার কাজের পরামর্শ দেন নাই কেবল সাধারণভাবে বিরোধ প্রকাশ করিয়াছেন।
মেটা সাহেব বলিয়াছিলেন, সৈন্যবিভাগের খরচ অত্যন্ত বেশি বাড়িয়া গিয়াছে। ভারতবর্ষের ভূতপূর্ব রাজস্বসচিব সার্ অক্লাণ্ড কলভিনও ওই কথা বলিয়াছিলেন।
ওয়েস্ট্ল্যান্ড সাহেব পাকেপ্রকারে বলেন খরচ বাড়ে নাই, এক্সচেঞ্জের দুর্বিপাকে অধিক টাকা নষ্ট হইতেছে। তিনি বলেন পৌন্ডের হিসাবে হিসাব ধরিলে খরচ কম দৃষ্ট হইবে। এ কৈফিয়তটার মধ্যে কিছু চোখে ধুলা দেওয়া আছে এইরূপ আমরা অনুমান করি। ভারতবর্ষে যখন রৌপ্যমুদ্রায় অধিকাংশ খরচ নির্বাহিত হয় তখন পৌন্ডহিসাবে হিসাব করিয়া খরচ কম দৃষ্ট হইলেও প্রকৃতপক্ষে তাহাতে ব্যয়ের ন্যূনতা প্রমাণ হয় না। অতএব ওয়েস্ট্ল্যান্ড সাহেবের এ যুক্তির মধ্যে সরলতা নাই এবং তাহাতে আমাদের কোনো সান্ত্বনা দেখি না।
আমরা কাজের কথা কী বলিব? আমরা যদি বলি, সাহবে কর্মচারীদিগকে ক্ষতিপূরণবৃত্তি (কম্পেন্সেশন অ্যালাউয়েন্স) দিবার আবশ্যক নাই, তোমরা বলিবে, না দিলে নয়। বর্তমান এক্সচেঞ্জের হিসাবে ধরিয়াও তোমাদের স্বদেশের সহিত এখানকার বেতরেন তুলনা করিয়া দেখো। এখানে বিদেশে থাকিয়া তোমাদের খরচ বেশি হয়? কেন হয়? এমন যদি বুঝিতাম এখানে তোমাদের যেরূপ চাল বিলাতেও তোমাদের সেই চাল তাহা হইলে আমাদের কোনো আপত্তির কারণ ছিল না। বিলাতের মধ্যবিত্ত অবস্থায় কয়জন লোক বৎসরের মধ্যে কয়দিন শ্যাম্পেন্ডিনার ভোগ করিয়া থাকে? এ কথা কি সাহেবরা অস্বীকার করিতে পারেন যে, ভারতবর্ষে তাঁহারা বিস্তর অনভ্যস্ত এবং অনাবশ্যক নবাবী করিয়া থাকেন? সে-সমস্ত যদি তাঁহারা কিঞ্চিৎ খাটো করিতে প্রস্তুত হইতেন তাহা হইলে কি আমাদের এই-সকল অর্ধ-উপবাসীদের কষ্টসঞ্চিত উদরান্নে হাত দিতে হইত?
গল্পে কথিত আছে, বাবু যখন গোয়ালার বিল হইতে তাহার অর্ধেক পাওনা কাটিয়া দিলেন তখনও সে প্রসন্নমুখে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল– তাহার প্রসন্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সে কহিল, এখনও দুধে পৌঁছায় নাই। অর্থাৎ কাটাটা কেবল জলের উপর দিয়াই গিয়াছে। প্রতিকূল এক্সচেঞ্জেও এখনও সাহেবদের হুইস্কি সোডা এবং মুর্গি মটনে আঘাত করে নাই তাহা বড়ো জোর শ্যাম্পেন টোকে, এবং অতিরিক্ত ঘোড়া ঘোড়দৌড়ের উপর দিয়াই গিয়াছে; কিন্তু কম্পেন্সেশন অ্যালাউয়েন্স আমাদরে মোটা চাউল এবং বহুজলমিশ্রিত কলাইয়ের ডালে গিয়া হস্তক্ষেপ করিয়াছে।
আমরা বলিতেছি, তোমাদের ভারত শাসনের যন্ত্রটা অত্যন্ত বহুব্যয়সাধ্য হইয়াছে– যদি অধিকতর পরিমাণে দেশী লোক নিয়োগ কর তাহা হইলে সস্তা হয়। তাহাতে যে কাজ খারাপ হয় এমন কোনো প্রমাণ নাই। তোমরা বলিবে সে কোনো মতেই হইতে পারে না।
তোমাদের কথাটা এই, আমরা সৈন্য বিভাগের বিস্তার করিব, ভারতবর্ষের দুশো-পাঁচশো মাইল দূরে যেখানে যত ভীমরুলের চাক আছে গায়ে পড়িয়া সবগুলোতে খোঁচা মারিয়া বেড়াইব, ইংরাজ কর্মচারীদিগকে ক্ষতিপূরণবৃত্তি দিব, এবং মোটা পদের ইংরাজ কর্মচারী নিয়োগ করিয়া ভারতবর্ষের রক্তরিক্ত দেহে মোটা দাঁত বসাইয়া খাদ্য শোষণ করিব– ইহার অন্যথা হইবে না, এক্ষণে ব্যয়সংক্ষেপ সম্বন্ধে আমাদিগকে কাজের পরামর্শ দাও।
অনেক সময় যথার্থ কাজের পরামর্শ অত্যন্ত সহজ এবং পুরাতন। অজীর্ণ রোগী যত বড়ো ডাক্তারের নিকট উপদেশ লইতে যাক সকলেই বলিবেন, তুমি পথ্যসংযম করো। কিন্তু রোগী যদি বলে “ওটা কোনো কাজের কথা হইল না– আমি ঘৃতপক্ক অখাদ্য খাইবই, এবং ক্ষুধার অবস্থা যেমনই থাক্ আহারের পরিমাণ বাড়াইতে থাকিব, তুমি যদি বড়ো ডাক্তার হও আমাকে একটা চিকিৎসার উপায় বলিয়া দাও’– তবে সে রোগীর নিকট খাদ্য পরিবর্তন, বায়ু পরিবর্তন প্রভৃতি স্বাস্থ্যতত্ত্বের সমস্ত মূলনীতিই নিতান্ত বাজে এবং সাধারণ কথা বলিয়াই মনে হইবে।
বিবাহ করিতে উদ্যত্ কোনো যুবকের প্রতি পাঞ্চ্ পত্রিকার একটি অত্যন্ত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত উপদেশ ছিল– সেটি এই– “এমন কাজ করিয়ো না!’ অপব্যয় করিতে উদ্যত গবর্মেন্টের প্রতিও এতদপেক্ষা সহজ এবং সংগত উপদেশ হইতে পারে না। ফেরোজ শা মেটা সেই উপদেশটি দিয়াছিলেন– তাহাতেই কর্তারা অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশপূর্বক বলিয়াছিলেন ইহা কোনো কাজের উপদেশ হইল না।