ফেরারী
ডিসপেন্সারিতে ডাক্তার নেই শুনে হানিফের শরীরটা সহজ ঠেকলো। ভারি মাথা, ভারি বুক, ভারি হাত পা আর কাঁহাতক টানা যায়? কম্পাউণ্ডারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আঠালো উৎকণ্ঠা গলায় তবু চটচট করে।
‘ড্ ডাক্তারে ক্কৈ গেছে?’
সামনে ঝুঁকে প্রতাপ কম্পাউণ্ডার রাস্তার ওপার টোকা মিয়ার রেস্টুরেন্টের দরজায় মস্ত তাওয়ায় বিছিয়ে রাখা আলুর চপ দেখছে। পাশে জিলেপি ভাজা হচ্ছে, কম্পাউণ্ডার বোধহয় জিলেপিও দেখছে। রিকশা, স্কুটার ও ঠেলাগাড়ির ফাঁকে ফাঁকে তার লাল, শাদা ও খয়েরি রঙের চোখে এইসব খাদ্যদ্রব্য ছেঁকে নিতে নিতে সে কপাল কোঁচকায়, ‘কি?’
‘ড্ডাক্তারে কৈ গেছে?’
‘আমারে কইয়া গেছে?’
কম্পাউণ্ডারের জবাব শুনে হানিফের করোটিতে দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে : মালাউনের বাচ্চা, চাইয়া চাইয়া দ্যাখ। জিন্দেগিতে খাইতেতো আর পারবি না, দেইখাই মর!
আগুন জ্বলবার দপ আওয়াজে মাথা স্বাভাবিক ও পরিচিত হলো। নরম নরম গলায় সে মিনমিন করে, ‘অহন আইবো না?’
‘ক্যামনে কই?’
প্রতাপ কম্পাউণ্ডারের তেজটা বড়ো বেশি। হানিফ কি আর করে, ডানদিকে বাঁদিকে দেখে রাস্তা ক্রস করলো। প্রতাপের তাপে ওর ঘাড়ের চামড়া অনেকটা ঝলসে গেছে : কম্পাউণ্ডার হালায় বহুত বাইড়া গেছে। আউজকাই ডামলালুরে যুদি না কইছি!
নন্দলাল দত্ত লেন ধরে খানিকটা হাঁটতেই পাঁচভাইঘাট লেনের মাথায় ক্যারম বোর্ডের আড্ডা দেখে ঘাড়ের জ্বালাটা জুড়িয়ে গেলো।
খালি ড্রামের ওপর রাখা ক্যারমবোর্ড, বোর্ডে নতুন করে পাউডার ছিটিয়ে গুটি সাজাচ্ছে সালাউদ্দিন। হানিফ পাশে এসে দাঁড়ালে সালাউদ্দিন বলে, ‘তর বাপে মরছে?’
কথা বললে কি হবে, সালাউদ্দিন ওর দিকে একবার তাকায় না পর্যন্ত।
বোর্ড সাজাবার কাজে সে বড়ো ব্যস্ত।
‘কি বে গুটলি, কইলি না?’
হানিফ তার মুখের দিকে তাকালে সালাউদ্দিনের ভ্রূজোড়া দুলে ওঠে, ‘তর বাপে মরছে?’
হাসি হাসি মুখ তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে হানিফ এমনি প্লেন মুখেই বলে, ‘ড্ডাক্তাররে পাই না, ম্মউতরে ক্যামনে ঠ্যাকাই?’
বোর্ড সাজানো হলে প্রথমবার স্ট্রাইক করলো আহসানউল্লা। ওয়েল্ডিং মেশিনে কাজ করে ওর আঙুলগুলো হয়েছে সব ঝলসানো রডের মতো, ঐ দুটো রড দিয়ে পরপর দুটো শাদা গুটি গর্তে ফেলে সে স্ট্রাইকারের পজিশন ঠিক করে। কিন্তু লোকটার মনোযোগ সবদিকেই।
‘মতিন ডাক্তারে দ্যাহে না?’
খুক করে এক টুকরো হেসে সালাউদ্দিন মতিন ডাক্তারকে নস্যাৎ করে দিলো, ‘হেই লাইগাইতো জিগাই। অহনো জিন্দাই রইছে?’
হানিফের ঠোঁট থেকে সিগ্রেট টেনে নিয়ে লম্বা টান দিলে সালাউদ্দিনের গলা দরজা খুলে গেলো, ‘বুঝলি, ঐ হালার মতিন ডাক্তাররে ছাড়ান দে। তর বাপে না কাউলকাও কি যানি দ্যাখছে?’
হানিফ অন্য দিকে তাকিয়ে লালচে হাসে, ‘হ, জিন না পরী দেইখা রাইত ভইরা খালি চিল্লাইছে।’
জিনপরী দেখবার ক্ষমতা ইব্রাহিম ওস্তাগরের কি আজকের? এই মহল্লার এসব জানে না কে? বাপের ওস্তাদীর কথা বলবার জন্য হানিফের জিভ নিসপিস করে, কিন্তু সে খানিকটা তোতলা, একটু দেখে শুনে কথা না বললে তার চলে না; তাই মাটির দিকে তাকিয়ে একটু একটু হাসা ছাড়া বেচারা কি আর করতে পারে?
সিগ্রেট ফেলে দিয়ে সালাউদ্দিন সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে একটা রিকশার ভেতরে মেয়েও দেখে নিলো গোটা দুয়েক; তারপর সরু ও তীব্র ধারায় থুতু ফেললো দাঁতের ফাঁক দিয়ে।
‘মতিন হালার দাওয়াই খাইলে জিনপরীমাহাক্কাল ব্যাকটি হালায় লোর পাইড়া আইবো। ঐ ডাক্তারে আগে আছিলো জিন্দাবাহার, বুঝলি? মহল্লার মইদ্যে কেউগার ঘরে হালারে ডাকতো না।’
‘তুই জানলি ক্যামনে? খালি খালি প্যাচাল পারস!’
‘ঈমানে কই ওস্তাদ! ঈমানে কই!’ আহসানউল্লার কথার জবাব দিতে সালাউদ্দিনের চোখে মুখে সাড়া পড়ে যায়, জিন্দাবাহারের মইদ্যে ঢুইকা চাইরটা পাঁচটা ঘর বাদ দিয়া চিপা গল্লি আছে না একটা?—আছে না? — ঐ গল্লির লগেই ডাক্তারের ডিসপিনচারি, ডিসপিনচারির বগলে আমার মামুগো তেহারির দোকান। কতো গেছি না আমি? বড়ো রাস্তাটা পার হইলেই তো তোমার বাদামতলীর মাগীপট্টি, মতিনে হালায় দাওয়াই দিতো খানকি মাগীগো আর খানকিগো ভাউরা থাকে না? হেইগুলিরে। মাগীপট্টির কেউগার ব্যারাম হইছে তো ডাকো হালায় লম্বুরে, জিন্দাবাহারের মইদ্যে হ্যার নামই আছিলো খানকির ডাক্তার।’ সালাউদ্দিন খুক খুক করে কাশে আর ঘোলাটে দাঁতের ফাঁক দিয়ে চিক চিক থুথু ফেলে।
‘হেই পট্টি না উইঠা গেছে!’
‘হেই লাইগাই তো! — গুটলিচোদারে ক্যামনে কই?’ হানিফের নিরীহ কথায় সালাউদ্দিন চোখ মুখ কোঁচকায়, ‘হেই লাইগাই তো, গুটলিরে ক্যামনে বুঝাই? মোনেম খানে বাদশারে ফিনিস করবো, – বাদশা আছিলো বাদামতলীর বাদশা, শাহানশা। তে বাদশারে খতম করবো, হালার মোনেম খানে তাই মাগীপট্টি উঠাইয়া দিলো। খানকিরা কৈ কৈ গেলো গিয়া, লম্বুরে অহন ক্যাঠায় ডাকে? কেউগায় অরে কইছে, মিয়া, রোকনপুর যাও গিয়া, ডাক্তার উক্তার নাইকা, যাও, জমাইতে পারবা।’
‘কি বে হানিফ, খেলবি?’ সালাউদ্দিনের দীর্ঘ সংলাপ সংক্ষিপ্ত করার জন্য আহসানউল্লা এই প্রস্তাব দিলে হানিফ খুশিও হয়, ফের ভয়ও করে ওর, ওকে কি আর চান্স দেবে? ও ভালো খেলতেও পারে না; তবে সালাউদ্দিন কেটে পড়লে আর কেউ নেই বলে ওকে নিতে পারে। সালাউদ্দিন এখন কোথায় আর যাবে : বাঙলাবাজারের ছেমরিগো ইশকুল অহনতক ছুটি হয় নাই।
আহসানউল্লা ফের বলে, খেলবি তো খাড়াইয়া থাক। ডামলালু আহুক।’ কিন্তু ডামলালুর ঠিকঠাক কোনো সময় নেই; কৈ কৈ ঘুরাঘুরি করে, কারে মারবো, কেউগার পকেট কাটবো, কেউগারে ছপ্পনের ঝিলিক দ্যাহাইয়া মালপানি ব্যাকটি খসাইয়া লইবো, ওস্তাদের হালায় টাইম টুইম কিছু আছে? – আর পয়সা ছাড়া ডামলালু বোর্ডে হাত দেবে না। কিন্তু ক্যারমে পয়সার ব্যাপার থাকলে হানিফের হাত পা বড়ো কাঁপে, স্ট্রাইকার হয় গড়িয়ে পড়ে গর্তে, নইলে একসঙ্গে লং জাম্প হাই জাম্প দিয়ে বোর্ড ও ড্রাম ডিঙিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি করে। সালাউদ্দিন বললো, ‘ডামলালু আর আইছে!’
কথা বলতে বলতে সে চেষ্টা করছিলো রেড ফেলতে, গুটিটা গর্তে পড়লে ডান হাতের তিনটে আঙুলে সশব্দে চুমু খেয়ে হাঁক ছাড়ে, দিছি, হালারে এক্কেরে হান্দাইয়া দিছি।’
আহসানউল্লা একটু ধমক দেয়, ‘ডামলালু আইবো না? কেল্লায়?’
সালাউদ্দিন ফের হাত পা গুছিয়ে নিলো, ‘হায় হায়! তুমি জানো না ওস্তাদ? পুলিসে আউজকা ঐ হালার ঘরে ভি গেছিলো দুই তিনবার। হোনো নাই তুমি?’
‘পুলিসে বিচরায়? কারে? ডামলালুরে?’ হানিফের কণ্ঠে দ্রুতগতি তরঙ্গের আভাস পেয়ে সালাউদ্দিন নাকে ও গলায় অম্লধ্বনি উদগার করলো, ‘সোনার চান্দ, পিতলা ঘুঘু, ডামলালুকা পাট্টিমে তুম ভি ঘুসা? আভি টের্নিং চল রাহা?’
ডামলালুকা পাট্টিমে যানা এতনা আ’সানি নেহি। ডামলালু অতো সহজে কাউকে পাত্তা দেয় না। হানিফ ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে আজ কতোদিন ধরে; পাত্তা কি দেবে, ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত। মাত্র কয়েকদিন আগে ওকে একটা চান্স দিলো ওর সঙ্গে যাওয়ার। এইতো কয়েকদিন আগে। হানিফ বাপের জন্য বাকেরখানি নিয়ে ফিরছিলো কালাচান মিয়ার লঙির সামনে দিয়ে, তো দেখতে পেয়ে ডামলালু বললো, ঘরে রুটি দিয়া এহানে আয়।’
কালাচান মিয়ার লন্ড্রিতে বাকেরখানি রেখে হানিফ এগিয়ে আসে, ‘ককি ওস্তাদ?’
‘আমার লগে যাইবি। রুটি ঘরে রাইখা আয়।’
‘আইয়া দিমু।’
‘দিয়া আয় কইলাম! তর বাপে খাইবো না?’
ডামলালুর কথা অস্বীকার করবে হানিফ? বাবার ঘরে কাগজে জড়ানো বাকেরখানি ক’টা রেখেই চলে আসছে, ঘরে এক মিনিটও ছিল না, এর মধ্যেই বাপ হালায় গোঙাতে শুরু করলো, ‘পানের দোকানটা কইরা দিলাম, দুইটা ঘন্টাও যুদি বইতো! কৈ কৈ যায়, কি করে, হারামজাদারে লইয়া ক্যামনে কি করি!’ রাস্তায় নামতে নামতে শোনা গেলো ভাবীও যোগ দিয়েছে, ‘হ্যায় হইলো আমাগো বাড়ির মেহমানসাব। হ্যায় আইবো খালি খাওনের টাইমে টাইমে!’
তারপর শরীর ভরা ছটফটে সুখ নিয়ে ডামলালুর সঙ্গে সন্ধ্যাবেলার ভিড়ে সদরঘাট থেকে বাসে প্রেসক্লাব, প্রেসক্লাব থেকে হেঁটে হেঁটে রেসকোর্স।
ইঞ্জিনীয়ার্স ইন্সটিট্যুটের সামনে একটি দুটি লোক, একটু দূরে আলো জ্বলছে ঢাকা ক্লাবে। ঝাপশা মাঠের ওপারে দালানের সারি। এপারে রাস্তা। এতোক্ষণ ডামলালু একটি কথাও বলে নি। এখানে এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে খুব গম্ভীর স্বরে বললো, তুই খাড়াইতে পারবি না এহানে? পারবি?’
ঘাড় কাৎ করে হানিফে সায় দিলে ডামলালু বলে, ‘এহানে খাড়াইয়া থাক। পুলিস দ্যাখলে ময়দানের দিকে চাইয়া ‘জুম্মন’ কইরা বহুত জোরসে ডাক পাড়বি, বুঝলি?’
মস্ত বড়ো দুটো গাড়ি মসৃণগতিতে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। গাড়ির ভেতরে শাদা পুরুষ ও রঙিন মেয়েমানুষ। কিন্তু ডামলালুর লক্ষ্য অন্যদিকে। ঢাকা ক্লাবের সামনে দিয়ে একটা রিকশা আসছে। মনে মনে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে ডামলালু বললো, ‘তুই তাইলে খাড়াইয়া থাক। আমি কাম করি।
ডামলালু একটু এগোতেই দ্রুতবেগে একটা জিপ ছুটে আসে ঐদিক থেকেই। শাদা রঙের নতুন মডেলের জিপ। ওদিকে ডামলালু হাঁটছে ধীরে ধীরে, রিকশার কাছাকাছি চলে এসেছে। ডামলালু কি জিপটার দিকে তাকিয়েও দ্যাখেনি একবার? রেসকোর্সের কাঠের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো হানিফ; ডামলালু কি কিছুই বুঝতে পারেনি? জিপ এসে দাঁড়ালো হানিফের উল্টোদিকে, ইঞ্জিনীয়ার্স ইন্সটিট্যুটের বিপরীত ফুটপাথ ঘেঁষে ঝাঁকড়া মাথা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। হানিফের বুক টিপ টিপ করে : পুলিসে আইয়া পড়লো! ডামলালুরে অহন ক্যামনে কই? ওস্তাদরে ক্যামনে ডাকি? পুলিসে আইয়া পড়লো!
গাড়িটার দিকে তাকাতে গেলে চোখজোড়া সেঁধে যায় কোটরে, এর ফলে চোখের মণি নিভে যায় ও মাথার শিরাগুলো দপদপ জ্বলতে শুরু করে : পুলিসরে কইয়া ফালাই, আমি রিকশা হাইজ্যাক করুম, হেই লাইগা এহানে খাড়াইয়া রইছি। আমার নাম আবদুল হানিফ, কলতাবাজারের ইব্রাহিম ওস্তাগর আমার বাপ লাগে, আমারে ধইরা লন, আমি রিকশা হাইজ্যাক করবার লাইগা আইছি, আমারে ধইরা সূত্রাপুর লইয়া চলেন। — শিরাউপশিরাসমূহের এরকম রিমঝিম নাচের পর শিথিল ধড় নিয়ে হানিফ পুলিসের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
পুলিসের বদল গুটি গুটি পায়ে ফিরে আসে ডামলালু, ‘ল, যাই গিয়া।’ অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে হাইকোর্টের সামনে এসে ডামলালু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘চুতমারানি!’
বিগলিত গলায় হানিফ উত্তর দেয়, ‘প্পুলিসে আইয়া পড়লো, নাইলে ঐ রিকশার মইদ্যে ম্যালপানি বহুত মিলতো, না ওস্তাদ?’
ডামলালু অবাক হলো ‘পুলিস পাইলি কৈ?’
‘জ্জিপগাড়ির মইদ্যে পুলিস আছিলো না?’
‘আমার ল্যাওড়া আছিলো! জিপগাড়িটা দেখছিলি ভালো কইরা? দেখছিলি?’
হানিফ একেবারে চুপসে গেলো, ‘পুলিস আছিলো না?’
‘পুলিসের বাপে আছিলো বে তোতলাচোদা! দেখলি না লম্বা চুল, জুলফিআলা মস্তানগুলি হালায় ফাইব ফিফটি ফাইব মারতাছে! ঐগুলি পুলিসের বাপ লাগে, বুঝলি? হালারা ইসটুডেন!’
‘ইসটুডেন? ইইসটুডেনে ককি করবো?’
‘তরে না একখান চটকানা দিয়া কলতাবাজার পাঠাইয়া দেই তো আরাম পাই বুঝলি?’ ডামলালু খুব বিরক্ত হয়েছে, ‘ইসটুডেন হালারা কি করবো তুমি জানো না, না? কেলাব থাইকা, হোটেল থাইকা সায়েবরা বারাইবো মাল টাইনা, অরা হেই গাড়িগুলি ধইরা মালপানি কামায়, মাগীউগি পছন্দ হইলে ময়দানের মইদ্যে লইয়া হেইগুলিরে লাগায়। অহন বুঝলি হালার বাঙ্গুচোদা, বুঝলি? দিন তো অহন হালায় ইসটুডেন গো, হালায় ইসটুডেনের মারে বাপ!’
প্রেসক্লাবের সামনে এসে একটা বাস দেখে ডামলালু বলে, ‘ওঠ, যা গিয়া।’
হানিফ বলে, ‘ত্তুমি?’
‘আবে, তুই যা না বে।’
‘গুটলি, তর ডাক পড়ছে। সালাউদ্দিনের কথায় একটু চমকে উঠে ভাইপোকে আসতে দেখে হানিফ লাজুক লাজুক মুখে ওর গালের রঙ তখন বেশ বেগুনী ও ঠোঁটজোড়া একটু ফাঁক করা – এদিক পানে ওদিক পানে দ্যাখে। কামাল কাছে এসে বলে, ‘চাচা, তোমারে যাইতে কইছে। জলদি চলো, দাদায় না খালি জিনপরী দ্যাখতাছে।’
কামালের সঙ্গে যেতে যেতে হানিফ বলে, ‘তর দাদায় কি করে রে?’
‘দাদা? জিনপরী অহন দাদারে বহুত ডিসটাব করতাছে।‘
হানিফের বেঁটেখাটো পাজোড়া লম্বা লম্বা পদক্ষেপে প্রায় দৌড়ে চলে। কামাল কথা বলে যাচ্ছে অবিরাম, ‘চাচা, দাদায় মনে লয় খুব সোন্দর পরী দেখছে একখান। পরী না খাটের তলায় ঢুইকা পড়ছিলো, পরীগো বড়ি তো বহুত লাইট,’ খাটের তলায় ঢুইকা চুপ মাইরা বইয়া রইছে। দাদায় না বুঝবার পাইরা খালি জাম্প মাইরা উইঠা খাটের তলে বিচরাইয়া বেড়ায়। পরীরে দেইখা দাদায় খুব খুশি, না চাচা?’
হানিফের মাথা পরিষ্কার হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। স্বচ্ছ করোটিতে নতুন ও কোমল একটি হাওয়া খেলে যায় বাবায় বহুত দিন বাদে অগো লগে মিলতাছে।
‘চাচা, আমাগো ইশকুলের ড্রিল স্যারে না আমাগো চানা খাইতে কর। ক্লাস নাইন বি’র সিদ্দিক ভাই চানা খায় তো, বড়ির মধ্যে বহুত পাওয়ার, কারাত মাইরা বেঞ্চির পায়া ভাইঙ্গা ফালাইতে পারে।’
কিন্তু কামালের উৎসাহ হানিফকে ছুঁতেও পারে না। নিজেকে তার খুব ফালতু ঠেকে, তার কপালে কি জিনপরী আছে? অথচ ইব্রাহিম ওস্তাগরের সঙ্গে জিনপরীদের যোগাযোগ কি আজ থেকে? পৈতৃক পেশায় ঢোকার আগে যখন সে তরুণ যুবক, ঘোড়ার গাড়ি চালাতো, জিন পরীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সেই তখন থেকেই। আজ সপ্তাহখানেক হলো ইব্রাহিম ওস্তাগর অসুস্থ। তিনদিন থেকে বেশ বাড়াবাড়ি, গতকাল রাত্রি থেকে খাটের নিচে সে কি সব খুঁজে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যাবেলার বাতাসে বাবার রোগা শরীরটা বেলুনের মতন ওড়ে বাবার সিনার মইদ্যে, দিলটার মইদ্যে আজ বহুত হাওয়া খেলতাছে।
‘চাচা, সোহেলে না হাঁটতে গিয়া খালি পইড়া পইড়া যায়। দাদারে দেইখা ফুফু কানতাছে আর সোহেল খাড়াইতে গিয়া পইড়া গেছে তো, সোহেলে খালি কান্দে। দেওয়ালের লগে, ছাদের লগে জিনপরী দেইখা দাদায় হ্যাগো ধামকি লাগায় আর সোহেলে খালি ডরায়।’
কখনো কখনো ঘরের দেওয়াল কি ছাদের দিকে তাকিয়ে, ইব্রাহিম কার সঙ্গে কি বলে, কাকে ধমক দেয়, মিনতি করে সরে যাওয়ার জন্য। হানিফ তাড়াতাড়ি হাঁটে; ওর পায়ের রক্তে জলতরঙ্গ বাজে : বহুত দিন বাদে বাবায় অগো লগে মিলছে, বাবার না জানি কেমুন সুখ।
‘চাচা, ফুফায় না দাদার ঘর বাইন্দা দিবো। দোয়া পইড়া বাইন্দা দিলে জিনে আসতে পারবো না, না, চাচা?’
‘কি?’ কামালের কথায় হঠাৎ খেয়াল করে হানিফ বলে, ‘ফুফা? তর ফুফায় আইছে? তর ফুফুও ভি আইছে?’
‘আইছে না? এইতো এট্টু পরে ফুফু, ফুফা আর সোহেল আইছে রিকশা কইরা, আমি দরজা খুইলা দিছি তো, ফুফু দাদারে দেইখা খালি কান্দে, ফুফু না সুটকেসের চাবি ফালাইয়া আইছে।’
বড়োবোনের আসার খবর শুনে হানিফের পাজোড়া জমে গেলো। হানিফকে দেখে ফাতেমা নোনতা ও ঈষদুষ্ণ জলে একুল ওকুল প্রবাহিত হবে : ঘরের মেঝে, ছাদ ও দেওয়াল থেকে শূন্যতা ঝরে পড়বে নোনা স্বাদে, হানিফের স্বচ্ছ ও নতুন হাওয়া-লাগা করোটি হয়ে উঠবে ভারি ও গুমোট। শ্বশুরের আসন্ন মৃত্যুর অগ্রিম শোকে কণ্ঠ কানায় কানায় উৎকণ্ঠায় ভরে ফাতেমার স্বামী হবিবর আলী মৃধা — হালায় গেরাইম্যা মোল্লাটা — হানিফের দায়িত্বহীনতাকে ন্যাংটো করে চারকাবে, ‘মিয়া, বাপে দোকান কইরা দিলো, তাও দ্যাখবা না; হান্নানের কারবারের মইদ্যেও হাত লাগাইবা না, তোমারে দিয়া কি হইবো? আর ফাতেমার শৈশব থেকে সঞ্চিত পিতৃস্নেহে সমস্ত বাড়িঘর ভেসে গেলে হানিফ কোথায় ঠাঁই পায়? হানিফের বাঁ পায়ের লাল রক্ত ও ডান পায়ের লাল রক্ত জমে খয়েরি রঙের সুরকি হয়ে করকর আওয়াজ করে।
বড়োভাইকে নিয়ে হানিফের কোনো ঝামেলা নেই। হান্নান, সে এখন নতুন লেদ মেশিন বসাচ্ছে, শান্তিনগর বাজারের সঙ্গেই ঘর ভাড়া নিয়েছে, সেই ব্যাপারে সে বড়ো ব্যস্ত। ২৪ ঘন্টা তার ১ চিন্তা ১ ভাবনা – বিহারী ইসমাইল মোহাম্মদের মেশিনটা কেনার সময় কি করে ২০০০.০০ টাকা ২৫০০.০০ টাকা বাঁচানো যায়। না, হান্নান কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে না। কিন্তু ওর বোন ফাতেমাবিবি, হানিফের শৈশবকালের একমাত্র বন্ধু ফাতেমা, লম্বাটে মুখে তিনটে বসন্তের দাগ, ডানদিকের দাঁত একটা উঁচু; ঠাণ্ডা, নরম, ঘামে ভিজে, রোগা ও কালো ডান হাতে আঁকড়ে ধরা হানিফের বাঁ হাতের তর্জনী – এইতো এইসব রাস্তা, গলির ভেতর দিয়ে ভোরবেলা সোজা চলে গেছে শাহ সাহেব মসজিদের বারান্দায়, সেখানে আসিরুদ্দিন মৌলবির মক্তব। ঘন্টাখানেক আমপারা পড়ে আমড়ার আচার কি কাঠি দিয়ে কয়েতবেল খেতে খেতে ঘরে ফিরেছে। গরম জলের ভাপের আড়ালে সেই লম্বাটে মুখ ঝাপশা ও অস্বস্তিকর ঠেকে।
‘চাচা, আব্বা সোহেলরে ইস্পিরিঙের জাহাজ দিছিলো না ১২ টাকা দিয়া, সোহেল না চাক্কাউক্কা ব্যাকটি ভাইঙ্গা ফালাইছে। আম্মায় কয় কি, কুনো জিনিসের কুনো যন্ত নাই, অগো দিয়া ফায়দা কি? চাচা, আব্বায় কইছে, আল্লায় বাঁচাইলে আমাগো টয়েটা গাড়ি ভি হইবো। মালীবাগের বাড়ি হইয়া গেলে আব্বায় না গাড়ি কিনবো। কিনবো না?’
কামালের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাধ, হানিফের নিজের দুপায়ের শুকিয়ে যাওয়া রক্তবিন্দুসমূহের করকর আওয়াজ ও মাথার গুমোট স্তব্ধতা কানে বাজে এবং চাচা ভাইপোতে ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছে যায়।
ড্রেনের ওপর সিমেন্টের দুটো ঝুলন্ত ধাপে পা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই দ্যাখা গেলো হবিবর আলী মৃধা মগরেবের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসেই ডান হাত দিয়ে তার পিঠের দুর্গম জায়গাসমূহ চুলকাতে চেষ্টা করছে।
‘আরে মিয়া, তোমরা কৈ কৈ থাকো?’ দাড়িতে হাত বুলিয়ে জায়নামাজ তুলে ভাঁজ করতে করতে হবিবর আলী মৃধা হানিফের সঙ্গে ভেতরের ঘরে ঢুকলো। ডানদিকে পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে রয়েছে ইব্রাহিম ওস্তাগর। সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে, না কিসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে? নাকি চোখ বন্ধ করে একেবারে ভেতর পানে চোখ ফেলে শেষবারের মতো তাদের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে নিচ্ছে?
‘দ্যাহো মিয়া, হান্নান মিয়ায় অহন কতো রোজগারপাতি করে, বুইড়া মানুষটার বহুত তকলিপ, ঘরে একটা ফ্যান লাগাইতে পারো না?’
হবিবর আলী মৃধা বয়সে এদের চেয়ে অনেক বড়ো, এ ছাড়া সে একজন মৌলবি, তাই সর্বদা তার মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব।
কামাল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ফুফা, আম্মায় কয়, এই দোজখখানার মইদ্যে ফ্যান লাগাইয়া কি হইবো? মালীবাগে বাড়ি হইলে এক্কেরে ফ্যান উন
মাথার ওপর ধুলো কালি ঝুলে বাড়ানো তার বেয়ে টিমটিমে আলো এসে জ্বলছে ৪০ পাওয়ারের বাল্বে। ইব্রাহিম ওস্তাগর চিৎ হয়ে শুয়ে সেই বাল্বের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে।
বাপের মাথার কাছে মুখ নিয়ে ফাতেমাবিবি বলে, ‘বাবা! কি কও?’ বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে নিয়ে ইব্রাহিম ওস্তাগর তখন বেশ ঝুঁকে পড়ে তক্তপোষের নিচে কি খুঁজতে শুরু করলো।
ফাতেমা বলে, ‘ও বাবা, কি বিচরাও? বাবা! ও বাবা?’
মাথাটা ফের বালিশে ফিরিয়ে এনে ইব্রাহিম মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার দশ বছর আগে মরে যাওয়া বৌকে ধমকায়, ‘হালিমের মাও, অজু না কইরাই এহানে আইছো? তোমারে কতো কই।’
এতোকাল পর মৃত মায়ের প্রতি বাপের সম্বোধন শুনে ফাতেমা ফোঁৎ ফোঁৎ করে কাঁদে।
কাঁদলে ফাতেমাকে আরো খারাপ লাগে। বসন্তের দাগ একটা মিলিয়ে গেছে। আর দুটোর আকার আরো বেড়ে যাওয়ায় অশ্রুবিন্দু জমে সেগুলো বসন্তের জ্যান্ত গুটি হয়ে দৃষ্টিহীন তাকিয়ে থাকে।
ফাতেমার গেঁয়ো গেঁয়ো চেহারা দেখে হানিফের রাগ হয় : মোল্লা হালায় আর কেমুন কইরা রাখবো?
হবিবর আলী মৃধা ইব্রাহিম ওস্তাগরের বাড়িতে থেকে লালবাগ ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতো। পরে ফাতেমার সঙ্গে বিয়ে হলে নিজেদের গ্রামের কাছেই মীরকাদিম জামে মসজিদের ইমামতির চাকরি নিয়ে সে গ্রামে চলে যায়। অনেকক্ষণ দেখবার পরও ইব্রাহিম জামাইকে চিনতে পারে না, খুব ভক্তির সঙ্গে বলে, ‘স্লামালেকুম মৌলী সার। লক্ষ্মীবাজারের গলাকাটায় ঐ ছেমরিটারে বহুত দিগদারি করতাছে। কহন ফালাইয়া দিয়া ছেমরিরে মাইরাই ফালাইবো। আমারে দ্যাখলেই গলাকাটায় হালায় খালি ফাল পাইড়া ওঠে। আউজকার দিনটা বাদ দিয়া কাউলকা আমার মউত, আমারে পেরেশানি কইরা অগো ফায়দাটা কি?’
এক গ্লাস পানি হাতে এসে দাঁড়ালো হান্নানের বৌ। আব্বা, ওষুধ খান, টেবিলে রাখা একটা শিশি থেকে ক্যাপসুল বার করে সুফিয়া ইব্রাহিমের মাথার নিচে হাত রাখলো, ‘আব্বা, এট্টু দেহি!’
ইব্রাহিম মিনতি করে, ‘তোমরা আমারে বহাইয়া দিবার পারো?’
হানিফ ও হবিবর আলী মৃধার মিলিত প্রচেষ্টায় ঘাড়ের নিচে ও পিঠের সঙ্গে তিনটে বালিশ দিয়ে ইব্রাহিমকে বসিয়ে দেওয়া হলো। সে খুব ক্লান্ত এবং তার চোখ দেখে মনে হয় তার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ক্যাপসুল মুখে দেওয়ার আগের মুহূর্তে সে বিকট চিৎকার করে, চুতমারানি, তুই গেলি না? তরে আমি জানে খতম কইরা দেই, র, খাড়া।
সুফিয়া ও ফাতেমা ছিটকে সরে দাঁড়ালো। হবিবর মৃধা বলে, আরে ডরাও ক্যান তোমরা? ডরাও ক্যান? এগুলি ইবলিসের কারসাজি। আল্লার নাম লইলে ইবলিসে তোমাগো ছুইবার পারবো?’
এর সঙ্গে শয়তানের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের খবর জানতে পেরে দুজনে আরো ভয় পায়।
ইব্রাহিম ওস্তাগর ক্লান্ত হাতে একবার ডানদিকে একবার বাঁদিকে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ে। হাত নাড়তে নাড়তেই বিরক্ত ও শ্রান্ত স্বরে সে কাউকে দূরে সরে যেতে আদেশ দেয়, আঃ! যা, যা!’ চোখ বুজে আসে তার, কথা শুনে মনে হয় চাঁদনী রাতে কাউকে ডাকতে ডাকতে সে খুব দূরে মাঠের ওপারে চলে যাচ্ছে। ঘুমে তার চোখের পাতা একেবারে খুঁজে আসে, কোনোবার অল্প খোলে, একেকবার সম্পূর্ণ খুলে সে জগৎ দ্যাখে। ঘুমঘুম, দীর্ঘ ও গম্ভীর কণ্ঠে সে বলে, ‘যাঃ! যা কহলাম!’ কাউকে তাড়াবার জন্যে শূন্যে উড়তে গিয়ে ডান হাতটা তার পড়ে যায় ধপাশ করে।
বাইরের ঘরে কণ্ঠ ও জুতোর শোরগোল তুলে এই ঘরে ঢুকে হবিবর আলী মৃধাকে দেখে হান্নান হাসলো, ‘আরে স্লামালেকুম মৌলী সাব! আইয়া পড়ছেন? অহন আমাগো আর কিয়ের ভাবনা?’ তারপর সে ডাকে তার বৌকে, ‘কামালের মা, কামালের মা! বাবার ঘরটা এট্টু ঠিকঠাক কইরা লওতো। ডাক্তার লইয়া আইছি। ডাক্তার শামসুদ্দোহারে কল দিছি। জলদি করো।’ সে নিজেই বাপের ওষুধপত্র, হাতপাখা, চিলমচি, থার্মোমিটার, টয় গ্লাস, পানির জগ, আধখানা কমলালেবু, বাকেরখানির ভাঙাচোরা টুকরা, কারুকাজ করা শাদা কিস্তিটুপি—এইসব জিনিষপত্রের জায়গা বদলে দিতে দিতে বৌকে ধমকায়, ‘খালি খাড়াইয়া থাকে! হাত লাগাও না! ডাক্তার সাব গাড়ি পার্ক কইরা এই আহে। মেডিকেলের পেরপেচার, বহুত বড়ো ডাক্তার, এই মহল্লার মইদ্যে জিন্দগীতে আইছে? ৪০ টাকা লইবো খালি ভিজিট!’ ৪০ টাকার কথায় কাজ হলো। হানিফের হাত থেকে পড়ে গিয়ে একটা খালি শিশি ৪ কি ৫ টুকরা হয়ে যায়, চিলমচি চলকে নোংরা পানি গড়িয়ে পড়ে সুফিয়ার পা লেগে, একবার পড়তে পড়তে চেয়ারের হাতল ধরে সামল নিলো ফাতেমা।
গম্ভীর ও অসন্তুষ্টমুখে ইব্রাহিমের নাড়ি টেপে ডাক্তার। বুকে স্টেথসকোপ লাগায়, জিভ দ্যাখে ও শেষ পর্যন্ত নিজের নাম ও দুলাইন ডিগ্রী ছাপানো প্যাডে প্রেসক্রিপশন লেখে। এই সময় হান্নান ঘরের প্রত্যেকটি লোক ও মেয়েলোককে নানাপ্রকার ইঙ্গিত করে। যেমন, সে হানিফকে নাক খুঁটতে বারণ করে, হবিবর আলী মৃধাকে ইশারা করে ময়লা ও ছেঁড়া গেঞ্জিটার ওপর জামা চড়াবার জন্য, দরজার ওপার থেকে উঁকি দিতে থাকা বৌকে কাছে আসতে বলে; কিন্তু ওর কোনো নির্দেশ কেউ বুঝতে না পেরে কেবল এদিক ওদিক তাকায়।‘
ডাক্তার উঠতে উঠতে বলে, ‘ঘরটা বড়ো ড্যাম্প।’
‘ইয়েস সার!’ হান্নান সঙ্গে সঙ্গে ওর জিভটাকে ল্যাজের মতো নাড়ে, ‘বহুত পুরানা আমলের ঘরবাড়ি সার। ড্যাম্প স্যর। আনহাইজিনিক সার! রোগ নির্ণয়ের ভঙ্গিতে ডাক্তার নোনা ধরা দেওয়াল দ্যাখে, হুঁ বোঝাই যায়।’ ডাক্তারের মুখ একই রকম অসন্তুষ্ট ও গম্ভীর।
হান্নান ফের বলে, ‘ওল্ড ঢাকা খুব ন্যাস্টি স্যর। আমি স্যর মালীবাগে বাড়ি করতাছি, দোয়া কইরেন স্যর। বাড়ি কমপিলিট হইলেই চইলা যাই সার। ওল্ড ঢাকার যা কন্ডিশন সার!’
ডাক্তার চলে গেলে ঘরের বাইরে গলিতে উপগলিতে লোম ওঠা নেড়ি সন্ধ্যাকাল নর্দমা থেকে উঠে এসে গা ঝড়ে। ঘরের ভেতর ইব্রাহিম ওস্তাগরের শ্যাওলা-পড়া চোখের ছাই রঙ মণিতে লেখা চলে লালকালো ছবি। ঘরে বড়ো গুমোট। গুমোট এতো বেশি যে ছাদের পুরনো কড়িবর্গার টকটক মেঘ যে কোনো সময় ঘাম হয়ে ঝরে পড়তে পারে। তার ২ ছেলে, ২ মেয়ে ও ১ জামাই অপরিচিত অনুভূতি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করে। এদের গলায় খরা, সুতরাং জিভ জলশূন্য। এই কষাটে স্বাদের নীরবতায় ঢিল পড়ে যখন হবিবর আলী মৃধা ভাঙা ভাঙা ও খরাঝলসানো স্বরে বলে ওঠে, ‘আল্লা, আল্লা, তুমি রহমকরনেওয়ালা, আল্লাহু গনি!’ এই ঈশ্বর-সম্বোধন একটি নোতুন পাখা গজানো পিঁপড়ে হয়ে সমস্ত ঘরে পতপত ঘুরে দীর্ঘ উড়াল দেয় বাইরের রোঁয়া-ওঠা সন্ধ্যাবেলার লাল ও ধোঁয়াটে প্রদীপশিখায়। সেই ডানা-ওঠা পিপীলিকা দেখে হবিবর আলী মৃধার রুহ কেঁপে ওঠে, ‘এশার আজান অয় নাই?’
তার এই প্রশ্ন শেষ হতেই ইব্রাহিম ওস্তাগর সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে, ‘অরে লইয়া তুই কৈ যাস? আব্বে খানকির বাচ্চা, কই লস অরে?’ একই সঙ্গে পাড়ার দুটো মসজিদ থেকে আজান শোনা যায়। আজানের ধ্বনি ও ইব্রাহিমের জিন পরীদের প্রতি নিক্ষিপ্ত সংলাপ ঘরের নোঙরা ও স্যাতস্যাতে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে মাথা ঠোকাঠুকি করে ও পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। এদের কোনো কোনো টুকরা ছিটকে পড়ে গলিতেও এবং গলির শেষপ্রান্তে দোলাইখালে ডাইভ দিতে গিয়ে দ্যাখে ঘোলা জলের জায়গায় সেখানে রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
এদিক ইব্রাহিমের তৎপরতা ক্রমে বেড়েই চলে। এক হাতে বিছানার একটি প্রান্ত ধরে তক্তপোষের নিচে সে কি খোঁজে, তখন সমবেত প্রচেষ্টায় সবাই তার হিজিবিজি স্মৃতি-ও-সাধে ভারি মুণ্ডু উত্তোলন করে রেখে দেয় বালিশের ওপর। তার চোখ প্রায় বোঁজাই থাকছে। মাঝে মাঝে চোখ রাঙাবার জন্য সেই চোখজোড়া মেলতে গেলে মরচে পড়া দরজার মতো আধখানা খুলেই সেগুলো থেমে যাচ্ছে। কাউকে তাড়াবে বলে কখনো ডান হাত কখনো বাঁ হাত তুলতে গেলে তার দুটো হাতই দুই টুকরা কাঠ হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। একটানা গোঙানি বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে; মনোযোগ দিয়ে শুনলে বোঝা যায় সে আঃ। অরে ছাইড়া দে না! অরে ছাড় চুতমারানি, তরে আমি দেইখা লমু! ছাড়লি না? খানকির বাচ্চা তর মারে চুদি তর বাপের গলায় বাইন্দা, ছাড়!’—এইসব কথা বলবার চেষ্টা করছে।
এশার নামাজ পড়ে হবিবর আলী মৃধা ফিরে আসে মসজিদ থেকে। সুন্নত, ফরজ, নফল ও বেতের—সর্বমোট ১৫ রাকাত নামাজ পড়ে তার শক্তির অনেকটা ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় হবিবর আলীর গলা থেকে খুব কাঠকাঠ কথা বেরিয়ে আসে ঠা ঠা করে।
‘হানিফ মিয়া, কোরান শরীফ লও তো, রাইতটা তেলোয়াৎ করি।’
হানিফ হান্নানের দিকে ও সুফিয়ার দিকে তাকালো।
‘তাড়াহুড়া কইরা আইছি তো, কেতাব লইয়া আইতে পারি নাই।‘
কিন্তু এদের ঘরে কোরান শরীফ নেই। ঘরে কোরান শরীফ নেই এই লজ্জায় হান্নানের ফর্সা গাল লালচে ও কাচুমাচু হয়। তবে লজ্জা কাটিয়ে ওঠার আগেই সে সপ্রতিভভাবে বলে, ‘হানিফ, আমীর চাচামিয়াগো বাড়ি যা তো এট্টু। চাচামিয়ারে গিয়া বাবার খবরটাও কইবি, কোরান শরীফ ভি লইয়া আইবি।’
‘যাও মিয়া, জলদি যাও। রাইতটা তেলোয়াৎ করলে আব্বার রুহের উপরে আল্লাপাকের রহম হইবো?’
হবিবর আলীর এই শুকনো ও কালো বাক্যে অদৃশ্য আগরবাতি ও লোবানের গন্ধে ঘরবাড়ি ম’ ম’ করে। হানিফ ছিটকে পড়ে বাইরে।
তেরো চোদ্দো দিন আগে গেলো রোজার ঈদ। আজ তা হলে পূর্ণিমা কি তার কাছাকাছি। আকাশে বড়ো সাইজের হলদে চাঁদ। এইসব সরু সরু রাস্তায়, গলি উপগলিতে চাঁদের আলো আড়ষ্ট, এখানে ওখানে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়ায়। লাজুক জ্যোৎস্না কোথাও কোথাও ময়লা রঙে খেলা করে। এই অসূর্যস্পশ্যা, কোমলভাষিনী ও গুণ্ঠণবতী আলোতে কোনো গুমোট নেই, জ্যোৎস্না থেকে হাওয়া বইছে; হাল্কা পায়ে উড়তে উড়তে হানিফ চলেছে ওর পিতৃবন্ধু আমীর আলীর বাড়ি।
বন্ধুর ওপর আমীর আলী বেশ চটা, ‘তর বাপেরে আমি জিন্দেগীতে নমাজটা ধরাইতে পারলাম না। খালি বায়োস্কোপ দেখছে, খালি বায়োস্কোপ দেখছে। ঘোড়ার গাড়ি চালাইতো আর বায়োস্কোপ দেখতো। ওস্তাগরি করলো বহুত দিন, তহনো ভি চানাস পাইলে লায়নের মইদ্যে ফুল সিরিয়াল মারছে।’
আমীর আলী প্রথমে কোরান শরীফ দিতে চায় না, ‘পেশাব কইরা পানি লইবি না, নাপাক থাকস, তগো হাতে আল্লার কালাম দেই ক্যামনে? অনেকক্ষণ বকার পর তার দয়া হলে সে বলে, ‘লইয়া যা, মগর আগে অজু কইরা ল।’
আমীর আলীর বিধবা ভাগ্নী বদনায় পানি এনে দিলে হানিফ বারান্দায় বসে অজু করে আর জলচৌকিতে বসে-থাকা আমীরের দিকে আড়চোখে দ্যাখে, কখন কি ভুল করে ফেলে। অন্ধকার উঠানের গাঢ় কালচে সবুজ পেয়ারাগাছের শিরশির বোলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে আমীর আলী বিড়বিড় করে, বুঝলি, তর বাপেরে টুপি ছাড়া কুনোদিন দেহি নাই, মহল্লার মইদ্যে ওয়াজ কি কাওয়ালি উয়ালি হইছে তো হ্যায় গিয়া খাড়াইছে ব্যাকটির আগে, মৌলবির লগে বেটির শাদি ভি দিলো, মগর—।’ হঠাৎ কথা বন্ধ করে অনেকক্ষণ একনাগাড়ে কেশে নিয়ে জিভ ও ঠোঁটের মিলিত তৎপরতায় করোটিবিদারী ধ্বনি করে সে পোয়াটাক থুথু ফেলে, অন্ধকারে পেয়ারাগাছের খুচরা আঁধারসমূহ তিরতির করে কাঁপে; বড়ো বড়ো কয়েকটা নিশ্বাস নেওয়ার পর সে তার দীর্ঘ বাক্য সম্পূর্ণ করে, মগর ওস্তাগররে নমাজ ধরাইতে পারলাম না।’
হানিফের অজু করা শেষ হলে আমীর আলী ঘরের উঁচু তাক থেকে রেহেলে রাখা কোরান শরীফ খুব সাবধানে পেড়ে এনে ওপরের লাল ও শাদা জুঁইফুল আঁকা ছিটকাপড়ের ঢাকনা ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে আলগাছে সমর্পণ করে হানিফের হাতে।
কাউলকা ফজরের নমাজ পইড়া ইনশাল্লা তগো বাড়ি যামু, ওস্তাগররে কইস।’ ডান হাতে কোরান শরীফ শক্ত করে ধরে হানিফ পাতলা খান লেন থেকে বেরুলো! সে হাঁটছে বেশ ধীরে, হাতে তার আল্লার কালাম পাক, দেখে শুনে পা ফেলা দরকার। নর্থ ব্রুক হল রোডের মোহনায় বড়ো দালানের সারি বাঁকা হয়ে চলে গেছে বাঁদিকে, ডানদিকে ট্রাফিক পুলিস দাড়াবার উঁচু জায়গা। পাশে ভিক্টোরিয়া পার্কের কালচে সবুজ আভা মেশানো ঠাণ্ডা হাওয়া একটা ঝাপটা দিলে হানিফের বুকের খাঁচা দুলে উঠলো। কিন্তু হাতে ওর কোরান শরীফ, কে কি করবে ওর? দুই হাতে কোরান শরীফ আঁকড়ে ধরলো বুকের সঙ্গে, কার ক্ষমতা ওকে স্পর্শ করে? কোরান শরীফ সঙ্গে থাকলে ওদের নাম পর্যন্ত কাছে ঘেঁষতে পারে না : বাবার লগে তো আর আল্লার কেতার আছিলো না।
কিন্তু সবকিছু ভেদ করে হানিফের বুকের ঝোপে ঝাড়ে ইব্রাহিম ওস্তাগরের ডানা ঝাপটানো শোনা যায় : ‘হেইদিন খিজিরে আমাকে কইয়াও ভি গেলো, ‘তাজমহলের মইদ্যে ‘পুকার’ খেলতাছে, ল যাই সেকেন শো মাইরা দেই।’ মগর খিজিরের লগে গেলাম না।’
কতোকাল আগেকার সেই সব শীতগ্রীষ্ম এবং সেইসব রৌদ্র ও রাত্রি ইব্রাহিমের তখন বিয়ে হয়নি, বাপও বেঁচে ছিলো। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে, আড্ডা দিয়ে ও বায়োস্কোপ দেখে ওর দিন কাটে। এতে খিজিরের লগে গেলাম না। ঈদে উদে কি জন্মাষ্টমী মহরমে লায়নের মইদ্যে তহন ফুল সিরিয়াল লাগাইতো, সাড়ে ছয় আনার টিকেট না লইয়া রাইত ভইরা হালার ফাইটিং খেল দ্যাহো।’
লোরি মাস্টারের জামাই ছিলো লায়নের টিকেট মাস্টার। আগের দিন ইব্রাহিমের গাড়ি করে সপরিবারে গিয়েছিলো পরীবাগ পীরসাহেবের বাড়ি। চিরাচরিত প্রথায় নামমাত্র ভাড়া দিয়ে টিকেট মাস্টার কোনোদিকে না তাকিয়ে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো, ‘কাল ফুল সিরিয়ালমে জওয়ানি কি বাস’ আওর তখতে তুফান’ খেলেগা, বহোত তেজী পিকচার হ্যায় মিয়া।’
তো ইব্রাহিম ভাবলো, আসল ছবি শুরু হতে হতে সাড়ে ন’টার আগে নয়, রাত্রি আটটার ট্রেন ধরতে পারলে প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায়। সে তাই গাড়ি নিয়ে গেলো ফুলবাড়িয়া স্টেশন। ‘ধানকুরার বাবুগো বাড়ির সন্তোষ বাবুর সম্বন্ধী না ভায়রা কি লাগে, হ্যায় আইছে কইলকাতা থাইকা বিবি পোলাপান লইয়া, হ্যাগো লইয়া একটা টিরিপ মারলাম বাঙলাবাজার। প্যারীদাস রোডে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ইব্রাহিম চললো কলতাবাজার, গাড়ি ঘোড়া রেখে সোজা হেঁটে চলে যাবে লায়ন সিনেমা। আশেক লেনে পাগলার দোকানে এক প্লেট গেলাসি মেরে দেবে দুটো খাস্তা পরোটার সঙ্গে। তারপর সারারাত নাচে গানে ভরপুর ফাইটিং পিকচার। এইসব কারণে ইব্রাহিমের মেজাজ খুব ভালো। বিকালবেলা ঘরে গিয়ে সে গোসল করেছে একবার, তার রেশ এখনো কাটেনি। তার গায়ের শাদা পাঞ্জাবীর গলার কাছে, বুকে ও দুই হাতায় সরু কাজ করা, তার পরনে চিকন পাড়ওলা সেলাইহীন শাদা লুঙি। গলায় লাল গোলাপ ও সবুজ পাতা আঁকা আতরমাখা রুমাল জড়ানো। এদিকে আবার ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে সন্ধ্যা থেকে, চারদিকে জোৎস্না। ইব্রাহিম খুব মৌজে আছে।
নর্থব্রুক হল রোড দিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে এসে দ্যাখে, চান্দের রোশনী ছাড়ছে, যেমুন হালায় নহরের পানি ছুটাইয়া দিছে, বুঝলি? যেদিকে তাকানো যায়, জ্যোৎস্না, কেবল জ্যোৎস্না। আকাশ, গ্রহ, নক্ষত্র আলো করা জ্যো স্নায় ইব্রাহিম তার টাটকা একজোড়া চোখে কেবল লাল নীল হলুদ সবুজ গোলাপী ও অপরিচিত বিচিত্র সব নতুন রঙের আলোর স্রোত এবং আলোর ঢেউ দেখতে লাগলো। এতো আলোয় রাস্তাঘাট বাড়িঘর সব একাকার, গাড়ি নিয়ে সে কোনদিকে যায়? রাস্তা ঠাহর করা যায় না, সে গাড়ি চালাবে কোনদিকে? ‘গাড়ি লইয়া কি করি, কি করি, ঘোড়ার রাশটি ধইরা রাখছি এক হাতে, আরেক হাতে রইছে চাবুকখান, গাড়ি লইয়া খালি ঘুরতাছি, ময়দানটারে চক্কর দিয়া খালি হালায় ঘুইরা মরি, মগর চুতমারানি রাস্তারে বিচরাইয়া পাই না। ভিক্টোরিয়া পার্ককে কেন্দ্র করে এরকম কয়েকবার ঘোরবার পর ইব্রাহিম দেখলো, পার্কের রেলিঙ ঘেঁষে একটি যুবতী গাড়ি থামাবার জন্য হাত তুলে তাকে ইশারা করছে। যুবতী ‘বহুত খাবসুরাত’ এবং মৃদু বাতাসে তার খোলা চুলে জ্যোৎস্না লুকোচুরি খেলে। খানদানি ঘরের সুন্দরী মেয়ে এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে, গাড়ি থামাবে বলে ইব্রাহিম রাশ টানলো। ঘোড়া দুটো রাশ মানতে চায় না। ইব্রাহিম খুব জোরে রাশ টেনে ধরলে সামনের পাগুলো শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে জ্যোৎস্নাবিদারী হেমাধ্বনিতে তারা কেবল না না করে।
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘোড়া দুটো থামিয়ে ইব্রাহিম গাড়ি থেকে নিচে নেমে এলো। পার্কের এপারে রেলিঙ ঘেঁষে যুবতী দাঁড়িয়ে রয়েছে। খোয়াবিছানো রাস্তায় মাঝে মাঝে ঘাসের চাপড়া। সবুজ ও হলুদ ঘাস এবং খয়েরি রঙের খোয়ার ওপর আলগোছে পেতে রাখা সুন্দরীর খালি পাজোড়া ফর্সা এবং নীলচে লাল। চামড়া কি পাতলা! নীল আলোর নিচে, স্বচ্ছ ও পাতলা চামড়ার নিচে নীলচে লাল রঙের স্রোত দ্যাখা যায়।
‘কেমুন লাগে, বুঝলি, মনে লয় চান্দের রোশনি হালায় পায়ের মইদ্যে না হান্দাইয়া পইড়া অহন আর বারাইবার পারতাছে না।’
ঘোড়া দুটো ছটফট করে। ইব্রাহিম গাড়ির দরজা খুলে দিলো, শাহজাদী তশরিফ নিক। কিন্তু সুন্দরী ইশারা করে, তুমি তোমার হাতের চাবুক ফেলে দাও, তোমার হাতে চাবুক, আমি কি করে তোমার গাড়িতে উঠি? ইব্রাহিম তখন বুঝতে পারে নি, কিন্তু ‘বহুত দিন বাদে আমীরে কইছে, চাবুকের লগে লোহা আছিলো তো, হেইগুলি আবার লোহালুহা কি আগুনের চোট সইজ্য করবার পারে না।’ চাবুক রেখে দেবে বলে সে ফের গাড়ির ছাদে উঠেছে, ঘোড়াও অমনি ছুটতে শুরু করলো। রাশ টানতে টানতে সে একবার পেছনে তাকায়। এক পলকে সব অন্ধকার হয়ে গেছে। সব অন্ধকার। অন্ধকারে অস্পষ্ট দ্যাখা যায়, শাহজাদীকে পাঁজাকোলা করে তুলে পার্কের ভেতরে একটি পামগাছের ঝাঁকড়া মাথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর ইব্রাহিমের আর কিছু জানা নেই। পার্কের কোণে পানির ট্যাঙ্কের দারোয়ান দেখতে পেয়ে ঘোড়া সামলে ওকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে।
এরপর প্রায় বছর দুয়েক বাড়ির লোকজন ওকে চোখে চোখে রাখতো। এই সময়টায় সে খুব রোগা হয়ে গিয়েছিলো, মাথার চুল সব সময় খাড়া হয়ে থাকতো, মুখ দিয়ে লালাও পড়তো মাঝে মাঝে, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ বোধ ছিলো না তার এবং সকাল দুপুর বিকাল ও রাত্রির পার্থক্য বুঝতো না। মীরপুর মাজারের পানিপড়া নিয়ে এসেছিলো আমীর আলী। কিন্তু আমীর আলীও খুব আশা দিতে পারে নি, ‘পুরা ভালো হ্যায় জিন্দেগীতেও হইতে পারবো না। ক্যামনে হয়? মাহাক্কালে আসর করছে অরে; না মিয়া, শাহ সাবের হেড খাদেমে নিজের জবানে আমারে কইলো, অরে জিনে ধরে নাই; জিনে তো খোদার ইমানদার বান্দা, মাহাক্কাল হালায় ইবলিসের গোলাম। তোমাগো মহল্লার গলাকাটা সৈয়দে তো মাহাক্কাল হইছে। মাহাক্কালে কেউরে ধরলে ছাড়ে?’
তো একটু সেরে ওঠার পর ইব্রাহিম ওর রাজমিস্ত্রী বাপের সঙ্গে যোগানদার হয়ে রইলো কিছুদিন, বাপ মারা গেলে পুরো ওস্তাগর। সেইসব দিনে ওয়ারি, টিকাটুলি, সেগুনবাগিচা, পুরনো পল্টনে নুতন নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে, রোজগারের অভাব হয়নি। কেবল বাঁশের মইতে কাজ করতে করতে নিচে তাকালে কখনো কখনো সেই কবন্ধকে দ্যাখা যেতো, দুলতে দুলতে কোথায় চলে যাচ্ছে। একদিন, লারমিনি স্ট্রিটে অতুল গুহ জজসাহেবের বাড়ির দেওয়ালে প্লাস্টার লাগাচ্ছে, মাথার ওপর জ্যৈষ্ঠ মাসের রোদ জ্বলছে দাউদাউ করে, চোখের সামনে কেবল বিন্দু বিন্দু রোদের ফুলকি।
‘ঠাঠা রইদ তামানটা আসমান জুইড়া খালি ঝিলিক মারে আর নিচের দিকে চাইয়া দেহি কি গলাকাটায় হালায় ছেমরিটারে লইয়া কই পলাইয়া যায়।’ ইব্রাহিমের বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে, হালার নাক নাই চোখ নাই, মাথামুথা খোমাউমা কিছু নাইকা, চুতমারানি হালায় ছেমরিটারে কই ফালাইয়া দিবো! ফাল দিলাম এক্কেরে দোতালার কার্নিশের লগের চঙ থাইকা, খানকির পুতে কই মিলাইয়া গেলো বুঝবার ভি পারলাম না।’ নিচে স্তূপাকৃতি বালির ওপর পড়ায় সে যাত্রা কেবল ডান হাতের ওপর দিয়েই গেলো। ইব্রাহিমের এই মস্তানি করা নিয়ে খিজির মিস্ত্রী ঠাট্টা করতো, ‘বুঝছি! তোমার হালায় বাহাদুর হইবার হাউস হইছিলো। তোমার পেয়ারের ছেমরিরে লইয়া দুষমুনে পলাইয়া যায় আর তুমি হালায় ফাল দিয়া পইড়া হ্যারে ক্যাপচার করবা, না? পঙ্খীরাজ ভি রাইখা দিছিলা একটা, না? রাখছিলা?’
এখনো চাঁদনী রাত হলেই একজোড়া পায়ের পাতায় বন্দী জ্যোৎস্না দ্যাখার লোভে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে সে ভিক্টোরিয়া পার্কে চলে আসে।
তবে সেই পামগাছগুলোই কি আর এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। লোহার রেলিঙের জায়গায় এখন ছোটো দেওয়াল, কংক্রিটের ফুটপাথ। আর বুকের সঙ্গে তার সাপটে ধরা কোরান শরীফ। তার আবার ভয় কি? কিন্তু : তামান আসমানটা জুইড়া চান্দে হালায় ডিউটি দিবার লাগছে ঠিকই। খিজির মিস্ত্রী বলে, ‘আমাগো বাপদাদায় আমাগো বহুত কইছে, রাইত হইলে ঐ ময়দানের বগলেও ভি যাইবি না। আন্টাঘরের ময়দানের মইদ্যে— অহন ভিক্টোরিয়া পার্ক কয় না? হেই ময়দানের মইদ্যে গাছগুলির লগে লটকাইয়া ফাঁসি দিছিলো সিপাইগো। চান্দের রোশনী ছাড়লেই সিপাইগুলি মাথার লগে লাল নীল লাইট না ফিট কইরা মহল্লা জুইড়া খালি নাইচা বেড়ায়। ওর বাপের সঙ্গে ওদের দ্যাখ্যা হয়েছিলো তো এখানেই! এখানে : সিপাইগো বৌ-ঝিয়েরা লক্ষ্মৌ, দিল্লী, লাহোর, আগ্রা উগ্রা থাইকা আইয়া অহনো ভি সিপাইগো বিচরাইয়া বেড়ায়। আউজকা ঘরের মইদ্যে শাহজাদীরে দেইখা, দুষমুন কবন্ধটারে দেইখা বাবায় মনে লয় উন্নিশ বচ্ছরের জোয়ান মরদাটা না হইয়া এক্কেরে সিধা খাড়াইয়া পড়বো।
উনিশ বছর বয়সের ইব্রাহিমকে মনে পড়ে যাওয়ায় হানিফের চোখ, মুখ, গাল, কান, নাক, কপাল, এমন কি করোটি ও চুলেও ঝিরঝির হাওয়া বইতে শুরু করে। এই ধরনের স্পর্শের সঙ্গে সে কি পরিচিত? বর্ষাকালে থৈ থৈ জলভরা দোলাই খালে ডুবতে ডুবতে হঠাৎ জেগে উঠে নিশ্বাস নেওয়ার স্মৃতিতে হানিফের নাকমুখ শিরশির করে ওঠে। গ্যান্ডারিয়া লোহার পুলের রেলিঙ থেকে ডাইভ দিয়ে কতোবার সে স্পর্শ করেছে জলের তল ভেসে ওঠবার পরও জলের ভেতরকার শাঁসের বায়ুহীন, আলোহীন আচ্ছন্নতা কিছুতেই ছাড়তে চায়না ওকে, নাকের ডগাটা তখন জ্বলে; অপরিচিত মিষ্টি কষাটে স্বাদে মুখের ভেতরে টাকরায় ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে, মনে হয় পিপারমেন্ট দেওয়া লজেন্স চুষেছে অনেকক্ষণ ধরে। কানের পেছনদিকে ঠাণ্ডা হাওয়া ধাক্কা দিলে ওপরে তাকিয়ে দ্যাখে লোহার পুলের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ঝরঝরে বাস; পেছনে ঘোড়ার গাড়ির ছাদে চাবুক রাখতে উঠে বসছে ইব্রাহিম। শাহজাদীকে রেলিঙের পাশে ফেলে রেখে ঘোড়াদুটো ছুটতে শুরু করলো, ইব্রাহিম পেছনে তাকাচ্ছে, ঘোড়ার গাড়ি গড়িয়ে চলে যাচ্ছে কেশব ব্যানার্জী রোডের দিকে। কিন্তু লোহার পুলের রেলিঙ ধরে খালের জলে ছায়া ও আগুন ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে শাহজাদী। কবন্ধ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলতে গেলে তার হাত ছুটে রেলিঙ গড়িয়ে শাহজাদী পড়ে গেলো দোলাই খালের ঘোলা জলে। সেখানে হানিফ ও হানিফের সমবয়স্ক ইব্রাহিম দিনমান শুধু সাঁতার কাটে। ডানদিকে বাঁদিকে সটকে পড়বার মতো কোনো গলি নেই, এই খালের কোনো শাখা খাল নেই। সুতরাং ঠাসবুনুনী করোটি নিয়ে প্রায় নাচতে নাচতে হানিফ পৌঁছে যায় নবদ্বীপ বসাক লেনে।
পাঁচভাই ঘাট লেনে ঢোকবার মুখে শ্যাওলা পড়া দীর্ঘ দেওয়াল পেরোবার সময় ওর গা ছমছম করবার কথা, কিন্তু এখন পা তার মাটি ছোঁয় না, ভয় আসবে কোত্থেকে? বুকের সঙ্গে কোরান শরীফ আঁকড়ে ধরে অবশেষে সে তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তো সঙ্গে সঙ্গে মিলিত মনুষ্যকণ্ঠের চিৎকারে ওর জমাট বাঁধা করোটিতে একটি বিষ্ফোরণ ঘটলো। হৃদপিণ্ড ছিটকে পড়লো এদিক ওদিক এবং সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে গিয়ে হানিফ তার বেঁটে শরীর থেকে প্রায় বেরিয়ে পড়লো।
‘বাবা গো!’ ফাতেমা হামলায়, ‘ও বাবা! কথা কইবা না? আর কথা কইবা না বাবা? ও বাবা গো! হালিম চিৎকার করে, ‘বাবা!’
সুফিয়ার বাক্যহীন রোদন হবিবর আলী মৃধার ভিজে আয়েত-পাঠের সঙ্গে মিশে গিয়ে চপচপ করে। মহল্লার আরো লোকজন এসে পড়েছে। সকলের মিশে গিয়ে চপচপ করে। মহল্লার আরো সম্মিলিত শোকধ্বনি পুলিস সার্জেন্টের পা হয়ে সলিড একটা লাথি মারলো হানিফের পাছায়; সুতরাং আবদুল হানিফ ছুটতে শুরু করলো উল্টোদিকে। এই এক মুহূর্তেই হানিফের সমস্ত শরীরের রক্ত, মাংস এবং করোটির বিন্যাস বড়ো এলোমেলো হয়ে গেলো। সদ্য বিদ্যুৎমুক্ত শিথিল ও অবসন্ন আঙুলের ফাঁক দিয়ে কোরান শরীফ গড়িয়ে পড়লে তার মজ্জাহীন শুকনো হাড়গোড়ে ফাতেমার হাহাকার খটাখট প্রতিধ্বনি তোলে, শূন্য হাতে বিলাপমুখরিত বাতাস কেটে কেটে হানিফ বয়ে চলে সামনের দিকে।
সামনে কি? নবদ্বীপ বসাক লেনের মাথায় এসে দাঁড়ালে চারদিক বড়ো স্পষ্ট হয়ে উদয় হলো। সামনে : ‘বঙ্গলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার / এখানে খাঁটি দুধের ছানায় প্রস্তুত রসগোল্লা, অমৃতি, পাণ্ডুয়া, সন্দেশ প্রভৃতি মিষ্টান্ন পাওয়া যায় / পরীক্ষা প্রার্থনীয়/১১/বি/৩ সুভাষ বোস এভেনিউ/লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা ১।’ সাইনবোর্ডের ২ প্রান্তে ২ জন পরী মিষ্টান্নের থালা হাতে মুখোমুখি ওড়ে। ‘সোনার বাংলা হার্ডওয়্যার সাপ্লাই’য়ের ‘সোনার বাং’ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু ‘লা হার্ডওয়্যার সাপ্লাই’ দুমড়ে বেঁকে গিয়ে ঝুলে রয়েছে একদিকে। তারপর ‘দি সানশাইন লণ্ড্রী/ওয়ান ডে সার্ভিস/অটোমেটিক মেশিনে উত্তমরূপে কাপড় ধোলাই করা হয়। প্রোঃ মোছাঃ ছুপিয়া খাতুন/লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা ১/বাংলাদেশ। এই লণ্ড্রীর ভেতরে এখনো আলো জ্বলছে। মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের ভেতর প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে ৪/৫টা কাঠচাঁপা গাছ। উল্টোদিকে সেন্ট গ্রেগরিস স্কুল; সেন্ট ফ্রান্সিসের কাছে ল্যাম্পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ১টা মেয়ে কুকুর এদিক ওদিক দেখছে। আরো একটু এগিয়ে গেলে ভিক্টোরিয়া পার্কের পেছনে বালির স্তূপ। গোটা পার্ক ঘিরে রাত্রি কাটায় সারি সারি অতিকায় ট্রাক। পার্কের পেছনদিকের ফুটপাথে মানুষ, মেয়েমানুষ, কুকুর ও মেয়েকুকুরের অহিংস সহ-অবস্থান। তাদের মলমূত্রের মিলিত ঘ্রাণ লক্ষ্মীবাজারের খানিকটা, একদিকে কলতাবাজার ও অন্যদিকে নর্থব্রুক হল রোডের ১টা অংশকে গেঁথে রেখেছে একসূত্রে।
কান পাতলেই ফাতেমা ও হালিমের বিলাপের ধ্বনি কানের পর্দায় টং করে প্রতিধ্বনি তুললে মনে হয় সেখানে মহরমের ঢাক পেটানো ছলছে। হানিফ তখন সুভাষ বোস এ্যাভেন্যু অতিক্রম করে ঢুকে পড়লো শ্যামাচরণ রায়চৌধুরী লেনে। এই রাস্তার শুরুতেই ১টা পানের দোকান। মাথায় ডব্লু. ডি. এ্যাণ্ড এইচ. 3. উইলস কোম্পানীর দেওয়া সাইনবোর্ডে স্টার সিগ্রেটের সবুজ বিজ্ঞাপন। হানিফ একটু দাঁড়িয়ে সেই সাইনবোর্ড পড়তে শুরু করলে ১২/১৩ বছরের ১টি বালক তার কাছে এসে সুর করে বললো, ‘মালিশ!’ হানিফের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ফের বলে, ‘মালিশ লাগবো?’ জবাব না পেয়ে ছেলেটি অন্যদিকে চলে যায়।
এই রাস্তাকে চওড়াই বলা চলে। রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলে ডানদিকে কে. জি. গুপ্ত লেন, বাঁদিকে পাতলা খান লেন। সোজা চলে যাওয়াই বরং ভালো। সোজা গিয়ে এই রাস্তারই নাম হয়েছে ঈশ্বরদাস লেন। ‘বাণী ভবনে’র সামনে ১টা বয়স্ক কুকুর তার পদশব্দে চোখ মেলে তাকিয়ে ৪ বার ঘেউ ঘেউ করে ফের শুয়ে পড়লো। কুকুর শুয়ে পড়লে ভাইবোনের মিলিত বিলাপ ফের তাকে তাড়া করে। দ্রুত প্রবাহিত হয়ে গিয়ে সে গড়িয়ে পড়ে গলির মোহনায়। ‘মোছলমানির জন্য আমাকে শরণ করুন/মোঃ এবাদুল্লাহ/৬৯/২/বি নং আলী হোসেন লেন, লালবাগ, ঢাকা বাংলাদেশ (হেনা মেডিকেলের পশ্চিমের গলি)।’ দেওয়ালে গাঁথা টিনের ওপর লেখা এই বিজ্ঞাপনের পাশে সিনেমার পোস্টারে হাসছে রাজ্জাক ও কবরী। এই রাস্তা বড়ো আলোকিত এবং খোলামেলা। এমন কি অনেক ল্যাম্পোস্টেও আলো জ্বলছে। মৃত বাপকে জাগিয়ে তোলার জন্য ফাতেমার হামলানো এখানেও ঠিক পৌঁছে যেতে পারে। সুতরাং হানিফ বাধ্য হয়ে রূপচাঁদ লেন ধরলো। বেশ সরু গলি। এখানে এসে বুকে বল পাওয়া যায় : পাইছি। চিপাগল্লি পাইছি একখান!
কিছুক্ষণ পর ২দিকে ২টো গলি ছড়িয়ে দিয়ে ফুরিয়ে গেলো রূপচাঁদ লেন। এই রূপচাঁদ লেন, শুকলাল দাস লেন ও রূপলাল দাস লেনের সঙ্গমে টিনের ড্রামের ডাস্টবিনে মুখ থুবড়ে আটকে রয়েছে ১টি ধূসর কুকুর। কুকুর মৃত এবং বয়সে নবীন। তার সামনের পাজোড়া আটকনো ডাস্টবিনের মাথায়। হঠাৎ মনে হয়, সামনের ২ পায়ে ডাস্টবিনের দেওয়াল ধরে চাঁদ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে সে মুখ থুবড়ে মরে গেছে। শুকলাল দাস লেনের বাড়িগুলোর শুরু সরাসরি রাস্তা থেকে। কোথাও কোথাও ২ দিকেই খুব উঁচু বাড়ি। এতো চাপা গলি, এপার ওপারের বাড়িগুলো একটু করে এগিয়ে এলেই তাদের সংঘর্ষের ফলে পথচারীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। প্রত্যেকটি বাড়িই স্যাঁতস্যাঁতে, দেওয়ালের রঙ কালচে সবুজ, কোথাও কোথাও ঘন সবুজ রঙের পুরু কম্বল। কোনো কোনো বাড়ির নিচে কাশ থুতু ছিটানো নোঙরা বারান্দা। সমস্ত রাস্তা জুড়ে মাছের আঁশটে ও ভোঁতা গন্ধ। এর সঙ্গে রাস্তার ২ পাশের কালচে সবুজ ও হলদে রঙ শাসিত নালা থেকে উঠে আসা মলমূত্রের তীব্র গন্ধ উড়ে এলে নাকের একঘেঁয়েমি কাটে। ২ দিকে দোতলা তিনতলা থেকে ফেলে দেওয়া আবর্জনায় ছোটো ছোটো খোলা ডাস্টবিন তৈরি হয়েছে। ১টি কালো বিড়াল হেঁটে গেলো ঘুমের মধ্যে, এক ডাস্টবিন থেকে আরেক ডাস্টবিন করতে করতে এর রাত্রি কাটে। কালো বিড়াল দেখে হানিফের গা ছমছম করে উঠলে ওর বাবার গলার ঘর্ঘর আওয়াজ শোনা যায়। সুতরাং ডানদিকে বাঁদিকে ১টা উপগলি শাখাগুলি পেলেও চোরের মতো মাথা নিচু করে সে ঢুকে পড়ছে সেখানে। দেবেন্দ্র দাস লেনে চলতেই পায়ের নিচে নরম কি ঠেকলে সে তাকিয়ে দ্যাখে ছেঁড়া বালিশ ফেটে তুলো বেরিয়ে পড়ছে চারদিকে একটু এগিয়ে গেলে রাস্তা ১ জায়গায় বেশ চওড়া হয়ে গিয়েছে। আরো ২টো গলি এসে মিশেছে এখানে। এই চওড়া তেমাথায় এককালে জমাট আড্ডা ছিলে ডামলালুদের। সেই সময়ের কথা ভালো করে মনে পড়বার আগেই উল্টো দিকের বাড়ির দোতলায় খ্যাক করে উঠলো আলো, জানালায় দাঁড়িয়ে কেউ থুতু ফেললো। হঠাৎ করে বাঙলা মদের কড়া গন্ধ নাকের ভেতরে সুড়সুড়ি দিলে ইব্রাহিম ওস্তাগর হানিফের করোটি জুড়ে একটার পর একটা ইট গাঁথতে শুরু করে। হানিফের বেঁটে শরীরে বাঁশের মই জুড়ে দিয়ে ইব্রাহিম ওস্তাগর উঠে যাচ্ছে তার মাথায়। এই মই ঝেড়ে ফেলবার জন্য শরীরে ঝাপ্টা দিয়ে হানিফ জোড়ে জোরে পা ফেলে। পা ফেলতে ফেলতে একটু কান পাতলে শোনা যায়, ঝাপশা স্বরের হামলানো পাঁচভাইঘাট লেনের অত জীর্ণ কোনো উপগলি থেকে বেরিয়ে তার মাথায় ভেতরে স্থায়ী পত্তনি নেওয়ার লোভে আছড়ে পড়ছে তার দুই কানে।
কিন্তু হানিফও চাল্লি কম নয়। একটু বাঁদিক ঘেঁষে জল উপচে পড়া খোলা ম্যানহোল লাফিয়ে পার হয়ে সে দিব্যি পৌঁছে গেলো ফরাশগঞ্জ লেনে। পানির কলের সামনে রেখে দেওয়া কয়েকটি কলসি লাইনে বসে মুখে কালো করে পানির অপেক্ষা করে। পচা ডিমের গন্ধে ৬টা কি ৭টা পদক্ষেপ শেষ হতে না হতেই গলি ফুরিয়ে গেলো। এখন মদন সাহা লেন। হাতের বাঁদিকে মস্ত বড়ো পুরনো বাড়ি। গভীর রাতে সেই বাড়ির নিশ্বাস প্রশ্বাস এবং ক্লান্ত ১টি রিকশা চলে যাওয়ার সাৎ সাৎ আওয়াজে ফাতেমার বিলাপ জলদে পৌঁছে গেলে হানিফ ছোট্ট ১টি লং জাম্পে আরেকটি খোলা ম্যানহোল ক্রস করলো। বেঁটে পা ২টোকে বেবীট্যাক্সির চাকার মতো গড়িয়ে আর ১ মিনিটে গলির শেষ মাথায় পৌঁছে সে দেখলো, এপারটাকে খালের ওপারে গড়িয়ে দেওয়ার জন্য লোহার পুল উঠে গেছে ‘আখেরি চাট্টান’ ছবিতে দ্যাখা ঝাপশী পাহাড়ের মতো। ছবিতে দ্যাখা ঝাপশা পাহাড়ের মতো। এই সেতুর উপত্যকায় শক্ত সমর্থ ও নিশ্চিন্ত শরীর নিয়ে প্রতীক্ষা করে লাল রঙের সূত্রাপুর থানা। খাল থেকে বয়ে আসা শেষ অক্টোবরের মধ্যরাত্রির হিমহিম বাতাস ওর কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে সমস্ত শরীর জুড়ে তীব্র শীষ বাজায় : আমি যুদি অহন থানার মদ্যে গিয়া দারোগারে ডাইকা কই, ‘স্যার, আমার নাম আবদুল হানিফ, আমার বাপের নাম ইব্রাহিম, মরহুম মোহাম্মদ ইব্রাহিম ওস্তাগর, কলতাবাজারের ডামলালু আমার ওস্তাদ লাগে, আমি ডামলালুর পাট্টির মানু,’ তো হালার খানকির পোলায় আমারে ধইরা রাইখা দিবো না? রাখবো তো?